#সায়র
#পর্ব_১৬ [বোনাস পর্ব]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
হাতে তীব্র যন্ত্রণায় কিরণের ঘুম ছুটে। অনুভব করে সে পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে। খুব কষ্টে চোখ মেলে দেখে জাওভান তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে যে কিরণের নিঃশ্বাস আটকে আসছে। আর সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে তার বাম হাতে। কিরণ ব্যথায় চিৎকার করে উঠে। জুভ ছেড়ে দিয়ে কিরণের মুখ দুহাতের আজলায় নেয়,
‘তুমি ঠিক আছো সোনা। খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার? কোথায় কোথায় ব্যথা পেয়েছ সোনা? বলো না!’
জুভের চোখ টকটকে লাল। উশকোখুশকো চুল। চোখের পানি নাকের পানি মিলে একাকার। সে একাধারে কিরণকে ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। কিরণ ব্যথায় একটা কথাও বলতে পারছে না। ডান হাত দিয়ে জুভকে সরাতে চাইছে পারছে না। জুভ পাগলের প্রলাপ বকেই যাচ্ছে। কিরণ খুব কষ্টে দাঁত খিচিয়ে বলল,
‘হাতে..বাম হাতে ব্যথা পাচ্ছি জুভ। ছা..ছাড়ো প্লিজ।’
‘বাম হাতে ব্যথা, বাম হাতে? দেখি।’
জাওভান আরো বেশি করে বাম হাত ছুঁয়ে দিলো। বাম বাহু ধরে কিরণকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে মাথা নাড়াতে নাড়াতে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলতে লাগল,
‘ব্যথা কমে যাবে জান, ব্যথা কমে যাবে। একটুও ব্যথা লাগবে না লাভ। তুমি ঠিক হয়ে যাবে, তুমি ঠিক হয়ে যাবে।’
জুভ উন্মাদের মতো আচরণ করছিল। ব্যথায় কিরণের চোখ দিয়ে পানি এসে পড়েছে। এভাবে ব্যথার জায়গায় ব্যথা দিলে ব্যথা কমবে কীভাবে? কিরণের মনে হচ্ছে জুভ আসলে তাকে মেরে ফেলতে চাইছে, সে তো কিরণের কষ্টই বুঝে না। এত করে বলছে ছাড়তে, সে না ছেড়ে উল্টো আরো চেপে ধরছে। কিরণ নিজেকে ছাড়াতে পারছে না কিছুতেই। খুব জোরে চিৎকার করল এবার। যদি কেউ শুনে তাকে বাঁচাতে আসে। জাওভান কিরণের চিৎকার শুনে কিরণকে আরো জোরে বুকে চেপে ধরে। তার কিরণের অনেক ব্যথা করছে!
উজান তখন ডক্টরের সাথে কথা বলছিল আর কেবিনের দিকে এগিয়ে আসছিল। দূর থেকে কিরণের চিৎকার শুনতে পায় সে। ডক্টর আর উজান দুজনে দৌড়ে ছুটে আসেন। উজান কেবিনে ঢুকতেই দেখে জুভ কিরণকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে আর কিরণ দুর্বল হাতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
উজান গিয়ে জুভের দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে পেছনের দিকে টান দেয়। এমনভাবে টান দেয় যাতে কিরণ পড়ে না যায়। আচমকা টানে জাওভান পেছনের দিকে হেলে পড়ে। কিরণ কান্না করছে ব্যথায়। তার হাত ছিঁড়ে যাচ্ছে। ডক্টর দ্রুত গিয়ে কিরণকে ধরে। আরো কয়েকজন নার্স চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ছুটে আসে।
জাওভান উজানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইছে, পারছে না, সে চিৎকার করে বলে,
‘ছাড় আমাকে উজান। আমার কিরণের কষ্ট হচ্ছে। আমাকে ওর কাছে যেতে দে। উজান, আই সয়্যার আমি তোকে মেরে ফেলব, আমার কিরণের কিছু হলে আমি তোকে ছাড়ব না।’
উজান শক্ত করে চেপে ধরে তাকে বাহিরে নিয়ে যায়। জাওভান উজানের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। তাকে তার কিরণের কাছে যেতে হবে।
উজান হসপিটালের করিডোরের কোণায় নিয়ে গেল। সে গতকালের ঘটনার পর জুভের সাথে একটা কথাও বলেনি। না ফোন কল, আর না ফ্ল্যাটে গিয়েছিল।
‘জুভ শান্ত হ।’
জুভ শান্ত হচ্ছিল না। উজান জুভের কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। জুভ যখন বারবার ছোটার চেষ্টা করছিল উজান তখন জাওভান বলে খুব জোরে ধমক দিলো। এত জোরে ধমক খেয়ে জাওভান কিছুটা হকচকিয়ে যায়। তার ভাই উজান কোনোদিন তার উপর চেঁচিয়ে কথা বলেনি।
উজান থেমে থেমে কঠিন গলায় বলল, ‘কিরণ অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। তোর কী উচিত ছিল না ও’কে আগে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করা? তা না করে তুই ও’কে আরো অসুস্থ করে তুলছিস। তুই জানিস তুই এতক্ষণ কী করছিলি? যাকে এত ভালোবাসি ভালোবাসি বলিস, তার কষ্টটা তোর চোখে পড়ল না? ওর হাতে ব্যথা তোর চোখে পড়ল না?’
