#সায়র
#পর্ব_১২,১৩
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
১২
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
কিরণের দিন ব্যস্ততায় কাটে ইদানীং। সারাদিন অফিস করে এসে জাওভানের পাগলামী সহ্য করা এই নিয়েই তার জীবন। সে চেয়েছিল চাকরিটা ছেড়ে দেবে। প্রাইভেট কোম্পানীতে বেতনের চেয়েও গাধার খাটুনি দ্বিগুন। সকালে গিয়ে রাতে ফেরাটা কিরণের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। শরীরে আর কত কুলায়? আর তার বেতনটাও কেটে দিয়েছে বস। পরের মাস থেকে বেতন কমাবে কারণ কোম্পানি ভালো যাচ্ছে না। পড়াশোনা লাটে উঠিয়েছে আরো আগেই। মাস্টার্স কমপ্লিট করে বসে আছে। সে ভাবছে কোনো ব্যবসা করবে। কিন্তু কী ব্যবসা করবে? অনলাইনে শুরু করতে চেয়েছিল, খুব বড়সড় ধোঁকা খেয়েছে কাস্টমারদের থেকে। ফ্রিল্যান্সিং করতে চেয়েছিল, সেখানেও অনেক সময় যাবে আর্নিং করতে, তার চেয়ে বড় কথা স্ক্রিনে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না, মাথা ব্যথা করে। টিউশনিতে আরো প্যারা। কিরণের মাথায় কাজ করে না সে কী করবে, তার উপর জাওভানের পাগলামী তো আছেই। হুটহাট করে অফিসে চলে আসে, রাত যতটাই গভীর হোক না কেন, জাওভানের মন চাইলে তাকে কল করে বসে। কিরণের ক্লান্তির কথা চিন্তা করে না। যদি কিরণ বলে তার খারাপ লাগছে, তাহলে জাওভানের মন যদি ভালো থাকে তাহলে শুয়ে পড়তে বলবে, আর মন ভালো না থাকলে কিরণকে ঘুম নষ্ট করে জাওভানের ঘ্যানঘ্যান শুনতে হয়।
লাইফের উপর খুব বিরক্তি এসে গেছে কিরণের। কয়েকদিন আগে কিরণের ভাই কিয়াদ এক্সিডেন্ট করেছে। স্কুল থেকে আসার পথে গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে পা ভেঙেছে। ডাক্তার বেড রেস্টে থাকতে বলেছে আপাতত। প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে তাকে সদরে শিফ্ট করেছে কিরণ, কারণ প্রাইভেটের সিটের চার্জ দেয়ার মতো তার কাছে টাকা নেই। কিরণের মাও অসুস্থ।
ব্যাংকে যা জমা ছিল তার চার ভাগের তিন ভাগ শেষ হয়েছে ভাইয়ের পেছনে। জাওভান চেয়েছিল কিরণকে টাকা দিয়ে হেল্প করতে, কিরণ দেয়নি, কারণ সে একটা ব্যাপার খুব ভালো করে জানে জাওভান সম্পর্কে, তা হলো, জাওভান যদি কখনো কোনোভাবে হেল্প করে, আর তার যদি কোনোসময় খুব রাগ উঠে তাহলে সে ঐ হেল্প করা নিয়ে খোঁটা দেয়। একবার কিরণের উপর প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল জুভের, তাদের ঝগড়ার এক পর্যায়ে জাওভান খুব ছোটো একটা বিষয় নিয়ে খোঁটা দিয়েছে। বিষয়টা ছিল, কিরণ মাঝে মাঝে খুব প্রয়োজনে জাওভানের গাড়িটা ব্যবহার করতো। জাওভান নিজেই কিরণকে বলেছিল এটা তার গাড়ি ভেবে ব্যবহার করতে, কিরণও বোকার মতো ব্যবহার করেছে, আরেকদিন বিপদে পড়ে জুভের থেকে ষাট হাজার টাকা ধার নিয়েছিল, জুভ বলেছে এই টাকা তাকে ফেরত দিতে হবে না, কিন্তু কিসের কি! সেসব নিয়ে শেষে জুভের থেকে গায়ে আগুন জ্বালানোর মতো খোঁটা সহ্য করতে হয়েছে তাকে। খুব কষ্টে নিজের মাসিক হাতখরচ জমিয়ে, ওভারটাইমে কাজ করে কিরণ তখন তার টাকা পরিশোধ করেছে। রাগ কমায় জুভ অবশ্য তার থেকে টাকা নিতে চায়নি, কিন্তু কিরণ জোর করে ফেরত দিয়ে দিয়েছে, কারণ জুভ পরে রাগলে ঠিকই খোঁটা দিবে। তারপর থেকে কিরণ কানে ধরেছে, তার জীবনে দুর্ভিক্ষ এলেও সে জাওভানের থেকে সাহায্য চাইবে না, ভুলেও না।
কিরণ ভাবছে, কোনো ব্যাংক থেকে লোন নেবে, কিন্তু মাসের কিস্তি পরিশোধ করবে কীভাবে? তার এডুকেশনাল সার্টিফিকেটে তার নাম্বার খুবই কম, যার জন্য কোনো ভালো জবে পোস্ট হচ্ছে না। সত্যি বলতে সে কোনোদিন পড়ালেখার প্রতি সিরিয়াস ছিল না, কোনোরকমে টেনেটুনে পাশ করা ছাত্রী সে। পড়ালেখার মতো সিচুয়েশন কিংবা সেই পরিবেশ তার কোনোদিন ছিলোই না। কিরণের চোখের কোণ বেয়ে গরম জলের ফোঁটা পড়ল। অতীতের কত দুর্বিষহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে বেড়ায় তাকে। অতীত কেন মুছে ফেলা যায় না জীবন থেকে? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কিরণ, সেই দীর্ঘশ্বাসের সাথে কত নাম না জানা কষ্ট, আর্তনাদ, হাহাকার বেরিয়ে আসে। ইদানীং সে খিটমিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। কোনোকিছুই ভালো লাগে না তার। তার জীবনটার আসলে কোনো মানেই নেই। তার যদি কোনো পিছুটান না থাকত তাহলে কবেই আত্মহত্যা করত।
