#সিন্দুক রহস্য,পর্ব ৫
#শেলী ভট্টাচার্য
রমেন বাবুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা উবের ক্যাব বুক করে আমরা সোজা চলে গেলাম লালমোহন বাবুর বাড়িতে। সারাটা রাস্তায় ফেলুদা ফোন ঘেটে ঘেটে চুপচাপ কীসব পড়ছিল। আমি বাড়িতে ফোন করে বৌকে জানিয়ে দিলাম যে, ফিরতে দেরি হবে।
লালমোহন বাবুর বাড়ি পৌঁছতে আমাদের প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেল। জটায়ুর তো আমাদের দেখে আনন্দে প্রায় ডানা মেলে ওড়ার মতো অবস্থা হল। মুখে ফুটে উঠল সেই বিখ্যাত হাসি।
“আরে একি স্বপ্ন নাকি? দুই মূর্তি একসাথে আমার দরজায়” দরজা খুলে আমাদের দেখে ওর চোখ দুটো শিশুর মতো আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠল। ওকে সে অবস্থায় দেখে কে বলবে যে সিনিয়ার সিটিজেন হয়ে গেছেন।
ভেতরে ঢুকে সোফায় বসেই ফেলুদা ফোন ঘেটে একটা ইউটিউব ভিডিও বের করে বলল “বাকি কথা বলছি ধীরে ধীরে। আপনার গপ্পে লাগতে পারে, দেখে নিন পৃথিবীর এই আজব জায়গায় কিভাবে মানুষদের ভাব বিনিময় হয়। তারপর একটা গপ্প লিখে ফেলুন এর উপর। গপ্পটির নাম দেবেন না হয় তুরকির তথ্য।” বলে নিজের ফোনটা লালমোহন বাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ব্যালকনির দিকে গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল ফেলুদা। আমি বুঝলাম, পথে আসতে আসতে এটাই খুঁজে বের করছিল ফেলুদা।
আমি লালমোহন বাবুর পাশে বসে ভিডিওটিতে মন দিলাম। অদ্ভুত সুন্দর পাহাড়ি চা বাগানের সাথে স্ক্রিনে এক এক করে ভেসে উঠল এক একটা অসাধারণ তথ্য।
তুরকির ইস্ট ব্ল্যাক রিজিয়িনে … একসময় সুদূর পাহাড় মধ্যবর্তী অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হত হুইসেল ল্যাঙ্গুয়েজ। অদ্ভুত সুরেলা সেই ভাষা। কখনও দেখাচ্ছে চা বাগানে কর্মরত পুরুষকে হুইসেল দিয়ে সুদুর ঘর থেকে তার বৌ জানাচ্ছে ‘খাবার তৈরি হয়ে গেছে।’ আবার কখনও চা বাগানের পুরুষ জানাচ্ছে ‘চা পাতা তোলার জন্য ব্যাগেজ শেষ।’ তখন অন্য সঙ্গীটি দূর থেকে হুইসেল দিয়ে জানাচ্ছে ‘অপেক্ষা করো। আনছি।’ অদ্ভুত কমিউনিকেশন।
লালমোহন বাবু তো মুগ্ধ হয়ে দেখে হাত তালি দিয়ে বলে উঠলেন “অ্যামিউজিং, অ্যামিউজিং।”
“এমন একটি ছেলের সঙ্গে দেখা করে এলাম” ফেলুদা ব্যালকনি থেকে বলল।
“বলেন কী মশাই!” উত্তেজনাসহ বলেই পরমুহূর্তে ভ্রুকুঞ্চন করে কতটা রাগী মুখ করে জটায়ু বললেন “আমাকে ছাড়াই?”
“কেসটা হঠাৎ করেই এসে গিয়েছিল। তাছাড়া অকুস্থলে গিয়ে তো প্রথমে পরখ করার দরকার ছিল, যে সেখানে সিনিয়র সিটিজেন মানুষকে নিয়ে যাওয়াটা রিক্স হবে কিনা?” ফেলুদা একপেশে হাসির সঙ্গে আমার দিকে ইশারা দিয়ে তাকিয়ে নিজের ফোনটাকে চাইল। আমি লালমোহন বাবুর হাত থেকে ফোনটাকে নিয়ে ফেলুদাকে দিয়ে এলাম।
জটায়ু তৎক্ষনাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন “সত্যি বলো তো ভায়া, আমাকে বুড়ো বলে মনে হয় তোমার?”
