#সিন্দুক রহস্য,পর্ব ৬
#শেলী ভট্টাচার্য
পরেরদিন সকালে ফেলুদা ব্যায়াম করছিল। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। চোখের ইশারায় আমায় ধরতে বলল। আমি ধরে কথা বললাম। দেখি রমেন বাবু। বলছেন, আজ সকাল ন’টা অবধি দাদা বাড়িতে থাকবে। আমরা যদি আসতে চাই, তো আসতে পারি। ফোনের উপর ডান হাত চাপা দিয়ে ফেলুদাকে বললাম কথাটা। ফেলুদা ইশারায় হ্যাঁ জানিয়ে দিতে, আমি বলে দিলাম আমরা আসছি।
এরপর ভেজানো ছোলা বাদাম মুখে দিয়ে আজকের কাগজের কটা পাতা উল্টেই ফেলুদা বলল “একটা উবের বুক কর।”
“লালমোহন বাবু যাবেন বলছিলেন যে” আমি বললাম।
ফেলুদা দেয়াল ঘড়িতে চোখ রেখে ফোনটা পকেট থেকে বের করে কানে নিয়ে কিছুক্ষণ পর বলল “আমরা আর আধঘন্টা মানে এই ধরুন পৌনে আটটার দিকে বেরোব। আপনার আসাটা সম্ভব?”
“বেশ” বলে ফোনটা রেখে দিল ফেলুদা।
“আসছেন?”
“হুম। তুই রেডি হয়ে নে। আমি চারমিনারকে স্কুলে ছেড়ে আসি। হাঁটাটাও হবে। কাল ইভিনিং ওয়াক হয় নি।”
ফেলুদার স্বাস্থ্য সচেতনতাবোধ বেশ ভালো লাগে আমার। ডাক্তার বলার পর থেকে সিগারেটের সংখ্যাটাও বেশ কমিয়ে ফেলেছে এখন। খাঁটি কথা বলে ফেলুদা, শরীর একটা যন্ত্র। একে ঠিক না রাখতে পারলে এর পার্টসগুলো যেমন মাথাও … অচল হয়ে যাবে।
ফেলুদা আমার মেয়েকে স্কুলে দিয়ে ফিরে এসে চা বিস্কুট খেয়ে রেডি হয়ে বসেছিল। এমন সময় বাইরে গাড়ির হর্ণ শুনে আমি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, লালমোহন বাবু সবুজ ওয়াগনোরের জানলা দিয়ে মুখ আর হাত বের করে হাস্যমুখে নিচে আসার ইশারা দিচ্ছেন।
ফেলুদা আর আমি নিচে নেমে গাড়িতে উঠতেই, ফেলুদা বলল “ঠিক সাড়ে সাত মিনিট লেট।”
“বাঙ্গালির এটা মজ্জাগত স্বভাব। তাই না ভাই তোপসে?” হাসিমুখে আমার দিকে চেয়ে চোখ টিপে বললেন জটায়ু।
“বাঙালির আরেকটাও স্বভাব আছে।”
ফেলুদার কথায় লালমোহন বাবু মুখটা এগিয়ে নিয়ে বললেন “কী?”
“কথায় কথায় স্বজাতির বদনাম করা।”
আর কিছু বললেন না জটায়ু।
গাড়িতে আসতে আসতে ফেলুদা জটায়ুকে আবার আগের দিনের আলোচনার বিষয়ে কিছু বলতে শুরু করল “কাল আপনার সঙ্গে কথা বলার পর ঘরে এসে কিছু পড়াশোনা করছিলাম। জানলাম অনেক কিছু। সাধনার মূলত দুটি মার্গ থাকে। নিবৃত্তি মার্গ আর প্রবৃত্তি মার্গ। যারা নিবৃত্তি মার্গগামী, তারা ভোগ বাসনা শূন্য নিষ্পৃহ যোগী হয়। তন্ত্র কিন্তু ভোগী হতে যোগী হতেই উদবুদ্ধ করে।
From evil comes good.” বলে থামল ফেলুদা।
লালমোহন বাবু প্রসংশার স্বরে বললেন “দারুণ বললেন তো। রত্নাকর দস্যুর ব্যাপারটাও তো তাই ছিল।”
আমরা ঘোষাল বাড়িতে প্রায় সাড়ে আটটার দিকে গিয়ে পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম রমেন বাবু একতলার বারান্দা থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ফেলুদা লালমোহন বাবুর সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন বন্ধু বলে।
তারপর আমরা একতলায় রমেন বাবুর ঘরের দিকে এগোতেই ফেলুদা কয়েকবার লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল “ভেষজ তেল ব্যবহার করে কেউ?”
