সুখের খোঁজে,পর্ব -১৩,১৪

0
383

#সুখের খোঁজে,পর্ব -১৩,১৪
#মৌমিতা হোসেন
১৩

তৌসিফ বাসায় এসেই দেখে সব এলোমেলো।এসব এলোমেলো অবশ্য ও নিজেই করে গেছে। ভেজা তোয়ালে বিছানায়, নোংরা কাপড় নিচে পরে আছে।এসব দেখে খুব বিরক্ত হয় ও।আগেও অবশ্য এমনি থাকতো। রাহেলা ওর সময়মতো কখনো গুছিয়ে দিতো আবার কখনো এলোমেলোই থাকতো।নিতু আসার পর থেকে সব গোছানো থাকতো তাই অল্প দিনেই এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।আজ তাই সব এমন অবস্থায় দেখে আবার মেজাজ বিগড়ে যায়। রাহেলাকে চিৎকার করে ডাকে।রাহেলার বিরক্ত হয়ে দৌড়ে আসে।বলে,”কি হইছে?আইজ সকাল থেইক্কা চিল্লাইতাছেন কেন?আমারে দৌড়ের ওপর রাখতাছেন।”

তৌসিফ এর মেজাজ আরো খারাপ হয়।বলে,”আমার ঘর এর এই অবস্থা কেনো?গুছিয়ে রাখতে পারো না?”

রাহেলা উত্তর দেয়,”ওমা আমার আর কাম নাই?আইজ বৌমনি বাসায় নাই।সব কাম একলা একলা করন লাগতেছে।বৌ মনি থাকলে হে নিজেই অর্ধেক কাম কইরা ফালায়।আর আপনের এইসব কাম কি আমি করি?এইগুলাতো বৌমনি করে।আমারে এগুলা ধরতে দেয়না।তাই এই রুমেও আসি নাই আর দেখিও নাই।তাই এগুলা গুছানো হয়নাই।”

“আপনে তাড়াতাড়ি বৌমনিরে নিয়া আইসেন।ওনারে ছাড়া কাম করতেও ভালো লাগতাছে না। খুব লক্ষি আমাগো বৌ মনি।”

তৌসিফ শুনে আর কিছু বলেনা। চুপ করে বাড়ান্দায় চলে যায়। ওকে দেখেই পাখিটা আবার ছটফট করতে থাকে আর জোরে জোরে নিতু কে ডাকতে থাকে। কর্নারে কয়েকটা ফুল গাছ এনে লাগিয়েছিলো নিতু। কবে কে এনে দিয়েছে এসবের কিছুই জানেনা তৌসিফ। তবে নিতুকে প্রতিদিন এগুলোতে পানি দিতে দেখতো।কাঠগোলাপ ,বেলি,জবায় বেশ কদিন ধরেই ফুল ফুটছিলো।ভালোই লাগতো।আজ খেয়াল করলো মাত্র দুই দিন পানি না দেয়ায় গাছগুলোকে কেমন জানি শুকনো মনে হচ্ছে। মাটি শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেনো জানি তৌসিফ এর গাছগুলোতে পানি দিতে ইচ্ছে হয়না।ভাবে ,”আরেকটু দেখি কি হয় গাছ এর অবস্থা।গাছ এর মতো আমার হৃদয়টাও তো শুকিয়ে যাচ্ছে। হৃদয়টা তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠছে কাউকে দেখার জন্য,কারো কন্ঠ শোনার জন্য, কারো নরম হাতের ছোঁয়া পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেতো আমাকে এই দুই দিনে একবারের জন্যও মনে করলো না। আমি কি এতোটাই খারাপ? এতোটাই জঘন্য?”

