সুখের খোঁজ,পর্ব -৫,০৬

0
498

#সুখের খোঁজ,পর্ব -৫,০৬
#মৌমিতা হোসেন
০৫

আসিফ ডাক্তার তৌসিফ এর মেয়েদের প্রতি এমন মনোভাব সম্পর্কে অবগতো ছিলেন না। তিনি আকবর আলি কে যেটুকু
দেখেছেন তাতে তার মনে হয়েছিলো পরিবারটা ভালো।পরে আকবর আলির কাছে ছেলের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন এর কথা শুনে প্রথমে আপত্তি জানায়। কিন্তু আকবর আলির অনুরোধে ভাবে যে,মা মরা ছেলে কোন ভালো সংসারি মেয়ে পেলে যদি আড্ডাবাজি ছেড়ে ভালো হয়ে যায় তাহলে ক্ষতি কি। আর নিতু পড়াশোনায় অমনোযোগী হলেও খুব সংসারি লক্ষি মেয়ে।এতে কোন সন্দেহ নেই।এসব ভেবে তিনি আকবর আলি আর তৌসিফ কে নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় নিতু দের বাসায় আসার প্রোগ্ৰাম করে। ওদের সাথে তৌসিফ এর দুই চাচা -চাচিও আসার সিদ্ধান্ত নেয়।

ছেলের বাড়ির লোকজন আসবে তাই সকাল থেকেই সালেহা বাজার ,রান্না,ঘর গোছানো সহ সব কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ছেলে একটু কম পড়াশোনা জানলেও নিজেদের ফ্ল্যাট, দোকান আছে।একটাই ছেলে।কোন ঝামেলা নেই।সব মিলিয়ে সালেহার বেশ পছন্দ হয়। তবুও ভাবে যদি কথা বলে ছেলেকে ভালো না লাগে তাহলে না করে দেবে।

এদিকে নিতু পড়ালেখায় আগে অমনোযোগী হলেও বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে পড়ালেখার প্রতি আগ্ৰহ বাড়ে। নিতু মনে মনে ঠিক করে পড়ালেখা করে একটা চাকরি করবে। মায়ের পাশাপাশি সেও তার উপার্জন থেকে সংসারে খরচ করবে। সেতু আর সাজিদ কে অনেক পড়ালেখা করাবে।এতে মায়ের কষ্ট একটু হলেও তো কমাতে পারবে। কিন্তু হঠাৎ করে বিয়ের প্রস্তাব আসায় মনে হচ্ছিলো ওর স্বপ্ন হয়তো আর পুরন হবে না। নিতু সব ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়।

নিতুর মা একটা জামদানী শাড়ি বের করে নিতু কে দেয় পড়ার জন্য। নিতু প্রথমে শাড়ি পড়তে না চাইলেও মায়ের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়। সবুজ রঙের লাল পাড়ের শাড়িটা নিতুর খুব পছন্দের। কিন্তু নিতু শাড়ি পড়তে পারেনা। সালেহা বেগম নিতু কে শাড়িটা খুব যত্ন করে পড়িয়ে দিয়ে একটু সাজতে বলে রান্নার কাজে চলে যান। নিতু মায়ের কথায় হালকা সাজে।চোখে কাজল, হালকা লিপস্টিক, হাতে কাঁচের চুড়ি,লম্বা চুল খোঁপা করে রাখা এই সাজেই নিতু কে দেখতে বেশ মিষ্টি লাগছিলো।কেউ এভাবে দেখতে আসছে ভেবে নিতুর কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছিলো।

এর মধ্যেই সাজিদ, সেতু দৌড়ে নিতুর রুমে এসে বলে পাত্র চলে এসেছে। সেতু বলে,’আপু ভাইয়া দেখতে বেশ সুন্দর।লম্বা,শ্যামলা একটু নায়ক নায়ক ভাব আছে। তোমার সাথে বেশ মানাবে।’

