সুখহীন নিশিদিন
শেষ পর্ব
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা I নিষণ অনেকক্ষণ ধরে বারান্দায় বসে আছে I কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না I চোখ বুজলেই দীপার টলটলে চোখ দুটো চোখের সামনে ভেসে উঠছে I কেন যে কিছু বলতে পারল না তখন I ডিবেটের মঞ্চে কথা বলা সহজ I উপস্থিত বক্তৃতা কিংবা শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তর দেয়া অনেক সহজ I জবাব চাওয়া ও অনেক সহজ I শুধু নিষণই পারল না I একটা প্রশ্ন করেছিলো I শুধু একটা প্রশ্ন I সেটার জবাব ও চাইতে পারলো না I দীপা বলেছিল যেদিন দেখা হবে সেদিন উত্তর দেবে I তবে দিল না কেন ? সব দোষ কি ওর ? হ্যাঁ ঠিকই তো I সব দোষ তো ওরই I ওই তো এরকম বিচ্ছিরি ব্যবহার করেছে সব সময় I
ছোটবেলায় কি অসহ্য রকমের ভালো লাগতো দীপাকে Iস্কুলে থাকতে যখন ও লম্বা দুই বেনী করে হাসতে হাসতে ক্লাসের মধ্যে ঢুকত , মনে হতো ক্লাসরুমটা আলোয় ঝলমল করে উঠছে I বিচ্ছিরি রকমের যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি হত I সেই বয়সে বুঝতে পারেনি I শুধু ভীষণ রাগ হতো নিজের উপর I আর সেই রাগটা ও সবসময় দেখাতো দীপার সঙ্গে I তবুও দীপা কখনো কিছু বলে নি ওকে I আচ্ছা দীপা কি ওকে ভালোবাসতো ? পুরোটা রহস্যে মুড়ে রেখেছে নিজেকে I অথচ কি রকম কায়দা করে নিষনের কাছ থেকে সব কথা বের করে নিল I নিষণ তো বলেছে ওকে আগেও ভালোবাসতো I আর সপ্ত , ও কে ও তো বলেছে I তবু কেন এভাবে চলে গেল দীপা ?
অনেক বছর আগে দীপাকে একটা গান শুনাতে চেয়েছিল নিষণ I ভেবেছিলো বড় হলে কোন একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে এই গানটা শোনাবে ওকে I পরিস্থিতির চাপে পড়ে এই অনুভূতি গুলি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল I আজ বহু বছর পর সবকিছু মনের মধ্যে ভিড় করে উঠে আসছে I এতদিন সব বিচ্ছিরি স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিল I অথচ আজ শুধু সুন্দর স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে I খুব ইচ্ছা করছে দীপার কাছে গিয়ে ওকে বলতে
সপ্তদীপা তোমাকে ছাড়া আমার একটুও চলবে না Iএকটুও না
নিষণ পাশের সাইড টেবিল থেকে ফোন টা তুলে নিল I তারপর কি একটা ভেবে আবার পকেটে রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো I
দীপা বাসায় ফিরেছে সন্ধ্যার পর I খুব ভয়ে ভয়ে ছিল I বাবা হয়তো অনেক প্রশ্ন করবে I কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে বাবা তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেননি I দু’একটি কথা বলেছেন তাও খুবই অপ্রাসঙ্গিক I এই যেমন ট্রাফিক জ্যাম ছিল কিনা I রাস্তায় অনেক ধুলোবালি I গোসল করে নিতে তাড়াতাড়ি, এইসব I অনেক সময় নিয়ে গোসল করেছে দীপা I তারপর বাবা মাকে নিয়ে একসঙ্গে খেতে বসেছে I একটু ও খেতে ইচ্ছা করছিল না I তবু খেতে হয়েছে I তা না হলে বাবা ভাবত ওর মন খারাপ I খাওয়া শেষ করেই তাড়াতাড়ি ঘরে চলে এসেছে I দীপার ঘরটা দক্ষিণ মুখী I রাস্তার দিকে বিশাল বারান্দা I দীপা চা নিয়ে বারান্দায় বসে রইল অনেক্ষণ Iরাত গভীর হলে ওদের পাড়াটা যেন জেগে ওঠে I খুব বিরক্ত লাগছে আজ I একটু নিরিবিলি একা একা থাকতে ইচ্ছা করছে I অথচ বাইরে যেন আসর বসেছে I ধুর ছাই Iএই পুরনো ঢাকায় আর থাকতে ইচ্ছা করে না I মনে হয় গ্রামে চলে যাই I দীপা অনেকক্ষণ রেলিঙে ভর করে দাঁড়িয়ে রইলো I ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে I হঠাৎ করেই ভোঁ ভোঁ শব্দে খেয়াল হল ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলো I স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল ওর I
দীপা কোনমতে ফোনটা ধরে বলল
হ্যালো
দীপা
হু
ঘুম আসছেনা
দিপার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল i ইচ্ছে হলো বলতে যে ঘুম আসছে তো আমি কি করবো ? মনে হয় আমার খুব ঘুম আসছে ? কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না I বরং বলল
ঘুম না আসলে তুমি কি করো ?
