সুখহীন নিশিদিন পর্ব 6

0
348

সুখহীন নিশিদিন
পর্ব 6

তুমি এখানে ?

দীপার চোখ ভিজে আছে I বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে I এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হয়েছিল নিষণ ডুবে যাবে I নিষণ রুক্ষ স্বরে বলল
কি মনে করে তুমি আমাকে ধরলে ?
দীপা খুব কষ্ট করে নিজেকে সামলাল I তারপর বলল
তুমি ভেবে ধরিনি I একজন মানুষ ডুবে যাচ্ছে ভেবেই বাঁচাতে গিয়েছিলাম
কে বলল আমি ডুবে যাচ্ছিলাম ?
তাহলে রাতের বেলা কি সুইমিং করতে নামছিলে ? মরতে হলে পাশের সুইসাইড স্কোয়াড গিয়ে মর I এখানে কেন ?
কেন এখানে পানিতে নামতে গেলে তোমার পারমিশন লাগবে ?
এখানে আমরা আনন্দ করতে এসেছি I এখানে সুইসাইড করে আমাদের আনন্দ নষ্ট করোনা I অন্য জায়গায় গিয়ে যা করার করো
কিসের সুইসাইড ?
ও তুমি তাহলে সুইসাইড করছিলে না ?
ডিসকাস্টিং
বলতে বলতে নিষণ পানি থেকে উঠে হোটেলের দিকে হাটা শুরু করল I
কোথায় যাচ্ছ ?
যেখানে গেলে তোমার চেহারা আর দেখতে হবে না

দীপা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না i দুইহাতে মুখ ঢেকে বালির মধ্যে হাঁটু মুড়ে বসে ডুকরে কেঁদে উঠলো i কেন এই ছেলেটা সবসময় ওর সঙ্গে এরকম আচরণ করে ? ছোটবেলা থেকেই এরকম হয়ে আসছে I একদিনের জন্য ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি I এটা ঠিক যে দীপা ওকে অনেক জ্বালিয়েছে কিন্তু সেটা তো ওর মন ভালো করার জন্য I ওর ব্যাগ থেকে খাবার নিয়ে খেয়ে ফেলত I তারপর ক্যান্টিন থেকে মামার হাতে খাবার পাঠিয়ে দিতে ওর জন্য I সবসময় বলে দিত যেন ওর নাম না বলে I একদিন ওর ব্যাগ থেকে খাবার বের করতে গিয়ে ওর ডাইরিটা পেয়ে গিয়েছিলো I ডাইরি পড়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল দীপা I একটা মানুষের জীবনে এত কষ্ট থাকতে পারে I এই জন্য ও সবসময় এতো গম্ভীর হয়ে, মন খারাপ করে থাকে I এরপর থেকে দীপা আরো বেশী করে চেষ্টা করেছে ওর মন ভালো করতে I কিন্তু যতোই দীপা ওর কাছে যেতে চেয়েছে , নিষণ ততই ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছে I একবার দীপা ওর ব্যাগের ভেতর একটা হাস্যকর ভুতের মুখোশ রেখে দিয়েছিল i ওকে হাসানোর জন্য I পরদিন দীপা ক্যান্টিনে বসে খাচ্ছিল কোত্থেকে নিষণ এসে মুখোশটা ওর সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল
তুমি কেন এটা আমার ব্যাগে রেখেছো ?
ঘরভর্তি লোকের সামনে এভাবে চিৎকার করায় দীপার ও খুব মেজাজ খারাপ হয়ে গেল I এক কথা দুকথায় বিশাল ঝগড়া বেধে গেল I এক পর্যায়ে নিষণ বলল
তুমি দেখতে যেমন ভূতের মত তোমার আচার-আচরণ ও ভুতুড়ে
এই কথাটা শুনে দীপা কেমন চুপসে গিয়েছিল I দীপা দেখতে সুন্দর নয় I তথাকথিত সুন্দরী বলতে যা বোঝায় দীপা সেটা নয় I ওর গায়ের রং শ্যামলা মাথার চুল কোঁকড়ানো I তবে ওর মুখশ্রী খুব মায়াবী I আর মনটা ভীষণ পরিষ্কার I এটা সবসময়ই ওর মা বলে I কি জানি হয়তো নিজের মেয়ে বলে বলে I হয়তো আসলেই ও দেখতে ভূতের মত I এরপর ক’দিন খুব মন খারাপ করে ছিল দীপা I মনে মনে আশা করেছিল নিষণ হয়তো এসে সরি বলবে I কিন্তু সেটা আর হয়নি I এই ঘটনার পর দুইদিন নিষণ স্কুলে আসেনি I তৃতীয় দিন স্যার এসে বললেন
এবার কালচারাল প্রোগ্রাম তোমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হবে দীপা
স্যার আমি তো কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই না I সব সময় নিষণ গায়
হ্যাঁ আমি জানি I কিন্তু এবার তোমাকে গাইতে হবে I
নিষণ কেন গাইবে না স্যার ?
নিষণ স্কুল ছেড়ে দিয়েছে I ওর ফ্যামিলিতে একটা ইন্সিডেন্ট হয়েছে I
নিষনের কি হয়েছে জেনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল দীপা I কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারেনি I নিষণদের বাসা স্কুলের খুব কাছেই I দীপা একদিন গিয়েছিল ওদের বাসায় I কিন্তু ততদিনে ওরা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে I

