সায়র #পর্ব_১৫

0
170

#সায়র
#পর্ব_১৫
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

কিরণ ঘুম থেকে উঠল সকাল সাড়ে সাতটায়। প্রকৃতি তখন হীমশীতল। গত রাতে জানালা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছির বিধায় সারা রুমে ঠাণ্ডার দাপট চলছে। শীতে দাঁতে দাঁত লেগে আসছিল কিরণের। গায়ে চাদর জড়িয়ে মাথায় মাঙ্কি টুপি পরে রান্নাঘরে আসলো। কড়া এককাপ চা বানিয়ে ড্রয়িংরুমে বসল। বাহিরে এতই কুয়াশা যে দেখলে মনে হয় এখন ভোর চারটা। সামান্য আলোটুকুও নেই।

হঠাৎ ঠকঠক শব্দ করে উঠল মেইন দরজাটা। কিরণ তখন চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিচ্ছিল। আকস্মিক আওয়াজে কিরণের আত্না তড়াক করে লাফিয়ে উঠে যার দরুন তার ঠোঁট পুড়ে যায়। পুড়ে যাওয়া ঠোঁটটাকে সামান্য কাতরানোর সময় না দিয়ে আবারো আওয়াজ আসলো। এবার কলিংবেলের আওয়াজ। কিরণ ভাবে আবার ইয়ানা আসেনি তো? সে গিয়ে কীহোলে চোখ রাখতেই দেখে উজান। উজানের কাছে তো চাবি থাকেই তাহলে? কিরণ দরজাটা খুলে দিতেই উজান বড় বড় পা ফেলে উপরে চলে যায়। কম সময়ের জন্য হলেও কিরণ লক্ষ্য করে উজানের কপালে গালে রক্তের দাগ, উজানের গালে থাকা কাটা দাগ থেকেও রক্ত বের হচ্ছে। সে কিছু বলার সুযোগ পায় না। তার আগেই উজানের রুমের দরজা বন্ধের আওয়াজ পাওয়া যায়।

কিরণকে কপাল কুঁচকে ভাবতে থাকল আসলে ঠিক কী হয়েছে? হঠাৎ উজান চোট পেল কীভাবে? কারো সাথে মারমারি করেনি তো? উজান তো ঐরকম ছেলেও নয়। আবার করতেও তো পারে। কিরণ এসে সোফায় বসল পা উঠিয়ে। ততক্ষণে চা হাফ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে গেল কিরণের। কিন্তু চা তো আর ফেলে দেয়া যাবে না, আবার গরম করতে জ্বালা, তাই সে শরবতের মতো এক চুমুকে চা পান করে নিলো।

তারপর ঝিম ধরে বসে রইল সোফায়। আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। তাই এখন ঘুম আসছে। সোফাতেই ঢুলতে লাগল সে। চোখটা যখন একটু লেগে আসবে আসবে করছে তখনই মোবাইল টুংটুং আওয়াজ তুলে বেজে উঠল। কিরণের মুখ দিয়ে বিশ্রী একটা গালি আসতে গিয়েও আসলো না। মোবাইল নিয়ে দেখে জাওভান ভিডিও কল করেছে।

চ কারান্ত শব্দ তুলে কিরণ তার রুমে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ে। ক্যামেরাটা নিজের দিকে এমনভাবে সেট করল যাতে জুভ আশপাশ না দেখতে পারে।

জাওভান ভিডিও কল দিয়ে চুপচাপ কিরণকে দেখতে থাকে। সে বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। জুভের মুখটা হাসি হাসি। জাওভান কথা না বলা অবধি কিরণ কোনো কথা বলল না। সে মুখ গম্ভীর করে রেখেছে।

‘আমার কিরণটার মন খারাপ?’ জাওভান স্মিত কণ্ঠে বলল।

‘নাহ তো।’ কিরণ স্বাভাবিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। জুভের সাথে এখনও সে স্বাভাবিক হতে পারেনি। জুভকে দেখলেই তার মাথা গরম হয়ে যায়। ইচ্ছে করে জুভকে মেরে ফেলতে। তাহলে এর মতো জানোয়ার বিয়ে করা লাগতো না।

‘তাহলে মুখ অমন করে আছো কেন জান?’

‘উঁউঁ জান। ঢং কত ছাগলের!’ কিরণ মনে মনে ভেংচি কাটে।

‘কথা বলছ না কেন?’

