সায়র #পর্ব_০৫

0
214

#সায়র
#পর্ব_০৫
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

কিরণের দিনকাল আনন্দেই কাটছে। জাওভান গত শুক্রবার নিউইয়র্ক গিয়েছে, এক সপ্তাহ হয়েছে, আর এক দুইদিন পরই চলে আসবে বলেছিল। এই কয়দিন জাওভানকে না জানিয়ে সে ময়মনসিংহে তার গ্রামের বাড়িতে বেশ জমিয়ে দিন কাটাচ্ছে। পরিবার বলতে তার মা আর ছোট ভাই আছে। বহুদিন পর পরিবারের সাথে থাকতে পেরে তার আনন্দের সীমা নেই। সে মীরাকেও সাথে নিয়ে এসেছিল। আজ তার যাওয়ার দিন। কখন না কখন জাওভান এসে পড়ে, আর তাকে যদি না পায় তাহলে বড় কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে।

বাসে বসে জানালার পাশে একধ্যানে কিছু ভাবছিল কিরণ। বাহিরে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার কারণে। সকালের ঘন কুয়াশার আবরণে সমস্ত কিছু ঢেকে গেছে। তার কোলে কিউট একটা বিড়ালছানা। কিরণের বিড়াল খুব পছন্দ। বিড়ালটাকে রাস্তায় পেয়ে উঠিয়ে এনেছে সে। জ্যাকেট দিয়ে বিড়ালটিকে আড়াল করে রেখেছে শীতের হাত থেকে। বিড়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে বিড়ালটিকে ওম দিচ্ছে। এত কিউট! একদম গুলুমুলু। কিরণ বিড়ালটির মাথায় কয়েকটা আলতো চুমু খেলো।

মীরা তার পাশে বসে মোবাইল দেখছিল। তখন মীরার ফোন বাজল, দেখল জাওভান। মীরা কিছুটা অবাক হলো, জাওভান কিরণকে কল না করে তাকে কল করছে কেন? তারপর দৃষ্টিপাত করল কিরণের হাতের কাছে থাকা মোবাইলটাকে। সেখানে নোটিফিকেশনে জাওভানের দেয়া ৪৫ মিসকল। কিরণের ফোন সাইলেন্ট করা। এদিকে মীরার ফোনেও কল করছে জাওভান। সে ধরল না, ধরলে তো বুঝে ফেলবে তারা বাসে, তখন ঝড় যাবে কিরণের উপর। মীরা হাত দিয়ে ধাক্কা দিল কিরণকে।

‘কি হয়েছে?’

‘মোবাইল দেখ ছাগী।’

বিরক্ত নিয়ে মোবাইল দেখল কিরণ। মোবাইল দেখতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। জাওভানের এতগুলো কল! সে দ্রুত কলব্যাক করতে নিলো। থামিয়ে দিলো মীরা।

‘গাধীর বাচ্চা গাধী। কল ধরিস না। ধরলে বুঝে ফেলবে তুই যে বাহিরে, আর আজ অফিসও বন্ধ, যদি বলে তুই কোথায় তখন কি বলবি?’

‘আসলেই তো! থ্যাংকস রে।’
কিরণ যেন বড় বাঁচা বেঁচে গেল। এক্ষুনি তো একটা অঘটন ঘটাতে যাচ্ছিল। শিট!

‘তাড়াতাড়ি মেসেজ কর। শালা তো আমার মোবাইলে বারবার কল দিচ্ছে।’ মীরার তাড়া কন্ঠ।

কিরণ মেসেজ অপশনে গিয়ে তাড়াতাড়ি জাওভানকে মেসেজ করল।

‘আজব, কল দিচ্ছ কেন? দেখছো না ধরছি না।’

তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই এলো জাওভানের,’কল ধরছো না কেন? কল ধর তাড়াতাড়ি।’

জাওভানের মেসেজে রাগের অস্তিত্ব টের পেলো কিরণ। কিন্তু কিরণ উল্টো এমনভাবে মেসেজ করল যেন সে নিজেই রেগে আছে,

‘আরে কচুর মাথা। মোবাইলের স্পিকারে কি যেন সমস্যা হয়েছে, কোনো কথা শুনা যায় না, বলাও যায় না। তাই ধরছি না।’

‘তাই বলে যখন কল দিয়েছি তখন কেন মেসেজ করলে না? এত দেরি কেন লাগল?’