কিরণ বসে আছে গার্ডেনে। সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি, বাসাতেও রান্না করেনি সে। এখন প্রয়োজনে জাওভানের ফ্লাটে এসেছিল। বাসার কেচিগেইট লক। কিরণ গেইট দিয়েই ভালো করে দেখল, উজানের ফ্লাটে তালা মারা কিন্তু জুভেরটায় নেই। তারমানে জুভ বাসায় আছে, তাহলে গেইট এখনো খুলছে না কেন? নিশ্চয়ই পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে এই বেলা দশটাতেও। কিরণ অনেকবার কলিংবেল চেপেছে, জুভের মোবাইলে কল দিয়েছে অনেকবার, ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। জুভের ফ্লাটের পাশটাতেই দেয়াল, যার কারণে কিরণ ফ্লাটের পাশে গিয়ে জানালায় টোকা দিতে পারছে না, আর জুভের রুমটাও ভেতরে। জুভের আজ বাসায় থাকারই কথা, কারণ আজ শুক্রবার, আর ছুটির দিনে জুভ এগারোটা বারোটায় ঘুম থেকে উঠে। কিরণকে তাহলে আরো একঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।
জুভের বাসায় কিরণের অনেক জিনিসপত্রই রয়ে গেছে। সে তার বর্তমানের বাসাটা ছেড়ে দিবে, বাসা ভাড়ার সাথে কুলাতে পারছে না। একা একটা মেয়ে, কতদিক সামলাবে সে? মায়ের অসুস্থতা, ভাইয়ের পড়াশোনা, অসুস্থতা, বাড়তি খরচ, তার এখানে থাকা খাওয়ার খরচ, এসব এই অল্প বেতনে চলে? তাও তো আগে কিরণ ভালো এমাউন্টের বেতন পেত, এখন তাও নেই। এই অল্প বয়সেই তার ক্লান্তি চলে এসেছে। মীরাও চলে গেছে হোস্টেলে। কিরণ ভাবছে সেও হোস্টেলে চলে যাবে। এই মাসের ভাড়া দিয়ে সামনের মাস থেকে হোস্টেলে উঠবে, তাতে খরচ যদি কিছু কমে। আজ এখান থেকে যাওয়ার সময় হোস্টেল সুপারের সাথে কথা বলতে হবে তার।
কিরণ যখন এতসব চিন্তা করছিল তখন গেটের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকা একটি গাড়ি হর্ন বাজায়। কিরণ ঘুরে দেখে এটা উজানের গাড়ি। উজান গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢোকার পথে কিরণকে বাগানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কিরণ উজানকে দেখে এগিয়ে আসে। উজানের কাছে গেট আর ফ্লাটের সবকিছুরই চাবি থাকে।
উজান তার দিকে দুর্বল পায়ে এগিয়ে আসতে থাকা কিরণকে একপলক চেয়ে চোখ ফিরিয়ে আবারো তাকাল। কিরণের চোখের নিচে কালি, মুখ শুকিয়ে আছে, দেখে মনে হয় পেটে কিছু পড়েনি তার, চুল এলোমেলো।
কিরণ উজানের সামনে এসে দাঁড়াল। তার দিকে চেয়ে থাকা রহস্যময় চোখের দিকে চেয়ে কিরণ স্তিমিত কন্ঠে বলল,
‘গেইটটা একটু তাড়াতাড়ি খুলো।’
উজান চোখ ফিরিয়ে নেয়। গেইট খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি এখানে কেন? তাও নিজ থেকে?’
‘বাসা চেঞ্জ করব, জিনিসপত্র নিতে আসছি।’
‘বাসা চেঞ্জ করবে কেন? জাওভান জানে?’
‘আজকে জানবে।’
উজান আবার প্রশ্ন করে, ‘বলছো না যে কেন বাসা চেঞ্জ করবে?’
কিরণ কিছুটা বিরক্ত হয়। সেইদিন সরি বলার পর থেকে উজান এখন আর তার সাথে লাগেনা তেমন। আগে যেখানে কথায় কথায় অপমান করত এখন শুধু চোখ উল্টিয়ে সরিয়ে নেয়। একদম চুপচাপ থাকে। যেন কিরণকে এখন আর সে শত্রু হিসেবে দেখে না। উজানের হঠাৎ এই পরিবর্তন কিরণের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। কেমন ভদ্র ছেলের মতো কথাবার্তা হয়ে যাচ্ছে তার, যদিও উজানের ভদ্র কথাবার্তা সবার বেলাতেই খাটত শুধু কিরণ ছাড়া। কিন্তু এখন কত পরিবর্তন! যেমন এখন অনেক প্রশ্ন করছে, অথচ তার উচিত ছিল কিরণকে পাত্তা না দিয়ে নিজে গেইট খুলে নিজের কাজে মন দেয়া।
কিরণের থেকে উত্তর না পেয়ে উজান পেছন ফিরে দেখে কিরণের চিন্তিত মুখ।
‘কী এমন ভাবছো এত?’
