সুখহীন নিশিদিন ,পর্ব 2 এবং 3

0
403

সুখহীন নিশিদিনপর্ব 2 এবং 3

দীপা যে রাতে জন্মেছিলে সেই রাতে আকাশে কোন চাঁদ ছিল না I চারিদিক ছিল নিকষকালো অন্ধকারে ঢাকা I দীপার মা সুমনাকে যখন ওটিতে নেওয়া হলো তখন শহরজুড়ে লোডশেডিং I হাঁসপাতালের অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তৌহিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন I আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার I তিনি স্পষ্ট সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখেছিলেন I চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রার্থনা করেছিলেন হে মহান সৃষ্টিকর্তা আমার বাচ্চাটাকে তুমি নিরাপদ এই পৃথিবীতে নিয়ে এসো I ঠিক তখনই কান্নার শব্দ ভেসে এলো I নার্স এসে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দিলেন I

তৌহিদের মা তাহেরা বেগম বাচ্চার মুখ দেখে বললেন
– এমুন কাইল্লা মাইয়া !
তৌহিদ রক্তচক্ষু নিয়ে মায়ের দিকে তাকালেন I মেয়ের গায়ের রং আসলেই কালো I মাথার চুল কোঁকড়ানো I শুধু আয়তাকার বড় বড় চোখ গুলো দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল I তৌহিদ কিছুক্ষন মুগ্ধ চোখে তাঁকিয়ে রইলেন তারপর ঘোষণা দিলেন

আমার মেয়ের নাম আমি রাখলাম সপ্তদীপা
তাহেরা বেগম মুখ কালো করে বলেছিলেন
দেখতে যেমুন কালা ঐরকম অন্ধকার লইয়া আইছে চাইরদিকে

এক বছরের মধ্যে দৃশ্যপট পাল্টে গেল I সপ্তদীপা দাদির অন্তপ্রাণ হয়ে উঠলো I তাহেরা বেগম নাতনিকে ছাড়া কিছুই বোঝেন না এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করেন না I যেখানেই যান সঙ্গে নিয়ে করে নিয়ে যান I সবাইকে গর্বভরে বলেন
– আমার নাতনী I এক্কেবারে আমার মতন দেখতে I

দীপার বাবা তৌহিদের বনেদি ব্যবসায়ী পরিবার I ওদের পরিবারে কেউ কখনো চাকরি করেনি I কিন্তু শুরু থেকেই তৌহিদের ব্যবসায় মন নেই I ওর কবিতা পড়তে ,গান গাইতে , ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে I তৌহিদের বাবারা তিন ভাই I সবাই ব্যবসায় অংশীদার I ব্যবসায় মনোযোগ নেই বলে তৌহিদের বাবা চাচারা কখনো কিছু বলেননি I বরং নিজেদের কাঁধে সব দায়িত্ব তুলে নিয়ে ওকে তার মতই থাকতে দিয়েছেন I তৌহিদ নিজের বাড়িতেই একটা অফিস রুম করে ফেলেছেন I ঘণ্টা দুয়েক সারাদিনে সেখানে বসে ব্যবসার কাজকর্ম দেখা ছাড়া আর তেমন একটা দায়িত্ব পালন করেননা I তিন পুরুষ ধরে ওদের বিশাল বাড়ি পুরনো ঢাকায় I তৌহিদের দাদা বেঁচে থাকতে একই বাড়িতে তিন ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে থাকতেন I সময়ের সাথে সাথে সবারই পরিবার বড় হওয়ায় বাড়িটা তিনটি অংশে বিভক্ত হয়ে গেল I মজার ব্যাপার হচ্ছে তিন ভাইয়ের কারোরই কোন ছেলে নেই I চাচাতো বোনেদের সঙ্গে তৌহিদের খুব ভাব i একেবারে নিজের ভাই বোনের মতন I বড় চাচার তিন মেয়ে I ছোট চাচার 2 মেয়ে I এদের মধ্যে একজন দেশের বাইরে থাকেন I বাকি চারজন এই বাড়িতেই নিজের ফ্ল্যাটে আছেন I সবার সঙ্গেই তৌহিদের অসম্ভব ভাব I দীপা এদের সকলেরই চোখের মনি I

