#সুখের খোঁজে,পর্ব -১৭,১৮
#মৌমিতা হোসেন
১৭
নিতুদের রওনা দিতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে যায়। সালেহা বেগম নিতুর শ্বশুর এর জন্য খাবার, মিষ্টি, তৌসিফ এর জন্য পিঠা,নাড়ু অনেক কিছু দিয়ে দেয়। সাজিদ, সেতু সবাই খুব মন খারাপ করে।নিতু মা’কে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদে। কিন্তু কেঁদেই বা কি হবে।যেতে তো হবেই।
সিএনজিতে নিতু মন খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে মায়ের কথা ভাবছিলো।চোখ থেকে না চাইতেও পানি পড়ছে নিতুর। আজকাল রাস্তায় খুব যানজট। গরমে ঘেমে অস্থির হয়ে যাচ্ছে । খুব বিরক্ত লাগছে নিতুর। তৌসিফ এর থেকে বেশ দুরত্ব রেখেই বসেছিলো নিতু। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ ওর শরীর ঘেসে বসে আছে।আর এক হাত দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। নিতু সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলে। তৌসিফ এর এই কাজে নিতু বেশ খুশি হয়। তৌসিফ বলে,”এতো কাঁদছো কেনো? মাথা ব্যথা হবে।যেতে সময় লাগবে। তুমি চাইলে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে পারো।”
নিতু যেনো সকাল থেকে তৌসিফ এর সব কথায় বারবার শুধু অবাক হয়েই যাচ্ছে। নিতু মাথা নাড়ে।বলে,”দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।”আবার বাইরে তাকায়।
প্রায় আটটার দিকে ওরা বাসায় এসে পৌঁছায়। মাথায় কারো হাতের আলতো স্পর্শে ঘুম ভাঙে নিতুর। জেগে দেখে বাসার সামনে চলে এসেছে।কখন যে তৌসিফ এর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছে টেরই পায়নি। তাড়াতাড়ি সিএনজি থেকে নামে। ভাড়া মিটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নিলেই দেখে জুঁই,বিথি, সাদিয়া সব দাঁড়িয়ে আছে। বিথি দৌড়ে এসে নিতু কে জড়িয়ে ধরে।বলে,”এতো দিন কেউ বাবার বাড়ি থাকে? তোমাকে কতো মিস করেছি জানো? তোমাকে ছাড়া আমাদের গল্প যেনো জমছিলোই না। তুমি কি পাষান গো ।আর ভাইয়ার অবস্থা দেখো তোমাকে ছেড়ে এই কদিনেই কেমন দেবদাস হয়ে গেছে।”হঠাৎ মাথায় কারো হাতের থাপ্পর খেয়ে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।
বিথি সাথে সাথে চুপ হয়ে যায়। মিনমিন করে বলে,”ভাইয়া আমি তো শুধু বলেছি যে….”
তৌসিফ আর কিছু বলতে দেয়না।বলে ,”একদম চুপ। সারাদিন বকবক করতে না পারলে তোর ভাত হজম হয়না তাইনা?মাত্রই তো এলাম। ঘরে যেতে দে আগে।তারপর বকবক করিস।আর এ সময়ে এখানে কি করিস? সবাই গিয়ে পড়তে বস যা।”সবাই চুপ হয়ে যায়।
নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”চলো ওপরে।পরে ওদের সাথে কথা বলো যতো মন চায়।”
নিতু তৌসিফ এর কথায় আজ বারবার চমকে যাচ্ছে। তবে কিছু বলেনা চুপ থাকে। এতোটা পথ জার্নি করে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।বিথির গালে হাত দিয়ে বলে,”এখন যাই বোনু। একটু রেস্ট নেই। কাল কথা হবে ইনশাআল্লাহ।”
বিথি একটু মন খারাপ করে আর কোন কথা বলেনা। সবাই যে যার কাজে চলে যায়। নিতু তৌসিফ এর পেছনে পেছনে হেঁটে বাসায় আসে।আকবর আলি এখনো বাসায় আসেনি।খাবার গুলো ঠিক মতো রেখে নিতু রুমে যেতে নেয়। নিতুর মনে হচ্ছে অনেক দিন পর নিজের ঘরে এসেছে। রুমে ঢুকেই এলোমেলো অবস্থা দেখে আবারও নিতু প্রচন্ড বিরক্ত হয়। নিতু বিরবির করে,”একটা মানুষ এতোটা অগোছালো কীভাবে হতে পারে?মাত্র এই কদিনে রুমটার কি বাজে অবস্থা বানিয়েছে।এখন এটা কীভাবে পরিস্কার করবো আমি?”
