সায়র #পর্ব_২০

0
190

#সায়র
#পর্ব_২০
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

সকাল সাতটা। সূর্যের দেখা মিলেনি এখনো। পরিবেশ ঢেকে আছে আবছা কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে। সাত আটফুট দূরে থাকা জিনিসগুলোও অস্পষ্ট। আজ শীত একটু বেশিই পড়েছে। উজান হাত দিয়ে চুলগুলো পেছনের দিকে ব্রাশ করল। চশমাটা পরে নিলো। বারান্দার রেলিংয়ের উপর দুহাত ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে শীতল আবহাওয়া উপভোগ করছে সে। তবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাগানটাও অস্পষ্ট। সাতটা বাজলেও মনে হয় এখন ভোর চারটা। উজান আজ জগিংয়ে যায়নি। শীতের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। আজ বোধহয় সারাদিনে কুয়াশা কাটবে না।

উজান বারান্দার স্লাইডিং ডোর সবগুলো খুলে দিলো। হুড়হুড় করে হিমশীতল বাতাসে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল তার রুমটা।

উজান তার রুমে রকিং চেয়ারে এসে বসে। রুমে মৃদু সোনালী আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে সে। তার চোখের সামনে চারফুটের একটা ক্যানভাস ঝুলানো। এটা সে মাত্রই আলমিরা থেকে বের করে টানিয়েছে। উজান ঘোর লাগানো চোখে একধ্যানে তাকিয়ে ছিল ছবিটার দিকে। চশমা খুলে রেখেছে। সে এই ছবিটা কৃত্রিম উপায়ে নয়, নিজের চক্ষুদ্বয় দ্বারা দেখতে চায়। উজান রকিং চেয়ার থেকে উঠে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ছবিটার দিকে। ছবিটায় চমৎকার দেখতে একজন রমনী কতগুলো ফুল হাতে বসে ছিল। তার ঢেউ খেলানো চুল পিঠময় ছড়িয়ে। সাদা ড্রেসে স্বর্গীয় অপ্সরীর ন্যায় লাগছিল রমণীটিকে। উজান ডান হাতের তর্জনী দিয়ে মেয়েটির গাল ছুঁলো, ঠোঁট স্পর্শ করল। তৃষ্ণার্ত চাহনি মেলে তাকিয়ে থাকে সে। তখন উজানের নাকে এসে লাগল বেলী ফুলের মিষ্টি সুবাস। চোখ বন্ধ করে প্রাণভরে শ্বাস নিলো সে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। যতবারই এই ছবিটা তার কাছাকাছি থাকে ততবারই তার মনে হয় সে বেলীফুলের বাগানে এসে গেছে। এটা কি অলৌকিক কিছু? হয়তো! উজানের কাছে মনে হয় এটা আসলেই অলৌকিক। এই রমণীর আরো অনেকগুলো ছবি এঁকেছে সে। সেগুলোর সামনে গেলেও বিভিন্ন ধরনের ফুলের ঘ্রাণে ছেয়ে যায় তার আশপাশ। কখনো লিলি, কখনো গোলাপ…

উজান ভেবে রাখল সে সবগুলো ছবি এখন রুমে টাঙাবে। ঘুম থেকে উঠলেই যাতে চোখে পড়ে। পুরো রুমটা ভরে যাবে বিভিন্ন ফুলের ঘ্রাণে। কখনো খুলবে না এগুলো। আর কত লুকিয়ে রাখবে? আর নাহ! যে যা ভাবুক!

সে আলমিরা থেকে বড় বক্স বের করল। বাক্সে কাপড় মোড়ানো অনেকগুলো পেইন্টিং। উজান পেইন্টিংগুলো হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখছে। এই ছবিটার সামনে আসলে গোলাপের ঘ্রাণ আসে।

তখন ঠকঠক আওয়াজে কড়া নেড়ে উঠে। উজানের ঘোর কাটে। সে পেইন্টিংগুলো হাত থেকে নামিয়ে টেবিলে রেখে দিলো। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। অল্প করে ফাঁক করল দরজাটা। দেখল বাহিরে মমতাজ দাঁড়িয়ে। এবার সে পুরো দরজা মেলে দিলো।

‘কিছু বলবেন আন্টি?’

মমতাজ কিছু বলবে তার আগেই তার চোখ গেল দেয়ালে থাকা বড় একটি নিখুঁত চিত্রকর্মের দিকে। যেখানে একগুচ্ছ ফুল হাতে বসে ছিল হুরপরীর ন্যায় রূপবতী কন্যা কিরণ! তা দেখে মৃদু হাসি খেলে গেল মমতাজের ঠোঁটের কোণায়। তিনি যা ভেবেছিলেন তাই ঠিক!

