সুখবর্ষণ পর্ব ৩ ( শেষ পর্ব)

0
448

#সুখবর্ষণ
পর্ব ৩ ( শেষ পর্ব)
লিখা- Sidratul Muntaz

রিকশা থামল একটি আবাসিক হোটেলের সামনে। অরিনের চেহারা প্রায় র’ক্তশূন্য হয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,” আমরা এখানে কেন এসেছি?”
হাসাদ অরিনের কাঁধে হাত জড়িয়ে বলল,” ভেতরে চলো। তোমার সাথে কথা আছে।”
অরিন সাথে সাথে হাত সরিয়ে দিল। কঠিন গলায় বলল,” আমি আপনার সাথে ভেতরে যাবো না।”
হাসাদের চেহারায় বিরক্তি। তবুও নরম হেসে বলল,” কেন? আহা, চলো না। তুমি না পাঁচহাজার টাকার কথা বলছিলে? দেখি ব্যবস্থা করতে পারি কি-না। আসো।”
অরিনের কান্না পাচ্ছে। মানুষটিকে আলাদা ভেবেছিল সে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে উনি সাইফুল আঙ্কেলের চেয়েও বাজে। অরিনের ইচ্ছে করল চিৎকার করে বলতে,” আমি কোনো বে’শ্যা না যে টাকার লোভ দেখিয়ে আমাকে রুমে নিয়ে দরজা দিতে পারবেন।”
কিন্তু অরিন কিছু বলতে পারল না। তার ডাগর চোখ দু’টি ভিজে আসছিল। কণ্ঠ কেঁপে আসছিল।চারপাশে ঝাপসা দেখতে শুরু করল। হাসাদ বলল,” কি হয়েছে অরিন? দেখো প্রয়োজন আমাদের সবারই আছে। এতো ন্যায়-অন্যায় ভাবলে চলে না। আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি। তোমার হাতে এখন দু’টো অপশন। বাড়ি ফিরে গেলে তুমি পাঁচহাজার টাকা পাবে না। বরং আরও ছাব্বিশ হাজার মিলিয়ে মোট একত্রিশ হাজার টাকা যোগাড় করতে হবে। আর যদি আমার সাথে ভেতরে যেতে পারো, তাহলে তোমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তোমার পুরো জীবন আমি গুছিয়ে দিবো৷ তোমাকে আমি বুদ্ধিমতী মনে করি। আশা করছি, তুমি নিজের ভালো বুঝবে।”
অরিন মনে মনে বলল,” আপনি একটা জঘন্য, পঁচা গন্ধযুক্ত নর্দমার কীট!”
অরিনকে চলে যেতে দেখে বিস্মিত হলো হাসাদ। সে ভাবেনি যে অরিন তার প্রস্তাব এইভাবে প্রত্যাখ্যান করবে। ভীষণ বিরক্ত লাগল। পান্তা খেতে নূন পায় না তার আবার এতো ভাব কিসের? হাসাদ অরিনের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল,” বোকামি কোরো না অরিন। মানুষের জীবনে সুযোগ একবারই আসে।”
অরিনের খুব ইচ্ছে করল হাসাদ ভাইয়ের গালে একটা শক্ত চড় মা’রতে। কিন্তু পারল না। এই চড়টা পরবর্তী সময়ের জন্য তোলা থাকুক। ছাব্বিশ হাজার টাকা তার মুখের ওপর ছুঁড়ে মা’রার পর না হয় অরিন চড়ের সঙ্গে একদলা থুতুও উপহার দিবে।
” এইযে মামা, এদিকে আসুন।”
রিকশা ডেকেই অরিন উঠে পড়ল। হাসাদ রিকশা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। দৃঢ় গলায় বলল,” অরিন আরেকবার ভেবে দেখো।”
অরিন গরম কণ্ঠে বলল,” রিকশা ছাড়ুন নয়তো আমি চিৎকার করবো।”
অরিনের র’ক্তিম চেহারা দেখে হাসাদের ভয় হলো। রিকশা ছেড়ে দিল সে। অরিন কাঁদতে কাঁদতে ছোটবেলার কথা মনে করল। এমন একটি ভয়ংকর সময় তার জীবনে আরও একবার এসেছিল। সাইফুল আঙ্কেল প্রায়ই তাদের বাড়ি আসতেন। অরিনদের প্রতিবেশী ছিলেন তিনি। আদর করার বাহানায় বাজেভাবে অরিনকে স্পর্শ করতেন। অরিন মায়ের কাছে অভিযোগ করেছিল। অথচ মা তার কথা বিশ্বাসই করল না। বলাই বাহুল্য যে তখন সাইফুল আঙ্কেলর সাথে অরিনদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি বিভিন্ন সময় অরিনদের উপকারে এসেছেন। আর কিছুদিন আগে যখন মা অসুস্থ হলো, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ এগিয়ে এলো না। সাইফুল আঙ্কেল মা’কে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছেন। হসপিটালের বিল দিয়েছেন। তার বাড়ি নিয়ে অরিনদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। যেই লোকটিকে ছোটবেলা থেকে অরিন ঘৃণা করে এসেছে নিরুপায় হয়ে তারই সাহায্য হাত পেতে গ্রহণ করতে হয়েছে। এর চেয়ে বাজে অনুভূতি কারো জীবনে আর কি হতে পারে?
