সায়র #পর্ব_১৪

0
183

#সায়র
#পর্ব_১৪
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

কিরণের রুমটা অনেক বড়। তবে আসবাব কম। অ্যাটাচড আলমিরা। তাতে ডিজাইন করা ফুলের কারুকাজ। পাশে ছোট্ট ড্রেসিং টেবিল আর জানালার দিকে মুখ করে রাখা একটা টেবিল। স্লাইডিং ডোর খুললেই বারান্দা। যেহেতু তার রুম নিচের তলায় তাই মাটির কয়েকট ফুট উঁচুতে তার বারান্দা। এখান থেকে গার্ডেনের একাংশ নজরে পড়ে।

কিরণ চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। গত মাসের বেতন পেয়েছে মোট বেতনের অর্ধেক। চাকরি ছাড়ার দিন বস তাকে তিরস্কার করাটাও বাদ রাখেনি। কিরণ চুপচাপ মেনে নিয়েছে সব। দোষ তো তারই ছিল, অফিস অনেক কামাই দিয়েছে সে।

কিরণের জীবনে একটা বড় স্বপ্ন ছিল নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করা। ছোটো থেকেই কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ক্রাফ্টিং, সুই সুতার কাজ খুব ভালো জানতো। তার মন শৈল্পিক। মনে মনে কত ডিজাইন এঁকে রেখেছে সে, শুধু বাস্তব রূপ দিবে বলে। তার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে এসবের ব্যবসা করবে। এমব্রয়ডারি করা ব্যাগ, অঙ্কিত রঙিন শাড়ি, হাতে তৈরি ফুলের টব, ছেলেদের পাঞ্জাবী সবকিছু সে নিজের হাতে করে বিক্রি করবে। বড় শো রুমে তার এগুলা সারিবদ্ধভাবে সাজানো থাকবে। কারুকাজ করা শাড়ি পরে কাস্টমার রিভিউ দিবে, তার ডিজাইনের ব্যাগ হাতে কাস্টমার তার দোকানে আসবে, যা দেখলে মন ভরে যাবে কিরণের। ব্যবসা বড় হবে, আনাচে কানাচে তার নাম ছড়িয়ে পড়বে। তার আন্ডারে কাজ করবে শত শত মানুষ। সবাইকে কাজ শিখাবে। সবাই দেখবে তার সৃজনশীলতা, প্রশংসা করবে। এই স্বপ্নটাই দেখে কিরণ। স্বপ্নটা কি খুব বেশি কিছু?

কিরণ আলমিরা থেকে তার ব্যাগ বের করল। এখনো সবকিছু গুছিয়ে আলমিরায় রাখা হয়নি। ব্যাগ থেকে সোনালী পাড়ের সাদা শাড়ি বের করল। আঁচলে ছোট্ট গোলাপী সুতোর ফুল। এই শাড়িটার কিছু অংশ কিরণ কমপ্লিট করতে পেরেছে। শাড়িটার নিচে একটা ডিজাইনিং খাতা। কিরণ খুব যত্নে পেজগুলো উল্টাতে লাগল। একেকটা পেজে ম্যান্ডেলা আর্ট, হুপ আর্ট, বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন আঁকা। এগুলো এঁকেছিল কোনো এককালে। মাঝখানের একটা পেজে এসে তার হাত থামল। এখানে খুব সুন্দর একটা গাউনের বুক পর্যন্ত অর্কিড ফুল আঁকা। এটা শেষ করা হয়নি। শেষ করার মতো সময় হয়ে উঠেনি তার। এরকম অনেক কাজ আছে যেগুলো কিরণ সময়ের অভাবে করতে পারেনি।