কিরণের ধ্যান ভাঙে, ‘হুম কিছু না তো।’
‘সকাল থেকে কিছু খাওনি?’
‘হুম?’ কিরণের চোখে খেলা করছে বিস্ময়। উজান বুঝল কীভাবে?
‘বলছি সকাল থেকে কিছু খাওনি?’
‘খেয়েছি।’ কিরণ নিজেকে সামলায়।
‘তাহলে চোখমুখ এমন শুকনো লাগছে কেন?’
নাহ! কিরণ ঠিকই শুনছে এসব। উজানের মুখ থেকে এসব বেরিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগলেও বিষয়টা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে কিরণের। উজান কিনা তাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছে, আবার যেখানে উজান এক কথা একবার বলে সেখানে তাকে দু’বার বলছে! খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার। কিরণ উজানের মুখের দিকে ভালো করে চোখ মেলে দেখল, উজানকে বড্ড সতেজ লাগছে। গোসল করলে মানুষকে যেমন ফ্রেশ লাগে ঠিক তেমন।
‘দেখা শেষ?’
‘হুম?’
‘কী বারবার হুম হুম করছো? এক কথা কয়বার জিজ্ঞেস করা লাগে তোমাকে? ভেতরে চলো।’
এই বলে উজান পা বাড়াল ভেতরে। শেষ কথাটা কিছুটা ধমকের সুরে বলল উজান। কিরণ আসলেই ভাবে তার কী হয়েছে? এত টেনশনে মাথা আউলিয়ে গেছে নাকি?
কিরণ জুভের ফ্লাটে পরপর কয়েকবার কলিংবেল বাজায়, তারপর মনে পড়ে সে তো এখনো ঘুমায়। সে উজানের কাছে ফ্লাটের চাবি চাইল। উজান তখন তার নিজের ফ্লাট খুলছিল। কিরণকে চাবি দিতে গিয়ে তার হাত থেমে যায়। তার মুখ দেখে মনে হয় হঠাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা যেন তার মনে পড়েছে। সে চাবি আবার পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। কিরণের ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে আসে।
‘কী হলো?’
‘তুমি এখন আমার ফ্লাটে চলো।’
কিরণের মুখ হা হয়ে যায়, হতভম্ব গলায় বলে, ‘মানে কী?’
‘কানে শুনোনি? বলেছি আমার ফ্লাটে আসতে। জাওভান ঘুমাক। ও ঘুম থেকে উঠলে যেও।’
‘জাওভানের প্রয়োজন নেই, তুমি চাবিটা দাও, আমার কিছু জিনিস আছে, তা নিয়ে চলে যাব।’
‘কানে যায় না কী বলেছি? পরে যেও। চলো।’
উজান এবার কিরণের হাত টেনে ভেতরের দিকে অগ্রসর হয়। ঠিক সেই মুহুর্তে জুভের ফ্লাটের দরজা খুলে। তখন অনেকবার বেল বাজানোর জন্য এখন খোলা হয়েছে। কিরণ ঘাড় ঘুরায়। কিন্তু যা দেখে তাতে তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। পা থামে তার। উজান কিরণের হাত ধরা অবস্থায় থেমে যায় কিরণের থামা দেখে।
কিরণ দেখে দরজা খুলেছে ইয়ানা। তার পরনের জামা দেখেই কিরণ বেশ চমকায়। তার পরনে জাওভানের শার্ট। যা ইয়ানার হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। বোতাম কয়েকটা লাগানো, দেখে মনে হয়, দ্রুত পরতে যেয়ে উল্টাপাল্টা পরেছে।
ইয়ানাও চমক লাগা চোখে একবার কিরণ আরেকবার উজানের দিকে তাকায়। সে দ্রুত দরজা আটকাতে যায়। ততক্ষণে কিরণ ঝাড়ি মেরে উজানের হাত সরিয়ে দরজা ঠেলতে শুরু করেছে। ইয়ানা কিরণের শক্তির সাথে পারেনি। কিরণ দরজা ঠেলে খুলে তড়িৎ পায়ে জাওভানের রুমের দিকে হাঁটা দেয়। তার মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। পেটের জ্বালা, মাথার জ্বালা মিলে মনে হয় অগ্নিকাণ্ড ঘটাবে আজ।
জুভের রুমে গিয়ে কিরণ থামে। ইয়ানাকে দেখে যা ভেবেছিল তাই। বিছানায় নগ্ন অবস্থায় জাওভান ঘুমিয়ে আছে। তার পেট অবধি শুধু একটা চাদর জড়ানো। তার সারা গায়ে কামড়ের দাগ। বিছানায় গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছিটানো। ফ্লোরে ইয়ানার আন্ডার গার্মেন্টস আর জাওভানের শর্টস পড়ে আছে। এছাড়া প্রটেকশনের প্যাকেট পড়ে আছে বেডসাইড টেবিলে। টেবিলের ড্রয়ার খোলা, সেখানে কয়েকটা নিউ প্যাকেট গুছিয়ে রাখা। তারমানে এসব নতুন কিছু না!
কিরণের মনে হলো বুকের ভেতর কেউ ভারী পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। নাহ! ভালোবাসার না, ধোঁকার কষ্ট। জাওভানের প্রতি কিছুটা হলেও তার মায়া ছিল। জাওভানের এত পাগলামী দেখে ভেবেছিল সে সত্যি কিরণকে ভালোবাসে। এ ব্যাপারে কিরণ শতভাগ নিশ্চিত ছিল। অথচ আজ! সবটা মিথ্যে প্রমাণিত হলো। জাওভানের চরিত্র এত নোংরা! তার চরিত্রের সার্টিফিকেট তো ঐদিন বাসেই পেয়ে গিয়েছিল। সে ভেবেছিল জুভ অতটুকু পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে এসব করে বেড়ায় সে সম্পর্কে তো কিরণ সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। কিরণকে এভাবে ধোঁকা দিলো? এত নিষ্ঠুর ভাবে?