তৌসিফ এসেই ওয়াশরুমে ঢোকে।বেশ কদিন পরে সেইভ করে একটু ফ্রেশ লাগছে নিজেকে।বের হয়েই ভেজা তোয়ালে আবার বিছানায় রাখে। নিতু কে একা একা কথা বলতে দেখে বলে,”এভাবে একা একা বিরবির করে লাভ নেই। এতো দিন বাবার বাড়ি থাকলে ঘরের অবস্থা এমনটাই হবে।”
তৌসিফ এর কথা শুনে নিতু আর কিছু বলেনা।তোয়ালে নিয়ে বারান্দায় যায় নাড়তে। পাখিটা নিতু কে দেখেই নিতু নিতু বলে ডাকা শুরু করে।নিতু ও পাখিটাকে আদর করে, খাবার দেয়।পাখির ভালোবাসা দেখে নিতুর খুব ভালো লাগে।আর অপরদিকে তৌসিফ ও নিতুর প্রতি পাখির ভালোবাসা দেখে অবাক হয়। নিতু গাছগুলো দেখে মন খারাপ করে। ফুল নেই।গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে এই অল্প কদিনের অবহেলায়। তাড়াতাড়ি গাছে পানি দেয়। তৌসিফ এসব কিছুই পর্যবেক্ষণ করে।
নিতু ঘরে ঢুকলেই নিতু কে উদ্দেশ্য করে বলে,”গাছের মতো অন্য একজনের ও এমন অবস্থা।কারো অনাদরে, অবহেলায় ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে ।কেউ যদি এভাবে আমারও যত্ন নিতো….”
তৌসিফ এর কথা শুনে নিতু কি বলবে বুঝতে পারেনা। চুপচাপ রুমে গুছিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।আর তৌসিফ বসে বসে নিতু কে দেখতে থাকে অপলক।বন্ধুরা ফোন দেয়। বাইরে যেতে বলে কিন্তু আজ আর ঐদিকে কোন মনোযোগ নেই ওর।তাই ওদের না করে দেয়।একা একা আনমনে বলে,”আজ আর বাইরে বের হবোনা।আজ নিতু কে দেখবো মন ভরে।”
নিতু ফ্রেশ হয়ে নীল রং এর একটা সুতি শাড়ি পরে। ফর্সা নিতু কে একেবারে চমৎকার লাগছে দেখতে। একেবারে বৌ বৌ। তৌসিফ যতোই নিতু কে দেখছে ততোই ওর অস্থিরতা বাড়ছে। খুব করে ওকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। নিতু কে ডাকে তৌসিফ।বলে,”আমার পাশে একটু বসবে নিতু? একটু গল্প করি।”
নিতু ভাবে,এই মানুষটার আজ হলো কি?সেই সকাল থেকে আবোলতাবোল বকছে। আবার ডাক দিলে তাকায় তৌসিফ এর দিকে।খানিক মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে। তৌসিফ কে বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন দেখতে। তবে মনে হলো চুলগুলো যদি কেটে একটু সেট করে তাহলে আরো ভালো লাগবে দেখতে।এরই মাঝে তৌসিফ এর হাসি দেখে সাথে সাথে মাথা নিচু করে।বলে,”বাবা মনে হয় চলে এসেছে। বাবার সাথে দেখা করবো।বাবাকে খাবার দেবো।এখনতো….বসার সময় নেই।কাজ শেষ করে আসি?”
তৌসিফ আবার হাসে।আজ ওর মন ভালো। খুব ভালো।তাই হাসি চাপিয়ে রাখার মানেই হয়না।আস্তে নিতুর কাছে এসে কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে নেয়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,”আর কতো অজুহাত দেখিয়ে পালাবে তুমি? তুমি এমন হলে কেনো নিতু? কেনো এমন করো আমার সাথে?”
