সাঁঝক বাতি,২৪,২৫
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২৪]
তখন বিকাল পাঁচটা। শিফা গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। দুপুরে খেয়ে দিগন্তের সঙ্গে ঝগড়া করে ঘুমিয়েছিল। দিগন্ত বাইরে থেকে এসে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। শিফার উপর। পুরো ভর ছেড়ে দিলো। তার ঠোঁট শিফার গলায়। আদুরে স্পর্শ
দিতে ব্যস্ত। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে শিফা বিরক্ত হলো। মুখ কুঁচকে চোখ খুলে দিগন্তকে একবার দেখল। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে পুনরায় ঘুমিয়েও গেল। দিগন্তের সেটা সহ্য হলো না। সে
শিফার গলায় কামড় বসিয়ে দিলো। শিফা রেগে দিগন্তের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে ব্যর্থ হলো।ওর ধাক্কা খেয়ে দিগন্ত সরলোও না, নড়লোও না।সে হেসে শিফাকে বুকে টেনে নিলো। মুখভর্তি হাসি।
শিফা নিশ্চুপ। দিগন্ত নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে’ই আছে। চোখে তৃষ্ণা। শিফা উঠতে চাইলে মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। হাতের বাঁধন শক্ত করল।
মুখ উঁচিয়ে শিফার কপালে আদর দিলো। কথা নেই। চুপ করে কাজগুলো করে যাচ্ছে। শিফা ভ্রু কুঁচকে শুয়ে রইল। দিগন্তের প্রশস্ত বুকের উপর।ওর হার্টবিট দ্রুত গতিতে চলছে। অদ্ভুত লাগছে।
দিগন্ত একইভাবে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। শিফা অবাক হলেও প্রকাশ করল না। বরং বিরক্ত নিয়ে বলল,
-‘বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছেন কেন? আমাকে আগে দেখেন নি?’
-‘তোমাকে দেখার পিপাসা আমাকে কখনোই মিটবে না।’
শিফা নির্বাক। দিগন্তের চোখে অশ্রু! এ’ও কি সম্ভব! অথচ মুখে হাসি। ওর মনখারাপ নাকি শরীর খারাপ? কিছু হয়েছে? বোঝাও বড় দায়। দিগন্ত শিফার সদ্য ঘুম থেকে ওঠা দু’চোখের পাতায় আদর দিলো। তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
-‘তোমার ঘৃণার চাহনি আমার জন্য অসহ্যকরণ বহন। মরে যেতে ইচ্ছে করে।’
-‘মরে যান।’
-‘কষ্ট পাবে না?’
-‘না। অন্তত ভালোবাসার নাটক বন্ধ হবে।’
-‘নাই বা ভালবাসলে! তবুও আমার প্রণয়ের সুঁতো ধরে টান দিও না। বুকে রক্তক্ষরণ হয়।’
কথাটা বলে দিগন্ত ওকে শক্ত জড়িয়ে নিলো। না অশ্রু দেখতে দিলো; না কিছু বলতে দিলো। তবে
শিফা শান্ত হয়ে গেল। দিগন্তের বলা কথাটা ওর বুকে গিয়ে বিঁধেছে। নারী মনেও আঘাত করেছে।
অভিনয়ের ছলে কেউ এসব বলতে পারে? এতটা নিখুঁতভাবে! গতকাল দিগন্ত একটা সবুজ শাড়ি এনেছিল। শিফাকে পড়ার অনুরোধ করেছিলো।