তৌহিদের বিয়ের সময় বাবা চাচারা চাইছিলেন কোন ব্যবসায়ী পরিবার থেকে মেয়ে আনবেন I কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না I তৌহিদের সুমনাকে ভালো লেগে গেল I সুমনা অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে I পড়াশোনা শেষ করে একটা বেসরকারি স্কুলে চাকরি নিয়েছিল I এত বড় পরিবার থেকে বিয়ের কথা শুনে বেশ অবাক হয়েছিল সুমনার পরিবার I ভয় পেয়েছিল মানিয়ে নিতে পারবে কিনা I উদাসীন স্বামী , রাশভারী শশুর আর ঝগড়াটে শাশুড়ি নিয়ে ভয়ে ভয়ে সংসার শুরু করেছিল সুমনা I ভেবেছিল বিয়ের পর হয়তো আর চাকরি করতে পারবে না I কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো তাহেরা বেগম কথায় কথায় ঝগড়া করলেও তার মনটা খুব ভালো I সুমনা স্কুলে যাবার আগেই তা খাবারটা পর্যন্ত রেডি করে ব্যাগের মধ্যে ভরে দেন আর বলেন
-মাইয়া লইয়া চিন্তা কইরো না I আমার রক্ত আমার কাছে আছে এর থেকা নিরাপদ আর কোনখানে থাকবো না

দীপাও দাদির ভীষণ ন্যাওটা I ন্যায় অন্যায় সমস্ত আবদার তার দাদীর কাছে I তারপরও এই পৃথিবীতে দীপার সবচাইতে প্রিয় মানুষ তার বাবা I তার আলাভোলা উদাসীন বাবা তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ I আর বাবা বাসা থেকে কাজ করায় দিনের পুরোটাই তার দীপার জন্য বরাদ্দ I তৌহিদের খুব শখ ছিল গান শেখার I পরিবারের চাপে পারেননি I এখন মেয়ের জন্য ওস্তাদ রেখেছেন I বাবা মেয়ে একসঙ্গে গান শেখেন I নজরুল গীতি এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত I দীপার অবশ্য এসবে আগ্রহ নেই I ওর ভালো লাগে পপ মিউজিক I স্টেজ কাপানো শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা ওর I
দীপার গানের গলা অসম্ভব মিষ্টি I বাবার এলোমেলো পাগলাটে স্বভাবের অনেকটাই ও পেয়েছে I আশেপাশের সবাইকে মাতিয়ে রাখে I পরিবারের সবাই ,পাড়া-প্রতিবেশী , স্কুলের টিচার ,এমনকি আশে পাশের দোকানদার, রিক্সাওয়ালা সবাই তার ভক্ত I এর একটাই কারণ সবাইকে খুব গভীরভাবে ভালোবাসে দীপা I সবার সঙ্গে গল্প করে Iকারও মধ্যে ভেদাভেদ করে না I বাচ্চা বুড়ো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব ওরI কাউকে মন খারাপ করা দেখতে পারেনা দীপা I সবাইকে হাসিয়ে ,রাগিয়ে মজা পায় I এই পৃথিবীতে শুধু একজনই আছে যার সঙ্গে ওর আজন্ম শত্রুতা I কি জানি কি অদ্ভুত কারণে সে দুই চোখে দেখতে পারেনা দীপাকে I তবে দীপা ও ছেড়ে দেবার মতন মেয়ে নয় I একবার ওর অংক খাতায় গোমড়ামুখো পেঁচার ছবি এঁকে রাখল I টিফিন টাইমে দীপা যখন তাড়াহুড়ো করে হোমওয়ার্ক শেষ করছিল তখনই সে এসে বলল
– তুমি আমার খাতায় এটা কি এঁকেছ ?
– তোমার একটা ছবি আকলাম I
ছেলেটা রেগেমেগে বলল
– এটা আমার ছবি ?
খাতা থেকে মুখ না তুলেই দীপা বললো
– কান টা একটু ছোট হয়ে গেছে I তুমি চাইলে বড় করে নিতে পারো I
তোমার এত বড় সাহস
– ছবি আঁকতে সাহস লাগে না ক্রিয়েটিভিটি লাগে I
ছেলেটা বেঞ্চের উপর এত জোরে ঘুসি মারলো যে পানির বোতল উল্টে দীপার খাতা ভিজে একসা হয়ে গেল I দীপা সরু চোখে তাকিয়ে বলল
– তুমি এটা কি করলে ?
– বেশ করেছি I
ততক্ষনে ঘন্টা বেজে গেছে I দীপা মুখ কাচুমাচু করে স্যারের কাছে গিয়ে কিছু একটা বলছে দূর থেকে দেখল ছেলেটা I মনে মনে খুব খুশী হলো এবার শিক্ষা হবে ডাইনিটার I স্যার দীপাকে জায়গায় গিয়ে বসতে বললেন I তারপর সামনে তাকিয়ে বললেন
– নিষণ তুমি দীপার খাতা ভিজিয়ে ওর হোমওয়ার্ক নষ্ট করেছে আগামী সাতদিন তুমি ওকে ম্যাথ করতে হেল্প করবে I

