সায়র #পর্ব_১৬

0
214

#সায়র
#পর্ব_১৬
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

জানালা দিয়ে প্রভাতের স্নিগ্ধ কিরণমালা উজানের রুমটাকে স্বর্গীয় আলোয় আলোকিত করে তুলছে। সূর্যের সোনালী কোমল আলোকরশ্মি গায়ে মেখে বাগানের ফুলগুলো দুলছে। সেদিকে উজানের নজর স্থির। কফিমগ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, একটু বাদে বাদে ঠোঁট সিক্ত করছে ধোঁয়া উঠানো গরম কফিতে। আরেকহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকানো। অফ হোয়াইট শার্টের বোতাম গলা অবধি লাগিয়ে পুরোদস্তুর ভদ্র ছেলের মতো দেখাচ্ছে তাকে। গতরাতে সে আর ফ্লাটে যায়নি। এখানেই রয়ে গেছিল।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে উজানের সম্বিত ফিরে। সে এসে দরজা খুলে দেয়। দেখে কিরণ দাঁড়িয়ে। কিরণ আজ একটু শপিংএ যাবে, তাই উজানকে বলতে এসেছে।

উজানকে সকালের মিষ্টি রোদে খুব স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। মুখের ক্ষতগুলোর চারপাশে কিছুটা কালচে। চশমা নেই তার। চশমা ছাড়া উজানকে দ্বিগুণ ম্যানলি লাগে।

উজান দরজা খুলে দিলো ঠিক তবে কিছুই বলল না। দরজা খুলে কিরণের দিকে তাকিয়ে আছে কিরণ কী বলবে সেই আশায়।

‘আমাকে একটু শপিং এ যেতে হবে। তোমার গাড়িটা ইউজ করতে পারি?’

‘না।’ উজানের কাটকাট জবাব।

এমন মুখের উপর অপমান করায় কিরণের মুখ ঝুলে গেল। সে ভেবেছিল উজান নরমাল বিহেভ করবে। কিন্তু সেই আগের উজানের মতো বিহেভ করছে যে কিনা কথায় কথায় কিরণকে অপমান করতো। সে থমথমে মুখে চলে আসতে নিলে উজান পেছন থেকে বলে,

‘দশটায় আমি শহরে যাবো। সাথে যেতে চাইলে রেডি হয়ে থেকো।’ এই বলে উজান ধাম করে দরজা বন্ধ করে দেয়।

কিরণ ভেংচি কাটে, যখন সাথে নিবেই তখন অপমান করার কী দরকার ছিল!

.

এক সপ্তাহ হয়ে গেছে কিরণের এখানে আসার। আর এক সপ্তাহের মতো থাকতে পারবে সে। তারপর একটা চাকরি খুঁজে সেই পুরোনো জীবনে ফিরে যেতে হবে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হয় কিরণের।

কিরণ মীরার সাথে যোগাযোগ করে বলেছে সে হোস্টেলে এবার উঠবে। আর মীরা নাকি পাশেই এনজিওতে চাকরি করে। সেখানে কিরণের জন্য একটা চাকরি জোগাড় করে দিবে। পদ ছোটো তবে তাতে কিরণের সমস্যা নেই। দুটো টাকা রোজগার তো হবে। কিরণ সিদ্ধান্ত নেয় চাকরি করার পাশাপাশি জুভকে না জানিয়ে সে নিজের ব্যবসা দাঁড় করাবে। তবে আগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে রাখবে। এই এক সপ্তাহে কিরণ অনেক কিছুই বানিয়েছে। কয়েকটা শাড়ি পেইন্টিং করেছে, কতগুলো ব্যাগ এমব্রয়ডারি করেছে, কার্ডবোর্ড দিয়ে ওয়াল হ্যাংগার, ওয়ালমেট, মিনিয়েচার হাউজ অনেক কিছুই বানিয়েছে। কিরণ একটা জিনিস বুঝেছে যে কিছু করার আগে প্রায়োরিটি থাকতে হয়। এই কাজগুলো প্রায়োরিটির লিস্টে রাখলে কাজটা নিত্যদিনের কাজের মতোই সহজ হয়ে যায়। কিরণ সকাল থেকে রাত অবধি কঠোর পরিশ্রম করেই এসব বানিয়েছে। তার মাঝে প্রতিদিন উজানের কাজও শেষ করেছে। কিরণের হাতে আর এক সপ্তাহ বাকি। এই এক সপ্তাহের মধ্যে অনেক কাজ এগিয়ে নিতে হবে কেননা পরে চাকরির জীবনে ঢুকলে এখনকার মতো অফুরন্ত সময় হাতে পাবে না।