বিচ থেকে ফিরে হোটেলে ঢুকতে ঢুকতে নিষণ খেয়াল করলো ওর পুরো জুতো প্যান্ট বালিতে মাখামাখি হয়ে আছে I হোটেলের বাইরে থেকে পা ধুয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবে তখনই লক্ষ্য করলো পাশের হোটেলে খুব হইচই হচ্ছে I ওদের হোটেলটা হোটেল সাইমনের ঠিক পাশেই I নিষণ একটু বিরক্ত হয়ে তাকালো I বোধহয় কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে I ডিপার্টমেন্টের আজকের প্রোগ্রামের সঙ্গে ডিনার ইনক্লুডেড ছিল তাই সবার ফিরতে ফিরতে দেরি হচ্ছে Iনিষণ এর খাবার ইচ্ছা মরে গেছে I রুমে ফিরে ও ঘরটা গুছিয়ে নিল I তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো I রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের গর্জন বড় বেশি বিষন্ন শোনাচ্ছে I নিষণ মোবাইল চেক করে দেখল সপ্তর্ষি অফলাইনে Iখুব অস্থির লাগছে I নিষণ ভেবেছিল আজ সপ্তর্ষি ওর কাছে এসেছে I কিন্তু দীপাকে দেখে মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ হয়েছে I এতটাও খারাপ ব্যবহার করা হয়তো উচিত হয়নি I কিন্তু কিছু করার নেই I এই মেয়েটার সঙ্গে ওর জীবনের খুব খারাপ কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে I শেষ সেদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেদিন ও খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল I ঘরভর্তি লোকের সামনে ওকে অপমান করে বেরিয়ে এসেছিল I স্কুল থেকে i ফিরতে ফিরতে একবার মনে হয়েছিল পরদিন গিয়ে সরি বলবে I কিন্তু সেদিন রাতেই এত ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটবে ভাবতেও পারেনি নিষণ I

সেদিন সকাল থেকে প্রচন্ড মন খারাপ ছিল নিষনের I নিষণ এর শোবার ঘরটা বাবা মায়ের ঘরের ঠিক পাশেই I প্রতিদিন রাতেই সেখান থেকে ঝগড়ার শব্দ ভেসে আসে I মাঝে মাঝে মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায় নিষণ I সকালে উঠে মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারে না I মায়ের ফুলে ওঠা চোখ নির্ঘুম রাতের সাক্ষী দেয় I বুকের ভেতরটা ভেঙেচুড়ে যায় ওর I বরাবর কিন্তু এমন ছিলনা I

নিষনের বাবা-মা, আরিফ আর রিমা দুজনেই ডাক্তার I একই মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছে Iতিন বছর সম্পর্কের পর তাদের বিয়ে হয় I রিমা তখন ফার্স্ট ইয়ারে আর আরিফ ফাইনাল ইয়ারে I প্রথম দেখাতেই রিমার প্রেমে পড়ে যায় আরিফ I প্রেমে পড়ার মতোই মেয়ে রিমা I যেমন সুন্দরী তেমনি ভালো রেজাল্ট I রিমা , বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান I এই সম্পর্কটাকে বাবা-মা খুব ভালোভাবে নেননি I অনেক বুঝিয়েছিলেন বিয়ের আগে I কিন্তু রিমা সে সময় আরিফের প্রেমে অন্ধ হয়ে ছিল I এমনকি পাস করা পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি I

