সায়র #পর্ব_২০ [বোনাস]

0
222

#সায়র
#পর্ব_২০ [বোনাস]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

উজানের ফোনে হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। উজান তখন ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিল। ফোনের ওপাশ থেকে কিছু শোনামাত্র সে কাজ বন্ধ করে তড়িঘড়ি করে গাড়ি নিয়ে বের হলো।

কিরণ গার্ডেনে। দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে আর এটা সেটা ভেবে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সে মায়ের মুখোমুখি হয়নি। মাকে কী বলবে সেই আশায়। কিরণের ইচ্ছা নেই আপাতত বিয়ের পিঁড়িতে বসার। সে ব্যবসাটাও এখনো ঠিকমতো দাঁড় করাতে পারল না।

না চাইতেও বিভিন্ন আজগুবি চিন্তাভাবনা কিরণের মাথায় এসে চেপে বসেছে। সে যতই মনটাকে অন্যদিকে ঘুরাতে চাচ্ছে তার মন ততই ঘুরেফিরে সেই আজব চিন্তাতেই মশগুল হচ্ছে। এই যেমন সে ভাবছে, উজানের সাথে বিয়ে হলে, সে উজানের সাথে এই বাড়িতেই উজানের রুমে থাকবে, ঘুম থেকে উঠে উজানের ঘুমন্ত মুখ দেখবে, উজান যখন চশমা চোখে এঁটে আর্ট নিয়ে বসবে কিরণ গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকবে, আবার দুজনে রান্নাঘরে একই সাথে দুই রকম খাবার বানাবে। এই ধরনের চিন্তা থেকে কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছে না কিরণ। সে জানে না কেন এসব চিন্তা মাথায় ভর করছে। আর সবচাইতে বেশি যেই ব্যাপারটা ক্ষণে ক্ষণে উদয় হচ্ছে তা হলো উজান কি রোমান্টিক? দেখে তো মনেই হয় না, মনে হয় রসকষহীন মানুষ।

কিরণ চুল শক্ত করে চেপে ধরল। উফফ! এইসব আজেবাজে চিন্তা কেন তার মাথায় আসছে? লজ্জায় তার কান লাল হয়ে গেছে। কিরণ কান চেপে ধরে। মনটাকে কোথায় ঘুরাবে? সে এবার বাগানের গাছগুলো গুণতে লাগল। একটা দুইটা তিনটা, আচ্ছা, উজান কি প্রতিরাতে নদীর কাছে একসাথে হাত ধরে হাঁটার পারমিশন দিবে? উহ!

কিরণ দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। না আর পারছে না সে। মনটা বারবার উজানের কাছে চলে যাচ্ছে। কিরণ বুকে হাত দিয়ে নিজে নিজে বিড়বিড় করল, ‘আমি কি উজানকে ভালোবাসি? তাহলে কোনো ফিলিংস আসে না কেন?’

তার মন থেকে কেউ একজন বলল, ‘তাহলে তুই ওর কথা ভাবছিস কেন?’

‘ভাবা মানেই কি ভালোবাসা নাকি? এমনিতেই ভাবনা চলে আসে।’

‘কেন চলে আসবে যদি তার প্রতি তোর কোনো টান না থাকে?’

কিরণ বুক থেকে হাত সরাল। মনকে সে আর প্রশ্ন করবে না। এবার বাগান থেকে একটা টকটকে লাল গোলাপ ছিঁড়ে নিলো। সে মোবাইলে দেখেছে, ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভালোবাসে কিনা দেখে। তাই সে এবার একটা করে পাপড়ি ছিঁড়তে লাগল আর আওড়াতে লাগল, ‘আই লাভ হিম, আই লাভ হিম নট… ‘

শেষের পাপড়ি ছেঁড়ার পর উত্তর পজিটিভ। সে তাকে ভালোবাসে। কিরণ বিরক্ত হয়ে আরেকটা ফুল নিয়েও এমন করল। সেই সেম রেজাল্ট। কিরণ হাল ছেড়ে দিল। সবাই তার বিপক্ষে। কেউ তার পক্ষ হয়ে কথা বলছে না। তখন তার মন বলে, ‘তুই ইচ্ছে করেই নিজেকে বিপক্ষে নিচ্ছিস। নিজের জেদটাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমাকেও তোর বিপক্ষ দলে ফেলে দিলি। পাগল মেয়ে।’