জুভের গলা ধরে আসছিল। সে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, ‘আমি..তো ও’কে কম্ফোর্ট ফিল করানোর জন্য… ‘
‘এটা তোর কম্ফোর্ট ফিল করানো? ক্ষতস্থানে আরো গভীর ক্ষত দিয়ে কম্ফোর্ট ফিল করাতে চাস তুই? আরেকটু হলেই তো বেচারি মা’রা যেত।’
‘আমার কির…কিরণ। ওর অনেক কষ্ট হয়েছে না?’
জুভ দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে বসে পড়ল। বিড়বিড় করতে লাগল। উজান ঢোক গিলল। জাওভানকে কষ্টে দেখতে পারে না সে। জাওভানের কথায় তার খারাপ লাগলেও সে তো আর ছোটো ভাইকে ফেলে দিতে পারে না! তার এই দুনিয়াতে আপন বলতে তো জাওভানই আছে। জাওভানের অবস্থা দেখে উজানের দৃষ্টি কোমল হয়ে আসলো। সে এক হাঁটু মুড়ে জুভের পাশে বসে জুভকে শান্তনা দিতে লাগল।
‘কিরণ ঠিক হয়ে যাবে। তুই শান্ত হ জুভ।’
জুভের চোখ আচমকা হিংস্র হয়ে উঠল। সে উঠে দাঁড়াল।
‘ছাড়বো না আমি। আমার কিরণের যে এই অবস্থা করেছে তাকে আমি ছাড়বো না। মেরে ফেলব তাকে।’
‘কী বলছিস তুই এসব? এট জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট।’
‘কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট করেছে ও? জায়গাটা কোথায়?’
‘পাগলামি করিস না।’
উজান জুভের কাঁধে হাত রাখল। জুভ ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলো। সে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
‘তুই বলতে না চাইলে বলিস না। আমি ঠিকই খুঁজে নেব।’
জাওভান অগোছালো পায়ে চলে যায়। উজান ছোটো করে একটা শ্বাস ফেলে। জাওভান এখন আবার কী কাণ্ড জানি ঘটায়! কিরণের কানে গেলে ও’ তো আরো ঘৃণা করবে জুভকে। এমনিতেই তো দেখতে পারে না জাওভানকে। উজান যত চায় কিরণ জুভকে ভালো চোখে দেখুক, ততবারই জাওভান এমন কিছু কাজ করে বুঝিয়ে দেয় যে সে কিরণের যোগ্য না।
উজান চলে যায় রেস্টুরেন্টে, কিরণের জন্য খাবার কিনতে। কিরণকে রিলিজ দেওয়ার কথা আজ বিকেলে ছিল, কিন্তু এখন তা সম্ভব কিনা জানে না সে, আবার কিরণের হাতের ব্যথা বেড়েছে বোধহয়। জাওভানকে আটকানোর মতো তার ইচ্ছা নেই। মূলত ইচ্ছাগুলো কেন যেন মন থেকে আসছে না। আর কত ত্যাগ করবে ভাইয়ের জন্য?