নিতু ভাই বোনের কথা শুনে একটু লজ্জা পায়। কিন্তু কিছু বলেনা।চুপ থাকে। নিতু মনে মনে দোয়া করে,যে ছেলে দেখতে যেমনি হোক না কেনো চরিত্র যেনো ভালো হয়। চরিত্র ভালো হলেই হলো।এর মাঝেই নিতুর মা আর ডাক্তার চাচার বৌ রুমে আসে নিতু কে পাত্র পক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য । সালেহা রুমে এসে মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।বলে,’মাশায়াল্লাহ আমার মেয়েটাকে একদম পরীর মতো লাগছে।’

সালেহার নিতুর বাবার কথা খুব করে মনে পড়তে থাকে।কান্না চেপে রেখে নিতু কে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসে। নিতু মাথা নিচু করেই সবাইকে উদ্দেশ্য করে আস্তে সালাম জানায়। তৌসিফ এর চাচিরা নিতুর হাত ধরে তাদের পাশে বসিয়ে বলে,’মাশাআল্লাহ মেয়েতো দেখতে ভারী মিষ্টি।কেমন আছো মা?’

‘জ্বী ভালো আছি।’

চাচির কথায় তৌসিফ চোখ তুলে নিতুর দিকে প্রথমবারের মতো তাকায়। সাধারণ সাজে নিতু কে তৌসিফ এর ভালোই লাগে। তবে আহামরি কিছু না। মোটামুটি আর কি।

আকবর আলির নিতু কে খুব পছন্দ হয়। টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করে।এরই মাঝে সালেহা নাস্তা নিয়ে আসে।বাবা না থাকা সত্ত্বেও মেয়ের বাড়ির আয়োজন দেখে তৌসিফ এর বাবা চাচারা বেশ খুশি হয়। তৌসিফ একটু এলোমেলো জীবন-যাপন করলেও বাবাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে।তাই বাবার যেখানে মেয়ে পছন্দ হয়েছে সেখানে তৌসিফ আর না করলো না।

ডাক্তার চাচা আর তৌসিফ এর ছোট চাচা বড়দের অনুমতি নিয়ে তৌসিফ কে নিতুর সাথে আলাদা করে কথা বলতে বলে। কিন্তু যেহেতু তৌসিফ এর বাবার নিতু কে পছন্দ হয়েছে তাই তৌসিফ আর নিতুর সাথে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না।আর তাই আলাদা কথা বলার ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করলো।

এদিকে নিতু প্রথমে এক পলক তৌসিফ কে দেখার পর আর চোখ তুলে তাকায়নি। তবে মনে মনে চাচ্ছিলো যেনো বিয়ের আগে একবার কথা বলার সুযোগ পায়। কিন্তু তৌসিফ যখন এই ব্যাপারে না করে দেয় তখন বেশ অবাক হয়। ভাবে সব ছেলে হয়তো এক নয়।এই ছেলে যেহেতু বাবাকে এতো মান্য করে সেক্ষেত্রে পড়ালেখা কম করলেও ছেলে নিশ্চই ভালো চরিত্রের হবে।

ছেলের বাবা,চাচাদের অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ঐ রাতেই সালেহা বেগম বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক করে ফেলে। লেনদেন এর প্রসঙ্গ আসলে আকবর আলি এক কথায় না করে দেন।তার একটাই চাওয়া আর সেটা হলো ছেলের জন্য একটা লক্ষি বৌ।যে তার ছেলেকে বাহিরের আড্ডাবাজি আর উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে ফিরিয়ে এনে সংসারি করতে পারবে। ছেলের বৌ এর কাছে থেকে এটুকুই তার চাওয়া। আকবর আলির কথা শুনে সালেহা আরো বেশি খুশি হয়।কারন এই যুগে এমন শ্বশুর পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।নিতুর মা ভাবে ছেলেরা বিয়ের আগে তো একটু এমনি হয়।এটা কোন চিন্তার বিষয় না। বিয়ে হলেই দেখা যাবে সব ঠিক হয়ে গেছে।