কিরণের কাছে মনে হলো উজান আর ফ্ল্যাটে যাবে না, এখানেই থাকবে। কেননা ভাইয়ের থেকে পাওয়া আঘাতের পর উজান জুভ সম্পর্কে একটা কথাও বলেনি। উজান বাংলোয় থাকলে কিরণের জন্য একটা সুবিধা। সে উজানকে বলবে তার কাছে কিছু মাটি বিক্রি করতে। উজানের কাছে কয়েক ধরনের মাটি আছে। মাটিগুলো কিরণ দেখেছে, এগুলো দিয়ে খুব সহজে অনেক কিছু বানানো যাবে। এই মাটি উজান কোথা থেকে ইম্পোর্ট করে কিরণ জানে না। কিরণ এই ইম্পোর্ট করার খরচ চালাতে পারবে না। তাই সে উজানকে বলবে তাকে কয়েক বস্তা মাটি দিতে বিনিময়ে তার বেতনের থেকে কেটে নিতে।

সেই মাটি দিয়ে কিরণ জিনিসপত্র বানাবে। ছোটোবেলায় সে যে হোস্টেলে ছিল তার পাশেই ছিল কুমোরশালা। সেখানে সে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখতো কীভাবে কী বানায়, সে নিজেও চাচাদের বলে মাটি হাতে এটা সেটা বানাতো। তাই সে একটা পটারী হুইল কিনবে। তারপর পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আর এখন অনলাইনে দেখে নিজে বানাবে, মাটির হাড়ি, ফুলদানী, কাপ পিরিচ, হাতের চুড়ি, আংটি, ইউটিউবে দেখেছে কয়েকজন আঙুলের সমান ছোটো ছোটো ফুলদানী, পুতুল ইত্যাদি বানাতে। সেও বানাবে এসব, তার কাছে এই ছোটো জিনিসগুলো অনেক কিউট লাগে। কিরণের শখের শেষ নেই। তার চোখ চকচক করে যখন সে তার স্বপ্নের কথা ভাবে। নিজের দোকান, নিজ হাতে বানানো আসবাবপত্র, আহা! চোখের শান্তি মনেরও শান্তি।

‘কোথায় নামবে তুমি?’

উজানের আচানক প্রশ্নে ভাবনার সুতো কাটে কিরণের। সে এতক্ষণ গাড়িতে বসে কত কী কল্পনা করছিল!

‘এখানেই। তুমি কি কোথাও যাবে এখন?’

‘হুম।’ রাস্তায় দৃষ্টি রেখে জবাব দেয় উজান।

কিরণ কিছু না বলেই নেমে পড়ে। ভদ্রতার খাতিরে জানালা দিয়ে উজানকে বলে,

‘থ্যাংকস।’

এই বলে সে উজানের জবাবের অপেক্ষা না করে চলে যায় কারণ উজান জবাব দিবে না। কিন্তু কিরণকে অবাক করে দিয়ে উজান বলল,

‘ওয়েলকাম।’

কিরণ পেছনে ফিরবে তার আগেই উজান গাড়ি টান দিলো।

.

.

