সুখের খোঁজে,পর্ব -১৫,১৬

0
439

#সুখের খোঁজে,পর্ব -১৫,১৬
#মৌমিতা হোসেন
১৫

সকালে সেতু, সাজিদ স্কুলে চলে গেলে সালেহা বেগম এসে নিতু কে ঘুম থেকে ডেকে ওঠায়। ঘড়িতে তখন সকাল আটটা বাজে।এই কয়দিন সকালে উঠলেই মা জোর করে আরেকটু ঘুম পারিয়েছে। সেখানে আজ জোর করে টেনে তুলছে। রাতে দেরী করে ঘুমানোর জন্য আজ আর নিতুর ঘুম ভাঙতে চাচ্ছেনা। নিতু তাই হাই তুলতে তুলতে বলে,”মা আজ কি হয়েছে?এতো সকালে ডাকছো কেনো?আরেকটু ঘুমাই?”

“না আজ আর ঘুমাতে হবে না। বাসায় মেহমান আসবে। আমাকে আজ একটু রান্নায় সাহায্য করবি আয়। উঠে আগে ঘরটা একটু গুছিয়ে রাখ। তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে পরিপাটি হয়ে আসবি।”সালেহা বেগম কথাগুলো বলে যেতে নিলে নিতু একটু অবাক হয়। ঘড়ির দিকে তাকায়।দেখে মাত্র আটটা বাজে।

মাকে জিজ্ঞেস করে,”হঠাৎ কে আসবে মা?রাতেও তো কিছু বললেনা।”

“সময় হলেই দেখতে পাবি।তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে। এখন তাড়াতাড়ি আয়।”বলেই তাড়াহুড়ো করে হেঁটে রান্নাঘরে চলে যায় ।

সালেহা রাতে নিতু কে বললেও ওনার মনে হচ্ছিলো নিতু তৌসিফ কে ফোন দেবে না।তাই মেয়ের সংসার এর শান্তির জন্য রাতেই তিনি আকবর আলি কে ফোন দেন।আকবর আলিও তৌসিফ এর কথা সব খুলে বলেন। দু’জন বুঝতে পারে যে কিছু নিয়ে তৌসিফ আর নিতুর মাঝে হয়তো কোন ঝামেলা হয়েছে তাই সালেহা বেগম জামাই এবং বেয়ান দুজনকেই দাওয়াত করেন। কিন্তু দোকান খোলা।আরো কিছু সমস্যা থাকায় আকবর আলি বলেন যে তিনি যাবেন না। তৌসিফ কে পাঠিয়ে দেবেন।আর তখনই আকবর আলি গিয়ে তৌসিফ কে বলে নিতু কে নিয়ে আসার জন্য।

নিতু অবাক হয় মায়ের আচরণে।রাত পর্যন্ত কারো আসার কথা ছিলো না। হঠাৎ সকালে উঠে শোনে মেহমান আসবে।যাক মা যেহেতু বলেনি তার মানে বলবেও না।আজ ওদের সারপ্রাইজ দেবে।তাই নিতু আর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন অনুভব করলো না।সময় হলেই দেখতে পাবে। সাথে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ও ফেলছে।কারন মেহমান এর চিন্তায় মা তৌসিফ এর কথা ভুলে গেছে। তৌসিফ কে ফোন করতে হবে না, আসতে বলতে হবে না তাই শান্তি লাগছে। নিতু উঠে বিছানা গুছিয়ে রান্নাঘরে যায় মাকে কাজে সাহায্য করতে। গিয়ে দেখে মা বিশাল রান্নার আয়োজন করছে। মনে হচ্ছে মেয়ে জামাই আসবে। যেহেতু মা কিছু বলবে না তাই আর জানতে চাইনি নিতু। চুপচাপ কাজ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই সালেহা জোর করে নিতু কে গোসলে পাঠায়।আর গোসল করে একটা সুন্দর শাড়ি পড়তে বলে। নিতু কিছু না বলে মায়ের কথামতো চলে যায়।