তৌসিফ এর বাবার কথা শুনে নিতুও মনে মনে খুশি হয়। বাবাকে খুব মনে পড়ে নিতুর।।আকবর আলি নিতুর মাথায় হাত দিয়ে বলে,’আজ থেকে আমি তোর বাবা।তাই বেয়াই এর কথা মনে করে আর কাঁদবিনা মা। আমার সংসার এর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুতি নিতে শুরু কর।’

আকবর আলি তৌসিফ কে ডেকে ছোট একটা বক্স দেয় আর বলে,’বৌ মাকে পড়িয়ে দে।’

তৌসিফ তেমন কিছু না বলে বাবার কথা মতো নিতু কে আংটি পড়িয়ে দিলো। নিতু একটু কেঁপে ওঠে তৌসিফ এর স্পর্শে। পরানোর সাথে সাথেই হাত ছেড়ে উঠে দাড়ায় চলে যাওয়ার জন্য।আসোলে এই সম্পর্কের বাঁধনে তৌসিফ জড়াতেই চাচ্ছেনা। বাইরের জগৎটাই ওর বেশ ভালো লাগে।তাই নিতু কে দেখে একটু ভালো লাগলেও ওর প্রতি তেমন কোন অনুভূতি ওর মনে আসেনি।

তৌসিফ এর হঠাৎ যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো দেখে নিতু একটু অবাক হলেও বাবার কথা শুনে নিতু আবেগি হয়ে কেঁদে দেয়। সবাইকে সালাম জানায়। অনেক রাতে সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিদায় নেয়।আর পনেরো দিন পরেই বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়।

পরদিন থেকে সালেহার বাসায় কেনাকাটার তোরজোর শুরু হয়। বেশি কিছু না পারলেও যতোটুকু সামর্থ্য আছে সেই অনুযায়ী কি কি দেবে তার লিস্ট করলো। একটা খাট আর আলমারি কিনে পাঠিয়ে দেয়। ছেলের জন্য পোশাক কিনে আর নিতুকে নিজের সোনার চুড়ি দুটো পড়িয়ে দেয়।

এই পনেরো দিনে তৌসিফ একবার এর জন্য নিতু কে ফোন দেয়নি বা দেখা করতে চায়নি।নিতু ভেবেছিলো তৌসিফ হয়তো ওকে ফোন দেবে, কথা বলবে। একটু কথা বললে অনেক কিছুই জানতে পারবে একে অপরের সম্পর্কে। তাহলে নিতু সহজেই ঐ বাড়িতে গিয়ে সবার সাথে মিশতে পারবে। কিন্তু তৌসিফ এর এমন অনাগ্ৰহ দেখে ও কিছুটা চিন্তায় পরে যায়। মনে মনে অবশ্য নিতুর তৌসিফ কে ভালো লাগে। জীবনে প্রথম কোনো ছেলের প্রতি এমন অনুভূতি আসে নিতুর মনে। তবে এই অনুভূতির নামটা ওর ঠিক জানা নেই।

অন্যদিকে তৌসিফ এর বন্ধুরা সবাই বন্ধুর বিয়ে খাবে তাই খুব হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকে। যদিও তৌসিফ খুব একটা খুশি ছিলো না।পরাধীন হতে হবে এই ভেবে বিরক্ত হচ্ছিলো।আর তাই কথা বলারও কোনো আগ্ৰহ ছিলো না। বন্ধুদের বলে,’বিয়ে মানে কি শারীরিক চাহিদা মিটবে,বাচ্চা হবে,বৌ সব সামলাবে।এইতো।এর বাইরে আর কি?’