“আমার ছেলে মাথায় মেখেছে। ওর নাকি চুল পড়ে যাচ্ছে তাই। বুঝুন, এই বয়সেই তার কত খেয়াল এসবে।”রমেন বাবু একটু হেসে উত্তর দিলেন।
“আপনার ছেলে আছে এখন?”
ফেলুদাকে “হ্যাঁ, আছে তো। ডাকি দাঁড়ান” উত্তর দিয়েই রমেন বাবু গলা উঁচু করে ডাক দিলেন “শুভ্র” বলে। তাতে একটি বছর উনিশ কুড়ির ছেলে এসে হাজির হল ফেলুদার সামনে।
“এতে কি শুধু চুল ঝড়া কমে নাকি নতুন রুটও গজায়?” ফেলুদা প্রশ্ন করল ছেলেটির দিকে চেয়ে।
“দুটো হয় বলেই তো জানি। সঞ্জীব দাতো তাই নিয়ে এসেছিল।”
“আমার ভাগিনার আবার হেরিডটরি ইস্যু আছে। তাই হেয়ার লসে খুব ভয় ওর। ও তাই এসব নিয়ে এসেছে। ছেলেও তাই দেখে মাথায় দেয় মাঝেমধ্যে।” রমেনবাবু ছেলের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বললেন।
“সঞ্জীব কোথায়?” ফেলুদা এদিকওদিক দেখে বলল।
“দাদা স্নানে ঢুকে গেছে। এই তেল দিয়ে মেপে মেপে তিন ঘন্টা রেখে তারপর স্নানে যায় দাদা।”
“রোজ দিতে হয় নাকি?” ফেলুদাকে দেখলাম বেশ আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করছে।
“দাদা অল্টারনেট ডে তে দেয়। আমি মাসে তিন বার মতো।”
“কোথায় পাব ভাই তেলটা?” হঠাৎ করে জটায়ু বলে উঠলেন।
আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারিনি। ফেলুদা ঈষৎ পেছনে ফিরে বলল “আপনার জন্যই তো জানছিলাম।” বলে রমেন বাবুকে জিজ্ঞেস করল “আপনার দাদা কি দোতলায় আছেন?”
“হুম, চলুন।” বলে রমেন বাবু আমাদের নিয়ে উপরে উঠলেন। আমি পেছন ফিরে দেখলাম লালমোহন বাবু রমেন বাবুর ছেলের থেকে তেলের নামটা জেনে নিচ্ছেন। ওঁর চোখেমুখ থেকে বেশ একটা আশার ঝিলিক বের হচ্ছে।
দোতলায় উঠে আমাদের বৈঠকখানার ঘরে বসিয়ে রমেন বাবু বেরিয়ে গেলেন। বাইরে দেখলাম ওর বৌদি দাঁড়িয়ে আছেন। রমেন বাবু ওকে কী যেন একটা নিচু গলায় বললেন, সম্ভবত দাদাকে ডাকতে বললেন। তারপর রমেন বাবু চলে গেলেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ গম্ভীর মুখ করে একজন ঘরে প্রবেশ করলেন। সঙ্গে রমেন বাবুর বৌদি। এবার আর রমেন বাবু এলেন না।
ফেলুদা নিজে উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোর করে বলল “নমস্কার। আমি প্রদোষ মিত্র।” বলতেই সামনের ভদ্রলোক হাতের ইশারায় বললেন “বসুন। আমি আপনার পরিচয় জেনেছি। বলতে পারেন আমি একরকম স্ত্রীয়ের কথা রাখতেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছি। ও ঠিকই বলেছে, আমার ভাইয়ের ভুলটা ভাঙ্গার জন্য আমাকেও তো সাহায্য করতে হবে।”
“আপনার তো প্রোমোটারির ব্যবসা।”
ফেলুদার প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রলোক বললেন “হুম। তা প্রায় কুড়ি বছর ধরে আমার নিজস্ব ব্যবসা চলছে।”
“আপনার বাবার কি আপনার এই ব্যবসার ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ ছিল?”
