সুখের খোঁজে,পর্ব -১১,১২

0
625

#সুখের খোঁজে,পর্ব -১১,১২
#মৌমিতা হোসেন
১১

নিতুর এমন আচরণে তৌসিফ প্রচন্ড বিরক্ত হয়।ভাবে সব সময় এমন করার মানে কি?আজ নিতু কে একটা শিক্ষা দেবেই।এর মধ্যেই নিতু বের হলে গিয়ে ওর সামনে পথ আটকে দাঁড়ায়। নিতু দুর্বল চোখে তাকায় তৌসিফ এর দিকে। তখনি ওর কাঁধে শক্ত করে ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,”সমস্যা কি তোমার? এভাবে চলে যাওয়ার মানে কি?”

নিতু নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”আমার ভালো লাগছিলো না।বমি পাচ্ছিলো।তাই…”

নিতু কে আর বলতে দেয়না তৌসিফ। রেগে চিৎকার করে বলে,”মানে কি?যখনি তোর কাছে আসি তখনই বলিস তোর ভালো লাগছে না। তোর তরফ থেকে তেমন আগ্ৰহ আমি দেখিনা কেনো?বিয়ে করে বৌ করে নিয়ে এসেছি তোকে।যখন চাইবো তখন আসবি।অন্য পুরুষ দেখলেই তো মুখে হাসি ফোঁটে।আর আমার সাথে থাকলে তোর বমি পায়?”গাল চেপে ধরে বলতে থাকে তৌসিফ।

নিতু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তৌসিফ এর দিকে। কি বলছে এসব !!খুব কাদে,খুব বিরক্ত হয় আজ তৌসিফ এর কথায়।গাল থেকে হাত সরিয়ে রেগে গিয়ে নিতুও আজ বলে ফেলে,”বিয়ে করেছেন তো? তাতে কি হয়েছে? কতোটুকু চেনেন আপনি আমাকে?কি জানেন আমার সম্পর্কে?আর কয়দিন পার হলেই আমাদের বিয়ের এক মাস হবে।এর মধ্যে আমার সাথে একদিন ও দশ মিনিট বসে কথা বলেছেন? জানতে চেয়েছেন আমার কি পছন্দ,কি অপছন্দ? নাকি আপনার সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ দিয়েছেন? আমি এই বাড়িতে এসেছি আপনার ভরসায়। কখনো আমারও যে কিছু দরকার হতে পারে সেসব বিষয়ে জানতে চেয়েছেন?আপনি সারাদিন বাইরে ঘুরে যখন মন চায় তখন বাড়ি ফেরেন।আর এসেই শুরু করেন…… “নিতু কাঁদতে থাকে আর বলতে পারে না।

তৌসিফ নিতুর এতো রাগ দেখে ওর কথা শুনে ঝটকা খায়।চুপ করে শুনতে থাকে ওর কথা।কি উত্তর দেবে বুঝতে পারেনা।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিতু আবার বলে,”যখন আপনার প্রয়োজন হয় তখন কাছে টেনে নিয়ে আবার পরক্ষনেই ছুড়ে ফেলেন। বিবাহিত জীবন বুঝি এমন হয়?এমন হলে এই জীবন আমার একটুও পছন্দ না। আমার ভালো লাগে না।মা বলেছিলো সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনার মন মতো চললেই নাকি আপনিও আমাকে ভালোবাসবেন। কিন্তু মা ভুল বলেছিলো। আপনি তেমন মানুষ নন। খুব জঘন্য আপনি। আমাকে পছন্দ না হলে আপনি কেনো বিয়ে করতে গেলেন? শুধু….. শুধু ঐ সব কাজ করার জন্য?”