নিষণ হতভম্ব হয়ে গেল I এখন এই ডাইনীটা কে আগামী সাত দিন সহ্য করতে হবে ?

দীপা ভেবেছিল সাতদিন ম্যাথে হেল্প করতে করতে হয়তো ওদের বন্ধুত্বটা হয়ে যাবে I কারো সঙ্গে বেশিদিন ঝগড়া রাখতে পারেনা দীপা I কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে I কিন্তু সেরকম কিছুই হলোনা বরং দুদিনের মাথায় বিশাল ঝগড়া বেধে গেল I শুরু থেকেই অবশ্য নিষনের মেজাজ খারাপ ছিল I সারকে রিকোয়েস্ট করে বলেছিল
স্যার অন্য কোন শাস্তি দিন I এটা না
এটাই তোমার শাস্তি I
তাহলে টাইম টা একটু কমিয়ে দিন
না, দশ দিনই
নিষণ আঁতকে উঠে বলেছিল
স্যার , সাত দিন বলেছিলেন তো
ও আচ্ছা I তাই বলেছিলাম নাকি ? ঠিক আছে তাহলে সাত দিন I আর দীপা , ও যদি তোমাকে হেল্প করতে না চায় তাহলে আমার কাছে এসে বলবে I আমি ওর পরীক্ষার নাম্বার কমিয়ে দেব I এমনিতেও গত পরীক্ষায় ও 100 তে 105 পেয়েছে I
ক্লাস শুদ্ধ সবাই হেসে উঠল I তবে ঘটনা সত্য নিষণ আসলেই 100 তে 105 পেয়েছে I নিষনের অংক খাতায় কখনই কলম ছোঁয়ানো যায় না I তাই ইচ্ছে করেই স্যার উপরের ক্লাসের একটা অংক দিয়েছিলেন এবং প্রশ্নপত্রে লিখে দিয়েছিলেন যে এটা করতে পারলে তাকে বোনাস 5 নাম্বার দেওয়া হবে I নিষণ অন্য সব গুলো অংক সঠিক করার পাশাপাশি এটাও সঠিকভাবে দিতে পেরেছিল I কাজেই বাধ্য হয়েই থাকে 105 দিতে হয়েছে I