উজান কিরণের পিছু পিছু আসে। উজানের উপস্থিতি টের পেয়ে কিরণ পিছু তাকায়। তার চোখে জল। মুখশ্রী কঠিন। ভেজা গলায় শক্ত কন্ঠে উজানকে বলে,
‘তোমার ভাইয়ের কুকীর্তি তুমি আগে থেকেই জানতে তাই না? ছিঃ! এতটা নিকৃষ্ট মন কী করে হতে পারে কারো?’ বলেই ঘৃণায় একদলা থুথু ছুঁড়ল নিচের দিকে।
উজান নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখে রা নেই। কিরণ জাওভানের দিকে এগিয়ে যায়। আর ভাবতে থাকে, মানুষের কত রূপ! একেকজনের কাছে প্রকাশ পায় একেক রূপ। সে জাওভানকে ভালোবাসে না। কিন্তু তাকে এভাবে ধোঁকা দেওয়াটা কিরণ মানতে পারেনি। এমন যদি হতো যে, কিরণ যদি জানত জুভের চরিত্র আগে থেকেই এমন, তাহলে আজকের ঘটনাটা মেনে নিতে কষ্ট হতো না। কিন্তু জাওভান অভিনয় করে গেছে এই এতগুলো মাস। এত নিখুঁত অভিনয়! কাকপক্ষীটিও টের পায়নি।
কিরণ বেডসাইড টেবিল থেকে পানির জগ নিয়ে পুরোটা ছুঁড়ে মারে জাওভানের মুখে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় মুখে ঠান্ডা পানি পড়ায় হকচকিয়ে উঠে জাওভান। বিরক্ত নিয়ে সে ডান পাশে তাকায়, দেখে ইয়ানা আর উজান দাঁড়িয়ে আছে, উজানের চোখমুখ গম্ভীর। আর ইয়ানা তার গতরাতের শার্ট পরে আছে। কিন্তু পানিটা মারল কে? জাওভান এবার বাম পাশে তাকানোর সাথে সাথেই শক্ত চড় এসে গালে পড়ে। চড়টা এতটাই শক্ত ছিল যে জুভের গাল জ্বলে গেল। সে গালে হাত দিয়ে কিরণের দিকে তাকাতে গেলে আরেকটা শক্ত চড় তার আরেক গালে লাগে। কিরণ জুভের মুখের উপর থুথু ছুঁড়ে মারে।
‘তুই যে কি লেভেলের হিপোক্রিট তা এখানে না এলে জানতাম না। জানোয়ারের বাচ্চা।’ বলে আরেক দলা থুথু জুভের উপর ছুঁড়ে মেরে চলে যায় কিরণ।
এতক্ষণের ঘটনা বুঝতে একটু সময় লাগে জুভের। সে কিরণকে এই সময় এখানে আশা করেনি একদমই। কিরণ তো কখনো নিজ থেকে আসে না। আজ কেন আসলো? সে চেঁচিয়ে বলে,
‘কিরণ দাঁড়াও।’
জাওভান উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্ট পরতে পরতে বলে,
‘ফাক! কিরণ এখানে কী করছে? গড!’
তারপর উজানের দিকে তাকিয়ে চিল্লিয়ে উঠে,
‘তুই কিরণকে এনেছিস এখানে? মাদারফাকার।’
জাওভান খালি পায়ে কিরণের পিছু পিছু দৌড়ে যায়। ততক্ষণে কিরণ উধাও।
.
.
চলবে…
[ভুল হলে ধরিয়ে দিবেন]
#সায়র
#পর্ব_১৩
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
পড়ন্ত বিকেল। বাহিরে ছোট্ট উঠানে দুই তিনটা কুকুর একমনে ঘেউঘেউ করছে। উঠানের কোণে ছিমছাম একতলা বাসায় চারটা রুম। এগুলাকে রুম না বলে স্টোর রুম বলা যেতে পারে। বরং স্টোর রুমও এর চেয়ে বড় হয়। এই কনকনে শীতেও ঘরের ভেতরে এত গরম যে উজানের ইচ্ছে করছিল কোট খুলে ফেলতে।
উজান এসেছে ময়মনসিংহ। কিরণের বাড়িতে। শক্ত গদিতে উজান বসা। সূর্যের মৃদু কিরণ জানালার ফাঁক গলে মেঝের উপর থাকা উজানের পায়ের কাছে লুটোপুটি খাচ্ছে। উজান আর না পেরে কোট খুলে সাইডে রাখল। উঠে গিয়ে ফ্যানের সুইচ চালাতে গিয়ে দেখল কারেন্ট নেই। অথচ পাশের বাসা থেকে টিভির আওয়াজ আসছে।
‘ফ্যান চলবে না। মিটারের ব্যালেন্স শেষ।’
কিরণ রান্নাঘর থেকে আসতে আসতে বলল। তার হাতে লেবুর শরবত। উজানের সামনে শরবত রাখতেই উজান ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। এত গরম লাগছিল যে উজানের ভেতরকার আত্না বেরিয়ে যাচ্ছিল যেন।
‘থ্যাংকস।’ টিস্যুতে মুখ মুছতে মুছতে উজান বলে। একহাতে টিস্যু দিয়ে মুখ মোছাটাও যে কী সুন্দর হতে পারে তা উজানকে না দেখলে বুঝত না কিরণ। এই ছেলের সবকিছুতেই আর্ট। কিরণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাশের গদিতে বসে।
‘কী জন্য এসেছো?’ কিরণের প্রশ্ন।
বিকেলের রোদ তখন উজানের পা থেকে উঠে তার চোখে গিয়ে লাগছে। উজ্জ্বল মিষ্টি রোদের উজানের চোখ আর চুল ঝলমল করছিল। উজানকে দেখে কিরণের এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো সে কোনো বইয়ের চরিত্র থেকে উঠে আসা রমণীদের প্রাণপুরুষ। যাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা যায় চিরকাল।
‘তুমি জানো না কী জন্য এসেছি?’ উজানের পাল্টা প্রশ্ন।
‘এতদিন তো চেয়েছিলে আমি যাতে জুভের জীবন থেকে সরে যাই। আর এখন যখন চলে এসেছি তখন আবার ফিরে যাওয়ার জন্য বলছো?’