বিয়ের পরপরই রিমা বুঝতে পেরেছিল ক্যাম্পাসে থেকে প্রেম করা আর একই ছাদের নিচে থেকে সংসার করার মধ্যে অনেক পার্থক্য I আরিফ তখন সদ্য চাকরি পেয়েছে I রিমা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো আরিফের সংসারের কোন কাজের প্রকৃতি কোন আগ্রহ নেই I রিমা সংসার সামলে কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল I বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করায় সাংসারিক কোন ঝামেলার কথা বাবা-মায়ের সঙ্গে শেয়ার করতে না I বিয়ের পরপরই নিষনের জন্ম হয় I ছোট্ট নিষণকে সঙ্গে নিয়ে বহু কষ্টে ডাক্তারি পাশ করার পর কোনোভাবেই চাকরি করার কথা ভাবতে পারেনি রিমা I হাল ছেড়ে দিয়ে রিমা সংসারে মনোযোগী হল I এই সুযোগে আরিফ নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল I যদিও রিমার কোন আফসোস ছিল না I নিষণকে পেয়ে সবকিছু ভুলে গিয়েছিল ওI নিষণ ও ছিল তেমনি লক্ষ্মী I ওর খাওয়া-ঘুম পড়াশোনা কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করতে হত না I ছোটবেলা থেকেই নিষণ লক্ষী ছেলে I মায়ের খুব খেয়াল রাখতো I নিষনের বয়স যখন সাত বছর তখনই একটু গুছিয়ে নিয়ে একটা চাকরিতে ঢুকল রিমা Iএকজন সিনিয়ার ডক্টর কে অ্যাসিস্ট করতে হবে I মায়ের খুশি দেখে নিষণ অনেক খুশি হয়েছিল I মাকে আশ্বস্ত করেছিল ঠিকই নিজের খেয়াল রাখতে পারবে ওI কিন্তু বিপত্তি বাধল কয়েক মাসের মধ্যেই I রিমা টের পেল আবারো মা হতে যাচ্ছে ওI অগত্যা চাকরি ছেড়ে আবার সংসারে মনোযোগী হল রিমা I হতাশা পেয়ে বসল তাকে I স্বামীর উদাসীনতা,নির্লিপ্ততা ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খেতে লাগল I এত হতাশার মধ্যেও একটাই আশার আলো , আর সেটা ছিল নিষণ I রিমা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে মাত্র আট বছর বয়সেই অদ্ভুত মানসিক পরিপক্কতা এই ছেলেটির I ভাইকে পেয়ে নিষনের সে কি আনন্দ I ভাইকে ঘুম পাড়ানো ,খাওয়ানো ,গল্প পড়ে শোনান সবকিছুতেই নিষনের ভারী উচ্ছ্বাস I দু’বছরের মধ্যেই তুষাণ বিশাল ভক্ত হয়ে গেল নিষনের I স্কুল থেকে আসার আগেই গেটের কাছে বসে থাকতো I এই অবস্থা দেখে একটু একটু করে আবার চাকরিতে ঢোকার সাহস করলো রিমা I ততদিনে বিশ্বস্ত একজন কাজের লোক পেয়ে গেছে I তুষাণের যখন তিন বছর তখন রিমা আবার নতুন চাকরিতে জয়েন করলো I এ নিয়ে আরিফের বিরক্তির সীমা ছিলনা I নিজের লাইফ স্টাইল কোনভাবেই চেঞ্জ করতে রাজি নয় সে I নিত্যদিন বাড়িতে অশান্তি লেগে থাকত I তার পরেও নিষণ আর সালমা খালার ভরসাতেই চাকরিটা করে যাচ্ছিল রিমা I কাজের প্রতি ওর ডেডিকেশন দেখে কিছুটা দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়া হলো ওর I

ওই দিনটার কথা কোনদিনও ভুলতে পারবেনা নিষণ I সকালবেলা উঠেই মা বলেছিল আজকে ওর নাইট ডিউটি আছে I নিষণ স্কুল থেকে ফিরলেই মা বেরোবে I পরদিন সকাল সাতটায় ফিরে আসবে I সপ্তাহের এই দিনটাতে সাধারণত আরিফের নাইট ডিউটি থাকে না I সব গুছিয়ে নিয়ে রিমা যখন আরিফ কে বলল আরিফ ভুরু কুঁচকে জানালো যে আজকে ওর নাইট ডিউটি আছে I রিমা হতভম্ব হয়ে গিয়েছেল কারণ ও খুব ভাল করেই জানে , এই দিনে আরিফ ওর বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাবে যায় I কখনোই নাইট ডিউটি রাখেনাI অনেক বোঝানোর পরও আরিফ কিছুতেই রাজি হলো না I এককথায় জানিয়ে দিল রিমাকে চাকরি ছেড়ে নিতে I অনেকটা জোর করেই রিমা একা একা সবটা গুছিয়ে নিল I সালমাকে বলল রাতে থাকতে I নিষণ স্কুল থেকে ফিরলে ওকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল I সন্ধ্যা পর্যন্ত নিষণ ভাইকে নিয়ে খেললো I কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকেই তুষাণের হঠাৎ জ্বর বাড়তে আরম্ভ করলো I রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়তে থাকল I নিষণ বাবা-মাকে ফোন দিল I মায়ের ফোন বন্ধ I মা বলেছিল সার্জারির সময়ে ফোন বন্ধ থাকবে I বাবার ফোন বেজেবেজে থেমে গেল কিন্তু ধরলো না I রাত তিনটার দিকে তুষাণের খিচুনি শুরু হল I নিষণ বুঝতে পারছিল না কি করবে I উপায়ান্তর না দেখে সালমা খালাকে নিয়ে কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে গেল ভাইকে I

