সুখহীন নিশিদিন
পর্ব-০১
লেখনীতে অনিমা হাসান
– বস, এসব কি গান শুনেন আপনি ?
নিষণ পাশ ফিরে তাকাল I রানা আবারও কানে হেডফোন গুঁজে দিয়েছে I কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল নিষণ I এই ছেলে সারাক্ষণ কানের মধ্যে হেডফোন গুঁজে গান শুনে I কি শুনে কে জানে ?নিষণ এর হেডফোনে গান শুনতে ভালো লাগেনা I ওর একটা ছোট টেপ রেকর্ডার আছে টেপ রেকর্ডার বললে ভুল হবে আসলে সিডি প্লেয়ার এখন অবশ্য আর কেউ সিডি প্লেয়ারে গান শোনে না I তবুও নিষণ এটা রেখে দিয়েছে I এটা ওর মায়ের ছিল I মা ভীষণ ভালোবাসতো গান শুনতে I যতটা না শুনতে ভালবাসত, তার থেকেও বেশী ভালবাসত গাইতে I অসম্ভব সুন্দর ছিল মায়ের গলা I ছোটবেলায় মায়ের গান না শুনলে নিষণর ঘুমই আসতো না I ইস ! মায়ের কিছু গান যদি রেকর্ড করা থাকত I নিষণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
– তুইতো কানে হেডফোন গুঁজে আছিস I আমার গানে তোর এত সমস্যা হচ্ছে কেন ?
– সমস্যা নাই বস I কথা হলো এইসব স্লো মোডের গান শুনে আপনি এত কঠিন কঠিন ম্যাথ কিভাবে সলভ করেন ? আমার তো ঘুম আসে I
– রবীন্দ্র সংগীত শুনলে আমার মাথা ঠান্ডা থাকে I তখন চিন্তা করতে খুব আরাম লাগে I প্রবলেম গুলো খুব সহজেই সলভ করে ফেলতে পারি I
– কোনদিন আমার মতোন RAP MUSIC শুইনা দেখেন I
– ওসব আমার ভালো লাগেনা I নট মাই কাপ অফ টি
আরে না শুনেই জাজ করতাছেন I করোলা না খাইলে বুঝবেন কেমনে তিতা মিঠা ?
না খেয়েও বোঝা যায় I এই যেমন ধর বই পড়েও অনেক কিছু বুঝি তাই না ?
আপনার লগে কথায় পারবো না I তবে একবার ট্রাই কইরা দেখেন
রানা জোর করে নিষনের কানে হেডফোন গুঁজে দিল I প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে শোনা শুরু করলেও একটু থমকে গেল নিষণ I অসম্ভব মিষ্টি কন্ঠ I গানের লিরিক মোটামুটি I খারাপ বলা চলে না I কিন্তু যে ব্যাপারটা অদ্ভুত সেটা হচ্ছে কেমন একটা জোর করে কণ্ঠস্বরে কর্কশ ভাব নিয়ে আসার চেষ্টা I নিষণ হেডফোন খুলে রানার হাতে দিয়ে হাসলো
কি বস কেমন লাগলো ?
ভালো
খালি ভালো ? ইউটিউব চ্যানেলের ভিউ কত দেখছেন ? মানুষজন পাগল ওর জন্য
মানুষজন তো কতকিছুর জন্যই পাগল I সেসব দিয়ে কি আর একটা জিনিসের কোয়ালিটি বোঝা যায় ? তবে আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা ট্যালেন্ট ওয়েস্ট করছে I এই মেয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাইলে অসাধারণ হবে I
আপনার সবকিছু তে খালি রবীন্দ্র সংগীত I আর ভুলেও মানুষের সামনে ওরে এই মেয়ে বইলেন না I লোকজন খেইপা যাইব I
তো কি বলব ? ম্যাডাম ? নিষণ হাসতে হাসতে বলল
ওর একটা সুন্দর নাম আছে I
তুই তো দেখি পুরো ক্রেজি ওর ব্যাপারে I দেখতে কেমন ?
জানিনা বস I কোনদিন দেখি নাই
বলিস কি ? না দেখেই এই অবস্থা
তাইলে বুঝেন I দেখলে তো পুরো কাইত হইয়া যাইতাম I রানা বিছানায় ধপাস করে শুয়ে বুকের মধ্যে হাত রেখে বলল
আচ্ছা তুই এখন বিদায় হ I
বাইর কইরা দিতাছেন ?