একটু থামে কিরণ। সে একটু ভুল বলেছে। সে চলে আসেনি, জুভের থেকে ছাড়া পাওয়া তার জন্য এই জীবনেও সম্ভব না বোধহয়। তার মন বলছে ঠিকই তাকে চলে যেতে হবে জুভের বন্দিনী হয়ে।
সে তাচ্ছিল্য করে বলে, ‘তোমার মতো ভাই আমি আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি জানো উজান। ছোটো ভাইয়ের অপকর্ম জেনেও কীভাবে তার জীবনে একটা মেয়েকে ঠেলে দিচ্ছো, মেয়েটা তোমার ভাইয়ের কাছে ভালো থাকবে না জেনেও, শুধুমাত্র ভাই সুখে থাকবে বলে। অথচ ভাবছো না একটা মেয়ের জীবন যে শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
‘তোমার কি জীবন বলতে আদৌ কিছু আছে কিরণ?’
উজানের প্রশ্নে চকিতে চায় কিরণ। বিভ্রান্তি খেলা করে তার মুখে, আসলেই তো! তার জীবন বলতে আদৌ কিছু আছে? নেই তো। কী অবলীলায় সত্যিটা বলে দিলো উজান!
কিরণকে চুপ থাকতে দেখে উজান বলে, ‘যাহোক, তুমি আজ এই মুহুর্তে আমার সাথে যাবে। জুভ পাগল হয়ে গিয়েছে তোমার জন্য।’
শেষ উক্তিটি শুনে মনে মনে হাসে কিরণ। হাহ! পাগল! তার জন্য পাগল! কি চমৎকার মিথ্যা কথা!
সেই মুহুর্তে উজানের ফোনে একটা মেসেজ আসে। উজানের ফোনটা টেবিলেই ছিল। না চাইতেও মেসেজটা চোখে পড়ে যায় কিরণের। এক নিমিষে তার চোখ পড়ে ফেলে মেসেজটা। তারপর এমনভাবে চোখ সরিয়ে নেয় যেন সে মেসেজটা দেখেইনি। উজান মোবাইলের আওয়াজ শুনে মোবাইলটা হাতে নেয়। একবার মেসেজে চোখ বুলিয়ে উল্টো করে রেখে দেয় যাতে কিরণ দেখতে না পারে।
‘তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি কিরণ, জাওভানকে তুমি যেমন ভাবছো ও ঠিক সেরকম নয়। তিনদিন আগে তুমি যা দেখেছো তা সম্পূর্ণটাই ভুল। চোখের দেখাটাও কিন্তু অনেক সময় ভুল হয় কিরণ। এই সবকিছুই ইয়ানার প্ল্যান ছিল। ও তোমাকে সহ্য করতে পারে না সেটা তুমি জানো, তাই ও অমন বিশ্রী খেলা খেলেছে তোমার সাথে। জাওভান শুধুমাত্র ঐ খেলার শিকার হয়েছে। ওর কোনো দোষ নেই। ইয়ানা এসব করেছে যাতে তোমার আর জুভের সম্পর্ক ভেঙে যায়।’
কিরণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। একটু আগের মেসেজের কথা মনে পড়ে তার, মেসেজটায় লিখা ছিল, “আমি যে ইয়ানার সাথে সবসময় মেকআউট করি এটা যাতে কোনোভাবেই কিরণ না জানে উজি। আমার শুধু কিরণকে চাই ব্যস। আর ও’কে এনে দেওয়ার দায়িত্ব তোর। অপেক্ষা করছি আমি।”
মেসেজটা যে জাওভানের তা বুঝতে সময় লাগে না কিরণের। কিন্তু উজান তো আর জানে না যে তার অগোচরে মেসেজটা কিরণ দেখে ফেলেছে। অথচ ভাইকে নির্দোষ প্রমাণ করতে উজান কি সুন্দর মিথ্যা বলছে। মনে হয় যেন কিরণ বিশ্বাস করবে!!
কিরণ মেসেজের কথা গোপন রেখেই শান্ত কন্ঠে বলল,
‘মানলাম এসব ইয়ানার প্ল্যান। কিন্তু ইয়ানা কী করে জানলো যে আমি ঐদিন জুভের বাসায় যাবো? ইয়ানা তো ঠিকভাবে জানেও না আমি কখন কোথায় থাকি বা কী করি। তাহলে সেইদিনই বা কীভাবে জানল?’