হঠাৎ এমন কান্ডে নিতুর ভেতরে কেমন যেনো এক অদ্ভুত অনুভূতি দেখা দেয়। তৌসিফ এর নিঃশ্বাস এর শব্দ শুনতে পায় নিতু। তৌসিফ এর এতো দিন এর ছোঁয়া আর এখনের ছোঁয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য। আজকে তৌসিফ এর কাছে আসায় আগের মতো ততোটা বিরক্ত লাগছে না। তৌসিফ এর বলা কোন কথাই আজ নিতু বুঝতে পারছেনা।এ যেনো এক ভিন্ন তৌসিফ। নিতু কাঁপা কন্ঠে উত্তর দেয় ,”অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে খেতে দেবো।আর বাবাও মনে হয় চলে এসেছে।তাই যেতে চেয়েছি।”
তৌসিফ আবার হাসে। নিতুর গালে হাত রাখে। বলে,”ঠিক আছে যাও।”আবার কপালে চুমু খেয়ে নিতু কে ছেড়ে দেয়।
নিতুর হাত, পা কাঁপতে থাকে। কিছু বোধগম্য হচ্ছেনা আজ। চুপচাপ দুহাত কচলাতে কচলাতে চলে যায়।আর তৌসিফ নিতুর কান্ড দেখে হাসতে থাকে।
নিতু গিয়ে দেখে আকবর আলি চলে এসেছে। ঘরের মেইন দরজার দুটো চাবি দুজনের কাছে থাকে। তৌসিফ এর মা মারা যাওয়ার পরে এই ব্যবস্থা নেয়।কারন অনেক সময় তৌসিফ দেরি করে আসে আবার অনেক সময় তিনি নিজেই।তাই দুজনের মধ্যে কারোর যেনো দরজা খোলার অপেক্ষা করতে না হয় সেজন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।অবশ্য নিতু আসার পর থেকে কেউ এলে দরজা খোলার দায়িত্ব টা ওই নিয়েছে।গতো কদিন ও না থাকায় আবার আগের নিয়মে চালু হয়েছিল।নিতু শ্বশুর এর সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে বলে,”কেমন আছেন বাবা? এতো দেরি করে ফিরলেন যে?”
আকবর আলী এতো দিন পর ছেলের বৌকে দেখে খুব খুশি হয়। সালামের উত্তর দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা। দোকানে কাস্টমার বেশি।সব গুছিয়ে আসতে সময় লাগে একটু। বুঝিস তো। ছেলেটা সাথে গেলে এতো কষ্ট হতো না।তুই কেমন আছিস?বেয়াইন ভালো আছে তো?কখন এসেছিস?”
“এইতো আটটার দিকে এসেছি। ভালো আছি বাবা। বাসার সবাইও ভালো আছে।”একটু থেমে নিতু আবার বলে,”বাবা হাত মুখ ধুয়ে আসেন আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।মা আপনার জন্য খাবার দিয়ে দিয়েছে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তৌসিফ কি বাসায় নাকি বাইরে?”
“বাসায় বাবা।ডাকবো?”
“আজ একসাথে খাবো। ওকেও ডেকে আন।”
“ঠিক আছে বাবা।”
ছেলে এ সময়ে বাসায় আছে শুনে বেশ ভালো লাগলো। সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করলো।আজ বাবা-ছেলে দুজন তৃপ্তি সহকারে খেলো। সবাই যে যার রুমে চলে গেলে নিতু সব গুছাতে থাকে আর ওর চিন্তাও বাড়তে থাকে।রুমে যাবে কি যাবে না সেই দ্বন্দে ভুগতে থাকে ও।এই কদিন বেশ ভালোই ছিলো নিতু।আজ সকাল থেকেই তৌসিফ এর কোন কথা ওর বোধগম্য হচ্ছেনা। তবে ওর এলোমেলো কথা খারাপ ও লাগছে না।তাই বলে আবার বিয়ে বলতে সবাই যেই সম্পর্ক বোঝাতে চায় যা এতো দিন ধরে হয়েছে তেমন শারীরিক সম্পর্ক চাচ্ছেনা নিতু। তৌসিফ এর সাথে ও মন খুলে অনেক কথা বলতে চায়। ওকে মন থেকে ভালোবাসতে চায়। হয়তো ও ভালোবেসেও ফেলেছে। নিতু চায় তৌসিফ ও ওকে ভালো ভাবে জানুক,ভালোবাসুক ।তারপর নাহয় ওসব হোক।এসব ভাবনার মাঝেই তৌসিফ এর ডাক শুনে তাড়াতাড়ি রুমে যায় নিতু।
তৌসিফ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের তাঁরা দেখছিলো। নিতু কে বললো,”দরজা লাগিয়ে আমার কাছে এসো।”
নিতুর আবার অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরে বলে,”দরজা লাগাতে হবে কেনো?কেনো ডেকেছেন বলুন?”
