সুখহীন নিশিদিন পর্ব 7

0
280

সুখহীন নিশিদিন
পর্ব 7

তুমি আমার প্রশ্নের কোন জবাব দিলে না সপ্ত ?
কি প্রশ্ন ?
তুমি আমার মন ভালো করার কারণ হবে কিনা ?
আমাকে দেখার পরও তোমার যদি এই প্রশ্নটা থাকে তখন জবাব দেব
তোমার মনে হয়, তোমাকে দেখলে আমার প্রশ্ন বদলে যাবে ?
দীপা হাই তুলতে তুলতে বলল
সম্ভাবনা খুবই বেশি
আমাকে তোমার এরকম মনে হয় ?
তুমি কি রকম সেটা ব্যাপার না বিষয়টা হচ্ছে আমি কিরকম
কিরকম ?
আমি দেখতে খুব খারাপ Iএকবার একজন আমাকে বলেছিল যে আমি দেখতে ভূতের মত I
তোমাকে কেউ এই কথা বলেছে ? তোমাকে ?
হু
যে বলেছে তার চোখ নেই
দিপা খিল খিল করে হেসে উঠলI তারপর হাসি থামিয়ে বললো
ঘুমিয়ে পড়ো I রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে I কাল সকালে তোমার প্রোগ্রাম আছে I
সপ্ত I এখনই সূর্যোদয় হবে I তুমি আমার সঙ্গে সূর্যোদয় দেখবে
দীপা তাকিয়ে দেখল পুব আকাশে সোনালী রেখা দেখা যাচ্ছে I
দুজনেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের জীবনের প্রথম সমুদ্র সূর্যোদয় দেখলো I

পরবর্তী কয়েকটা দিন নিষণ এবং দীপা দুজনকে খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো I খুব একটা কথা হলনা I বেশিরভাগ ভাব বিনিময় হল মেসেজে I নিষণ তিনদিন থেকে ফিরে এসেছে I ডিপার্টমেন্ট এর অনুষ্ঠান মূলত তিনদিনই ছিল I এরপর সবাই সেন্টমার্টিন, ছেড়া দ্বীপে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল I নিষণ মূল প্রোগ্রাম শেষ করে ফিরে এল I

যেদিন ফিরল , বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল I ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছিল I কোনমতে শাওয়ার শেষ করে বিছানায় যেতেই টের পেল মেসেজ অপশন টা জ্বলজ্বল করছে I সপ্তর্ষি মেসেজ পাঠিয়েছে
পৌঁছেছে ঠিকভাবে ?
পৌঁছেছি I কাল দেখা করবে ?
একটা হাসির ইমোজি এল I নিষণ বুঝতে না পেরে লিখল
মানে কি ?
উত্তর এলো
ঘুমিয়ে পড়ো I কালতো ক্লাস নেই I সকালে কথা বলবো I
এর কিছুক্ষণ পর একটা অডিও এল I নিষণ হাসিমুখে অডিওটা অন করল তারপর গানটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পরল I এই গানটা ওর খুব প্রিয় I আজ অনেকদিন পর শুনলো

চক্ষে আমার তৃষ্ণা,
ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।
চক্ষে আমার তৃষ্ণা,

আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন,
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন,
সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে

নিষনের ঘুম ভাঙলো অনেক বেলা করে I সাধারণত দেরি করে উঠলে ওর মাথা ধরে থাকে I আজ সেরকম হলো না I কেমন একটা ফুরফুরে অনুভূতি হচ্ছে I কি যেন একটা মিষ্টি স্বপ্ন দেখেছে I স্বপ্নটা মনে নেই I শুধু তার রেশ রয়ে গেছে মনের মধ্যে I একটা দৃশ্য কেবল মনে আছে I খোলা একটা রিকশা ভ্যান তার উপর অনেক গাঁদা ফুল I নিষণ শুয়ে আছে ভ্যানটার উপর I ভ্যানটা চলছে একটা কাঁচা রাস্তা ধরে I উপরে হালকা নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে Iরাস্তার দুই পাশে অনেক গাছ আকাশটাকে ঢেকে রেখেছে I গাছের ফাঁক গলে ভোরের ঝলমলে রোদ মাঝে মাঝে চোখে এসে লাগছে I কেউ একজন বোধহয় আছে ওর পাশে I দেখতে পেল না স্বপ্নের মধ্যে I শুধু হাতের স্পর্শ টা লেগে আছে I

নিষণ ঘড়ি দেখল I দশটা বাজে I তারপর ফোনটা তুলে ফোন করল
তুমি কি বিজি সপ্ত ?
না তো
আজ দেখা করবে ?
না কাল I তোমার তো কাল ছুটি তাই না ?
হ্যাঁ
তাহলে কাল দেখা করি
আচ্ছা I কালকের গানটা আরও ভাল ছিল I
ভুল ছিল কোন ?
নাহ
আচ্ছা তুমিতো আমাকে এখনো গান শোনালে না
যখন দেখা হবে তখন শোনাব
না এখনই শোনাও
আমি অনেক বছর গান গাইনা সপ্ত
না এখনই I এখনই
তুমি ভারী জেদ করো
হ্যাঁ করি I গান না শোনালে তোমার সঙ্গে দেখা করবো না
আচ্ছা আচ্ছা শোনাচ্ছি I তারা আগে বল আমি তোমাকে চিনব কি করে
উম ! তাইতো I তুমি বলো
নিষণ জবাব না দিয়ে গান শুরু করল

যদি তারে নাই চিনি গো, সে কি…
সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে?
জানি নে, জানি নে
যদি তারে নাই চিনি গো, সে কি…