কুয়াশা এখনো কাটেনি। কিরণ এদিক সেদিক হাঁটছে। তখন গাড়ির আওয়াজ শোনা যায়। সে বাগান পেরিয়ে উঁকি দিলো। দেখল উজান গাড়ি থেকে নামছে। ভ্রু কুঁচকে কৌতুহল নিয়ে চেয়ে রইল কিরণ। উজান আবার কখন বের হলো? সে তো দেখলোই না। কিরণ আরো অবাক হলো যখন দেখল উজানের সাথে একজন মহিলা ও পুরুষ নেমেছে। উজান আর মহিলাটি লোকটিকে দুদিক থেকে ধরে ঘরের ভেতর নিচ্ছে। কিরণ আরেকটু এগিয়ে গিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল এবার। এনাদেরকে এর আগে জাওভানের ফোনে দেখেছিল। উজান ও জাওভানের মা আর বাবা। এনারা তো নিউইয়র্কে। হঠাৎ এখানে? উজানও তো কিছু বলল না এই ব্যাপারে। আর উজানের বাবার এই অবস্থা কেন? হাতে আর কপালে ব্যান্ডেজ। সে ঘরে ঢুকে গেল পেছনের দরজা দিয়ে।

জাহানা এবং মহিনকে উজান নিচতলার একটা রুমে নিয়ে এসেছে। মহিনকে বেডে বসিয়ে মাকেও ফ্রেশ হতে বলল। সে বেরিয়ে সকলের জন্য খাবার তৈরি করার জন্য রান্নাঘরে গেল। মমতাজ রান্নাঘরেই ছিলেন এতক্ষণ। উজানকে রান্নাঘরে দেখে বললেন,

‘ওনারা কি তোমার বাবা মা উজান?’

‘জি আন্টি।’

‘তোমার বাবার হাতে কী হয়েছে?’

‘সিঁড়ি থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছিল।’

এবার কিরণ এসে রান্নাঘরে যোগ দিলো। মমতাজকে ঘরে পাঠিয়ে নিজে রুটি বানাতে লাগল। এই ফাঁকে উজানকে বলল,

‘তোমার বাবা মা যে আসবে বললে না তো একবারও।’

‘আমি নিজেও জানতাম না যে তারা আসবেন।’

‘মানে? আর আংকেলের হাতে কপালে ব্যান্ডেজ কেন?’

উজান ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তখন ফোন পাওয়া মাত্রই সে হাসপাতালে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে তার বাবা হসপিটালের বেডে, আর মা পাশে বসে কাঁদছেন। তাদেরকে জিজ্ঞেস করে যা জানা গেল তা হলো, জাহানা আর মহিনের এই মাসেই বিডিতে আসার কথা ছিল। তারা এটা জাওভানকে জানিয়েছিল। তারা জানতেন না যে উজান শিফ্ট করে বাংলোতে এসেছে। যখন ফ্লাটে পৌঁছায় তখন জাওভান মাতাল ছিল। জাহানা ছেলের এই অবস্থা দেখে অনেক ক্ষুব্ধ হন। অনেক কথা শোনান জাওভানকে। সাথে উজানকেও দোষ দিতে থাকেন তার ছেলেটাকে একা রেখে চলে গেছে বলে। উজানের কথা উঠতেই জাওভানের মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে উল্টো রাগারাগি করতে থাকে মায়ের সাথে। উজানকে বাজে কথা বলার সাথে সাথে তার মাকেও কথা শোনায়। তা দেখে জাওভানের বাবা মহিন সপাটে চড় মারেন জাওভানের গালে। চড়টা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে। সে ভুলে গেল সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো যে তার বাবা মা। জাওভান তার বাবাকে ধাক্কা মারল সজোরে। তার বাবা উল্টে পড়ে কপাল ফাটালেন। জাহানা চিৎকার করে উঠলেন। জাওভান তার বাবার কলার ধরে টেনে এনে দরজার বাহিরে ফেলল। তাল সামলাতে না পেরে মহিন সিঁড়িতে আছড়ে পড়েন। মাত্র তিনটা সিঁড়ি ছিল। সেই তিনটা থেকেই গড়িয়ে নিচে পড়েন। তারপর সে তার মাকে বের করে দিয়ে দরজা আটকে দিল। তার মা কাঁদতে কাঁদতে ড্রাইভারের সাহায্যে নিকটস্থ হসপিটালে নিয়ে আসেন।