তৌসিফ চোখ, কপাল কুঁচকে তাকায়। মৃদু হেসে বলে,”দরজা খোলা রেখেই তুমি আমার সাথে থাকবে? মানে কীভাবে?”
নিতু চোখ তুলে তৌসিফ এর দিকে তাকায়। একটু অবাক হয় ওর কথায়।কি বোঝাতে চাইছে তৌসিফ? খুব টেনশন হয় নিতুর। ঘামতে থাকে। তবে কি ওসব কাজের কথা ইঙ্গিত দিচ্ছে? খুব কাছে কারো উপস্থিতি অনুভব করে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ দাঁড়িয়ে আছে। তৌসিফ নিতুর হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায় । খানিক দুরত্ব রেখে তৌসিফ দাঁড়ায়।নিতুও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,”এই কদিন খুব আনন্দে ছিলে তাইনা?এই কদিনে আমার কথা মনে পড়েনি তোমার?”
নিচের দিকে তাকিয়ে নিতু।উত্তর দেয়,”হুম। মানে…. পড়েছে মনে।”
“তবে একবার এর জন্য ফোন দাওনি যে?”
“আপনিও তো দেননি ফোন।আর…”
“আর কি?বলো।”
“আর যেহেতু আপনিও ফোন দেননি। আমি আগ বাড়িয়ে ফোন দিয়ে আপনাকে কি বলবো?আর তাছাড়া….”
“তাছাড়া কি?”
“যদি আপনি রেগে যান ,বকেন তাই আপনাকে ফোন দেইনি।”
তৌসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বলে,” আমি কি তোমার সাথে সারাক্ষন রাগ করি নিতু?”
“রাগ করেন কিনা জানিনা। তবে স্বাভাবিক ভাবে কথাও তো বলেন না। আমার আপনাকে দেখলেই অস্থির লাগে।টেনশন হয়।”
তৌসিফ কি বলবে বুঝতে পারছে না।এর পুরো দোষ অবশ্য ওর নিজের।তাই তপ্ত শ্বাষ ফেলে বলে,”আর ভয় পেওনা,টেনশন করোনা। তোমার কিছু লাগলে বা কোন কথা থাকলে এখন থেকে আমাকে নিশ্চিন্তে বলবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। একটা কথা বলি?”
“হুম বলো।”
“আমার পায়ে ব্যাথা করছে।এখন তাহলে শুয়ে পড়ুন। আমিও ঘুমাতে যাই?”
তৌসিফ এতোক্ষণ নিতু কে দেখছিলো আর ওর কথা শুনছিলো। শুয়ে পড়ার কথা শুনে তৌসিফ মুচকি হেসে বললো,”শুয়ে পড়ার আজ এতো তাড়া কেনো তোমার?”
নিতু কিছুই বোঝে না।ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে তৌসিফ এর দিকে।কি বলবে ভেবে পায়না।
চলবে…….