শিফা পড়ে নি। বরং বলেছিল, জোর করলে সে ফাঁস দিবে। ওই শাড়ির ফাঁসে’ই ঝুলবে ওর মৃত দেহ। প্রাণ ত্যাগ করবে তবুও পরবে না। দিগন্তও বুঝে গেছে, শিফাকে মানানো যাবে না। সে এতই ঘৃণা করে; মৃত্যুকে গ্রহন করতে প্রস্তুত তবুও ওকে না। এভাবে কতদিন? শিফাকে আঁটকে রাখতেও পারবে না। শিফাও পোষ মানবে না। সে অবাধ্য পাখি। মর্জিমতো চলে। সুযোগ পেলে’ই খাঁচার মায়া ত্যাগ করবে। পিছু ফিরে তাকাবে না।বড্ড
হৃদয়হীন! তাছাড়া, প্রতিটা কর্মের কর্মফল ভোগ করতে হয়। ভালো অথবা মন্দ। সেও করবে। তা যথাশীঘ্রই!শিফাকে চুপ থাকতে দেখে দিগন্ত বেশ কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
-‘আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। পারলেও কখনো বলা হয় নি। নিজের অনুভুতি প্রকাশেও ব্যর্থ।হোক ভালো অথবা মন্দ। সব নিজের মধ্যে চাপিয়ে রাখতে পছন্দ করি। আমি এমনই।আমি
জানি, আমার বিনাশ নিশ্চিত। তবুও তোমাকেই ভালোবেসেছি। নিখুঁতভাবে। স্ব-যতনে! নিরবে! নিরন্তনভাবে! যেটা ব্যাখা করতে আমি অক্ষম।
আমার ভালোবাসায় নিদির্ষ্ট কোনো কারণ নেই। তোমাকে অকারণেই ভালোবেসে ফেলেছি। গাঢ় অনুভূতিতে আঁটকে গেছে। এমন হওয়ার কথা ছিলো না। তবুও হয়েছে। পৃথিবীতে এমন পুরুষ নেই, যে বুকের হাত রেখে বলতে পারবে; ‘আমি
বিনাকারণেই আমার প্রিয়সীর ভালোবাসা চাই না। সম্পর্কের পূর্ণতাও না।’ প্রনয়ের আসক্তিতে
উন্মাদ হওয়া পুরুষ একথা বলতেও পারবে না।
আমিও পারছি না। অথচ তা কখনো সম্ভব না।
আমার অতীত বিষেপূর্ণ। তবে বিষেপূর্ণ অতীতে
সুমিষ্ট পাওয়া ;তুমি। জেদ, জোর, রাগ, অথবা
লড়াই। যাই হোক আমাকে বিয়ে করার পন্থাটা দারুণ ছিলো। সেদিন মনে মনে হেসেওছিলাম, কেউ আমার জন্য এমন পাগলামিও করছে। তা হোক মিথ্যা অভিনয়। বা ভিন্ন কোনো আশায়।
সেদিন থেকেই প্রণয়ের সূচনা। জানতাম কখনো তোমাকে পাবো না। তাই কল্পনাতে আমার রাণী করে সুখী হবো ভেবেছিলাম। অপ্রকাশিত রাখতে চেয়েছিলাম। সময়ও কাটছিল। আর আমার এই অনুভূতিও বাড়ছিল। যা নিয়ন্ত্রণ করতেও ব্যর্থ।
একপর্যায়ে তোমাকে হারাতে গিয়ে নিজেই হেরে গেলাম। গাঢ় প্রণয়ে আসক্তও হলাম। জানো?
সময় বদলায়, মানুষ বদলায়, স্বপ্ন বদলায়,ইচ্ছে
বদলায়, হঠাৎ পরিস্থিতিও বদলায়। শুধু হৃদয়ের গহীনে থেকে যায়, নিস্বার্থ প্রণয় আর স্মৃতিটুকু।
আমি পাপী! পাপে পরিপূর্ণ। স্বীকারও করব। যা
ক্ষমার অযোগ্য। ক্ষমা করতে বলব না। করো’ও না ক্ষমা। যদিও ক্ষমা করা সম্ভব না। এখন এই কথাগুলো বলছি, তোমার সহানুভূতি পেতে নয়। তোমাকে দূর্বল অথবা ভালোবাসার আবদারেও নয়। তুমি শুধু মনে রেখো, একজন পাপীও খুব ভালোবাসে।পাপে পূর্ণ মনেও ভালোবাসা জন্মে। হাজারটা খুন করেও বেলাশেষে প্রিয়সীর ঘৃণার চাহনিতে গুমরে মরে। কষ্টও হয়! ব্যথাও পায়!