কিরণ শপিং করে মীরার সাথে দেখা করতে এসেছে। হোস্টেল সুপারের সাথে কথা বলবে। কিন্তু তিনি এখন নেই। দুপুর দুটো বাজে। কিরণ দুইঘন্টা ধরে অপেক্ষা করেছে, পরে যখন সুপারের আসার নাম নেই তাই সে চলে যায়। মীরাও তার সাথে আসে। সে যাবে টিউশনিতে। তারা চৌরাস্তার মোড়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে। এখান থেকে একটা সিএনজি ধরে কিরণ উজানের বাংলোয় যাবে, আর মীরা মাঝপথেই নেমে যাবে। সিএনজির লাইন রাস্তার ঐ পাড়ে। সে হাতের ব্যাগগুলো নিয়ে রাস্তার দুইপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে পার হতে নেয়। মীরা সামনে কিরণ পেছনে।

আচমকা বাম দিক থেকে ধেয়ে আসে একটা প্রাইভেট কার। কিরণ সেটা লক্ষ্য করেনি, সে হিসাব কষছিল তার কত খরচ হয়েছে শপিংএ। আর কয়েক কদম ফেললেই রাস্তার এ পাড়ে চলে আসবে সে। ঠিক চার সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়িটি কিরণের বাহুতে ধাক্কা দেয়। ভাগ্য সহায় ছিল কিরণের যে মীরা তৎক্ষণাৎ গাড়িটিকে খেয়াল করে আর কিরণের হাত ধরে টান দিয়েছে বিধায় তার শরীর গাড়ির নিচে চাপা পড়া থেকে রক্ষা পায়। আকস্মিক ঘটা ঘটনাটিতে কিরণের ব্রেইন কয়েক মুহুর্তের জন্য ব্লাংক হয়ে যায়। বুঝতে পারে না কী হলো তার সাথে। তার বাম হাতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়ার পর হুঁশ ফিরে। বাম হাত ব্যথায় যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। হাতের ব্যাগ ফেলে রাস্তায় বসে পড়ে কিরণ। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ে পিচ ঢালা রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে যায়। মাথা দুলে উঠে তার। দৃষ্টি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। চারিদিক কেমন ঝাপসা, তিমিরে ডুবা।

রাস্তায় মানুষের ভীড় জমে গেছে। গাড়িটি ভয়ে পালিয়েছে আরো আগে। মীরা চিৎকার করে উঠল কিরণের অবস্থা দেখে। সে সহ কয়েকজন মহিলা এসে দ্রুত কিরণকে উঠায় আর হসপিটালে নিয়ে যায়।

.

.

হসপিটালের তীব্র ফিনাইলের গন্ধ কিরণের নাকে সুড়সুড়ি দেয়। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে তার। পিটপিট করে চোখ মেলে। বুঝতে সময় লাগে সে এখন কোথায় আছে। হাত নাড়াতে গিয়ে দেখে সে ডানহাত শুধু নাড়াতে পারছে। আরেকহাতের উপস্থিতি টের পাচ্ছে না সে। যেন অবশ হয়ে গেছে। শ্রান্ত চোখে সে আশপাশটা দেখে। ভালো করে দেখতে পারল না। চোখ বুজে এলো যন্ত্রণায়। কিরণ কিছুক্ষণ চোখকে বিশ্রাম দিয়ে আবার তাকায়। ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখে এখন রাত। উঠে বসায় চেষ্টা করে। পারে না।

উজান তখন মেডিসিনের প্যাকেট হাতে কেবিনে ঢুকে। কিরণকে বসার চেষ্টা করতে দেখে আদেশ করে সে,

‘ডোন্ট মুভ কিরণ।’

কিছুটা হতচকিত হয় কিরণ। চোখ উঠিয়ে দেখে উজান দাঁড়িয়ে। তার পেছনে মীরার উদ্বিগ্ন চেহারা দেখা যায়। মীরা দ্রুত এসে কিরণের পাশে বসে। উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে,

‘এখন কেমন লাগছে কিরণ? বেশি ব্যথা করছে হাত?’