সবকিছু শুনে কিরণ স্তব্ধ বনে গেল। জাওভান এতটা নিষ্ঠুর! নিজের বাবা মাকেও ছাড়েনি! ছিহ! ধিক্কার এমন সন্তানকে।

উজান একটা ট্রেতে রুটি ডিম আর ফ্রেশ জুস নিলো। বাবার জন্য ডিম সেদ্ধ করল আলাদা করে।

জাহানা স্বামীর পাশে বসে আছেন আর নিজের ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছেন। কেমন ছেলেকে পেটে ধরলেন তিনি যে কিনা নিজের বাবা মাকে আহত করে!

উজান নক করে ভেতরে ঢুকল। টি টেবিলে মায়ের খাবার রেখে বাবাকে ধরে বসাল। নিজ হাতে বাবাকে খাইয়ে দিতে লাগল সে। তা দেখে কান্না উপচে পড়ল জাহানার। এই একটা ছেলে যে তাদের যত্ন করে যেখানে নিজের পেটে ধরা ছেলেটা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। জাহানা আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকেন উজানের দিকে। তার বোন মারা যাওয়ার পর উজানকে নিজের ছেলের মতো করে বড় করেছিলেন। জাওভান আসার পর উজানের আদরে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। এমন না যে তিনি উজানকে কম আদর করতেন। দুজনকেই সমান আদর করতেন। তাও, কোনো না কোনোভাবেই তার নিজের ছেলের প্রতিই টানটা বেশি থাকত। তিনি সবসময় উজানের সাফল্য থেকে জাওভানের সাফল্যে বেশি খুশি হতেন। বড় হওয়ার পর জাওভান ভাইয়ের জন্য যখন পাগলপ্রায় হয়ে গেল তখন তার উজানকে বিরক্ত লাগা শুরু করেছিল। উজান সব দিক দিয়েই এগিয়ে ছিল জাওভানের থেকে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি জাওভানকে পাঠিয়ে দিলেন উজানের কাছে। জাওভানের ব্যবহারের চেয়ে উজানের ব্যবহার ছিল মনকাড়া আর আকর্ষণীয়। জাহানা ভেবেছিলেন তার উচ্ছৃঙ্খল ছেলেটা উজানের সংস্পর্শে এসে কিছুটা হলেও বদলাবে। বদলেও ছিল। তারপর কোন একটা মেয়ে আসলো জাওভানের জীবনে, তখন থেকে জাওভান আগের চেয়েও বেশি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। মুখে প্রকাশ না করলেও জাহানা মনে মনে এসবের জন্য উজানকে দোষ দিয়েছেন। কিন্তু উজানের জন্য তার ভালোবাসারও কমতি ছিল না। জাওভানকে যা দিতেন উজানকে আরো বেশি করে দিতেন। উজানের মায়া মায়া চেহারার দিকে তাকালে জাহানা উজানকে কাছে টেনে নিতেন, আর যখন জাওভানের বিশৃঙ্খলাপরায়ণ জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে যেতেন তখন আবার উজানের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাতো।

অথচ এই ছেলেটাই আজ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বুড়ো বাবা মাকে আগলে রেখেছে। জাওভান কখনো নিজ থেকে ফোন দিয়ে তাদের খোঁজ খবর রেখেছে কিনা তার মনে নেই, তাদেরকেই জাওভানকে কল করতে হতো। অন্যদিকে উজান প্রায়শই কল করে তাদের খোঁজ খবর নিতেন। উজান, তার বোনের ছেলেটা আজ তাদের নিজের ছেলের থেকেও বেশি আপন হয়ে উঠল। জাহানার এখন আফসোস হচ্ছে শুধু শুধু উজানকে মনে মনে তিনি খারাপ ভাবতেন। সেই খারাপ ছেলেটাই আজ মহিনকে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে।

‘মা তুমি খাচ্ছো না কেন?’

