সিন্দুক রহস্য,পর্ব ৩

0
275

#সিন্দুক রহস্য,পর্ব ৩
#শেলী ভট্টাচার্য

আমরা দুজনে রমেন বাবুর সাথে যাদবপুরের যে রেস্তোরায় গিয়ে বসলাম, তার নামটা ফেলুদার জব্বর পছন্দ হল। আমিও ঢোকবার সময় বেশ মজা করে পড়ছিলাম নামটা ‘ভূতের রাজা দিল বর।’ এইট বি বাসস্ট্যান্ডের লাগোয়া ইউনিভার্সিটির ঠিক উল্টোদিকে এই রেস্তোরাটা। ভেতরটা ছিমছাম পরিবেশে বেশ সুন্দর করে সাজানো। হাল্কা মিউজিকও বাজছে। ফেলুদা রমেন বাবুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলে, উনি প্রস্তাব দিলেন রেস্তোরার ভেতরে গিয়ে বসার জন্য। বাড়িতে গেলে নাকি প্রাণখুলে সব কথা বলা যেত না। রেস্তোরায় ঢুকে একটা টেবিলকে কেন্দ্র করে তিনটে চেয়ারে বসলাম আমরা। চায়ের সাথে অন্যকিছু খাওয়ার জন্য বারবার জোর করছিলেন রমেন বাবু। ফেলুদা এসব অফারে বেশিরভাগ সময়ে ফিশফ্রাই অর্ডার দিতে বললেও, এক্ষেত্রে রমেন বাবুর পারিবারিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে, ভেজ কাটলেট অর্ডার দিতে বলল। এরপর শুরু হল আলোচনা। রমেন বাবুই শুরুটা করলেন …

“আপনাকে আমাদের বাড়ির কথা গোড়ার থেকেই বলি। নইলে এখনকার ফ্যামিলি মেম্বারদের মধ্যের সম্পর্ক বোঝানোটা আমার পক্ষে কতকটা অসুবিধা হবে। আমি ছোটো থেকেই দেখে এসেছি, বাবা ঘরে কম থাকত। পরে বড় হয়ে বুঝেছি, শুধু ঘরে নয়, বাবা দেশেও কম থাকত। ওঁর ছিল বিবিধ ভাষা জানার নেশা। বিবিধ জাতির মানুষকে নিয়ে ফিল্ড স্টাডি করে লেখালেখি করত। তাতে প্রসারও করেছিল। শুনে থাকবেন হয়তো বাবা একসময় তুরকির একটা প্রায় হারিয়ে যাওয়া ভাষা নিয়ে গবেষণা করে পুরস্কারও পেয়েছিল।”

“রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কারপ্রাপ্তির কথাটা বলছিলেন কি?” ফেলুদা সংশয়ে বলল।

“না না, রাষ্ট্রপতির হাত থেকে নয়, ওটা ছিল ওয়ার্ল্ড ল্যাঙ্গুয়েজ সংস্থার উদ্যোগ।”
দেখলাম ফেলুদা ছোট্ট করে “আচ্ছা” বলে চুপ করে গেল।

রমেন বাবু বলে চললেন “সে যাইহোক, এসব কাজের জন্যই বাবা দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াত। তবে মাসে মাসে টাকা পাঠাত। টাকা আসলেও একা হাতে চারটে ছেলেমেয়েকে সামলে চলা তো আর চাট্টিখানি কথা ছিল না। তখন এক অবিবাহিত পিসি আর ঠাকুমাও ছিল আমাদের বাড়িতে। সব সামলে মা আমাদের নিয়ে একেবারে নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল। সেসময় মায়ের অবস্থা বুঝে দাদাকে মামা এসে নিয়ে যায় ওর বাড়িতে। মামা প্রোমোটারির ব্যবসা করত। দাদা বড় হয়ে সেই ব্যবসাতে হাতেখড়ি দিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করে। তারপর ধীরে ধীরে দিদির বিয়ে হয়ে যায়। আমরা দুভাই বিয়ে করি। দাদা বৌদিকে নিয়ে এ বাড়িতে চলে আসে। আমি তখন একজনের কাপড়ের ব্যবসায় পার্টনার ছিলাম। নিজের ব্যবসা শুরু করিনি। ছোটো বোন বিয়ে করে চলে যায়।