আর ভালো লাগে না ভাবতে । রুমে এসে মোবাইলে একবার নিতুর নাম্বার বের করে। আবার পাশে রেখে দিয়ে বিছানায় ক্লান্ত,বিষন্ন শরীরটা এলিয়ে দেয়।চোখ বন্ধ করতেই নিতুর চেহারা ভাসতে থাকে। ভালো লাগে না কিছু। সারাদিন আর বাইরে বের হয়না তৌসিফ। দুপুরে খায়ওনা। বসে,শুয়ে, আকাশ দেখেই সারাটা দিন পার করে।শেষ বিকেলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে।

দুপুরে আকবর আলি বাসায় খেতে আসলে যখন শোনে তৌসিফ বাসায় তখন প্রথমে একটু অবাক হয়।পরে বুঝতে পারে ছেলের সমস্যা কোথায়।আকবর আলিও কয়েকবার খেতে ডাকে ছেলেকে। কিন্তু তৌসিফ বলে ,”ক্ষুধা নেই আমি খাবো না এখন। তুমি খাও।”

আকবর আলি ইচ্ছা করেই কয়েকবার নিতু কে নিয়ে বিভিন্ন কথা বলে।ওর প্রশংসা করে।ছেলে চাইলেও যেনো বৌমাকে না ভুলতে পারে এটাই ছিলো ওনার উদ্দেশ্য। কিন্তু নিতু কে যে তৌসিফ ভুলতেই চায়না এটা এখনো ওর বাবা বুঝতে পারেনা।আকবর আলি ওনার কাজে চলে যায়।

নিতু সারাটা দিনে অনেক বার বাসার সবার কথা, পাখি, গাছের কথা মনে করেছে। সারাদিনে একবার ও তৌসিফ ওর খবর নেয়নি তাই না চাইতেও মন খারাপ হয়েছে। নাম্বার টা সেইভ করেনা।ভাবে ,” কখনো যদি তৌসিফ আমাকে মন থেকে ভালোবাসে তাহলে সেদিন নাহয় নাম্বার টা সেইভ করবো।”দ্বিতীয় রাতটাও ছটফট করেই কাটে নিতুর। মানুষটার এতো এতো খারাপ অভ্যাস যা নিতুর একেবারেই পছন্দ না। তবুও ওর জন্য নিতুর অস্থিরতা ওর মনে ঠিক কীসের সংকেত দিচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে না নিতু।

তৌসিফ ও বিকেলে অল্প সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলো।সন্ধ্যার পর হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই নিতুর কথা খুব মনে পড়তে থাকে।বাইরেও যেতে ইচ্ছে হয়না। জানালার পাশে বসে আকাশ দেখে।মা মারা যাওয়ার পর থেকে যখনি খুব একা লাগতো এই জানালার কাছে এসে অথবা বাড়ান্দায় বসে আকাশ দেখে মনটা ভালো করতো তৌসিফ।আজ ও একই কাজ করে আর এর সাথে সঙ্গি হয় সিগারেট। এটা অনেক আগে থেকেই তৌসিফ কে মানসিক শান্তি দিয়ে আসছে।মন খারাপের সাথি হলো এই সিগারেট এর ধোঁয়া।

নিতুর বলা কথাগুলো খুব করে হৃদয়ে আঘাত করতে থাকে ওর।নিজের কাজের জন্য নিজের ওপর খুব রাগ হয়। সত্যি তো মাস প্রায় শেষ হতে চলেছে ওদের বিয়ের।অথচ এতো দিনেও নিতুর ব্যাপারে ও তেমন কিছুই জানেনা। কখনো জানতেও চায়নি ওর পছন্দ অপছন্দ।সব দ্বিধা ফেলে ঠিক করে নিতু কে ফোন দেবে।ওর সাথে কথা না বললে যে মনটা শান্ত হবে না এটা বুঝতে পেরেছে তৌসিফ।তাই মোবাইল বের করে ফোন দেয়। নিতু তখনই পাশের বাড়ির আন্টির সাথে দেখা করতে যায় ওর মায়ের সাথে। মোবাইল বাসায় সাইলেন্ট করে রেখে যায়।যার কারনে ও আর টের পায়না।আর তাই তৌসিফ এর ফোনটাও রিসিভ করতে পারে না।

এদিকে কয়েকবার ফোন করার পরেও নিতু রিসিভ না করায় আবার খুব রেগে যায় তৌসিফ। মোবাইল ছুঁড়ে মারে।একাই বলে,”এতো কীসের দেমাগ?আমিতো আগে ফোন দিলাম তবুও রিসিভ করো না।শেষ পর্যন্ত এই দুই দিন আগে আসা মেয়েটার জন্য আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।অসহ্যকর।”
একা একা বিরবির করে কথাগুলো বলতে থাকে আর টেবিলের ওপর রাখা গ্লাসটাও ছুড়ে মারে।আর ভালো লাগে না তৌসিফ এর।

