#সুখবৃষ্টি-১
বিছানার উপর মেয়েদের বায়োডাটা ছুঁড়ে মা’রলেন মিসেস ইলোরা। দাম্ভিক স্বরে বললেন,” এখানে যতগুলো মেয়ে আছে সবাই আমার ছেলের যোগ্য পাত্রী ছিল। সুন্দরী, শিক্ষিতা আর উচ্চবিত্ত পরিবার। ওদের নখের সমান হওয়ার ক্ষমতাও তোমার নেই। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। অস্বীকার করতে পারবে তুমি?”
অরিনের চোখ থেকে একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল। মিসেস ইলোরা অরিনের শাশুড়ী হোন। কিছুদিন পর পরই তিনি অরিনকে অপমান করার নান্দনিক উপায় খুঁজে বের করেন। আজ বের করেছেন মেয়েদের বায়োডাটা। অরিনের সাথে ইলহানের বিয়ের আগে ঠিক এতোগুলো মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল ইলহানের জন্য। হ্যাঁ, অরিন স্বীকার করে যে এই মেয়েগুলোর তুলনায় সে কিছুই না। তার না আছে রূপ, না আছে অসাধারণ কোনো গুণ। আর না আছে উচ্চবিত্ত পরিবার! সে অতি সামান্য একটি মেয়ে। কিন্তু এই সামান্য মেয়েটিকেই অসামান্য ভালোবাসা দেখিয়ে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল ইলহান। একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে এমন রুগ্ন,কালো, দরিদ্র ঘরের মেয়েকে কিছুতেই মানতে পারছেন না ইলোরা। কথায় কথায় অরিনকে তিনি মনে করিয়ে দিতে চান যে অরিন অযোগ্য!
মিসেস ইলোরা বললেন,” চুপ করে আছো কেন? কাগজগুলো হাতে নাও। নেড়েচেড়ে দেখো কত ক্লাসি মেয়েদের ছবি আছে এখানে। সবাইকে রিজেক্ট করে ইলহান তোমাকে বেছে নিয়েছে। কেন জানো? কারণ আমার ছেলে অকৃতজ্ঞ নয়। যে একবার ওর উপকার করে, সেটা ও জীবনভর মনে রাখে। তুমি ওর একটা বড় ভুল শুধরে দিয়েছিলে তাই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ও তোমাকে বিয়ে করেছে।”
অরিন শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল,” কিন্তু আমি তো উনাকে কখনও বলিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আমাকে বিয়ে করতে হবে। আমি কারো উপকার করলে দায়িত্ববোধ থেকে করি। বিনিময় পাওয়ার আশায় করি না।”
” তাই বুঝি? শুধু মুখেই বড় বড় কথা। না চাইতেও যখন কেউ কিছু পেয়ে যায় তখন সেই জিনিসের মূল্য দিতে পারে না। তুমিও নিজের যোগ্যতার বাইরে অনেক বড় কিছু পেয়ে গেছো৷ তাই ঠিকঠাক কদর করতে পারছো না।”
” মা, আপনার কেন মনে হয় যে আমি ইলহানের যথাযথ কদর করতে পারছি না?”