রাস্তায় যানজটে বসে নিতুর কথা ভাবছে তৌসিফ।এমন সময় দেখে ফুটপাতে ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে গোলাপ বিক্রি করছে।দুজন অল্প বয়সী ছেলে-মেয়ে পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলো।দেখে বোঝা যাচ্ছে স্টুডেন্ট । ছেলেটা ছোট্ট মেয়েটার কাছ থেকে কয়েকটা গোলাপ কিনে মেয়েটাকে দেয়। মেয়েটা খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে ফুলগুলো নেয়।দৃশ্যটা তৌসিফ এর খুব ভালো লাগে। মনে মনে ঠিক করে নিতুর জন্য ফুল কিনে নেবে। পরমুহূর্তেই আবার ভাবে,ফুল নিয়ে গেলে নিতু নেবে তো?এক সময় দেখে মেয়েটা বাসের ভেতর উঠে ফুল বিক্রি করছে। তৌসিফ আর না ভেবে কয়েকটা গোলাপ কিনে নেয়। গোলাপ হাতে নিজেকে দেখতে খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো ওর।যানজট ছাড়ে তখনই মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে নেমে যায়।বাস চলতে থাকে।প্রায় দু ঘন্টা লাগে নিতুর বাসায় যেতে।বাস থেকে নেমে বাবার কথামতো মিষ্টি, কিছু ফল এগুলো কিনে নেয়। নিতুর জন্য স্পেশাল কিছু কিনতে চায় কিন্তু ও তো নিতুর পছন্দ অপছন্দ কিছুই জানে না। তাই আর কিনতে পারেনা।

বাসার সামনে এসে কেমন জানি অস্থির লাগছে আজ।আগে কখনো এমন লাগেনি তো। নিতু কে দেখবে এক সপ্তাহ পরে তাই বেশ ভালো লাগছিলো। তৌসিফ কলিং বেল চেপে দাঁড়িয়ে থাকে।

নিতু গোসল করে গোলাপী রং এর একটা শাড়ি পরে। মাত্রই গোসল করে বের হয়ে চুল মুছতে নিয়েছে।এর মধ্যেই তৌসিফ কলিং বেল বাজালে সালেহা জোরে নিতু কে ডাকে।বলে,”নিতু কে এসেছে দেখতো মা। আমি রান্না ঘরে ব্যস্ত।”

নিতু তোয়ালে হাতেই তাড়াতাড়ি দরজা খুলতে যায় আর বলে,”হ্যা মা দেখছি আমি। অস্থির হইওনা তো।”

দরজা খুলতেই তৌসিফ কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত থেকে তোয়ালে নিচে পরে যায়। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উসকোখুসকো চুল, ঘামে ভেজা শার্ট সব মিলিয়ে কেমন রুগ্ন লাগছে তৌসিফ কে। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়।এরই মধ্যে নিতুর মা শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে বলে,”কে এসেছেরে নিতু?”

নিতুর ধ্যান ভাঙে। তাড়াতাড়ি তোয়ালে ওঠায় নিচ থেকে। দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।মায়ের দিক অবাক হয়ে তাকায়। সালেহা মেয়েকে এড়িয়ে তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে,”কেমন আছো বাবা? ভেতরে আসো।”

তৌসিফ শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে সালাম দেয়।বলে,”এইতো ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তা তোমার চেহারার এই অবস্থা কেনো? শরীর খারাপ করেছে নাকি? তাড়াতাড়ি ভেতরে এসে ফ্যানের নিচে বসো।”বলেই তাড়াতাড়ি নিতু কে বলতে যাবে এরই মধ্যে দেখে নিতু জামাই এর জন্য সরবত বানাতে গেছে। সালেহা এটা দেখে বেশ খুশী হয়।