.

.

‘কিরণ, এই কিরণ।’

মমতাজ কিরণকে জাগাচ্ছেন। কিরণ মরার মতো ঘুমাচ্ছে। গত রাতে উজানের সাথে নদীর ধার থেকে এসেছিল দেড়টা কী দুটোয়। তাই সেই সময়কার ঘুম এখন উসুল করে নিচ্ছে। কিন্তু মায়ের জ্বালায় সেটা ঠিক মতো হচ্ছে না। কিরণ অনেক বিরক্ত হয়। কম্বল দিয়ে মাথা ঢেকে হুম হুম করে। মমতাজ শেষে না পেরে এক ঝটকায় কম্বল সরিয়ে দেন। তারপর কিরণের বাহু ধরে ঝাঁকাতে থাকেন। কিরণ উঠে বসে। ঘুম ঘুম চোখে বিরক্তি। এখন মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। এই শীতে এই সময়টা এখন ভোর। এই টাইমে কেউ ঘুম থেকে উঠে! বিরক্তিকর শব্দ তুলে বলে,

‘কী হয়েছে তোমার? এমন করো কেন?’

‘আমার একটা কথা রাখতে হবে।’

চোখ ডলে হাই তুলে কিরণ, ‘কোনটা না রাখছি? বলো।’

‘কসম দে।’

‘উফফ, বলো তো। এমন করে বলো যেন কোনোদিন তোমার কথা রাখি নাই? বলছি না রাখব।’

‘তোকে বিয়ে করতে হবে।’

কিরণের ঘুম ছুটে যায়। ঘুমে ফুলে থাকা চোখ মুহুর্তেই বড় বড় হয়ে যায়।

‘মাথা খারাপ নাকি তোমার? সকাল সকাল বিয়ের ভূত তোমার মাথায় চাপলো? সরো তো, ঘুমাবো।’

কিরণ এই বলে কম্বল নিলো মূখ ঢাকার জন্য। মমতাজ তা হতে দিলেন না। ছোঁ মেরে কম্বলটা ফেলে দিলেন।

‘মা!’ বিরক্তির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তার।

‘তুই বিয়ে করবি কিনা বল!’

‘না।’

‘আমাকে কসম দিয়েছিস কিন্তু।’

কিরণ দুহাতে চুল খামছি দিয়ে ধরল। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে সে। মমতাজ কিরণের দুহাত নিজের হাতে রেখে বললেন,

‘উজানকে বিয়ে করবি তুই।’

কিরণের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সে কি ঠিক শুনছে? উজানের মতো ভদ্র মানুষ দেখে হয়তো তিনি কিরণের যোগ্য মনে করছেন। কিন্তু উজান তো কখনোই তাকে বিয়ে করবে না, আর না কিরণ! সে হাত ছাড়িয়ে নিলো মায়ের থেকে। তারপর হেসে বলল,

‘তুমি পাগল হয়ে গেছ মা, পুরো পাগল।’

এই বলে সে উঠে হাই তুলে বাথরুমের দিকে এগোতে লাগল। মমতাজ এসে হাত চেপে ধরলেন কিরণের।

‘হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি। এখন এই পাগল মায়ের কথা তোর শুনতে হবে। তুই উজানকে বিয়ে করবি।’

কিরণ হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, ‘মানুষ আর খুঁজে পেলে না? বিয়ে করতে হবে তাও কিনা ঐ উজানকে? এরচেয়ে ভালো সারাজীবন আবিয়াইত্তা থাকব।’

‘কিরণ!’ মমতাজের কণ্ঠ সিরিয়াস। ‘তুই উজানকেই বিয়ে করবি। আমার এই কথাটা রাখতে পারবি না তুই?’