#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -১৮)
#মৌমিতা হোসেন
নিতু তৌসিফ এর কথা শুনে কি বলবে ভেবে পায়না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তৌসিফ নিতু কে দেখে হাসে।বলে,”ঠিক আছে চলো শুয়ে পরি।”
নিতু ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে দরজা লাগানো। তৌসিফ শুয়ে পরেছে।চোখ বন্ধ দেখে মনে মনে খুশি হয়।বলে,”আলহামদুলিল্লাহ মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে।”আস্তে গিয়ে খাটের এক পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরে।ঘুম চোখে ধরা দিতেই যাচ্ছিলো অমনি তৌসিফ এর স্পর্শে নিতুর ঘুম ভেঙ্গে যায়।এই অবস্থায় ও কি করবে বুঝতে পারছিলো না। এতো দিন পরে কাছে আসতে চাচ্ছে বাধা দিলে আবার যদি রেগে যায়। তাছাড়া বাধা দেয়া হয়তো ঠিকও হবে না।তাই কিছু বলেনা চুপ থাকে।
তৌসিফ নিতু কে ওর দিকে ফিরিয়ে একদম কাছে এনে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,”ভয় পেওনা নিতু। তোমার ঐ সব কাজ আর করবো না।যতোক্ষনে না তুমি নিজ থেকে আমার কাছে আসতে চাও। তোমার কথা মতো নাহয় দু’জন দু’জনকে ভালো করে একটু জানি। নাকি বলো? তবে ….তাই বলে এই যে জড়িয়ে ধরা, একটু ভালোবাসা, একটু কাছে আসা ওসব কিন্তু বন্ধ হবে না। এটুকু চলবে।আর একটা কথা তোমাকে আমার অনেকটাই জানা হয়েছে। বাকিটা অল্প দিনেই জেনে নেবো। তুমিও বেশি দেরি করো না প্লিজ।এতো সময় হয়তো অপেক্ষা করতে পারবো না”কপালে আলতো আদর দিয়ে নিতু কে জড়িয়ে ধরে রাখে।
নিতু যেনো জমে বরফ হয়ে যায়। পুরোটাই এক অন্য রকম অনুভুতি।এই কদিনেই মানুষটির এতো পরিবর্তন ও ঠিক মানতে পারছেনা। তবে খুব ভালো লাগে নিতুর।তাই আর নড়াচড়া না করে চুপচাপ শুয়ে থাকে।আজ তৌসিফ এর শরীরের ঘ্রানটাও ভালো লাগছে।এতো দিনে তো কখনো এমন লাগেনি । দুজন কখন যে ঘুমিয়ে পরে টেরই পায়না।
খুব ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে নিতুর।চোখ খুলে একদম সামনেই তৌসিফ কে দেখে রাতের কথা মনে পরে। তৌসিফ কে আজ ওর অনেক ভালো লাগে। রাতের কথা মনে পড়তেই বেশ লজ্জা পায় ।আস্তে করে ওর হাতটা সরিয়ে উঠে যায়।ওযু করে নামাজ পড়ে। বারান্দায় যেতেই টিয়া পাখিটাও ডাকে। পাখির সাথে একটু কথা বলে, গাছে পানি দেয়।আজ সকাল টা বেশ ভালো লাগছে নিতুর।এর মাঝে কলিং বেল বাজলে গিয়ে দরজা খুলে দেখে রাহেলা খালা এসেছে। ওনাকে দেখেই সালাম জানায়।বলে,”কেমন আছেন খালা?”
রাহেলা নিতু কে দেখে খুব খুশি হয়। সালামের উত্তর দিয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনে কেমন আছেন বৌমনি?কখন আইছেন? এতো দিন কেউ বাপের বাড়ি থাকে? আপনেরে ছাইরা এই কয়দিন ইট্টুকো ভালো লাগে নাই। একলা একলা এই বাসায় এহন আর কাম করতে ভালো লাগে না।”
নিতু খালার কথায় হাসে।বলে ,”এতো কথা একবারে জানতে চাইলে উত্তর দেবো কীভাবে খালা? আগে ভেতরে আসো। রান্নাঘরে চলো কাজ করি আর উত্তর দেই।”
রাহেলা লজ্জা পায়। বলে,”রাগ হইয়েননা বৌমনি।চলেন ।”
দুজন বেশ গল্প করতে করতে নাস্তা বানায়।আকবর আলি উঠে গেলে ওনাকে নাস্তা দিয়ে তৌসিফ কে ডাকতে যায়। রুমে এসে দেখে এখনো ঘুমাচ্ছে। নিতু কি করবে বুঝতে পারেনা।ডাকলে যদি আবার রাগ করে।এই ভাবতে ভাবতেই তাকিয়ে দেখে তৌসিফ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একটু অবাক হয়।বলে,”আপনি উঠে গেছেন?বাবা নাস্তা খেতে বসেছে। আপনিও আসুন।”
নিতু তৌসিফ এর কাপড় বের করে দেয়।ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে আসলে আকবর আলি বলে ওনার সাথে দোকানে যেতে।
তৌসিফ বলে,”প্লিজ বাবা আমাকে এখন আর কিছু বলো না। দোকানে এখনি বসতে চাইনা।”
আকবর আলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। জানে যে বলে লাভ নেই। তাই চুপ থাকে। শুধু বলে,”তোর যা ইচ্ছা তাই কর। আমি আর কখনো দোকানে যেতে বলবো না তোকে।”
নিতুর খারাপ লাগে শ্বশুর এর জন্য।বয়স হয়েছে তবুও কতো খাটে। একটু দোকানে গেলে বাবাকে কাজে সাহায্য করলে কি এমন ক্ষতি হয় এই মানুষটার?