‘ঘুমাচ্ছিলাম। ফোন সাইলেন্ট ছিল।’

‘ফোন সাইলেন্ট কেন করেছিলে?’

‘মনে নেই কেন করেছিলাম। হয়তো ভুলে।’

‘নাকি আমি কল দিলে তুমি বিরক্ত হও বলে?’

কিরণ ‘ঠিক তাই’ লিখে তারপর কেটে দিলো আবার। নিজেকে সংযত করল আপাতত কোনো ঝগড়া না করার। কিন্তু জাওভানকে এত কৈফিয়ৎ সে দিতে পারবে না। খুব বিরক্ত লাগে জাওভানের এই সাধারণ ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি করাটাকে। তাই এই কথাবার্তার ইতি টানতে সে একটু লুতুপুতু লেখা লিখল,

‘কি যা তা বলছো! তোমার কল পেলেই তো আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হই জাওভান। ভালোবাসার মানুষের ডাকে কেউ বিরক্ত হয় বুঝি? আমার ভালোবাসার মানুষ তো ওয়ান অ্যান্ড অনলি তুমি, আমার জাওভান ওরফে আমার জান।’ তারপর কয়েকটা কিসিং ইমোজি।

মেসেজটা লিখতে গিয়ে কিরণ হেসে দিলো। মীরাও ফিক করে হেসে দিলো। যেন এর চেয়ে ফানি জিনিস তারা আর কোথাও দেখেনি। মীরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল কিরণের উপর।

ওপাশ থেকে কয়েক মুহুর্ত কোনো মেসেজ আসেনি। তাই কিরণ হাসি থামিয়ে লিখল,

‘সোনা, আমার আরো ঘুম পেয়েছে। একটু ঘুমাবো। পরে কথা বলি, প্লিজ লাভ?’

তাও কোনো রিপ্লাই আসলো না, কিন্তু সীন হলো ঠিকই। কিরণ জানে জাওভান মেসেজের দিকে এখন চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। কারণ জাওভান কিরণকে এর আগে কোনোদিন এত রোমান্টিক আলাপ করতে দেখেনি। তাই বোধহয় বেচারা শক খেয়েছে। কিরণ আবার লিখল,

‘আপাতত বাই। আমি নেট অফ করে দিচ্ছি, এখন কল দিও না। বাই।’

তারপর সে মেসেনজার ক্লোজ করে দিলো। মীরা তখনো হাসছে। কিরণ মুচকি হেসে জানালার বাহিরে তাকাল। এখনও কুয়াশা কাটেনি। দশটা তো বাজে প্রায়। শীত লাগছে বেশ। কিরণ জানালা টেনে দিলো।

আচমকা মীরা প্রশ্ন করল,

‘তুই কি জাওভান ভাইয়াকে সত্যি ভালোবাসিস?’

কিরণ মীরার দিকে ফিরল। মীরার মুখের হাসি উধাও হয়ে ভর করছে সিরিয়াসনেস। কিরণ হালকা হেসে বলল,

‘তোর কি মনে হয়? ভালোবাসি ও কে?’

‘এই কয়েকদিনে তোর আর ভাইয়ার কথাবার্তায় আমার কাছে মনে হয়েছিল তুই ভাইয়াকে ভালোবাসিস। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে না।’

কিরণ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, ‘ভালোবাসি না তাকে। কখনো পারবো কিনা তাও জানিনা।’

‘তাহলে তুই যে নিজে থেকে প্রতিদিন ভাইয়ার খোঁজ নিস, তার এত কেয়ার করিস, এগুলো কি?’