কিরণ কোমরে দুহাত রেখে বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল, ‘আচ্ছা মা, তোমার মাথায় বিয়ের চিন্তাটা ঢুকিয়েছে কে বলোতো? আর ঐ উজান-ই কেন? উজানের কথা-ই তোমার মাথায় কেন আসলো? উজান আর আমি দুই মেরুর। না সে আমাকে পছন্দ করে আর না আমি। সে কখনোই আমাকে বিয়ে করবে না, এই চিন্তাটা তার স্বপ্নেও আসবে না আমি একশো পার্সেন্ট শিওর।’

তারপর সে বাথরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। তখন মমতাজ জোরে বলে উঠলেন,

‘উজান রাজি।’

কিরণ যেভাবে ধাম করে দরজা আটকে ছিল সেভাবেই খুলল। চোখে বিস্ময়। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

‘তুমি স্বপ্ন দেখেছ নিশ্চয়ই? কতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকো। ঠিক হয়ে যাবে।’

মমতাজ কিরণকে টেনে বের করলেন বাথরুম থেকে।

‘সত্যি বলছি আমি। ও তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। তবে তোর মত ছাড়া বিয়ে করবে না।’

কিরণ যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য তার চোখের সামনে দেখল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে থমকানো গলায় বলল,

‘এই কথা উজান কখনোও বলবে না। জীবনেও না।’

তারপর পা ফেলে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। উদ্দেশ্য উজানের সাথে কথা বলা। তার বুক ধড়ফড় করছে। উজানের মতো মানুষ তাকে কেন বিয়ে করবে? এটা হতেই পারে না। কখনোই না। উজান তাকে বস্তি, রাস্তার মেয়ে এত বাজে কথা বলে এখন তাকেই বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছে! দোতলায় গিয়ে উজানের দরজায় কড়া নাড়ে সে। দরজাটা খোলাই। কিরণ এবার অনুমতি ছাড়াই ঢুকে পড়ে রুমে। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। দেখল উজান দেয়ালে একটা পেইন্টিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পেইন্টিংটার নিচে লেখা ‘mi amor’

উজান রুমের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। দরজা খোলার শব্দে সে পেছনে ফিরে তাকায়। দেখে কিরণ অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় তার রুমে ঢুকছে। সে সেদিকে ফিরে পকেটে হাত পুড়ে দাঁড়াল।

কিরণ উজানের সামনে এসে দাঁড়াল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘এসব কী শুনছি?’

‘তুমি কী শুনছ আমি কীভাবে জানব?’

এই বলে সে কফিতে চুমুক দেয়। দৃষ্টি তার সদ্য ঘুম থেকে উঠা কিরণের ফোলা চেহারায়।

‘একদম ঢং করবে না আমার সামনে।’ চটে যায় কিরণ, ‘তুমি নাকি আমাকে বিয়ে করবে বলেছ?’

‘এই মিথ্যে কথা কার থেকে শুনেছ?’ উজান ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল।

কিরণ বুকে হাত দিয়ে শান্তির শ্বাস ছাড়ল। তার মা-ই সবসময় আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কিরণের শান্তির শ্বাস আটকে গেল মাঝপথে যখন উজান বলল,

‘বলেছি আমি বিয়ের জন্য রাজি। বিয়ে করব তখন যখন তুমি হ্যাঁ বলবে।’

কিরণ দম আটকে আসা চেহারায় তাকিয়ে থাকে উজানের দিকে। কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘কী যা তা বলছ তুমি?’

উজান জবাব না দিয়ে বারান্দায় চলে গেল। কিরণ তার পিছু পিছু গেল। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘কী বললে তুমি এসব? তুমি আমাকে বিয়ে করবে?’

উজানকে জবাব দিতে না দেখে দিশেহারা হয়ে গেল কিরণ। এটা কীভাবে সম্ভব? উজান কেন তাকে বিয়ে করবে?

‘উত্তর দেও না কেন?’

‘কিরণ। একটা কথা তোমাকে এতবার বলা লাগে কেন? কান পরিষ্কার করে এসে কথা বলো।’

কিরণ এক হাতে চুলে রেখে মাথা ঠাণ্ডা করতে লাগল। সে কয়েকটা গভীর শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

‘মা তোমাকে প্রস্তাবটা দিয়েছে? আমার মা না, আসলে, তোমাকে ভেবেছিল আমার যোগ্য তাই হুট করে বলে বসেছে। তুমি নিশ্চয়ই মাকে মজা করে হ্যাঁ বলেছ তাই না?

‘এই ধরনের বিষয়ে আমি মজা করি না। আর আমাকে কি সত্যি তোমার যোগ্য মনে হয় না কিরণ?’

‘কেন?’ ঢোক গিলল কিরণ, ‘কেন আমাকে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছ?’

‘রাজি না হওয়ায় কারণ আছে?’

‘না থাকার কথা না। তোমার কাছে আমি রাস্তার মেয়ে, বস্তির মেয়ে, থার্ড ক্লাস, লোভী আরো কত কী! সেই মেয়েকেই কেন বিয়ের জন্য রাজি হলে?’