জাওভান কিরণের শখের মূল্য দিতে জানত না। কিরণ যখন বলে তার স্বপ্নের কথা তখন জাওভান কিরণকে উৎসাহ তো দেয়ইনি বরং কিরণের তার চেয়ে বেশি অন্য কিছুকে প্রায়োরিটি দেওয়াটা মেনে নিতে পারেনি। যত রকমভাবে কিরণের কাজে ডিস্টার্ব করা যায় করেছে। জুভ যখন নিউ ইয়র্ক যেত তখন খালি কিরণ হাতে একটু সময় পেত। তখন সে এসব নিয়ে বসতো, অনলাইনে একবার খালি একটা ব্যাগ সেল করতে পেরেছিল। পনেরশ টাকায়। তাও একমাস মোবাইলে সময় দেয়ার পর। তারপর খুব বাজেভাবে ধোঁকা খায় কিছু কাস্টমারদের কাছ থেকে। এত পরিশ্রম ঢেলে তার শখের কাজগুলোর সে তৈরি করেছিল, চোখ ব্যথা নিয়ে মোবাইলে বায়ার খুঁজছিল, তাই ধোঁকাটা হজম করতে খুব কষ্ট হয়েছে কিরণের। তা নিয়ে রাতের পর রাত কেঁদেছেও। অনলাইন বিজনেসের প্রতি মন উঠে গিয়েছিল তার। তারপর সে সিদ্ধান্ত নেয় সে লোকালেই মার্কেট করবে। কিরণ তার দোকানের নামও ঠিক করে রেখেছে। ‘কিরণ বুটিক হাউজ’ নামটা কী খুবই কমন? আরেকটু আনকমন হলে ভালো হতো না? ভাবতে হবে।

কিরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ অনেকদিন বাদে সে একটু শান্তিতে কাজ করবে। উজানের থেকে দুই সপ্তাহ চেয়ে নিয়েছে। তারপর সে হোস্টেলে উঠে যাবে।

এখন সে উজানের আন্ডারে কাজ করে। টিউশনি করতে চেয়েছিল, কিন্তু উজানের বাংলোটা এতই দূরে যে আসা যাওয়াতেই সময় চলে যাবে। তাই উজান তাকে বলেছে তার হয়ে কিছু কাজ করতে। আর কাজের বিনিময়ে তাকে প্রতিদিন বেতন দেয়া হবে। কাজ তেমন কঠিন না। উজানের পেইন্টিং রুমে কিরণ যেতে পারবে এখন, শুধু কিছু সময়ের জন্য। সেই সময়ের মধ্যে উজানের আর্টগুলো ভালো করে প্যাকেজিং করা, ঘর পরিষ্কার রাখা, যত সরঞ্জাম আছে সব ঠিকভাবে সাজিয়ে রাখা আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, বাগানের পরিচর্যা করা ও বাগান থেকে সবচেয়ে সুন্দর ফুলগুলো এনে উজানের পেইন্টিং রুমের টবে সাজিয়ে রাখা। উজান এসব নিজেই করতে পারত, কিন্তু কিরণকে কাজে লাগানোর জন্যই এটা করা।

কিরণের কাছে উজানের কাজটা ভালোই লাগে। দিনে মাত্র কয়েক ঘন্টা এই কাজ, এই অল্প কাজেই অনেক টাকা পায় প্রতিদিন। তারপর বাকিটা সময় সে নিজেকে দেয়। কতদিন পর নিজেকে দেওয়ার জন্য একটু সময় পেল, এই সময়টাকে তো আর অবহেলা করা যাবে না। উজানের আর্টগুলো দেখে তার নিজের মধ্যেও অনেক আইডিয়া চলে আসে। সে হিসেবে কাজটা কিরণের পছন্দসই বলা চলে।

তার এখন আপাতত কোনো টেনশন নেই। মা ভাই ভালো আছে, সেও ভালো আছে। জাওভানকে তার আর এখন ভালো লাগে না। আগে যেই মায়াটা ছিল সেটাও কেটে গেছে। জাওভানকে নিয়ে সে টেনশনও করে না। জুভ তার মতো থাকুক। যা ইচ্ছা করুক। জুভের সাথে নাহয় সে বাকিটা জীবন অভিনয় করেই কাটাবে। কিরণের স্যাক্রিফাইসের জন্য যদি তার পরিবার যদি সুখে থাকে তাতে ক্ষতি কী? যা আছে ভাগ্যে তাই হবে।

কিরণের মনে তখন অন্য কিরণ এসে প্রশ্ন করতে চায়, ‘তুই নিজে সুখে থাকবি তো?’ এই প্রশ্নটা মনে আসার আগেই মনের কপাট খুব শক্ত করে আটকে রাখে কিরণ।

.
.