গান শুনি
তাহলে শোনো গান I কে নিষেধ করেছে ?
তুমি না শোনালে কি করে শুনবো ? তুমি তো জানো তোমার গান না শুনলে আমার ঘুম আসেনা I
দীপার ভীষণ রকম কান্না পাচ্ছে I মুখে হাত দিয়ে ও ডুকরে কেঁদে উঠল I
কি হলো ? কাঁদছো কেন ?
দীপা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো
কোথায় কাঁদছি ?
এইতো চোখ মুছলে
দীপা অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকালো I তারপর বলল
তুমি কি করে জানলে ?
এখন আবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন ?
তুমি কোথায় নিষণ ?
নিষণ কিছুক্ষণ চুপ রইল I তারপর আস্তে আস্তে বলল
তোমাদের বাসার নিচে
দীপা আঁতকে উঠল
এই এত রাত্রে তুমি এখানে কি করছ ?
আমাকে কি এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখবে ?
এই রাত দুইটার সময় আমি তোমাকে উপরে কি করে নেব ? সবাই উঠে পরবে I
দীপা প্লিজ I তোমাদের বাসার নিছে অনেক বড় বড় কুকুর I আমি কুকুর ভীষণ ভয় পাই I
দীপা খিল খিল করে হেসে উঠল I তারপর হাসতে হাসতেই বললো
তুমি কুকুর ভয় পাও ? আমার নিজেরই তো তিনটা কুকুর I ওরা অবশ্য এখন ঘুমাচ্ছে I
ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি I
না দাঁড়াও I ডান দিকে চেয়ে দেখো একটা পেঁচানো লোহার সিঁড়ি আছে ওটা দিয়ে ছাদে উঠে যাও I আমি আসছি I
দীপাদের বাড়ির এই অংশটা বেশ পুরনো আমলের I তিনতলা এই বাড়িটার বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি I পুরনো হবার কারনে এখানে কোন লিফট নেই I দীপার বাবা এখানেই থাকতে পছন্দ করেন I এর কারণ হলো তার বড় চাচা এখানে থাকেন I বড় চাচার কোন ছেলে নেই I বড় চাচা তৌহিদকে নিজের সন্তানের চাইতেও বেশি ভালোবাসেন I তার এক মেয়ে বিদেশে অন্য দুই মেয়ে পাশে আরেকটা ফ্ল্যাটে থাকেন I তিনি নিজে পক্ষাঘাতগ্রস্ত I সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারেন না I তাই তৌহিদ সপরিবারে উনার সঙ্গেই আছেন বহুবছর I
ছাদে উঠে নিষণ অবাক হলো I এইরকম পুরোনো দিনের ছাদ ও কখনো দেখেনি I একপাশে বিশাল কবুতরের খাঁচা I অন্যদিকে ফলের বাগান I পেয়ারা ডালিম আম থেকে শুরু করে অনেক ধরনের ফলই আছে I একপাশে কিছু ফুলের গাছ ও দেখা যাচ্ছে I দীপা ছাদে উঠে দেখল নিষণ হাসনাহেনার ঝড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে I অন্ধকারে ওর মুখ ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না I দীপা গুটি গুটি পায়ে ওর সামনে এসে দাড়ালো I
তুমি এখানে কেন এসেছো নিষণ ?
তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম I সেদিন জবাব দাওনি I বলেছিল দেখা হলে দেবে I ওই প্রশ্নটার জবাব নিতে এসেছি
কি প্রশ্ন ?
নিষণ জবাব দিল না I ওকে চুপ করে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ পর দীপা আবারো বললো
কি হলো ,বললে না কি প্রশ্ন ?
তুমি কি আমাকে ভালোবাসো ?
এই প্রশ্ন তো ছিল না
তোমার তাহলে মনে আছে কি প্রশ্ন ছিল I তাহলে সেটারই জবাব দাও I
দীপা জবাব দিল না I মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইলো I নিষণ আর একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল
আমার সঙ্গে কথা বলবে না I রাগ করেই থাকবে ?