.
.
জাওভান গাড়ি চালিয়ে উত্তরা সেক্টর সাতে গেল। গলির মোড়ে গাড়ি পার্ক করল। টাইম দেখল মোবাইলে। এখন সকাল সাতটা বেজে চল্লিশ। আর বিশ মিনিট সে অপেক্ষা করল। বিশ মিনিট পর একটা কালো গাড়ি গলি থেকে বেরিয়ে চলে গেল। গাড়িতে ছিল একজোড়া মিডল এইজের দম্পতি। জুভ গাড়ি থেকে নেমে পা চালিয়ে ডানে বামে মোড় নিতে নিতে সে একটা খোলা জায়গায় এসে থামল। সামনেই ভূঁইয়া ভিলা, তার পাশে পার্কিং লটে সেই লাল গাড়িটি, যেটা সে একটু আগে চৌরাস্তার মোড়ের এক দোকানের সিসি ক্যামেরায় দেখেছিল, যেটা তার কিরণকে ধাক্কা মেরেছে, গাড়িটা দেখেই সে চিনে ফেলেছিল।
বাসায় গিয়ে কয়েকবার নক করল। তিনবারের মাথায় নক করার পর দরজা খুলল। ইয়ানা জাওভানকে দেখে অবাক হলো। জাওভান তার বাড়িতে? জাওভান দেখল কান্নারত ইয়ানা বারবার হাত দিয়ে চোখের পানি মুছছে। জুভকে দেখে ইয়ানা কান্না বন্ধ করে বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে।
‘জাওভান তুই এখানে? ভেতরে আয়।’
জাওভান ভেতরে আসলে দরজা বন্ধ করে দেয় ইয়ানা।
‘তুই এখানে হঠাৎ?’
‘কান্না করছিলি কেন?’
‘বাবা মায়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে তাই।’ ইয়ানা রাগ নিয়ে বলে।
জাওভান গিয়ে সোফায় বসে। তার চোখে হিংস্রতা। ইয়ানা জাওভানকে দেখে কিছুটা ভড়কালো।
‘কী হয়েছে তোর?’
‘তুই কি আমাকে ভয় পাস না?’ জাওভানের গলা সমুদ্রের মতো শান্ত। যেন ঝড় আসার পূর্বাভাস।
‘মানে কী?’ বিভ্রান্তি খেলে যায় ইয়ানার মুখে।
জাওভান ঘাড় কাত করে ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘গতকালকে যা ঘটালি, তার জন্য যে আমি তোকে ছাড়বো না সেটা ভেবে কি একবারো তোর ভয় লাগল না?’
ইয়ানার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। হাত পা হিম হয়ে আসলো। বাবা মায়ের সাথে ঝগড়ার পর তার আর গতকালের ঘটনা মাথায় ছিল না। জাওভান কীভাবে জানল? আমতা আমতা করে বলল,
‘জুভ। আই ক্যান এক্সপ্লেই…’
ইয়ানার কথা শেষ হওয়ার আগে জাওভান তেড়ে এসে ইয়ানার গলা জানালার পর্দার সাথে পেঁচিয়ে ধরল। ইয়ানা হাত দিয়ে জুভের হাত থাপ্পড় দিয়ে ছাড়াতে চাইল। শক্তিতে কুলাতে পারল না সে।
গতকাল ইয়ানা চৌরাস্তার মোড়ে কিরণকে দেখে। কিরণকে দেখলেই তার শরীরে আগুন জ্বলে উঠে। এই একটা ছোটোলোকের মেয়ে, অথচ তার কী তেজ! কতবার অপমান করল কিরণ তাকে? কিরণকে অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হতে দেখে তার মাথায় হঠাৎ কুবুদ্ধি ভর করল। চেয়েছিল কিরণকে প্রাণে না মেরে হাত পা ভেঙে দিয়ে বসিয়ে দিবে। জাওভান তো আর পঙ্গু মেয়েকে বিয়ে করবে না। কিরণের পঙ্গুত্ব দেখলে তার ভালোবাসা নামক মোহ ঠিকই কেটে যাবে।