কিরণ রান্নাঘরে গিয়ে দুপুরের খাবার তৈরি করে। উজান আসলে উজান নিজেই নিজের খাবার রান্না করে। সে খুব স্বাস্থ্য সচেতন। কিরণের মতো সে ভাজা পোড়া, আনহেলদি খাবার এড়িয়ে চলে।

তখন কলিংবেলের আওয়াজ শোনা যায়। এই সময় এখানে কে আসলো? উজানের কাছে এক্সট্রা চাবি থাকে যার কারণে কিরণকে দরজা খোলার জন্য তটস্থ থাকতে হয় না। উজান তো নয়, তাহলে? কিরণ দরজা খুলবে তার আগেই লনে ইয়ানাকে দেখল। বাংলোর যেই সাইডে পুল ঐ সাইডেই লন। আর ঘর আর পুলের মাঝে কাঁচের বড় স্লাইডিং ডোর। দরজাটা খোলা। তাই ইয়ানা পুল পার হয়ে সেই দরজা দিয়েই ভেতরে ঢুকে। কিরণ তখন মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইয়ানার গতিবিধি লক্ষ্য করছিল।

ইয়ানার স্লিম দেহে ক্রপ টপ আর লং জিন্স। তার উপর বাদামী রঙের জ্যাকেট। কাঁধে ব্র্যান্ডের খুব সুন্দর একটা পার্স। হাতে বিভিন্ন ফুলের বড় একটা ব্যুকে। ইয়ানা আশেপাশে তাকিয়ে উজানকে ডাকতে লাগল। কিরণ অবাক না হয়ে পারে না। ইয়ানার কি ক্যারেক্টার বলতে আসলেই কিছু নেই? কিছুদিন আগে জুভের সাথে, এখন আবার উজানের সাথে ঢলাঢলি করতে এসেছে।

‘উজান নেই।’ কিরণ গমগম করে বলে। এগিয়ে যায় রান্নাঘরে।

ইয়ানা কিরণকে দেখে ভ্রু কুঁচকায়। কপালে ভাঁজ ফেলে এগিয়ে আসে। ডাইনিং আর রান্নাঘর সামনাসামনি, মাঝে কোনো দেয়াল নেই। মার্বেল টেবিলের উপর ফুলের তোড়াটা রেখে ইয়ানা প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায়,

‘তুই এখানে কী করছিস?’

‘নাচতেছি।’ কিরণ দাঁত কিড়মিড় করে উত্তর দিলো।

‘ত্যাড়া উত্তর না দিলে তোর চলে না?’

‘না।’

ইয়ানা ঘাড়ের পেছনে হাত বুলায়। চোখ উল্টিয়ে কিরণকে বলে,

‘তুই যে এখানে জাওভান জানে?’

‘জানবে না কেন? তার ভাইয়ের বাড়িতে আসছি আর সে জানবে না?’ মিথ্যে বলে কিরণ। তার কাছে মষে হলো ইয়ানা তার এখানে থাকার ব্যাপারটা জানে না। আর যদি মিথ্যেটা না বলত আর ইয়ানা যদি তা জুভকে কোনোরকমে বলে দিতো তাহলে বাঁশ খেতে হবে কিরণকে। জুভ জানে সে ময়মনসিংহ। কয়েকদিনের জন্য সেখানে থাকবে মা ভাইয়ের কাছে, যেহেতু তার ভাই অসুস্থ। সেটাই উজান জুভকে বুঝিয়েছে। এখন যদি ইয়ানার কাছ থেকে জানে যে সে এখানে তাহলে আবার কোন অঘটন ঘটে কে জানে!

‘একটা সত্যি কথা জানিস জাওভান সম্পর্কে?’ চেয়ার টেনে আরাম করে বসল ইয়ানা। ঠোঁটে শয়তানি হাসি।

‘জানার দরকার নেই।’ চুলায় তেল গরম দিল কিরণ।

‘আরে শোন না। অনেক ইন্টারেস্টিং কিন্ত। বলি তোকে। জুভ আর আমার সম্পর্ক কিন্তু অনেক আগে থেকেই বুঝলি।’ পা দোলাতে দোলাতে বলল ইয়ানা।

ব্যাগ থেকে একটা চুইঙ্গাম বের করে মুখে দিয়ে আবার বলল,
‘ওর সাথে আমার ইন্টিমেসি কিন্তু এই প্রথম না। অনেক মেকআউট করেছি আমরা, তোর সাথে সম্পর্ক হওয়ার আগে যতটুকু করেছি সম্পর্ক হওয়ার পরে আরো বেশি করেছি। কিন্তু তুই গাধী কিছুই বুঝতে পারলি না। জুভ তোকে বিয়ে করে ভোগ করতে চাইত। একদম পবিত্রভাবে। ওর আবার তোকে অপবিত্র করতে মনে বাঁধে কিনা। তোকে জাওভান ভালোবেসেছে ঠিক কিন্তু প্রথম শারীরিক সুখটা আমার কাছেই পায়।’

ইয়ানার লজ্জা করছে না এইসব নিয়ে কথা বলতে? জুভকে খারাপ করার পাশপাশি নিজে যে আরো নীচু হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না? কিরণ খুব শান্তভাবে বলে, ‘তা কত করে পেমেন্ট করত তোকে?’