আমি চোখ কুচকে একটু পরখ করার মতো মুখ করে বললাম “কৈ নাতো।”
“দেখুন। আপনার মশাই চোখ পরখ করানো দরকার। আমাকে দেখে সবাই এখনও বলে, আপনার তো বয়স কমছে দিনে দিনে।”
“সেতো টেবিলের উপরটা দেখে বেশ বুঝতে পারছি।” ফেলুদার উত্তর।
লালমোহন বাবু টেবিলের দিকে চেয়ে জিভ কেটে চটজলদি টেবিলের উপরে পরে থাকা ওষুধের স্ট্রিপ্সগুলোকে একত্র করে একটা বাক্সে পুরে ফেললেন। আর বিড়বিড়িয়ে বললেন “এই জন্য গোয়েন্দা ঘরে ঢোকার আগে সব প্রমাণ লোপাট করে রাখতে হয়।”
আমি সোফায় বসে বেশ অনুভব করছিলাম মুহূর্তটা। এমন সময় ফেলুদা আমায় বলল “তুই লালমোহন বাবুকে আজকের কেসটা বল। আমি একটা জরুরি ফোন সেরেনি।”
আমি দেখলাম ফেলুদা সিগারেটের শেষ দিকটাকে টানতে টানতে বুদ্ধির গোঁড়ায় ধোঁয়া দিচ্ছিল কিছুক্ষণ। ততক্ষণে লালমোহন বাবু আবার আমার পাশে এসে বসেছেন। ওনার চোখেমুখ দিয়ে কৌতূহল ঠিকরে বেরোচ্ছে। আমায় বলতে থাকলেন “বলো ভাই তপেস রঞ্জন। জলদি বলো।”
আমি ওর অবস্থা দেখে মৃদু হেসে বলা শুরু করলাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই ফেলুদা ফিরল ফোন সেরে। আর আমারও কেসের বিবরণ বলা শেষ হল। লালমোহন বাবু তখন দেড় ইঞ্চি মুখের হাঁ সহ আমার দিকে চেয়ে বসে রয়েছেন। ফেলুদা ঘরে ঢুকতেই বললেন “তাহলে এবার ২৬ টা অ্যালফাবেটের মধ্যে পাজল সলভ করবেন আপনি?”
“আমি একা কেন? আপনারাও থাকবেন।”
“আমরা থাকব তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই লেভেলের ধারালো মগজাস্ত্র তো আর আমাদের নেই। আমরা সহকারী মাত্র। কী বলো ভাই তোপসে?” বলে আমার দিকে চেয়ে চোখ মটকে হাসলেন জটায়ু। আমিও মৃদু হাসিতে তাকে সমর্থন করলাম।
“তো কবে যাবেন আবার ঘোষাল বাড়িতে?” লালমোহন বাবু জিজ্ঞেস করলেন।
ফেলুদা বলল “ঠিক নেই। বাড়ির বড় ছেলের সময় হলে, আমাদের ডাক পড়বে। তার ইন্টারভিউ নেওয়া বাকি আছে এখনও।”
“আমায় কিন্তু জানাবেন। আর সেদিন আমি গাড়ি নিয়ে এসে আপনাদের পিক আপ করে নেব।”
“হরিপদ ওয়াগনারে অভ্যস্থ হয়েছে কি আদৌ? শেষে আবার না কেসের হদিস বের করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই কেস ফাইলে ঢুকে যাই।” ফেলুদা কিঞ্চিৎ রসিকতা করে বলল।
লালমোহন বাবু জিভ কেটে মাথাটা ঘন ঘন দুদিকে নাড়িয়ে বললেন “আরে না না মশাই। আমি এমন গোয়েন্দাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করব, এমন ভাবলেন কী করে? হরিপদকে ট্রেনিং দেওয়ানো হয়েছে। তারপর আমি এর মধ্যে বেশ কয়েকবার প্রকাশকের বাড়ি গিয়েছি নতুন গাড়িতে করে। ফেরার পথে গঙ্গার হাওয়া খাব বলে একটু লঙ ড্রাইভও করিয়েছি। তাতে যা বুঝেছি, তা হল হরিপদ এখন আধুনিক হয়েছে। সবুজ অ্যাম্বাস্যাডারের ড্রাইভার থেকে ওর পাকাপোক্ত প্রোমোশন হয়েছে সবুজ ওয়াগনারে।”
“আবার সবুজ?” আমি বলে উঠলাম।
“দেখবেন, আবার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে না পড়েন? যতই হোক আগের দিন তো আর নেই। এখন মানুষের স্বাধীনভাবে নিজ জীবনে চলার স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যাইহোক, আপনার নেক্সট উপন্যাস কী আসছে?”
“তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে লিখেছি। একটা হাইলি সাসপিসিয়াস অঘোরীকে নিয়ে। উপন্যাসের নাম অতলে অঘোরী। বুঝলেন মশাই, এদের মধ্যে মারাত্মক রকম একটা ইয়ে আছে …।” ডান হাতের তালু মুঠো করে উত্তেজনা সহ বললেন জটায়ু।
আমি বেশ বিস্ময়ের সঙ্গে বললাম “বাপরে! এরাতো সাংঘাতিক হয় শুনেছি। এদের হিস্ট্রি পড়লেন কোথায়?”