কিরণ জবাবে শুধু না বোধক মাথা নাড়ায়। ইশারায় বলে তাকে উঠে বসাতে। মীরা কিরণকে ধরে বসাতে নেয়। অসাবধানতা বশত তার হাত কিরণের বাম হাতে চাপ লাগলে ব্যথায় ককিয়ে উঠে কিরণ। তা দেখে মীরা ভয় পেয়ে ছেড়ে দেয় কিরণকে। উজান মেডিসিন রেখে তড়িৎ গতিতে এসে কিরণকে ধরে নেয়। কিরণের মাথা উজানের বুকে ঠেকছে। উজান একহাতে কিরণের মাথা চেপে ধরে আরেকহাতে কিরণের পিঠ গলিয়ে কোমর চেপে ধরে উঠে বসায়। কিরণের পোশাক তখন পেটের উপরে উঠে গিয়েছিল যার কারণে উজানের হিমশীতল হাত কিরণের কোমর স্পর্শ করে। হঠাৎ উজানের ঠাণ্ডা ছোঁয়াতে কিরণের অন্তরাত্মা ছলকে উঠে। কাঁপুনি দিয়ে উঠে শরীর। সেই কাঁপন উজানও টের পায়। সে কিরণকে ছেড়ে দিয়ে দূরে এসে দাঁড়ায়।

মীরা কিরণকে হসপিটালে এনে উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ছুটছিল। কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তখন মাথায় আসে জাওভানকে ফোন করার। ফোন করতে গিয়ে মনে পড়ে কিরণ যে ঢাকায় তা জাওভান জানে না। মীরা জানে কিরণ এই কথাটা লুকিয়েছে জুভের কাছে। তাই সে ভেবে না পেয়ে উজানকে কল করে। উজান তখন স্কাল্পচার ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের গাইড করছিল। মীরার কল পেয়ে ছুটে আসে হাসপাতালে। তারপর বাকি দিক সে সামলায়।

কিরণের হাতে ব্যান্ডেজ। ভাগ্যিস তার অস্থিভঙ্গ হয়নি। শুধু চোট পেয়েছে। ডাক্তার বলেছে কয়েকদিন লাগবে ব্যথা ঠিক হতে। এই সময় হাতে চাপ বা ভারী কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এই কথা শুনে কান্না এসে পড়েছিল কিরণের। সে যদি কোনো কাজ না করতে পারে তাহলে সে জিনিসপত্র বানাবে কী করে? একহাতে তো আর সবকিছু করতে পারবে না। আজকে এত মালপত্র কিনল শুধু আগামী এক সপ্তাহ কাজে লাগাবে বলে অথচ সে এখন বিছানায় পড়ে! কিরণের ভাগ্য এত খারাপ কেন?

তখন কিরণের মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইলটা ছিল কিরণের ব্যাগে যা মীরার কাছে ছিল। মীরা মোবাইল বের করে দেখল জুভের সাতষট্টিটা কল আর বাইশটা মেসেজ। এতক্ষণের এত চাপে সে খেয়ালই করেনি। সে কিরণের কাছে যায়।

‘কিরণ, জাওভান ভাইয়া কল করেছে।’

জাওভানের নাম শুনতেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় কিরণের। এই আরেক ঝামেলা কপালে গেড়ে বসেছে। একদম স্থায়ী হয়ে। সে মোবাইলটা ডান হাতে নিয়ে হালকা কেশে গলা ঠিক করে। রিসিভ করতেই জুভ ওপাশ থেকে হড়বড় করে বলে,

‘কিরণ তুমি আমার ফোন ধরছ না কেন? কোথায় তুমি? কয়টা কল করেছি সে খেয়াল আছে?’

জুভ আরো বলে যেতে লাগল। কিরণ চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেলল। ফোনটা কান থেকে একটু সরিয়ে আবার কানে দিলো।

‘তুমি বাড়িতে নেই কেন? ঘরে তালা কেন? কোথায় গিয়েছ? তোমার ভাই আর মা কোথায়?’

কিরণ আশ্চর্যান্বিত হয়। কী বলছে জাওভান?

‘কী বলছো এসব? তুমি কোথায় আগে সেটা বলো?’

ওপাশ থেকে জুভের ক্রোধান্বিত গলা শোনা যায়, ‘আমি ময়মনসিংহ, তোর বাড়ির সামনে বি..’