অরিন বাড়ি ফিরে এলো। হালিমা অরিনকে দেখে ভ্রু কুচকে বললেন,” কিরে, এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি যে?”
অরিন জবাব না দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেল। হালিমাও পেছন পেছন এলেন। আগ্রহপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,” বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথা হলো? কি বলল হাসাদ?”
অরিন রাগী স্বরে বলল,” মা, তুমি আর কখনোই আমাকে হাসাদ ভাইয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে না। আমি ম/রে গেলেও তাকে বিয়ে করবো না।”
অরিন দরজা আটকে কাঁদতে বসল। হালিমা সেই কান্নার আওয়াজ শুনলেন না। রাগে গজগজ শুরু করলেন। যেন অরিন ভীষণ অপরাধ করে ফেলেছে। অরিন আলমারী খুলে দু’টো ভারী স্বর্ণের দুল বের করল। জীবনে কত ঝড়-ঝঞ্ঝা গেছে। কিন্তু কখনও এগুলোয় হাত দেওয়ার সাহস হয়নি। বাবা এই দুলগুলো বানিয়ে রেখেছিলেন অরিনের বিয়ের জন্য। আজ অরিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এগুলো বিক্রি করে দিবে। হাসাদ ভাইয়ের ছাব্বিশ হাজার টাকা শোধ না দেওয়া পর্যন্ত তার গায়ের র’ক্ত ঠান্ডা হবে না।

ইলহান আয়নায় দাঁড়িয়ে চুলটা আবার গুছিয়ে নিল। তাকে দেখতে ভালো লাগছে তো? নাকি একটু শেভ করবে? ইলমিকে জিজ্ঞেস করলে হয়। ইলমির রুমের দরজায় টোকা দিতেই সে বলল,” কে? ভাইয়া নাকি?”
” বুঝলি কিভাবে?”
ইলমি হাসল। আজকে ভাইয়া কম হলেও দশবার তার রুমে এসেছে। শুধু মেঘা কখন আসবে এটা জিজ্ঞেস করার জন্য। এতো এতো আগ্রহের পেছনের রহস্য বুঝতে ইলমির অসুবিধা হচ্ছে না। তার বেশ ভালোই লাগছে। অবশেষে ভাইয়ার কোনো একটা মেয়েকে তো পছন্দ হলো! কিন্তু মাঝে মাঝে ইলমির মনে হয়, ভাইয়ার পছন্দ করা মেয়েটি মেঘা না হলেই ভালো হতো। মেঘাকে ইলমির তেমন একটা পছন্দ নয়। কিন্তু কি করার? ভাইয়া যেহেতু পছন্দ করেছে তাই ইলমিকেও মেনে নিতে হবে। ইলহান আয়নার দিকে চেয়ে বিভ্রান্তির স্বরে বলল,” আচ্ছা ইলমি, আমার কি দাড়িটা শেভ করা উচিৎ? ”
” হঠাৎ দাড়ি শেভ করবে কেন?”