বন্ধুরা অনেক আজেবাজে গল্প করতে থাকে। সবাই এসব শুনে একসাথে মজা নেয়।এক বন্ধু এর মাঝে বলে,’আমাদের সাথে ভাবির পরিচয় করিয়ে দিবি না?একটু দেখি আমাদের ভাবি দেখতে কেমন।’

তৌসিফ বলে,’দেখার কি আছে?কোন রাজকন্যা নয়।চলে মোটামুটি। বাবার পছন্দ। ঘরে একটা মেয়ে মানুষ লাগবে ঘর সামলাতে।এই মেয়ে এসে ঘর সামলাবে আর প্রয়োজনে প্রয়োজন মেটাবে এর বেশি আর কোন চাহিদা নেই আমার।’

বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে হাসতে থাকে তৌসিফ। বন্ধুরাও সব হো হো করে হেসে দেয়।এভাবেই পনেরো দিন পার করে তৌসিফ। নিতুর জন্য কোন কিছু কিনতেই বাবার সাথে মার্কেটেও যায়নি ও।সব কিছু ওর বাবাই পছন্দ করে কেনে।

অবশেষে বিয়ের দিন চলে আসে। যেহেতু নিতুদের অবস্থা বেশি ভালো না তাই ঘরোয়া ভাবেই বিয়ের আয়োজন করা হয়।নিতু দের পক্ষ থেকে নিকট কয়েকজন আত্মীয় আর নিতুর কয়েকজন বান্ধবী কে বলা হয়।যদিও নিতুর খালামনি ছাড়া অন্য কেউ আসে না বিয়েতে।ফুপু,চাচা সবাই উল্টো রাগ দেখিয়ে বলে যে আসবে না।তাই সালেহাও আর জোর করে না।

আর তৌসিফ পক্ষ থেকে ওর চাচারা, এলাকার কয়েকজন মুরুব্বি আর ওর বন্ধুদের বলা হয়।

বিয়ের দিন সকাল থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয় সালেহার।বাড়িতেই বিয়ের আয়োজন করা হয়।রান্নার জন্য একজন বাবুর্চি নিয়ে আসে। নিতু কে ওর দুই বান্ধবী আর সেতু মিলে একটা পার্লারে নিয়ে যায়। নিতুর অবশ্য এতো ভারী মেকআপ কখনোই পছন্দ ছিলোনা। কিন্তু সবার জোড়াজুড়িতে রাজি হয়।পাশেই একটা পার্লার থেকে সেজে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।সালেহা মেয়েকে দেখে কেঁদে দেয়।বলে,’মাশাআল্লাহ।দেখতে দেখতে কতো বড় হয়ে গিয়েছে আমার মেয়েটা। দোয়া করি যেনো সুখে সংসার করতে পারিস।তোর শ্বশুর আর তৌসিফ এর সব কথা মেনে চলবি। মনে রাখিস মা তোর বাবা নেই। নতুন সংসার তার অপরে তৌসিফ এর মা বেঁচে নেই।তাই হয়তো সব তোর মন মতো হবে না।সব হয়তো অগোছালো পাবি।সব গুছিয়ে সুন্দর মতো সংসার করবি। আমার বিশ্বাস তুই কখনো এমন কিছু করবিনা যাতে আমি ওনাদের কাছে ছোট হই। মেয়েদের অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়।এটাই নিয়ম হয়ে এসেছে। আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছিস।’

‘আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো। আরেকটা কথা বিয়ের পর যদি তৌসিফ চায় তাহলে পড়ালেখা চালিয়ে যাবি নাহলে সংসার ধর্ম পালন করবি। এক্ষেত্রে এখন আর আমার কিছু করার নেই রে।’

নিতু মায়ের কথায় মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বুকের ভেতর কেমন যেনো খালি খালি লাগতে থাকে। ভাবতে থাকে মেয়েদের জীবনটা সত্যি বড়ই অদ্ভুত। এতো বছরের আপন মানুষদের ছেড়ে আজ অপরিচিত একজনের সাথে তার বাড়ি চলে যেতে হবে।তাদের সবাইকে আপন করে নিতে হবে।চাইলেও আর আগের মতো মায়ের কাছে থাকতে পারবেনা। বাবার কথা খুব মনে পড়তে থাকে….