‘এগুলোকে তোর ভালোবাসা মনে হয়? মায়া বলতেও একটা জিনিস আছে মীরি। জুভের সাথে থাকতে থাকতে ওর প্রতি আমার শুধু মায়া কাজ করে। এটা কি অস্বাভাবিক কিছু? আমরা যদি নরমালি কারো সাথে কয়েকদিন মিশি তার প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মায়া কাজ করবে। আর সেখানে জাওভানের সাথে আমার সম্পর্কের আটমাস প্রায়। ও নিজেও প্রতিদিন আমার খোঁজখবর নেয়, কি করেছি না করেছি সব বিষয়ে কেয়ার করে, হ্যাঁ মানছি ওর এসব অতিরিক্ত। কিন্তু ও যদি একদিন এমন না করে তাহলে ব্যাপারটা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগবে এবং আমি জাওভানের এই পাগলামীগুলো মিস করব। কিন্তু তাই বলে কি এটা ভালোবাসা? জাওভানের এসব পাগলামী শুধু অভ্যেসে পরিণত হয়েছে আর এই সবই মায়ার বশে। ভালোবাসলে মনের থেকে যে একটা টান আসে ঐ টানটা আমার জাওভানের জন্য কাজ করে না। আর অনেস্টলি, জাওভান আমার ভালোবাসা ডিজার্ব করে না, শুধুই মায়া ডিজার্ব করে।’

‘তাহলে তুই যে জেলাস হস? ইয়ানাকে জাওভানের পাশে দেখলেও তো তুই জেলাস হস? এই জেলাসিটাও কি মায়া?’

কিরণ একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল,

‘মীরা, শোন। তোর একটা ফ্রেন্ডের সাথে যদি হঠাৎ অন্য একজন এসে ক্লোজ হওয়ার চেষ্টা করে তখন কিন্তু তোর মধ্যে জেলাসি কাজ করে, তোর মন চায় ঐ ফ্রেন্ডটার সাথে আমি ছাড়া আর কেউ ক্লোজ না হোক। তার মানে কি তুই ঐ ফ্রেন্ডকে ভালোবাসিস? আসলে আমরা চাই কেউ যদি আমাদের দিকে তার একান্ত সব ধ্যান দেয় সেই একই ধ্যানটা যাতে অন্য কেউ না নেয়। এটা জেলাসি, কিন্তু ভালোবাসা না। এর জন্য দোষী কিন্তু ঐ মানুষটাই। সে যদি আমাদেরকে এতটা ইম্পর্টেন্স না দিয়ে সবাইকে সমান ইম্পর্টেন্স দিতো তাহলে এই জেলাসিটা আমাদের মধ্যে কাজ করত না। ঠিক তেমনই জাওভান তার সব ধ্যানজ্ঞান আমাতে দিয়েছে, এখন ইয়ানা যদি এসে ভাগ বসাতে চায় তাতে আমার জেলাস হওয়া নরমাল।’

‘কিন্তু তুই তো জাওভান ভাইয়াকে ভালোইবাসিস না। তাহলে এত জেলাস কেন হস?’

‘ঐ যে বললাম মায়া, সবটাই মায়া।’

‘যেহেতু তোদের মধ্যে ভালোবাসা নেই তারমানে তো একদিন না একদিন তোকে জাওভানকে ছাড়তেই হবে। তখন তুই জেলাস হবি না যদি ভাইয়ার মনে অন্য কেউ আসে।’

কিরণ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে,

‘একটা কথা ভুল বললি, ভালোবাসা আছে, তবে তা সম্পূর্ণ জাওভানের তরফ থেকে, আমার তরফ থেকে শুধুই মায়া। আর আমি জানি না কোনোদিন জাওভানকে ছাড়তে পারবো কিনা। সরি, আমি না, জাওভান আমাকে ছাড়তে পারবে কিনা।’

‘তারমানে তুই জাওভানকে ছাড়তে চাস?’