অরিনের প্রশ্নে মিসেস ইলোরার চেহারা শক্ত হলো। ঠোঁটে অবজ্ঞার হাসি মিশিয়ে বললেন,” নির্লজ্জের মতো প্রশ্ন করছো? তুমি জানো না কেন? নাকি ভাবছো আমি তোমার ব্যাপারে কিছুই খোঁজ-খবর রাখি না? দিনের পর দিন আমার ছেলেটাকে ঠকিয়ে যাচ্ছো তুমি। অথচ ও তোমাকে বিয়ে করে তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপকার করেছে। সেই উপকারের প্রতিদান তুমি দিচ্ছো প্রতারণা দিয়ে। ছিঃ! লজ্জা লাগা উচিৎ। ”
অরিন নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শাশুড়ীমায়ের এহেন কথা মোটেও বোধগম্য হলো না। সে ঠকাবে ইলহানকে? এমন সর্বনাশের কথা চিন্তাও করতে পারে না কখনও। মিসেস ইলোরা সরু দৃষ্টিতে বললেন,” অভিনয়ে তুমি মারাত্মক। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই বুঝতে পারছো না। কথাগুলো আমি ইলহানের সামনেই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জানতাম ওর সামনেও তুমি এমন নাটক করবে। তাই আলাদা ডেকে এনেছি। প্রমাণ তো আমি আজ নয় কাল যোগাড় করবোই। এখন থেকে তোমার প্রত্যেকটা পদক্ষেপে আমার নজর থাকবে।”
অরিন কাতর গলায় বলল,” মা, আপনি নিশ্চয়ই ভুল শুনেছেন। আমাকে ক্লিয়ার করে বলুন। নাহলে আমি বুঝতে পারছি না।”
” এখন আমি তোমাকে কিছুই বলবো না অরিন। আগে-ভাগে তোমাকে বলে দেই আর তুমিও সতর্ক হয়ে যাও এতো বোকা আমি না। তোমাকে হাতেনাতে ধরা হবে। আর তখন দেখবো কিভাবে নিজেকে বাঁচাও তুমি।”
অরিন আশ্চর্য হয়ে গেল। ভদ্রমহিলা কি চাইছেন তার থেকে? মনে হচ্ছে অরিনের সংসারটা না ভাঙা পর্যন্ত উনি ক্ষান্ত হবেন না। অরিনের ক্রোধে কেঁদে ফেলতে মন চাইল। ইলোরা ঝাঁঝালো গলায় বলল,” দাঁড়িয়ে না থেকে আমার চোখের সামনে থেকে যাও। আমার কথা শেষ। ”
বায়োডাটার কাগজগুলো আলমারিতে তুলে রাখছেন ইলোরা। অরিন নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো। পুরো ব্যাপারটাই ষড়যন্ত্র মনে হচ্ছে। একটি গভীর ও জঘন্য ষড়যন্ত্র। অরিন জানে না ভাগ্যে কি আছে! তবে এইটুকু সে জানে, তার ভাগ্যে কখনোই সুখ স্থায়ী হয় না।
” অরিন, একটু আমার রুমে এসোতো। ট্রাউজারটা খুঁজে পাচ্ছি না।”
ইলহানের ডাক শুনে অরিন ধীরপায়ে বেডরুমের দিকে গেল। কিন্তু ট্রাউজার খুঁজে না পেলে অরিনকে ডাকার কি আছে? অরিন তো ইলহানের ড্রয়ার গোছায় না। ইলহান নিজেই গুছিয়ে রাখে। তবে মাঝে মাঝে কাজের মেয়ে জরী ছাদ থেকে শুকনো কাপড় এনে ভাজ করে ইলহানের ড্রয়ারে রাখে। অরিন রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল,” আমি কিভাবে জানবো তোমার ট্রাউজার কই? জরীকে ডাকলেই তো হতো।”
ইলহান ভ্রু কুচকে বলল,” জরী আমার বেডরুমে এসে ট্রাউজার খুঁজে দিবে নাকি? তোমার কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে?”
অরিন কিছু বলল না। সে বিছানায় বসার সাথে সাথেই ইলহান দরজা আটকালো। অরিন এইবার বুঝল ট্রাউজার খোঁজা আসলে একটি বাহানা মাত্র। ইলহান তাকে রুমে ডেকেছে অন্য মতলবে। অরিন একদৌড়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। তার চালাকি দেখে ইলহান হতভম্ব। দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলল,” অরিন এটা কিন্তু চিটিং। দরজা খোলো বলছি।”
” উহুম। চিটিং তো তুমি করেছো। মিথ্যে বলে আমাকে রুমে এনেছো। বদের হাড্ডি!”
” তাহলে আমার কি করা উচিৎ ছিল? মা-বাবা, বোন সবাইকে শুনিয়ে যদি বলতাম অরিন আমার রুমে এসো, তোমাকে চু’মু দিতে ইচ্ছে করছে। তাহলে ভালো হতো?”