কাঁদতে কাঁদতে আবার বলে,”আর আজতো এমন নোংরা ভাষা শোনালেন …..
আপনি আসোলেই একটা খারাপ মানুষ। খুব খারাপ মানুষ।”

“আমি… আমি থাকবো না আপনার সাথে।আর থাকবো না। আমি মায়ের কাছে যাবো। আমাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসুন। দয়া করে…… আমাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসুন।”হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে নিতু ধীর পায়ে হেঁটে বাড়ান্দা পর্যন্ত যেতেই জ্ঞান হারায়।

তৌসিফ নিতুর সব কথা চুপচাপ শুনছিলো।কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। প্রথমে একটু রাগ হলেও পরে নিতুর কান্না দেখে, কথা শুনে ওর কেনো জানি খুব কষ্ট হতে থাকে।নিতু ঠিকই তো বলেছে এতো দিনের মধ্যে নিতুর সাথে কখনো ও বসে একটু গল্প করেনি, কখনো ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করেনি। কখনো বেড়াতেও নিয়ে যায়নি।নিতুর কোন বিষয়েই তৌসিফ এর জানা নেই। আবার এটাও ঠিক যে নিতু কে দেখলেই ওর কেমন অস্থির লাগতে থাকে।আর যখনি ওকে কাছে টেনে নেয় তখনি আবার নিমিষেই অস্থিরতা কমে যায়।এটার ঠিক কি নাম দেয়া যায় সেটা তৌসিফ জানে না। শুধু বুঝতে পারছে এই কদিনেই এই মেয়েটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে।আগেও অনেক মেয়েদের দেখে ভালো লেগেছে, অনেকে ওর পেছনে ও ঘুরেছে কিন্তু নিতুর জন্য ওর যেমনটা লাগে অন্য কারো জন্য এমন অনুভূতি কখনো আসেনি।

এসব ভাবনার মাঝেই নিতু কে পরে যেতে দেখলে তৌসিফ দৌড়ে গিয়ে নিতু কে ধরে। ওকে কোলে করে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়। এতোক্ষণে তৌসিফ খেয়াল করলো জ্বরে নিতুর শরীর পুরে যাচ্ছে। তৌসিফ এর কেমন যেনো অপরাধবোধ হতে থাকে। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম থেকে মগে করে পানি এনে জলপট্টি দিতে নেয়। কিন্তু রুমাল কোথায় পাবে? কোথায় কি আছে তার কোন কিছুই তো তৌসিফ জানে না। অবশেষে ওর নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে জলপট্টি দেয়। কিন্তু জ্বর না কমায় ভয় পেয়ে ওর বাবাকে ডাকে। আকবর আলি বৌ এর প্রতি তৌসিফ এর টান দেখে বেশ খুশী হয়।ঔষধ বের করে খাইয়ে দিতে বলে। কিন্তু নিতু তো বেহুঁশ।তাই অনেক সময় ধরে মাথায় জলপট্টি দেয়। খুব পরখ করে নিতু কে দেখে। অনেকটা সময় ধরে দেখে। দেখতে দেখতে তৌসিফ নিজেও ঘুমিয়ে পরে।

খুব ভোরে নিতুর ঘুম ভাঙে। তাকিয়ে দেখে তৌসিফ বসে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।আর ওর কোলে নিতুর মাথা। নিতু তাড়াতাড়ি উঠতে গেলে দেখে মাথাটা বার হয়ে আছে। মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে। নিতুর উঠে যাওয়ায় তৌসিফ এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। বিছানা থেকে নামতে নিলে নিতুর হাত ধরে তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,”উঠে যাচ্ছো কেনো? তোমার শরীর খারাপ। শুয়ে থাকো।এখন কেমন লাগছে? মাথা ব্যাথা কমেছে?”

নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে কোন উত্তর না দিয়েই নিতু ধীরপায়ে ঢুলতে ঢুলতে হেঁটে ওয়াসরুমে চলে যায়। তৌসিফ সাহায্য করতে চাইলে নিতু বাধা দেয়।তাই আর জোর করেনা। অপেক্ষা করে নিতুর।

নিতু ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। তৌসিফ ডাকলে শুধু বলে,”নাস্তা খেতে আসুন।”

ভীতু নিতুর এমন মলিন চেহারা দেখে তৌসিফ এর বুকের ভেতর কেমন জানি চাঁপা কষ্ট অনুভূত হয়। তৌসিফ মনে মনে ভাবে নিতুর সাথে কথা বলে স্বাভাবিক হবে।এই ভেবে নাস্তার টেবিলে যায়। কিন্তু গিয়ে ওর বাবার কথা শুনে চমকে যায়।

আকবর আলি বলে,”তৌসিফ বাবা বৌমা আজ মায়ের বাড়িতে যাবে। থাকবে এক মাস।ওর শরীর ভালো না। একটু রেস্ট নিলেই ভালো লাগবে।আর এখানে থাকলে বৌমার রেস্ট হবে না।তাই আর কি। এখন বলো তুমি দিয়ে আসবে নাকি আমি ব্যবস্থা করবো পাঠানোর?”

আসোলে নিতু খাবার রেডি করে শ্বশুর কে ডাকতে যায়। তখন সুযোগ বুঝে বলে যে কিছু দিন মায়ের কাছে থাকতে চায়। মাকে খুব মিস করছে।আকবর আলি বুঝতে পারে যে হয়তো দুজনের মধ্যে কোন সমস্যা হয়েছে। তাছাড়া অনেক দিন হয়েছে নিতু মায়ের কাছে যায়না তাই আর না করেনি। শুধু বলেছে,”যেতে চেয়েছিস যখন যা মা তবে তাড়াতাড়ি চলে আসিস।এই বুড়ো বাবা কিন্তু এখন তোর উপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।আর জানিস তো আমার ছেলেটা একটু রাগী, সংসারেও অমনোযোগী।এতো দিনেও একদিন দোকানে বসাতে পারিনি। তবে ওর মনটা খারাপ না।কাল রাতে তোর জ্বরের সময় ওর অস্থিরতা আমি দেখেছি।এই অমনোযোগী ছেলেটাই সারারাত জেগে তোর মাথায় জলপট্টি দিয়েছে।দেখে খুব ভালো লেগেছে। আমি বুঝেছি যে আমার ছেলেকে একমাত্র তুই ঠিক রাখতে পারবি।তাই রাগ করে বেশি দিন থাকিস না।”

নিতু শুনে বেশ অবাক হয়।মন খারাপ কিছুটা কমলেও ঠিক করে মায়ের কাছে যাবে আর কিছুদিন থেকেই আসবে। নিতু শ্বশুর কে বলে,”না বাবা বেশি দিন থাকবো না। তাড়াতাড়ি চলে আসবো।”বলে দুজন নাস্তার টেবিলে আসে।আর তখনই তৌসিফ নাস্তা খেতে আসলে আকবর আলি ছেলেকে এই কথা বলে।

এতোক্ষণ যেনো তৌসিফ এক ধ্যানের মধ্যে ছিলো। এভাবে হঠাৎ করে বাবার বাড়ি যাওয়ার মানে কি? তবে যেতে যখন চাচ্ছে তখন এবার আর মানা করা যাবেনা।তাই বললো,”হ্যা বাবা আমি দিয়ে আসবো। তুমি কোন চিন্তা করোনা।”

তৌসিফ ভাবে ওর কথা শুনে নিতু খুশি হবে। কিন্তু নিতু চুপচাপ ওর কাজ করে যাচ্ছে। নাস্তা শেষ হলে সব গুছিয়ে রওনা দেবে তখন তৌসিফ বলে,”আমার এলোমেলো আচরণের জন্য দুঃখিত। বলছি কি তোমার মায়ের কাছে আজ না গেলে হয়না?”