নিষণ জবাব দিল না I ল্যাপটপ অন করে লিনিয়ার ইকুয়েশন এর মধ্যে ডুবে গেল I
রানা আর নিষণ এই অ্যাপার্টমেন্টে শেয়ার করে থাকে প্রায় দু’বছর হলো I নিষণ বুয়েটে পড়ে I চাইলে হলে থাকতে পারে কিন্তু ওর ইচ্ছা করে না I ক্যাডেট কলেজে পড়েছে বলে অনেকটা সময় অনেক শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়েছে I এখন একটু নিজের মত থাকতে চায় I রানা পড়ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি’তে I নিষনের এক ব্যাচ জুনিয়ার I নিষণ যখন প্রথম এই অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেয় তখন বাড়িওয়ালা বলেছিল তার এক ভাগিনা রাজশাহী থেকে আসছে ঢাকায় ভর্তি পরীক্ষা দেবে বলে Iএকটা রুম ওকে ছেড়ে দিলে ভাড়া 10000 টাকা কমিয়ে দেবে I নিষণ আপত্তি করেনি I বড় রুমটা নিয়েছিল এটাচ বাথ রুম , বারান্দা সহ I ছোট ঘরটা আর কমন ওয়াশরুম ছেড়ে দিয়েছিল ওর জন্য I
নিষণ ছোটবেলা থেকেই ইন্ডিপেন্ডেন্ট ধরনের ছেলে I নিজের কাজ ও নিজেই করে I রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘর গোছানো ,কাপড় ধোয়া এমনকি ঘর পর্যন্ত নিজেই মুছে I অগোছালো বাড়ীঘর ওর একেবারেই পছন্দ নয় I প্রথমদিকে মনে করেছিল ছেলেটা এলোমেলো ধরনের হলে বাড়ি ছেড়ে দেবে I কিন্তু ছেলেটা শুরু থেকেই নিষণকে খুব মেনে চলে I একটাই শুধু সমস্যা অতিরিক্ত কথা বলে I
নিষণ কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না I ওর কোন বন্ধু নেই Iইচ্ছে করেই রাখে না I কারো সঙ্গেই কখনো কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার শেয়ার করে না I অনেকেই ভাবে ,ভালো ছাত্র বলে ও ভীষণ অহংকারী I কে কি ভাবল তাতে অবশ্য ওর কিছু যায় আসে না I কোন মায়ায় জড়াতে চায় না নিষণ I তবে এই ছেলেটা শুরু থেকে আঠার মতো লেগে আছে ওর সাথে I প্রথমদিকে বিরক্ত হতো ,এখন অভ্যাস হয়ে গেছে I
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর রানা আবার এলো রাতের খাবারের জন্য ডাকতে I
– নিষণ ভাই খাইতে আসেন
নিষণ জবাব দিল না I ওর ইকুয়েশনের জট কিছুতেই খুলছে না I মাথার মধ্যে কিছু একটা ঘুরঘুর করছে টের পাচ্ছে না নিষণ I রানা আবারও এসে ডেকে গেল I
– কি হইলো ভাই ?
ইকুয়েশনটা কিছুতেই সলভ করতে পারছিনা I নিষণ হতাশ ভঙ্গিতে বলল
একটু ব্রেক নেন I গানটান শুনেন I কাহিনী হইসে জানেন I আমি উনারে লেখলাম আমার বড় ভাই বলছে আপনাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে I -কোনদিন রিপ্লাই করে না I আজকে একটা ইমোজি পাঠাইছে I
দুই হাতে মাথার দুই পাশে চেপে ধরে নিষণ বলল
– কি বললি ?
