সাঁঝক বাতি,১২,১৩

0
550

সাঁঝক বাতি,১২,১৩
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১২]

ঢাকায় দশতলা বিশিষ্ট রয়েল হসপিটাল। বেশ উন্নত। চিকিৎসার মানও বেশ ভালো। বিলাশ বহুল হসপিটালটা অসহায় এবং গরীবদের জন্য নয়। কারণ তারা খরচ বহন করতে অক্ষম। এই
হসপিটালের মালিক সাজ্জাদ হোসাইন শখ করে তৈরী করেছিলেন।অসহায়দের মানুষের চিকিৎসা প্রদানের জন্য। উনি ছিলেন নিঃসন্তান। অঢেল সম্পত্তির মালিকও। দেশের সব সম্পত্তি ভাইয়ের ছেলেদের দিয়ে প্যারাগুয়েতে চলে গিয়েছিলেন।
আর এই হসপিটালের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, বন্ধু
সুমন শেখকে। বাল্যকালের বিশ্বস্ত বন্ধু। সুমনের দুই ছেলে প্রশান্ত ও দিগন্ত। সুমনের বড় ব্যবসাও আছে। প্রশান্ত পড়াশোনা শেষ করে বসেই ছিল।
তার ভাবনা, কিছুদিন পর বাবার সঙ্গে ব্যবসাতে যোগ দিবে। ততদিনে একটু নিজেকে সময় দিবে।
ব্যবসাতে ঢুকে গেলে দিন দিন ব্যস্ততাও বাড়বে।
তখন চাইলেও আর এই সময়টা ফিরে পাবে না।

কিন্তু সাজ্জাদ প্রশান্তকে খুবই পছন্দ করেছিলেন। ওর মতো দায়িত্ববান ছেলেকে উনি খুঁজছিলেন।
প্রশান্তর সঙ্গে কথা বলে, উনি হসপিটালের সব দায়িত্ব প্রশান্তকে দিলেন। দিন যায়, মাসও যায়।
সময় পেরিয়ে দিনও কাটতে থাকে। দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রশান্তেরও ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। সে তার দায়িত্বে অটল। সেবার মান ভালো হওয়াতে ওর হসপিটালের নামও চারদিকে দ্রুত ছড়াতে থাকে। দিনকে-দিন হসপিটালটা উন্নত করার প্রচেষ্টাও চালাতে থাকে। তিনতলা হসপিটালে পেশেন্টের সুবিধায় আরো বড় করতে থাকে। ধীরে ধীরে তা দশ তলাতে ঠেকে। এর বছর চারেক পর সাজ্জাদ হোসাইন দেশে ফিরে এলেন। এবং হসপিটালটা উনার বোনের মেয়ের নামে করে দিতে চাইলেন।
তাহলে প্রশান্তও মুক্তি পাবে। কতদিনই বা ওকে
ধরে রাখবেন। ওর অন্যকিছু করার ইচ্ছে থাকতে পারে।

কিন্তু ততদিনে হসপিটালের উপরে প্রশান্তের মায়া জন্মে গেছে। এতদিনের পরিশ্রম। চার বছরে কম পরিশ্রম করে নি। নিজের ভেবেই হসপিটালটাকে এত বড় করেছে। প্রশান্তকে ভেঙে পড়তে দেখে, প্রশান্তর বাবা বন্ধু সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে কথা বললেন। এবং জানালেন হসপিটাল উনি কিনে নিবেন। কিন্তু সাজ্জাদ হোসেন তা মানলেন না। উনার বোনের একমাত্র মেয়ে শিফা। আর উনি শিফাকে খুব ভালোবাসেন। এই হসপিটাল উনি শিফাকে জন্মদিনে উপহার হিসেবে দিবেন। এটা উনি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন। উনাদের
বংশে শিফা বাদে কোনো মেয়ে নেই। এজন্য এত আদরের! নিঃসন্তান সাজ্জাদকে শিফা বাবা বলে ডাকত। শিফার মুখে প্রথম বাবা ডাক শুনে উনি কলিজা ঠান্ডা করেছিলেন। অনুভব করেছিলেন
এই ডাকের মায়া।তাই বন্ধুর কথা রাখতে পারেন নি। তাই বুঝিয়েও বলেছিলেন,

-‘সুমন, আমি সত্যিই দুঃখিত রে ভাই। শিফাকে
আমি খুব ভালোবাসি। ওটা আমার আরেকটা মা। আর শিফা মায়ের জন্য আমি হসপিটালটা রেখেছিলাম। কষ্ট নিস না বন্ধু।’

