সুখহীন নিশিদিন
পর্ব 4
আজকেও মন খারাপ ?
আজকে মন না মেজাজ খারাপ
কেন ?
আগের দিনের মতোই গতরাতে ও নিষণ সপ্তর্ষির গানটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল I সকালে ঘুম থেকে উঠেই চেক করলো তখনও আপলোড করা হয়নি I ভাবল হয়তো আর একটু পরে করবে I মর্নিং ওয়াক শেষ করে এসে ও আবার চেক করলো I না , এখনো নেই I কেন জানি না খুব রাগ হলো নিষনের I রাগটা যে কার উপর বুঝতে পারল না I হয়তো নিজের উপরেই I নিজেকেই বারবার বোঝাচ্ছিল কি দরকার এত চেক করার I কিন্তু পরমুহুর্তেই মনটা খচখচ করছিল , মেয়েটা কথা রাখলো না ? একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করবে ? পরমুহূর্তেই মনে হল থাক কি দরকার এত ইম্পর্টেন্স দিয়ে I শাওয়ার করতে করতে ও মাথার মধ্যে গানটা ঘুরঘুর করছিল I যেখানে একটু সুর কেটে গিয়েছিল সপ্তর্ষির I একবার ফোন করে ওটা ধরিয়ে দেয়া দরকার I ধুর কি যে হয়েছে I মাথার মধ্যে কি সব ঘুরপাক খাচ্ছে I
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় বসে টাওয়েল দিয়ে মাথাটা মুছতে মুছতে আরো একবার মোবাইলটা চেক করলো নিজের অজান্তেই I না , এখনো নেই I মেসেঞ্জার ওপেন করে ফোনটা করতে যাবে ঠিক সেই মুহুর্তেই রানা ঘরে ঢুকলো I একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে নিষণ চোখ ফিরিয়ে নিল I
বস আজকে আমার জন্মদিন
চকিতে একবার তাকাল নিষণ I তারপর চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল
ও আচ্ছা
রানা দমবার কিংবা মন খারাপ করার মতন ছেলে নয়I সে বেশ জোরের সঙ্গেই বলল
বস কারো জন্মদিন হইলে ও আচ্ছা বলে না বলে হ্যাপি বার্থডে
হ্যাপি বার্থডে I ক্লাস নাই আজকে ?
আছে কিন্তু করুম না
যাবিনা ক্যাম্পাসে ? বাসায় থাকবি ?
যামু না ক্যান ? পার্টি আছে তো I আপনার দাওয়াত I দুইটার সময় চইলা আইসেন
আমাকে বাদ দে I তোরা বন্ধুরা মিলে পার্টি কর
না বস I আপনাকে আসতেই হবে I ছোট ভাইয়ের আবদার ফেলবেন না I প্লিজ
আমার ক্লাস আছে
আপনার একটাই ক্লাস বারোটায় আমি জানি I শেষ কইরা আইসা পইড়েন
বৃহস্পতিবার এ ওর সাধারণত একটাই ক্লাস থাকে I ক্লাস শেষ করে লাইব্রেরীতে বসে I এরপর কোথাও লাঞ্চ করে বেলিরোড কিংবা টিএসসিতে চলে যায় I সন্ধ্যাটা কাটিয়ে আসে I রানা জানে I আর কোন অজুহাত খুঁজে পেল না নিষণ I বাধ্য হয়ে কথা দিতে হলো যে দুটোর সময় আসবে I রানা তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেল I বেশ খুশি হয়েই গেল I নিষণ লক্ষ করল আজ বেশ সেজেগুজেই বেরিয়েছে রানা I যাবার আগে বলে গেছে বস দেরি কইরেন না I দুইটার মধ্যে চইলা আইসেন I
রানা চলে যাবার পর অনেকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল নিষণ I ওর নিজের জন্মদিন পালন করা হয় না বহু বছর I ছোটবেলায় মা খুব যত্ন করে রান্না করত ওর জন্মদিনে I ওর সব পছন্দের খাবার I বিকেলবেলা ওদের দুই ভাইকে নিয়ে বেড়াতে যেত I বাবার কখনো মনেই থাকতো না I আগে থেকে বললেও কোনো দিন ছুটি নিত না I তবে কদিন পর খুব দামী একটা উপহার কিনে দিত I হয়তো টাকা দিয়ে সময় না দেয়ার অভাব পূরণ করতে চাইতো I কি জানি I নিষণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো I আর তখনই ফোনটা এলো I
বললে নাতো কেন মেজাজ খারাপ ?
তুমি গানটা চ্যানেলে দাওনি কেন ?
এইজন্য মেজাজ খারাপ ?
না
তাহলে ?
একজনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতে হবে
ভালো তো I এতে মেজাজ খারাপের কি হলো ?
আমার এসব ভালো লাগেনা
কি সব ?