“তা ঠিক নয়। বাবার আর আগে মায়ের একটাই বক্তব্য ছিল যে, আমি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেছি। দেখুন মশাই, আমি রাখঢাক না করেই বলছি আমি নিয়মিত না হলেও মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হলেই মদ্যপান করি। বাড়িতেই করি। তবে বাইরেও ব্যবসা সূত্রের বন্ধুদের সাথে হুল্লোড় করে অনেক সময় রাতে বাড়ি ফিরেছি। প্রচুর পরিশ্রম করি এই প্লান্ট, সেই প্লান্ট ঘুরে। তাই এভাবে একটু রিলাক্স হতে আমার ভালো লাগে। এসব মানেই যে আমি বাবাকে খুন করেছি, তার কোনো যুক্তি আছে কি?”
“তা নয়। তবে আপনি তো শুনেছি আপনার বাবাকে হুমকিও দিয়েছিলেন।” ফেলুদার সোজাসাপটা কথা।
এবার লোকটা বেশ রেগে গিয়ে বললেন “মতের অমিল হলে আমি হাইপার হয়ে যাই। মাথার ঠিক থাকে না। তাই হয়তো বলেছি। রাগের মাথায় কতজনই তো কতকিছু বলে, তা বলে কি তাই করবে? তাও আবার নিজের বাবাকে খুন?” বলে কিছুক্ষণ থামলেন ভদ্রলোক। ভদ্রমহিলাকে দেখলাম ওর কাঁধে হাত রাখতে।
“যেদিন সকালে বাবা মারা গিয়েছিলেন, সেদিন মাঝরাতেও আমি বাবার গোঙানির আওয়াজ পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। ইনহেলার দিয়ে বসেছিলাম। মিলু শুয়েছিল ওই ঘরে। জিজ্ঞেস করুন। আর সেটাকে কী বিশ্রী রকম ব্যাখ্যা দিচ্ছে আমার নিজের ভাই আর ভাগিনা। কথায় আছে না, যম, জামাই ভাগ্না কেউ নয় আপনা। আরে আমিও মামা বাড়িতে থেকেই মানুষ হয়েছি। মামাকে দেখে পরিশ্রম করে ব্যবসা করতে শিখেছি। তবে টাকা রোজগারের পথ পেয়েছি। ফাঁকিবাজি করে জুয়া খেলে টাকা উপায়ের পথ সঞ্জীবকে ওর বড় মামা দেখায় না। ওর হয়তো তাতে গায়ে লাগে। কিন্তু ছোটো মামার দেখানো নেশায় নেমে ওর তো ক্ষতিই হয়েছে, সেটা বুঝবে না মর্কট।” বলে রাগে গজগজ করতে করতে থামলেন ভদ্রলোক।
ফেলুদা কিছুক্ষণ সময় চুপ করে থাকল। সম্ভবত ঘরে বার্তালাপের উত্তাপ কমার জন্য। তারপর ধীরে প্রশ্ন করল “মিলু আপনার বাবার ঘরে শোয়?”