নিতু বাসায় এসে মোবাইল নেয় শ্বশুর আব্বাকে ফোন করবে বলে। মোবাইল নিয়েই দেখে তৌসিফ এর অনেক গুলো মিসকল উঠে আছে।দেখে একটু চিন্তায় পরে যায়।এই শক্ত মানুষ হঠাৎ ওর মোবাইলে এতো গুলো কল দিয়েছে নিশ্চই কোন ঝামেলা হয়েছে।তাই তাড়াতাড়ি ফোন দেয়।বেশ কয়েকবার রিং হয় কিন্তু রিসিভ হয়না দেখে চিন্তায় পরে যায় নিতু। কিছু একটা ভেবে শ্বশুর কে ফোন দেয়। তিনি রিসিভ করতেই সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,”বাবা বাসার সব ঠিক আছে তো? আপনার শরীর ভালো?”

আকবর আলি একটু অবাক হয় নিতুর কথায়।বলে,”হ্যা মা সব ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসেছি। এখনো খাওয়া হয়নি। কিন্তু কেনো কি হয়েছে।তুই এতো চিন্তিত কেনো?”

কি বলবে ভেবে পায়না। নিতু দ্বিধা করতে করতে বলে,”না মানে উনি ফোন দিয়েছিলো আমাকে। মোবাইল বাসায় রেখে আমি একটু মায়ের সাথে পাশের বাসায় গিয়েছিলাম তাই ফোন রিসিভ করতে পারিনি। একটু আগে বাসায় এসে দেখি অনেকগুলো মিস কল উঠে আছে।দেখে আমিও ফোন দিলাম কিন্তু উনি ফোন রিসিভ করেননি। ভাবলাম আপনার শরীর খারাপ করেছে কিনা তাই আবার আপনার মোবাইলে ফোন দিলাম।”

আকবর আলি সব শুনে নিতু কে বলে,”আমি তো একটু আগেই বাসায় এসেছি। তৌসিফ এর সাথে এখনো দেখা হয়নি। তবে ও আজ সারাদিন বাসাতেই ছিলো।কোন কারনে হয়তো মন খারাপ।তুই ফোনটা রাখ আমি দেখি ছেলেটা কি করছে।”

“ঠিক আছে বাবা আপনি একটু দেখে আমাকে জানাবেন। আমি রাখছি এখন।”

আকবর আলি মোবাইল হাতে আস্তে হেঁটে ছেলের রুমে যায়। দরজা খোলাই ছিলো। রুমে ঢুকে লাইট অন করতেই দেখে গ্লাস এর ভাঙ্গা টুকরো ফ্লোরে পরে আছে। রুমের কোথাও তৌসিফ নেই। হেঁটে বাড়ান্দায় গিয়ে দেখে নিচে বসে আছে।কেমন বিদ্ধস্ত চেহারা। হাতে সিগারেট জ্বলছে।আকবর আলি ছেলেকে দেখে দ্রুত এসে ওর মাথায় হাত দেয়। তৌসিফ বাবাকে দেখেই সিগারেট ফেলে দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”বাবা কিছু বলবে?কখন এসেছো তুমি?”

আকবর আলি দেখতে পায় ছেলের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।খারাপ লাগে ছেলের এমন বিষন্ন চেহারা দেখে।বলে,”কিরে বাবা কি হয়েছে তোর? এখানে এভাবে বসে আছিস কেনো?”