নিতু সরবত দিলে তৌসিফ খায়।আর নিতুর দিকে তাকিয়ে দেখতেই থাকে। মনে হচ্ছে অনেক দিন পর দেখছে এই তুলতুলে নরম বৌটাকে।মাত্র গোসল করে আসা গোলাপি শাড়ি পড়া তার এই বৌকে কতোই না স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে। শুধু দেখতেই ইচ্ছে করছে।

আর নিতু দেখছে এলোমেলো তৌসিফ কে।ও ভাবছে,”কি হয়েছে মানুষ টার?এমন অসুস্থ লাগছে কেনো দেখতে?কোই রাহেলা খালাতো একবার ও বলেনি যে তৌসিফ অসুস্থ।ওর ব্যবহার এর জন্য ওকে অপছন্দ করলেও প্রথম যেদিন দেখে সেদিন থেকেই তো নিতু তৌসিফ কে একটু একটু করে পছন্দ করেছিলো। সেই ভালোবাসা যদিও আবার হারিয়ে গিয়েছিল তবে একেবারে বিলীন তো হয়ে যায়নি।এতো দিন পর তাই এই রাগি মানুষ এর এই অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগছে।কেনো ওনার এই অবস্থা সেটা অবশ্য নিতুর বোধগম্য হয়না।”দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় যখন ব্যস্ত সালেহা বেগম তখন ওদের দেখে মিটমিট হেসে তৌসিফ এর আনা মিষ্টি,ফল এগুলো নিয়ে রান্নাঘরে যায়।আর নিতু কে বলে,”দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? জামাইকে নিয়ে ঘরে যা। গরমে এতোটা পথ এসে ওর নাজেহাল অবস্থা।ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেক।”

নিতু মায়ের কথায় মাথা নেড়ে সায় দেয়। তৌসিফ কে বলে,”রুমে আসুন।”শাড়ির আঁচল টেনে সামনে এনে ও ধীরপায়ে হেঁটে রুমে যায়। হঠাৎ এভাবে কিছু না বলে,না জানিয়ে এখানে আসার মান কি সেটা নিতু বুঝতে পারছেনা।আর মানুষ টাকে কেমন বিদ্ধস্ত লাগছে দেখেই বুকের ভেতর কেমন যেনো কষ্ট লাগছে। নিতু সোজা বারান্দায় গিয়ে তোয়ালে নেড়ে দিয়ে ঘরে ঢোকে।

তৌসিফ ওর আনা গোলাপ নিয়ে নিতুর পেছনে পেছনে হেঁটে নিতুর রুমে আসে।নিতু বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকতেই ওর সামনে গিয়ে দাড়ায়। নিতু একটু অপ্রস্তুত হয়ে পাশে কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই তৌসিফ ওর হাত ধরে। নিতু কে টেনে সামনে এনে দাড় করিয়ে মৃদু স্বরে বলে,”কেমন আছো?এতোদিন পরে আসলাম তবুও এড়িয়ে যাচ্ছো?”

নিতুর হাত ধরতেই ওর ভেতরে অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। মিনমিনে গলায় বলে,”ভালো আছি। আমি আপনার জন্য তোয়ালে বের করে আনি। মানে…তোয়ালে আনতে যাচ্ছিলাম । আপনাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে।গোসল করে আসলে ভালো লাগবে।তাই…”

“তোমাকে কিছুক্ষণ দেখি? তোমাকে দেখলেই আমার অর্ধেক ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।আর এই ফুলগুলো তোমার জন্য। একটা ছোট মেয়ের কাছ থেকে কিনেছি। ইচ্ছে হলো তোমার জন্য আনতে তাই নিয়ে এলাম।”নিতুর কথা থামিয়ে দিয়ে কথাগুলো বলে তৌসিফ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