ইলহান লাজুক মুখে বলল,” না। এমনি বলছিলাম।”
” তোমাকে দাড়িতেই বেশি সুন্দর লাগে ভাইয়া।”
” ও আচ্ছা।”
যদিও ইলহান জিজ্ঞেস করেনি তবুও ইলমি বলল,” মেঘারা ঠিক বিকাল পাঁচটায় আসবে। পাঁচটা বাজতে আর মাত্র তেত্রিশ মিনিট বাকি।”
ইলহানের সাদা চেহারায় গোলাপী আভা জমে উঠল। বিব্রত কণ্ঠে বলল,” আমি কি তোকে জিজ্ঞেস করেছি?”
ইলমি মুখ টিপে হেসে ফেলল। বলল,” জিজ্ঞেস না করলেও আমি জানি। তোমার মন আকু-পাকু করছে। তুমি বরং একটা কাজ করো। ঘরে গিয়ে ঘড়ি ধরে বসে থাকো। আর মাত্র বত্রিশ মিনিট। একমিনিট অলরেডি চলে গেছে।”
ইলহানের খুব অস্বস্তি লাগছে। তবুও বলল,” তুই কয়জনকে আসতে বলেছিস?”
” পাঁচজন।”
” এতোজনকে বলার কি দরকার ছিল? শুধু মেঘাকে বললেই হতো।”
” তোমার চিন্তা-শক্তি কি ভোঁতা হয়ে গেছে ভাইয়া? মেঘা আমার ক্লাসমেট। ওর সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক নেই। এখন হঠাৎ যদি ওকে একা বাসায় ইনভাইট করি তাহলে অন্যরা সন্দেহ করবে না?”
” ও আচ্ছা। ঠিক।”
ইলমি হাসি হাসি চেহারায় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ইলহান বিরক্ত হয়ে উঠে চলে এলো। না জানি মনে মনে কি ভাবছে মেয়েটা! ইলহান তো শুধু মেঘাকে ধন্যবাদ দিতে চায়। তবে এটা ঠিক যে ধন্যবাদ দেওয়ার থেকেও ইলহানের মন ব্যাকুল হয়ে আছে তার স্নিগ্ধ মুখটা দেখার জন্য।

মেঘারা এলো ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়৷ পুরো দেড়ঘণ্টা দেরি৷ এতো দেরি হওয়ার কারণ মেঘার সাজ-গোজ। মেয়েটা ভয়ংকর সাজ দিয়েছে। সামান্য একটা কারণে এমন বিয়ে বাড়ি মার্কা সাজ না দিলেও চলতো। ইলমি অবশ্য মেঘাকে কিছু বলল না। কিন্তু তার চূড়ান্ত বিরক্ত লাগছে। এমন একটা মেয়েকে তার ভাই যে কেন পছন্দ করল! ধূর! ইলমি সবাইকে নিয়ে ইলহানের রুমে এলো। কিন্তু দেখা গেল ইলহান অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সবাইকে বাহিরে দাঁড়াতে বলে ভেতরে এসে ভাইকে ডাকতে লাগল ইলমি। ইলহান তখন স্বপ্নে মগ্ন। ভারী অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখছিল সে। স্বপ্নে অরিন ছিল। তার চেহারা কাঁদো কাঁদো। ইলহান উতলা কণ্ঠে বলল,” প্লিজ আপনি কাঁদবেন না। আমার একটুও ভালো লাগছে না। আপনার কি সমস্যা আমাকে বলুন? আমি সব ঠিক করে দিবো।”
অরিন শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। কোনো জবাব দিচ্ছে না। ইলহান বুকের ভেতর অসহ্য শূন্যতা অনুভব করল। তখনি ইলমির ডাক কানে এলো,” ভাইয়া, ওঠো। মেঘারা চলে এসেছে।”
ইলহান হড়বড় করে উঠে বসল।
” সত্যি এসেছে? কোথায়?”
ইলমি মেঘাদের ভেতরে ডেকে আনল। ইলহান সবার দিকে তাকাল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত চেহারাটি খুঁজে না পেয়ে হতাশ হলো। ইলমি মেঘার হাত ধরে বলল,” এইযে, এটা মেঘা।”
মেঘার হাত-পা কাঁপছে। তার সামনে বসা ছেলেটি অতি মাত্রায় সুদর্শন৷ মেঘা চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না। কণ্ঠ জড়িয়ে আসছে লজ্জায়। এমন অবস্থাতেই বলল,” হাই।”
ইলহান তাকে কিছু বলল না। ইলমির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,” এটাই কি মেঘা?”