উজান নীরক্ত চোখে তাকায়। ‘আমি তোমাকে সরি বলেছি।’

‘বেশ! কিন্তু আমাকেই কেন? এমন তো না যে আমাদের মাঝে কোনোরকমের প্রণয় সৃষ্টি হয়েছে। কিংবা তোমার মনে বা আমার মনে একে অপরের প্রতি ফিলিংস আসার জন্য এমন কোনো কাজ আমরা কেউই করিনি। তাহলে? তাহলে কীজন্য রাজি হওয়া?’

উজান রুমের ভেতরে সেই পেইন্টিংয়ের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করল। কিরণ উজানকে অন্যদিকে তাকাতে দেখে বলল,

‘আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো উজান।’
উজান তাকালো। কিরণের চোখ বরাবর। কিরণের রাগ হঠাৎ করে নিভে গেল ঐ চোখে তাকিয়ে। উজানকে শাসানোর জন্য কোনো শব্দ তার মুখে আসলো না। উল্টো তার মনে হল উজানকে তার চোখের দিকে তাকাতে বলে ভুল করেছে। ঐ ধারাল দৃষ্টির সামনে সমস্ত রাগ নিমিষেই পানি হয়ে গেল। কিরণ হাঁসফাঁস করতে লাগল ভেতর ভেতর। তার একটু পানি খাওয়া জরুরী।

‘আমার মনে যে ফিলিংস নেই সেই খবর তুমি কীভাবে জানো?’ উজান গভীর চোখে তাকাল।

উজানের কথাটার মানে বুঝতে অনেকক্ষণ লাগল কিরণের। তারপর হতবুদ্ধ হয়ে বলল, ‘তার মানে আমার জন্য তোমার মনে ফিলিংস আছে?’

‘টিউবলাইট কিরণ।’ উজান ঠোঁট টিপে বলল।

‘একদম অপমান করবে না আমায়।’

কিরণ মাথা চেপে ধরল। উজানের প্রতিটি কথা তার অবিশ্বাস্য ঠেকছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল সে। বলল,

‘তুমি তো জানো আমার অতীতে কী হয়েছিল। নাকি সেই দয়া থেকেই রাজি হওয়া?’

‘আমি কাউকে দয়া দেখাই না কিরণ।’ শান্ত স্বরে বলল সে।

‘তোমার ভাই কালকে যা বলেছে তা তো একদম ঠিক বলেছিল। আমাকে যে বিয়ে করবে তার কপাল পুড়বে। আমি তো নষ্ট…’

‘কিরণ!’ উজান আচমকা ধমকে উঠল। সেই ধমকে কিরণ হালকা কেঁপে উঠল। উজানের চোখের দৃষ্টি এমন যেন সে খুব খারাপ একটা কথা বলেছে। উজানের চোখ রাঙা। সেই চোখে চোখ রাখতে পারল না সে। চোখ ফিরিয়ে নিলো কিরণ।

‘এইসব বাজে কথা তোমার মুখে যেন দ্বিতীয়বার না শুনি।’ উজান কঠিন গলায় বলল। তারপর কফিমগটা বারান্দার টেবিলে রেখে, কিরণের নিকট এক পা এগিয়ে আসলো। কিরণের এক হাত দূরত্বে।

ভারী সোয়েটার থাকা সত্ত্বেও কিরণের শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। উজান কিরণের মুখের নিকট ঝুঁকল। রেলিং শক্ত করে চেপে ধরল কিরণ। দাঁত ঠকঠক করে কাঁপছে তার। সে চোখ খুব কষ্টে কুয়াশায় ঢাকা অস্পষ্ট বস্তুর দিকে তাক করে রাখল।

উজান কিরণের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,

‘ভালোবাসা শব্দটা চার অক্ষরের হলেও এর অর্থ সমুদ্রের ন্যায় গভীর। এই গভীর অর্থ প্রকাশের ধরন কিন্তু সবার এক না কিরণ। তাই জাওভান আর আমাকে এক কাতারে ফেলবে না। আমি আমিই।’

উজানের উষ্ণ নিশ্বাস কিরণের কানে পড়ছে। তার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। কিরণ এক পা পেছাল। কয়েকবার ঢোক গিলে শুকনো খটখটে গলাটা ভেজানোর চেষ্টা করল।

উজান তার আগের জায়গায় ফিরে গেল। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কফির মগটা হাতে নিয়ে অবশিষ্ট কফিটুকু মগে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,

‘আমাকে বিয়ে করবে কিরণ?’

