সায়র #পর্ব_১৭

0
194

#সায়র
#পর্ব_১৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

কিরণের হাতের ব্যথা কিছুটা কমেছে। হাত বেশি নাড়াতে পারে না, তবে এখন আর নিজের কাজে মায়ের সাহায্য লাগে না। কিরণের মা আজ আটদিন এখানেই থেকেছে তার সাথে। কিরণের বাকি এক সপ্তাহ শেষ হয়ে গিয়েছে। উজানের বাংলো ছেড়ে তার যাওয়ার কথা ছিল হোস্টেলে। সে উজানকেও বলেছিল সে চলে যাবে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পর হোস্টেলে থাকা একদমই বন্ধ হয়ে গেছে। কিরণ শুনেছে সীট নাকি বুক হয়ে গেছে। আর সীট খালি নেই। সীট তো আর কিরণের জন্য অপেক্ষা করবে না। এটা শুনে কিরণের চিন্তার শেষ নেই। এখন সে কোথায় থাকার জায়গা খুঁজবে? ঢাকা শহরে বাসা ভাড়াও আকাশচুম্বী, যা কিরণের পক্ষে সামাল দেওয়া কষ্টকর। আবার উজানের বাসাতেও দীর্ঘদিন থাকা যাবে না। চক্ষুলজ্জা বলে একটা কথা আছে না!

কিরণ উজানের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে যাবে কিনা ভাবছে। উজান বলেছিল কিরণকে দুই সপ্তাহ সময় দেয়ার পর তাকে জাওভানের হাতে তুলে দিয়ে আসবে। দুই সপ্তাহ অলরেডি শেষ। কিন্তু এই শেষ এক সপ্তাহে কিরণ একবারও উজানকে দেখলো না সেই বিষয়ে কোনো কথা তুলতে।

আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার যেটা কিরণকে প্রতিদিন ভাবিয়ে তুলছে, তা হলো এই আটদিনে একটাবারও জাওভান তাকে কল করেনি। শেষ দিন দেখা হয়েছিল যেদিন জাওভান কিরণকে হুমকি দিয়েছিল। এমন না যে কিরণ মিস করে জাওভানকে। বরং আতঙ্কে থাকে। যদি জাওভান কিছু উল্টাপাল্টা করে থাকে। কিরণ তার ভাইকে নিয়ে বেশি ভয় পায়। তার ছোটো ভাই হসপিটালে। কিরণ সর্বদা তটস্থ থাকে। দিনে একশোবার হলেও ভাইকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবে সব ঠিক আছে কিনা। মমতাজকে বলেছিল চলে যেতে, মমতাজ মেয়েকে একা ছাড়তে চাননি।

তিনি চলে যাবেন কালকে। মেয়ে একা একটা ছেলের বাড়িতে আছেন সেটা নিয়ে প্রথমে তিনি অনেক চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু উজানকে দেখার পর, তার ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তার আর চিন্তায় থাকতে হয় না। আর এমনিতেও মেয়ের জীবনে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না। কিরণ যেমন ভাবে ইচ্ছা, যেখানে ইচ্ছা থাকুক, যা ইচ্ছা করুক। শুধু মেয়েটা একটু খুশি থাকলেই চলবে। মেয়ের মুখে একটু হাসি ফুটুক এই একটাই তার কামনা।

কিরণ চাইছিল উজানের সাথে ডিল ক্যান্সেলের ব্যাপারে কথা বলবে। যেহেতু এই ডিল রাখার আর কোনো মানে দেখছে না সে। তবে তার একটা দিক দিয়ে অসুবিধা হবে, উজান কিরণের পরিবারকে যেই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিয়েছে তা হয়তো খোয়াতে হবে। কিরণের ভাই আর মায়ের জন্য উত্তরাতে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে, যেটা সে আজকেই মায়ের মুখ থেকে শুনেছে। তখন তার মাথায় আসে, ফ্ল্যাটে থাকলে অন্তত তার বাসা ভাড়া কিংবা হোস্টেলের খরচ বেঁচে যাবে, আর মা আর কিয়াদের সাথেও একসাথে থাকা হবে। কিন্তু এখন যখন ডিল ক্যান্সেলই করে দিবে সেখানে তো উজান নিশ্চয়ই আর ফ্ল্যাট দিবে না?