তৌসিফ এতো কাছে এসে কথা বলায় এমনি নিতুর ভেতরে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিলো এমন সময় আবার তৌসিফ এর অদ্ভুত কথা ,ফুল দেয়া সবই যেনো কেমন লাগছে ওর।এতো ঠান্ডা,কোমল স্বর, এতো আকুতি মেশানো আবদার কোন কিছুই ওর বোধগম্য হচ্ছিলো না। তাই ফুলগুলো হাতে নিয়ে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতু দুরে সরে দাঁড়ায়। দৌড়ে আলমারি থেকে নতুন তোয়ালে বের করে দিয়ে বাইরে যাবে এমন সময় সালেহা রুমে ঢোকে। তৌসিফ এর কাছে গিয়ে বলে,”বাবা এগুলো তোমার বাবার পাঞ্জাবি -পায়জামা। তোমার হাতে কোন ব্যাগ দেখলাম না।মনে হয় তুমি কোন কাপড় আনোনি।তাই এগুলো নিয়ে এলাম।গোসল করে আপাতত নাহয় এগুলো পরো।”

সালেহা বেগম কাপড়গুলো রেখে যাওয়ার সময় নিতুও সুযোগ পেয়ে মায়ের পেছনে চলে যায়।

নিতুর দৌড়ে চলে যাওয়া, শ্বাশুড়ি মায়ের রুমে চলে আসা সব এতো দ্রুত হয় যে তৌসিফ নিতু কে আর কিছু বলার সুযোগ পায়না ।মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।ভাবে,”মেয়েটা কি সব সময়ই এমন ছোটাছুটি করবে?যখনই ধরতে যায় তখনই শুরু হয় ছোটাছুটি।তবুও ওকে দেখতে পেরে শান্তি লাগছে।মনে হচ্ছে মরুভূমির মাঝে যেনো এক পশলা বৃষ্টি নামলো আজ। তবে কি বন্ধুদের কথাই ঠিক?মনে সত্যিকার এর প্রেম এসেছে? শেষমেষ বিয়ের পরে বৌ এর প্রেমেই কি তাহলে পরে গেলো?প্রেম হোক আর যাই হোক নিতু কে দেখে আমি মানসিক শান্তি পাচ্ছি। অবশেষে নিতুর মাঝেই যেনো সুখ খুঁজে পাচ্ছি।”মুচকি হাসে তৌসিফ।আর তোয়ালে হাতে নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে ওয়াশরুমে।

নিতু মায়ের সাথে রান্নাঘরে গিয়ে কাজে সাহায্য করতে নেয়। তৌসিফ এর জন্য মিষ্টি,পিঠা সহ আরো কিছু খাবার ট্রেতে সাজিয়ে দিয়ে নিতু কে নিয়ে যেতে বলে। নিতু মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”সত্যি করে বলোতো মা আজ কারা আসবে।কার জন্য সকাল থেকে এতো আয়োজন?”

নিতুর মা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলে,”কার জন্য আবার? জামাই এর জন্য।আর অন্য কে আসবে?কাল রাতেই তো তোকে বললাম তৌসিফ কে আসতে বলতে।”

নিতু থতোমতো খেয়ে বলে,”ও হ্যা মনেই তো নেই যে তুমি আসতে বলতে বলেছিলে।”

“বুঝেছি।আর মিনমিন করতে হবে না ।এখন যাতো জামাইকে নাস্তা দিয়ে আয়। দুপুরের খাবার খেতে এখনো দেরি আছে।দেখে মনে হচ্ছে না সকালে তেমন কিছু খেয়েছে।নাস্তা নিয়ে যা। আমি চা নিয়ে আসছি। সাজিদ,সেতুর ও আসার সময় হয়ে গেছে।তুই তাড়াতাড়ি যা।আর দেখ কিছু লাগবে কিনা।”

“হুম যাচ্ছি মা।”বলে শাড়ির আঁচল সামনে এনে ঠিক করে ট্রে হাতে রুমের দিকে যায়।

চলবে….