অশ্রুও ঝরায়! হেরে যাওয়ার অনেক গল্প থাকে। কিছু গল্প প্রকাশিত আর কিছু অপ্রকাশিত।তবে সেসবে আফসোস নেই। আমি খুব সুখী। কারণ
তুমি আমার অপ্রাপ্ত এক প্রিয় মানুষ। যার গল্পে,
আমি না থাকলেও সে আমার পুরো গল্পেই রয়ে যাবে।’
কথাগুলো বলে দিগন্ত থামল। হঠাৎ ওর বুকের কাছে ভেজা কিছু অনুভব করল। শিফা কাঁদছে।
দিগন্ত ব্যাতিব্যস্ত হয়ে কিছু বলার আগেই শিফা ওর শার্টের কলার চেপে ধরল। অশ্রুসিদ্ধ চোখে
কলার ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে বলল,
-‘আজ এই পরিণতির জন্য কে দায়ী? কাকেই বা দোষ দিবো? কে শুনবে? এর সমাধানই বা কে করবে? আমিও তো এমন জীবন চাই নি! এমন হতেও চাই নি! আমারও স্বপ্ন, ইচ্ছে, ভাবনাপূর্ণ একটা ভুবন ছিলো। আমিও এক কল্পনারাজ্যের
রাণী ছিলাম। অমায়িক এক রাজকুমারের স্বপ্ন দেখতাম। সব নিঃশেষ! সব! আপনারা, হ্যাঁ আপনারাই সব শেষ করেছেন। আমাকে নিঃস্বও করেছেন। সব প্রিয় মানুষদেরও কেড়ে নিয়েছিল। আমার জীবনটাকে তিক্ত করে দিয়েছেন। ছোট্ট তনয়ের কাছে অপরাধী করেছেন। সে আমার প্রাণ। ওর মুখে মাম্মা ডাক শুনেছি। রাগ করলে মাম্মাম! মাম্মাম! বলে এই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ত। অসংখ্য আদর দিয়ে রাগ ভাঙাত। আমি ছাড়া কিছু বুঝতো না। সেই তনয়ের কাছে আমি পঁচা। আমার কাছে আসে না। মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই কষ্ট অপনি বুঝবেন? বুঝবেন, এই ব্যথা কতটা যন্ত্রণাদায়ক! আর কত দগ্ধ করবেন? বলুন না আর কত? তারচেয়ে মেরেই ফেলুন না! আমিও মুক্তি পাই। সহ্যশক্তিও হারিয়েছি। পারছি না আর। এই হারানোর ব্যথা আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। ক্লান্ত আমি! বড্ড বেশি ক্লান্ত।
আমারও ভালোবাসা চাই। খুব করে চাই! আমি সুখী হতে চাই! কারো হৃদয়শ্বরী হতে চাই। কারো বুকে মাথা রেখে কষ্ট লাঘব করতে চাই। কোথায় পাবো সেই বুক? কে দিবে আশ্রয়? আজ আমি বিবাহিত। আমারও স্বামী আছে। তবুও জড়িয়ে ধরতে পারি না। দু’ একটা মনের কথাও বলতে পারি না। আদুরে আহ্লাদ করতে পারি না। তার
হাত ধরে পথচলার প্রতিজ্ঞা করতে পারি না।তার স্পর্শ হৃদয় ছোঁয়াতে পারে না। বরং পুরো শরীর ঘিনঘিন করে। মনে হয়, এই শরীর অন্যেকারো
দখলে ছিলো। ঠোঁটজোড়া, হাত, বুক, নগ্ননারীর শরীরে মত্ত ছিলো। শুধু খায়েশ মিটানোর জন্য।
আপনার প্রতি জোর, দাবি, অধিকার, আবদার কিচ্ছু নেই। তবুও অন্য নারীতে মত্ত থাকার কথা শুনলে, কষ্ট হয়। বুকে ভাঙন ধরে! হৃদয় জ্বলে!