সকাল সাতটার সময় যখন আরিফ আর রিমা হসপিটালে পৌঁছালো ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে I তুষাণ কে বাঁচানো যায়নি I দূর থেকে নিষণ দেখেছিল বাবা হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে মাকে দোষ দিচ্ছে I অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছে I বাবাকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছিল I সাধারণত যেদিন বাবা ক্লাবে যায় পরদিন সকালবেলা তাকে অনেকটাই অপ্রকৃতস্থ লাগে I এত বছর পর এখন বুঝতে পারে নিষণ বাবা সেদিন মদ খেয়ে ছিল I আস্তে আস্তে মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের হাত ধরার চেষ্টা করল নিষণ I মাকে কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিলো I রিমা একবারও নিষনের দিকে তাকালো না I আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল I কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচ থেকে শোরগোল শোনা গেল I ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে দেখল মায়ের থেঁতলানো দেহটা পড়ে আছে I অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোন কথা বলতে পারেনি নিষণ I রিমার বাবা আফসার সাহেব নিষণ কে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেছিলেন I

একটা রাতেই নিষনের জীবনটা হঠাৎ করে অনেক বদলে গেল I নিষণ আর বাবার সঙ্গে থাকতে রাজি হয়নি I আফসার সাহেব নিষণ কে নিয়ে গিয়েছিলেন I আরিফ অনেক চেষ্টা করেছে I কিন্তু লাভ হয়নি I ছেলের জেদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি I এতে অবশ্য তাকে খুব একটা দুঃখিত বলে মনেও হয় নি I বরং কেমন হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল I এর কয়েক বছর পর আরিফ দেশ ছেড়ে চলে যায় I নিষণ আর আগের স্কুলে যেতে রাজি হয়নি I ইচ্ছা করে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছিল I চারবছর সেখান থেকে অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করে বুয়েটে চান্স পায় ও I ঢাকায় ফিরে এসেও নানা ভাইয়ের সঙ্গে উঠতে চায়নি I আলাদা বাড়ি ভাড়া করেছে I আফসার সাহেবের আর কোন সন্তান না থাকায় তার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী একমাত্র নিষণ I চাইলে ও অনেক বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারে কিন্তু ওর কখনো ইচ্ছা করে না I এমনিতে নিষণ খুব একটা কথা বলতো নাI এই ঘটনার পর নিজেকে আরও গুটিয়ে ফেলল I কোন কিছুতেই এখন আর কোনো আগ্রহ বোধ করে না ও I সারাক্ষণ নিজেকে পড়াশোনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে I ওর কোন বন্ধু বান্ধব নেই I বুয়েটে ভর্তি হবার পর আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল যেন নিজের মত থাকতে পারে I পড়াশোনা ছাড়া একমাত্র গান শুনতেই ভালো লাগে ওর I এখন আর গান গাইতে ও ইচ্ছা করে না I কারো সঙ্গে কথা বলতে ও ভালো লাগে না I শুধু একজনই আছে যার সঙ্গে কথা বললে ওর এই ঊষর , যন্ত্রণাময় জীবনের জ্বালাটা একটু কমে I কে জানে সেও বা কতদিন ওর সঙ্গে থাকবে I আজ পর্যন্ত তো ওর কোন ভালোবাসার মানুষকে ধরে রাখতে পারেনি ও I নিষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও ফোনের দিকে তাকালো I এখনো অফলাইনে ?