চলবে ‌……

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৬)
#মৌমিতা হোসেন

মায়ের সাথে কথা বলার মাঝেই সেতু, সাজিদ ও দৌড়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,’আপা তুমি কি শ্বশুর বাড়ি গিয়ে আমাদের ভুলে যাবে?’

নিতু ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বলে,’তোদের ভুলে যাবো কীভাবে রে। তোদের আমি অনেক ভালবাসি। প্রতিদিন ফোনে কথা বলবো আমরা।আর যখনই সুযোগ পাবো দেখা করতে চলে আসবো।’

দুজন মিলে একটা হাসি দেয় ।যদিও নিতুর ভেতরটা অস্থিরতায় ভরপুর থাকে। তবে ওদের সেটা বুঝতে দেয়না। মুখে একটা হাসি দিয়ে ওদের জরিয়ে ধরে।এর মাঝে বরপক্ষ চলে আসে। নিতুর খালামনি তাড়াতাড়ি এসে খবরটা দেয়। সাথে সাথে সেতু সাজিদ বোন কে ছেড়ে দৌড়ে গেটের কাছে চলে যায়।সেতুর মা,খালাও যায়। তৌসিফ কে শেরওয়ানীতে বেশ ভালো লাগছিলো। সবাই মিলে গেইট ধরে। পাঁচ হাজার টাকা দিলেই বরসহ সবাইকে ভেতরে ঢুকিয়ে বসতে দেয়।এর মধ্যে কাজী সাহেব চলে আসেন। বিয়ে পড়ানো হয়। তৌসিফ কে কবুল বলতে বললে সাথে সাথেই বলে দেয়।

নিতু ভেতরেই থাকে। ওকে কবুল বলতে বললে কিছুক্ষণ চুপ থাকে।ও কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। ভালো খারাপ মিলিয়ে এক মিশ্র অনুভূতি ওকে ঘিরে ধরে। সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে এই ভেবে কষ্ট পায়। আবার তৌসিফ কে এই কয়দিনেই মনে মনে পছন্দ করে ফেলেছে তাই ভালোও লাগছিলো। অবশেষে সবার বারবার বলায় কবুল বলে। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে মোনাজাত ধরে। মিষ্টি মুখ করে।কবুল বলার পরে নিতু কে এনে তৌসিফ এর পাশে বসানো হয়‌।

তৌসিফ এর বন্ধুরা নিতু কে দেখেই বিভিন্ন মজা করতে থাকে। তৌসিফ চোখ তুলে দেখে নিতু কে।বেশ ভালো লাগছিলো নিতু কে। আর অন্যদিকে নিতু ভয়ে,লজ্জায় তৌসিফ এর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলোনা। খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ হলে আসে বিদায় পর্ব।

প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনেই এই দিনটায় এক ভিন্ন ধরনের আবেগ কাজ করে। নতুন একজন জীবনসঙ্গী পায় যার সাথে তাকে জীবনের বাকিটা সময় কাটাতে হবে। সুখের দুখের সঙ্গী হিসেবে সবসময় পাশে থাকবে।তার অধিকার ঐ নারীর ওপর থাকবে সবচেয়ে বেশি। নতুন পরিবার, নতুন মানুষ, নতুন নিয়ম এক কথায় সব কিছুই নতুন।এই নতুন এর মাঝে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। তাদের সবাইকে আপন করে নিতে হবে। অন্যদিকে জন্ম থেকে এই পর্যন্ত যারা ভালোবেসে লালন পালন করে বড় করেছে,এতো দিনের আপনজন তাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ।এই কবুল শব্দটা বলার সাথে সাথে তার ওপর এতো দিনের প্রিয় মানুষ গুলোর অধিকার কমে যাবে অনেক টাই। নিতু ভাবতে থাকে কি এক অদ্ভুত নিয়ম।