#সুখের খোঁজে….(পর্ব-১৬)
#মৌমিতা হোসেন

তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে শ্বশুর এর পাঞ্জাবি পরে।যদিও আনইজি লাগছিলো তবুও কিছু করার নেই।কারন ও তো কোন কাপড় সাথে করে আনেনি।অভ্যাসবশত ভেজা তোয়ালে বিছানার ওপরেই রেখে দেয়। চুল আঁচড়াতে থাকে এমন সময় নিতু ট্রে হাতে রুমে ঢোকে। বিছানায় ভেজা তোয়ালে দেখে খানিক বিরক্ত হয়।টেবিলে ট্রে রেখে চোখ তুলে তাকাতেই দেখে তৌসিফ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিতু মাথা নিচু করে ফেলে।বলে,”নাস্তা এনেছি খেয়ে নিন।দুপুরের খাবার হতে সময় লাগবে।তাই মা পাঠিয়েছে।”

নিতুর সেই আগের স্টাইলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলা কথা তৌসিফ কে খুব আকর্ষন করছিলো।ও শুধু নিতু কে দেখছিলো। হঠাৎ কোমরে কারো হাতের ছোঁয়ায় নিতু চোখ ওপরে তুলে তৌসিফ এর দিকে তাকায়। খুব কাছে চলে আসে তৌসিফ।যতোটা কাছে এলে একে অপরের নিঃশ্বাস এর শব্দটাও শোনা যায়। উপলব্ধি করা যায় একে অপরকে ততোটা কাছে। নিতুর খুব অস্বস্তি হয়। খুব।এতো দিন পর আবার কেমন জানি লাগতে থাকে।আর তৌসিফ এর মনে হাজারো নিষিদ্ধ ইচ্ছেরা উকি দিতে থাকে।এক হাত নিতুর গালে রাখতেই দরজায় নক করার শব্দে নিতু তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ায়। দৌড়ে দরজার কাছে যায়। দরজা খুলে দেয়।দেখে মা তৌসিফ এর জন্য চা নিয়ে এসেছে।মনে মনে ভাবে,” এই লোকটা দরজা লাগালো কখন?”

তৌসিফ ও একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সালেহা রুমে এসে বলে,”তোমরা খেয়ে গল্প করো বাবা।চা খেলে ভালো লাগবে।”

নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”জামাইয়ের কিছু লাগবে কিনা খেয়াল রাখিস।”

সালেহা রুম থেকে যাওয়ার সময় আবার দরজা চাপিয়ে রেখে যায়।এতো দিন পর জামাই এসেছে ওদের একটু প্রাইভেসি দরকার ভেবে মনে মনে হাসে।

এদিকে মা’কে দেখে নিতু প্রথমে বেশ খুশি হয়।মনে মনে ভাবে মায়ের সাথে কাজের অজুহাত দেখিয়ে ও বাইরে চলে যাবে। কিন্তু কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা চাপিয়ে চলে যাওয়ায় হতাশ হয়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আঙুলে শাড়ি প্যাচাতে থাকে।

এমন সময় তৌসিফ এর ডাকে ওর ধ্যান ভাঙে।”ওখানে দাঁড়িয়ে শাড়ি প্যাচাবে নাকি সামনে আসবে? মানে কি খাবো দেবে তো?বৌ সামনে বসে থাকবে। স্বামী বৌ কে দেখবে আর খাবে। এতে যে এতো তৃপ্তি সেটা আগে জানা ছিলোনা।”

নিতু যেনো আজ সব কিছুতেই অবাক হচ্ছে।এই কটকট করা লোকটার মুখে আজ এতো সুন্দর সুন্দর কথা ওর ঠিক হজম হচ্ছেনা। হঠাৎ ওর মাথায় আসে লোকটা আবার ওর কাছে আসার জন্য এমন নরম কথা বলছে নাতো।এমন সময় তৌসিফ এর ডাকে চমকে তাকিয়ে দেখে সামনে দুহাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি বসবেনা সামনে? আমাকে খেতে দেবে না?”