নাস্তা শেষ করে শ্বশুর চলে যায়। নিতু তৌসিফ এর কাপড় বের করে রেখে আসতে নিলে তৌসিফ ডাকে নিতু কে। বলে,”কাপড় ঢুকিয়ে রাখো। আমি আজ বাসায় থাকবো। বাইরে যাবো না।”
আবার অবাক হয় নিতু।বলে,”আচ্ছা ঠিক আছে।”কাপড় গুলো জায়গা মতো রেখে রান্নাঘরে যেতে নেয়। অনেক কাজ বাকি।এর মাঝে তৌসিফ ডাকে,”কোথায় যাচ্ছো?”
“জ্বী রান্নাঘরে।কাজ আছে।”
“কোন কাজ নেই। এখানে এসে বসো। তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্য আমি বাইরে যাবো না।আর তুমি কিনা আমাকে রেখে রান্নাঘরে যাচ্ছো?”
নিতু কি বলবে ভেবে পায়না।চুপ করে এসে বসে। তৌসিফ বেশ খুশি হয়। নিতুর সামনে বসে বলে,”রাতে ঘুম হয়েছে?”
“হুম হয়েছে।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হুম”
“তুমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে রাজি হলে কেনো? তোমার বাসায় দেখলাম অনেক বই। তোমার ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার গাইড। মানে তো তোমার পড়ালেখা করার ইচ্ছা ছিলো। তাহলে কেনো বিয়ে দিয়ে দিলো তোমাকে?”
“বাবা নেই। মাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো।তাই সব মিলিয়ে মা বললো।আর আমি মায়ের কোন কথা ফেলতে পারি না তাই রাজি হয়েছি।”
“ওওও।আচ্ছা এখন যদি তোমাকে আবার পড়ার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে কি তুমি পড়বে? আমার আবার পড়ালেখার প্রতি তেমন ঝোঁক নেই। তবে তুমি যদি চাও তাহলে বলো ভেবে দেখবো তোমাকে পড়ানো যায় কিনা।আর না চাইলে কোন জোর নেই।”
নিতু তৌসিফ এর কথা শুনে বেশ খুশী হয়।পড়ুক না পড়ুক তৌসিফ এর কথা শুনে,কাল থেকে ওর ব্যবহারে মনে হলো আবার একটু একটু করে ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। এতো গুলো বয়সে অন্য কারো জন্য কখনো মনে এমন ভালো লাগা কাজ করেনি। নিতু হাসি মুখে বলে,”ঠিক আছে বলবো।”
তৌসিফ নিতুর হাত ধরতে যাবে এমন সময় রাহেলা বৌমনি ডাকতে ডাকতে রুমে আসে। তৌসিফ খুব বিরক্ত হয়। নিতু তাড়াতাড়ি দুরে সরে বলে,”আমি যাচ্ছি। অনেক কাজ পড়ে আছে।”
তৌসিফ হেসে দেয়।বলে,”আচ্ছা যাও।”
এর মাঝে ওর বন্ধুরা ফোন দিলে কাজ আছে বলে বেরিয়ে পরে।যাওয়ার সময় এই প্রথম তৌসিফ নিতুর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে যায়। ভালো লাগে নিতুর।আর বাইরে যাচ্ছে দেখেও একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে নিতু।পুরুষ মানুষ সকালে কাজে চলে যাবে রাতে ফিরবে এটাই দেখে এসেছে এতো গুলো বছর ধরে।এই বাসায় এসে তাই তৌসিফ কে সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে দেখে অথবা বাসায় বসে থাকতে দেখে নিতু বেশ বিরক্ত হতো।এখনো হয়।কেনো যে মানুষ টা বাবাকে কাজে সাহায্য করেনা এটা নিতুর মাথায় আসে না।