‘বহু আগে থেকেই।’

‘তাহলে সম্পর্কে গেলি কেন? ভালোই তো ছিল তুই যখন পালিয়ে গিয়েছিলি যেদিন জাওভান ভাইয়াকে রিজেক্ট করেছিলি। ফিরে আসলি কেন?’

কিরণ নিশ্চুপ রইল। সে এসব বলতে পারবে না মীরাকে। এমন অনেক কথাই আছে যা সে মীরাকে কেন কাউকেই বলেনি।

কিরণ এবার উদাস কন্ঠে বলল, ‘আচ্ছা এই মায়া দিয়ে কি সংসার করা যায় না? জাওভান তো আমাকে ভালোবাসে, আর ওর জন্য আমার মায়া কাজ করে, তাহলে ভালোবাসা মায়া দিয়ে কি সংসার করা যায় না?’

‘তা তো অবশ্যই যায়। কিন্তু কথা হলো ভাইয়ার ভালোবাসা তো অসুস্থ ভালোবাসা। তোর এই মায়া বিয়ের পর তিক্ততায় রূপ নেবে। তখন জাওভান ভাইয়ার এত কেয়ার, পাগলামী গলায় ফাঁসের মতো লাগবে। এখনি তো তোকে পারমিশন ছাড়া কোথাও যেতে দেয় না, কারো সাথে মিশতে দেয় না, বিয়ের পর তো শিকল দিয়ে আটকিয়ে রাখবে।’

কিরণ কিছু বলল না। সে জানে মীরা ভুল কিছুই বলেনি। জাওভান জীবনে আসার পর তার স্বাধীন জীবন পরাধীন হয়ে গিয়েছে। আর বিয়ে করলে তো তার জীবনই শেষ।

‘ভালোবাসা দিয়ে সংসার করা গেলেও অসুস্থ ভালোবাসা দিয়ে যায় না। তোর মতো চঞ্চল একটা মেয়ের ডানা কেটে দিবে, ইচ্ছে মতো কিছু করতে পারবি না, খাঁচায় বন্দী করবে, অলরেডি করেই ফেলেছে, এখন খালি খাঁচায় তালা মারার পালা।’

কিরণ খুব বড় করে গভীর একটা শ্বাস ছাড়ল। তার মাথা ব্যথা করছে। কি হবে জাওভানকে বিয়ে করলে?

.

.

তারা বাসায় পৌঁছল দুপুর একটায়। কিরণ ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ঢুকল। ড্রয়িংরুমের সামনে দিয়ে তার রুমে যেতেই গম্ভীর পুরুষালী একটা কন্ঠ বলে উঠল,

‘ছুটি কেমন কাটল?’

চমকালো কিরণ। চকিতে তাকাল ডানপাশের নরম গদিতে বসা পুরুষটির দিকে। উজান পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে, তার সরু দৃষ্টি কিরণের উপর। এই কনকনে ঠান্ডায়ও কিরণের মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। উজান এখানে? আর ছুটির ব্যাপারটা উজান কীভাবে জানল? এসব ভেবে কিরণের কপালে দরদর করে ঘাম ঝড়তে লাগলো এই শীতে।

উজান পা নামিয়ে কোটের পকেটে হাত দিয়ে ধীরপায়ে কিরণের নিকট আসলো। একহাত দূরত্ব তাদের মাঝে। হাত বাড়িয়ে কিরণের কপালে জমে থাকা ঘামের ফোঁটা তর্জনীতে নিলো। উজানের গরম হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলো কিরণ। উজান আঙুলে থাকা ঘামের ফোঁটা বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চুটকির মতো করে ছুঁড়ে মারলো ভীতসন্ত্রস্ত কিরণের মুখে। চোখ কুঁচকে বন্ধ করে নিলো কিরণ। উজান একটু দূরে সরে আসলো। কিরণকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। শান্ত গলায় বলল,

‘শশী লজ, জয়নুল আবেদীন পার্ক, জাদুঘর, সিলভার প্যালেস ঘোরা শেষ? নাকি আরো বাকি আছে?’