এই অনুষ্ঠান ফনুষ্ঠান আর কি I অহেতুক হইচই
জন্মদিনের কোন উপহার কিনেছো ?
না
কেন ? কি কিনবে বুঝতে পারছ না ?
বুঝতে পারছি I কিন্তু আজকে কেনার সময় নেই I
কি কিনতে হবে বলো আমি অনলাইনে অর্ডার করে দিচ্ছি
তোমার একটা সিডি I সে তোমার বিশাল ভক্ত I আর যদি তোমার ছবি থাকে তাহলে তো কথাই নেই I
ধেত I তুমি মজা করছ
না সত্যিই
তাহলে তাকে বল আমাকে ইনভাইট করতে I আমি লাইভ গান শুনিয়ে দেব
সত্যিই তুমি এটা করবে ?
তুমি চাইলে করবো I কিন্তু জন্মদিন টা কার ? তোমার গার্লফ্রেন্ডের ?
আরে ধুর I আমার আবার গার্লফ্রেন্ড I
কেন তোমার গার্লফ্রেন্ড থাকতে নেই ?
ওসব আমার জন্য না
কেন তুমি কি গে নাকি ?
নিষণ আঁতকে উঠে বলল
তোমার মুখে কিছুই আটকায় না সপ্ত ?
না I আমার মুখ হল জলপ্রপাতের মত I সত্যি বলোনা তুমি কি গে ?
উফ ! সকাল সকাল কি শুরু করলে ? আমাকে যেতে হবে I ক্লাস আছে
ক্লাসের তো দেরি আছে
ক্লাস 12 টায় কিন্তু এখনই যাব
কেন তোমার বয়ফ্রেন্ড কি ওয়েট করছে ?
হোয়াট ? কিসের বয়ফ্রেন্ড ?
তাহলে তুমি গে না I সরি আমি বুঝতে পারিনি I ইটস ওকে I তারমানে তোমার গার্লফ্রেন্ডের এর জন্মদিন আজকে ? সমস্যা নেই তুমি ফোন দিও গান শুনিয়ে দেব I
আমার রুমমেটের জন্মদিন I আর এসব ফালতু কথা বলে একদম আমার মেজাজ খারাপ করবে না I
অন্য পাশ থেকে হাসির শব্দ শোনা গেল I নিষণ চুপ করে কিছুক্ষন শুনলো I হাসিটা খুব চেনা চেনা লাগছে I কোথায় যেন শুনেছে মনে করতে পারছে না I নিষণ বলল
আচ্ছা এখন রাখছি I আমাকে যেতে হবে
এত তাড়া কিসের ? ক্লাস তো আমারও আছে
ও আচ্ছা ভালো কথা I তুমি আমাকে এত প্রশ্ন কর নিজের ব্যাপারে তো কখনো কিছু বলো না I কোথায় পড়ো তুমি ?
ঢাকা ভার্সিটি
কোন ডিপার্টমেন্ট বল I আমি আজকে ওখানে যাব I
আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে ?
না আগে থেকে আসার প্লান I জন্মদিনের অনুষ্ঠান ওখানেই I
সপ্তর্ষি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো I তারপর একটু গম্ভীর গলায় বলল
না আজ থাক I আরেকদিন এসো I ঠিক আছে রাখছি এখন I
নিষণ কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা রেখে দিল ও I একটু অবাক হয়ে গেল নিষণ I মেয়েটা অদ্ভুত I মাঝে মাঝে মনে হয় খুব কাছের আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যেন অনেক দূরের I অচেনা কেউ I
জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এসে নিশানের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল I একটাই ক্লাস ছিল বারোটার সময় I সেটা শেষ করে বেরুতে বেরুতে প্রায় দেড়টা বেজে গেল I দুটার মধ্যে যেতে বলেছে I দেরি হয়ে যাবে বলে আর হেঁটে গেল না Iএকটা রিক্সা নিয়ে নিল I মিটিং প্লেস কার্জন হলের ফিজিকস ডিপার্টমেন্ট I রানা বলেছে সবাই সামনের সিঁড়তে থাকবে I তারপরেও খুঁজে না পেলে ফোন করতে I খুঁজে না পাওয়ার কোন কারণ নেই I ফিজিকস ডিপার্টমেন্ট আসার অনেক আগে থেকেই ওদের হাসির শব্দ শোনা যেতে লাগলো I সর্বসাকুল্যে 7 জন I দুজন ফিজিক্সের I তিনজন বায়োকেমেস্ট্রির I আর রানা আর ওর এক বান্ধবী মাইক্রোবায়োলজির I একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো রানা I ফিজিক্সের টুম্পা আর মারুফ I বায়োকেমেস্ট্রির দিলরুবা , নেহাল আর মীরা I এছাড়া রান আর ওর বান্ধবী দীপা I দীপাকে দেখে নিষনের ভুরু কুঁচকে গেল I এমনিতেই এখানে আসতে ইচ্ছা করছিল না I এখানে এসে এই অসহ্য মেয়েটাকে দেখতে হবে এটা ও ভাবতেও পারেনি I এত বছরেও ওর মনোভাব বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি I দীপা খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল
কেমন আছ নিষণ ? তোমার একটু ও চেঞ্জ হয়নি I কানগুলো এখনো খরগোশের মতই আছে I জিরাফ আর খরগোশের এক অদ্ভুত কম্বিনেশন তুমি I
নিষনের চোয়াল শক্ত হলো I বাকি ছেলেমেয়েগুলো অদ্ভুতভাবে হাসছে I নিষনের হাইট প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি I স্কুলে থাকতে ও জিরাফ নামে পরিচিত ছিল I এত বছর পর এতগুলো অপরিচিত ছেলে মেয়ের সামনে এই মেয়েটা এই কথা বলবে ভাবতেও পারেনি নিষণ I ও না শোনার ভান করে বলল
আমার হাতে বেশি সময় নেই রানা I তোদের কি এখানেই বসার প্ল্যান ?