জাহানাকে মনমরা করতে দেখে উজান বলল। জাহানার ধ্যান ফিরে। তিনি চোখের পানি মুছে খাবারে মনোযোগ দেন। খাবার খেতে খেতেই তিনি স্বগতোক্তি করেন,

‘জুভ এতটা বেয়াদব হবে ভাবতে পারিনি। ও কীভাবে নিজের বাবার গায়ে হাত তুলল?’

বলতে গিয়ে তিনি কেঁদে ফেললেন। উজান এসে তার মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। জাহানা ছেলেকে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন।

কিরণ রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় ভেতরে গিয়ে সাক্ষাত করবে কিনা ভাবছে। এখন তাদের মাঝে ঢুকতে ইচ্ছা হলো না। তাই প্রস্থানের জন্য পা বাড়াল। তখন মহিন কিরণকে দেখে ডেকে উঠলেন,

‘কে তুমি?’

উজান তার মাকে ছেড়ে দরজার দিকে তাকায়। দেখে কিরণের জামার একাংশ দেখা যাচ্ছে। সে কিরণকে বলে,

‘কিরণ ভেতরে আসো।’

কিরণ ধীর পায়ে ভেতরে আসে। সালাম দেয় তাদের। জাহানার মনে হলো এই মেয়েটাকে দেখেছেন কোথাও। তার মনে পড়েছে। জাওভান তাদেরকে দেখিয়েছিল এই মেয়েটাকে। সে নাকি একে ভালোবাসে। এই মেয়েটার জন্যও তো জাওভান তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। উজান তার মায়ের চোখের ভাষা পড়ে ফেলল চকিতেই। মা যাতে কিরণ সম্পর্কে কোনো নেগেটিভ ধারণা না রাখে তাই সে বলল,

‘মা ও কিরণ। জাওভানের এক্স এখন। জাওভান তোমাদের সাথে যেই ব্যবহার করেছে কিরণের সাথে তারচেয়ে দ্বিগুণ বাজে ব্যবহার করেছিল।’

কথাটা অবিশ্বাস করলেন না মহিন ও জাহানা। যেখানে জুভ বাবা মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারে সেখানে কিরণ তো বাহিরের মেয়ে। জাহানা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। এখন আর তার কিরণের প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই। শুধু শুধু ক্ষোভ পুষে লাভ কী?

মহিন বলল, ‘ও এখানে কেন?’

‘কয়েকদিন আগে ও অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। আপাতত কোথাও উঠতে পারছে না। তাই এখানে নিয়ে এসেছি।’

উজান চোখের ইশারায় কিরণকে তার মায়ের পাশে বসতে বলল। কিরণও ভদ্র মেয়ের মতো বসল।

উজান জাহানার হাত ধরে বলল, ‘মা যা হয়েছে ভুলে যাও এখন। জাওভানের মাথা আপাতত ঠিক নেই। যখন নিজের ভুল বুঝবে তখন ঠিকই এসে ক্ষমা চেয়ে নিবে।’

জাহানার মনে হয় না জাওভান এমনটা করবে। জাওভান এমন ছেলেই না।

‘আমি ও’কে কখনো ক্ষমা করব না।’

‘এভাবে বলো না মা। ও তোমার ছেলে। সন্তানেরা ভুল করবেই। তুমি আর বাবা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে ও কার কাছে যাবে বলো! ও ক্ষমা চাইবেই। চাইতেই হবে। তুমি প্লিজ জুভকে ক্ষমা করে দাও মা।’

উজান আরো কিছু বলে মাকে আশ্বস্ত করল। তারপর তাদের বিশ্রাম করতে দিয়ে কিরণকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

.