তৌসিফ আরো কিছু বলবে তার আগেই নিতু কেঁদে দেয় আর বলে,”আমাকে যেতে দিন। আমি আপনার কাছে থাকবো না। মায়ের কাছে একটু যেতে চাই। অনেক দিন মাকে দেখিনা। আমার কিছু ভালো লাগছেনা”

তৌসিফ নিতুর কথা শুনে আর কিছু বলতে পারেনা।রেডি হয়ে নিতু কে নিয়ে রওনা দেয়। দুজন পুরোটা পথ কেউ কারো সাথে কোনো কথাই বলেনি। তৌসিফ দু একবার নিতুর দিকে তাকালেও নিতু পুরো সময় বাহিরে তাকিয়ে ছিলো।

সালেহা বেগম বসে সেলাই করছিলেন।এমন সময় কলিংবেল এর আওয়াজ শুনে এসে দরজা খুলে মেয়ে আর জামাই কে দেখে অবাক হয়। এভাবে হঠাৎ কিছু না জানিয়ে আসায় একটু খটকা লাগে।কারন কাল দুপুরেও যখন কথা হয় তখন বলছিলো বেয়াই অসুস্থ। হঠাৎ ওনাকে ফেলে চলে আসার মেয়ে নিতু না। নিতু মাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। তৌসিফ সালাম জানায়।

সালেহা বলে,”কি ব্যাপার এভাবে হঠাৎ তোমরা? মানে কোন সমস্যা হয়নি তো?”

তৌসিফ সাথে সাথে বলে,”না মা আসোলে নিতুর শরীর ,মন একটু খারাপ। অনেক দিন আপনাদের দেখে না। বাবাও বললো আর ও নিজেও আসতে চাচ্ছিলো তাই বেড়াতে নিয়ে আসলাম। কিছু দিন বেড়ালে ভালো লাগবে ওর।”

সালেহা সবটা শুনে খুশি হলো। দুজনকেই বসতে বলে তাড়াতাড়ি সরবত বানিয়ে নিয়ে আসলো। তৌসিফ কে রুমে যেয়ে ফ্রেশ হতে বললে তৌসিফ বলে,”না মা আমি এখন চলে যাবো। একটু কাজ আছে। আমি নিতু কে রেখে যেতে এসেছিলাম। নিতু তো থাকবেই কিছুদিন।এর মাঝেই আবার আসবো ইনশাআল্লাহ।”

“ওমা এটা কোন কথা হলো? এতো দিন পর এসে খালি মুখে চলে যাবে?না না বাবা বসো। অন্ততঃ এক কাপ চা হলেও খাও।”সালেহা কথাটা বলেই আবার রান্নাঘরে পা বাড়ালো।
নিতু ও মায়ের পেছনে পেছনে চলে যায়।

তৌসিফ বসে বসে সাজিদ আর সেতুর সাথে গল্প করতে থাকে।এর মধ্যেই সালেহা জামাই এর জন্য চা , নাস্তা নিয়ে আসে। তৌসিফ চা খেয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর নিতুর কাছে আসে। কিন্তু সবার সামনে কি বলবে চিন্তায় পরে যায়। সালেহা মেয়ে জামাইয়ের জড়তা বুঝতে পেরে সাজিদ, সেতুকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। নিতুও পেছন পেছন চলে যেতে নিলে তৌসিফ হাত ধরে দাঁড়াতে বলে। নিতু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

তৌসিফ বলে,”যখন তোমার যেতে মন চাইবে তখন আমাকে ফোন দিও আমি এসে নিয়ে যাবো। তোমার মোবাইলে মিস কল দিয়েছি একটু আগে। ওটা আমার নাম্বার।সেইভ করে রেখো।আর ……আর রাতের ব্যবহার এর জন্য সরি।”