কিরণের এলোমেলো ভাবনার মাঝে খট করে উজানের রুমের দরজাটা খুলে যায়। আকস্মিক হওয়ার দরুণ কিরণ ঈষৎ কেঁপে উঠে। নিজেকে সামলে সামনে তাকায়। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা উজানকে সকালের নরম স্নিগ্ধ রোদের মতো সতেজ লাগছে। সাদা টিশার্ট আর একটা টাউজার পরনের উজানের এলোমেলো চুল কপালে ছড়ানো। চোখজোড়ায় এখনো ঘুম লেগে আছে। কিরণ জীবনেও ঘুম থেকে ওঠা উজানকে দেখেনি। দেখবেই বা কীভাবে! উজান তো ভেরের পাখি। আর সেখানে কিরণ লেট লতিফ।

উজান তখন সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। প্রতিদিন সে সকাল ছয়টা বাজে ঘুম থেকে উঠে এক্সারসাইজ শুরু করে। নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন সে। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া ঘুম, সব তার রুটিন মতো। ফলস্বরূপ তার পেটে মেদ নেই, চমৎকার সুঠাম দেহ। কিন্তু আজ একটু বেশিই দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে সে। গতকাল রাতে সে একটা পেইন্টিং শেষ করেছে। তার জন্যই ঘুমাতে এত দেরি।

‘কী হয়েছে? ডাকছিলে কেন?’ উজানের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ।

কিরণকে ভাবান্বিত দেখায়। সে কখন উজানকে ডাকল? তার তো মনে পড়ে না। এখানে এসেছে ধরেই তো দাঁড়িয়ে চিন্তার ঝুড়ি মেলে বসেছিল।

‘কী হয়েছে কিরণ?’

হঠাৎ করেই কিরণের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ খেলে যায়। উজানের জড়ানো কণ্ঠে কিরণ ডাকটা খুবই আবেশী লাগছে তার কাছে। এমনকি সব কথাই।

ধরাম করে দরজা আটকানোর আওয়াজে কিরণের হুশ ফিরে। দেখে উজান দরজা আটকে দিয়েছে। কী হলো এটা? ওহ! দোষটা তো তারই। সেই তো কথা না বলে আজেবাজে চিন্তা করছিল।

হতাশার শ্বাস ফেলে কিরণ চলে যেতে নেয়। এক পা বাড়াতেই আবারো দরজা খোলার আওয়াজ। কিরণ পিছে ফিরে। উজান দরজা খুলে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ভাবা শেষ?’

কিরণ ছোট করে বলে, ‘হু।’

‘কী জন্য এসেছো?’

‘কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।’

উজান দরজা পুরোটা মেলল। ‘এসো।’

কিরণ রুমের ভেতরে যেতেই মনমাতানো সুগন্ধী তার নাকে এসে সুড়সুড়ি দিলো। উজান এখানে থাকা শুরু করার পর থেকে কিরণ কখনো আসেনি তার রুমে। উজানের রুমের ঘ্রাণটা মোহনীয়। কিরণ চোখ বুজে শ্বাস টেনে ঘ্রাণটাকে নিজের মধ্যে নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। উজানকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে কোন পারফিউম ইউজ করে।

‘বসো। আমি আসছি।’

উজান রুমে থাকা সোফাটাকে দেখিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। কিরণ ঘুরে ঘুরে রুমটাকে দেখতে থাকে। উজান এখানে থাকার পর অনেক আসবাব চেঞ্জ করেছে। উজানের রুমটা অনেক বড়। বড় হওয়ারই কথা যেহেতু এটা মাস্টার বেডরুম। রুমটার কানায় কানায় শৌখিনতার ছোঁয়া। হেডবোর্ডের বড় একটা খাট। তার দুপাশেই ছোট তেপায়া টেবিল। টেবিলের উপরে ভাস্কর্য। দেয়ালে ক্যানভাসে আঁকা চোখ ধাঁধানো কিছু পেইন্টিং। মেঝেতে বিশাল সাইজের কার্পেট। একপাশে সোফা সেট। কোণায় বিভিন্ন ধরনের ল্যাম্প। আর বারান্দার দেয়ালটা সম্পূর্ণ কাঁচের। দিনের আলোয় ঝলমল করতে থাকে সারাটা রুম।