“কিছু হয়নি বাবা। ভালো লাগছেনা তাই এখানে বসে আছি।”

আকবর আলি বলে,”নিতু ফোন দিয়েছিলো। তোকে খুঁজছে।ওর মোবাইল সাইলেন্ট এ ছিলো তাই রিসিভ করতে পারেনি চিন্তা করছে মেয়েটা তোর জন্য। ওকে একটু ফোন দে। কথা বলে খেতে আয়।দুই বাপ ছেলে আজ একসাথে খাই।”

তৌসিফ এর মনটা বিষন্নতায় ভরা থাকলেও নিতু ফোন দিয়েছে, খবর নিচ্ছে শুনে ভালো লাগে ।তাই খুশি হয়ে বলে ,”ঠিক আছে বাবা তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি আসছি।”

তৌসিফ নিতুর ফোন রিসিভ না করতে পারার কারন জানতে পারায় স্বস্তি পায়।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মোবাইল অফ হয়ে আছে। মোবাইল অন করে। কিন্তু চার্জ নেই তাই ফোন করতে পারেনা। মোবাইল চার্জে দিয়ে খেতে যায়।

এদিকে আকবর আলি নিতু কে ফোন করে সবটা বলে।আর এও বলে যে, তৌসিফ নিজেই ফোন করবে ফ্রি হয়ে। নিতু যেনো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সবটা শুনে নিতুর ভালো লাগে। মনে মনে ভাবে,সেদিনের পর থেকে তৌসিফ কে একটু অন্যরকম লাগছে।কে জানে কি হয়েছে।সাজিদ,সেতুর ডাকে ধ্যান ভাঙে নিতুর। মোবাইল রেখে ও নিজেও খেতে যায়। খাওয়া শেষ করে গল্প করছিলো এর মাঝেই ফোন আসে তৌসিফ এর।

নিতু দ্বিধা করতে করতে ফোন রিসিভ করে। প্রথমে নিতুই বলে,”হ্যালো”

তৌসিফ চুপ করে শোনে নিতুর কথা। মনে হচ্ছে বহুযুগ পরে শুনছে কারো কাঁপা কন্ঠ।

ওপাশ থেকে কোন উত্তর না আসায় নিতু আবার হ্যালো বলতেই তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,”কেমন আছো?”

তৌসিফ এর এতো নরম কন্ঠ বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত নিতু শুনতে পায়নি।তাই অবাক হয়। ভালো লাগে খুব। পরমুহূর্তেই ভাবে যে না নরম হওয়া যাবে না।তাই স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেবার চেষ্টা করে।বলে,”ভালো আছি। আপনি?”

“হুম ভালো। তুমি কবে আসবে?”

নিতু উত্তর দেয় ,”জানিনা। ”

তৌসিফ একটু রেগে যায়।বলে,”জানিনা মানে কি? আমার সমস্যা হচ্ছে। বাবার সমস্যা হচ্ছে। তুমি চলে আসো।কাল আমি তোমাকে নিতে আসবো।রেডি থেকো।”

নিতু আবার তৌসিফ এর কথা শুনে বিরক্ত হয়। ইচ্ছে না করলেও না চাইতেও সাহস করে বলে ,”আসবো কিনা সেটা জানি না। আপনার জীবনে আমার আদৌ কোন ভূমিকা আছে ওসব ছাড়া?কেনো আসবো আমি বলুন?কোন কিছু করেন আপনি? সারাক্ষন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া হলো আপনার কাজ।এমন একজন কি আমার ভরন পোষণের দায়িত্ব নিতে পারবে?আর যদি বলেন সংসার এর কাজ সে তো একজন বুয়াও করতে পারবে। এজন্য আমি না আসলেও চলবে।”

এতো কঠিন ছেলেটা আজ এতো নরম নিতুর এসব কঠিন সত্যি কথা যেনো কোনভাবেই মানতে পারছিলো না । ভেতরটা কেমন যেনো চাপা কষ্ট হতে থাকে। নিতুর বলা প্রতিটা কথা সত্যি।তাই আর কোন কথা না বলে ফোনটা রেখে দেয়।ভাঙা মন নিয়ে বিছানায় ফোনটা ফেলে রেখে বাড়ান্দায় চলে যায়।আজ ঘোর অমাবস্যা।পুরো আকাশ অন্ধকার। যেমনটা আজ তৌসিফ এর মনটা অন্ধকার হয়ে আছে। রাতটা নির্ঘুম কাটে তৌসিফ এর।

নিতু কথা গুলো বলার পর ভাবে যে না বললেও হতো এতো কথা। আবার রেগে গিয়ে কি করতে কি করবে।সাহস করে কেনো যে বলতে গেলো।ওর নিজের ও ভালো লাগছেনা কিছুই।মাকে এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি।বলে হয়তোবা লাভও হবে না।আর ভেতরে ভেতরে ও নিজেও হয়তো এই অতি অপছন্দের মানুষটাকে পছন্দ করা শুরু করেছে। শুধু তৌসিফ কে নয় ঐ বাড়ির সবাইকে।সব মিলিয়ে ভালো লাগে না নিতুর।ভাবনায় আসে সামনে সুখের খোঁজ পাবে তো কখনো?