‘মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি তো তাই।’

‘ওহ। জান শুনো। তোমার সাথে একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করতে চাই আমি।’

‘হুম বলো।’

‘তুমি মনোযোগ দিচ্ছো না।’

‘আমার মনোযোগ আছে। তুমি বলতে থাকো।’ কিরণ অবহেলায় বলল।

‘আচ্ছা শুনো। মন দিয়ে শুনবে। কোনো রিয়েক্ট করবে না প্লিজ।’

‘আরে কী আজব, বলো না তুমি।’ কণ্ঠে বিরক্তি।

‘ওয়েট।’ জুভ বড় একটা শ্বাস নিলো। বলা আরম্ভ করল, ‘ঐদিনকার ব্যাপারটা তোমার কাছে ক্লিয়ার করা উচিত।’

‘আমি শুনতে চাই না ঐসব ব্যাপারে। আর কিছু বলার থাকলে বলো।’

জুভ ভাবে কিরণ অভিমান করেছে। অথচ কিরণের মনটা বিষিয়ে উঠছিল জুভের এই ঢঙে। এখন আবার কী কাহিনী বানায় কে জানে!

‘না তোমাকে শুনতেই হবে। যদি না শোনো আমি কিন্তু ময়মনসিংহ চলে আসবো। তখন সামনে বসিয়ে শোনাবো।’

‘আসা লাগবে না, বলো।’

‘ঐদিন কী হয়েছিল কী, রাতের বেলায় আমি এডাল্ট ভিডিও দেখছিলাম।’

কোনো দ্বিধা ছাড়াই জুভ বলে যাচ্ছিল আর কিরণ দাঁত খিচিয়ে তার বানানো গল্প শুনতে লাগল।

‘তখন হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠে, তো আমি ভেবেছি উজান। তাই আমি দরজা খুলেই আবার রুমে চলে আসি। আমি জানতাম না আসলে যে ইয়ানা এসেছে। আমার রুমের দরজাও তখন খোলা ছিল আর দেখি কেউ একজন হেসে উঠল। ফিরে দেখি ইয়ানা, হাতে গোলাপ ফুল কতগুলো। আমি মোবাইলটা রেখে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম ততক্ষণে। আমার খুব রাগ লাগছিল ইয়ানাকে দেখে, ও’কে বের হয়ে যেতে বললাম। ও বলল, সে ভেবেছিল উজান বাসায় আছে। কারণ উজান নাকি ইয়ানাকে বলেছিল সে রাতে বাসায় আসবে। আমাকে অনুরোধ করল এখন যাতে একটু থাকতে দেয় তারপর উজান এলে চলে যাবে। উজানের ফ্ল্যাটের চাবি আমার কাছে ছিল না যে ইয়ানাকে ওখানে পাঠাব। তখন আমার আসলেই যে কী হয়েছিল আর কোন পাগলা কুকুর কামড়িয়েছিল যে ইয়ানাকে আমি থাকতে দিয়েছিলাম!!’

এই বলে জুভ থামল। কিরণের প্রতিক্রিয়া তখন নির্বিকার। কিরণকে এমন নির্জীব থাকতে দেখে জুভের খুব কষ্ট হয়। তার কিরণটা ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে!

‘জান এগুলো শুনতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?’ জুভের চোখে অনুতপ্ততা।

‘তুমি বলতে থাকো।’ গম্ভীর কন্ঠ কিরণের।

‘আমি কিন্তু তখন একটা শর্টস পরেছিলাম। তারপর আমি দরজা বন্ধ করেই ভিডিও দেখতে বসলাম। তখন ইয়ানা নক করল দরজা। আমি মোবাইল রেখে দরজা খুলে দিলাম। ও বলল, ওর জামা ভিজে গেছে পানি পড়ে। ঠাণ্ডায় থাকতে পারছে না তাই আমার একটা টিশার্ট বা শার্ট দিতে। ও নিজেই একটা শার্ট বেছে নিলো। আমি তখন খাটে বসে ছিলাম আর ওর যাওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। ও তখন আমার ওয়াশরুমে গিয়েই চেঞ্জ করে আসলো। আমার অনেক ঘুম আসছিল তখন, ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়ব। মোবাইল অফ করে আমিও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তো ও হঠাৎ আমার সামনে আসে আমার শার্ট পরেই। আমার তখন চোখে ঘুম। কিন্তু ও রুম থেকে যাচ্ছিলোই না। আমি বললাম যে যাওয়ার সময় দরজা আটকে যেতে। বিশ্বাস করো আমার মাথা যে কেনো ঐদিন শান্ত ছিল আমি নিজেও জানলাম না। আমার উচিত ছিল ও’কে ধাক্কা মেরে বের করে দেয়া অথচ আমার এসব মাথাতেই ছিল না।’