প্রতিটা মেয়ের কাছে বাবা আর স্বামী ই অমূল্য।
মেয়েরা বাবার ভাগ দিলেও স্বামীরটা ভাগ দিতে নারাজ। বাবার ভাগ ভাই অথবা বোনকে দিতে হয়। এটা সহজ হিসাব। কিন্তু স্বামী! সেই স্বামী নামক মানুষটা শুধু তার, তার, তার’ই। অথচ সেই মানুষটাও আমার নেই। যে আছে সে পাপী, খুনী, বিবেকহীন, হিংস্র, পর-নারীতে আসক্ত।
বলুন, আমার এই না পাওয়াগুলোর হিসাব কে চুকাবে? কে দিবে, এই কষ্টের মূল্য! আপনি কেন ভালো হলেন না?কেন আমাদের গল্পটা সাধারণ হলো না? কেন সম্পর্কের পূর্নতা পাচ্ছি না? কেন
বলুন, কেন?
কথাগুলো বলে শিফা ডুকরে কেঁদে দিগন্তের বুকে মুখ লুকালো। আজ কাঁদছে। প্রচন্ড কাঁদছে। ওর কান্না দেখে দিগন্ত’ও ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সে নিরবে অশ্রু ঝরিয়ে শিফার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বুকে অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। আফসোস হচ্ছে। সত্যিই তো! ওদের জীবনী অন্যরকম হতে পারত! শিফা দিগন্তের বুকের শার্ট আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। উচ্চশব্দে। এতদিনের জমানো কথা সে বলতে পেরেছে। বোঝাতে পেরেছে অব্যক্ত মনের কথা। হোক, মানুষটা বৈধ শত্রু। শিফা হয়তো এটা জানবে না, শুধু ওর জন্য দিগন্ত চারিদিকে জাল বিছিয়েছে। অদৃশ্য জাল। যাতে কেউ ওর ক্ষতি করতে না পারে। শতবার আড়ালে থেকে ওকে বাঁচিয়েছে। নয়তো একা একটা মেয়ে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়ত। সে যতই বুদ্ধিমতী হোক না কেন! সে প্রশান্তের করা কাজগুলোতে প্রথমে অবগত ছিলো না। সাফার মৃত্যু আর তনয়ের হাত কাটার পর অবগত হয়েছে। তখন থেকে’ই শিফাকে নিরাপত্তা দিয়েছে। নিজেকে আড়ালে রাখতেই, শিফাকে কষ্ট দিতো, অপমানও করত।
এই কাজে সফলও হয়েছে। প্রশান্ত ওর নিষেধাজ্ঞা
অমান্য করাতে মারতেও দ্বিধা করল না। বাবা নামক মানুষটাকেও শাস্তি দিয়েছে। নির্মম এক শাস্তি। দিগন্ত ইচ্ছে করে’ই শিফাকে এসব কথা জানাল না। কারণ শিফার সহানুভূতি সে সহ্য করতে পারত না। কর্মদোষে সে ঘৃণায় পাত্র। এ
কথা মানতেও বাধ্য। শিফা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। দিগন্ত কম্পিত হাতে ওর গাল ধরে মুখটা তুলল। অঝরে অশ্রু ঝরছে। চোখজোড়াও লালবর্ণ হয়ে গেছে। যেন এক্ষুণি রক্ত গড়িয়ে পড়বে। দিগন্ত দু’বার ঢোক গিলে মৃদু স্বরে বলল,
-‘পুনর্জন্ম বলে যদি কিছু থাকে। তাহলে আমি আবারও জন্ম নিতে চাই৷ এক জীবনে, তোমাকে ভালোবাসার স্বাদ আমার মিটলো না।’
শিফার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেল। দিগন্তের এক একটা কথায় কিছু একটা আছে। দিগন্তকেও কেমন জানি লাগছে! অস্বাভাবিক! হয়তো হৃদয়ে জ্বালাময়ী প্রণয়ের জ্বালা বেড়ে গেছে। কষ্ট হচ্ছে?