উজান এবার চুপ করে রইল। সে বুঝতে পারেনি কিরণ যে এই প্রশ্নটা করবে, নাহলে সে আরেকটু সাজিয়ে মিথ্যাটা বলত। আসলে জুভের জন্য তার টেনশন হচ্ছিল প্রচণ্ড। জাওভান অসুস্থ হয়ে গেছে প্রায়। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে সারাদিন কিরণের নাম জপছে, ঠিক প্রথমদিনের মতো। উজানের মন পুড়ে ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে। ছোটোবেলায় জাওভান যা যা আবদার করতো সব পূরণ করেছে উজান, সব। এখন তার কাছে কিরণকে ভিক্ষা চাইছে। উজান জানে যে জাওভানের বিশ্বাস একমাত্র তার ভাই-ই পারবে কিরণকে এনে দিতে।
কিরণের ফোন তখন তারস্বরে বেজে ওঠে। মায়ের ফোন। কিরণ ফোন ধরে জানতে পারল আজ কিয়াদের অপারেশনের ডেট। এটাই নাকি শেষ অপারেশন। তারপর কিয়াদ বাড়ি ফিরতে পারবে। কিরণ দ্রুত তার হাতব্যাগ নিয়ে নেয়। তার শরীরটাও ভালো নেই। খাওয়া দাওয়া হচ্ছে না ঠিকমতো, তার উপর এত টেনশন।
‘কোথায় যাচ্ছো?’
‘হসপিটালে।’ জুতা পরতে পরতে কাষ্ঠ গলায় বলে কিরণ।
উজান আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে বাহিরে চলে যায়। কিরণ ঘরে তালা লাগিয়ে বের হতে গিয়ে দেখে উজান গাড়ি নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
উজান গাড়ির দরজা খুলে বলে,
‘গাড়িতে উঠো।’
কিরণ বিনাবাক্যে উঠে পড়ে। এখান থেকে মেইন রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার মতো শক্তি নেই তার। আর হসপিটালেও পৌঁছাতে হবে তাড়াতাড়ি। তাই গাড়িতে উঠতে দ্বিমত করেনি।
হসপিটালে আসলে কিরণ তৃতীয় তালার দুইশত তিন নং ওয়ার্ডে যায়। রুমের শেষের দিকে কিয়াদের বেড।
উজানের দম বন্ধ হয়ে আসে হাসপাতালের ভ্যাপসা গন্ধে। চারিদিকে এত এত অসুস্থ মানুষ, এত কোলাহল তার মতো ইন্ট্রোভার্ট মানুষের মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। দম আটকে সে কিরণের পিছু পিছু যায়। রুমের প্রতিটা মানুষ উজানকে অবাক চোখে দেখছে। উজান রুমের অর্ধেক গিয়েই ফিরে আসে। রুমের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে।
কিরণের মায়ের চেহারা রুগ্ন। ঘুমন্ত কিয়াদের পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। কিরণকে দেখে তাঁর মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হয়।
‘কিরণ মা। এসেছিস!’
তার মা মমতাজ কিয়াদকে জাগাতে নেয়। কিরণ বাঁধা দেয়।
‘উঠিও না ও’কে। ঘুমাচ্ছে ঘুমোক।’
ঘুমন্ত ভাইয়ের চেহারা মায়া মায়া। কিরণ ভাইয়ের কপালে চুমু খায়। কিয়াদের মাথার পাশে রসায়ন আর পদার্থবিজ্ঞান বই। এই ছেলে হাসাপাতালে এসেও পড়ালেখা ছাড়েনি।
‘তোর অনেক কষ্ট হয় না রে কিরণ?’
কিরণ চোখ উঠিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তার মায়ের চোখ ছলছল করছে। চোখ ফিরিয়ে নেয় সে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সে নিজেও কান্না আটকাতে পারবে না। তাকে কান্না করতে দেখলে মাও ভেঙে পড়বে।
‘আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তোকে যদি জন্মটা না দিতাম, তাহলে তোর এই নিষ্ঠুর দুনিয়া দেখা লাগতো না। সব ভুল আমার।’
‘তুমি আবার শুরু করেছো মা।’ কিরণ বিরক্তির ভান ধরে চোখের জল আটকায়।
‘না রে, সত্যি বলছি। ছোটো থেকেই তো তোকে কত কিছু সহ্য করে আসতে হয়েছে। আমি মা হয়ে কিছু করতে পারলাম না তোর জন্য।’
‘ডাক্তার কী বলেছে? অপারেশনের ব্যাপারে।’ কিরণ কথা ঘুরায়। তার এখন অতীতের কথা মনে করতে ইচ্ছা করছে না।
‘ডাক্তার যেন কী বলেছে? বলেছিল অপারেশন করতে, কত টাকা যেন লাগবে..ভুলে গেছি।’ মমতাজ মনে করার চেষ্টা করলেন। দিনে দিনে তিনি স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছেন মনে হয়। কিছুই মনে থাকে না ইদানীং।
‘আচ্ছা আমি গিয়ে কথা বলে আসছি। তুমি থাকো।’
কিরণ উঠে বাহিরে যায়। বাহিরে উজানকে পায়চারি করতে দেখে। কিরণ পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিরণকে কোথাও যেতে দেখে উজানও তার পিছু নেয়। কিরণ রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করে অপারেশনের ব্যাপারে। আর জানায় সব মিলিয়ে মোট পঁচানব্বই হাজার লাগবে।