নিতুর মা আকবর আলি কে বলে,”বেয়াই সাহেব আজ থেকে আমার মেয়েকে আপনাদের হাতে তুলে দিলাম।ওর বাবা নেই। আপনি আজ থেকে ওর বাবা। মেয়েটা আমার সহজ সরল।কোন ভুল করলে ওকে বুঝিয়ে বলবেন।”

“অবশ্যই বেয়ান। এটাও কি বলতে হবে? আমার কোন মেয়ে নেই।আজ থেকে নিতু আমার মেয়ে। ইনশাআল্লাহ ও আমাদের পরিবারে ভালো থাকবে।চিন্তা করবেন না।”এ কথা বলে আকবর আলির কেঁদে দেয়।

সালেহা তৌসিফ এর হাতে নিতুর হাত দিয়ে কাঁদতে থাকে।এতো দিনের আদরের মেয়ে যখন অন্যের হাতে তুলে দিতে হয় তখন কোন মা কি না কেঁদে থাকতে পারে? তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে শুধু বলে,”বাবা আমার মেয়টার দিকে খেয়াল রেখো।আজ থেকে ও তোমার আমানত।”

নিতু তৌসিফ এর হাত ছেড়ে মাকে ধরে কাঁদতে থাকে। সাজিদ,সেতুও কাঁদে। অবশেষে বিদায় পর্ব শেষ করে সবাই মিলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নিতু গাড়িতে উঠে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরে।ঘুমের মাঝে কখন যে তৌসিফ এর কাঁধে মাথা রাখে সেটা আর নিতু টের পায়না।

এদিকে নিতুর এতো কান্না, বিয়ের এতো নিয়ম, সবার এতো কথায় তৌসিফ খানিকটা বিরক্ত হয়। অবশেষে জ্যাম পাড়ি দিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তৌসিফ রা ওদের বাসায় এসে পৌঁছায়। ‌তখনই তৌসিফ এর ডাকে নিতুর ঘুম ভাঙে। নিতু ঘুম ভাঙতেই নিজের অবস্থান দেখে খানিকটা বিব্রতবোধ করে। বুঝতে পারে যে গন্তব্যে চলে এসেছে।চাচি শ্বাশুড়ি নামতে বললে নিতু আস্তে করে গাড়ি থেকে নামে। পুরোনো তিনতলা বাড়ি। একটু ঘিঞ্জি এড়িয়া। সামনে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ অপেক্ষা না করে বাড়ির ভেতর ঢুকে পরেছে। একটু অবাক হয় তৌসিফ এর এমন আচরণে।এই মানুষটার ভরসাতেই তো সবাইকে ছেড়ে নিতু এই বাড়িতে এসেছে।

যাক এর মধ্যে সুন্দর মিষ্টি চেহারার তিনজন মেয়ের ডাকে নিতু ওদের দিকে তাকায়। তিনজনই ওকে ভাবী ডাকে। মনে মনে ভাবে যে ওরা হয়তো কোন আত্মীয় হবে। ওদের হাত ধরে নিতু বাড়িতে প্রবেশ করে।দোতলায় নিতু কে তৌসিফ এর রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।খাটে বসার পর নিতু ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করলো। রুমটা খুব বড় না হলেও মোটামুটি সাইজের। রুমে আসবাব বলতে ওদের বাড়ি থেকে দেয়া খাট, আলমারি, পুরোনো ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা টেবিল আর চেয়ার আর পুরোনো একটা ওয়াড্রব।ওয়ালে একটা ছবি টাঙানো।খাটে বসে ভালো ভাবে বোঝা যাচ্ছেনা।

মেয়েগুলোর মধ্যে একজন বললো,”ভাবি আমি বিথি,আর ওরা হলো সাদিয়া আর জুঁই। আমি আর সাদিয়া দুজন বোন। আমি ক্লাস নাইনে পড়ি আর সাদিয়া টেন এ পড়ে।আমরা তোমার ছোট চাচা শ্বশুর এর মেয়ে।আর জুঁই আপু অনার্সে পড়ে।আপুর এক বড় ভাই আছে তপু ভাই।তপু ভাই আর তৌসিফ ভাই একই বয়সের। তপু ভাই পড়ালেখা শেষ করে এখন চাকরি খুঁজছে।।ওরা বড় চাচার ছেলে-মেয়ে।”