– কইলাম মেসেজের রিপ্লাই দিছে I
– ভালো তো I ইমোজির আনন্দ সেলিব্রেট কর I
– ভাই আপনার মত এরকম বেরসিক মানুষ আমি দেখিনি
নিষণ ভাত মাখাতে মাখাতে বলল
– ভালো করে দেখে নে I তোর তো আবার না দেখেই জিনিসপত্র জাজ করার অভ্যেস I
রানা গোমরা মুখে ভাত খেতে লাগলো I তবে হাল ছাড়লো না I দুইটা গানের ভিডিও নিষনের মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দিল I
রাত প্রায় দেড়টা বাজে I নিষণ কফি বানিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো Iঘুম আসছেনা I মাথা ব্যথা করছে I একটু ব্রেক নেয়া দরকার I নিষণ কফির কাপে চুমুক দিয়ে ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগলো I হঠাৎই নজরে এলো রানা একটা ভিডিও শেয়ার করেছে I কৌতূহলবশত অন করে দেখল ওই মেয়েটার ভিডিও I লাইক পড়েছে 17.6 K I নাম সপ্তর্ষি I প্রোফাইল পিকচারে রাতের তারা ভরা আকাশ Iনিষণ বিরক্তি নিয়ে গানটা শুনলো I আবারও মনে হলো মেয়েটা জোর করে নিজের কণ্ঠস্বর কর্কশ করতে চাইছে I নিষণ ভিডিওতে কমেন্ট না করে ওর পার্সোনাল আইডিতে কমেন্ট বক্সে গিয়ে লিখল
– আপনি আপনার ট্যালেন্ট ওয়েস্ট করছেন I রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে ভালো করতেন I
মেয়েটা বোধহয় জেগেই ছিল I ঝটপট জবাব এলো
– এই নিয়ে আজ দ্বিতীয় জন আমাকে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে বলল I কিছুক্ষণ আগে একজন লিখল তাঁর বড় ভাই নাকি আমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বলেছে I
নিষণ হেসে ফেললো I তারপর লিখল
– তাহলে তো আপনার ট্রাই করা উচিত
অনেকক্ষণ কোন জবাব এলো না Iনিষণ কফি শেষ করে যখন ঘুমোতে যাবার জন্য পা বাড়ালো তখনই জবাবটা এল
– রবীন্দ্র সংগীত গাইবার মত কনফিডেন্স আমার নেই
– আপনি যেটা গাইছেন সেটার জন্যই তো বেশি কনফিডেনসিয়াল দরকার
– না I আচ্ছা , আমি যদি একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত এর অডিও আপনাকে পাঠাই আপনি শুনে বলতে পারবেন কেমন হয়েছে ?
নিষণ ভীষণ অবাক হয়ে গেল I এই মেয়ের এত ফলোয়ার আর সে কিনা নিষণ এর মতো একজনের কাছ থেকে মতামত চাইছে ? হয়তো মজা করছে ওর সঙ্গে I কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মেয়েরা সত্যি সত্যি একটা গান পাঠাল I
ওলো সই, ওলো সই
আমার ইচ্ছা করে
তোদের মতন মনের কথা কই
ছড়িয়ে দিয়ে পা দু’খানি
কোণে বসে কানাকানি
কভু হেসে, কভু কেঁদে
চেয়ে বসে রই
ওলো সই, ওলো সই
আমার ইচ্ছা করে
তোদের মতন মনের কথা কই
তোদের আছে মনের কথা
আমার আছে কই?
আমি কি বলিবো কার কথা
কোন সুখ, কোন ব্যথা
আমার নাই কথা
তবু সাধ শত কথা কই
ওলো সই, ওলো সই
তোদের এত কি বলিবার আছে
ভেবে অবাক হই
আমি একা বসি সন্ধ্যা হলে
আপনি ভাসি নয়নজলে
কারণ কেহ সুধাইলে
নীরব হয়ে রই
গানটা শুনে চমকে গেল নিষণ I এটা মায়ের খুব প্রিয় গান ছিল I মায়ের কাছে নিষনের গান শেখা I ক্যাডেট কলেজে ঢোকার আগে পর্যন্ত স্কুলের প্রতিটা ফাংশনের ও গান করত I এই গানটা ও গেয়েছিল একবার I কত বছর পর শুনলএই গানটা I কি আশ্চর্য মিষ্টি মেয়েটার গলা I কি ভীষণ মানিয়েছে I মেয়েটাকে বলা উচিত এটা I নিষণ আরো একবার গানটা শুনল I আরো একবার Iশুনতে শুনতে কখন ওর দুচোখের পাতায় ঘুম নেমে এল নিজেও টের পেল না I
চলবে…..