“বাবার অসুস্থটা বাড়ায় ডাক্তার ইঙ্গিত দেওয়ায় গত পাঁচ ছয় দিন ধরে মিলু ওই ঘরেই শুতো।” ভদ্রমহিলা বললেন।
“আপনিও তো সুমন বাবুর সঙ্গে শ্বশুর মশাইকে দেখতে গিয়েছিলেন সেই রাতে?” ফেলুদা ভদ্রমহিলার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল।
“না, আমি ঘরে জেগে বসেছিলাম। সেদিন সন্ধ্যেয় আমার ডান পাটা গোড়ালির কাছে মুচড়ে গিয়ে খুব ব্যথা হচ্ছিল। ভলিনি স্প্রে লাগাচ্ছিলাম।”
“আপনি সেই রাতে বেরোননি ঘর থেকে?” ফেলুদা ভুরু কুঁচকে আবার প্রশ্নটা করল।
“না। পা ফেলতেই তো পারছিলাম না। ফুলে গিয়েছিল। রাতে অনেকক্ষণ জেগে থাকায়, সকালে সাড়ে ছটায় উঠি আমি। অন্যদিন হলে মিলু সাড়ে পাঁচটায় যখন স্নানে ঢোকে ওর গান শুনেই আমি উঠে যাই।”
ফেলুদাকে দেখলাম, বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে গেল। সামনের ভদ্রলোক তখন বললেন “আমার দেরি হচ্ছে। আমি উঠব এবার। তবে আপনার কাছে একটা অনুরোধ, সম্ভব হলে সিন্দুকটা খোলার ব্যবস্থা করুন।”
ফেলুদা গম্ভীর গলায় বলল “আমি চেষ্টা করছি। আপনি বরং কাজে বেরোন। আমি আজ আরেকবার ওই ঘরে মানে আপনার বাবার ঘরে ঢুকতে চাই।”
“নিশ্চয়ই।” বলে ভদ্রলোক ওর স্ত্রীকে বললেন “রমেনকে বলো খুলে দিতে। আমি স্নানে ঢুকছি।” বলে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার কয়েক পা পিছনে ফিরে এলেন ভদ্রলোক। আর ফেলুদাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “আর একটা কথা বলি আপনাকে। বাবা মারা যাওয়ার তিন দিন আগে বাবার কথা বলা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন কেন জানি একটা কথা বেশ কয়েকবার বলেছিল।”
“কী কথা?” ফেলুদার প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রলোক বললেন “কেউ আরও আছে।”
“আপনার কী মনে হয়, কার কথা বলতে চাইছিলেন প্রসূন বাবু!” ফেলুদার প্রশ্ন।
“মোটা মাথার খাটোয়া ব্যবসায়ী আমি। সূক্ষ্মতাবোধ কম আমার। এসব হেয়ালি আপনিই বুঝবেন আশা করি। বাবার এই কথায় একবার অবিশ্যি আমার বোন অনিতার কথা মনে হয়েছিল। বহুবছর হল সে এ বাড়িতে আসে না। বাবা হয়তো মৃত্যুশয্যায় ছোটো মেয়েকে দেখতে চাইছিল। তাই বলতে চাইত, কেউ আরও আছে যাকে দেখতে চায়। কিন্তু পুরো কথাটা বলে উঠতে পারত না। তবে এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ধারণা। বাকিটা আপনিই বুঝবেন। আমি চলি।” বলে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
“আপনার শ্বশুর কি এই কথাটা আপনাকেও বলেছিলেন?” ভদ্রমহিলাকে প্রশ্ন করল ফেলুদা।
“হ্যাঁ, দু তিনবার বলেছিলেন। জিভে কথা জড়িয়ে আসত তখন বাবার। তাই প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি, পরে বুঝেছি। হয়তো রমেন ঘরে গেলেও একথা বলেছিল। বাকিরা তো বাবার ঘরে নিয়মিত যেত না। ডাক্তার বদ্যি এলে, বা তেমন কিছু হলে আসত।”
ফেলুদা চুপ করে রইল। ভদ্রমহিলা এবার নিচু গলায় একটা অনুরোধ করলেন।
“কিছু কথা বলি আপনাকে, একটু গোপন রাখবেন?”
ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল “নিদ্বিধায় বলুন।”
“আমার শ্বশুর মশাইকে শেষ দিকে বলতে শুনতাম, আমি যদি বড় ছেলেটাকে একটু শুধরাতে পারতাম। ওর মাও ওর চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। এবার না ওর জন্য তুমিও কষ্ট পাও। তাছাড়া বাড়ির বড়জনেদের কাঁধের উপর গোটা বাড়ির অনেক দায়িত্ব থাকে। তার সঠিক থাকাটা দরকার। তাই একটা শেষ চেষ্টা করতে চাই বৌমা। তুমি ওকে আমার কাছে পাঠিও শনিবার করে। সেদিনগুলোতে ও যেন আমায় ওষুধ খাওয়াতে আসে। বাবার কথামতো গত এক মাস আমি তাই করছিলাম। বাকি এই বিষয়ে আমি আমার শ্বশুরকে বা আমার স্বামীকেও কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আমার বিশ্বাস ছিল, বাবা যাই করবেন, ছেলের ভালো চেয়েই করবেন।” বলতেই রমেন বাবু ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রমহিলা ঝট করে কথা বদলে বললেন “আপনারা বাবার ঘরে যেতে চান তো?”
ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল “হুম। যেতে পারলে একটু ভালোই হয়। আর আপনারা চিন্তা করবেন না, মিঃ বাগচীকে আমি কাল সন্ধ্যেয় ফোন করে সব জানিয়ে দিয়েছি। আমি সচেতন আছি। এভিডেন্সে কোনও ডিস্টারবেন্স হবে না।”
আমার মনে পড়ল গতকাল লালমোহন বাবুর বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফেলুদা কাকে যেন একটা ফোন করছিল। এবার বুঝলাম, সেটা বাগচীকেই করেছিল।
ফেলুদার কথার শেষেই রমেন বাবু বললেন “আসুন। তালাটা খুলে দি।”
প্রসূন বাবুর ঘরে ঢুকে লালমোহন বাবুতো মন্ত্রমুগ্ধের মতো সিন্দুকটা দেখছিলেন। ফেলুদা চারদিকে নজর ঘোরাতে ঘোরাতে বলল “এই সিন্দুকের পাসওয়ার্ড ঠিক কত অ্যালফাবেটের হতে পারে? কোনও ধারণা দিয়েছিলেন কি প্রসূন বাবু?”
রমেন বাবু আর তার বৌদি মাথা দুদিকে নেড়ে প্রায় সমস্বরে বললেন “না”।
রমেন বাবু বললেন “তবে একটা কথা বলি, এই বিষয়ে মিলু আপনাদের সাহায্য করতে পারে। বাবা ওকে অনেককিছু বিশ্বাস করে বলত। বাবা জানত, ও বিশ্বস্ত আর ওর ভাষা সমস্যা কাউকে কিছু বলতে অপারক। বললেও বা বুঝবে কে? তবে ও বাংলা বোঝে, আমাদের কথা বোঝে। কিন্তু উত্তরে হয় শিষ দিয়ে নয়তো কিছু তুরকি ভাষায় বোঝাতে চায়। টুকটাক বাংলা শব্দ বিকৃত উচ্চারণ করে বলে মাঝেমধ্যে।”
“ও লিখতে পারে? মানে তুরকি ভাষায়?” ফেলুদা প্রশ্ন করল।
দুদিকে মাথা নাড়িয়ে দিয়ে রমেন বাবু জানালেন “সম্পূর্ণ নিরক্ষর।”
আমরা প্রসূন বাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নামতেই দেখলাম, সঞ্জীব রেডি হয়ে অফিস বেরিয়ে যাচ্ছে। ফেলুদা হেসে বলল “শনিবারেও অফিস ফুল আওয়ারস নাকি?”
“প্রাইভেট কোম্পানির স্ট্রাগল। পারলে রবিবারও ডাকে আর কী! আসলাম।” বলে বেশ তাড়াহুড়ায় বেরিয়ে যাচ্ছিল সঞ্জীব।
ফেলুদা বলল “আপনাকে পরে প্রয়োজন পড়লে আবার প্রশ্ন করতে বসতে পারি তো?”
সঞ্জীব একটু থেমে গিয়ে বলল “যে বাড়িতে আছি, সেখানের প্রয়োজনে তো আমায় সাড়া দিতে হবেই। আর আপনার পেশাই তো এটা।” বলে গেট ঠেলে রওনা দিল সঞ্জীব।
রমেন বাবু এবং ওর বৌদি অনেকবার আমাদের অনুরোধ করলেন চা খেয়ে যাওয়ার জন্য। অশৌচের বাড়িতে কীবা খাওয়াবেন বলে আফসোস করলেন ভদ্রমহিলা। ফেলুদা হেসে বললেন “না না। সেসব কোনো ব্যাপারই না। আমরা চা জলখাবার খেয়েই বেরিয়েছিলাম। তাছাড়া আবার তো আসবই।”
এমন সময় রমেন বাবুর ফোনে রিং হওয়ায়, উনি আগের দিনের মতোই দূরত্বে চলে গিয়ে ফোনটা ধরলেন। তবে এবার কিছু কথা যেন কানে পৌঁছাল। কীসব লট না কি যেন বলছিলেন।
ভদ্রলোক দু তিন মিনিট কথা বলেই ফিরে এলেন। আমরাও ওকে বিদায় জানিয়ে ঘোষাল বাড়ির থেকে বেরিয়ে এলাম।
(ক্রমশ)