কিরণ গিয়ে সোফায় বসে পড়ে। সোফার সাইডের দেয়াল জুড়ে বড় একটা পেইন্টিং। চারিদিকে থৈ থৈ করা নীল জল। জোৎস্নার কোমল আলো ঝিকিমিকি করছে সমুদ্রের পানিতে। তার মাঝে একটি মেয়ে দুইহাত ছড়িয়ে সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ছে। ছবিটা এতটাই জীবন্ত যে দেখলে মনে হয় চোখের সামনেই সমুদ্র, ঢেউগুলো এসে এক্ষুনি পা ভিজেয়ে দিয়ে যাবে, মেয়েটাকে ছোঁয়া যাবে হাত বাড়ালেই। পেইন্টিংটার নাম কোণায় লেখা- সায়র।

উজান এসে কিরণের সামনের সোফাটায় বসে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে,

‘বলো কী বলবে?’

ভেজা মুখের উজানকে সুদর্শন লাগছিলো আরো বেশি। কিরণ উজানের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বারান্দায় দৃষ্টিপাত করল।

‘ডিলের ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছি।’

‘ডিল ক্যান্সেল।”

কিরণ চমক লাগানো চোখে চায় উজানের দিকে। উজান ডিল ক্যান্সেল করে দিয়েছে? বিশ্বাস হয় না তার।

‘তুমি শিওর উজি?’

‘হুম।’

‘তাহলে তোমার টাকা আমি ফি..’

উজান কিরণকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ওসব নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি যা দেই তা ফিরিয়ে নেই না।’

‘কিন্তু…’

‘কোনো কিন্তু না। তোমাকে আমি কম হয়রানি করিনি। ছোটো ভাইয়ের কথা ভাবতে গিয়ে তোমার জীবনটাও শেষ করেছি। এগুলো সরি হিসেবে রাখতে পারো। ভবিষ্যতেও তোমার যদি কোনো সাহায্য লাগে আমাকে বলতে পারো। আ’ম অলয়েজ দেয়ার ফর ইউ।’

উজান একটু থেমে বলে, ‘উত্তরায় তোমাদের জন্য যেই ফ্ল্যাট কিনেছি সেটাতে তোমরা চাইলে এই সপ্তাহে উঠতে পারো। সবকিছু ঠিকঠাক করে দেবো আমি। ততদিনে তুমি এখানে থাকতে পারো।’

কিরণের অনেক লজ্জা লাগছিল উজান তাকে এতভাবে সাহায্য করছে দেখে। কিন্তু ভেতরের মনটা বলে উঠল, “এটা সাহায্য না রে পাগল। এটা ক্ষতিপূরণ। তোকে তো জাহান্নামে ঠেলে দিতে চেয়েছিল সে, আজ সে নিজেই তোকে ফিরিয়ে আনছে। সেটারই ক্ষতিপূরণ এসব। লজ্জা না পেয়ে মেনে নে।”

কিরণ অধিক কষ্টে মুখ ফুটে বলল, ‘থ্যাংকস।’

কিরণ যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে যেতে উজান দরাজ কণ্ঠে ডেকে উঠে।

‘কিরণ।’

কিরণের পা থমকায়। ঘাড় ঘুরায় উজানের দিকে। উজানের দৃষ্টি তখন সামনের টানানো সায়র পেইন্টিংটার দিকে। সেখানে দৃষ্টি আবদ্ধ করে ধীরস্বরে বলল,

‘সরি।’

কিরণ আর কিছু বলল না। শব্দহীন পায়ে উজানের রুম ত্যাগ করে।

.

.

বেলা মধ্যাহ্ন। দুপুরের খাবার তৈরি করছেন মমতাজ। চিংড়ি মাছ ভর্তা, কলা ভর্তা, মুরগীর মাংস, আর চিংড়ি মালাইকারী। উজান তখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। রান্নাঘরে যায় নিজের খাবার তৈরি করতে। উজানকে রান্নাঘরে দেখে মমতাজ বলেন,

‘উজান বাবা, তোমার আজ কিছু করতে হবে না‌। আজ তুমি আমাদের সাথে খাবে।’