বিথিকে থামিয়ে দিয়ে জুঁই বলে ,”এবার চুপ কর বিথি। সারাদিন ভাবির ওপর অনেক ধকল গেছে।রেস্ট নিতে দে।তোর অতিরিক্ত বকবক বন্ধ কর।”

জুঁই এবার নিতু কে বলে,”ভাবি তুমি কিছু মনে করোনা।বিথি এমনি। বেশি কথা বলে। তুমি বয়সে আমার ছোট হলেও বড় ভাইয়ের বৌ তাই ভাবি ডাকতে হবে তোমাকে। তবে আমরা কিন্তু সবাই তোমাকে তুমি করেই বলবো।”

নিতুর কাছে এই তিন বোনকেই বেশ ভালো লাগে।কথা শুনেই বুঝলো এরা বেশ মিশুকে। নিতু হাসি দিয়ে বলে,”কোন সমস্যা নেই আপু আমাকে আপনারা তুমি করেই বলবেন।”

এর মধ্যে দুই চাচি রুমে আসে।বড় চাচি বলে,”এই তোরা সব বের হ রুম থেকে। মেয়েটাকে একটু রেস্ট নিতে দে।আর নিতু কিছু প্রয়োজন হলে আমাদের বলো। আমি ওপরে থাকি আর ছোট নিচ তলায় থাকে।এই বাসায় শুধু ভাই আর তৌসিফ থাকে।মা ছাড়া সংসার তাই একটু এলোমেলো।আস্তে ধীরে তুমি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিও।”

এই কথা বলে রুমে কিছু খাবার,পানি রেখে মেয়েদের নিয়ে সবাই বের হয়ে যায়। নিতু মনে মনে শান্তি অনুভব করে।কারন বাসার প্রায় সব মানুষকেই নিতুর ভালো লাগে।মা, সাজিদ, সেতুকে মিস করে নিতু।সেতুর পড়শু পরীক্ষা নাহলে ও আসতো নিতুর সাথে। হঠাৎ বেল এর শব্দে তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে বেল বাজছে।রাত বারোটা কখন বেজে গেছে টের পায়নি নিতু। হঠাৎ ভাবনায় এলো যেই মানুষটার জন্য ও আজ এই বাড়িতে এসেছে সেই মানুষটিকে এই তিন ঘন্টায় একবার ও রুমে আসেনি।ওর খোঁজ খবর নেয়নি। একটু খারাপ লাগে নিতুর।কেমন এক ভিন্ন অনুভূতি,ভয়,শঙ্কা সব মিলিয়ে অপেক্ষায় থাকে নিতু।

ভাবনার মাঝেই ক্লান্ত নিতু কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। হঠাৎ কোমরে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙে নিতুর।বেশ ভয় পায়।হাত সরাতে নিলে আরো শক্ত করে চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,”এতো ছটফট করছো কেনো? আমি তৌসিফ তোমার বিয়ে করা স্বামী।বাসর রাতটা ঠিক মতো পালন করতে দাও।”

নিতু থমকে যায়।ভয় পায় আর কিছুটা বিরক্ত হয়।।যেই মানুষটার সাথে এখন পর্যন্ত কোন কথাই হয়নি, শুধু দেখেছে।তার পছন্দ,অপছন্দ, ভালোলাগা সম্পর্কে কিছুই জানেনা, এমনকি কবুল বলার পর থেকেও এ পর্যন্ত কোন কথা বলেনি বা সামনেও আসেনি সেই মানুষটা হঠাৎ এভাবে এসে জড়িয়ে ধরার মানে কি? নিতুর বান্ধবীদের কারোর এখনো বিয়ে হয়নি।আর বেশি লাজুক হওয়ায় এসব ব্যাপারে কারো সাথে কখনো কথাও হয়নি।আর কি বা বয়স হয়েছে নিতুর।মাত্র সতেরো পেরিয়ে আঠারোতে পা রেখেছে।বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এতো কম বয়সে নিতু কে কখনোই বিয়ে দিতো না।যাই হোক এসব কারনে নিতুর এসব ব্যাপারে জ্ঞান অনেক কম।