এরপর বড়দার একটা মেয়ে হয়। আমার এক ছেলে হয়। ছেলে হওয়ায় ছোটো বৌ, মানে আমার স্ত্রী আমার মায়ের কাছে বরাবরই বেশ সুনজরে ছিল। যেটা বড় বৌদির ক্ষেত্রে একেবারেই ছিল না। মায়ের দিকের কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেলে, মা সবসময় ছোটো বৌকে সঙ্গে নিতে যেত। বৌদিকে হেসেল ছেড়ে একদিনও উঠতে দেওয়া হত না। কিন্তু তাই বলে এসবের জন্য তো আর আমার বৌ দায়ী ছিল না?”

এমন সময় পোষাক পরিহিত বেয়ারা চা ও কাটলেট নিয়ে আসায়, রমেন বাবুর কথায় ছেদ পড়ল।

একটা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে ফেলুদা বলল “আপনাদের দুভাইয়ের কখনও বাবার গবেষণার প্রতি কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না? মানে, বাবা বাড়িতে আসলে সেসব নিয়ে কখনও কথা বলেননি?”

“না, আমার মাথায় সেসবের প্রতি ঝোঁক অনুভব করিনি কখনও। বোধ করি দাদাও করেনি। তবে বড়দি আসলে বাবা টুকটাক আলোচনা করত। দিদির এসব গবেষণামূলক কাজে ইন্টারেস্ট ছিল।”

“তিনি এখন …” বলে ফেলুদা লাগাম টানল।

“দিদি মারা গেছে আজ প্রায় নয় বছর হল। অ্যাক্সিডেন্টে। জামাইবাবুও একসাথেই …” বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কিছুক্ষণ থামলেন রমেন বাবু।

“বড়দির ছেলে সঞ্জীব সেই থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকে।”

“আচ্ছা, যে আপনার দাদাকে সেদিন রাতে প্রসূন বাবুর ঘরে ঢুকতে দেখেছিল?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি জানেন?”

“হুম। বাগচী বলছিলেন ওপর ওপর দিয়ে। তারপর বলুন।”

এরমধ্যে বেয়ারা আরেকবার এলো আর কিছু লাগবে কিনা জানতে। তখন রমেন বাবু আবার সৌজন্যতা দেখিয়ে বললেন “আর কিছু অর্ডার করব?”

ফেলুদা হাত নাড়িয়ে, না না বলে থেমে গেল।

বেয়ারাও রমেন বাবুর ইশারায় চলে গেল।

রমেন বাবু আবার বলতে লাগলেন “মা মারা যাওয়ার এক মাস আগে বাবা শেষ বিদেশ যাত্রা সেরে বাড়ি ফিরেছিল। মায়ের মৃত্যুটা হঠাৎ করেই হয়েছিল। একটা স্ট্রোক, তারপর সাতদিনের মধ্যে পরপর আরো দুটো স্ট্রোক হয়ে চলে গেল মা। যাওয়ার আগে বাবাকে এ সংসারে স্থিতু হতে বলেছিল। তারপর থেকে প্রায় বারো বছর বাবা একটানা বাড়িতে ছিল। এ বিষয়ে আপনাকে একটা কথা বলে রাখি, মায়ের মৃত্যুর কারণেও ইনডাইরেক্টলি দাদাই ছিল। দাদার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছিল তখন। টাকার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করছিল। জোর করে বাড়ির রিমডেলিং করে, দোতলায় একটা ঘর করেছিল। সেখানে সপ্তাহে সপ্তাহে মদের আসর বসত। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন চলছিল। মা এসব মেনে নিতে পারছিল না। বাবাকে বহুবার চিঠি লেখার পর বাবা দেশে ফিরেছিল। কিন্তু ততদিনে চিন্তায় চিন্তায় মা ধুঁকে গিয়েছিল। শেষবার বাবা যখন তুরকি থেকে ফিরল, তার সাথে করে এসেছিল মিলু। আমাদের বাড়ির চাকর।”