অরিন দু’হাতে কান চেপে ধরল,” ছি, দিন দিন খুব নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছো তুমি।”
” যদি এখনি বের না হও তাহলে কিন্তু এর চেয়েও বেশি নির্লজ্জ হবো।”
” শর্ত আছে।”
” আবার কি শর্ত?”
” আজকে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ছাদে গিয়ে আমরা বৃষ্টিতে ভিজবো।”
” অসম্ভব। কোনো মানেই হয় না। পরে যদি জ্বর-টর আসে?”
” এখন বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর আসে তাই না? অথচ বিয়ের আগে কত বড় বড় কথা। তোমার সাথে সারাজীবন সুখবর্ষণ দেখতে চাই। অরিন, তুমি তো আমার সুখবৃষ্টি। চিরকাল বৃষ্টিতে ভেজার সঙ্গিনী হবে? আর এখন বৃষ্টিতে ভিজতে বললেই বাহানা তাই না?”
ইলহান হাঁফ ছেড়ে বলল,” ওকে, ভিজবো। এবার অন্তত বের হও।”
অরিন দরজা খুলে বের হতে বোধ হয় একটু দেরি করল। কিন্তু ইলহান তার নরম শরীর শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে এক মুহূর্তও দেরি করল না। অরিন হাঁসফাঁস করে বলল,” ছাড়ো, দম আটকে মে’রে ফেলবে নাকি?”
ইলহান ছাড়ল না। গভীর স্পর্শে চু’মু দিল গালে, নাকে, কপালে, ঠোঁটে আর গলায়।
রাতে সত্যিই খুব জোরালো বর্ষণ হলো। টিনের চাল হলে ঝমঝম আওয়াজটা মজা করে শোনা যেতো। অরিনদের আগের বাড়িতে টিনের ছাদ ছিল। বৃষ্টি এলেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তো অরিন। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির গান শুনতো। দারুণ চমৎকার একটি ব্যাপার ছিল। অরিনের ইচ্ছে করছে ছাদে যেতে। কিন্তু একা বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে না। ইলহান ঘুমিয়ে পড়েছে। তার সুন্দর ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে ডাকতে মায়া লাগছে। অরিনের মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়৷ তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা রাজপুত্রের মতো দেখতে অদ্ভুত সুদর্শন মানুষটিই কি তার স্বামী? অরিন কখনও কল্পনা করেনি যে এমন চমৎকার একজন মানুষের সাথে তার বিয়ে হবে।
সেদিনও এমন বৃষ্টির রাত ছিল। অরিন মনের সমস্ত অভিমান জমা করে, নিজেকে পাথর বানিয়ে একটি অমানুষের সাথে বিয়ের পিরিতে বসতে যাচ্ছিল। তখনি এক পশলা সুখের বৃষ্টির মতো আবির্ভাব ঘটল ইলহানের। তার ছোটবোন ইলমি অরিনের বেস্টফ্রেন্ড। সে বিয়েবাড়িতে ঢুকে অরিনকে বাহিরে আসার অনুরোধ করল। অরিনের মা হালিমাও কেন যেন রাজি হলেন। হয়তো ইলমিকে তিনি বিশেষ পছন্দ করতেন, সেজন্যই। অরিন যখন ইলমির হাত ধরে বাহিরে বের হচ্ছিল তখনও সে জানতো না তার জীবনে কি আমূল পরিবর্তন আসতে চলেছে! ইলমি তাকে একটি বড় গাড়ির সামনে এনে দাঁড় করালো। বলল তার ভাই অরিনের সাথে কথা বলতে চায়। অরিনের অবাক লাগল। কি এমন কথা যা ঘরের বাহিরে এনে এভাবে বলতে হবে? তাছাড়া ইলমির ভাইয়ের সাথে অরিনের আলাপ হয়েছে মাত্র একবার। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলার মতো কোনো পরিচয়ই তৈরী হয়নি। তবুও অরিন গাড়িতে উঠে বসল। ইলহানের অবস্থা তখন দিশেহারা। দিকভ্রান্তের মতো উশখুশ করেই যাচ্ছিল। আসল কথা মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না কিছুতেই। এক পর্যায় অরিন নিজেই বুঝতে পারল। মৃদু হেসে বলল,” মা কখনোই রাজি হবেন না ইলহান সাহেব।”
ইলহান উতলা গলায় বলল,” আপনি রাজি তো?”