কথাগুলো বলেই হাত ছেড়ে চলে যায় তৌসিফ। নিতু খানিক অবাক হয়। এতো দিনে এই প্রথম এতো নমনীয় হয়ে কথা বললো ও।তারপর আবার ভাবে যাই বলুক না কেনো এসেছে যখন তখন কিছু দিন থেকে তারপর যাবে।রোজ রোজ ওসব কাজ নিতুর ভালো লাগে না। এবার গেলে আবার কবে আসতে পারবে তার ঠিক আছে?আর বাবাতো বললই এক মাস থাকবে তাই চিন্তা নেই।এর মাঝেই মোবাইলে রিং হলে দেখে নতুন একটা নাম্বার দিয়ে ফোন এসেছে। নিতু বুঝতে পারে এটাই হয়তো তৌসিফ এর নাম্বার।তাই ইচ্ছা করে রিসিভ না করে কল কেটে দেয়।

চলবে…..

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -১২)
#মৌমিতা হোসেন

তৌসিফ রিকশায় উঠে ইচ্ছে করেই ফোন দিয়েছিলো। দেখতে চেয়েছিলো নিতু ফোন ধরে কিনা। কিন্তু নিতুর ফোন কেটে দেয়ায় তৌসিফ একটু মেজাজ খারাপ করে। মোবাইলটা পকেটে রেখে দেয়।বাসস্ট্যান্ড এ গিয়েই বাস পেয়ে যায়। বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

নিতু মোবাইল নিয়ে রুমে এসে কাপড় বের করে ফ্রেশ হতে চলে যায়। নাম্বারটা ইচ্ছে করেই সেইভ করেনা।ফ্রেশ হয়ে এসে সাজিদ আর সেতুর সাথে গল্প জুড়ে দেয়। সালেহা এতো দিন পর মেয়েকে পেয়ে মেয়ের পছন্দের খাবার রান্না করে । সবাই একসাথে খায়। তবে জ্বর থাকায় নিতু তেমন খেতে পারেনা। বিকেলে আবার জ্বর আসলে সালেহা মাথায় পানি ঢেলে ঔষধ খাইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।নিতু অনেক দিন পর মায়ের ভালোবাসা পেয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হয়। ঘুম থেকে উঠে দেখে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।জ্বর একটু কমেছে তাই একটু সুস্থ বোধ হচ্ছিলো। সাজিদ, সেতু পড়াশোনা করছে তাই ওদের কাছে না বসে মায়ের রুমে যায়।আসার পর থেকে মায়ের সাথে তেমন কথা হয়নি নিতুর।

এদিকে রাস্তায় অনেক যানজট থাকায় তৌসিফ এর বাড়ি ফিরতে প্রায় দু ঘন্টার বেশি সময় লাগে। নিতু কে রেখে আসতে ওর কেমন জানি লাগছিলো।কেমন এক অস্থিরতা, আশেপাশের সবকিছু বিরক্ত লাগছিলো।ভাবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলে হয়তো ভালো লাগবে।তাই বন্ধুদের কাছে যায়।দুপুরেও কিছু খায়নি।অনবরত সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে একের পর এক।বন্ধুরাও খেয়াল করে তৌসিফ কোন কারনে বিরক্ত।কারন জানতে চাইলে আরো বিরক্ত হয়ে সন্ধ্যার পরপরই বাড়ি চলে আসে ।এই সময়ে আকবর আলি ছেলেকে বাসায় দেখে অবাক হয়ে যায়। তৌসিফ কে উদ্দেশ্য করে বলে,”আজ এই সময়ে তুই বাসায়? শরীর খারাপ করেছে নাকি তোর?এমন দেখাচ্ছে কেনো তোকে?”