নিষণএর ইচ্ছে হচ্ছে হাত কামড়াতে I কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই I পরদিন থেকে যথারীতি টিফিন পিরিওডে দীপাকে নিয়ে ম্যাথ করতে বসতে হলো I এমনিতেই মেয়েটাকে দেখলে অসহ্য লাগে তার ওপর আবার ওর বিরক্তিকর প্রশ্ন শুনে মাথায় আগুন ধরে যায় I নিষণ ভগ্নাংশের অংক বোঝাচ্ছিল বাঁশের অর্ধেকটা লাল রং বাকি দুই তৃতীয়াংশ সবুজ এক-চতুর্থাংশ হলুদ কতটুকু বাকি থাকে I দীপা জিজ্ঞেস করল
– বাঁশের মধ্যে রং করার দরকার কি ? রং না করলে তো আর এইসব ঝামেলা হতো না
নিষণ অনেক কষ্টে রাগ সংবরণ করে বললো
ঠিক আছে এখন তুমি নিয়ম টা দেখো
ধুর ! এই অংক ভালো লাগছে না অন্য কিছু করি
আচ্ছা তাহলে শতকরার অংক গুলি বোঝাচ্ছি
ওকে
টাকায় দশটা আমলকি কিনে বারোটা দরে বিক্রি করলে শতকরা কত লাভ বা ক্ষতি হচ্ছে ? বলতো কমনসেন্স কি বলে লাভ হচ্ছে না ক্ষতি হচ্ছে ?
এক টাকায় দশটা আমলকি ? এখন তো দশটা টাকাতেও দশটা আমলকি পাওয়া যায় না I এ অনেক পুরনো দিনের অংক আধুনিক কিছু করাও I
নিষণ দাঁতে দাঁত চেপে বললো
অংক গুলো আমি বানাইনি
আমলকির কথা শুনে এখন আমলকি খেতে ইচ্ছা করছে
নিষণ বুঝল এর উদ্দেশ্য অংক করা নয় ওকে বিরক্ত করা I প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বললো
সারাক্ষণ শুধু খাই খাই করো কেন ?একটু আগেই তো দেখলাম কী যেন খাচ্ছিলে I
-টিফিন টাইমে খাব না তো কখন খাব ? আমি ক্যান্টিনে যাচ্ছি I তোমার কিছু লাগবে ?
– না আমি খাবার নিয়ে এসেছি
– ওকে I আমি তাহলে গেলাম
– এই অংকটা শেষ করে যাও I তা না হলে স্যার বলবেন আমি তোমাকে হেল্প করিনি
– কিছু হবে না আমি স্যারকে বলে দেবো তুমি হেল্প করেছো

দীপা দৌড়ে চলে গেল I অগত্যা কিছু করার না পেয়ে নিষণ খাবার জন্য ব্যাগ খুলল Iস্কুল ব্যাগ টা খুলে হতভম্ব হয়ে গেল নিষণ I ব্যাগের ভেতর টিফিন বক্স টা খোলা পড়ে আছে কিন্তু তাতে কোন খাবার নেই I সকালে মা একটা স্যান্ডউইচ দিয়ে দিয়েছিল I ব্যস্ততার জন্য ব্রেকফাস্ট দিতে পারেনি I বলেছিল এই স্যান্ডউইচ খেয়ে নিতে টিফিন পিরিওডে আর বাড়ি ফিরে ভাত খেতে I কিন্তু সেটা কোথায় গেল ?

***********

আপনি তো একবারও বললেন না যে আমার গানটা কেমন হয়েছে ?

মেসেজটা পেয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল নিষণ I গানটা এতো ভাল লেগেছিল যে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল I বহুদিন পর প্রশান্তির ঘুম আসাতে ,সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন সারা ঘর ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায় I নিষণ সাধারণত খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে i তখন হয়তো সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে I তারপর ঘণ্টাখানেক হেঁটে এসে সকালের খাবারের প্রস্তুতি নেয় I রোদ উঠে গেলে ,ঘুম থেকে উঠলে ওর ভীষণ মাথা ধরে থাকে সারাদিন I আজও তাই হয়েছিল পুরোটা দিন ই মাথাব্যথা ছিল I ক্লাস শেষ করে তাই আর লাইব্রেরীতে বসেনি I বাসায় এসে খায়নি পর্যন্ত কিছু I পেইন কিলার খেয়ে একটু শুয়েছিল কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টেরও পায়নি I ভেবেছিল ঘুম থেকে উঠলে মাথা ব্যথা কমবে I কিন্তু কমার বদলে ব্যাথা আরো বেড়ে গেল I এক মগ গরম কফি নিয়ে বারান্দায় বসে ফেসবুক স্ক্রল করছিল ,তখনই মেসেজটা নজরে এলো I