কিরণ চমকায়। উজান নিজের মুখে বলেছে!! তাকে প্রস্তাব দিয়েছে বিয়ের!! উজানের প্রশ্নটা কিরণের মনে তোলপাড় সৃষ্টি করে দিলো। সে কখনো উজানের চোখে তার জন্য আলাদা কিছু দেখেনি। তার মনেও তো কিছু নেই। তাহলে সে কীভাবে উজানকে বিয়ে করবে?

‘তুমি তো বলেছিলে আমার মত ছাড়া বিয়ে করবে না তাই না?’

উজান মগ ঘুরানো থামিয়ে কিরণের দিকে তাকায়। কিরণ সেই চোখে চোখ রেখে বলে,

‘আমি যদি তোমাকে বিয়ে করতে না চাই?’

‘কারণ দেখাও।’

‘কারণ হলো… কারণ…’ কিরণ বিভ্রান্ত হলো, সে কী কারণ দেখাবে এখন? উজানকে বিয়ে না করার কারণ তো নেই। তাও সে জোর করে একটা কারণ দেখাল, ‘কারণ আমার মন সায় দিচ্ছে না।’

‘আমি তোমাকে কখনোই মনের বিরুদ্ধে যেতে বলব না কিরণ। তুমি ভাবো। তাও যদি তোমার মন না চায় তাহলে… তাহলে ব্যাপারটা এখানেই ক্লোজ।’

সেই মুহুর্তে কিরণ একপ্রকার পালিয়ে চলে এলো উজানের রুম থেকে। যেন সে কিছু চুরি করেছে। উজানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি সে পাচ্ছিল না। তার বুক কাঁপছিল।

কিরণ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অনেক কথা ভাবতে থাকে। জাওভান আর উজান দুজনেই আলাদা মানুষ। জাওভানের জন্য ভালোবাসা তার মনে তৈরি না হলেও প্রথম প্রথম একটু মায়া জন্মেছিল। তারপর সেটাও কেটে গেল। কিন্তু উজান! উজানের বেলায় তার কখনো কিছুই হয়নি। উজানকে সে নিজের জীবনের সর্বনাশের জন্য দায়ী করে। কিন্তু আদৌ কী তা? উজান তো তাকে আরো বাঁচিয়ে দিয়েছিল সর্বনাশ থেকে। তার পরিবারকে রাস্তায় বসা থেকে বাঁচিয়েছিল। হয়তো সে তার ভাইয়ের জন্যই করেছিল। কিন্তু এখানে তো উজানের স্বার্থ নেই। সব জাওভানের জন্য করেছে সে। উজানের দোষ সে খুঁজে পাচ্ছে না। কিরণকে জাওভানের জীবনে এনেছিল এই একটাই তো ভুল ছিল তার। এসব করেও লাভটা কী হলো উজানের? বরং উজান এতকিছু করে ভাইয়ের থেকে সেই অবজ্ঞাই পেয়ে যাচ্ছে, গালি শুনছে। বলতে গেলে সবদিক দিয়ে উজানের কোনো স্বার্থই ছিল না। সে অবহেলিত।

এখন আবার উজানের মনে নাকি তার জন্য কিছু আছে! এটা কী বিশ্বাস করার যোগ্য? কীভাবে? মানে কীভাবে সম্ভব? উজান সর্বদা এড়িয়ে গেছে কিরণকে। তাহলে তার জন্য…! কিরণের মনে তো উজানের জন্য কোনো ফিলিংস নেই। তবে… তবে অপছন্দ না হওয়ারও তো কোনো কারণ নেই! উজানের ব্যবহার ভালো, নমনীয়, সবদিক দিয়েই সে একশোতে একশো। জাওভানের মতো উচ্ছৃঙ্খল না। উজানকে রিজেক্ট করার মতো আসলে কোনো রিজনই খুঁজে পাচ্ছে না সে। তবে কী উজানকে একটা সুযোগ দিবে?

উজান ফের রুমে এসেছে। দেয়ালে টানানো ছবিটার দিকে তাকাল। কিরণ এটা কী দেখেনি? উজান সেই ঠাণ্ডা কফিতেই চুমুক দিলো। আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই ঠাণ্ডা কফিটাও তার কাছে এখন অমৃত লাগছে! সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বিড়বিড় করল, ‘mi amor’

.
.
চলবে…

**Mi amor মানে কী কে বলতে পারবেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here