দুপুরে সবাই খাবার টেবিলে বসল। মমতাজ চলে যাবেন বিকেলে। তিনি এখনো কিরণকে খোচাচ্ছেন উত্তর দেয়ার জন্য। কিরণ উত্তর দেয়নি। সে আরো ভাববে। ভেবে জানাবে।

উজান দ্বিধাবোধকে দূরে ঠেলে সবার সাথে বসল। কিরণ আর উজান মিলমিশ করে খাবার সবার পাতে তুলে দিচ্ছে। এরমধ্যে মমতাজ জাহানার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছেন।

খাবার পর্ব শেষে কলিংবেল বেজে উঠে। উজান গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা বোতল উজানের পায়ের সামনে এসে ভেঙে পড়ে। উজান সাইডে সরে দাঁড়ায়।

জাওভান নিয়ন্ত্রণহীন পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। উষ্কখুষ্ক চুল ছড়িয়ে আছে সারা কপালে। জাওভানকে দেখে সবাই চমকে যায়।

উজান জাওভানকে ভেতরে আসতে দেয়। জাওভান এসে সোফায় ধাম করে বসে পড়ে। জাহানা ভাবেন তার ছেলে ক্ষমা চাইতে এসেছে। কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত হলো যখন সে তার বাবা মাকে দেখে উজানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমি জানতাম। আমি জানতাম মম ড্যাড এখানেই আসবে। তুই এনেছিস তাই না। মম ড্যাডকে এখন আমার থেকে কেড়ে নিতে চাচ্ছিস তাই না?’ জাওভানের কণ্ঠ জড়ানো। সে যে মাতাল তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

উজান হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে ছিল। জাওভানের কথা শুনে বলল,

‘আমি কাউকেই কেড়ে নেইনি। তুই ভুল করেছিস এখন ক্ষমা চাইবি।’

‘ভুল?’ জাওভান বিদ্রুপ করে বলে, ‘আমি, এই জাওভান কখনো ভুল করে না। যা করে একদম ঠিক করে।’

‘জাওভান!’ মহিন ধমকে উঠলেন।

‘এই বুড়া চুপ। একদম চুপ।’ সে ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে মহিনকে চুপ করতে বললেন। জাহানা হতবাক। জাওভানের সাহস কত!

‘জাওভান, দিন দিন অসভ্য হচ্ছিস তুই।’ উজান বলে উঠে।

‘আমি সভ্য নাকি অসভ্য তা নিয়ে তোর মাথা না ঘামালেও চলবে।’

মহিন বসে ছিলেন চেয়ারে। জাওভান মহিনের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে আফসোসের ভান করে বলল, ‘আহারে। ঐ বুড়াটার কী অবস্থা হয়েছে। আমার তো ইচ্ছা ছিল একদম বসিয়ে দিবো।’

উজান কঠোর গলায় বলল, ‘লিমিট ক্রস করবি না।’

‘হুর! ছাড়তো। আজাইরা। তুই বলার কে? আমি আমার বাপ মাকে যা ইচ্ছা তা বলব। তোর সমস্যা?’

জাহানা এসে জাওভানের গালে চড় বসালেন। জাওভান হুট করে তার মাকে ধাক্কা দিলো। উজান পাশেই ছিল বলে সে মাকে ধরে ফেলল। সে কিছু বলবে তার আগে মহিন চেঁচিয়ে বললেন,

‘বেয়াদবির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি? বস্তি থেকে উঠে আসা ছেলে মেয়েরাও বাপ মায়ের কদর করতে জানে। তুমি তো তাদের চেয়ে আরো নিকৃষ্ট।’

জাওভান পাত্তাই দিলো না। সে বুজে আসা চোখে চারপাশটা দেখল। কিরণকে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চোখ বড় হয়ে যায়। এক ভ্রু উঁচু করে জিভ টেনে টেনে জড়িয়ে আসা গলায় উজানকে বলে,

‘আমি নাকি অসভ্য! তুই তো আরো বেশি অসভ্য তাহলে। এই স্লাটটাও দেখি এখনো এখানে। এখানে রেখে কি তার থেকে সার্ভিস নিচ্ছিস নাকি?’