সুমন শেখ কষ্ট পেলেও জবাবে কিছু বলেন নি। ব্যাপারটা বুঝে চলেও এসেছিলেন। না পেলে কি আর করার। চেষ্টা তো করেছিলেন।এর কিছুদিন পর, সাজ্জাদ হোসাইন নিঁখোজ হলেন। কোথাও উনার খোঁজ মিলল না। এমনকি এখনো উনার লাশও না। তখন শিফা ভেঙে পড়েছিল। পরে,
পরিবারের সাপোর্টে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। সাজ্জাদ হোসাইন ছিলেন শিফার বন্ধু। তারপর মামা। সব আবদার উনার কাছেই। এমনকি, সে মামার কাছে জেদ ধরেই ক্যারাত শিখেছিল।ওর বাবা-মা রাজি হচ্ছিল। পরে মামার কথাতে মত দিয়েছিলেন। উনার নিঁখোজের আটমাস পর,
গোপন সূত্রে জানা গেছে, উনাকে কেউ এসিডের কূপে ফেলেছিল। এসিডে উনার শরীরটা ঝলসে
কঙ্কালে রুপান্তরিত হয়েছিল।

ওই ঘটনার একবছর পর,

বাবা- মা আর সাফা-স্বপ্নীল চার সদস্যের সুখী পরিবার। সুখ যেন পরিবারে উপড়ে পড়ত। ওরা এতটাই সুখে ছিল। শিফাদের নতুন বাড়ির কাজ চলছিল। এজন্য কিছুদিন ভাড়া থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যাতে বাড়ির কাজটা ধীরে সুস্থে হয়।
তাড়াহুড়োর কাজ ভালো হয় না। স্বপ্নীল বাইরের দেশে থাকে। উনারা মাত্র তিনজন। এতে সমস্যা হওয়ার কথা না। তাছাড়া মাত্রকয়েকটা মাসেরই ব্যাপার। খোঁজ নিয়ে, চারতলা বিশিষ্ট বাড়িটার নিচে তলায় ভাড়া এসেছিল। এই বাড়ির মালিক সুমন শেখ। খুব ভদ্র একজন মানুষ। এলাকাতে
ভলোই সুনাম রয়েছে। উনার ছেলে দু’টোও ভদ্র, প্রশান্ত ও দিগন্ত। দেখা হলে, আগে সালাম দেয়।
কত্ত সুন্দর তাদের বিনয়ী ব্যবহার। আর সেখানে ঝোট-ঝামেলা ছাড়া ভালোই দিন কাটছিল।
সাফা একমাত্র কলিজার বান্ধবী শিফা। দু’জনে যেন একে অন্যের প্রাণ। কলেজ জীবনে তাদের
বন্ধুত্বের সূচনা। সাফা সহজ সরল এবং নরম মনের। আর শিফা সম্পূর্ণ বিপরীত। সে সর্বদা একটু কড়া টাইপের। ওই বাসার ছোট ছেলেটাকে সাফার খুব মনে ধরেছিল। লুকিয়ে দেখতোও।লজ্জায় লাল হয়ে একথা শিফাকে জানিয়েছিল।
শিফা ভ্রু কুঁচকে বলেছিল,

-‘আমি আগে দেখব ছেলেটা কেমন। তারপর..!
নয়তো বাদ।’

-‘আচ্ছা, তুই যা বলবি তাই!’

শিফা সাফারদের বাসায় ঘনঘন আসত। কিন্তু দিগন্তকে দেখত না। তবে মাঝে মাঝে প্রশান্তকে দেখত। একদিন ফুল ছেঁড়ার সময় দিগন্ত নিজে এসে কথা বলেছিল। তারপর থেকে শিফা ওকে ফলো করত। ছেলেটার উপর নজর রেখে তেমন কিছু পায় নি। বরং বেশ সুনাম রয়েছে। মেয়েলি কেস নেই। বাবা-মায়ের আদর্শ ছেলে। তারপর
শিফা খোঁজ নিয়ে সাফাকে বলেছিল,

-‘ তুই প্রেমে লেগে পড়। তোদের বিয়ের অবধি নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমার।’