না বস I আজকের পার্টি দীপা দিচ্ছে I ধানমন্ডিতে যাইতে হবে I আমাদের বাসার কাছেইI অসুবিধা হবে না আপনার I খাওয়া শেষ কইরা সোজা চইলা যাইবেন বাসায়
কোন রেস্টুরেন্ট বল
রানা দীপার দিকে ফিরে বলল
কি হলো দীপা বল
দীপা যেটা বলল সেটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল নিষণ I কোন রেস্টুরেন্টে যাওয়া হচ্ছে না I ধানমন্ডির কয়েকটা কমিউনিটি সেন্টার ঠিক করা হয়েছে I এর মধ্যে যেকোন একটাতে গিয়ে দাওয়াত খেয়ে আসার প্ল্যান I তাও উইদাউট ইনভিটেশন Iএটা নাকি খুবই এক্সাইটিং একটা ব্যাপার I মিশন সাকসেসফুল হলে রানা সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াবে I
নিষণ হাল ছেড়ে দেয়া ভঙ্গিতে বলল
আমাকে মাফ কর I
আরে বস আপনে না গেলে কেমন চলব
তোরা যা I আমার দ্বারা এসব হবে না I আর আমার এডভাইস যদি চাস তো আমি বলব তোর ও যাস না I শুধু শুধু অপমানিত হতে হবে I
দীপা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল
থাক বাদ দে রানা I এসব মিশনের জন্য সাহস লাগে I এসব ভীতু বোরিং মানুষদের জন্য না I
নিষণ রেগে উঠে বলল
কি বলতে চাও তুমি ? এরকম একটা কাজ করার মধ্যে কোন বাহাদুরি আছে ? চরম স্টুপিডটি I তাছাড়া এটা তো আন এথিকাল ও I
দীপা উঠে দাঁড়িয়ে বলল
চল রানা I এসব সাহসের অভাবে চরিত্রবান আমার অনেক দেখা আছে I
হোয়াট ডু ইউ মিন ? আমার সাহসের অভাব ?
রানা তাড়াতাড়িই দুজনের মাঝখানে এসে দাড়িয়ে বলল
কুল , কুল I বস আজকে আমার জন্মদিন Iআমার কথা আপনারে রাখতেই হবে I
নিষণ কোনভাবেই ওদের পিছু ছাড়তে পারো না I অগত্যা কিছুক্ষণের মধ্যেই চারটা রিক্সা ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে ধানমন্ডির দিকে যেতে দেখা গেল I প্রথম স্পট ধানমন্ডির সুগন্ধা কমিউনিটি সেন্টার I এই লোকেশন টা রানা ঠিক করেছে I জায়গাটা একটু ঘিঞ্চি I আশেপাশে কিছু বিচ্ছিন্ন বাড়িঘর থাকায় ধরা পড়ে গেলে পালাতে সুবিধা হবে I সামনের দিকে একটা রাস্তার মতন ঢুকে গেছে তারপর হাতের ডান দিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই মূল সেন্টার টা I সিঁড়ির কাছে কাউকে দেখা গেল না I বেশ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতেই সবাই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল ওরা I ভেতরে ঢুকতে যাবে ঠিক তার আগ মুহূর্তে অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি পরা মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক সামনে এসে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন
তোমরা কোন পক্ষ ?
রানা হড়বড় করে বলল
আমরা পাত্রপক্ষ I ছেলের ছোট ভাইয়ের ফ্রেন্ড I
ভদ্রলোক চশমার ফাঁক দিয়ে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন Iতারপর বললেন
ছেলের ছোট ভাই ?
ভয়ে সবার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে I এখন কি হবে ?
চলবে…..
সুখহীন নিশিদিন
লেখনীতে অনিমা হাসান