জাওভান কথা শেষ করে না, থেমে যায়। বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকে। জুভ না বললেও কিরণ বুঝল যে জুভ তাকে গালি দিতে গিয়ে থেমে গেছে। কিরণ খুবই অবাক হলো যখন জুভ বলল সে ময়মনসিংহ।

‘কথা বলছো না কেন? কোথায় তুমি? বাড়িতে আসবে কখন? গত একঘন্টা ধরে বাড়ির সামনে বসে আছি তোমার কোনো খোঁজ নেই।’ জুভ কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল।

কিরণ একবার উজানের দিকে তাকায়। উজান হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে সামনের চেয়ারে বসে আছে। মাথা হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। রাত তো কম হয়নি। কিরণ মোবাইলটা সামনে এনে সময় দেখল, রাত দুটো। তারমানে জুভ এই মাঝরাতে তার বাড়িতে?

‘তুমি বাড়িতে কেন গিয়েছ?’ কিরণ কিছুটা অস্থির হয়ে বলে।

‘বা’ল ফালাতে আসছি।’ হিসহিস করে বলে জুভ, ‘তুমি ফোন ধরছিলে না তাই এসেছি।’

দিনে দিনে জুভের মুখের ভাষা বড্ড খারাপ হচ্ছে। কথা বলতেও অসহ্য লাগছে কিরণের। যেদিন থেকে জুভের সাথে ইয়ানাকে ধরে ফেলেছে ঐদিন থেকে জুভের আরো অবনতি হচ্ছে যেন।

উজান কি তাহলে জুভকে এক্সিডেন্টের ব্যাপারে কিছু বলেনি? কিরণ সাবধানে প্রশ্ন করে,’উজানের সাথে তোমার কথা হয়েছে?’

অধৈর্য হয় জাওভান, ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, ‘ওর সাথে আমার কেন কথা হবে? ওর কথা বাদ দাও, তুমি কোথায় আছো সেটা বলো।’

কিরণ বুঝে নেয় উজান যে জুভের সাথে যোগাযোগ করেনি। এখন যদি জুভের সাথে উজানের ঝামেলা না থাকতো নিশ্চয়ই কিরণের সব খবর জুভকে দিয়ে দিতো। ঐ ঝামেলার রেশ ধরেই উজান জুভের সাথে আর কথা বলেনি।

কিরণ এবার সত্যিটা বলে, ‘আমি ঢাকায়।’

‘হোয়াট? তুমি ঢাকায়? সিরিয়াসলি? আমাকে জানাওনি কেন?’

‘ভেবেছিলাম জানাবো। সময় পায়নি।’

‘ফাক ইওর টাইম।’ জুভ চিৎকার করে উঠে, ‘আমি এখানে পাগল হয়ে যাচ্ছি তোমার টেনশনে আর তুমি কিনা…’

রাগে জুভের কণ্ঠস্বর কাঁপে। ‘তুমি কি ফ্ল্যাটে?’

‘না…’

‘কোথায় তুমি এত রাতে? বাসা তো ছেড়ে দিয়েছো? এখন কোথায়, কার কাছে গিয়েছ? তাড়াতাড়ি বলো।’

জুভের গাড়ি চলার আওয়াজ শোনা যায়। কিরণ নিজেকে শান্ত রাখে, ‘হাসপাতালে।’

‘হাসপাতালে কী?’

‘অ্যাক্সিডেন্ট করেছি।’

জুভ জোড়ে ব্রেক কষে, ‘মানে?’

‘আসলে আমি আজ ঢাকায় রওয়ানা দিয়েছিলা, আর আসার পথেই অ্যাক্সিডেন্ট করেছি।’ সত্যটা চেপে যায় কিরণ।

হাত তিরতির করে কাঁপে জুভের। কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে আসে, ‘অ্যাক্সিডেন্ট..তুমি..কীভাবে?’