কিরণ বিস্মিত হলো। উজান কীভাবে জানলো যে সে ময়মনসিংহে গিয়ে এসব জায়গায় ঘুরেছে?

‘অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এই অল্প কয়দিনে তো বেশ ঘুরলে।’ বলে উজান।

কিরণ কন্ঠে বিস্ময় ঢেলে বলল, ‘তুমি কীভাবে জানো এসব?’

উজান কিছু বলল না। কিন্তু কিরণের কেন যেন মনে হলো উজান তার কথার প্রত্যুত্তরে হাসছে।

‘জুভ তো তোমার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলো আমার উপর।’ অনেকক্ষণ পর বলল উজান।

‘তার মানে কি তুমি আমাকে স্টক করেছিলে?’ কিরণের কন্ঠে হালকা রাগ।

‘হাহ! পাগল নাকি! আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই তোমার মতো মেয়ের পেছন পেছন ঘোরা।’ উজানের কন্ঠে তাচ্ছিল্য।

‘ ‘তোমার মতো মেয়ে’ মানে কি বুঝালে?’

উজান তার উত্তর না দিয়ে বলল,

‘এই যে পাখির মতো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছো জুভের অনুপস্থিতিতে, জুভ কি জানে?’

‘তুমি যদি বলে থাকো তাহলে তো জানবেই।’ কিরণের কাটকাট উত্তর। মনে মনে সে ভয় পেলেও প্রকাশ করল না। ভয় পেতে দেখলে উজান আরো পেয়ে বসবে।

উজান একহাতে চশমা ঠিক করল। কিরণের এবারও কেন যেন মনে হলো উজান হালকা হাসলো। অথচ তার মুখ একদম নির্বিকার। নাকি কিরণ ভুল ভাবছে!

‘চলো।’ এই বলে উজান বেরিয়ে যেতে লাগলো।

‘কোথায়?’ প্রশ্ন করল কিরণ।

‘গেলেই দেখতে পাবে। আর কিছু জামাকাপড় প্যাক করে নিও।’

দীর্ঘ জার্নির পর কিরণের কোথাও যেতে মন চাইছিল না। একটু ঘুমোতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আপাতত উজানের সাথে তর্কে যেতে চাচ্ছে না। যদি রাগের মাথায় জাওভানকে বলে দেয় সব? অগত্যা কিরণ উজানকে অনুসরণ করতে লাগলো।

উজান ড্রাইভিং করছে আর কিরণ তার পাশে বসে বিড়ালের গায়ে হাত বুলাচ্ছে। তাদের মাঝে পিনপতন নীরবতা। প্লে লিস্টে বাজছে লাভ স্টোরি গানটা।

Take my hand
Promise me that everything will be fine
Hold me tight
Next to you, I still dream,
Yes, yes I want to stay,
But I don’t know how to love anymore,
I’ve been too stupid,
Please, stop, stop
How much I regret, no, I didn’t want all this,
I would be rich and
And I’ll offer you all my gold
If you don’t care, I
I, I’ll be waiting for you in the port,
If you ignore me I, will offer you my last breathe of life,

In my love story
In my love story
In my love story
My love story

কিরণের চুল বাতাসে উড়ছে। সে চুলগুলো ঠিক করলো না, উড়তে দিলো। আজ অনেক ক্লান্তি লাগছে তার। গানটি খুব সুন্দর কিন্তু ভাষাটা কেমন অচেনা লাগছে, ইংলিশ না। তাও গানটা হৃদয়ে দাগ কাটার মতো, যেন এক্ষুনি কেঁদে দেবে। উজান জানালা তুলে দিলো।

‘বন্ধ করলে কেন?’