কিরণ তখন বিড়বিড় করে বলল, ‘মাথায় থাকবে কীভাবে, তখন তো খালি আজেবাজে ভিডিও মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিল।’

‘কিছু বললে কিরণ?’

‘বলছি তারপর কী হয়েছে?’

‘তারপর আমার যখন চোখ লেগে আসছিল অনুভব করলাম ইয়ানা আমার পাশে এসে বসে আমার দিকে এগিয়ে আসছে কিস করার জন্য। কিন্তু আমার তখন অনেক ঘুম পাচ্ছিল যে আমি ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেই। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আর সকালে উঠে তোমাকে দেখি। তোমাকে রাগতে দেখে আর ইয়ানাকে আমার শার্টে দেখে আমার তখন মনে হয়েছিল তুমি হয়তো ভুল ভাবছো আমাকে। আসলেই তাই। আমি কিন্তু নেকেড ছিলাম না কিরণ। আমার পরনে শর্টস ছিলো, তুমি খেয়াল করেছ কিনা জানি না।’

কিরণের মনে পড়ল জুভের কোমর থেকে বাকি অর্ধেক চাদরে জড়ানো ছিল। আর ওর শর্টস ফ্লোরে পড়ে ছিল।

‘লাভ, তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। ইয়ানার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ও আসলে তোমাকে সহ্য করতে পারে না তাই এই নাটকটা করেছিল যাতে তোমার আর আমার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়। আমি কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে কথাই বলিনি আর ইন্টিমেসি তো দূরের কথা।’ এই বলে জুভ মুখ ছোটো করে ফেলল।

কিরণ মনে মনে বলল, “ওহ! আর কিছু বলবেন? মাইক সামনে ধরব? উজানের ফোনে যে মেসেজ পাঠিয়েছেন সেটা আমি দেখিনি ভেবেছেন? ছাগল, কাহিনীও সুন্দর করে বানাতে জানে না।”

‘তবে তোমার ভুল বোঝারই কথা। তোমাকে ভুল বোঝানো হয়েছে।’

এ পর্যায়ে কিরণের কান খাড়া হয়ে গেল, ‘মানে?’

‘সব উজানের দোষ। উজান হয়তো জানতো এসব ব্যাপারে তাই সে তোমাকে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে যাতে তুমি আমাকে ভুল বুঝো। আসলে ঘরের শত্রুই বিভীষণ।’ বলেই জুভ চোয়াল শক্ত করে ফেলল।

‘ওয়েট, এখানে উজান আসলো কোথা থেকে?’

‘কারণ ও তোমাকে নিয়ে এসেছে।’

‘তুমি কীভাবে বুঝলে যে ও নিয়ে গিয়েছিল আমায়?’

‘তুমি কোনোদিন নিজ থেকে আমার বাসায় আসতেই না। অথচ সেইদিনই আসলে, তাও আবার তোমার সাথে ছিল উজান। এসব উজানেরই প্ল্যান। শালা মাদারফাকার।’

কিরণ হতবাক হয়। নিজের ভাইকে ভুল বুঝে আবার গালাগাল করছে? হঠাৎ কিরণের মনে পড়ল উজানের ওই অবস্থা। জাওভান কিছু করেনি তো? সে জিজ্ঞেস করল,

‘উজান তো গতকাল বাসায় গিয়েছিল, তুমি এই ব্যাপারে কিছু বলেছ?’

‘বলেছি মানে, একদম ধুয়ে দিয়েছি ও’কে।’

‘কী করেছো? মেরেছো?’