হোটেল সায়মন এ আজ একটা গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম হচ্ছে I যদিও বলা হয়েছিল ঘরোয়া অনুষ্ঠান কিন্তু প্রায় শ’খানেক লোক হয়ে গেছে Iহোটেলের একটা বিশাল অংশ বুক করা হয়েছে I দীপার বড় ফুপুর ছেলে রোহান আর ছোট ফুপুর মেয়ে সপ্নার বিয়ে হচ্ছে I প্রতিবছরই একবার সবাই মিলে সপরিবারে কক্সবাজার আসে ওরাI যেহেতু সপ্না এবং রোহানের বিয়ের কথা অনেক আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে কাজেই এবার ঠিক হলো কক্সবাজার এসে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করা হবে I আত্মীয়-স্বজন সব মিলে প্রচুর লোক কিন্তু অনুষ্ঠানের কোন প্রাণ নেই I সবাই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে একজনকে I দীপা যখন হোটেলে ঢুকলো সবাই ওকে দেখে চমকে গেল I দীপা রুমে চলে গেল মাথা ব্যথার অজুহাত দিয়ে I কিছুক্ষণ পর তৌহিদ ঘরে এসে ঢুকলেন I দীপা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল I তৌহিদ ওর মাথায় হাত রেখে বললেন
মন খারাপ মা ?
হ্যাঁ বাবা
আমি তোমার কাছে জিজ্ঞেস করবো না কেন মন খারাপ কিংবা তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে I শুধু একটা কথাই বলবো যখন আমাদের মন খারাপ থাকে তখন আমরা এটা কখনোই বুঝতে পারি না যে আমাদের কারণে অন্যদের কতটা খারাপ লাগতে পারে I তুমি নেই বলে নিচের অনুষ্ঠানে কেউ আনন্দ করতে পারছে না I
দীপা উঠে বসে চোখ মুছলো I তারপর বলল
বাবা তুমি নীচে যাও আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি I
কিছুক্ষণের মধ্যেই দীপাকে ঝলমলে পোশাক পরিহিত অবস্থায় পার্টি হলে অনেক আনন্দ করতে দেখা গেল I তার মুখের হাসি দেখে কেউ আন্দাজ ও করতে পারবে না যে ওর বুকের ভেতর কি প্রচন্ড যন্ত্রণা চলছে I

দীপা যখন রুমে ফিরে এলো তখন রাত দুইটা বাজে I আজ সবাই মেহেদি পড়বে বলে মেয়েরা সব একই ঘরে আছে I এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে একা একা থাকতে পারছে ও I দীপা চেঞ্জ করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল 42 টা মিস কল এসেছে I শেষটা এসেছে দুই মিনিট আগে I ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে গেল দীপা

তুমি ঠিক আছ নিষণ ?
তোমার পার্টি শেষ হয়েছে ?
হ্যাঁ হয়েছে
তুমি কি এখন কক্সবাজারে ?
দীপা চমকে উঠলো I তবে কি ও টের পেয়ে গেছে যে দীপাই সপ্তর্ষি I দীপা ভয়ে ভয়ে বলল
কেন ?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি এখানে
না আমি এখানে না
ও আচ্ছা I নিষণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো I যাক ভাল হয়েছে I আমি কালকে ফিরে যাব I এখানে আর ভালো লাগছে না I তুমি কি কালকে আমার সঙ্গে দেখা করবে ?
তুমি কালকে কেন ফিরে যাবে ? কালকে তো তোমার অ্যাওয়ার্ড সেরিমনি I তুমি এওয়ার্ড নেবে না ?
আমার কিছু ভালো লাগছেনা
কি হয়েছে ? আমার সঙ্গে শেয়ার করা যায় ?
আমার খুব বলতে ইচ্ছা করে তোমাকে I তুমি শুনবে ?
অবশ্যই শুনবো
যে কাজটা কখনোই করেনি নিষণ আজ তাই করল I ওর জীবনের অন্ধকার অধ্যায় হঠাৎই উন্মোচিত করল একজনের সামনে I কথাগুলো বলতে পেরে এক ধরনের প্রশান্তি বোধ করল নিষণ I তারপর আস্তে আস্তে বলল
আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো সপ্ত I আমার শরীরেও আমার বাবার রক্ত আছে I হয়তো আমিও একসময় এরকমই করব I বাবা আমার মায়ের গায়ে হাত তুলত I অথচ শুনেছি তাদের ভালোবাসার বিয়ে I
তোমার শরীরে তো তোমার মায়ের রক্ত ও আছে I এমনও তো হতে পারে যে তুমি তোমার বউয়ের হাতে মার খেলে I
নিষণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো I তারপর হো হো করে হাসতে শুরু করল I একসময় হাসি থামিয়ে বলল
তোমার কাছাকাছি থাকলে আমার মনটা অকারণেই ভালো হয়ে যায় I তুমি কি আজীবন আমার মন ভালো হওয়ার কারন হবে ?
চলবে…………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here