ইয়ানা তেঁতে উঠল, ‘আমায় কি তোর স্লাট মনে হয়?’

‘জুভ তো তাই বলত।’

ইয়ানা হাত মুষ্টিবদ্ধ করল, ‘এগুলো তোর কাছে ভালো হওয়ার জন্য বলতো। দিনশেষে ঠিকই আমার কাছে চলে আসতো জুভ।’

বড় বড় শ্বাস ফেলল ইয়ানা। কিরণকে রাগাতে গিয়ে নিজেই ট্রিগার খেয়ে যাচ্ছে। শান্ত করতে লাগল নিজেকে।

‘ঐদিন আমাদের সারাদিন কোর্স করার কথা ছিল। কিন্তু তুই শালী এসে সব প্ল্যান ভেস্তে দিলি আমাদের। আচ্ছা সত্যি করে বলতো, তোর সেকেন্ড হ্যান্ড মাল ইউজ করতে ভাল্লাগে? না মানে জুভ তো অলরেডি সেকেন্ড হ্যান্ডেড।’

‘আর তুই তো মনে হয় কারো একশতম ইউজ করা মাল। একশটার সামনে পা মেলে দেস। এখন আবার আসছিস উজানের সামনে পা মেলতে।’

‘কিরণ!’ ইয়ানা কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। সে তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আর এই পর্যায়ে।

‘একদম চেঁচাবি না। এটা দেখছস? গরম তেল ছুঁড়ে মারব গায়ে। তারপর দেখব কয়জন আসে তোর কাছে।’

কিরণ নিজেও অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। চোয়াল শক্ত করে ফ্রাই প্যানের হাতল ধরল। ইয়ানা তা দেখে ভড়কে গেল কিছুটা। কিরণের ঠিক নেই। যা বলেছে তা করতেও দুইবার ভাববে না। ফোঁস ফোঁস করতে করতে ব্যাগ হাতে নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল,

‘তোর কপাল পুড়বে দেখে নিস। জাওভানের সাথে তুই সুখে থাকবি না। দিন রাত তড়পাবি।’

ইয়ানা দরজায় লাথি মেরে চলে গেল। কিরণ সামান্য হাসে। তার কপাল তো অনেক আগেই পুড়ে গেছে। আর কী পুড়বে? ইয়ানা যে কিরণকে রাগানোর জন্য এত কথা বলছিল তা কিরণ ইয়ানার ভাবমূর্তি দেখে আন্দাজ করে নিয়েছে। তাই সে নিজেকে শান্ত রেখে উল্টো ইয়ানাকেই রাগিয়ে দিয়েছে। জুভের জন্য তার ফিলিংস থাকলেই না সে ঈর্ষান্বিত হবে!

রান্না যখন কিরণের শেষ পর্যায়ে তখন উজান চলে আসে। তার হাতে কতগুলো ব্যাগ। নতুন কেনা কতগুলো বিভিন্ন সাইজের ক্যানভাস। উপরে ব্যাগগুলো রেখে সে নিচে চলে আসে।

দুপুরের রোদ স্লাইডিং ডোরের কাঁচ গলে ডাইনিং আর ড্রয়িংরুমকে আলোকিত করছে। ঘরটাকে অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত করে তুলছে। পুলের পানি চিকচিক করছিল আলোতে। উজান আজ রান্না করেনি কিছু। সকাল থেকেই তাকে এক্সিবিশনের কাজের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। তার আর্ট প্রোডাক্টস এসেছেও তিন ঘন্টা লেইট করে। রান্না করার উদ্দেশ্যে সে রান্নাঘরে ঢুকল।

কিরণকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী করছো?’

‘নাচি।’ কিরণ খিটমিট করে জবাব দিলো।

‘কিন্তু তুমি তো রান্না করছো।’

কিরণ কোমরে হাত দিয়ে পিছু ফিরল। চোখেমুখে বিরক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে বলল, দেখতেই তো আছো, ‘তাহলে আবার জিজ্ঞেস করো কেন? আজব মানুষ!’