‘একটু মারতে পেরেছি, আমার তো ইচ্ছা ছিল ও’কে জীবন্ত কবর দিবো। অথচ ও আমাকেই আহত করল। দেখো,’

এই বলে জুভ তার হাতের আর পেটের ক্ষত কিরণকে দেখাল।

‘তবে আমিই উজানকে বেশি মেরেছি জানো।’ কথাটা বলে জুভ ঠোঁট টেনে হাসলো। কিরণ হতভম্ব। ভাইকে মেরে আবার সেটা প্রাউড করে বলছে যেন বড় কোনো পুরষ্কার পেয়েছে।

উজান তো কিরণকে নিয়ে যায়নি, বরং কিরণ নিজেই গিয়েছিল তার কাজে। আর উজান উল্টো ভাইয়ের দোষ ঢাকার জন্য কিরণকে ফ্ল্যাটে ঢুকতে বারণ করেছিল। জাওভান কি আসলে কোনো সাইকো? কিরণ একজন বাইরের মেয়ে। আর এই বাইরের মেয়ের জন্য নিজের ভাইকে মারল? তাও আবার জুভের নিজের মনে গড়া বানোয়াট কাহিনী যেখানে আসলেই উজানের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। যেই ভাই ছোটো ভাইয়ের অপকর্ম ঢাকতে একশোটা মিথ্যা বলল, জুভকে খুশি রাখার জন্য কিরণকে অনুরোধ করল, সেই ভাইকে ভুল বুঝে তার উপর হাত উঠিয়েছে! সত্যি না জেনেই জাওভান এমন কাজ করেছে! উজান জুভকে বাঁচাতে বলে ইয়ানা দোষী আর এদিকে জুভ উজানকে ফাঁসাতে বলে উজান আর ইয়ানা দোষী। কেউ মিথ্যে সাজাতেই পারে না। কে মিথ্যে বলছে আর কে সত্য বলছে?

কিরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তোমারই ভুল হচ্ছে জুভ। উজান আমাকে নিয়ে যায়নি, আমিই গিয়েছিলাম।’

‘তুমি উজানকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলছো না তো?’ জুভ সন্দেহী গলায় বলল।

কিরণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ‘আজব! আমি মিথ্যে বলব কেন? এতে আমার কী ফায়দা? নিজে ভুল করে খালি অন্যের উপর দোষ চাপাও কেন তুমি?’

‘বললাম তো আমার কোনো ভুল নেই। এসব ইয়ানা ইচ্ছে করে করেছে। ঐ ডাইনীকে আমি কাছে পাই। মেরে ফেলব।’

কিরণের এখন কিচ্ছু বলতে ইচ্ছা করল না। কৈফিয়ৎ দিয়ে উজানের পক্ষে কথা বলার কোনো মানেই নেই। একদম ঠিক হয়েছে, আমার জীবন হেল করে নিজেরা সুখে থাকবে? হাহ!

‘রাখো এখন, তোমার সাথে কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। আমার ক্ষুধা লেগেছে আমি গেলাম।’

‘তুমি খাও আমি দেখি।’

‘মোবাইলে চার্জ নেই। রাখি, পরে কথা হবে।’ খট করে কেটে দিলো ফোনটা।

সঙ্গে সঙ্গেই জুভের মেসেজ, ‘বিকেলে কল করব লাভ।’

কিরণ ফোন অফ করে দিলো। উজানের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে হবে। কিরণ মন্থর গতিতে উজানের রুমে গেল। দেখল দরজা ভেজানো। তাও নক করল কিরণ, যদি আবার অভদ্র বলে অপমান করে? অনেকক্ষণ নক করার পরেও যখন উজান এসে দরজা পুরোপুরি খুলল না তখন কিরণ দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল উজান বারান্দায় বসে আছে। সে এবার অনুমতি ছাড়াই ঢুকে গেল। বেতের চেয়ারে উজান বসে আছে। দৃষ্টি তার শুন্যে। মুখের হাবভাব বুঝতে পারল না কিরণ বুঝেছেই বা কবে সে? উজান হাসুক, রাগুক, কষ্ট পাক, তারপরও তার মুখ নির্বিকার থাকে। এবারও তাই। তার ভেতরে আসলে কী চলছে কিরণ বুঝতে পারে না। কিরণ গলা খাঁকারি দেয়। তাতেও উজান তার দিকে ফিরল না।

তাই কিরণ দুহাত পেছনে নিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ কী লাভ হলো ভাইয়ের জন্য এতকিছু করে? যেখানে তোমার ভাই তোমাকে বিশ্বাস অবধিও করে না!’