চলবে……

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -১৪)
#মৌমিতা হোসেন

কথা শেষ হবার আগেই কিছু না বলে,রাগ না দেখিয়ে মোবাইল রেখে দেয়ায় নিতুর চিন্তা হয়। তৌসিফ এর নিরবতা ওকে খুব করে ভাবায়। ভালো লাগে না কিছু।বেশ কিছু সময় একা একা বসে থাকে। নিতু এতোক্ষণ বারান্দায় বসে কথা বলছিলো। ঘরে এসে দেখে সাজিদ , সেতু ঘুমিয়ে পড়েছে।একবার ভেবেছিলো তৌসিফ কে আবার ফোন দেবে পরে আবার ভাবে ফোন করে কি বলবে। ওদের মধ্যে একে অপরের সাথে বলার মতো তেমন কোন কথাই তো নেই।আছে শুধু নিরবতা।যা নিতুর কাছে অসহনীয় লাগছে।তাই নিতু মোবাইল রেখে শুয়ে পরে ।

এদিকে নিতুর কথা শুনে তৌসিফ কি বলবে ভেবে পায়না। খারাপ লাগে। নিতুর সব কথাই ঠিক। কিন্তু ওর কাছে সত্যি এসবের উত্তর নেই। খুব করে ভাবে তৌসিফ।একা একাই বিরবির করে বলে,”দোকানের দায়িত্ব,নিতুর দায়িত্ব এতো এতো দায়িত্ব আমি নিতে পারবো না। বিয়ে করেছি এইতো বেশি।এর বেশি কিছু আমাকে দিয়ে হবে না। আমার স্বাধীন জীবনে কারো হস্তক্ষেপ আমি মেনে নেবো না। কিন্তু অল্প কিছু দিন আগে আসা মেয়েটার মধ্যে কেমন যেনো এক যাদু আছে। ওকে দেখলেই ভেতরে যেই অনুভূতি হয়,ওর অনুপস্থিতি আমাকে যেমনটা কষ্ট দিচ্ছে এসবের কারন আমার জানা নেই।যাক এতো ভাবার দরকার নেই আর। আমি আমার মতোই থাকবো।ভুল কথা বলেছিলাম ,সরিও বলেছিলাম আর কি করার আছে আমার?”

তৌসিফ মোবাইল রেখে শুয়ে পরে। নিতু কে আর ফোন দেয়না।এক সপ্তাহ কেটে যায়।এই কদিনে কেউ কাউকে আর ফোন দেয়না। তৌসিফ সকাল হলেই বেরিয়ে পরতো। সারাদিন বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা,ঘুরে বেড়ানো এসবই ছিলো ওর প্রধান কাজ। ইচ্ছে করেই সারাদিন তৌসিফ ঘরে আসে না। আসলেই নিতুর কথা খুব করে মনে পড়ে।চোখ অস্থির হয়ে ওঠে ওকে দেখার জন্য।ওর কন্ঠ শোনার জন্য বন্ধুদের বিভিন্ন নাম্বার থেকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে তৌসিফ। ওপাশ থেকে নিতুর হ্যালো,হ্যালো ডাক শুনে লাইন কেটে দেয় ও।ওর কন্ঠ শোনার জন্যই যেনো ফোনটা করা হতো। তবে যতোই সারাদিন বাইরে বন্ধুদের সাথে সময় কাটাক না কেনো রাতে বাসায় ফিরলেই আবার নিতুর কথা খুব করে মনে পড়তে থাকে তৌসিফ এর। কিছুতেই যেনো শান্তি পাচ্ছিলো না। বিষয়টা বন্ধুদের নজরেও পড়েছে।তাই ওরাও ওকে খ্যাপাতে থাকে।বৌ এর প্রেমে পাগল বলতে থাকে।সব সময় অল্পতেই রাগলেও এবার কেনো জানি বন্ধুদের এসব কথায় ও আর রাগ করেনা । মনে মনে ভাবে,”সত্যি কি নিতুর প্রেমে পরে গেলাম আমি।”