“এসেছিল মানে? ভিনদেশী?” প্রশ্ন করল ফেলুদা

“হুম, ও তুরকির বাসিন্দা। মা বাবা মরে যাওয়া অনাথ মিলুর তখন বয়স ছিল ষোলো কি সতেরো। ও নাকি বিদেশে বাবার সাথে টানা ছয় সাত বছর ছিল। একরকম মায়া বশতই বাবা ওকে এদেশে নিয়ে এসেছিল।”

“আপনার বাবা কি মৃত্যুশয্যাতেও ভাষার গবেষণা করছিলেন?”

ফেলুদার প্রশ্নের উত্তরে রমেন বাবু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন “সেটা সঠিক বলতে পারব না। কিন্তু কিছু একটা নিয়ে খুব মনোযোগী হয়ে থাকত। বা হয়তো পড়াশোনা করত। এই কয়মাস খুব অসুস্থ ছিল বলে, নইলে ছ’মাস আগেও মাঝেমধ্যেই দরজা বন্ধ করে সিন্দুক খুলে কিছু করত ঘরে। আর আমার ধারণা সেটা খুব মূল্যবান কিছু নিয়ে গবেষণা। সেসব কাগজপত্রই ছিল সিন্দুকে।”

“ছিল মানে? আপনি বলছেন এখন নেই সেসব?” ফেলুদার প্রশ্ন।

“এবার তাহলে আসল ব্যাপারটা খুলেই বলি আপনাকে। দাদার দুমাস আগে অনেক বড় একটা লস হয়। সোসাইটি করবে বলে বড় ফ্ল্যাট করেছিল দশ এগারো বছর আগে, তা অনেকটা ভেঙ্গে পড়ে। বুঝতেই পারছেন দু নম্বরি মালপত্রের কারবার। সেই ঘটনার পর, ফ্ল্যাটের যে অংশগুলো ঠিক ছিল, তারাও ছেড়ে দিতে চায়। সবাই মিলে দাদার ব্যবসার বিরুদ্ধে মামলা করে। ক্ষতিপূরণ চায়। কেস ওঠে আদালতে। তাতে দাদার সুনাম প্রায় জলে যাবার মতো অবস্থা। তখন ও বাবার সাহায্য চায়। বাবা বলেছিল, তার সেরকম সঞ্চয় কিছুই নেই। কিন্তু দাদা সে কথা কানেও তোলে নি। একদিন রাগের মাথায় বাবাকে সিন্দুক খুলতে বলে। বাবা যতই বলে যে ওতে যা আছে তার আর্থিক মূল্য নেই। তাও দাদা বেশ কয়েকবার জোরজুলুম করে। আপনাকে আগেও বলেছি, আবারও বলছি, দাদা মোটামুটি বহু ম’গামী। মদ, মাংস, মেয়ে … যাইহোক” বলে নাক সিটকিয়ে চুপ করে যান রমেন বাবু।

“আপনার কী মনে হয় সিন্দুকে শুধু গবেষনার কাগজপত্রই ছিল? নাকি আরো মূল্যবান কিছু ছিল?”

“সে যাই থাকুক, মূল্যবান তো বটেই। নইলে বাবা এরকম অভিনব সিন্দুক বানিয়েছিলেন কেন, যেখানে অ্যালফাবেটের কম্বিনেশনে বন্ধ করতে হবে।”

“তাহলে সে কম্বিনেশন না জেনে আপনার দাদাই বা তা খুলবে কিকরে?” ফেলুদার প্রশ্ন।

রমেন বাবু এবার এদিক ওদিকে চেয়ে মাথাটা একটু নিচু করে বললেন “বাবার সঙ্গে দাদার বেশ রাগারাগি হয়েছিল দেড় মাস আগে। তারপর কদিন পর হঠাৎ করেই দেখলাম, দাদা বাবার ঘরে ঘন ঘন যাচ্ছে। আর বেশ সুন্দর কথাবার্তা হচ্ছে দুজনের মধ্যে। আমার সন্দেহ এর পেছনে বৌদির হাত আছে। বৌদি প্রায়ই আমাদের ওদিকের এক কালীর থানে যায়। কী বলব মশাই, আমার ছেলে পর্যন্ত জ্যেঠি বলতে অজ্ঞান। আমাকে পাত্তাও দেয় না। আমার বাবার জামার পকেটে আমি মাঝেমধ্যে লাল জবা ফুলও পেয়েছিলাম। আমার তো মনে হয় বৌদি বাড়ির সবাইকে দরকারে বশ করে রেখেছে। বিশেষ করে বাবাকে।” শেষ কথাটা বেশ জোরের সাথেই বললেন রমেন বাবু।