কিরণের ব্যাংকে এত টাকা নেই। যা ছিল তা দিয়ে এই কয়দিন মায়ের আর কিয়াদের ঔষধে শেষ হয়ে গিয়েছে। কিরণ ব্যাংক থেকে লোন নিবে ভাবে, যেহেতু এছাড়া আর উপায় নেই তার কাছে।
কিরণ হসপিটালের বাইরে বের হলে উজান পেছন থেকে ডাক দেয়।
‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।’
কিরণ ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, ‘লাগবে না।’
এই বলে আবার হাঁটা দেয়। উজান দৌড়ে এসে কিরণের হাত ধরে থামায়।
‘হাত ছাড়ো উজান।’
‘লিসেন কিরণ। তোমাকে সব দিক দিয়ে সাহায্য করব আমি। তার বদলে তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।’
‘না লাগবে আমার সাহায্য, না আমি আপনার সাথে যাব।’ চিৎকার করে উঠে কিরণ। হাত ছাড়িয়ে নিতে চায় সে। পারে না। উল্টো উজান আরো শক্ত করে চেপে ধরে।
‘পাবলিক প্লেসে সিন ক্রিয়েট করো না। সবাই দেখছে।’
কিরণ চারিদিকে তাকিয়ে দেখে প্রত্যেকটা মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিরণ শান্ত হয়। উজান কিরণের হাত টেনে ধরে দোকানের কোণায় নিয়ে আসে।
উজান বড় করে শ্বাস নেয়। মুখ গম্ভীর করে বলে,
‘তুমি বাধ্য কিরণ। আমি শুধু ভদ্রতা বজায় রেখে তোমাকে যাওয়ার জন্য বলছি। জাওভানকে এখানে না নিয়ে এসে নিজে এসেছি শুধু তোমাকে বুঝিয়ে নিয়ে যেতে। আমার সাথে গেলে তোমারই লাভ। জুভকে যদি বলি তুমি এখানে আছো, তাহলে ও কিন্তু তোমাকে আর তোমার মা ভাইকেও ছাড়বে না, সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো নিশ্চয়ই। তোমাকে তো নিয়ে যাবেই, সাথে তোমার মা আর ভাইয়ের জীবনটাও শেষ করবে।’
কিরণ থমকানো গলায় বলে, ‘তুমি আমাকে থ্রেট দিচ্ছো?’
‘যা ভাবো।’ উজানের শীতল গলা।
কিরণের অশ্রুর ধারা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। তা দেখে মায়া হয় না কঠিন হৃদয়ের উজানের। সে গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বলে,
‘তোমার ভাইয়ের অপারেশনের টাকা থেকে শুরু করে সব টাকা আমি দিবো। তোমার চিন্তা করতে হবে না।’
‘ঠিক এরকম একটা ডিলের জন্যই আমি জুভের কাছে বন্দী হয়েছি। এখন আবার সেই একই ডিল!’ কিরণের কণ্ঠ রুদ্ধ। চোখ ঘোলা হয়ে আসছে ক্রমশ।
‘আমার ডিলটা মাত্র একমাসের ছিলো, তারপর তো তোমাকে আমি মুক্ত করেই দিয়েছিলাম। জুভ তোমাকে আটকিয়েছে, তাহলে দোষটা কি আমার? আর তোমাকে আমি বাড়তি আরো অনেক সুযোগ দিবো কিরণ। তোমার ভাইয়ের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য যা লাগে সব দিবো। নতুন পরিবেশ পাবে তোমার পরিবার। তুমি কি এখনো রাজী হবে না? নাকি নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে এই সুযোগটা হারাবে?’
কিরণ ধরা গলায়, ক্ষীণ কণ্ঠে শুধু এইটুকুই বলে, ‘তুমি অনেক স্বার্থপর উজান, অনেক স্বার্থপর।’
.
.
কিরণকে উজান নিজের বাংলোতে নিয়ে এসেছে। কিরণ বলেছে তার কিছুদিন সময় দরকার। সে জাওভানের সাথে এখনি দেখা করবে না। উজানও সময় দিয়েছে, তবে শর্তস্বরূপ কিরণকে জুভের সাথে ফোনে কথা বলতে হবে। জুভকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব উজানের।
কিরণকে তার বাসায় ছেড়ে দিতে চেয়েছিল সে, পরে মনে পড়ে, কিরণ বলেছিল এ মাসের শেষেই বাসা ছেড়ে দিবে। আর এ মাস শেষ আজকে। তাই উজান কিরণকে বলেছে সে তার ব্যাগ গুছিয়ে আনতে, বাকি জিনিসপত্র পরে উজান লোক দিয়ে নিয়ে যাবে। কিরণের আগে থেকেই প্রয়োজনীয় সব গুছানো ছিল। তাই সমস্যা হয়নি।
এ মাসের ভাড়া উজানই দিয়ে দেয় যেহেতু কিরণের কাছে তত টাকা ছিল না। ভাড়া দেয়ার সময় আয়াতের সাথে দেখা হয়ে যায় তাদের।
আয়াত কিরণকে দেখে বলে,
‘কিরণ তুমি কোথায় ছিলে গো? তোমার বয়ফ্রেন্ড তো আমার বাসায় এসেছিল কাল, সে কি হাঙ্গামা সৃষ্টি করেছে। আমি যত বলেছি তুমি কোথায় আছো আমি জানি না, তিনি তো বিশ্বাসই করেনি। উল্টো আমাকে থ্রেট দিয়েছে জানো। এখন তুমি এসে গেছ ভালোই হয়েছে। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমার বফের হুমকিতে।’