” হ্যাঁ। মেঘাই তো। ওকেই তুমি আসতে বলেছিলে।”
ইলহান খুব বিরক্তবোধ করছে। সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিতে মন চাইছে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে চুপ রইল। এর মধ্যে ইলমি বলল,” তুই নাকি নাইট পার্টির দিনে ভাইয়ার কি একটা উপকার করেছিলি? সেজন্য ভাইয়া তোকে থ্যাংকস জানাতে চায়।”
মেঘার মনে পড়ছে না। সে কি উপকার করেছিল?ইলহান গম্ভীর মুখে বলল,” হ্যাঁ,আপনাকে ধন্যবাদ।”
” কিন্তু আপনি আমাকে ধন্যবাদ কেন দিচ্ছেন? আমি না কিছু বুঝতে পারছি না।”
মেঘার কণ্ঠে বিভ্রান্তি। ইলহান বলল,” আমিও কিছু বুঝতে পারছি না।”

অরিনের বিয়ের ব্যবস্থা খুব দ্রুত করা হলো। হাসাদ ভাই হঠাৎ বাড়ি এসে বললেন, তিনি অরিনকে বিয়ে করবেন। কাজী প্রস্তুত। ঘরোয়াভাবে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। সবচেয়ে উৎসাহী ছিলেন হালিমা। পাশের বাড়ির নাজমা ভাবীও এসে হালিমার সাথে রান্না-বান্নায় হাত লাগালেন। আজকের মধ্যেই কাবিন হয়ে যাবে। নাজমার মেয়ে শিউলি এসেছে অরিনকে বউ সাজাতে। হাসাদ ভাই অনেক টাকার জিনিস কিনে এনেছেন। অরিন মূর্তির মতো চুপচাপ বসে আছে। চোখের পলকটাও ফেলছে না। সে আজ অনুভূতিশূন্য। হাসাদ ভাই যখন বাড়িতে এলেন, অরিন তার সাথে একটা কথাও বলল না৷ দরজা দিয়ে বসে রইল। কিন্তু মা খুব চেঁচামেচি করছিলেন। অরিন দরজা খুলতে বাধ্য হলো তখন। হাসাদ ভাই হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে গেলেন। অরিনের পায়ে ধরে বললেন,” মাফ করে দাও। আমি তোমাকে চিনতে ভুল করেছি অরিন। আর ভুল তো সব মানুষের হয়। আমি তো ফেরেশতা না। জানি তুমি আমার উপর অনেক রেগে আছো। তোমার রাগ ভাঙানোর জন্যই এতো আয়োজন। আমি কিন্তু তোমার কাছে এখন কোনো অন্যায় আবদার করছি না। বিয়ে পবিত্র বন্ধন। আশা করি, এতে তোমার কোনো আপত্তি থাকবে না। ”
অরিন থমথমে মুখে বলল,” আমি আপনাকে বিয়ে করবো না হাসাদ ভাই। আপনি চলে যান। লজ্জা থাকলে আপনার এই কুকুরের মতো চেহারা নিয়ে আর কখনও আমার সামনে আসবেন না।”
কথাটি অরিন খুব উচ্চস্বরে বলেছিল। মা শুনতে পেলেন রান্নাঘর থেকে। সাথে সাথেই তেড়ে এসে অরিনের গালে একটা কষিয়ে চড় মারলেন।
” অভদ্র মেয়ে! তোকে আমি এইভাবে মানুষকে অপমান করার শিক্ষা দিয়েছিলাম?”
হাসাদ বলল,” থাক খালাম্মা, মাথা গরম করবেন না। অরিন না বুঝে বলেছে। আমি কিছু মনে করিনি।”
হালিমা নরম গলায় বললেন,” আমার মেয়ের হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।”
অরিন বাথরুমে চলে গেল। কল ছেড়ে কাঁদতে বসল। একটু পরেই হালিমা এসে আদেশ করলেন,” দরজা খোল অরিন। শিউলি তোকে সাজাতে এসেছে। যদি তুই এই বিয়ে না করিস তাহলে তারিন আর জেরিনকে নিয়ে আমি বিষ খেয়ে ম’রবো। আর কত জ্বালাবি আমাদের? তোর এই বিয়েটা যে কত জরুরী সেটা কি বুঝতে পারছিস না? নাকি আমাদের ভালোটাই তুই সহ্য করতে পারছিস না?”