সেদিন সাফার খুশির অন্ত ছিল না। শিফাকে যে কতবার জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল হিসাব নেই। তবে দিগন্তকে দেখলেই কাঁপুনি শুরু হয়ে যেতো। না কিছু বলতে পারত; না বলতে দিতো। দিগন্তকে সে প্রিয় বলতে ডাকত। একদিন সাফা এটাও বলেছিল, ‘তুই আমার সতীন হবি। আমরা এক সাথেই থাকব। আর বরকে নিয়ে ঝগড়া করব।’
শিফা ওর কথা শুনে রেগে গেলে সাফা খিলখিল করে হাসত। যদিও ইচ্ছে করেই শিফাকে রাগিয়ে দিতো। সাফা স্বপ্নীলকে নিয়েও শিফাকে খোঁচা মারত। ভাইয়ের বউ, আম্মুর পুত্রবধূ, সাফার ভাবি, এসব বলে প্রায় ডাকত। এসব খুনশুটিতে
মেতে থাকত। বেশকয়েকদিন পর, দিগন্তই আগে সাফাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাল। সাফা
কালবিলম্ব না করে কনফমও করে ফেলেছে। সে
যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছে। তারপরে দু’জনের
টুকটাক কথাও হতো। দিনকে-দিন সম্পর্কটাও
সহজ হতে লাগল। কতশত প্রেমালাপও চলত।
দিগন্ত মর্জিমতো সাফাকে ছবি দিতে বলত। না দিলে কথা বলত না, এড়িয়ে চলত। সাফা ওর এড়িয়ে চলা সহ্য করতে না পেরে ছবিও দিতো। তবে এসব কথা শিফাকে জানাত না। কারণ সে জানে, শিফা রাগ করবে। প্রিয় মানুষকেই দিচ্ছে,
তাহলে সমস্যা কোথায়? এভাবে সময় পেরেতো লাগল।

সাফা দিগন্তদের বাসাতেও যাওয়ার-আসা শুরু করল। নিহার সঙ্গে ওর আড্ডাও বেশ জমতো।
শিফাকে কম সময় দিতে লাগল। কষ্ট পেলেও শিফা কিছু বলত না। সে যতটুকু পারত, সাফার খোঁজ রাখত। সাফা পড়াশোনাতে অমনোযোগী
হয়ে গেল। তার কাজ, সারাদিন ফোনে দিগন্তের সঙ্গে চ্যাট করা। শিফা কিছু বললে উল্টে রাগ দেখাত। এরপরে হঠাৎ, সাফার শরীরটা খারাপ হতে শুরু করল। দিন দিন পাগলামির মাত্রাও বেড়ে গেল। স্মৃতিশক্তি কমতে শুরু করল।চোখে কম দেখতে লাগত। তবুও সারাদিন ফোন নিয়েই পড়ে থাকত। অনলাইনে না দেখলে দিগন্ত নাকি রাগ করত। দিগন্ত যখন যা বলত তাই’ই করত। যত দিন কাটতে লাগল সাফার সমস্যাও বাড়তে লাগল। সে মাঝে মাঝে শিফাকেও চিনতে পারত না। ভুল বুঝে অনেক আঘাতও করেছে। খানিক পরেই; দেখে, বুঝে, জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতোও।
কিন্তু ডাক্তারের কাছে যেতে চাইত না। এর কারণ
পরে জানা গেছে, দিগন্তই নাকি ডাক্তার দেখাতে নিষেধ করেছে। সারাদিন ফোন টিপে তাই নাকি এমন হচ্ছে। আপনাআপনি সব ঠিক হয়ে যাবে।
সাফা তাই বিশ্বাস করেছে। শিফা একদিন জোর করে, ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। শিফার চোখ এড়িয়ে সে পালিয়েও এসেছিল।

একমাস পর, সাফার আরো করুণ অবস্থা হয়ে গেল। তবে ওর ফোনটা কোথাও পাওয়া যায় নি। সে নিজে নিজেই কীসব বিরবির করত। সাফার অবস্থা দেখে ওর বাবা-মাও ভেঙে পড়েছিলেন। স্বপ্নীলের পরীক্ষা চলছিল। তাই আসতেও পারে নি। বোনের চিন্তায় পাগলপ্রায় অবস্থা হয়েছিল।
আর শিফা মনটা শক্ত করে সবাইকে সামলেছে।
সাফা করুণ অবস্থাতে শিফা কত কেঁদেছে, কত মানত করেছে। যাতে সাফা আগের মতোই হয়ে যায়। তা হচ্ছিল না। বরং বিপরীতটাই হচ্ছিল।
আর শিফার সঙ্গে সাফার শেষ কথাটা ছিল,

-‘প্রিয় আমার প্রাণ নিলো রে। হ্যাঁ, ওই, ওই প্রিয় আমার প্রাণ নিয়েছে।’