নিতু তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে চলে আসে।বলে,”হুম আসুন না।”

তৌসিফ নিতুর সামনেই বসে খেতে থাকে।আর অপলক নিতু কে দেখতে থাকে। নিতু নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।কি করবে বুঝতে পারছে না।কতোক্ষনে এর খাওয়া শেষ হবে আর ও এখান থেকে পালাবে সেই অপেক্ষায় আছে নিতু। খাওয়া শেষ হলেই নিতু ওগুলো রেখে আসার জন্য বাইরে যেতে নেয়।তখনি তৌসিফ বলে,”পালাচ্ছো কেনো?বসো একটু কথা বলি।”

নিতু যেনো আজ তৌসিফ এর সব কথাতেই অবাক হচ্ছে।বলে,”আমার সাথে কথা!! হুম বলুন শুনছি।”

“এভাবে না ।বিছানায় এসে বসো। একটু গল্প করি। তোমার সম্পর্কে জানি।”

নিতুর মনে আবারো ভয়।বলে,”বিছানায় কেনো? এখানেই ঠিক আছে। বলুন তাড়াতাড়ি। ওখানে আমার সমস্যা হয়।”

তৌসিফ হয়তো বুঝলো নিতু কেনো এমনভাবে কথাগুলো বলছে।তাই বেশ মজা পেলো আর উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। নিতু সেই হাসি শুনে আবারো তৌসিফ এর দিকে তাকালো। হাসিটা বেশ সুন্দর।যেকোন নারীর মন কেড়ে নেয়ার মতো হাসি। তবে ওকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো।এই কদিনে কেমন রুগ্ন লাগছে তৌসিফ কে।তাই আনমনেই জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে আপনার? আপনি কি অসুস্থ ছিলেন গতো কদিন?এমন রুগ্ন দেখাচ্ছে কেনো আপনাকে?”

তৌসিফ হাসি বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। নিতুর দিকে তাকিয়ে একটু অভিমানের স্বরেই বললো,”এটা জানা কি খুব দরকার?এমন জঘন্য মানুষ সুস্থ নাকি অসুস্থ সেটা জেনে কি লাভ বলো।”

তৌসিফ এর এমন উত্তর শুনে নিতুর খারাপ লাগে।কি বলবে বুঝতে পারছিলো না।এমন সময় তৌসিফ আবারো বললো,”উত্তর দিলেনা তো।এই জঘন্য মানুষ টাকে এই কদিনে মনে পড়েনি একবারও?একবারের জন্যও তো খবর নাও নি।”

নিতুর কথা বলতে আর ইচ্ছা হয়নি।কি বলবে?ওতো খবর নিয়েছে খালার কাছে থেকে। তৌসিফ এর সাথে কি ওর এমন সম্পর্ক এখনো হয়েছে যে ফোন করে খবর নেবে?এসব ভাবতেই তৌসিফ ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। বাহুতে কারো স্পর্শ পেয়ে দেখে তৌসিফ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।চোখ নামিয়ে ফেলে নিতু। তৌসিফ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”তোমাকে আর খবর নিতে হবে না দুরে বসে বসে।সেই সুযোগ আর দেবো না তোমাকে।ব্যাগ গুছিয়ে রাখো। বিকেলে বাসায় যাবো আমরা । আমার বৌ আমার কাছে থাকবে। আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও থাকা আর চলবে না”

কথা শেষ করে কানে আলতো চুমু খেয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে বারান্দায় চলে যায় তৌসিফ।

তৌসিফ এর সব কথা নিতুর বোধগম্য হয়না। তবে খারাপ লাগে না। ভালো লাগে আজ।আজ ওর কথায় কিছু একটা ছিলো। এরই মাঝে আপন মনে বলে ওঠে,”তবে তাই বলে হুট করে বললেই হবে নাকি।আজকেই কেনো যেতে হবে?আরো কদিন থাকলে কি হবে?আর এই যে যখন তখন কাছে আসা এসব কি।” আর ভাবলোনা নিতু।ট্রে নিয়ে রান্নাঘরে চলে আসে।