জাওভানের অবস্থা বুঝতে পেরে কিরণ বলে, ‘রিল্যাক্স জুভ। কিচ্ছু হয়নি আমার। দেখছো না আমি ঠিকভাবে কথা বলছি তোমার সাথে। যাস্ট একটু ব্যথা পেয়েছি।’

টুট টুট শব্দ শুনে কিরণ মোবাইল কান থেকে সরিয়ে চোখের সামনে নেয়। দেখে জুভ কেটে দিয়েছে কল।

কিরণ গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে উজানের দৃষ্টি সরাসরি কিরণের চোখের দিকে। কিছুটা থতমত খায় কিরণ তবুও উজান দৃষ্টি সরায় না। এই না দেখল উজান ঘুমাচ্ছিল!

‘কিরণ, আমাকে যেতে হবে।’

পাশে দাঁড়ানো মীরার কথায় তার দিকে চায়।

‘এতরাত অবধি বাহিরে থাকার কোনো নিয়ম নেই। দুইটা বেজে গেছে অলরেডি।’ মীরা অসহায় চোখে তাকায়।

‘যা তুই। এখন তো আমি ঠিক আছি। সমস্যা হবে না।’

‘গেলাম আমি।’

‘নিজের খেয়াল রাখিস। সাবধানে যাস।’

‘তুইও নিজের খেয়াল রাখিস। বাই।’

‘আর শুন।’

‘বল।’

‘তুই একটু কষ্ট করে জুভকে হসপিটালের ঠিকানা দিয়ে দিস।’

‘আচ্ছা।’

মীরা চলে যাওয়ার সময় উজানকে বলে, ‘ভাইয়া ওর একটু খেয়াল রাখিয়েন প্লিজ।’

উজান নিশ্চুপ। তার দৃষ্টি তখনও কিরণের দিকে। মীরা চলে যায়। বাতাসে দম আটকানো অস্বস্তি টের পায় কিরণ কারণ উজান চোখ সরাচ্ছেই না। কেমন কঠোর চেহারায় তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এখনি কোনো পানিশমেন্ট দিবে। কিরণ কিছুটা অস্থির হয়ে এদিক সেদিক তাকায়। চোখের দৃষ্টি কোথায় নিবদ্ধ করবে বুঝতে পারছে না। ঘাড় ঘুরাতে পারছে না। হয় সামনে তাকাতে হবে নয়তো নিচের দিকে। সামনে পায়ের উপর পা উঠিয়ে উজান বসা। নিচের দিকেও তাকিয়ে থাকা যায় না অনেকক্ষণ। সে এবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিন্তু তাতে কিরণের মনে হলো যেন উজানের চাহনি আরো বেশি করে প্রখর হলো। সে চোখ খুলে। আজকে হঠাৎ এমন লাগছে কেন উজানের সামনে? আগে তো ঠিকই সে ঐ চোখের দিকে অগ্নিঝড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারত। আজ এত জড়তা কেন? কিরণের গলা শুকিয়ে যায়। পানি খেতে চায় সে। দুর্ভাগ্যবশত টেবিলটা কিরণের বাম সাইডে। সে ডান হাত দিয়ে পানির গ্লাসটা ছুঁতে চায়, কিন্তু ব্যর্থ।

তখন উজান চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে। কিরণ আড়চোখে তাকায়। তখনো উজান কিরণের দিকে চেয়ে আছে। কিরণের দিকে চেয়েই পানির গ্লাস বাড়িয়ে দেয়। কিরণ ঢকঢক করে এক নিঃস্বাসে পানি শেষ করে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে গলা পর্যন্ত গড়িয়ে পড়ে পানি। কিরণের পানি খাওয়া শেষে উজান গ্লাসটা যথাস্থানে রেখে আগের জায়গায় ফিরে যায়। কি আজব! এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিরণ চোখ মুখে হাত দিয়ে দেখে কিছু লেগে আছে কিনা, যার জন্য উজান এভাবে তাকিয়ে আছে।

সময় যায়, কিন্তু উজানের হেলদোল হয় না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। তাই কিরণ ভিতরে ভিতরে সাহস সঞ্চার করে। আজ সাহসেরা সব গেল কই? সে নিজেকে প্রস্তুত করে খেঁক করে উঠে বলে,

‘কী সমস্যা? এমনে তাকায় আছেন ক্যান?’