উজান তার নিজের রান্না নিজে করে উপরে নিয়ে যেত। একা একা খেতেই তার পছন্দ। মমতাজ আর কিরণ নিচেই ডাইনিংএ খেত। মমতাজ এর আগে যতবার উজানকে ডাকতে চেয়েছে কিরণ ততবারই বারণ করেছে। কিরণ জানে উজান ইন্ট্রোভার্ট। উজানের বাড়িতেই থেকে শুধু শুধু উজানকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চায় না সে। কিন্তু আজ মমতাজ চাইছেন উজান তাদের সাথে একসাথে বসে খাবে। সারাদিন কীসব লতাপাতা খায়, ভাত খায় এক কাপের চেয়েও কম। এসব খেলে সুস্থ থাকে মানুষ? তাই তিনি উজানকে নিজের হাতের রান্না খাওয়াতে চান। আর এমনিতেও তিনি তো কালকে চলেই যাবেন। এরপর আর দেখা হবে কিনা কে জানে। আজকে একটু ভালোমন্দ খাক ছেলেটা। ছেলেটার মা বাবা তো আর সাথে থাকে না, নিজে বানাবে সেই সময়টাও তো ছেলেটার নেই।

উজান বাঁধা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু রান্নাঘরে থাকা কিরণ মায়ের পেছন থেকে উজানকে চোখের ইশারায় বলছিল অন্তত আজকের জন্য হ্যাঁ বলতে। উজান চুপ করে রইল। এক টেবিলে বসে দুইজনের সাথে খাবে এটা ভাবতেই তার ভেতরটা কেমন খচখচ করে। সে কখনোই একসাথে খেতে বসেনি। অভ্যাস নেই। ছোটো বেলায় নানু খাইয়ে দিতো। নানু মারা যাওয়ার পর নিজের মতো করে সবটা করে। জাওভান থাকাকালীন জাওভান বাহিরেই বেশি সময় কাটাতো।

মমতাজ তাকে বারবার অনুরোধ করছেন। বয়সে বড় একজন এমনভাবে অনুরোধ করছেন যে না করলে খারাপ দেখায়। উজান একজন মুরব্বীর মুখের উপর না করতে পারছে না। কোনোদিন পারবেও না। তার কথায় কেউ কষ্ট পাক এটা সে চায় না। তাই নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বলল,

‘আচ্ছা আন্টি।’

মমতাজ অনেক খুশি হলেন। তিনি মেন্যুতে আরেকটা পদ যোগ করলেন, বাঁধাকপি ভাজি।

খাবার টেবিলে উজানের অস্বস্তি টের পেল কিরণ। তার মা’ও না! বারবার উজানের পাতে এটাসেটা তুলে দিচ্ছে আর খাবার সম্পর্কে একশোটা উপদেশ দিচ্ছেন। এটা খাওয়া ভালো, ওটা খেলে ভালো হয়, উজান যা খায় এসব খেলে স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না হেনতেন। উজান না পারছে কিছু করতে না পারছে বলতে। কিরণ উজানের ধৈর্য্যশক্তি দেখে অবাক না হয়ে পারে না। উজানের মুখাবয়ব এতটাই নির্মল আর স্বচ্ছ যে দেখলে মনে হয় মমতাজ যা বলছেন তার সব কথার সাথে সে সহমত।

মমতাজ রান্নাঘরে গেলেন ভাত আনতে। এরমধ্যে উজান মুখোমুখি বসে থাকা কিরণের পাতে সব খাবার ঢেলে দিলো। নিজের পাতে একটু ভাত আর ভর্তা রাখল। কিরণ আরে আরে করে চেঁচাতে গিয়ে থেমে গেল। উজান আঙুল ঠোঁটে ঠেকিয়ে কিরণকে চুপ থাকতে বলছে। কিরণ ফিসফিস করে বলল,

‘আমি এতকিছু খেতে পারব না। আপনাকে দিয়েছে আপনি খান।’

উজান কিরণের ন্যায় ফিসফিস করে বলল,
‘এক বিন্দু খাবারও যাতে নষ্ট না হয়। সবটা খাবে তুমি।’

‘আরেহ..’