এসব ভাবনার মাঝেই তৌসিফ নিতু কে ওর দিকে ফিরিয়ে আরো কাছে টেনে নেয়। তৌসিফ এর স্পর্শ নিতুর একটুও ভালো লাগছিলো না। আতিক ভাই যখন নিতু কে ছুঁয়ে দিয়েছিলো তখনও নিতুর এমনি ভালো লাগেনি। নিতু বাধা দিতে গেলে তৌসিফ রেগে গিয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে।জোর করেই অধিকার খাটায় নিতুর ওপর। তবে সেটা শুধুই শারীরিক অধিকার। এখানে মনের কোন মিলন ছিলোনা। তৌসিফ এর কামড়ে, আঁচড়ে নিতুর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। নিতু কষ্টে,ব্যাথায় কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পরে। তৌসিফ ওর কাজ শেষ করে ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরে।

ভোরে পাখির ডাকে নিতুর ঘুম ভাঙে।চোখ মেলে পাশে তাকাতেই তৌসিফ কে দেখতে পায়। গভীর ঘুমে নিমজ্জিত তৌসিফ কে দেখলে মনে হচ্ছে কতোটা নিষ্পাপ ও। হঠাৎ নিতুর রাতের কথা মনে পড়ে যায়। উঠতে গিয়ে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে উঠতে। শরীরে এক টুকরো কাপড় নেই।চুড়ি ভেঙে হাত কেটে গেছে। বিছানায় রক্তের দাগ।কোন রকম শাড়িটা বুকের কাছে ধরে নামতে গিয়ে দেখে হাঁটতে পারছে না। কিন্তু কেনো?এর কারনটাও বুঝতে পারছেনা। এলোমেলো পায়ে হেঁটে অনেক কষ্ট করে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়েই নিচে বসে কান্না শুরু করে নিতু। খুব কষ্ট হয় নিতুর।আয়নায় নিজের শরীরের এতো দাগ,রক্ত দেখে নিজেকে নোংরা মনে হয়। মায়ের কথা খুব করে মনে পড়ে।

অনেক সময় ধরে গোসল করে বের হয়ে দেখে তৌসিফ তখনও ঘুমাচ্ছে।ও আস্তে করে শাড়ি বের করে কোনরকম পড়ে। চুপচাপ বসে থাকে চেয়ারটাতে।কি করবে বুঝতে পারছিলো না।এর মধ্যে তৌসিফ এর ঘুম ভাঙলে নিতু কে দেখে রাতের কথা মনে পড়ে। তবে ওর মাঝে কোন অনুতপ্ততা কাজ করেনা।আড়মোড় ভেঙে নামতে গিয়ে বিছানায় রক্তের দাগ দেখে হাসি দিয়ে মনে মনে বলে,”আমি তাহলে সলিড জিনিস পেয়েছি।”

নিতু টেবিলের পাশেই জানালার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তৌসিফ নিতুর শরীর ঘেসে দাড়াতেই নিতু ভয় পায়।সরে যেতে চাইলে তৌসিফ আবারো নিতু কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ এনে মৃদু স্বরে বলে, “আমি ওয়াশরুম থেকে বের হবার আগে চাদরটা পাল্টে ফেলো।আলমারিতে চাদর আছে।আর হ্যা এরপর থেকে এতো ছটফট করবে না। সমানতালে সাড়া দিলে তোমারো ভালো লাগবে। নতুবা কষ্ট পাবে।”কথাগুলো বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে ওয়াসরুমে চলে গেলো তৌসিফ।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here