শিফা সাফার পাগলামি থামাতে ব্যস্ত হয়েছিল।
তাই কথাটাতে গুরুত্ব দেয় নি। সাফাকে বুঝিয়ে রাতে ঘুম পাড়িয়েও এসেছিল। তারপরের দিনেই সাফা আত্মহত্যা করেছিল। এই ঘটনা এখানেই থেমে থাকে নি। সাফার বডি নিয়েও আরেকটা ঘটনারও সূচনা হয়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত শক!
সাফার চিকিৎসা চলাকালীন একটা বন্ড সাইন করতে হয়েছিল। যাতে, হঠাৎ শিফার কিছু হয়ে গেলে হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা না হয়।
সেই পেপারটা পুরো না পড়ে সাফার বাবা সাইন করেছিলেন। পুরোটা পড়ার ধৈর্য্য তখন উনার ছিলো না। অথচ সেই পেপারের নিচের পেপারে
লিখা ছিল,

-‘পেশেন্টের মৃত্যুর পরপরই চোখ আর কিডনীটা হসপিটালে জমা দিতে হবে। সেটা কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই। না দিলে, হসপিটাল কতৃপক্ষ যে কোনো ব্যবস্থা নিতে বাধ্য থাকবে।’

To be continue…..!!

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১৩]

আজ দুইদিন হলো শিফার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাবার বাসাতেও যায় নি। আত্মীয়-স্বজন,
এবং বন্ধুরাও তার খোঁজ জানে না। মেয়েটা হুট করেই উধাও! কোথায় গেল? কেন গেল? শিফার চিন্তায় সবার নাওয়া- খাওয়াও বন্ধ। দিগন্ত দায় এড়াতে শশুড়বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়েছিল।সে খোঁজার চেষ্টা না করলেও; দেখাচ্ছে আর কি।
এমন ভাব যেন শিফাকে না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছে। আজ হসপিটালে দিগন্তের জরুরি কাজ আছে। সে দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল।
হসপিটালে পৌঁছে ওর কেবিনে চলে গেল। দ্রুত দরজা আটকে গোপন দরজা দিয়ে পাতাল ঘরে
চলে গেল। পাতালঘরে দশজন পেশেন্টের বডি আছে। সাফার মতো এদের পরিবারের থেকেও
সাইন নেওয়া হয়েছিল। এদের শরীরের দরকারী
পার্টস জমা দিতে হবে। না দিলে, আইনী ব্যবস্থা নিবে।পরিবারের লোক ঝামেলা করলে বোঝায়, এগুলো বিনামূল্যে অন্য পেশেন্টদের দিয়ে প্রাণ বাঁচানো হয়। মৃত ব্যাক্তির জিনিসে অন্যরা বেঁচে থাকছে। অর্থাৎ সেই ব্যাক্তিরও সাওয়াব হচ্ছে।

অথচ একথাটা সম্পূর্ন মিথ্যে। চোখ ও কিডনি থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব পার্টসগুলো চড়া দামে বিক্রয় করা হয়। কয়েক বছর থেকে সে এই কাজগুলোই করে আসছে। এই হসপিটালটা বিলাশবহুল। এখানে ধনীরা বেশি আসে। তারা শিক্ষিত মানুষ। বন্ড পেপার সম্পূর্ণ পড়েই সাইন করে। তাই দিগন্তের ব্যবসা লাটে ওঠার সম্ভবণাও বেশি। এজন্য রয়েল হসপিটালের পাশেই একটা চারতলা বিশিষ্ট হসপিটাল করে দিয়েছে।সেখানে
নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তরা আসে। আর এদের বেশিরভাগ মানুষই অশিক্ষিত। নয়তো ইংলিশ বোঝে না। অথচ বন্ড পেপারের এমন শর্তগুলো ইংলিশে লিখা। যদিও এটাও একটা টোপ।যাতে
কার্যসিদ্ধি হয়। মানুষগুলো যখন ইংলিশ বোঝে না, তখন রিসিপশানে থাকা কেউ এগিয়ে যায়।
তারা পুরো পেপারে নাম ঠিকানা লিখে, দেখিয়ে দেয় কোথায় সাইন করতে হবে! বিপদের সময়ে আগে-পিছে না ভেবে পেশেন্টের বাড়ির লোকও সাইন করে দেয়। ওই লোকগুলোকে এই কাজেই রাখা হয়েছে। তাদের এই দায়িত্বেই নিয়োজিত।
পরে, অসহায় মানুষগুলো জানতে পেরে, হাইহাই করে। তখন আর কিছু করারও থাকে না। শুধু আফসোস করা ছাড়া! এই পর্যায়ে এসে, সেখানে আরেকদলকে লোকের আগমন ঘটে। যারা সেই
পেশেন্টের বাড়ির লোকদের বুঝিয়ে ব্রেণ ওয়াশও করে ফেলে। তারা বোঝায়; চোখ ও কিডনি দান করা পূণ্যের কাজ।