নিতু রান্না শেষ করে গোসল করে, নামাজ পড়ে উঠতে না উঠতেই দেখে তৌসিফ চলে এসেছে। হাতে বেলি ফুলের মালা। এতো তাড়াতাড়ি এসেছে তাই বেশ ভালো লাগে নিতুর।কারন আজ রান্নার সময়ে খালার কাছে শুনেছে গতো কয়দিন তৌসিফ কেমন বেপরোয়া সময় কাটিয়েছে। খাওয়া,গোসল সব কিছুই ছিলো এলোমেলো।আজ তাই তৌসিফ কে দেখে মনের অজান্তেই প্রশ্ন জাগলো মনে,”আপনি কি তবে আমার জন্যই আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলেন? ফুলের মালাটা কি আমার জন্য?”
এমন সময় তৌসিফ সামনে দাঁড়িয়ে তুড়ি বাজায়।বলে,”তোমার কি বিরবির করার রোগ আছে?কি বলছো জোরে বলতে পারোনা?”
তৌসিফ এর কথায় ওর দিকে তাকায় মুচকি হাসে।আর তৌসিফ নিতু কে দেখে অপলক। ঘোমটা মাথায় পুরো বৌ বৌ লাগছে। ফুলের মালাটা নিতু কে দেয়।বলে,”এটা তোমার জন্য। খোঁপায় লাগালে দেখতে দারুন লাগবে তোমায়।এক জায়গায় গিয়েছিলাম ফেরার পথে সামনে পরলো তাই নিয়ে এলাম তোমার জন্য।”
নিতু চরম অবাক হয় আর খুব খুশি হয়। মালাটি নিয়ে ড্রেসিংটেবিলের ওপর রাখে। তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”ধন্যবাদ উপহার এর জন্য। আমি খাবার দিচ্ছি ফ্রেশ হয়ে খেতে আসুন।”
নিতুর মুখে হাসি দেখে তৌসিফ ও বেশ খুশি হলো।এই প্রথম ওর দিকে তাকিয়ে এভাবে হাসতে দেখলো নিতু কে।প্রিয় মানুষ কে একটু খুশি করতে পারলেই যে এতো ভালো লাগে সেটা আগে বোঝেনি তৌসিফ। আগে কখনো এমন আনন্দ পায়নি ও।অবশ্য এক বাবা ছাড়া আপন বলতে আর কাউকেই ও কখনো ভাবতে পারেনি।ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তৌসিফ রুমে এসে নিতুর অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু এমন সময় দুই চাচি আর বোনেরা আসায় তৌসিফ এর আশা ভরসা সব শেষ হয়ে যায়। নিতু ও এতো দিন পর সবাইকে পেয়ে গল্প জুড়ে দেয় সবার সাথে। তৌসিফ কিছু সময় রেস্ট নিয়ে বাইরে চলে যায়। নিতু কে এতো হাসি খুশি দেখে ভালো লাগে সাথে একটু মন খারাপ হয় ।কারন ওর সাথে কখনো নিতু এভাবে হাসেনি। তৌসিফ যাওয়ার আগে নিতু কে জোরে জোরে ডাকতে থাকে। নিতু ডাক শুনে দৌড়ে যায়। বলে যে,”কি হয়েছে? কিছু লাগবে?”
“আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ইচ্ছে হলে ফুলের মালাটা খোঁপায় লাগিও। ফিরতে রাত হবে। তোমাদের গল্প শেষ হোক তারপর নাহয় আসি। এখানে আমার সাথে কথা বলার মতো সময় কারো নেই।”
নিতু একটু মন খারাপ করে।কারন নিতুও চাচ্ছে তৌসিফ এর সাথে সময় কাটাতে। অস্বস্তি হচ্ছে,ভয়, লজ্জা সব লাগছে তবুও চাচ্ছে মানুষটাকে জানতে। কিন্তু বাসায় মেহমান এলে তাদের রেখে কি রুমে বসে থাকা যায়?তাই তৌসিফ এর কথার কোন উত্তর দেয়না। চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। তৌসিফ কথা শেষ করে যাওয়ার সময় নিতুর গালে চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়।
নিতু সাথে সাথে আবার চমকে যায়, হার্টবিট বেড়ে যায়। গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ওভাবে। বিথি এসে নিতু কে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,”কি হয়েছে ভাবি? এভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো?”
নিতু গাল থেকে হাত সরিয়ে ফেলে।বলে ,”কোই কিছু হয়নি তো বোনু।চলো চা বানাই।চাচিরা সবাই বসে আছে।”
নিতু চা, নাস্তা দেয় সবাইকে। সবাই গল্প করে একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যার পর নিতু মা, সেতু এদের সাথে ফোনে কথা বলে।একা একা সময় কাটায়। হঠাৎ ফুলের মালাটা দেখলে খোঁপায় লাগায়। একটা টিপ পরে।আজ কেনো জানি তৌসিফ এর জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে।রাতে দশটার দিকে তৌসিফ আর বাবা একসাথে বাড়ী ফেরে। তৌসিফ বাসায় আসার পর থেকে লজ্জায় নিতু রুমে যায়না। খাবার গরম করে শ্বশুর কে ডেকে তৌসিফ কে ডাকতে যায়।
এদিকে এতোটা সময় পরে বাসায় আসার পরেও নিতু রুমে না আসায় তৌসিফ একটু রাগ করে। বারান্দায় টিয়া পাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”তোর নিতুর মনে একটু ও মায়া নেই জানিস পাখি? এতোটা সময় পর ফিরেছি অথচ এখনো সামনে আসছেনা।এসব কি মানা যায় বল?”
নিতু রুমে এসেই দেখে তৌসিফ কোথাও নেই। ধীরপায়ে বারান্দায় যায়। তৌসিফ কে দেখে মিনমিন স্বরে বলে,”খাবার গরম করেছি। খেতে আসুন।”
তৌসিফ ফিরে তাকায়। নিতু কে দেখে বলে,”আমি খাবো না।ক্ষিদে নেই।”
নিতু বুঝতে পারে যে তৌসিফ অভিমান করে এসব বলছে।তাই আবারো সাহস করে বলে,”রাগ করছেন কেনো? মানে মেহমান থাকলে কি আমি তাদের ফেলে রুমে বসতে পারি?তারা তখন আমাকে খারাপ ভাববে না?তাই……”
“তাই এখন এতো রাতে আসার পরেও সামনে আসোনি?এখনো কি মেহমান আছে?”
“না মেহমান ছিলোনা। আমার কাজ ছিলো।”বলে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ ওকে দেখছে।আবারো অস্বস্তি হয় ওর ।চোখ নামিয়ে ফেলে। তৌসিফ এতোক্ষণে নিতুর দিকে তাকিয়ে দেখে মুগ্ধ হয়। কপালে টিপ, খোঁপায় ফুল এতেই যেনো দারুন লাগছিলো নিতুকে । তৌসিফ নিতুর কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে নেয়। কপালে, গালে চুমু খায়। নিতু আবারো বরফের মতো জমে যাচ্ছিলো। হঠাৎ আকবর আলির ডাকে এক ধাক্কায় তৌসিফ কে সরিয়ে দৌড়ে রুম থেকে চলে যায়। তৌসিফ এর বিষয়টা বুঝতে একটু সময় লাগে।ঘোর কাটলে নিজেই আপনমনে হেসে দেয়। নিতুর খোঁপায় মালাটা দেখে মনটা বেশ উৎফুল্ল হয়। বাবার ডাকে একটু পরে তৌসিফ ও খেতে যায়।
চলবে………