“বলছেন, আপনার বাবা বশীভূত হয়েই আপনার দাদাকে সিন্দুকের কম্বিনেশন বলে দিয়েছিলেন?”

“একদম তাই। নইলে দাদা মাঝ রাত্রিরে বাবার ঘরে কেন ঢুকেছিল সেদিন? আর যদি বাবার শরীর খারাপই হবে, তো তখনই বাড়ির কাউকে জানায়নি কেন? আমিতো সেদিন রাতে বাড়িতে ছিলাম না। আমার ভাগ্নে সঞ্জীব পরের দিন আমায় বলেছে এসব। সে এও বলেছে যে, সেরাতে নাকি বৌদিও গিয়েছিল বাবার ঘরে।”

“আপনি তো শুধু চুরির অভিযোগই …”

ফেলুদার কথাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ঘন ঘন মাথাটাকে দুদিকে নাড়িয়ে রমেন বাবু বলে উঠলেন “না না, শুধু চুরি নয়। খুন, দাদা বাবাকে খুন করেছে। বৌদি রোজ অনেক সকালে ঘুম থেকে ওঠে। তাহলে সেই অনুযায়ী সেতো ভোরেই দেখেছিল বাবা আর নেই। তবে সেটা বিন্নি আসার পর সবাই জানল কেন? আর একটা কথা, বাবার ইনহেলারটাও মিসিং।”

“বিন্নি কে?”

“আমাদের রান্নার মেয়ে।”

“আপনি এই মুহূর্তে আমার কাছ থেকে ঠিক কী সাহায্য চান?” ফেলুদা এবার প্রফেশনাল ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল।

“সিন্দুকটা খোলা খুব দরকার প্রদোষ বাবু। তাহলে ওই ফাঁকা সিন্দুকটা দেখিয়ে আমি অনেক কিছুই প্রমাণ করতে পারব।”

“কিন্তু এ কাজে নামতে গেলে তো আমায় আপনাদের বাড়ির বাকি লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেটা করতে গেলে আমার পরিচয় সবাইকে বলাটা দরকার। নইলে আমার প্রশ্নের উত্তর ওরা দেবেই বা কেন …” ফেলুদার পরিষ্কার যুক্তি।

“তা বলবেন। ওদের মনে পাপ না থাকলে তো তাতে কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। তাছাড়া আমার মনে হয় না, আমি এমন কোনও কাজ করছি, যাতে লুকোচুরির কোনও প্রয়োজন আছে বলে। তাতে যদি কেউ কমফোর্টেবল বোধ না করে, সেক্ষেত্রে আপনিই বুঝবেন না হয় কারণটা।”

“বেশ, তাহলে ওঠা যাক এবার।” বলে ফেলুদা টানটান হয়ে উঠে দাঁড়াল। আমি আর রমেন বাবুও উঠে দাঁড়ালাম। বিল পেমেন্ট হয়ে স্লিপ সহ ব্যালেন্স এসে গিয়েছিল ততক্ষণে। তার মধ্যের ২০ টাকা টিপসের জন্য ছেড়ে দিয়ে রমেন বাবু বিলটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে দুমড়ে ফেললেন।

এখন অবধি যা কথাবার্তা হল, তাতে আমার রমেন বাবুকে খুব একটা অসৎ বলে মনে হল না। তবে ওর মনের সন্দেহগুলো শুধুই বাতিক না যুক্তিযুক্ত, তার প্রমাণের জন্য সময় আর ফেলুদার মগজাস্ত্রের উপর ভরসা করতে হবে।

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here