সাফার সঙ্গে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। সাফারও কিডনী, লিভার, ফুসফুস, ও চোখ বাধ্য হয়ে’ই দিতে হয়েছিল। সেদিন থেকে শিফার অঘোষিত লড়াইও শুরু হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, ওর সাজ্জাদ বাবার হসপিটালটা দিগন্ত নিজের করে নিয়েছে। সে হসপিটালের মান খুবই ভালো
দেখায়। আর সবার আড়ালে অসহায় মানুষদের ফাঁসিয়ে দেয়। স্ব-ইচ্ছায় দান করা একথা। আর বাধ্য হয়ে দেওয়া ভিন্ন কথা। বিগত কয়েক বছর
ধরে সে এসব করছে। আর এভাবে কোটি কোটি টাকাও উপার্জন করছে। শিফা চেষ্টা করেছে, এই তথ্যগুলো খোঁজার। কিন্তু সম্ভব হয় নি। বরং সে খুঁজতে খুঁজতে পাতালঘর অবধি পৌঁছেও গেছে। আর সেদিনই দিগন্তের কাছে ধরা খেয়েছে। আর ততদিনে দিগন্তও শিফার কথা জেনে গিয়েছিল। শিফা কে? কেন খোঁজ নিচ্ছে। তার উদ্দেশ্যেই বা কী? সেদিনই সে গুপ্তচরের মাধ্যমে শিফার দূর্বল পয়েন্টের কথাও জেনেছিল। মেয়ে বলে ওয়ানিং দিয়েছিল। শিফা তবুও থামছিল না বরং মরিয়া হয়ে উঠেছিল। পরে দিগন্তই শিফার সঙ্গে দেখা করে বলেছিল,

-‘কি চায়?’
-‘আপনাকে।’
-‘কেন?’
-‘বিয়ে করব।’
-‘ইচ্ছুক নই!’
-‘আমি কোন দিকে থেকে কম?’
-‘উহুম, কম নয়। বরং একটু বেশিই হট।’
-‘তাহলে রাজি?’
-‘না।’
-‘ওকে।’

এরপরেই শিফা দিগন্তকে বিয়ে করার জেদ করে।
লজ্জা ভুলে বাসায় দিগন্তের কথা জানায়। কেউ রাজি না হলে আত্মহত্যার হুমকিও দেয়। শিফার বাবা মেয়ের জেদের কাছে হার মানে। উনি নিজে দিগন্তের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। আর
শিফা দিগন্তকে বিরক্ত করতে থাকে। দিগন্ত রেগে ওকে বলেছিল,

-‘যদি পারো, বিয়ে না করে আমার কাজে বাঁধা দিয়ে দেখাও।’

-‘কাপুরুষের মতো ভয় পাচ্ছেন? আহারে, ভীতু ছেলেটা।’

কেউ ইচ্ছে করে মরতে চাইলে সুযোগ দিতে হয়ে।
এটা দিগন্তের উক্তি। তাই সে কিছু না বলে রাজি হয়েছিল। দূর থেকে নজর রেখে শিফারও কাজ হচ্ছিল না। এজন্য বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধও হয়েছিল। বিয়ে না করলে বাসায় ঢুকতেও পারবে না। আর তথ্যও সংগ্রহ করতে পারবে না। যেটা ওর জন্য খুব জরুরি। দিগন্তের বাসায় যাওয়ার পর, শিফা তথ্য সংগ্রহের যথেষ্ট চেষ্টাও করেছে।
কিন্তু তেমন কিছু পায় নি। বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে চুপিচুপি সে সাজ্জাদ বাবার বাসায় যেতো।
সেই স্থানটা ছিল ওর জন্য নিরাপদ। সাজ্জাদের সহকারী হাসিব বর্তমানে শিফাও সহকারী। আর মাক্স পড়া সেই মেয়েটা ছিল, তমা। তনয়ের মা।
খোঁজ দিয়ে দিগন্ত তমাকেও চিনে ফেলেছিল। সে প্রথমবার ওয়ানিং দিয়েছিল। তমা ওর বারণ না শুনাতে, তনয়কে অপহরণ করেছিল। তিনদিন আটকে রেখেছিল। তারপর তনয়ের হাত কাটার পর, দিগন্ত হসপিটালে দেখতেও এসেছিল। ছোট্ট তনয় দিগন্তের কোলে উঠে কেঁদে বলেছিল,