সে কি আমার কুঁড়ির কানে কবে…
সে কি আমার কুঁড়ির কানে
কবে কথা গানে গানে
পরান তাহার নেবে কিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে?
জানি নে, জানি নে
যদি তারে নাই চিনি গো, সে কি…
নিষণ হঠাৎ গান থামিয়ে বললো
এর পরের লিরিক ভুলে গেছি

দীপা খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো
কত বছর পর শুনলাম
মানে ?
মানে তুমি কত বছর পরে গাইলে আর কি
ও I সত্যিই তো আমি তোমাকে চিনব কি করে ? তুমি কি একটা সবুজ রঙের ড্রেস পড়ে আসতে পারবে ?
সবুজ তোমার প্রিয় রং ?
হ্যাঁ
ঠিক আছে I
কোথায় আসবে বলো
কার্জন হল I ফিজিকস ডিপার্টমেন্ট
আবার ফিজিকস ডিপার্টমেন্ট
কেন কি হয়েছে ?
কিছু না I ঠিক আছে I পাঁচটায় ?
ওকে পাঁচটায় I সি ইউ

দীপা দূর থেকে নিষণ কে দেখলো I পা ছড়িয়ে বসে আছে ডিপার্টমেন্টের সামনের সিঁড়িতে I ওর পরনে শাদা ফতুয়া সঙ্গে জিন্স Iচোখেমুখে উদ্বেগ I বারবার ঘড়ি দেখছে I দীপা মনে মনে একটু হাসলো I একবার সামনে দিয়ে হেটে গেলI নিষণ লক্ষ্য করলো না I
আজ দীপা খুব যত্ন করে সেজেছে I সবুজ রঙের লং কামিজের সঙ্গে ব্ল্যাক চুরিদার I লম্বা চুলে বিনুনী করে এক পাশে ফেলে রেখেছে I চোখে ঘন করে কাজল দিয়েছে I কানে ঝুমকা I ভারী মিষ্টি লাগছে ওকে দেখতে I দীপা আরেকবার সামনে এসে দেখল নিষণ উঠে দাঁড়িয়েছে I ডান হাত দিয়ে ওর চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে দিতে দিতে বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছে I দীপা একটু হাসলো I এবার আর সামনে দিকে না এসে ডিপার্টমেন্টের পেছন দিকে চলে গেল I পেছন থেকে ঘুরে বারান্দায় এসে দেখল নিষণ আবার ফিরে এসে বসেছে I

আজকের দিনটা ঝলমলে নয় I আকাশে মেঘ করে আছে I দীপা যখন কার্জন হলের গেট দিয়ে ভিতরে আসছিলো কয়েক ফোটা বৃষ্টি ও ওর উপর এসে পড়েছে I দীপা সিঁড়ির কাছে এসে বলল
হাই নিষণ
নিষণ একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো I কোন জবাব দিল না I দীপা আরেকটু কাছে এসে বলল
তুমি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছো ?
নিষণ প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে তাকালো I দীপা আবারো বললো
স্পেশাল কেউ ?
নিষণ উঠে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল
দ্যটস নান অফ ইওর বিজনেস I তারপর আর দাঁড়ালো না সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল I
দীপার হঠাৎ চোখে পানি এসে গেল I ও কি ভেবে রেখেছিল আর কি হলো I দীপা আস্তে আস্তে হেঁটে ডিপার্টমেন্টের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে রইল হাটুর মধ্যে মুখ গুঁজে I ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে I তুমুল বর্ষণ I এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে দিপার চোখের জল কেউ দেখতে পারছে না I দীপা তেমনি বসে রইল I ঘন্টাখানেক ভেজার পর যখন কাঁপন ধরে গেল তখন উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি পথ ধরল I

বৃষ্টি নামার পর নিষণ সিডি থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেল I রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল অনেক্ষণ I ফোন চেক করে দেখলো সপ্তর্ষি অফলাইনে I মোবাইলটা ও বন্ধI এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল সপ্তর্ষি বোধহয় চিরকালের মতো হারিয়ে গেল ওর জীবন থেকে I পরমুহুর্তেই মনে হোলো কোনো বিপদ হয়নি তো ? আসার পথে I নিষণ অনেকগুলি টেক্সট পাঠালো I ফোন করলো অনেকবার I কিন্তু কোন জবাব এলো না I সন্ধ্যা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে যখন বৃষ্টি ধরে এল তখন আস্তে আস্তে হেঁটে রিক্সা নিয়ে বাড়ি চলে গেল I

তৌহিদ দরজা খুলে মেয়েকে দেখে চমকে উঠলেন I দীপার চোখ লাল হয়ে আছে I ঠোট ফ্যাকাশে রক্তশূন্য I মেয়েকে ধরে ভয় পেয়ে গেলেন তিনি I শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক রকম বেশি I তিনি দীপাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন I সারারাত জেগে মেয়ের শিয়রে বসে রইলেন I রাতে দীপার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠলো I

একরাশ অভিমান নিয়ে নিষণ রিক্সা করে বাড়ির দিকে যেতে লাগলো I কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই অভিমান উদ্যোগে পরিণত হবে এবং শেষ হলে দুশ্চিন্তায় I হঠাৎই ভীষণ রকম ভয় করতে লাগলো I যদি সপ্তর্ষির কিছু হয়ে যায় I যদি সেও আর সবার মত ওকে ছেড়ে চলে যায় I তাহলে কি নিয়ে থাকবে নিষণ ? বাড়ি ফিরে নিষণ সোজা রানার ঘরে গেল I রানা তখন কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছিল I নিষণ কে দেখে একটু হাসল I নিষণ কাছে এসে টান মেরে ওর হেডফোন খুলে বলল
তোর কাছে কি দীপার নাম্বার আছে ?

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here