অরিন নিশ্চুপ হয়ে গেল। কি উত্তর দিবে? এতোবড় স্বপ্ন তো সে কল্পনাতেও দেখেনি। নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ বুঝে নিয়েই অরিনের হাতের উল্টোপিঠে চু’মু দিল ইলহান। অরিন কেঁপে উঠল। ইলহান শক্ত করে তার হাতটা ধরল। আশ্বস্ত করে বলল,” এবার শুধু দেখুন আমি কি করি।”
অরিন অজান্তেই ভরসা পেল। দৃঢ় কিছু অনুভূতি মনের দুয়ারে ঠাঁই নিল। আস্থা গড়ে উঠল।
অরিনকে গাড়িতে বসিয়ে রেখেই ইলহান সোজা চলে গেল অরিনদের বাড়ির বৈঠকঘরে। যেখানে কাজীসাহেব, অরিনের হবুবর এবং অরিনের মা হালিমার পাশাপাশি আরও কিছু মানুষ উপস্থিত ছিল। সবার সামনেই ইলহান বলল,” আন্টি, একটু বাইরে আসবেন? কথা ছিল।”
হালিমা অপ্রতিভ হলেন। প্রশ্ন করলেন,” তুমি কে?”
” আমি ইলমির বড়ভাই। ইলহান।”
” ও।”
হালিমা বাইরে এলেন ইলহানের সাথে। ইলহান তখন সবচেয়ে ভয়ংকর কান্ডটি করল। হাঁটু গেঁড়ে হালিমার সামনে বসে হাতজোড় করে বলল,” আমি অরিনকে বিয়ে করতে চাই৷ এই বিয়েটা আপনি ভেঙে দিন। প্লিজ নিষেধ করবেন না। আমি অরিনকে ছাড়া এখান থেকে কিছুতেই যাবো না। হয় আমার লা’শ যাবে নয়তো অরিনসহ আমি।”
হালিমা হতভম্ব হয়ে গেলেন৷ মাথা ঝিম ধরে এলো।কয়েক মুহূর্ত পুরোপুরি স্তব্ধ রইলেন। এক পর্যায় ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো খুব। চোখ দু’টো যেন জলাশয়।চেহারা থেকে উজ্জ্বল আভা ঠিকরে বের হচ্ছে। হালিমা চাঁদের মতো দেখতে ছেলেটিকে ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। কিন্তু হাসাদকেই বা নিষেধ করবেন কিভাবে? শেষমেষ অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। ইলহানকে বললেন,” আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাও।”
ইলমি পাশেই দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। এই কথা শোনার পর ভাই-বোন আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। ঝড়ের বেগে গাড়িতে উঠে অরিনকে নিয়ে রওনা হলো। সেই ঝমঝমে বৃষ্টির রাতে কাগজ-কলম আর কালিমাকে সাক্ষী রেখে ইলহান-অরিন আবদ্ধ হলো পবিত্র বন্ধনে। কিন্তু ঝামেলা তো তখনও শেষ হয়ে যায়নি। হাসাদ অরিনদের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে চলে গেল। শপথ করল কিছুতেই অরিনের পরিবারকে এই এলাকায় টিকতে দিবে না। আর সবচেয়ে বড় ঝামেলা শুরু হলো অরিন শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পর। মিসেস ইলোরা পুত্রবধূকে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। যা অরিনের জন্য চূড়ান্ত অপমানজনক ঘটনা।
চলবে
লিখা- Sidratul Muntaz