হয়তোবা! দিগন্ত স্বযত্নে শিফার চোখজোড়া মুছে দিলো। কপালে আদর দিতে গিয়ে থমকে গেল। ওর স্পর্শে শিফার শরীর ঘিনঘিন করে। বিরক্ত হয়। দিগন্ত নিজেকে সামলে কম্পিত কণ্ঠে চোখে চোখ রেখে বলল,
-‘সামান্য একটু ভালোবাসবে আমায়?’
-‘কখনোও না!’
-‘আচ্ছা।’
-‘আপনাকে আমি প্রচুর ঘৃণা করি, প্রচুর।’
-‘তবুও! যন্ত্রণার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছি; এই শূণ্য হৃদয় শুধু তোর’ই নামে খোদাই করা।’
To be continue…………!!
-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২৫]
-‘তবুও! যন্ত্রণার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছি, এই শূণ্য হৃদয় শুধু তোরই নামে খোদাই করা।’
কথাটা শুনে শিফা দিগন্তের বুকের উপর থেকে সরে গেল। পাশ ফিরে শুলো। কেন জানি অশ্রু ঝরছে। কষ্ট হচ্ছে! বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়েছে। দিগন্তের বলা কয়েকটা উক্তি শুনে নয়। আবেগের বর্শিভূতও নয়। কষ্টকে গুরুত্ব দেয় না,
ভালো মন্দের পরোয়াও করে না। সে বাস্তবাদী। নির্মম বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার ধৈর্য আছে। তা যতই কষ্ট হোক না কেন!তবুও দিগন্ত যদি সাফার মৃত্যুতে বাঁধা দিতো। মামাকে নিখোঁজ না করত। হসপিটাল নিজের নামে না করত। কিডনি বেচা চক্রের সঙ্গে জড়িত না হতো। খুনী না হতো। ওই
সরল মানুষগুলোকে কৌশলে ফেলে কিডনি না নিতো। পর-নারীতে আসক্ত না হতো। তাহলে ওদের গল্পটাও অন্য রকম হতো। সবাই তো সুখ চাই। ভালোবাসা চাই! সেও ব্যাতিক্রম নয়। সব স্বাভাবিক থাকলে ওরাও সুখী হতো। সুখ দিয়ে সংসার সাজাত। দিগন্তকে প্রণয়ের বাঁধনে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে রাখত। কখনো ছাড়ত না। পাপী নয় বরং পারফেক্ট সঙ্গী হতো। দিগন্ত নামক ওই সুদর্শন পুরুষটা একান্ত তার হতো। প্রশস্ত বুকটা ওর দখলে থাকত। সূখপূর্ণ জীবন হতো। অথচ সেটা আর সম্ভব না। দিগন্ত কোন কাজটা ক্ষমার যোগ্য আর কোনটা অযোগ্য? যোগ্য কার্যক্রম আছে কি? চোখে তো পড়ে না। বরং পাপ হচ্ছে জেনেও সে নিশ্চুপ ছিলো। অথচ ওর অজানায় থেকে যাবে, দিগন্ত সাফা, মামা, আর তনয়ের ঘটে যাওয়ার ঘটনার কথা পরে জেনেছে। তখন জানলে, সে পদক্ষেপ নিতে পারত। বাঁধা দিতে পারত। যদিও, দিগন্ত তখন ডুবে থাকত নিজের জগতে। বাবা আর ভাইয়ের দিকে নজর দেওয়ার সময় কই!