তৌসিফ বাবার এতো প্রশ্নে একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়,”উফ্ বাবা একসাথে কতো প্রশ্ন করো? কিছু হয়নি। এমনি ভালো লাগছে না তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। দেরিতে এলেও রাগ করো।আর আজ তাড়াতাড়ি এসেছি এতেও এতো প্রশ্ন।”

আকবর আলি কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। তবে আজ ছেলের বিরক্তি,রাগ দেখে মন খারাপ করেনি।বেশ ভালোই লাগছে।মন মনে বললো,”নিতু কে মায়ের কাছে পাঠিয়ে মনে হচ্ছে ভালোই করেছি।”

মৃদু হেসে তৌসিফ কে বলে,”যাক এসেছিস ভালো হয়েছে। আজ তো আর নিতু বাসায় নেই যে খেতে দেরি করবি আর গরম করে বসে থাকবে তোর জন্য। খাবার রাহেলা টেবিলে রেখে গেছে। সময়মতো খেয়ে নিস। আমি একটু দোকানে যাচ্ছি।”

তৌসিফ কোন উত্তর না দিয়ে ওর রুমে চলে যায়। নিতুকে ছাড়া পুরো বাসাটা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।ফ্রেশ হতে যাবে কিন্তু আজ ওর কাপড় , তোয়ালে কিছুই বের করা নেই। এই কদিন প্রতিদিন তৌসিফ বাসায় ফিরলে নিতু সব এগিয়ে দিয়েছে।তাই সব কিছুতে অনেকটাই নিতুর ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। কোথায় কি আছে জানতে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইল বের করতেই মেজাজটা যেনো আরো খারাপ হয়।সেই আসার পর থেকে একবার ও ফোন দিলো না মেয়েটা।তাই রেগে মোবাইল বিছানায় ছুড়ে মারে।ফোন দিতে গিয়েও আর ফোন দেয়না।নিজেই খুঁজতে গিয়ে সব এলোমেলো করে ফেলে। অবশেষে ড্রয়ার থেকে কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। সারাদিন না খাওয়ায় প্রচন্ড ক্ষুধা পায় তৌসিফ এর ।তাই টেবিলে গিয়ে খেতে বসে।গতো কিছুদিন ধরে প্রতিদিন খাওয়ার সময় নিতু সামনে বসে সব এগিয়ে দিয়েছে।কোন কথা না বললেও চুপচাপ বসে থেকেছে।আজ একা একা খেতেও বিরক্ত লাগছে তৌসিফ এর। তাছাড়া আজ খাবার বিস্বাদ লাগছে।এই কদিনেই নিতুর হাতের রান্না খেয়ে আকবর আলি আর তৌসিফ দু’জনই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।তাই ক্ষুধা থাকলেও অল্প খেয়েই উঠে পরে।গলা থেকে যেনো খাবার নামছিলো না আজ।

নিতু মায়ের রুমে গেলে সালেহা মেয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর আছে কিনা।জিজ্ঞেস কর,”এখন কেমন লাগছে মা? কীভাবে জ্বর বাধালি?”

“জানিনা মা।জ্বর আসতে কি কোন কারন লাগে?আর এখন বেশ ভালো লাগছে।জ্বর নেই।”

“আমিতো দুপুরে তোর জ্বর দেখে চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম।তোর শ্বশুর ফোন করেছিলো ।তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো।তোর জ্বর শুনে খুব চিন্তায় পরে গেলো। কথা হয়েছে ওনার সাথে?”

“না ,মা।আসার পর থেকে কথা হয়নি। দেখি ফোন দেবো এখন।আসোলে বাবা আমাকে বেশ স্নেহ করেন।ঔষধ খেয়েছে কিনা সেটাও মনে করিয়ে দিতে হবে।”