‘সবটা।’ কঠিন গলা উজানের।

‘উফফ।’

মমতাজ রান্নাঘর থেকে ভাতের বাটি হাতে ফিরলে উজান সোজা হয়ে বসে চোখমুখ স্বাভাবিক করে ফেলল। যেন এই মুহুর্তে কিছুই হয়নি। তাকে নিষ্পাপ বাচ্চার মতো বসে থাকতে দেখে কিরণ বিড়বিড় করে কিছু কথা শোনালো।

উজানের শেষের এক লোকমা ভাত খেয়ে বলে,

‘আপনার রান্না সত্যি চমৎকার আন্টি। বিশেষ করে এই চিংড়ি ভর্তা।’

তা শুনে কিরণ মনে মনে তিরস্কার করল উজানকে, “উউউউহ! না খেয়েই চমৎকার! ঢং দেখে বাঁচি না।”

মমতাজ অনেক আপ্লুত হলেন। উজানকে আরো সাধলেন,

‘নাও বাবা, চিংড়ি ভর্তাটা আরেকটু নাও না। গরম ভাত দেই, মজা লাগবে আরো।’

‘না না আন্টি। আমার পেট ভরে গেছে। আর খাবো না এখন। আমি উঠছি।’

মমতাজ তৃপ্তি ভরা চোখে তাকালেন। নিজের মেয়েটাও এমনভাবে একটু প্রশংসা করে না। তিনি ভাবলেন যাওয়ার আগে উজানকে চিংড়ি ভর্তা রেসিপিটা দিয়ে যাবেন।

.

.

সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্তে আহযান আর আয়াতের দেখা পাওয়া যায়। তারা এসেছে বিয়ের কার্ড দিতে। তার আর আয়াতের। আয়াত কিরণকে দেখে অবাক হয়। তার অবস্থা শুনে আফসোসও করে। উজান তখন পুলের পাশে বসেছিল। মোটা ফ্রেমের চশমার বিপরীতে থাকা গম্ভীর চোখগুলো তখন হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে লেখা ‘Being the best version of you’ বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ। আহযান আসায় তাকে বই থেকে মনোযোগ সরাতে হয়। আহযান জানে উজান কখনো তার বিয়েতে আসবে না। উজান মানুষের ভীড়ে থাকতে অপছন্দ করে। তাও আহযানের মেন্টর হিসেবে উজানকে ভদ্রতা রক্ষার্থে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছে।

কিরণ ড্রয়িংরুমে ডিজাইন বই হাতে নিয়ে বসেছিল। এখন আয়াতের সাথে খোশগল্পে মেতেছে। মমতাজ তার জামাকাপড় ব্যাগে ভরছিলেন।

এই সাদামাটা সন্ধ্যাটাকে বিনষ্ট করতে আগমন হয় জাওভান নামক জাহান্নামের।

মেইন দরজা ভেজানো ছিল তখন। জাওভান এসেই দরজায় এমন জোরে ধাক্কা দেয় যে আয়াত আর কিরণ পিলে চমকে উঠে। কিরণ জাওভানকে দেখে নিদারুণ আতঙ্কে মুখের রক্ত সরে যায় কিরণের। জাওভানের চোখ টকটকে লাল, চুল এলোমেলো, চেহারা ফ্যাকাসে।

সে কিরণকে দেখে বাঁকা হাসে। বিড়বিড় করে বলে,

‘জান আমি এসেছি, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেই এসেছি সোনা। তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আমার করে…’

এগিয়ে যেতে থাকে কিরণের দিকে। কিরণের সামনে আসতেই তাকে হাত ধরে টেনে উঠায়। কিরণের কাছে মুখ নিয়ে যায়। কিরণ মাথা সরিয়ে নিতে গেলে জাওভান কিরণের চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরায়। কিরণের ব্যথাতুর শব্দ জাওভানের কানে লাগে না। সে কিরণের মুখের কাছে মুখ এনে বলে,

‘তুমি আমার হবে কিরণ। একমাত্র আমার, আমার কিরণ..’