এসব ঘটার পর, প্রশান্ত যখন শিফার দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। তখন দিগন্ত সতর্ক হয়েছিল। ওদের নজরে রেখেছিল। বুঝেছিল, এবার ওদের থামাতে হবে। নয়তো শিফাকে হারাবে। যেটা ওর জন্য কষ্টসাধ্য। সে খারাপ। তবে তার প্রণয় নয়,
অনুভূতিও নয়! খুব ভালোবাসতেও জানে। আর ভালোবাসা রক্ষার্থে সে মরতেও পারবে ;মারতেও পারবে। এমন ধাঁচের মানুষ সে। দিগন্ত খারাপ হলো কেন? এর উত্তর জানা নেই। খারাপ হতে কারণ লাগে না। বরং ভালো থাকাই, কষ্টসাধ্য। হয়তো মর্জিমতো চলতে চলতে’ই পথভ্রষ্ট হয়েছে। সঙ্গদোষে ভালোকে অতিক্রম করে সে খারাপকে বেছে নিয়েছে। তাছাড়া, যখন কেউ টাকার প্রতি মত্ত হয়। তখন তার সবকিছুতে আপনা-আপনি পরিবর্তন চলে আসে। কাজে, ব্যবহারে, চাল- চলনে। দিগন্তেরও তাই! শিফার অজানায় থেকে যাবে এসব। থাকুক। মন্দ কী? সব জানতে হবে? কেন? দিগন্ত আগেও জানতে দেয় নি। এখনো জানাল না। সে খারাপ, খারাপই। নিজেকে সাধু প্রমাণ করার ইচ্ছে নেই। চেষ্টাও করবে না।করেও
লাভ নেই; তিক্ত অতীত।
শিফাকে কাঁদতে দেখে দিগন্ত বাঁধ সাধল না।চুপ
করে দেখছে। শিফার বলা কথাগুলো তাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে। নিজের প্রতি’ই ঘৃণা ধরিয়ে দিয়েছে। বুকে যন্ত্রনায় তীর ছুঁড়েছে। সেই তীরের আঘাতে বুকে অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কষ্টে দম আঁটকে আসছে। দিগন্ত ওর কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে অশ্রু মুছে বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।
সুখ রাজ্যেও নই রে সুখী
দুঃখের রাজা আমি।
আমার আয়ুটুকু চাই যে দিতে।
যাকে, আমি ভালোবাসি।
(আলোমনি)
শিফা ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে তাকাল। কথাটা কি ওকে বলল? ওর আয়ু শিফাকে দিবে? দিগন্ত ততক্ষণে স্থান ত্যাগ করেছে। শিফা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে বিষ্ময়! একোন দিগন্তকে দেখছে? তখন সুখু এসে বাইরে দাঁড়িয়ে কোথাও যাওয়ার তাগাদা দিলো। খুব’ই জুরুরি। যেতেই হবে। শিফা উঠে চোখে মুখে পানির ছিঁটা দিয়ে সুখুর সঙ্গে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছে?সুখুকে জিজ্ঞাসা করলেও বলছে না। ওর মুখটা থমথমে হয়ে আছে। ব্যবসাতে লস গেছে? নাকি
কাস্টমার টাকা মেরে দিয়েছে? হবে, কিছু একটা! নয়তো মুখ থমথমে কেন? তখন সুখু মাথা নিচু করে কান্নারত কন্ঠে বলল,
-‘আমার মৃত্যু না হওয়া অবধি আপনার সঙ্গে
থাকার হুকুম জারি কইরা দিছে।’
-‘মানে? কে করেছে?’