কিরণের উপর যখন গাড়ি চালিয়ে দিতে চাইছিল কিরণের ঐ বজ্জাত ফ্রেন্ড কিরণকে বাঁচিয়ে দেয়। তখন সে দ্রুত গাড়ি নিয়ে সরে পড়ে। এই ঘটনাটা জাওভানের তো জানার কথা না।
ইয়ানা শ্বাস নিতে পারছে না। জাওভান জানালার পর্দা আরো শক্ত করে চেপে ইয়ানার গলায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘শু’য়োরের বাচ্চা, তুই আমার জানকে মারতে চেয়েছিস, সেইদিন নাটক করে আমাকে আমার কিরণ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলি আর গতকাল তুই আমার জানকেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলি। কু’ত্তার বাচ্চা, তোকে তো আজ আমি মেরেই ফেলব, আমি আমার জানকে ফুলের টোকা লাগতে দেই না আর তুই… জা’নোয়ার… আজকে তুই শেষ।’
ইয়ানার জিহ্বা বেরিয়ে এলো। চোখ উল্টে গেল। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল ধীরে ধীরে। হাত পা তড়পাতে থাকল। ছটফট করতে লাগল ডাঙায় তোলা মাছের মতো।
.
.
কিরণকে দুপুরের খাবার খাইয়ে দিচ্ছে জাওভান। উজান রিলিজের সব ফরম পূরণ করে কেবিনে আসলো। কিরণকে অবস্থা যেহেতু গুরুতর না তাই তাকে বিকেলেই রিলিজ দেওয়া হবে। কিরণকে নিয়ে যাওয়া হবে জাওভানের বাসায়। কিরণকে না চাইতেও জাওভানের বাসায় যেতে হবে। কোনো নার্স রাখবে না জুভ। সে নিজেই খেয়াল রাখবে কিরণের। তা শুনে কিরণের এই ভেবে কিছুটা ভয়ও লাগল, অসৎ চরিত্রের জাওভান তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে। যেহেতু কিরণকে জুভের ফ্লাটেই রাখবে, আর জাওভানও সেই একই ফ্ল্যাটে থাকবে।
কিরণ ভাবল কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচা যায়। জামা কাপড় চেঞ্জ করা, গা গোসল ধুয়িয়ে দেওয়া, এসব সে জুভের হাতে করবে না, উহু কিছুতেই না। কোনোভাবেই না। কিন্তু এছাড়া আর উপায় কী? তখন কিরণকে বাঁচিয়ে দিয়ে উজান বলল,
‘কিরণ তোমার মা আসছেন।’
উজান কিরণের অ্যাক্সিডেন্টের খবর জানিয়ে দিয়েছে মমতাজকে। তিনি মেয়ের অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। তিনি উজানকে বলেছেন তিনি আসবেন, কিয়াদকে নার্সরা দেখবে, এছাড়া কিয়াদ যথেষ্ট বুদ্ধিমান, নিজের খেয়াল রাখতে পারবে। কিরণ চাইছিল না মাকে তার অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা জানাতে যেহেতু তিনি অনেক টেনশন করবেন। কিন্তু মমতাজ আসলে যে জাওভানের কুরুচির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে সেটা ভেবে খুব খুশি হলো সে।
কিরণের মায়ের আসার কথা শুনে জাওভান অনেকটা বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘কিরণের মাকে কেন আসতে হবে? এখন গাইয়া বুড়িকে সাথে করে এক বাসায় থাকতে হবে!’