এসে দেখে সাজিদ, সেতু চলে এসেছে ‌। ওরা দুলাভাই এর সাথে দেখা করতে আগ্ৰহি।দুজনই ফ্রেশ হয়ে রুমে গিয়ে তৌসিফ এর সাথে গল্প জুড়ে দেয়। তৌসিফ কে এতো সুন্দর করে ওদের সাথে গল্প করতে দেখে নিতুর খুব ভালো লাগে।বলে,মানুষটা মনে হয় ততোটাও জঘন্য না।যতোটা আমি ভেবেছিলাম।”কথাটা বলে আপন মনেই হাসে। নিতু আর রুমে যায়না। মাকে কাজে সাহায্য করতে নেয়।

বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়। দুপুরে খাবার রেডি হলে জামাইকে খেতে ডাকতে বলে সালেহা। নিতু সেতুকে বলে,”যাতো তোর দুলাভাই কে ডেকে নিয়ে আয়।”

“ঠিক আছে যাচ্ছি।”বলে উঠতে নিলেই সালেহা বেগম এর ধমকে বসে পরে।

একটু রাগী চোখে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোর বুদ্ধি এতো কম হলো কবে থেকে নিতু?সেই কখন থেকে ছেলেটা একা বসে আছে। কয়বার যেতে বললাম গেলি না। এখন খেতে ডাকতে বলছি সেটাও সেতুকে বলছিস?তুই গিয়ে ডেকে নিয়ে আয়।”

নিতু রান্না ঘরে আসার সাথে সাথেই সালেহা বেগম নিতু কে বলে রুমে যেতে। জামাই এর সাথে গল্প করতে কিন্তু নিতু এটা সেটা করে এতোটা সময় কাটায়। তৌসিফ এর সামনে যেতে কেমন যেনো লাগছিলো ওর।আর গেলেই আবার ব্যাগ গোছাতে বলবে তাই আর যায়নি। কিন্তু এখন মায়ের আদেশ আর অমান্য করতে পারলো না।তাই রুমে যায় ডাকতে।

সেই যে গেছে মেয়েটা আর একবারের জন্যও এসে দেখে যায়নি । এতোটা সময় একা একা থেকে তৌসিফ বিরক্ত বোধ করছে আর নিতুর কথাই ভাবছে।কখন বিকেল হবে আর বাসায় যাবে সেই অপেক্ষায় থাকে।সময় কাটাতে সিগারেট ধরায়। নিতু ডাকতে গিয়ে দেখে রুমে ধোয়ায় ভরা। বাজে সিগারেট এর গন্ধে রুমটা ভরে গেছে। পেট গুলিয়ে বমি পায় নিতুর। রেগে বিরবির করে,”বাজে অভ্যাস জীবনেও যাবেনা লোকটার। এগুলো মানুষ খায়?”

তৌসিফ বলে,”বিরবির না করে যা বলবে জোরে বলো।আর এতোক্ষণে তোমার আসার সময় হলো? আমার কিছু লাগবে কিনা একবার ও জানতে ইচ্ছে হয়নি?”

নিতু চোখ তুলে তাকায়।বলে,”না আসোলে আমি রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলাম। মা’কে সাহায্য করছিলাম। খেতে চলুন।মা ডাকছে আপনাকে।”সিগারেট এর গন্ধে মাথা ধরে যাচ্ছিলো তাই তাড়াতাড়ি চলে যেতে নিলে তৌসিফ এবার বিরক্ত হয়। রেগে হাতটা ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।বলে,”তুমি এমন কেনো নিতু?”