-‘ছ্যার! বিনিময়ে দশ কোটি ট্যাহা আর একখান বাড়ি দিছে।’
শিফা হাঁটা থামিয়ে দিলো। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকাল। সুখু মাথা নিচু করে নিলো। ওর চোখে পানি। শিফা তা খেয়াল করল না। দেখার আগেই সুখু অন্য দিকে তাকিয়ে মুছে নিলো। সে নিরুপায়। দিগন্ত ভরসা করে ওকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে। তাকে ওই দায়িত্বে অনড় থাকতেই হবে।
শিফা রেগে গেল সুখুকে মাথা নিচু করতে দেখে।
এটা কোনো কথা? সুখুর মৃত্যু না হওয়া অবধি মানে? দিগন্ত চাচ্ছে টা কি? এই লোকের ফালতু কাজকারবার! সুখুকে রাখবে কেন? তাও টাকার বিনিময়ে। এসবের মানে হয়? শিফা তখন গর্জে উঠে বলল,
-‘আমি কানা নাকি খোঁড়া যে তোমাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে?’
-‘আমার দায়িত্ব আপনাকে রক্ষা করা। রাগুন, মারুন, কাটুন, তবুও আমি যাবো না। আমার ছ্যারের হুকুম।’
-‘ দিগন্ত কোথায়?’
-‘বলা বারণ আছে।’
শিফা বিরক্ত নিয়ে হাঁটা শুরু করল। সুখুর হাতে থাকা ফোনে দিগন্ত এসব শুনছিলো। শিফা এই প্রথম ওর নাম উচ্চারণ করল। ডাকল।ওর কথা জিজ্ঞাসা করল। দিগন্তর মুখে হাসি ফুটল। প্রাণ জুড়িয়ে গেল। প্রিয় মানুষটা নাম ধরে ডেকেছে!
এটাও কম নয়! বেলাশেষে অনাকাঙ্খিত প্রাপ্তি।
দিগন্তর ঝাপসা চোখে শিফার মুখ ভেসে উঠছে।
চিরচেনা ওই রাগান্বিত মুখভঙ্গি। শিফা ওর সঙ্গে কখনো হাসি মুখে কথা বলে নি। মায়ার দৃষ্টিতে তাকায় নি। চোখে চোখে প্রণয়বাক্যে রচনা করে নি। মোহময় দৃষ্টিতে কাছে ডাকে নি। খুনশুটির
মুহূর্তও নেই।তবে দিগন্ত ওর চোখে ঘৃনা দেখেছে। তীব্র ঘৃণা। যেটা দিগন্ত জন্য প্রচন্ড কষ্টের। প্রিয় মানুষটার চোখে ঘৃণায় দৃষ্টি কতটা বেদনাদায়ক। সেটা এক ব্যর্থ প্রেমিকই অবগত। সেই বুঝবে এ দহনের জ্বালা। দিগন্তের হাতে চকচকে ছুরি। তবে সাধারণ ছুরির মতো নয়। প্যাঁচানো। ঠিক বাঁকা সিঁড়ির মতো। হাতলেও নিখুঁত কারুকাজ করা। অদ্ভুত সুন্দর ছুরিটা। ধারালোও বটে। সে বাইরে দেশ থেকে এনেছিলো। দুটো সুইচ আছে। একটা সুইচে প্যাঁচানো ছুরিটা বের হবে। অন্যটাতে খুব সাধারণ ছুরি। তবে সাধারণ ছুরিতে এক ধরনের তরল মিশানো থাকে। যেটাতে, মানুষের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তারপর শ্বাসনালীও। এবং ক্ষণিকের ব্যবধানে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু। দিগন্ত কব্জিতে ছুরি রেখে চোখজোড়া বন্ধ করে বলল,
-‘প্রণয়হীন যন্ত্রনার তীর’টা এই বুকেই মারলি। আমিও শূন্যতাকে পূর্ণতাভেবেই গ্রহন করলাম।’