এই এক সপ্তাহে নিতু একবার ও ওকে ফোন দেয়না।তাই একটু অভিমান হয় তৌসিফ এর। রহিমার হাতের রান্নাও খেতে পারেনা বিস্বাদ লাগে।তাই এই কদিনে একটু রুগ্ন হয়ে যায়।দাড়ি বড় হয়, চুলগুলো কেমন লালচে সব মিলিয়ে চেহারা কেমন যেনো দেখা যাচ্ছে।

এদিকে নিতু তৌসিফ এর কাছে ফোন না করলেও শ্বশুর এর কাছে নিয়মিত ফোন করেছে।সময়মতো ঔষধ খেয়েছে কিনা,খেয়েছে কিনা এসব খবর নিয়েছে। রাহেলা খালাকে ফোন দিয়ে রান্না সহ সব বিষয়ে তদারকি করেছে। মাঝে মাঝে তৌসিফ এর খবর নিয়েছে। তৌসিফ এর সব খবর শুনে ওর খারাপ লাগে। কিন্তু যেহেতু ওর মনের খবর নিতুর অজানা তাই ভাবে যে হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে বন্ধুদের সাথে তাই এমন করছে। তৌসিফ এর জন্য চিন্তা হলেও ফোন দিতে ইচ্ছে হয়না।ফোন করে খোঁজ নেয়ার মতো সম্পর্ক যে এখনো তৈরি হয়নি।তাই তো রাহেলা খালার কাছে খবর নিয়েই মনে মনে স্বস্তি পায় নিতু। নিতুর মা শ্বশুর বাড়ির সবাইকে নিয়ে মেয়ের এতো চিন্তার বিষয়টা খেয়াল করে। মেয়েকে রাতে রুমে ডাকে।নিতু খাওয়া শেষ হলে শ্বশুর এর সাথে কথা বলে মায়ের রুমে যায়।মায়ের পাশে বসে বলে,”বলো মা কেনো ডেকেছো? জরুরী কোন কিছু?কোনো সমস্যা?”

নিতুর মা বলে,”নারে কোন সমস্যা না। এমনি একটু কথা বলতাম তোর সাথে।আচ্ছা মা নিতু একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

নিতু বলে,”বলো মা। আমাকে কোন কথা বলতে গেলে আবার তোমার অনুমতি নিতে হবে? তুমি মা । তুমি তোমার সন্তানদের যা খুশি বলতে পারো।”

সালেহা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,”সেটা ঠিক। আমি সব বলতে পারি আমার সন্তানদের। তবে যখন ছেলে-মেয়েরা বড় হয়,তাদের বিয়ে হয় তখন অবশ্যই তাদের অনুমতি নিয়ে বলা উচিত।তখন ইচ্ছে হলেই আমরা সব বলতে পারিনা মা।”

নিতুর মাথায় এতো কিছু ঢোকেনা।তাই বলে,”মা আমি বুড়ি হয়ে গেলেও তোমার কাছে সেই ছোট নিতুই থাকবো। আমাকে কিছু বলতে হলে তোমার কখনো অনুমতি নিতে হবে না। তুমি বলো তো কি বলবে।”

সালেহা বেগম আস্তে আস্তে বলে,”ইয়ে মানে তুই বাসায় কবে যাবি?এক সপ্তাহের বেশি হয়ে গেলো এসেছিস। তৌসিফ সেই যে গেলো আর এলো না।কোন সমস্যা হয়নি তো? মায়ের মন বুঝতে পারছিস নিশ্চই।তোর বাবা থাকলে এতো চিন্তা হয়তো কখনোই হতো না।তোর ফুপিরা তো রেডি হয়ে বসে আছে কোন সমস্যা হলে কথা শোনাতে এক তিল পরিমাণ পিছ পা হবে না।তাই চিন্তা হয় তোদের নিয়ে।ভয় হয়।তোদের নিয়ে কেউ কিছু বলুক এটা আমার সহ্য হবে না।”