সালেহা শ্বশুর বাড়ির প্রতি মেয়ের এমন টান দেখে বেশ খুশী হয়। তৌসিফ এর সাথে কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে নিতু প্রসঙ্গ এড়িয়ে রুমে চলে যায়। মোবাইল নিয়ে শ্বশুর কে ফোন দেয়।বেশ কিছু সময় কথা বলে রেখে দেয়। সবাই একসাথে খেয়ে শুয়ে পরে।আজ দুই ভাই বোন নিতুর সাথে ঘুমাবে বায়না ধরে। নিতু অনেক মজার গল্প বলে দুই ভাই বোন কে ঘুম পারিয়ে দেয়। কিন্তু আজ ওর চোখে কিছুতেই ঘুম ধরা দিচ্ছেনা।তাই বারান্দায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ তৌসিফ এর চিন্তা মাথায় ভর করে।খেয়েছে কিনা,কাপড় খুঁজে পেয়েছে কিনা। তৌসিফ এর অনেক কিছুই ওর অপছন্দ। তারপরেও এতো দিনে একটা মায়া তো তৈরি হয়েছে।আর সকালে বাবার কাছে যখন শুনেছে যে রাতে ওর জ্বর দেখে কতোটা অস্থির হয়েছে তৌসিফ তখন থেকে একটু হলেও মনটা ভালো হয়েছে নিতুর। মোবাইল হাতে নেয় কিন্তু দেখে যে তৌসিফ এর কোন ফোন আসেনি।তাই আবার মন খারাপ করে মোবাইল রেখে আকাশ দেখতে থাকে। পাখিটাকেও খুব মিস করে। ওকে দেখলেই খুব সুন্দর করে নিতু নিতু ডাকে।

তৌসিফ বাবার সাথে নিতুকে কথা বলতে দেখে অথচ নিতু তৌসিফ কে এই পর্যন্ত ফোন দিয়ে একবার খবর নেয় না।এসব ভেবে অভিমান হয় ওর। বারান্দায় বসে সিগারেট খেতে থাকে। টিয়া পাখি আজ নিতু নিতু ডেকেই যাচ্ছে।পাখির ছটফট দেখে মনে হচ্ছে আজ ওর মতো পাখিটাও নিতু কে খুব মিস করছে। কয়েকবার ফোন করতে নিয়েও আবার থেমে যায়।একা আকাশের তারা দেখতে থাকে। চোখে শুধু নিতুর ভীতু চেহারা,ছোট ছোট বোকামি গুলো ভাসছে। খুব মনে পরছে খুব।এই একদিনেই এতো অস্থিরতা কি মনের টান নাকি প্রতিদিনের মতো নিতু কে কাছে একান্ত নিজের করে পাওয়ার বাসনা। সেটা তৌসিফ কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। ক্লান্ত লাগছে খুব। কিন্তু বিছানায় যেতে ইচ্ছে করছে না কিছুতেই। নিতু কে জরিয়ে ধরে ঘুমানো যেনো অভ্যাস হয়ে গেছে। নিচে বসে একের পর এক সিগারেট খেতেই থাকে।এক পর্যায়ে রুমে এসে ঘুমিয়ে পরে।

সকালেও ঘুম থেকে উঠে নিতু শ্বশুর কে ফোন করে ঔষধ,নাস্তার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়।ইচ্ছা থাকলেও তৌসিফ এর কথা কিছু জিজ্ঞেস করেনা। নাস্তা শেষ করে ওর পড়ার টেবিলের সামনে বসে বইগুলো দেখতে থাকে। পড়ার প্রতি কোন কালেই কোন আগ্ৰহ না থাকলেও বাবা মারা যাওয়ার পর ভেবেছিলো পড়াশোনা করে চাকরি করবে। মাকে সাহায্য করবে।ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব ও নিজেও কিছুটা নেবে। কিন্তু হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এসবের কিছুই হলোনা। মেয়েদের জীবনটা কেমন জানি। ইচ্ছা থাকলেও সব মেয়েরা বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে পারে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মা একা কতো কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছে সেটা দেখে মন খারাপ করে।

মায়ের কাছে গিয়ে কাজে সাহায্য করতে নেয়।জ্বর না থাকায় আজ বেশ ভালো লাগছে। তবুও সালেহা কাজ করতে দেয়না।বলে,”শ্বশুর বাড়িতে তো করিস এখানে কিছু করতে হবে না। তাছাড়া এসেছিস রেস্ট নিতে রেস্ট নে।এসব টুকটাক কাজ আমি একাই শেষ করতে পারবো।”

একটু থেমে আবার বলে,”নিতু মা জামাই এর সাথে কথা হয়েছে? তোদের সম্পর্ক ঠিক হয়েছে তো?”