কথাটা বলে দিগন্ত ছুরি হাতে চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত গড়িয়ে গেল। লাল রক্ত। দেখতে বেশ লাগছে। দিগন্ত হাসছে। হাসতে হাসতে দু’চোখে পানি এসে গেছে। হয়তো এটা জ্বালাময়ী হৃদয়ের
নিরব আর্তনাদ। গগনবিদারী আর্তনাদের থেকে নিরব আর্তনাদ ঘাতক বেশি। আর ওইদিকে, সুখু শিফাকে নিয়ে নিচ তলার এক রুমের প্রবেশ করল। অদ্ভুত জায়গা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শিফা
সুখুর পেছন পেছন হাঁটছে। ঘাড়-ঘুরিয়ে আশে পাশে তাকাচ্ছে। আরো কয়েক ধাপ হাঁটার পর, সুখু একটা দরজা খুলল। শিফাকে ঢুকতে দিয়ে নিজেও ঢুকল। রুমে কেউ নেই। বেশ পরিপাটি করে সাজানো। অভিজাত্যে ভরপুর। দেওয়ালে দিগন্তের ছবি টানানো। মুখে ফিচেল হাসি। সেই কথা বলা চোখ। ওয়াশরুমে পানির শব্দ ভেসে আসছে। দিগন্ত হয়তো। শিফা বসে সুখুর দিকে তাকাল। পাশেই নতমুখে দাঁড়িয়ে। শিফা পাশের সোফায় বসল। মুখে বিরক্তির ছাপ। একটুপরে, ওয়াশরুম থেকে স্বপ্নীল বেরিয়ে আসল। পরণে শুভ্র তোয়ালে জড়ানো। শিফা হতভম্ব। স্বপ্নীল
এখানে? তাহলে দিগন্ত কই? দিগন্ত ওকে এখানে
আসতে দিলো? কেন? স্বপ্নীল দ্রুত পোশাক পরে শিফার মুখোমুখি বসল। কতদিন পর দেখা। সে আলতো করে শিফার গাল ছুঁয়ে দিলো। শিফার অবাক চাহনি। স্বপ্নীল অক্ষত অবস্থায়! কিভাবে সম্ভব? স্বপ্নীল তখন মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলল,
-‘অবশেষে পেলাম। আমরা নতুন করে সূচনা করব। তোকে প্রচন্ড ভালোবাসি, শিফা।’
শিফা নিশ্চুপ! স্বপ্নীলের মুখে তৃপ্তির হাসি। প্রিয় মানুষটা এখন তার। আর সুখু রুমের এককোণে দাঁড়িয়ে বাহুতে মুখ চেপে কাঁদছে। নিরবে। যেন কেউ বুঝতে না পারে। শিফা সত্যিই খুব পাষাণ। নয়তো দিগন্তকে বুঝতে চেষ্টা করতো। সে পাপী। কিন্তু অবুজ মন তো পাপ পূর্ণের হিসাব বুঝে নি। নিষিদ্ধ মানুষটাকেই চেয়ে বসেছে। তাকে পেতে রঙিন স্বপ্ন বুনেছে। সুখু ওদের দিকে তাকালেও না। শিফাকে অন্যের সঙ্গে মানতে পারছে না।
শিফা দিগন্তের। সেও তো রত্নাকে ভালোবাসে। কই রত্না তো ছেড়ে যায় নি। বরং মারলে উল্টো ওকেই জড়িয়ে ধরে। ভালোবাসার আবদার করে। রত্নার বাচ্চা হয় না। সে তো রত্নাকে ছুঁড়ে ফেলে নি। হৃদপিন্ড কে ছুঁড়ে ফেলা যায়? শিফা তো দিগন্তের হৃদপিন্ড। কেউ না জানুন সে তো জানে। নয়তো কাউকে এত ভালোবাসতে পারে?
তাহলে শিফা কেন পারছে না? শিফার প্রণয়ের পরশে দিগন্তকে কেন বদলাচ্ছে না? সুখু মনে মনে একটা কথা আওড়ালো।
-‘ স্যার পাপী বিধায় এত অভিযোগ। যারা ভালো তাদের ভালোবাসা স্বচ্ছ তো?
To be continue………!!