এই বলে চুলা অফ করে প্লেটে খাবার বেড়ে ডাইনিংয়ে চলে গেল।

কিরণের এমন রিয়েক্ট করাটা উজান আশা করেনি। সে ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করেছিল। এতে এত রেগে যাওয়ার কী আছে? আজব মেয়ে!

উজানের তখন নজরে আসলো টেবিলের উপরে থাকা ব্যুকেতে। হঠাৎ ব্যুকে কোথা থেকে আসলো?

সে ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে বলল, ‘এটা কে দিয়েছে?’

কিরণ জবাব না দিয়ে খেতে থাকল। উজান দেখল র্যাপিং পেপারের নিচে ‘ফ্রম ইয়ানা’ লেখা। লেখাটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ফুলের তোড়াটা বিনে ফেলে দিলো। ইয়ানার সাহস কী করে হয় এখানে আসার!

উজান কিরণের দিকে ফিরে কিরণকে বলল, ‘ইয়ানা কি কিছু বলেছে তোমাকে?’

‘কিছু বলার ছিল নাকি?’

‘তাহলে মুড অফ কেন তোমার?’

কিরণ খাবার রেখে উজানের দিকে তাকাল, ‘বাব্বাহ! আপনি আবার কবে থেকে আমার খেয়াল রাখা শুরু করলেন?’

‘একই ছাদের নিচে যখন আছি তখন এইটুকু কি চোখে পড়ে না আমার? আমি কি অন্ধ?’

‘হ্যাঁ তুমি আসলেই অন্ধ। আজকের মুড অফ চোখে পড়েছে তোমার অথচ তোমার ভাইয়ের জীবনে গেলে যে জীবনটাই অফ হয়ে যাবে সেইটা চোখে পড়ে না? মজা নেও আমার সাথে? আমি কি পুতুল? এত আদিখ্যেতা আমার সাথে করতে আসবা না।’

কিরণ ভাতের প্লেট নিয়ে দ্রুতপদে স্থান ত্যাগ করল। রাগে তার ব্রহ্মতালু জ্বলছে। এত ঢং করে কেন উজান? কিরণকে জাহান্নামে ঠেলে দিয়ে বলছে “কষ্ট হচ্ছে?”

উজান নিরব। কিরণ যেহেতু তার বাড়িতেই আছে তাই ভদ্রতা দেখিয়ে একটু কথা বলে। অনেক তো অভদ্রতামি করে ফেলেছে সে। এখন যা-ই একটু সুন্দর করে কথা বলতে যায় তখনই কিরণ রেগেমেগে উঠে। মেয়ে মানুষের এত মুড সুইং কেন হয়?

.

.

উজানের হাতে সিলিকন ক্লে। এক্সিবিশনের জন্য যেই স্কাল্পচারটা তৈরি করেছে তা খুবই দৃষ্টিনন্দন। পেইন্টিং আর ভাস্কর্য দুটোই আছে। বড় একটা পোর্ট্রেট, বিমূর্ত এঁকে ছবির কোল ঘেঁষে একটা হাত বাহিরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেই হাতটা সিলিকন মাটির তৈরি। থ্রিডি লুক। উজান তার এই আর্ট নিয়ে স্যাটিসফাইড। ফাইনাল টাচ করে উজান তার টুলে বসল। ছবিটির দিকে চেয়ে রইল অনেক্ষণ।

হাত পা ঝাড়া দিয়ে টুল থেকে উঠে ছবিটা জানালার পাশের টেবিলে রেখে দিলো। হাত ধুয়ে এসে বারান্দায় গিয়ে বসল। তার এই বারান্দা থেকে বাড়ির পেছনের নদী স্পষ্ট দেখা যায়। সন্ধ্যার কুয়াশায় ঢাকা নদী। দূর থেকে শিয়ালের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নদীর বুকে মিটমিট করতে থাকা দুটো হারিকেনের হালকা আলো নজরে পড়ে। মৃদুমন্দ বাতাস এলোমেলোভাবে এসে উজানের গায়ে বারি দিচ্ছে। উজানের শীত লাগছে না, বরং সাদা শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে দিলো বাতাস লাগানোর জন্য। চোখের চশমাটা খুলে ফেলল। কপালের চুলগুলো বাতাসের সাথে খেলা শুরু করে দিলো।

