#সুখের খোঁজে,পর্ব-১৯,২০
#মৌমিতা হোসেন
১৯
সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া শেষ করলে সব গুছিয়ে নিতু রুমে গিয়ে দেখে তৌসিফ বিছানায় বসে মোবাইল চালাচ্ছে। নিতু কিছু না বলে বিছানায় এক পাশে শুয়ে পরে। সারাদিন এর কাজে খুব ক্লান্ত লাগছিলো। তৌসিফ ও সাথে সাথে মোবাইল রেখে নিতু কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরে। নিতুর প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি হলেও পরে ভালো লাগে। তৌসিফ এর চোখেও নিতুর ক্লান্ত চেহারা ধরা পরে তাই আর কোন কথা বলেনা। নিতু কে আরেকটু বেশি কাছে পাওয়ার ইচ্ছে জাগলে ও মনকে মানায় তৌসিফ। অপেক্ষায় থাকে নিতুর হ্যা বলার।নিজ থেকে কাছে আসার।
এরপর বেশ কিছু দিন এভাবেই কাটে দুজনের। তৌসিফ প্রায় প্রতিদিন নিতুর জন্য ফুলের মালা নিয়ে আসে। একদিন কাঁচের চুড়ি নিয়ে আসে , আবার একদিন টিপ।এসব আনলে নিতুর মুখে যে একটা মিষ্টি হাসি দেখতে পায় সেটা দেখতে তৌসিফ এর খুব ভলো লাগে ।সময় পেলেই দুজন টুকটাক গল্প করে। নিতুর সাথে গল্প করতে,ওর সান্নিধ্য পেতেও তৌসিফ এর খুব ভালো লাগে।এরই মাঝে যখন খুব ইচ্ছে হয়েছে একটু ছুঁয়ে দিয়েছে নিতুকে। ঐ সময় নিতুর লাজুক চেহারা দেখতেও খুব ভালো লেগেছে।খুব ইচ্ছে থাকলেও গভীর ভাবে ছোঁয়ার অনুমতির অপেক্ষায় দিন গুনছে প্রতিমুহূর্ত। নিতু কে দেখলেই ওর সৌন্দর্যে বারবার মুগ্ধ হচ্ছে। বাইরে গেলেই বাড়ি ফেরার তাগাদা অনুভব করছে আজকাল। নিতু কে বারবার অযথাই ফোন দেয় ও। একটু কথা বলে আবার লাইন কেটে দিয়েছে। মানে সব কিছুতেই এক অস্থিরতা অনুভব করছে তৌসিফ। নিতুর সব কিছুই ভালো লাগে।একেই মনে হয় লোকে ভালোবাসা বলে। তবে এটা প্রকাশ করবে কীভাবে সেটা ওর জানা নেই। নিতুর প্রেমে পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তৌসিফ। নিতুর মাঝেই তৌসিফ ওর সুখ খুঁজে পাচ্ছে।
অপরদিকে তৌসিফ এর উপহার আনা, বারবার ফোন দেয়া, হঠাৎ কিছু না বলে কাছে চলে আসা,ওর কেয়ার করা সব কিছু নিতুর ভালো লাগতে শুরু করে।মনে এক ভিন্ন অনুভূতির আগমন হয়।এক ভিন্ন সুখ। তৌসিফ বাইরে গেলেই অপেক্ষায় থাকে তৌসিফ এর ফেরার। ফুলের মালা যেনো অভ্যাস হয়ে গেছে। তৌসিফ ফেরার আগে নিজেকে সাজাতে ভালো লাগে, একটু পরপর আয়নায় নিজেকে দেখতে ভালো লাগে, তৌসিফ যখন নিতু কে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেটাও ভালো লাগে। অপেক্ষায় থাকে কোন অজুহাত দেখিয়ে গল্প শুরু করার।হঠাৎ ছুঁয়ে দেয়া, জড়িয়ে ধরে ঘুমানো এসবই ভালো লাগে নিতুর। আগের মতো বিরক্ত লাগে না কোন কিছুতে। অস্বস্তি অনুভব হয়না। প্রায়ই ঘুমন্ত তৌসিফ কে লুকিয়ে দেখে।এটাও ভালো লাগে নিতুর।মনে মনে বলে, এবার মনে হয় জীবনে সত্যিকারের প্রেমে পরে গিয়েছি। তৌসিফ এর প্রেমে।এমন কটকট করা রাগি মানুষটার যে কখনো এমন পরিবর্তন হবে আর এই মানুষের প্রেমে পড়বে সেটা কখনো ভাবেনি নিতু। সামনে হয়তো দুজন একসাথে সুখের সাগরে ভাসবে সেই অপেক্ষায় আছে নিতু।