অরিন দরজা খুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” তুমি জানো? কেন আমি হাসাদ ভাইকে বিয়ে করতে চাই না? তিনি সেদিন আমাকে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে আবাসিক হোটেলে নিয়ে গেছিলেন। আমাকে জঘন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। এইরকম একটা অমানুষকে আমি বিয়ে করবো? তুমি যদি বলো এতোকিছুর পরেও বিয়ে করতে হবে তাহলে আমি তাই করবো।”
হালিমা অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। একটু পর বললেন,” তার উদ্দেশ্য খারাপ হলে সে নিশ্চয়ই তোকে বিয়ে কর‍তে আসতো না। ভুল মানুষের হতেই পারে। কেউ নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করা উচিৎ। ”
মায়ের উত্তর অরিনকে স্তব্ধীভূত করে দিল। আর তর্কে জড়ানোর আগ্রহ পেল না সে। মোমের পুতুলের মতো দূর্ভাগ্যকে মেনে নিল। হঠাৎ করেই পুরো জগৎটাকে খুব নিষ্ঠুর মনে হচ্ছিল তার। যেখানে নিজের মা-ই মেয়ের দুঃখ বুঝল না সেখানে অন্যকাউকে এই দুঃখের কথা বোঝানো নিতান্তই হাস্যকর। বুকে পাথর চাপা দিয়ে অরিন বিয়ের জন্য তৈরী হচ্ছিল। শিউলি কাজল পরানোর সময় বলল,” চোখের পানিটা মুছে নাও অরিন আপু। কাজল চোখে লাগছে না।”
অরিন আঙুলের ডগা দিয়ে চোখের জল মুছল। এমন সময় ইলমির ফোন এলো। অরিনের ইচ্ছে করছে না কারো সাথে কথা বলতে। বার-বার ফোন কেটে দিতে লাগল সে। কিন্তু ইলমিও নাছোড়বান্দা। অনবরত ফোন করেই যাচ্ছে। অরিনের একবার মনে হলো, ফোনটা বন্ধ করে রাখে। কিন্তু করতে পারল না। ইলমির কল রিসিভ করল।
” হ্যালো।”
” অরিন, কোথায় তুই? আমি তোর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
অরিনের বুক ধ্বক করে উঠল। এই রাতেরবেলা ইলমি তার বাড়িতে কেন এলো?
” কি হয়েছে? তুই হঠাৎ এখানে কেন এলি?”
” কেন? আমি কি আসতে পারি না?”
” অবশ্যই পারিস। কিন্তু এমন না বলে-কয়ে তো তুই কখনও আসিস না।”
” ভাগ্যিস না বলে এসেছিলাম। নাহলে জানতেই পারতাম না যে তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। স্বার্থপর! আমাকে জানালি না কেন?”
” সবকথা জানাতে ইচ্ছে করে না।” অরিনের কণ্ঠে তীব্র হাহাকার। ইলমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” আমার সাথে ভাইয়াও এসেছে। তুই একবার বাড়ির বাহিরের পেছনের রাস্তাটায় আসতে পারবি?”
” কি হয়েছে বলতো?”