দীপা হঠাৎ অদ্ভুত এক কাজ করলো I নিষনের বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো I হঠাৎই ওকে এরকম কাঁদতে দেখে নিষণ একটু হকচকিয়ে গেল I দীপা তখনো কেদেই চলেছে I নিষণ বুঝতে পারছে না ও কি করবে I দীপা কাঁদতে কাঁদতেই বলল
তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছো I অনেক অনেক খারাপ ব্যবহার করেছ আমার সঙ্গে I
নিষণ আলতো করে একটা হাত রাখল দীপার পিঠে অন্য হাতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
আচ্ছা আচ্ছা শোনো I শোনো I কান্না থামাও I আমার ভুল হয়েছে I আমি ক্ষমা চাইছি I সরি I
তুমি সরি বললে এখন সব ঠিক হয়ে যাবে ?
আচ্ছা কি করতে হবে বল I তুমি যেটা বলবে সেটাই করবো
আমার সব কথা শুনতে হবে
আচ্ছা
আমার সঙ্গে আর ওইএরকম ব্যবহার করা যাবে না
ওকে ডান
আমার সঙ্গে এখন নিচে যেতে হবে
ঠিক আছে I হোয়াট ? কোথায় যেতে হবে ?
নিচে I সবাই অপেক্ষা করছে তোমাকে দেখার জন্য
মানে ?
আমি উপরে আসার আগে বাবাকে বলে এসেছি I বাবা বলেছে তোমার সঙ্গে কথা বলে তোমাকে নিচে নিয়ে যেতে
দীপা আর ইউ সিওর ? মনে হয় আমার ব্যাপারে জানলে ওনাদের ভালো লাগবেনা
সবাই তোমার ব্যাপারে জানে I চলো
দীপা এগিয়ে এসে নিষনের হাত ধরল I
গভীর রাতে ঝড় বৃষ্টির মধ্যেই গাড়িটা ওদের দুজনকে নামিয়ে দিয়েই হুস করে বেরিয়ে গেল I অনেক গা বাঁচিয়ে ভেতরে ঢুকলেও দুজনেই ভিজে গেল খানিকটাI নিষণ দীপার হাতে চাবিটা দিয়ে বলল
তুমি উপরে যাও আমি ব্যাগ গুলো নিয়ে আসছি
এইবাড়িতে আগে ও এসেছে দীপা I নিষনের ঘরে ও এসেছে আগে একবার I তবে আজ ভেতরে ঢুকে অন্য রকমের ভালো লাগলো I ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো I বেলি ফুলের সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে I দীপা বিছানায় বসলো I ক্লান্ত লাগছে খুব Iএই ভারি শাড়ি গয়না পরে থাকতে একটু ও ইচ্ছা করছে না I দীপা গয়না গুলো খুলে পাশের টেবিলে রাখল I নিষন ওর পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখল দীপা খাটে বসে আছে I ওর পরনে জমকালো শাড়ি I ওকে দেখতে সম্রাজ্ঞীর মত লাগছে I দীপা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল I সাদা পাঞ্জাবিতে নিষণকে এত সুন্দর লাগবে ভাবতে পারেনি ও I দীপাকে ওই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিষণ বলল
কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন ?
কিছু না I মাথা ধরেছে
এখন কি করতে হবে ? সারারাত ধরে তোমার মাথা টিপতে হবে ?
সে তো হবেই I বিয়ে করেছ বউয়ের জন্য কিছু করবে না ?
নিষণ এগিয়ে এসে দুই হাতে ওর মুখটা তুলে ধরে বলল
– এই কয়দিন অনেক জ্বালিয়েছ I আজকে সুদে আসলে সর উসুলু করব
নিষণ ভেবেছিল দীপা হয়ত ওর সঙ্গে ঝগড়া করবে I কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে দীপা দুই হাতে ওকে জাপ্টে ধরলো I বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে অস্ফুটে কিছু একটা বলল ,ঠিক বোঝা গেল না I ওর কান্ড দেখে নিষণ হেসে ফেললো I তারপর দুই হাতে ওকে আগলে নিয়ে মুখ নামিয়ে বলল
কি বললে ?
আজকে ওই গানটা শোনাও
কোনটা ?
সেই যেটা আমাকে শুনাতে চেয়েছিলে
আচ্ছা শোনাচ্ছি I আগে একটু ছাড়ো
না ছাড়ব না I এভাবেই শোনাও
নিষণ কিছু বলল না I হাসলে শুধু একটু I বাইরে তখনো একইভাবেই বৃষ্টি পড়ছে I চারপাশটা ভীষণ নিরব I শুধু বৃষ্টির একটানা শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি ভরাট এবং গভীর কণ্ঠস্বর I
বঁধু, কোন আলো লাগল
লাগল চোখে
লাগল চোখে
বঁধু, কোন আলো লাগল
লাগল চোখে
বঁধু, কোন আলো লাগল চোখে
বঁধু, কোন আলো লাগল চোখে
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে
বঁধু, কোন আলো লাগল চোখে
ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে
জন্ম-জনম গেল বিরহশোকে
বঁধু, কোন আলো লাগল চোখে
সমাপ্ত