মোবাইলে এখন তৌসিফ এর নাম্বার টা সেইভ করে রেখেছে। নিতুর মনে পরে তৌসিফ এর বলা কথাটা। নিতু অনুমতি দেয়ার আগ পর্যন্ত তৌসিফ ওকে আর পুরোপুরি ভাবে কাছে টানবে না।
আকবর আলি ব্যবসার কাজে আজ একটু ঢাকার বাইরে গিয়েছে।কাল বা পড়শু ফিরবে।একা একা তৌসিফ এর অপেক্ষায় আছে নিতু।আজ নিতুর খুব ইচ্ছে হচ্ছে তৌসিফ এর সান্নিধ্য পেতে।মনে মনে ঠিক করে আজ একটু বেশিই সাজবে। চোখে কাজল, কপালে টিপ, হাতে চুড়ি সবই পরে নিতু। একটা নীল রঙের শাড়ি পড়ে। নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়,খানিক লজ্জাও পায়। ভালোবাসার কথাটা মুখে কখনো বলতে পারবে না।তাই নিতু একটা কাগজে শুধু “ভালোবাসি”শব্দটা লিখে টেবিলে রেখে দেয়।এমন সময় কলিংবেল এর শব্দে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দেখে তৌসিফ এসেছে। হাতে সেই নিয়মমতো বেলি ফুলের মালা।
তৌসিফ মালাটা নিতুর হাতে দিতে গিয়ে ওকে দেখে চমকে যায়।অসম্ভব সুন্দর লাগছে নিতু কে। নিতু একটু লজ্জা পেয়ে মালাটা নিয়ে রুমে চলে যায়। খোঁপায় মালাটা লাগিয়ে তৌসিফ এর জন্য কাপড় বের করে দেয়। দ্রুত রান্না ঘরে যায়।তৌসিফ রুমে এসে নিতুর এলোমেলো কাজ, চিন্তাযুক্ত চেহারা দেখে ভাবে কি ব্যাপার আজ আবার কি হলো নিতুর।এতো অস্থির লাগছে কেনো ওকে?এসব ভাবতে ভাবতে টেবিলে রাখা কাগজটা চোখে পড়ে। লেখাটা দেখে ঠিক বুঝতে পারেনা যে নিতু কি বলতে চাচ্ছে। কাগজটা রেখে তৌসিফ ফ্রেশ হতে যায়। এসে দেখে নিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ বাইরে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। নিতু হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি নিয়ে খেলছে আর আপনমনে হাসছে। নিতুর এই বৃষ্টির সাথে খেলা করার দৃশ্য তৌসিফ মুগ্ধচোখে দেখতে থাকে। বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ কারেন্ট চলে যায়। নিতু ভয় পেয়ে রুমে ঢুকতে নিলেই তৌসিফ এর সাথে ধাক্কা খায় । তৌসিফ ওকে ধরে ফেলে তাই আর পরে যায়না।
তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,”এভাবে ছোটাছুটি করছো কেনো আজ?আর বৃষ্টির মাঝে এখানে কেনো দাঁড়িয়ে আছো?”
নিতু কিছুই বলেনা। তবে তৌসিফ কে দেখে লজ্জা পায়। চলে যেতে নিলে তৌসিফ হাত ধরে আটকায়।বলে,”নিতু টেবিলে একটা চিরকুট পেলাম ওটা কার জন্য?”