তার বিড়বিড় করা কথা উজান ও কিরণ শুনতে পেল। উজান কিছু বলার আগেই কিরণ জোরে ধমকায় জুভকে,
‘জাওভান! ঠিক করে কথা বলো। উনি আমার মা হন।’
জাওভান নিজের মনের কথা আর আড়াল করল না। ঈষৎ রেগে বলে, ‘ঠিকই তো বলেছি। আমি চাইছি না তোমার আমার মাঝে কোনো পার্সন এলাউ করতে।’
‘মুখ সামলে কথা বলো জুভ। আমার মাকে থার্ড পার্সন বলার তুমি কে? তোমার আমার বিয়ে হয়েছে যে তুমি আমার মাকে থার্ড পার্সন বলো? নিজের মুখ সামলাও নয়তো জুতা খুলে মারব।’
কিরণের রেগে যাওয়াতে জাওভান আরো বেশি রেগে যায়। সে হাতে থাকা ভাতের প্লেট উল্টে ফেলে কিরণের গায়ে। তরকারির ঝোলে কিরণের জামা সহ বুক পেট ভিজে যায়। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে যে উজান কিরণকে বাঁচানোর সময় পায় না।
সে হালকা ধমকে উঠে জাওভানকে, ‘জুভ। বিহেভ ইওরসেল্ফ।’
কিরণ হতভম্ব ও রাগান্বিত। কার রাগার কথা ছিল আর রাগছে কে? জাওভান উঠে দাঁড়িয়ে বাহিরে যেতে যেতে বলে,
‘গরীব মেয়েদের সাথে প্রেম করার এই এক ঝামেলা।’
কথাটা শুনতে পেয়ে কিরণ পেছন থেকে চেঁচায়,
‘প্রেম করতে বলেছে কে তোকে? গরীবের কাছে যেচে আসলি কেন? তোর থেকে ঐ একবার টাকা ধার চেয়েছি বলেই গরীব হয়ে গিয়েছি তাই না? আরে ফকির, তোর টাকা তো তোরে আমি ঠিকই ফিরিয়ে দিসি। তুই ছোটোলোক। তোর মনটা ছোটো। খালি টাকা থাকলেই বড় হওয়া যায় না। বেয়াদব।’
কিরণ ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সে বড় বড় শ্বাস ফেলছে রাগে। জুভ চলে গেছে আরো আগেই। জাওভানকে কথা শুনানোর জন্য উজানের উচিত ছিল কিরণকে ধমকে থামিয়ে দেয়া। কিন্তু কেন যেন তার আর জুভকে ডিফেন্স করতে মন চাইল না। আগে জাওভান অন্যায় করলে যদি কিরণ উচিত কথা বলত তাহলে সে জাওভানের অন্যায়কে হাইড করে উল্টো কিরণকে দোষ দিত। কিন্তু আজ জুভের অন্যায়ের জন্য কিরণকে মুখ খুলতে দিয়েছে সে। আর জুভের হয়ে কিছু করবে না সে। জুভের অন্যায়কেও সাপোর্ট করবে না।
কিরণকে সে শান্ত হতে বলে। বিকেলের আগেই উজান কিরণকে নিয়ে চলে যায় তার বাংলোতে। জাওভানকে বলার প্রয়োজনবোধও করল না সে। তারপর গিয়ে কিরণের মাকে রিসিভ করে বাংলোতে নিয়ে আসে।
জাওভান বিকেলে হসপিটালে গিয়ে কিরণকে পায় না। রিসেপশনিস্ট বলে তাকে এক ঘন্টা আগেই রিলিজ দেওয়া হয়েছে। তা শুনে জাওভানের মাথা গরম হয়ে যায়। সে ফ্ল্যাটে গিয়েছিল তখন। তার আর কিরণের জন্য তার ফ্ল্যাট ঠিক করেছে আর কিরণের মায়ের জন্য উজানের ফ্ল্যাট গুছিয়ে এসেছিল। এখান থেকে কিরণকে নিয়ে যাবে বলে। অথচ কিরণকে নিয়ে উজান চলে গেছে? তাকে না বলেই? উজানের সাহস কী করে হয়? বড় ভাই হয়েছে দেখে কি মাথা কিনে খাবে?