নিতুর প্রথমে একটু খারাপ লাগলেও ও মায়ের অস্থিরতার কারন বুঝতে পারে তাই আর মন খারাপ করে না।মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বলে,”এইতো মা ২/১দিন পরেই যাবো বাসায়। তোমাকে ছেড়ে একা এই প্রথম এতো দিন থেকেছি। শরীর ও ভালো লাগছিলো না।তাই বাবার অনুমতি নিয়েই এসেছি। তুমি এতো চিন্তা করোনা।”

“জামাই এর সাথে কথা হয়? জামাইকে ফোন করে বল কাল আসতে।”

নিতু একটু দ্বিধা করে বলে,”ঠিক আছে মা বলবো। অনেক রাত হয়েছে এখন তুমি শুয়ে পরো। আমিও ঘুমাতে যাই।”

নিতু ওর রুমে গিয়ে ভাবতে থাকে কীভাবে তৌসিফ কে আসতে বলবে।কি মনে করবে আসতে বললে।নিজ থেকে বাসায় যাওয়ার কথা বলতে চায়না ও তৌসিফ কে। তাছাড়া শেষ দিন রেগে কতো কিছুই না বলেছে ।এখনো রেগে আছে কিনা তার কোন ঠিক আছে? আবার যদি কথা শুনিয়ে দেয়?তাই ঠিক করে ফোন দেবে না।আসতেও বলবে না। সকালে মা’কে একটা কিছু বুঝিয়ে দিলেই হবে।যখন নিজ থেকে নিতে আসবে তখন নাহয় যাবে বাসায়।

তৌসিফ সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বিথি, জুঁই দের সাথে দেখা হয়। সবাই ভাইয়ের চেহারার অবস্থা দেখে কপাল কুঁচকে বলে,”ভাই ভাবী মায়ের কাছে গিয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে। তুমি দেখি এরই মধ্যে দেবদাস হয়ে গিয়েছো।একি অবস্থা করে রেখেছো নিজের?”

তৌসিফ একটু বিরক্ত হয়।বলে,”বেশি কথা না বলে সামনে থেকে সরে দাড়া।আর আমি ঠিক আছি ‌। কিসের দেবদাস?কার জন্য?”

জুঁই বলে,”ভাইয়া বলছিলাম যে ভাবীকে নিয়ে আসো না। অনেক দিন হয়েছে দেখিনা।কতো ভালো ভাবী। আমরা খুব মিস করছি ভাবীকে।আর তুমিও যে ভাবীর শোকে কাতর সেটা তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”

এবার আর রাগ করেনা তৌসিফ।বলে,”দেখি কি করি।ওর বেড়ানো শেষ হোক তারপর নাহয় নিয়ে আসবো।”

ভাইয়ের এতো ঠান্ডা উত্তর ওদের ঠিক হজম হয়না।তাই মিটমিট হাসতে হাসতে ওরা বাসায় চলে যায়।

তৌসিফ বাসায় গিয়ে দেখে বাবা সোফায় বসে আছে।ও নিজের রুমের দিকে যেতে নিলে আকবর আলি ডাক দেয় ছেলেকে।বলে,”রাত এগারোটা বাজে।এতো রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি বাবা? তুই কি কখনোই ঠিক হবিনা? ঘরমুখো হবিনা? সংসার এর দায়িত্ব কবে থেকে নিবি তুই? আমার আর ভাবতে ভালো লাগে না। তোকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি। আমি মরে গেলে তখন দোকান সামলাতে অনেক হিমশিম খেতে হবে।তাই এখনো সময় আছে আমি বেঁচে থাকতে সব বুঝে নে। আমাকে একটু শান্তি দে।এতো সুন্দর,লক্ষি একটা মেয়েকে তোর বৌ করে এনেছি।ওর জীবনটা নষ্ট হতে দিস না। সংসারে মনোযোগ দে বাবা”