” আগে তুই আয়। তারপর বলবো।”
” এখন মা আমাকে বাসা থেকে বের হতে দিবে না। বিয়েটা মিটে যাক। তারপর আস্তে-ধীরে কথা হবে। তোরা ভেতরে এসে বস।”
ইলমি তুমুল কণ্ঠে বলল,” না৷ এখনি আসতে হবে। আন্টি বের হতে না দিলে আমি রাজি করাবো।”
ইলমি এই বলেই ফোন রেখে দিল। অরিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মেয়েটা কি করতে চাইছে? একটু পর হালিমা এসে বললেন,” অরিন, কেউ যাতে না দেখে এমনভাবে মাথায় বড় ঘোমটা দিয়ে বাইরে যা। দুইমিনিটের মধ্যে চলে আসবি৷ ইলমি এসেছে তোকে নিতে।”
হালিমা যখন এই কথা বলছেন ইলমি তখন পেছনে দাঁড়িয়ে হাসল। অরিন জানতো ইলমি মাকে রাজি করিয়েই ছাড়বে। মা ইলমিকে খুব পছন্দ করেন। অবশ্য যাদের টাকা-পয়সা আছে তাদের সবাইকেই মা পছন্দ করেন। আগে তিনি এমন ছিলেন না। ইদানীং অভাবে মায়ের স্বভাব নষ্ট হয়েছে। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য তিনি বুঝেন না। শুধু বোঝেন টাকার হিসাব। কি আশ্চর্য! অরিন ইলমির সাথে বাহিরে এলো। বড় গাড়ির ভেতর বসেছিল ইলহান। ইলমি বলল,” ভাইয়া তোর সাথে একটু কথা বলতে চায়।”
অরিন রেগে বলল,” এইজন্য আমাকে বাড়ি থেকে বের করে এনেছিস? কথাটা কি পরে বললে হচ্ছিল না?”
” পরে বললে খুব দেরি হয়ে যেতো।”
অরিন আগা-মাথা কিছু বুঝতে পারছে না। ইলমি ঠেলে অরিনকে গাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। দরজা লক করে দিল। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে রইল অরিন। পাশে ইলহান মাথা নিচু করে আছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ বলল,” কেমন আছেন?”
” ভালো আছি। আপনি?”
” এইতো ভালো। আজ বুঝি আপনার বিয়ে?”
প্রশ্নটা করার সময় ইলহানের কণ্ঠ কাঁপল। অরিন কি সেই কম্পন অনুভব করেছে? অরিন উত্তরে স্মিত হেসে বলল,” জ্বী।”
সেই হাসিতে বিষাদমাখা। সেদিনের মতো প্রাণবন্ত স্নিগ্ধ হাসি কেন হাসছে না অরিন? ইলহান ইতস্তত করে বলল,” সেদিনের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চেয়েছিলাম।”
” এর কোনো প্রয়োজন নেই৷ আমি যেটা করেছি তা আমার সাধারণ দায়িত্ববোধ। ”
এরপর শুধুই নিস্তব্ধতা। কেউ কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। অরিন বিব্রত গলায় বলল,” আপনি কি আর কিছু বলবেন?”
ইলহানের বুকভর্তি দ্বিধা। অনুভূতির জোয়ারে ভাসছে মন। কিন্তু বলার সাহস নেই। তবুও হঠাৎ বলল,” আমি কি একবার আপনার হাতটা ধরতে পারি?”
অরিন ভ্রু কুচকালো। কিছুটা অবাক হলেও সপ্রতিভ হেসে বলল,” ঠিকাছে। ধরুন।”
ইলহান অরিনের হাত ধরল। তার চেহারায় তৃপ্তির হাসি জ্বলজল করছে। ঘোর মাখা গলায় বলল,” আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার জীবনে খুশি হওয়ার মতো কোনো ব্যাপার কখনও ঘটেছে কি-না! তখন আমি জবাব দিতে পারিনি। কারণ মনে রাখার মতো কিছু খুঁজে পাইনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে পেয়েছি।”
” কি পেয়েছেন?”
এমন সময় ফোন বেজে উঠল। মায়ের নাম্বার। অরিন বিচলিত কণ্ঠে বলল,” এইতো, মা ফোন করছেন। আমাকে যেতে হবে।”
অরিন গাড়ি থেকে নামতে নিলেই ইলহান তার হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল। অরিন বিস্মিত গলায় বলল,” কি ব্যাপার?”
ইলহান আকুল কণ্ঠে অনুরোধ করল,” আমার হাতটা আর কিছুক্ষণ ধরে থাকবেন প্লিজ?”
” কতক্ষণ?” বড় অধৈর্য্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল অরিন। ইলহান বিড়বিড় করে বলল,” জানি না। হয়তো সারাজীবন!”
বাহিরে হঠাৎ বৃষ্টির তোলপাড় শুরু হলো। ঝমঝম শব্দ করে হাসছে আকাশ আর মাটি। পরিবেশে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে। অরিন ইলহানের হাতটা ধরে রেখেই জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। মনে হলো বৃষ্টি নয়, আকাশ থেকে যেন সুখবর্ষণ হচ্ছে!

____
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here