উজান তাও চুপ। কিরণ উজানকে ভালো করে দেখল। উজানের চশমা নেই, কপাল কেটে রক্ত শুকিয়ে গেছে, গালে কালচে দাগ, ঠোঁট কেটে গেছে। ভালোই মেরেছি দেখি!

কিরণ এবার ধীর পায়ে স্থান ত্যাগ করে।

উজান চোখ বুজে মাথা হেলিয়ে দেয় চেয়ারে। খুব বড় করে গভীর শ্বাস ফেলে। ভেতরের বিষাদ, তিক্ততা বের করতে চায়, পারে না।

গত রাতে যখন সে ফ্ল্যাটে যায় তখন গভীর রাত। দেরি হয়ে গিয়েছিল তার কাজ শেষ করতে করতে। তখন জুভ ঘুমে। জুভের সাথে উজানের তেমন একটা দেখা হয়ইনি বলা চলে।

কিরণ যখন চলে গিয়েছিল, উন্মাদ জুভকে সামলানোর জন্য ঐদিন শুধু উজান গিয়েছিল। তারপর যখন কিরণকে তার বাংলোয় নিয়ে আসে, সে জুভকে এটা বলে যে কিরণের ভাইয়ের অবস্থা খুবই খারাপ তাই কিরণ ময়মনসিংহ রয়ে গেছে। জুভ মানতেই চায়নি প্রথমে, সে শোনামাত্রই ময়মনসিংহ যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু উজান তাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় রেখেছে। তারপর থেকে উজান নিজের কাজেই থাকে, আর জুভের সাথে তার দেখা হয় না। উজান যখন বাসায় আসে তখন জুভ ঘুমে থাকে, আবার যখন চলে যায় তখনও জুভ ঘুমে থাকে। এমনিতেও তার এই বাসায় আসার কোনো দরকার নেই যেহেতু তার সব আর্ট সরঞ্জাম বাংলোতে নিয়ে গেছে। উজান চেয়েছিল বাংলোতেই থেকে যেতে, কিন্তু একা একটা বাসায় একজন ছেলে আর মেয়ে থাকবে সেটা কেমন অশোভন লাগে তার নিজের কাছে। তাই ফ্ল্যাটে চলে আসে।

বিষয়টা এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু না। আজ সকালে উজানের দরজায় তীব্র আঘাতের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই জুভ হঠাৎ তার উপর আক্রমণ করে বসে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উজানের পেটে দুইটা ঘুষি লাগায়। ঘটনার আকস্মিকতায় উজান হতভম্ব হয়ে যায়। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না কেন জুভ এমন করছে তাই সে জুভকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে শান্ত হতে বলে, কিন্তু জুভ শান্ত না থেকে উল্টো আরো তেড়ে আসে। হাতের কাছে পাওয়া ফুলদানী নিয়ে উজানকে মারতে চাইলে উজান নিজেকে রক্ষা করার জন্য জুভের পেটে লাথি দেয়। জীবনে প্রথম সে ভাইকে মারল, তা ভেবে তার ভেতরটা তখন আফসোসের উত্তাপে জ্বলছিল। লাথিটা বোধহয় একটু জোরেই লেগেছিল কারণ জুভ পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ে। উজানের এতে অনেক খারাপ লাগল। শত হোক ভাই তো! কিন্তু নিজেকে রক্ষা করার এর চেয়ে ভালো উপায় তখন তার মাথায় আসেনি। সে গিয়ে জুভকে ধরার চেষ্টা করলে জুভ তাকে বাঁধা দেয়। সে পেটে হাত দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে জুভের মুখের মধ্যে ঘুষি লাগিয়ে দেয়। এর মাঝেই জুভের কথাবার্তায় বুঝে গিয়েছিল সে ঐদিনের ঘটনার জন্য উজানকে দায়ী করছে। উজান কিছু বলার সুযোগ পায় না। তার আগেই জুভ হাতের কাছে যা পায় তাই ছুঁড়ে মারে। আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে।