‘জাওভান চুল ছাড়ো।’ ব্যথায় কিরণের মনে হয় চুলের গোছা ছিঁড়ে আসবে।

কিরণের কথা শুনে জাওভানের চোখ ভস করে জ্বলে উঠে। দাঁতে দাঁত ঘষে বলে,

‘ধরেছি কী ছাড়ার জন্য নাকি? ছাড়বো না তোকে, তুই শুধু আমার, শুধুই আমার, তোকে ধরার অধিকারও আমার। তোর সবকিছু আমার।’

জাওভান এলোমেলো বিলাপ করতে থাকে। কিরণের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। আয়াত কিরণের পাশে ছিল। সে দুরুদুরু বুকে বলে,

‘কিরণকে ছাড়ুন ভাইয়া।’

জাওভান ঘাড় কাত করে তাকায় আয়াতের দিকে। আয়াতের গলা ‌শুকিয়ে গেল ভয়ে। জাওভান আয়াতের কাঁধ ধরে জোরে ধাক্কা মারে আচমকা। সে গিয়ে টি টেবিলের উপর আছড়ে পড়ে। তারপর কিরণের চুল ধরে আবার টানতে টানতে নিয়ে যায়।

চেঁচামেচি শুনে উজান আর আহযান ঘরে আসে। মমতাজও বেরিয়ে আসেন। আহযান ছুটে আয়াতের কাছে। ততক্ষণে জাওভান কিরণকে দরজার বাহিরে নিয়ে গেছে।

কিরণ বাহিরের পিলার শক্ত করে চেপে ধরল ডান হাতে। সে কিছুতেই জাওভানের সাথে নিজের জীবন আর জড়াতে চায় না। উজান তো বলেছিল তাকে সাহায্য করবে। এখন এই আপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সে সাহায্য চাইলেককি উজান না করবে?

কিরণ ছটফট করতে লাগল, ‘ছাড়ো জাওভান। আমি যাবো না তোমার সাথে কোথাও।’

জাওভান চুল ছেড়ে কিরণের ডান হাত চেপে ধরে। পিলার থেকে কিরণের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,

‘যাবি না মানে, তোর ঘাড় যাবে। কত মিথ্যা বলেছিস আমায় হুম? এই বাড়িতে থেকে আমাকে বলতি তুই নিজের দেশের বাড়ি! মিথ্যাবাদী! অনেক হয়েছে, আজকে তোকে নিজের করেই ছাড়বো আমি। তোকে বিয়ে করার সব বন্দোবস্ত করেই এসেছি আমি। চল, আজ তোর আমার বিয়ে হবে, তারপর হবে আমাদের সোহাগ রাত। আজকে তোমার অনেক আদর করব কিরণ। কোনো কষ্ট দেব না বিশ্বাস করো… ‘

কিরণের চোখে পানি চলে এসেছে হাতের ব্যথায়। হাত মঁচকে ধরেছে জাওভান। সে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে,

‘তোকে বিয়ে করবো না আমি। নরকে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই।’

জাওভান উচ্চস্বরে বলল, ‘কেন বিয়ে করবি না তুই আমায় হুম? কেন করবি না? একটা বছর হয়ে গিয়েছে তোর পিছে কুত্তার মতো ঘুরেছি বিয়ের জন্য। তুই পাত্তাই দেস না। কী সমস্যা তোর বিয়ে করলে? যতবারই বিয়ের কথা বলি ততবারই তোর না না শুনি। আর না, আজ তোকে বিয়ে করতেই হবে। তারপর তোর ডানা ভাঙব আমি।’

কিরণকে টেনে জাওভান গেট অবধি নিয়ে গেল। কিরণ মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিল, সে তার জীবনের চরম সত্যিটা জানাবে এখন। যেই কথাটা আজ অবধি উজান আর তার মা ছাড়া জানে না আজ সেই কথাটা সে জাওভানকে বলবে। জাওভান তার সত্যি শুনে মানুক কিংবা না মানুক, কিরণের বিয়ে হোক বা না হোক, সে এই কথাটা জাওভানকে বলবেই বলবে।

সে তখন কান্নারত ভাঙা ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলল,

‘জাওভান। আই ওয়াজ রেইপড।’

থমকে যায় জাওভান। এক মুহুর্তের জন্য হার্টবিট বন্ধ হয়ে যায় তার। ভেতরটা দুলে উঠে। সে কি ভুল শুনলো? উজান ততক্ষণে সদর দরজা পেরোয়। জাওভান পেছনে ফিরে দেখে কিরণ কান্না করতে করতে মাটিতে বসে পড়েছে। তার কানে কিরণের বলা কথাটা বেজে উঠে বারংবার। কিরণের হাত ধরা তার হাতটা আলগা হয়ে যায়।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here