-‘আঙ্কেল! আঙ্কেল! হাত। আমার হাতটা ঠিক করে দাও। ফুপি পঁচা! প্লিজ হাত ঠিক করে দাও। আমি আর দুষ্টু হবো না, প্রমিস।

তনয়ের কথা শুনে দিগন্ত ওর চোখ মুছিয়ে শিফা আর তমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলেছিল,

-‘বড়দের কর্মফল ছোটদেরকে ভোগ করতে হয়।
যাতে বড়রা আফসোসে পুড়ে মরে। তাছাড়া, কে
বা চায় নিজেকে নিঃশেষ হতে দেখতে!’

ছোট্ট তনয় সেদিন এত কঠিন কথার মানে বুঝে নি। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। বোঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল। তখন শিফা নিজেকে দমিয়ে নেওয়া অভিনয়ও করেছিল। যাতে দিগন্ত বুঝে, শিফা কিছুটা ভয় পেয়েছে। শিফা নিশ্চুপই ছিল কয়েকদিন। তবে খোঁজ চালানো বন্ধ করে নি। হঠাৎ কিছু পেয়েও গিয়েছিল। দিগন্তের বেড রুমের ভেতরে আরেকটা রুম আছে। সেই দরজা দিয়ে ঢুকলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে পাতালঘর পাওয়া গেছে। বাসাতেও পাতাল ঘর! সে ভাবতেও নি। তবে পাতালঘরে তালা থাকায় ঢুকতে পারে নি। পরে পাতালঘরের চাবিটাও পেয়েছিল, দিগন্তের এ্যাকুরিয়ামের ভেতরে।আর চাবি ছিল প্লাস্টিকের মাছের মধ্যে। শিফা একদিন ভাবনায় মগ্ন হয়ে এ্যাকুরিয়ামের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ খেয়াল করে; সব মাছ নড়লেও সাদা মাছটা নড়ছে না।
ওর মনে মনে সন্দেহ হয়। উঠে মাছটা মরা নাকি
দেখতে গিয়ে চাবি পেয়েছিল। আর সুযোগ বুঝে
চাবিটা নিয়ে পাতালঘরেও গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে এসিডের গভীর কূপ এবং অসংখ্য কঙ্কাল দেখেছিল। প্রতিটা দেওয়ালে; কঙ্কাল ঝুলিয়ে নিচে নাম ও তারিখ দেওয়াছিল। শিফা সাজ্জাদ হোসাইনের কঙ্কাল পায় নি। সময়ও কম থাকায় খুঁজতেও পারে নি। দুইদিন পর গিয়ে দেখে চাবি কাজ করছে না। অর্থাৎ তালাটা কেউ বদলেছে।
রুমের কোথায় আর নতুন চাবি খুঁজে পায় নি।
খোঁজার মতো কিছু পায়ও নি। কারণ দিগন্তের রুমের প্রতিটা জিনিসে ওর ফিঙ্গার পিন দেওয়া। এমনকি আলমারিতেও।

দিগন্ত পাতালঘরে ডুকে নিজে পরখ করল। গত পরশু ডিল সাইন করেছে। সাত কোটির টাকার!
চোখ ও লিভারের ব্যবস্থা করতে হবে। আপাতত
একসপ্তাহের মধ্যে দশজোড়া চোখ পাঠাতে হবে।
এজন্য ঢোপও ফেলতে হবে। দিগন্ত সুখু নামের ছেলেটাকে বলল,

-‘তোর প্রেমিকার কি খবর?’
-‘হেহে, হের চক্ষূ দুইখান আগেই তুইল্লা নিছি। এহন কেডনীও তুলুম ছ্যার।’

দিগন্ত ফোন থেকে চোখ সরিয়ে বলল,

-‘কষ্ট হচ্ছে না তোর?’
-‘না তো। হেতীর ট্যামক শেষ কইরা দিছি।
-‘তোর ভাবির কি খবর?
-‘ভাবির খুঁজ এহনও পায় নাইক্বা।পাইলে তহনই
জানামু।’

দিগন্ত আর কথা বাড়াল না। ফোনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।

To be continue……..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here