উজান স্তব্ধ হয়ে যায় জুভের মুখের ভাষা শুনে। কী খারাপ ভাষায় তাকে গালাগাল করছে! গালিগালাজ অবধি ঠিক ছিল কিন্তু তারপর জুভ তার লাইন ক্রস করে ফেলে। চরম কিছু সত্যি কথা ছুঁড়ে মারে উজানকে। সে নির্বাক হয়ে যায় তা শুনে। জুভের এই কথাগুলো তীরের মতো ছুটে এসে উজানের বুকের মধ্যিখানটায় আঘাত হানে। কঠিন কথার তীরের ফলাগুলো উজানকে ভেতর থেকে ছিন্নভিন্ন করে নিঃস্ব করে দিলো।

কার জন্য এতকিছু করল সে? ছোটো থেকে জাওভান যা চেয়েছে সব দেওয়ার চেষ্টা করেছে উজান, শুধুমাত্র তার ভাই ভালো থাকবে বলে। ভাইয়ের কষ্ট হবে বলে নিজের পছন্দ অপছন্দ পরিবর্তন করল! এই এত বিসর্জন, এত ত্যাগ কার জন্য করা! আজ সেই ভাইটি তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে উজান আসলে তার কেউই না! সে জুভের পরিবারে উড়ে এসে জুড়ে বসা একজন!

তারপর আর উজান কিচ্ছু বলেনি। অগোছালো পায়ে তক্ষুণি চলে এসেছে বাংলোয়।

.

.

কিরণ আবার এসেছে। হাতে তার এইডবক্স। উজান চোখ বন্ধ করে আছে। উজানের কি কষ্ট হচ্ছে? সে উজানের সামনের ছোট্ট টেবিলটায় বক্সটা রাখল। উজান চোখ মেলে তাকাল টেবিলের দিকে। কিছুই বলল না।

‘ক্ষতস্থানে লাগিয়ে নিন।’ এই বলে কিরণ চলে যেতে লাগল। তারপর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উজানকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

দীর্ঘ দশমিনিট পর উজান এইডবক্সের দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু বক্সটা খুলতে গিয়ে তার হাত টনটন করে উঠল ব্যথায়। ফলে বক্সা উল্টিয়ে পড়ল। উজান দুই হাতের দিকে তাকালো। দুই হাতের তালুর ক্ষত গভীর। কিরণ পেছন থেকে সবটাই দেখল। মানবতা দেখিয়ে এবার সে এগিয়ে আসলো।

‘হেল্প লাগবে?’

উজান কিরণের কণ্ঠ শুনে সোজা হয়ে বসে হাত গুটিয়ে নেয়। কিরণ তার পাশের চেয়ারটায় বসে এইড বক্সের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখল।

‘মুখ ফুটে বললে কি মুখ ক্ষয় হয়ে যাবে নাকি?’

উজানের চেয়ারের কাছাকাছি নিজের চেয়ার টেনে নিলো কিরণ। তুলা দিয়ে উজানের কপালের ক্ষত পরিষ্কার করতে লাগল। উজান একটা টু শব্দ করল না। দিগন্তে দৃষ্টি তার।

কিরণ পরিষ্কার করতে করতে উপদেশ দেওয়ার স্বরে বলল,

‘একদম ঠিক হয়েছে। আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি তোমার ভাইয়ের লাইফে ঠেলে দিতে চাইছিলে না? এখন সেই ভাইয়ের হাতেই মিথ্যা অপবাদে মার খেতে কেমন লাগলো? অন্যের ভালোর দিকে না তাকিয়ে নিজের ভালোটাও একটু বুঝো। তোমার ভাই আজীবন স্বার্থপরই থাকবে। তুমি কলিজা কেটে খেতে দিলেও বলবে লবণ কম হয়েছে।’

কিরণের কথা শেষে উজান তার দিকে তাকালো চট করে। কিরণ উজানের গালের দিকটা তখন পরিষ্কার করছিল। উজানের প্রগাঢ় শানিত দৃষ্টির সাথে কিরণের দৃষ্টি মিলিত হতেই কিরণের বুক কেঁপে উঠল আচমকা। হাত থেমে গেল তার। কয়েক মুহুর্ত স্থায়ী হলো সেই ধারালো দৃষ্টি। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিলো উজান। উজানের আহত ক্লান্ত মুখের প্রখর চাহনিতে কিরণের বুক তখনো কাঁপছিল। উজানের দৃষ্টিতে ছিল মর্মবেদনা। উজানের ভেতরটা কি তখন কাঁদছিল?

.
.
চলবে…
[সবাই জানাবেন কী বুঝলেন আজকের পর্ব পড়ে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here