বাবার কথাগুলো তৌসিফ এর বুকে বিঁধে। আজকাল সবাই শুরু করেছে কি? সবাই সুযোগ পেলেই ওকে এতো এতো কথা শোনায়। মায়ের কথা খুব মনে পরে। নিতু কেও খুব মিস করে। ওকে দেখতে মন চায়, ছুঁয়ে দিতে মন চায় কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়।এই মুহূর্তে ওর নরম তুলতুলে শরীরের মাঝে ডুব দিতে খুব ইচ্ছে করছে ওর।এই কদিনে তৌসিফ একটা ব্যাপার খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছে। সেটা হলো, নিতু কে ছাড়া ওর চলবে না।জীবনে সুন্দর করে বেঁচে থাকতে হলে নিতুকে প্রয়োজন। মা মারা যাওয়ার পর থেকে নিতুর মতো অন্য কেউ এতো যত্ন করে ওকে কখনো আগলে রাখেনি।এই অল্প কদিনেই মনে হচ্ছে মেয়েটা ওর জীবনের বড় একটা অংশ দখল করে ফেলেছে।

আজ বাবাও কতো কথা বললো। সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে পরে।ঘোর অন্ধকার। আকাশ মেঘে ঢাকা। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। উদাস মনে বসে ভাবে আর সম্ভব না। কালকেই বাবাকে বলে নিতু কে নিয়ে আসবে।

আকবর আলি ছেলেকে খেতে ডাকে। তৌসিফ বলে,”খাবো না বাবা। খিদে নেই।”

আকবর আলি বুঝতে পারে ছেলের ব্যাথা। কড়া কথা ছেলেকে বলতে তার নিজের ও খুব কষ্ট হয়। কিন্তু আর কতো?এখনো দায়িত্ব না নিলে আর কবে নেবে?তাইতো বাধ্য হয়ে আজ তৌসিফ কে এতো কথা বলে।

আকবর আলি ছেলের চেহারা দেখে মনে মনে হাসে।কারন তার এই ছেলে যে বৌ এর জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছে।তাই নিজ থেকেই বলে,”কাল বা পড়শু সময় করে নিতু কে নিয়ে আসিস।যাওয়ার আগে ফোন করে নিস।এখনি আসতে চায় কিনা। নাকি আরো কদিন বেড়াতে চায়।

তৌসিফ কথাটা শুনেই বসা থেকে উঠে বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়।বলে,”কাল যাবো তাহলে আনতে?”

তৌসিফ যেনো কারো বলার একটু অপেক্ষায় ছিলো। বাবার বলার সাথে সাথে তাই বেশ আনন্দ হতে লাগলো।আকবর আলি গিয়ে শুয়ে পরে। আর তৌসিফ অপেক্ষা করতে থাকে কখন ভোর হবে।সারারাত তৌসিফ এর আর ঘুম হয়না।এ কেমন যেনো এক অস্থিরতা, ভালো লাগা ।এটা এক নতুন অনুভূতি তৌসিফ এর জন্য। ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে আসে ওর।

টিয়া পাখিটাও যেনো আকবর আলির কথা বুঝতে পারে।আর তাই ভোর হতেই নিতু নিতু বলে ডাকা শুরু করে।পাখির এই ডাকেই তৌসিফ এরও ঘুম ভাঙে। উঠে দেখে সকাল নয়টা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বের হয়ে যায়। তৌসিফ এর তাড়াহুড়ো দেখে আকবর আলি মিটমিট হাসে। তৌসিফ গাড়িতে বসে বসে ঠিক করে এবার নিতু কে বাসায় এনে ওর সাথে অনেক গল্প করবে, ওকে বেড়াতে নিয়ে যাবে, ওকে শপিং করে দেবে। তাহলে নিশ্চই আর এতো এতো অভিযোগ থাকবে না নিতুর।আজ রাস্তায় প্রচুর যানজট।রাস্তা যেনো শেষ হচ্ছেনা। নিতু কে দেখার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছে তৌসিফ।এই অস্থিরতার নাম কি ভালোবাসা নাকি অন্য কিছু সেটা তৌসিফ এর জানা নেই।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here