জাওভান তখনই বাংলোতে যায়। আকাশের লালচে আভা তখন বিদায় নিয়ে সাঁঝকে আগমন জানায়। রাস্তার পাশে শুধু ঘন জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই নেই। তার মাঝে জাওভানের কালো মার্সিডিজ ফুল স্পিডে চলছে উজানের বাংলোর উদ্দেশ্যে। জাওভান উজানের বাড়িতে পৌঁছে জোরে জোরে কলিংবেল বাজাতে থাকে।
উজান এসে দরজা খুলে। দরজা খোলা মাত্রই উজানকে দেখে হুট করে উজানের শার্টের কলার চেপে ধরে।
‘কিরণকে নিয়ে আসার সাহস কী করে হয় তোর? তুই কে ওর? ওর জন্য এত দরদ কীসের? আমার আর কিরণের লাইফে ইন্টারফেয়ার করবি না একদম।’ জাওভানের গলার স্বর উঁচু হয়।
কিরণের মা ছিল রান্নাঘরে। মেয়ের জন্য গরম গরম চা বানাচ্ছিলেন। চেঁচামেচি শুনে তিনি দ্রুত আসেন। কিরণও ধীরে ধীরে হেঁটে চলে আসে।
কিরণকে দেখে জাওভান উজানকে ছেড়ে দৌড়ে আসে। কিরণের হাত ধরার আগে উজান এসে জাওভানের হাত ধরে থামায়। জাওভান অগ্নিশর্মা চোখে তাকায় উজানের দিকে।
‘হাত ছাড় উজি। কিরণকে আমি নিয়ে যাবো আমার সাথে।’
‘কিরণ এই মুহুর্তে কোত্থাও যাবে না।’ উজানের হিম শীতল কণ্ঠ।
‘তুই বলার কে?’
‘তুই নিয়ে যাওয়ার কে?’ পাল্টা প্রশ্ন করে উজান।
এ কোন উজানকে দেখছে সে? উজান কিনা তাকে আটকাচ্ছে? ক্রোধে ফেটে পড়ে জাওভান। উজানের হাত থেকে হাত ছাড়াতে নেয়। এত জোরে চেপে ধরেছে উজান যে জাওভান শক্তির সাথে পারছে না।
‘কিরণ আমার হবুস্ত্রী।’ দিশেহারা কণ্ঠ জুভের।
‘হয়ে নিক। তারপর অধিকার খাটিয়ে নিয়ে যাস। কিন্তু আপাতত কিরণ এখানেই থাকবে।’
জাওভান গর্জে ওঠে, ‘কেন? আমার সাথে গেলে সমস্যা কী? ঐ বুড়.. কিরণের মাকেও আমি সাথে নেব। তারা দুইজনই আমার ফ্ল্যাটে থাকবে।’
উজান ভালো করে জানে কিরণ আর কিরণের মা জাওভানের সাথে থাকলে জুভ সারাদিন অপমান করবে তাদের। সে চিনে জাওভানকে। কিরণের মাকে যথাযথ সম্মান দিবে না আর কিরণকেও মানসিক চাপের মধ্যে রাখবে, আর কিরণের হাতের ব্যথারও তোয়াক্কা করবে না। তাই সে তাদের ভালোর জন্য এখানে নিয়ে এসেছে।
উজান অনুভূতিহীন চোখে তাকায় জাওভানের দিকে। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘কিরণ যাবে না মানে যাবে না। এই কথাটা যেন আর রিপিট করা না লাগে।’
উজানের কণ্ঠে কিছু একটা ছিল যার কারণে জাওভানের কণ্ঠস্বর থেমে গেল। তার অগ্নি দৃষ্টিতে পানির ছিটা পড়ে। তার নিজের ভাইয়ের চোখের দিকে চেয়ে থাকতে পারছে না সে। কথা আটকে গেল গলায়। সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। কিরণের দিকে চেয়ে থ্রেট দেয় তাকে,
‘আমি তোমাকে বিয়ে করে বন্দী করে নিবো কিরণ। যত পারো উড়ে নাও।’
তারপর সে সেখান থেকে প্রস্থান নেয়।
জাওভান গেলে মমতাজ কিরণকে জিজ্ঞেস করে,
‘এটা কে?’
‘উজানের ভাই।’
‘যার সাথে তোর বিয়ে হওয়ার কথা?’
‘হুম।’ নিস্তেজ কণ্ঠ কিরণের।
মমতাজ কিরণকে রুমে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘এই ছেলে কীভাবে উজানের ভাই হয়? দুইজন তো দেখি উত্তর দক্ষিণ। এই ছেলের ব্যবহার তো ভালো না। বড় ভাইয়ের কলার ধরে। বড়দের সম্মান করতে জানে না। আমাকে তো সালামটাও পর্যন্ত দিলো না। তুই ও’কে বিয়ে করবি কেন?’