‘ঠান্ডায় বিড়ালটির কষ্ট হচ্ছে।’

কিরণ এতক্ষণে খেয়াল করল যে তার কোলে বিড়াল আছে। আসলে এতো ক্লান্তি লাগছিল শরীর!

‘উজান। তুমি সত্যি জুভকে কিছু বলোনি তো?’ সাবধানে প্রশ্ন করল কিরণ।

‘তোমাদের মাঝে ঝগড়া মেটাতে মেটাতে আমি ক্লান্ত।’ সামনে তাকিয়েই উত্তর দিলো উজান।

প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিরণ। যাক, তার মানে উজান কিছুই বলেনি।

‘আচ্ছা, এই গানটা কোন ভাষার?’

‘ফ্রেঞ্চ।’

‘তুমি বুঝো লিরিক্সগুলো?’

‘না বুঝলে চালিয়েছি কেন?’

উফফ! এই ছেলেটা কি কিরণের সাথে নরমালভাবে একটু কথা বলতে পারে না? এত ত্যাড়া কেন? ফালতু। কিরণ আর কিছু বলল না। চোখ বন্ধ করে গানটা উপভোগ করতে লাগল।

কিরণ অনুভব করল কেউ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে পেছন থেকে। কিরণ পেছনে দাঁড়ানো মানুষটির পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখতে পারছে না মানুষটিকে। তার সামনে গাঢ় নীল সমুদ্র। এখন রাত নেমেছে সমুদ্রে। পূর্ণ চাঁদ তার রূপালী আলোয় আলোকিত করেছে সমুদ্রকে। চারিদিকে জোৎস্না। এত সুন্দর! চোখ জুড়ানো! ঠান্ডা হিমশীতল বাতাস কিরণের পাতলা সাদা গাউন ভেদ করে শরীরে শীতল স্পর্শ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। এত শান্তি! কিরণের কাছে মনে হলো সে সমুদ্রের পানির উপর হাঁটছে। তার ভয় হতে লাগলো। মাথা নাড়িয়ে না না করতে লাগল। তার ভয় লাগে পানিতে নামতে। কিন্তু কোমড় জড়িয়ে আগলে রাখা মানুষটি তাকে আশ্বস্ত করল,

‘আমি আছি কিরণ, তোমার সাথে। সারাজীবনের জন্য। ভয় পেয়ো না, আমি আছি তো। তোমার ভয়গুলোকে জয় করার পথ দেখিয়ে দেবো আমি। শুধু সাহস করে এগিয়ে চলো, তোমার পাশে আছি আমি, ঢাল হয়ে। থাকবো..সবসময়…সারাজীবন …মৃত্যু পর্যন্ত।’

মানুষটির কন্ঠ এতো স্নিগ্ধ হয়ে কিরণের কানে প্রবেশ করল যে কিরণ ভুলে গেল তার পানিতে ভয় আছে। এই স্নিগ্ধ জোৎস্না মেশানো রাতে শ্রুতিমধুর কন্ঠের ব্যক্তিটিকে ঢাল করে শীতল গভীর সায়রে ডুব দিলো কিরণ। তার ভয় নেই, কোনো বাঁধা নেই, আছে শুধু কিরণ, সে এবং গভীর সায়র…

গালে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শে চোখ খুলল কিরণ। তার মানে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল! গান শুনতে শুনতে কখন চোখ লেগে এসেছিল সে নিজেও বলতে পারবেনা। কিন্ত সে নড়তে পারছে না কেন? শরীর অবশ লাগছে! খুব কষ্টে চোখ ভালো করে খুলে দেখল জাওভানের চোখের কালো মনি তার দিকে নিবদ্ধ। তাকে দেখছে একধ্যানে। তার চোখেমুখে প্রশান্তির ছোঁয়া।

কিরণ উঠতে গিয়ে বুঝলো জাওভানের কোলে ঘুমোচ্ছিল। ভালো করে চারিদিক খেয়াল করে দেখল এখন তারা এয়ারপোর্ট থেকে বেরোচ্ছে। উজান সামনের সিটে।

‘কেমন আছো সোনা?’ জাওভান বলল, নরম গলায়।

‘ভালো। তোমার কি আজ আসার কথা ছিল?’