নিতু কিছুই বুঝতে পারেনা। কিছু বলবে এরই মাঝে সেতু, সাজিদ রুমে আসে তৌসিফ কে নিয়ে যেতে। তৌসিফ সাথে সাথে হাত ছেড়ে দেয়। সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করে। তৌসিফ খুব তৃপ্তি নিয়ে খায় ।মনে হচ্ছে অনেক দিন পর পেট ভরে খেলো। শ্বাশুড়ি মা খুব যত্ন করে তৌসিফ কে খাওয়ায়। এতে তৌসিফ এর মায়ের কথা বারবার মনে পড়ছিলো। খাওয়ার সময় সালেহা নিতু কে বলে,”নিতু মা খাওয়া শেষ করে ব্যাগ গুছিয়ে রাখিস। তৌসিফ বলেছে আজ তোকে নিয়ে যাবে।”

তৌসিফ সামনে থাকায় নিতু আর কিছু বলতে পারেনি। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে নিতু ওর মায়ের ঘরে যায়। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”মা একটা কথা বলি?”

“হুম বল,এতো অনুমতি নিয়ে কথা বলতে হবে?”

“মা আমি তোমার কাছে আরো কয়েকদিন থাকি?এখনি যেতে ইচ্ছে করছে না।”

সালেহা বেগম নিতুর দিকে তাকিয়ে ওর হাত ধরে পাশে এনে বসায়।এরপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে,”এক সপ্তাহের বেশি হয়েছে এসেছিস। বিয়ের পর মেয়েদের এতো দিন বাবার বাড়ি থাকতে হয়না। ওখানে তোর শ্বশুর, তৌসিফ একা। শ্বশুর অসুস্থ মানুষ।তোর শ্বাশুড়ি নেই তাই ওনাদের দায়িত্ব তোর হাতে।বেয়াই তোকে অনেক স্নেহ করে মা।ফোন করে বারবার তোর খবর নিয়েছে গতো কয়দিন। এমনটা সবার ভাগ্যে হয়না।তাই ওনার দিকে খেয়াল রাখিস,সেবা করিস।আর জামাই এর অবস্থা দেখেছিস? তোকে ছাড়া কেমনটা হয়ে গেছে। ছেলেটার মা নেই মাকে নিশ্চই খুব মনে করে।ও খুব করে কারো যত্ন চায় সেটা ওকে আজ দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি।তাই জামাই এর দিকেও খেয়াল রাখবি।”

“মন খারাপ করিস না। এবার যা। আগে সম্পর্ক ঠিক কর তোদের। স্বামী -স্ত্রী বিয়ের পর দুরে দুরে থাকতে হয়না।যতো দুরে থাকবি দুরত্ব ততোই বাড়বে।মাত্রই বিয়ে হলো তোদের। পাশাপাশি থেকে,কথা বলে সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। কাছাকাছি থাকলে দেখবি দিন দিন ভালোবাসা ও বাড়বে ।মনে কিছু আসলে কথা বলে সমাধান করে নিবি।এখন যা। চারটা বেজে গেলো।ব্যাগ গুছিয়ে ফেল।”কথাগুলো বলে সালেহা মেয়ের কপালে চুমু খায়।

নিতু আর কিছু বলার সুযোগ পায়না।আস্তে উঠে নিজের রুমে চলে আসে। সে-ই সিগারেট এর গন্ধ এখনো যায়নি। রুমে কোথাও তৌসিফ নেই। উঁকি দিয়ে দেখে বারান্দায় বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে। নিতু খুব বিরক্ত হয়।ভাবে, “এগুলো মানুষ এতো খেতে পারে? কীভাবে থাকবো আমি এই মানুষটার সাথে।”

তাড়াতাড়ি রুমে এয়ার ফ্রেশনার দেয় যাতে গন্ধটা কিছুটা হলেও চলে যায়।ব্যাগ গোছাতে থাকে।এর মাঝে তৌসিফ ঘরে এসে বলে,”নেশা দিয়েই নেশা কাটাতে হয়। সিগারেট নামক নেশা ততোক্ষণ ছাড়তে পারবোনা যতোক্ষন না তুমি নামক নেশা টা পুরোপুরি আমার কাছে ধরা দিচ্ছো।তাই এতো কপাল কুঁচকে, মনে মনে বকে কোন লাভ নেই।”

নিতু চুপচাপ শোনে। কিন্তু কিছুই বোঝে না।তাই ও ওর কাজ করতে থাকে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here