কিরণ উত্তর দিতে পারল না। বলতে পারল না, “তোমাদের ভালো থাকার জন্য আমাকে এই খারাপ ছেলেকে বিয়ে করতে হবে মা।”
কিরণ অন্য কথা বলে, ‘বিয়ে টিয়ে পরের কথা। বাদ দাও তো। এসব চিন্তা করে লাভ নেই। তুমি চা এনেছো?’
‘ওহো রে, চা তো চুলায় বসিয়েছি, মনে নেই।’ মমতাজ অস্থির পায়ে রান্নাঘরে ছুটে যায়।
মমতাজ গেলে কিরণ বিছানায় বসে পড়ে। সে কী উজানের সাথে ডিল ক্যান্সেল করার ব্যাপারে বলবে? এখন তো দেখছে ভাইয়ে ভাইয়ে মিল নেই। তাহলে তো আর কিরণকে চাপ দিতে পারবে না উজান। ডিলটা ক্যান্সেল করে দিতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হলো, জাওভান তো ছাড়বে না কিরণকে। সে তো ঠিকই কিরণকে নিজের করে নিতে চাইবে। এখন সে আর উজানকে পরোয়া করবে না। এখন ডিল ক্যান্সেল করলেও কী আর না করলেও কী, জাওভান ঠিকই কিরণকে বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগবে।
কিরণের ভাবনা চিন্তার মাঝে তার ফোন বেজে ওঠে। দেখে মীরা কতগুলো মিসডকল দিয়েছে। আজ সারাদিন কিরণের ফোনে চার্জ ছিল না তাই সে জানতে পারেনি। সে মীরাকে কল ব্যাক করে।
মীরা ওপাশ থেকে হন্তদন্ত হয়ে বলে,
‘দোস্ত, জানিস কী হয়েছে?’
‘কী?’
‘ইয়ানা আত্মহ’ত্যা করেছে।’
‘কিহ!’ কিরণ অবিশ্বাসের গলায় বলে।
‘হ্যাঁ রে সত্যি। আজ সকালে ওর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।’
‘পুরো ঘটনাটা বল।’
‘আজ সকালে ইয়ানার বাপ মা কাজে চলে যায়। তো সাড়ে নয়টায় ইয়ানার মা চলে আসে উনি অফিসের ফাইল রেখে গেছেন বলে। এসে দেখে দরজা খোলা। ভেতরে গিয়ে দেখে ইয়ানা ওর রুমে ফ্যানের সাথে ঝুলছে। পরে পুলিশ-টুলিশ আসছে। দেখে ওর টেবিলে একটা চিঠি। লেখা ছিল “মা বাবা, তোমরা কোনোদিন আমার মন বোঝার চেষ্টা করোনি। আমার চাহিদা মেটাতে পারোনি। আমি টাকা চাইলেই তোমাদের কাছে টাকা থাকে না। তোমরা মা বাবা হিসেবে ব্যর্থ। সবসময় বলো না যে আমি তোমাদের বোঝা, আজ তোমাদের বোঝা হালকা করলাম। ভালো থেকো।” তারপর পুলিশ খবর নিয়ে জানে মা বাবার সাথে ইয়ানা প্রতিদিন ঝগড়া করত টাকার জন্য। আজও ঝগড়া করেছে। আর ও প্রতিদিন বলত টাকা না দিলে মরে যাবে। তাই আজ ইয়ানার বাবা ও’কে চড় দিয়ে বলে, তুই মরে গেলেই আমাদের শান্তি। এই জন্যই ও আত্মহ’ত্যা করেছে।’
একদমে বলে মীরা থামে।
কিরণ চুপ করে থাকে। একবার সে দুদিনের জন্য ইয়ানার বাসায় ছিল। সেই দুইদিনেই দেখেছে ইয়ানার মা বাবার প্রতি ইয়ানার ব্যবহার। ইয়ানার টাকার প্রতি কত লোভ সেটা কিরণ জানে। কিন্তু ও যে এই কারণে আত্মহ’ত্যা করবে সেটা সে কোনোদিন ভাবেনি।
.
.
চলবে…