উজান জবাব না দিয়ে অপলক চেয়ে থাকে। কিরণের দম বন্ধ হয়ে যায়। কী এক পরিস্থিতিতে পড়ল সে! উজান জবাব দিলে কিরণ পরিস্থিতি অন্যদিকে ঘুরাতে পারত। কিন্তু এই ছেলে তো বোবা হয়ে গেছে যেন? আবার প্রশ্ন করে কিরণ,

‘জুভকে বলেননি কেন অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে? আপনার ভাইতো এই রাত করে আমার বাড়ি চলে গেছে?’

কিরণের মাথা দপদপ করে জ্বলে উঠে। উজানের আসলে সমস্যাটা কী? একটারও জবাব দেয় না। খালি তাকিয়েই আছে। বয়রা হয়ে গেছে নাকি! অস্বস্তিকর পরিবেশ!

‘ওহ, অনেক ঘুম পাচ্ছে।’

কিরণ হাই তুলার ভান ধরে। আসলে তার একটুও ঘুম পায়নি। কিন্তু এই মুহুর্তে ঘুম ছাড়া আর কোনো রাস্তা পেল না। সে মুখের সামনে হাত নিয়ে হাই তুলতে তুলতে উজানের দিকে চেয়ে বলল,

‘আপনিও ঘুমান।’ তারপর আশেপাশে তাকাতে আফসোসের সুরে বলল, ‘আহারে এখানে তো কোনো সোফা-টোফা নেই তাই ঘুমাতেও পারবেন না। এক কাজ করুন, বাহিরে চলে যান, একটা কেবিন ভাড়া করেন নয়তো বাহিরের চেয়ারগুলোয় শুয়ে পড়ুন।’

উজানকে সেই আগের মতো স্ট্যাচু হয়ে থাকতে দেখে কিরণ এবার চাদর টেনে মুখ ঢেকে ফেলে। বোঝাতে চায় যে সে ঘুমাবে এখন। হঠাৎ, একদম হঠাৎ করে কিরণের মনে পড়ল সে এতক্ষণ উজানকে কী বলে সম্বোধন করেছে! ‘আপনি!!’ কিরণ ডান হাতে মুখ চেপে ধরে চাদরের ভেতর। হায় আল্লাহ!! এটা কী করল সে? তার কী হয়েছে? সে উজানকে কোন হিসাবে আপনি আপনি করে বলল? তার কী একবারও মাথায় ক্যাচ করল না ব্যাপারটা? উজান কী বুঝতে পেরেছে? কিরণের এখন লজ্জায় বেডের নিচে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। যাতে উজান তাকে না দেখতে পায়।

সাদা চাদরটা পাতলা হওয়ার কারণে কিরণ সবকিছুই দেখতে পাচ্ছে। যেহেতু সে বসে বসে হেলান দিয়েই ঘুমের ভান ধরেছে তাই চাদরের ভেতর দিয়ে অস্পষ্টভাবে উজানকে দেখা যায়। এই ছেলের কোনো নড়চড় নেই। স্ট্যাচু বানাতে বানাতে সে নিজেই কি স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছে? উজানের হয়েছেটা কী? কিরণকে দোষ দিচ্ছে? যার জন্য এমন ভাবে তাকিয়ে আছে? তার ভাইয়ের সাথে ঝামেলা হওয়ার জন্য? দিক গে, আসলে তো কিরণের কোনো দোষই নেই। সে তো খালি ফেঁসেছে। নয় তো তাকে কী পাগলা কুত্তায় কামড়িয়েছিল যে সে জুভের লাইফে ইচ্ছে করে ঢুকবে? হুহ!

উজানের চোখ স্পষ্ট করে দেখা না গেলেও সে বুঝে যে এখনো উজানের অটল চাহনি তার দিকে।

দীর্ঘ দুই আড়াইঘন্টার মতো শুয়ে থাকতে থাকতে কিরণের চোখ লেগে আসছিল। সে মাথার ভার পেছনের হেডবোর্ডে দিয়ে চোখ বুজে নেয়।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here