“এখন তো পৃথিবী হাতের মুঠোতে ভাই। গুলল, নেটফ্লিক্স আমার দিনরাতের বন্ধু হয়ে গেছে।”
“এটা জানেন তো প্রকৃত অঘোরী কোনওভাবেই অনিষ্টকারী নয়।” ফেলুদা সোফায় বসে খবরের কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল।
“আরে মশাই, এরা সাঙ্ঘাতিক কর্মকাণ্ড করে।” কনফিডেন্সের সঙ্গে বললেন জটায়ু।
জটায়ুকে থামিয়ে দিয়ে ফেলুদা গরগর করে বলে চলল “এরা শৈব সাধক। মরা মানুষের মাংস খায়। মৃত দেহের সঙ্গে সেক্স করে। নিজের মলমূত্রাদিও ভক্ষণ করে। মোদ্দা কথা বিশ্বের সমস্ত বিস্বাদ আহরণ করে সাধনার সাধ পেতে চায়। মূলত দুর্গম জনবসতিশূন্য পাহাড়ের পাথুরে গুহায় এদের ডেরা। কিছু অঘোরী ঐতিহাসিক কিছু শ্মশানের আশপাশেও থাকে। যেমন বেনারসে আছে।” কথাগুলো একনাগাড়ে বলে থামল ফেলুদা।
লালমোহন বাবুকে দেখলাম অবাক করা মুখে চেয়ে আছেন। আমার তখন বমির ভাব হচ্ছিল। আমি উঠে গিয়ে ব্যলকনির দিকে গেলাম। শুনতে পেলাম লালমোহন বাবু বলছেন “আপনার দেখছি এ বিষয়েও বিস্তর জ্ঞান। তাহলে বলছেন, সাধনার কাজে এরা নিরীহ মানুষকে বশ করে না?”
“যারা করে, তারা তান্ত্রিক সাধক। অঘোরী নয়।” ফেলুদার স্পষ্ট বক্তব্য।
“আপনি যখন বলছেন। তবে তো তাই হবে। না, উপন্যাসটার আগামাথা বদলাতে হবে দেখছি।” লালমোহন বাবু ওঁর চকচকে টাকে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন।
সেদিন লালমোহন বাবুর বাড়ি থেকে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরার পথে ফেলুদা হঠাৎ বলল “আরে যাহ, একটা কথা তো ভুলেই গেছিলাম।”
“কী?” আমার প্রশ্ন।
উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করল ফেলুদা। আমার দেখে মনে পড়ে গেল রমেন বাবুর পকেট থেকে পড়া সেই কাগজটার কথা। ফেলুদাকে দেখলাম, বেশ মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখছে।
“এটা রমেন বাবুর পকেটের কাগজটা না?”
আবার আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফেলুদা পালটা প্রশ্ন করল “এখন পাসওয়ার্ড প্রটেকশন বলতে প্রথমেই কী মনে আসে বলতো তোর?”
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম “এ টি এম পিন।”
“আর সেটা হয় চারটে নাম্বারের কম্বিনেশনে।” ফেলুদার গম্ভীর গলায় রহস্য।
“হুম”
“তাহলে তো হতেই পারে যে প্রসূন বাবু তার সিন্দুকের পাসওয়ার্ড চারটে অ্যালফাবেটের কম্বিনেশনে করে রেখেছিলেন।”
“হতেও পারে।” আমি আন্দাজে বললাম।
“এই দেখ।” বলে ফেলুদা চিরকুটটাকে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি দেখলাম ইংলিশে cu মাঝে ছোট্ট গ্যাপ, তারপর zn লেখা। আমি বিস্ময় আর দ্বন্দ্বে বললাম “পাসওয়ার্ড কম্বিনেশন?”
“বুঝতে পারছি না। তবে হতেও পারে।”
“তুমি বলছো, লোকটা নিজে সিন্দুকের জিনিস সরিয়ে দাদার উপর দোষ দিচ্ছে। আবার তোমার কাছে ভালো মানুষ সেজে এসে তদন্ত করার আর্জি জানাচ্ছে?
তাতেও তো খটকা আছে। লোকটা তো সেদিন রাতে বাড়িতেই ছিল না।”
“পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তো মৃত্যুর সময়ের আন্দাজ দিয়েছে। সিন্দুকের মধ্যের জিনিস সরানোর সময়ের বিষয়ে নয়। আদৌ তা সরেছে কিনা বা সরে গেলেও কখন কার দ্বারা হয়েছে, তাতো নিছকই অনুমানভিত্তিক ব্যাপার। ভাগিনার দেখাটা বা রমেন বাবুর ধারনাটার স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ আছে কি? তাছাড়া আজ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রমেন বাবুর যে ফোন এসেছিল, তাতে কী এমন কথা হচ্ছিল যে, এতো নিচু গলায় কথা বলছিলেন রমেন বাবু?”
ফেলুদার কথায় আমার যেন সব গুলিয়ে গেল। এভাবে সত্যি তো ভাবিনি। মনে মনে ভাবলাম, কেসটাকে যতটা সহজ ভাবছিলাম, আদতে তা নয়। কেসটা সত্যিই বেশ জটিল।
(ক্রমশ)