নিতু কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”হুম সব ঠিক আছে মা।কোন সমস্যা নেই।”

নিতু ভাবে কবে এই সমস্যার সমাধান হবে সেটা একমাত্র আল্লাহ জানে।এতো এতো বদঅভ্যাস এই লোকের।এতো সহজে ভালো হবার নয়। কিন্তু মাকে বলে কোন লাভ হবেনা।উল্টো ওকেই মানিয়ে নিতে বলবে।তাই এসব ব্যাপারে কিছু বলেনা। না চাইতেও তৌসিফ নাস্তা করেছে কিনা,কি করছে এসব ভাবনা মাথায় বারবার উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু খবর নিতে ইচ্ছে হয়না।

তৌসিফ ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় তোয়ালে,কাপড় সামনে না পেয়ে জোরে জোরে নিতু কে ডাকে।গত কিছুদিন ধরে তৌসিফ এর বলার আগেই ওর প্রয়োজনীয় সব কিছু নিতু ওর সামনে রেডি করে রেখেছিলো।আজও ঘুম থেকে উঠে সবকিছু সামনে না পেয়ে তাই চিৎকার করে নিতু কে ডাকছিলো। নিতু যে বাসায় নেই সেটা ওর মনেই ছিলোনা।ওর চিৎকার শুনে তখনি রাহেলা দৌড়ে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,কি হইছে ভাইজান?চিল্লান কেন?”

রাহেলাকে দেখে তৌসিফ বলে,”তুমি কেন এসেছো? নিতু কোথায়?”

“বৌ মনিরে তো কাইল আফনে মায়ের বাড়ি দিয়া আইলেন।এর মধ্যেই ভুইলা গেছেন?”

রাহেলার কথায় তৌসিফ এর খেয়ালে আসে আর আবারো মনটা বিষন্ন হয়ে যায়।আস্তে করে বলে,”হুম ,মনে পড়েছে।ঘুম থেকে উঠলাম তো তাই মাথায় ছিলোনা।যাক তুমি নাস্তা রেডি করো আমি বাইরে যাবো।”তৌসিফ ফ্রেশ হতে চলে যায়।

রাহেলার ওর কাজে চলে যায়। নাস্তা রেডি করে দেয়। তৌসিফ নাস্তা শেষ করে ওর মতো বাইরে চলে যায়। বন্ধুদের সাথে দেখা করে আর কিছুক্ষণ পরপর মোবাইল দেখে যে নিতুর ফোন এসেছে কিনা। কিন্তু না প্রত্যাশিত ফোন আসেনা। বন্ধুরা জানতে চায় কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। তৌসিফ কিছু বলেনা এড়িয়ে যায়।যদিও ওদের পাঁচজনের গ্ৰুপের সবাই ভবঘুরে তবে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সবার সাথে সবার আত্মার সম্পর্ক। তৌসিফ এর আর ভালো লাগছিলো না তাই ঘন্টা দুয়েক থেকে বাসায় চলে আসে।

নিতু একবার রাহেলাকে ফোন করে বাসার কাজের তদারকি করে।না চাইতেও দায়িত্ববোধ মনের ভেতর বারবার তাগাদা দিচ্ছে এসব করার জন্য। তবে কেনো জানি তৌসিফ এর কাছে ফোন দিতে ইচ্ছে হয়না।আর তৌসিফ গতো কালকের পর থেকে আর ফোন দেয়না তাই নিতুরও ইচ্ছা হয়না।ভাবে,”অন্যায় যেহেতু তৌসিফ করেছে সেহেতু ফোন তৌসিফ আগে করবে আমি কেনো করবো?”

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here