নিতু কি বলবে ভেবে পায়না।ভীষন লজ্জা পায়।চুপ থাকে। তৌসিফ আবার জিজ্ঞেস করে। নিতু তখনও কিছু না বলে শাড়ির আঁচল আঙুলে প্যাচাতে থাকে । বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সেই আলোর ঝলকানিতে নিতু কে এভাবে দেখে তৌসিফ এর খুব ভালো লাগে।মনে আবার কিছু ইচ্ছেরা উকি দেয়। তৌসিফ নিতুর সামনে গিয়ে ওর হাত ধরে। নিতু চোখ তুলে ওর দিকে তাকায় । তৌসিফ আস্তে আস্তে বলে,”তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে নিতু। তুমি সামনে থাকলে সব ভালো লাগে। তুমি…. তুমি এতো সুন্দর কেনো নিতু?আসোলে আমি মনের কথা ওভাবে ঠিক গুছিয়ে বলতে পারিনা। তুমি কি বুঝতে পারছো আমার কথা?মা মারা যাওয়ার পর তোমার মতো করে কেউ আমার যত্ন করেনি জানো? তোমার যত্ন পেতে আমার খুব ভালো লাগে।বিয়ের পর প্রথম দিকে আমার করা ব্যবহার এর জন্য আমি খুবই দুঃখিত।ওসব মনে রেখো না প্লিজ।আর আমাকে ছেড়ে কখনো যেওনা। মানে আমি বলতে চাচ্ছি যে…. আমি মনে হয় তোমাকে অনেক ভালোবাসি।মনে হয় না সত্যি অনেক ভালোবাসি।”
নিতু এতোক্ষণ ধরে তৌসিফ এর কথা শুনছিলো।এই কটকট করা মানুষটা যে কখনো এভাবে ভালোবাসার কথা বলবে সেটা নিতু কল্পনাও করেনি। নিতুর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। এটা আনন্দের অশ্রু, সুখের অশ্রু। তৌসিফ নিতু কে কাঁদতে দেখে চিন্তায় পরে যায়।বলে,”আমার কোন কথায় কি তুমি মন খারাপ করলে?কষ্ট পেলে?আচ্ছা যাও তোমার আমাকে ভালোবাসতে হবে না। তবে আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যেওনা প্লিজ।কারন এখন আর আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবোনা।”
নিতু এবার আরো জোরে কাঁদে ।বৃষ্টির পানি গায়ে এসে পড়তে থাকে।তৌসিফ নিতুর চোখের পানি যত্ন সহকারে মুছে দেয়।গালে হাত রেখে বলে,”কেনো কাঁদছো তুমি? কথায় কথায় কাঁদো, আবার তোমাকে ধরার আগেই ছোটাছুটি করো কেনো?”
নিতু তৌসিফ কে জড়িয়ে ধরে।বলে,”আমিও আপনাকে ভালোবাসি।”বলে তৌসিফ এর বুকে মুখ গুজে দেয়। তৌসিফ নিতুর কথা শুনে আনন্দে কি করবে বুঝতে পারেনা।
তৌসিফ বলে,”এজন্য কান্না করছো? এতে কাঁদার কি হলো?”দুগালে হাত রেখে কপালে আদর দিতেই টিয়া পাখিটি বলে ওঠে, “ভালোবাসি, ভালোবাসি।”আর ডানা ঝাপটাতে থাকে।
নিতু, তৌসিফ দু’জনই তখন হেসে দেয়। ঘরে চলে আসে। ততোক্ষণে কারেন্টও চলে আসে ।নিতু তাড়াতাড়ি তোয়ালে দেয় তৌসিফ কে। মাথা মুছতে বলে। নিতুও তোয়ালে দিয়ে নিজের মাথা মুছে খাবার দিতে যেতে নেয়।আর তখনই তৌসিফ ওর হাত ধরে কাছে টেনে আনে। পরম আকুতি নিয়ে বলে,”একটা কথা বলি নিতু?”
“হুম বলুন।”
“আজ কি তোমাকে ভালোবাসার অনুমতি দেবে? একটু গভীর ভাবে ভালোবাসতে খুব ইচ্ছে করছে আজ।”
নিতু তৌসিফ এর কথা শুনে চোখ নামিয়ে ফেলে।কি বলবে বুঝতে পারেনা। এভাবে কি কেউ কখনো অনুমতি চায়?আর এক্ষেত্রে ও কীভাবে অনুমতি দেবে? কী বলবে তৌসিফ কে?এতো সুন্দর করে কেউ কিছু চাইলে কি সেটা না করা যায়?আর আজতো ওর নিজের ও ইচ্ছে আছে শতোভাগ। কিন্তু সেটা ও বলবে কীভাবে?এসব ভাবনার মাঝে কিছু একটা ভেবে তৌসিফ ওর হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে নিলে নিতু তৌসিফ এর হাত ধরে।কানের কাছে মুখ নিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে,”অনুমতি দিলাম ।”বলেই লজ্জায় দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকে নিতু।