নদীতে চেয়ে থাকতে থাকতে আনমনেই নজর গেল বারান্দার কোণায় রাখা ছোট্ট লম্বা তেপায়া টেবিলে। ধীর পায়ে অগ্রসর হলো সেখানে। টেবিলের উপর সাদা কাপড় দিয়ে কিছু একটা ঢেকে রাখা হয়েছে। উজান কাপড়টা খুব যত্নের সাথে সরিয়ে দিলো। চোখ শান্ত হয়ে এলো তার। সামনে খুব সুন্দর একটা নারীমূর্তি। এই ভাস্কর্যটার প্রতি উজানের আলাদা একটা টান কাজ করে। মেয়েটির গলার নিচ পর্যন্ত মূর্তিটি বানিয়েছে সে। এক হাতের উপর আরেকহাত রেখে মেয়েটি হাতের উপর মাথা দিয়ে শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। রমণীটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে উজানের চোখে ঘোর লেগে এলো। একটু এগিয়ে গিয়ে খুব সন্তর্পণে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো মেয়েটির ওষ্ঠে।

ঠিক সেই মুহুর্তে কিরণ উজানের রুমের দরজা খুলে। আজকে উজান অনেক জিনিসপত্র এনেছে। এগুলো ঠিক করে রাখার দায়িত্ব তো কিরণের। দরজা থেকে বারান্দার এপাশ ওপাশ সবটাই দেখা যায় যেহেতু উজান সবকিছুতেই কাঁচ লাগিয়েছে।

উজানকে এক নারীমূর্তির ঠোঁটে চুমু দিতে দেখে কিরণ হতবাক হয়ে যায়। গুটিগুটি পায়ে শব্দ না তুলে এগিয়ে যায় সে। উজানের মনে এত রোমান্টিকতা! এই সুন্দর সিন কি মিস দেয়া যায়? দুপুরের রাগ ভুলে কিরণের অনেক হাসি পেল। দ্রুত হাতে থাকা মোবাইল দিয়ে একটা ছবি তুলে নেয়। ছবি তুলতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। তার মনে নেই ক্যামেরার আওয়াজ যে অন করা। তাই ক্লিক ক্লিক শব্দ করে উঠে মোবাইলটি। এতেই ধ্যান ছুটে যায় উজানের। সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিরণ ধরা খাওয়া চোরের মতো মোবাইলটা সরিয়ে নেয়। উজান বারান্দা থেকে চলে আসে। তার মুখশ্রী কঠিন।

‘কারো রুমে ঢুকতে হলে যে নক করে ঢুকতে হয় সেই ম্যানারটুকু তোমার জানা নেই?’ উজান প্রখর চোখে চেয়ে আছে। কন্ঠ শীতল।

‘নক করলে তো আর দেখতে পেতাম না তুমি যে কত পারভার্ট!’ কিরণ হাসি চেপে বলে।

‘তুমি কী বোঝাতে চাইছো? কোন দিক দিয়ে আমাকে পারভার্ট লাগে?’

‘পারভার্ট না হলে কী আর একটা মূর্তিকে চুমু খেতে নাকি?’

‘আমি কী করব না করব সেটা কি এখন তোমাকে বলে করতে হবে?’

কিরণ দুদিকে জোরে জোরে মাথা নাড়াল, ‘নাহ তো, তোমার যা ইচ্ছা করো আমার কী?’

এই বলে সে উঁকি দিয়ে মূর্তিটা দেখল। মেয়েটি অনেক সুন্দর। চোখ বন্ধ করে আছে, হাতের উপর মাথা দিয়ে। মনে হয় ঘুমোচ্ছে।

‘ঘুমন্ত মেয়ের সুযোগ নিতে লজ্জা লাগে না?’ কিরণ ফিক হেসে দিলো কথাটি বলতে গিয়ে। কিন্তু উজানের ধারাল দৃষ্টি তার দিকে বিদ্ধ হয়ে আছে দেখে হাসি থামানোর চেষ্টা করে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

কয়েক মুহুর্ত উজান কিরণকে তার সূচালো দৃষ্টির তোপে রেখে ফের বারান্দায় চলে গেল। সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলো মূর্তিটাকে।

‘নিচে যেই মাটিগুলো পড়ে আছে সেগুলো পরিষ্কার করে ক্যানভাসগুলো আনপ্যাক করো।’
উজান হুকুম করল।

কিরণ কাজে লেগে পড়ল।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here