উজানের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। তার রাগ লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। ইদানীং কিরণ সম্পর্কে বাজে কথা তার সহ্য হয় না। সে মাকে ছেড়ে কষিয়ে একটা চড় দেয় জাওভানের গালে। ঘুষির চোটে জাওভান উল্টে পড়ে ফ্লোরের উপর।
সে গালে হাত রেখে চোখ লাল করে বিড়বিড় করে বলল, ‘শুয়ো’রের বাচ্চা।

উজান জাওভানের কলার চেপে ধরে। জাওভানের চোখে চোখ রেখে কঠিন গলায় বলে,

‘বাপ মা তুলে কথা বলবি না জাওভান। তোর মতো কুলাঙ্গার ভাই যাতে কারো না হয়।’

‘ভাই! হাহ! কে ভাই? কার ভাই? তুই আমার ভাই?’ জাওভান তাচ্ছিল্য করে বলে। উজানের হাত থেকে ঝাড়া মেরে নিজের কলার ছাড়ায়। ‘তোকে আমি ভাই বলে মেনেছি কবে? আর কী বললি? বাপ মা! বাপ মায়ের কি বুঝবি তুই? তোর কোনো বাপ মা আছে?’

তারপর পৃথিবীর অকাট্য সত্যিটা জাওভান অবলীলায় বলে উঠল, ‘তুই তো বেজন্মা। মম বলেছে আমায়, তোর মা একশোটা লোকের বিছানায় যেত। তোর জন্মের-ই তো ঠিক নেই। যার জন্মের ঠিক নেই সে আমাকে বাপ মা নিয়ে বোঝায়? কিসের ভাই তুই? তোকে আমার মা দয়া দেখিয়ে আশ্রয় দিয়েছে, নাহলে তোর মতো বেজন্মা তো রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়াত।’

উজান থমকে যায়। রাগের পরিবর্তে একঝাঁক তমসা ঘনিয়ে এসে ঝেঁকে ধরে তাকে। কিরণ সহ বাকি সবাই বিস্ফারিত নয়নে তাকায় জাওভানের দিকে। জাহানা এগিয়ে এসে জাওভানকে আরো চড় দিতে লাগে। একটার পর একটা চড় দিয়েই যাচ্ছেন। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কোন কুক্ষণে যে তিনি জাওভানকে এসব বলতে গেলেন! আগে এসব বলতেন জাওভান যখন উজানের জন্য পাগল হয়ে গেছিল। পরে নিজেই অনুতপ্ত হয়েছিলেন এসব বলার জন্য। কিন্তু জাওভান যে এখনো সেসব মনে রেখে উজানকে এভাবে আঘাত করে বসবে ভাবেননি তিনি।

কিরণ জানত না যে উজান আর জাওভান আপন ভাই নয়। সে কখনো এসব ব্যাপারে আগ্রহই দেখায়নি। কিন্তু এখন জাওভানের মুখ থেকে কী শুনছে সে এসব? উজানের বাবা মা নেই? সে আসলে এই ধরণীতে নিঃস্ব?

উজানের চোখমুখ লাল, চোখ কেমন ঘোলাটে আর ঝাপসা। সে ঠিকমত চোখ খুলে রাখতে পারছে না। তার মাথায় ক্রমাগত হাতুড়ের মতো কিছু একটা আঘাত করেই যাচ্ছে। এই কথাগুলোর কিছু কথা জাওভান আরো একবার বলেছিল। যেদিন তাদের মধ্যে প্রথম ঝগড়া হয় ফ্লাটে। তখন উজানের ততটা গায়ে লাগেনি যতটা আজ লেগেছে। আজ জাওভান আরো বেশি বলেছে তাকে। উজান ঢোক গিলল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। এতটা একা, নিঃসঙ্গ, কখনো মনে হয়নি তার। যেই জাওভানকে এতদিন আপন ভেবে এসেছিল সে যে কথার পিঠে এভাবে আঘাত করবে উজান ভাবেনি। কয়েকটা বাক্য একদম ধারালো তীরের মতো এফোঁড় ওফোঁড় করে উজানের বুক চিরে বেরিয়ে গেল। উজানের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে অনেক। সে টের পেল তার চোখে জল এসে ভীড় জমাতে শুরু করেছে। উজান চেষ্টা করল চোখে জল জমতে না দেওয়ার। কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। নিজেকে সামলাতে পারল না। এক ফোঁটা জল সঙ্গে সঙ্গে চশমার কাঁচে টুপ করে পড়ল। আজ নিজেকে কঠিন আবরণে ঢাকতে পারল না সে। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল জাওভানের কথায়।