তৌসিফ হেসে দেয়। প্রাপ্তির হাসি। নিতুর হাত দুটো সরিয়ে নিতু কে দেখতে থাকে। নিতু কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কপালে,গালে আদরে ভরিয়ে দেয়।এই ছোঁয়া ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। নিতু তৌসিফ এর সব ছোঁয়াতেই শিহরিত হয়। তৌসিফ লাইট অফ করে নিতু কে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে যায়। বাইরে সারারাত ঝুম বৃষ্টি হতে থাকে। প্রকৃতি সাজে নতুন রুপে।আর তৌসিফ নিতু একে অপরের মাঝে ডুবে থাকে। সারারাত একে অপরের ভালোবাসায় মত্ত থাকে, সুখের সাগরে ভাসতে থাকে দুজন। ভোরের দিকে দুজনের চোখে ঘুমেরা ধরা দেয়।
সকালে পাখির ডাকে নিতুর ঘুম ভাঙে।চোখ খুলে নিজেকে তৌসিফ এর বাহুডোরে আবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পায়।চোখ তুলে তৌসিফ এর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে থাকে। মনের অজান্তেই মাথায় চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দেয়। নিজেকে আজ খুব সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বাজে।খালা চলে আসবে তাই তৌসিফ এর হাত সরিয়ে উঠতে যাবে এমন সময়ে তৌসিফ একটানে আবার কাছে এনে জড়িয়ে ধরে। গলায় আদর দিতে থাকে। শরীরে চলে হাতের অবাধ্য বিচরন।নিতুর দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। লজ্জা নিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে,”সকাল আটটা বেজে গেছে।খালা চলে আসবে। উঠতে দিননা।”
“না উঠতে দেবো না। আমার কাছে থাকো ।আজ খালাকে আসতে মানা করে দাও। বাবাও তো বাসায় নেই।আজ ইচ্ছেমতো বৌকে ভালোবাসবো।”
নিতু অবাক হয় তৌসিফ এর কথায়।বলে,”কি ….কি বলছেন?সব কাজ আমি একা কীভাবে করবো?আর খাওয়া দাওয়া…..”
তৌসিফ নিতু কে আর কথা বলার সুযোগ দেয়না।দখল করে নেয় অধর। নিতু বুঝতে পারে তৌসিফ কে আর বাধা দিয়ে লাভ নেই।তাই চুপ থাকে। কিছুক্ষণ পরে নিতু কে ছেড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে রাহেলা খালাকে ফোন দিয়ে আসতে মানা করে দেয়। নিতু খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার প্রিয় মানুষটার দিকে।দুজনের চোখে মুখে এক বিশাল প্রাপ্তির হাসি। নিতু চোখ নামিয়ে ফেলে। লজ্জা পায় খুব।
তৌসিফ নিতুর গালে হাত রেখে বলে,”আমার মতো একজন মানুষ কে ভালোবাসার জন্য,আমার জীবনটা আনন্দে ভরিয়ে দেয়ার জন্য মানে….সব কিছুর জন্য তোমাকে এতো এতো ধন্যবাদ। আমার মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এভাবেই আমার পাশে সর্বক্ষণ আমি তোমাকে চাই। কখনো আমাকে ছেড়ে যেওনা যেনো।”
তৌসিফ এর কথা শুনে নিতুর চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে।এই অশ্রু কষ্টের না আনন্দের, অনেক বড় প্রাপ্তির। অবশেষে জীবনে তৌসিফ নামক সুখের খোঁজ পেলো ,একজন ভালোবাসার মানুষ পেলো সেই আনন্দের অশ্রু। নিতু তৌসিফ কে জড়িয়ে ধরে উত্তর দেয়,”কখনোই কোথাও যাবোনা আপনাকে ছেড়ে। কখনো না।”
তৌসিফ ও নিতুর পিঠে হাত রেখে পরম শান্তির, তৃপ্তির হাসি দেয়।চোখ বন্ধ করে শক্ত করে বুকের মাঝে আগলে রাখে।
চলবে……
#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -২০)
#মৌমিতা হোসেন
নিতুর ঘুম ভাঙে দশটায়। তৌসিফ এর হাতটা সরিয়ে দিয়ে আস্তে করে উঠে কোন রকম শাড়ি পেঁচিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। দীর্ঘ গোসল শেষে বের হয়ে দেখে তৌসিফ তখনও ঘুমে বিভোর। নিতু লাল টকটকে একটা শাড়ি পরে। শাড়িটা ওর মায়ের। নিতুর বাবা মারা যাওয়ার পর সালেহা বেগম আর এতো রঙিন শাড়ি পড়তে চায়না।আর পরা উচিতও নয়।তাই নিতু কে দিয়ে দেয়।আজ তাই নিতু এই শাড়িটাই পরে। কাজল,টিপ, চুড়ি পরে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়। আপনমনে হাসে।এমন সময় তৌসিফ চোখ খুলে নিতু কে একা একা হাসতে দেখে বলে,”কি ব্যাপার নিতু একা একা হাসছো কেনো?”