রানা আজ কোন বন্ধুর সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করবে I ফিরতে দেরী হবে বলে গেছে I খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে বাড়িটাI ছেলেটা যতক্ষণ থাকে বকবক করে বাড়ি মাতিয়ে রাখে I নিষণ জবাবে লিখল
– সরি ফর দা লেট রেসপন্স I গানটা অসম্ভব ভালো হয়েছে I আপনার এইটা চ্যানেলে দেয়া উচিত I
– দিতাম যদি ঠিকমত গাইতে পারতাম I সুরে অনেক ভুল ছিল
– ভুল কোথায় ? দ্বিতীয় অন্তরায় একটু সুর কেটেছিল I আর শেষের দিকে লয়টা দ্রুত হয়ে গেছে I এছাড়া তো সব ঠিকই ছিল I আমি বলছি ভালো হয়েছে
– বাহ আপনি তো গানের অনেক কিছু বোঝেন
– না না I সেরকম কিছু না I আমি প্রচুর গান শুনি I এই আর কি
– গান গাওয়া ছাড়লেন কেন ?
নিষণ একটু চমকে উঠলো I মেয়েটা কি তাহলে ওকে চেনে ? নাকি নিছকই অনুমান করছে ? কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো কোন জবাব দিল না ও I ক্যাডেট কলেজে যাবার আগ পর্যন্ত নিয়মিত গান গাইতো নিষণ I স্কুলের অনুষ্ঠান ওকে ছাড়া হতো না I হয়তো এখনও গাইত যদি না ওর জীবনটা এরকম ওলটপালট হয়ে যেত I বছরের এই সময়টা এলে খুব অস্থির লাগে ওর I সেদিনও এরকমই হেমন্তকাল ছিল I সবে শীত পড়তে শুরু করেছে I বাতাসে ঠান্ডা ভাব I স্কুল থেকে ফিরে দেখেছিল তুষাণের গায়ে হালকা জ্বর I সন্ধ্যার পর থেকে সেই জ্বর একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছিল I তখনও বুঝতে পারেনি নিষণ যে সকল হবার আগেই ওর জীবনটা এইরকম ভাবে বদলে যাবে I হঠাৎ করে মেসেজের শব্দ ঘোর কাটল নিষনের I
কি হলো বললেন না তো কেন গান ছাড়লেন ?
নিষণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিখল
ছাড়তে আর পারলাম কই
ক্যান আই কল ইউ ?
ভীষণ অবাক হয়ে গেল নিষণ I তবে আজ মাথাব্যথা থাকায় পড়াশোনা ও সম্ভাব না তাছাড়া মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়েছিল Iতাই লিখল
সিওর
যতটা না ফোন করার কথা শুনে অবাক হয়েছিল তার চাইতেও বেশি অবাক হয়ে গেলো ওর প্রথম কথাটা শুনেI ফোনটা ধরে হ্যালো না বলে মেয়েটা বলল
আপনার কি কোন কারণে মন খারাপ ?
না তো I কেন বলুন তো ?
মেয়েটা বোধহয় একটু হাসল ঠিক বোঝা গেল না I তারপর বলল
মন খারাপের কথা স্বীকার করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না
বললামতো মন খারাপ না
বলতে না চাইলে বলবেন না I মিথ্যা বলার তো দরকার নেই
অদ্ভুত তো
আচ্ছা ঠিক আছে আমি রাখছি I আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত
শুনুন I হ্যালো ?
শুনছি বলুন
গানটা চ্যানেলে কখন পাবো ?
পাবেন না
কেন ?
আমি দেব না তাই
সেকি ! আপনি আপনার ভক্তদের কথা রাখবেন না ?
আপনি তো আমার ভক্ত না I আমার গান শোনেনও নি কোনদিন I তাহলে আপনার কথা কেন রাখব ?
আগে গানটা দিন তারপর বুঝবেন ভক্ত কিনা
দিতে পারি একটা শর্তে
কি শর্ত ?
আপনি আমাকে একটা গান শোনাবেন I
হোয়াট ?
আর আমাকে এভাবে আপনি আপনি করবেন না I নিজেকে ভীষণ বয়স্ক মনে হচ্ছে I
নিষণ হেসে ফেললো I তারপর বলল
তোমার গান শুনতে হলে এখন আমার নিজের গান গাইতে হবে ?
একেবারেই
আমি বহু বছর গান গাইনা
আচ্ছা একটা কাজ করি I আমি তোমাকে কম্ফোর্টেবল করার জন্য একটা গান গাইছি I তারপর তুমি গাইবে I কেমন ?
নিষণ কিছু বলতে গিয়েও বলল না I কি দরকার শুধু শুধু গানটা মিস করার I বরং ও রেকর্ডারটা অন করে দিলো I সপ্তর্ষি গান শুরু করেছে I আজ গাইছে নজরুল গীতি

আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমার পিয়াসী বাসনায়
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়
আমারি মনের তৃষিত আকাশে
কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে
কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে
কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে
নিশীথে স্বপনে জোছনায়
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়

নিষণ বারান্দায় বসে ছিল I রাত তখন গভীর হয়েছে I চারিদিকে এতটুকুও জ্যোৎস্নার আলো নেই Iআজ বোধ হয় আমাবস্যা I তবে আকাশ খুব পরিষ্কার অনেক তারা দেখা যাচ্ছে I বহুদিন পর এত তারা দেখল নিষণ I হঠাৎই চোখে পানি এসে গেল I এই এত বড় পৃথিবীতে ওর আসলেই কেউ নেই I এই বোধটা কখনো মনের ভিতরে আসতে দেয় না ও I নিজেকে সবসময় ব্যস্ত করে রাখে I আজ কি করে যেন মনের সেই বন্ধ দরজাটা খুলে গেল কোন এক ঝলক দমকা হাওয়ায় I নিষণ অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো I অন্য পাশ থেকে বলল
কি হলো ? শুরু কর I এখন তোমার টার্ন
নিষণ চোখ মুছে আস্তে আস্তে বলল
আমারটা আজ থাক সপ্ত ?
কি বললে ?
বললাম আমার টা আজ থাক ?
তারপর কি বললে ?
সপ্ত I কি হলো হাসছো কেন ?
এমনিতেই
এই নামে তোমাকে আরো কেউ ডাকে ?
এই পৃথিবীতে আর একজন ই ডাকে
কে ?
আমার বাবা
আমি ডাকলে সমস্যা ?
না সমস্যা নেই I এবার গান শুরু করো
আজকে না I আজকে আমার মনটা আসলেই ভালো নেই I
তাহলে আমার একটা ধাঁধার জবাব দাও I তিন অক্ষরের নাম তার জলে বাস করে মাঝের অক্ষর বাদ দিলে আকাশ দিয়ে উড়ে
এটা খুবই স্টুপিড টাইপের ধাঁধা
তুমি পারো না তাই না ?
চিতল I এরকম স্টুপিড কোশ্চেন করার মানে কি ?
আচ্ছা আরেকটা বল I তিন অক্ষরের নাম একটা ফল মাঝের অক্ষর বাদ দিলে আরেকটা ফল
তুমি এ ধরনের ধাঁধা কেনো জিজ্ঞেস করছো ?
তুমি এটা পারো না আমি সিওর
কমলা I আমাকে এ ধরনের ফালতু কোশ্চেন করার মানে কি ?
বেশি বুদ্ধিমান লোকেরা স্টুপিড টাইপের ধাঁধার অ্যানসার করতে পারেনা I বোঝার চেষ্টা করছিলাম তুমি বেশি বুদ্ধিমান না অতিরিক্ত বোকা
কি বুঝলে ?
দ্বিতীয় টা বলেই সপ্তর্ষি হিহি করে হেসে ফেললো
নিষনের রাগ হওয়া উচিত কিন্তু কেন যেন হাসি পাচ্ছে I সপ্তর্ষি হঠাৎ করেই বললো I
আচ্ছা রাখছি I ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম I
খট করে লাইনটা কেটে গেল I এটা কি হলো ? নিষণ তো থ্যাংক ইউ বলেনি I তবে হঠাৎ করে লক্ষ্য করলো ওর মনের গুমোট ভাবটা চলে গেছে I আশ্চর্য তো I

চলবে…..

সুখহীন নিশিদিন
লেখনীতে অনিমা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here