কিরণ উজানকে দেখে আতঙ্কিত হলো। সে কখনো উজানকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখেনি। এই কঠিন মানুষটা যে হুট করে দুর্বল হয়ে পড়বে সে কখনো কল্পনাও করেনি। উজানের কষ্ট দেখে তার কষ্ট হচ্ছে। উজানকে মলিন মুখে মানায় না, তার তো মানায় গম্ভীর মুখে। কিরণ এসে উজানের পাশে দাঁড়াল। উজানের চোখের দিকে তাকাতেই কিরণ ধাক্কা খায়। উজানের চোখে জল! ঠিক কতটা কষ্ট পেলে এই কঠিন পাথরের ন্যায় মানবটা কেঁদে ফেলে!

কিরণ নিজের অজান্তেই উজানের হাত চেপে ধরল। উজান ম্লান চোখে তাকাল। কিরণের কান্না পাচ্ছে ভীষণ। উজানের চোখের দৃষ্টি কেমন শূন্য।

কিরণকে উজানের হাত চেপে ধরতে দেখে জাওভানের অগ্নিশর্মা চোখে তাকাল। মাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। মমতাজ এসে জাহানাকে ধরলেন। জাওভান দাঁত কটমট করে বলল,

‘পাবলিক প্লেসেই নষ্টামি শুরু হয়ে গেছে। আর কত নষ্টামি করবি? লজ্জা লাগে না তোর কিরণ? এই মুখ নিয়ে বেরোস কীভাবে? লুচ্চামি করস যেখানে সেখানে। এখন তো দেখি উজানের সাথে তোর অনেক ভাব। উজান কী তোর নাগর হয় নাকি রে?’

জাওভানের কথার জবাবে কিরণ শক্ত গলায় বলল,

‘হয়নি। তবে হবে।’

তারপর সে উজানের দুহাত ধরল। উজানের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘তুমি বলেছিলে না আমি বিয়েতে রাজি হলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। আমি রাজি। এখন এই মুহুর্তে আমাকে বিয়ে করতে হবে তোমায়।’

এই বলে সে উজানের হাত ধরে টেনে নিতে লাগল। হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় জাওভান তেড়ে আসে, কিরণের গলা চেপে ধরে বলে,

‘দুশ্চরিত্রা ,আমাকে ‌দিয়ে হচ্ছে না দেখে আরেক বেজন্মাকে দিয়ে নিজের চাহিদা মেটাতে চাস? আমাকে রেখে আরেক বেজন্মা কে বিয়ে করবি? এতই শখ তোর? বিয়ের সাধ মেটাচ্ছি তোর আমি। বলেছিলাম না, আমি না পেলে তোকে কাউকেই পেতে দেব না। আজ তোকে মেরেই ফেলব।’

কিরণের চোখ উল্টিয়ে আসে জাওভান এত শক্ত করে ধরায়। জাওভানের নখ বসে যায় কিরণের গলায়। সেই মুহুর্তে উজানের ভয়ংকর রূপ প্রকাশ পায়। সে জাওভানকে এত জোরে টান দিল যে জাওভানের সবগুলো শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেল। তারপর নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জাওভানের মুখে গুণে গুণে তিনটা ঘুষি দিল। পেটে লাথি দিল। একটা ঘুষিতেই জাওভানের দাঁত ভেঙে গিয়েছিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু করল। কেউ এসে ধরল না তাকে। ধরার প্রয়োজনবোধও মনে করল না।

উজানের এই রূপের সাথে কেউ কখনো পরিচিত ছিলনা বিধায় তারা অনেকটাই বিস্মিত হয়। কিরণ ভয় পেয়ে যায় কিছুটা। শান্ত মানুষ রাগলে কতটা ভয়ানক দেখায় তা উজানকে না দেখলে বোঝা যাবে না।

উজান কিরণের হাত চেপে ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। মমতাজ আর জাহানাও আসলেন সাথে। উজান গাড়ি নিয়ে সোজা কাজী অফিস চলে গেল। সেই মুহুর্তেই তার আর কিরণের বিয়ে হয়। একদম সাদামাটাভাবে।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here