জাওভান তার উত্তর না দিয়ে কিরণের দিকে তাকিয়ে রইল। কিরণের ঘুমঘুম কন্ঠ কি আবেশী! আর তার ঘুমঘুম চেহারা কোমল, স্নিগ্ধ। ইচ্ছে করছে এই মেয়েটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে। এত সুন্দর কেন মেয়েটা? জাওভান কিরণের গালে কপালে গভীর চুমু দিলো।

কিরণ কারেন্টের শক খেল যেন। এখান থেকে আয়নায় সরাসরি উজানকে দেখা যায়। লজ্জা নেই জাওভানের?

‘ছাড়ো।’ ফিসফিস করে বলল কিরণ।

কিন্তু জাওভান তো ছাড়লোই না বরং কিরণের হাতে চুমু দিতে লাগলো। প্রত্যেকটা চুমুর আওয়াজ পর্যন্ত হচ্ছে। কিরণের কান গরম হয়ে গেল রাগে, লজ্জায়। জাওভানটা আসলেই বেশরম। তার লজ্জা না থাকলেও কিরণের আছে। কিরণ জাওভানের চুল খুব জোরে টেনে ধরে তাকে ছাড়িয়ে সিটে বসে পড়ে। জাওভান আবার এগিয়ে আসতে নিলে কিরণ জুতা খুলে হাতে নেয়। জাওভানকে চোখ রাঙিয়ে শাসায়। জাওভান ঠোঁট কামড়ে হাসে।

কিরণের মনটা ফুরফুরে লাগছে ঐ স্বপ্নটার কারণে। এমন স্নিগ্ধতায় মাখানো স্বপ্ন প্রতিদিন কেন দেখে না সে? একসময় গাড়ি থামে। উজানের পাশের সিটে উঠে বসে ইয়ানা। ভ্রু কুঁচকে এলো কিরণের। ইয়ানা হঠাৎ? আবারো গাড়ি চলতে শুরু করে। এই রাস্তা তো তাদের বাসার রাস্তা না। তাহলে কোথায় যাচ্ছে তারা?

কিরণ প্রশ্ন করল এবার, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘তোমার শ্বশুরবাড়ি।’ বলল জাওভান।

কিরণ চোখ রাঙালো, ‘সত্যি করে বলো কোথায় যাচ্ছি?’

‘গেলেই দেখতে পাবে।’ উত্তর দিলো উজান।

জাওভান বলল, ‘ব্রো বলেছে আমাকে কি একটা সারপ্রাইজ দিবে। সেখানেই যাচ্ছি।’

কিরণ অবাক হয়ে বলল, ‘তো তোমার সারপ্রাইজ দেখতে আমি কেন যাচ্ছি?’

জাওভান কিছুটা রাগী গলায় বলল, ‘কারণ আমি মানেই তুমি, তুমি মানেই আমি।’

জাওভানের আদিখ্যেতায় ভেঙচি কাটে কিরণ।

অতঃপর তারা এসেই পড়ল। গাড়ি থেকে নেমে চমকে যায় কিরণ। তার মুখ দিয়ে আপনাআপনি বের হয়, ‘ওয়াও!’

.
.
চলবে…

[আমি যে গল্পের মাঝে গানের লাইন ঢুকিয়ে দেই তাতে কি আপনারা বিরক্ত হন? আসলে গল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই গান এড করি। লিরিক্স গুলো পড়েছেন তো? সময় পেলে পুরো গানের লিরিক্সগুলো পড়বেন।♥]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here