কিরণ জুভের হয়ে ক্ষমা চাইল। সে এখান থেকে চলে যাবে সেটা আয়াত আজই জেনেছে। কিরণের যে টাকার সমস্যা সেটা সে বুঝেছে। তবে সে বাবাকে বলে কিরণের থেকে কম ভাড়া নিতে পারত যদি উজানের উপর নজর ভালোভাবে গেঁথে যেত। কারণ উজানকে পেতে হলে কিরণকে মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো যেত। কিন্তু এখন তো উজানের থেকে নজর সরে গিয়ে আহযানের উপর পড়েছে, আর আহযান নিজেই এসে ধরা দিয়েছে। তাই আর কিরণকে তার লাগবে না। তাই সে কিরণকে বাসা ছাড়তে বারণও করেনি। তবে একটু খারাপ লাখছে, যেহেতু তার সাময়িক জুনিয়র ফ্রেন্ড ছিল কিরণ।
কিরণকে নিচের তলার একটা রুমে থাকতে দেয় উজান। আর কিরণকে সাবধান করেছে উপরের তলায় যাতে ভুলেও পা না মাড়ায়। কারণ সেখানে কিরণের পদচারণ তাকে ডিস্টার্ব করবে যা সে মেনে নিতে পারবে না।
কিরণ জুভের সাথে ফোনে কথা বলেছে। ভিডিওকলে বলতে হয়েছে। যদিও জুভ বুঝতে পারেনি কিরণ কোথায় আছে। কিরণের সাথে যখন কথা বলছিল জুভ এত আগ্রাসী হয়ে গিয়েছিল যে কথা মাঝে কিরণকে কল কেটে দিতে হয়েছে। দুইদিন হয় কিরণ এখানে এসেছে। তাকে নিয়ম করে প্রতিদিন দুইবার কল করতে হয় জুভকে। তার খোঁজখবর নিতে হয়। প্রথমে জুভ পাগল করেছিল কিরণ কোথায় আছে বলতে। পরে আর অবশ্য বলেনি। নিশ্চয়ই উজান কিছু একটা বলে সামলিয়েছে।
উজান এখানে সারাদিন থাকে, তবে কিরণের সাথে বলে না বললেই চলে। এখানে আসলে উপরের তলায় গিয়ে নিজের আর্ট আর স্কাল্পচারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার নাকি কয়েকদিন পর এক্সিবিশনে যেতে হবে।
সে দুপুরে এখানে আসে, আর রাত হলেই ফ্লাটে ফিরে যায়। মাঝখানের সময়টুকুতে সে কিরণের খোঁজ নেয়না, ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যায়। কিরণ তত মাথা ঘামায় না। উজানকে না দেখলেই ভালো, দেখলে বারবার তার স্বারপরতার কথা মনে পড়ে।
কিরণের ভাইকে কেবিনে শিফ্ট করেছে উজান। মমতাজকেও ভালো ডাক্তার দেখিয়েছে, অধিক টাকা দিয়ে নার্স রেখেছে আলাদা করে যাতে মমতাজের কষ্ট না হয়। কিরণ যখন মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিল তখন এক প্রসঙ্গে মমতাজ বলেন,
‘তুই যেই ছেলের কথা বলেছিলি না, সে তো অনেক ভালো রে।’
কিরণ বুঝতে পারে না প্রথমে, ‘কার কথা বলছো?’
‘ঐ যে তুই নাকি বিয়ে করবি কোন ছেলেটাকে। তোকে নাকি অনেক ভালোবাসে, ঐ ছেলেটা।’
কিরণ ভাবে জাওভান। জাওভান সম্পর্কে কিরণ তার মাকে কিছুই জানায়নি। বললে আরো টেনশন করবেন। তাই শুধু সে বলেছিল, এখানে একটা ছেলেকে তার পছন্দ হয়েছে, আর তারা বিয়ে করবে। তার মাও কিছু বলেনি, তার মেয়ে এত কষ্টের পর একটু সুখে থাকুক এটাই তো চায়।
কিরণকে চুপ থাকতে দেখে তার মা বলে চলে,
‘কাল এসেছিল এখানে, কিয়াদের জন্য কত বই এনেছে জানিস, খাবার আনল কয়েক পদের। আমার সাথে বসে অনেকক্ষণ গল্প করল। কত অমায়িক ব্যবহার! তোর সাথে অনেক মানাবে।’
কিরণ স্তম্ভিত হয়। জাওভান ওখানে গিয়েছে? জুভ তো জানেই না এসব ব্যাপারে, তাহলে সে কীভাবে যাবে?
‘মা, জাওভান ওখানে গিয়েছে?’
‘কে?’
‘জাওভান।’
‘সেটা আবার কে?’
‘যার কথা বলছো তুমি।’
‘ওর নাম তো উড়ান না জানি কী বলল।’
কিরণ চমকিত হয়। উজানের কথা বলছে না কি? নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলে, ‘উজান?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঐ উজান।’
কিরণের চোখে বিস্ময় খেলা করে। উজান গিয়েছে! কই একবারো তো বললো না সে!
‘মা, আমি তোমাকে যার কথা বলেছি সে উজান না, ওর নাম জাওভান। মনে নেই তোমার।’
‘কী নাম? জাওভান! কী জানি, আমার তো মনে নেই।’
‘যে গিয়েছে সে উজান, সে হচ্ছে জাওভানের বড় ভাই।’
‘ও বুঝেছি। বড় ভাইটা কত ভালো, না জানি ছোটো ভাইটাও কত ভালো হয়। দেখবি তোকে রানী করে রাখবে।’
কিরণ ভেতরটা দগ্ধ হয়ে যায় অদৃশ্য আগুনে। কষ্টের হাসি হেসে মনে মনে বলল, “হুম অনেক ভালো সে, আমার জীবনে তার চেয়ে ভালো লোক খুবই কম দেখেছি। একদম মাথায় করে রাখবে আমায়।”
.
.
চলবে…