নিতু চমকে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ এর ঘুম ভেঙেছে।ওর তাকানো দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।বলে,”কোই না তো।হাসছিনা তো। আপনি… আপনি কখন উঠেছেন?”
তৌসিফ উত্তর দেয় ,”যখন তুমি বের হয়ে লাল টকটকে শাড়ি পড়ে লাল পরী সাজছিলে তখন। মাশাআল্লাহ নিতু তুমি সত্যি….”
নিতু লজ্জায় আর থাকতে পারলো না।এক দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে তোয়ালে নেড়ে রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। নাস্তা বানাতে নিলে আবার তৌসিফ নিতু নিতু করে ডাকতে থাকে। নিতু রুমে গেলে দেখে তৌসিফ ওয়াশরুমে। তৌসিফ চিৎকার করে,”আমার কাপড় কোথায় নিতু?”
“এইতো দিচ্ছি অপেক্ষা করেন একটু।”নিতু তোয়ালে,শার্ট বের করে রাখতে নিলে দেখে তৌসিফ ওয়াশরুমের দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে। তৌসিফ বলে, “আমার জন্য নীল পাঞ্জাবি বের করো।আর তুমি একটা নীল রঙের শাড়ি পরে রেডি হও। আমরা আজ সারাদিন বাইরে বেড়াবো।”
বলেই দরজা লাগিয়ে দেয়। নিতু কিছুই বুঝতে পারেনা তাই চুপ করে বসে থাকে। কারন ও তো একটা সুন্দর শাড়ি পরেই আছে। আবার পাল্টাতে হবে কেনো?আর মনে মনে খুব খুশী হয় কারন এই প্রথম ও তৌসিফ এর সাথে কোথাও বেড়াতে যাবে।
এর মধ্যে তৌসিফ বের হয়ে দেখে নিতু বসে আছে।নিতু ও তৌসিফ কে খুব পরখ করে দেখতে থাকে।আজ মানুষটাকে অন্য রকম লাগছে। খুব আপন মনে হচ্ছে। ভালোবাসা যে এতো সুন্দর এক অনুভুতি এটা আগে জানা ছিলোনা। তৌসিফ নিতুর সামনে এসে বলে,”কি ব্যাপার নিতু রেডি হও। বসে আছো কেনো? আমি জানি আমি দেখতে ভালো।আর এখনতো আমি পুরোপুরি তোমার।যখন মন চাইবে দেখতে পারবে।কেউ বাধা দেয়ার নেই।তাই এখন আগে চলো কোথাও ঘুরতে যাই। সারাদিন বাইরে ঘুরবো,খাবো তারপর বাসায় ফিরবো। তোমাকে নিয়ে এতো দিনে একবার ও কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি তাই ভালোবাসার প্রথম দিনটি সুন্দর ভাবে কাটাতে চাই।”
নিতু চুপচাপ তৌসিফ এর কথা শুনছিলো। খুব ভালো লাগছে শুনতে।এমন সময় তৌসিফ কানের কাছে মুখ এনে বললো,”তুমি কি চাচ্ছো বলোতো। মানে আমি কি শাড়ি পড়িয়ে দেবো? নাকি সারাদিন ঘরে বসেই তোমাকে ভালোবাসবো। মানে তোমার ইচ্ছে টা আমাকে একটু খুলে বললে ভালো হয়।অবশ্য ঘরে বসে তোমাকে ভালোবাসতেও……”নিতু তৌসিফ এর মুখ চেপে ধরে।আর কোন কথা বলতে দেয়না।
তৌসিফ না চাইলেও জোর করে ওকে বারান্দায় পাঠিয়ে দেয়।আর নিতু আজ ইচ্ছে মতো সাজে। নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়।
বারান্দায় গাছগুলো আজ তৌসিফ এর নজরে পরে।এই কদিনেই নিতুর ভালোবাসায় সবগুলো গাছে নতুন কলি এসেছে,জবা গাছে ফুল ফুটেছে। গাছগুলো যেমন কারো আদরে,যত্নে আজ এতো সতেজ। তেমনি তৌসিফ এর মনটাও আজ নিতুর ভালোবাসায়,যত্নে প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে।এসব ভাবনার মাঝেই নিতুর ডাকে পেছনে ফিরে তাকায় তৌসিফ। নিতু কে দেখে হা করে তাকিয়ে দেখতে থাকে আর বলে,”মাশাআল্লাহ। তোমাকে পুরো পরির মতো লাগছে।লাল শাড়ির পরিবর্তে এটা পড়তে বললাম যাতে তোমাকে কম সুন্দর দেখা যায়। কিন্তু সেতো একই কথা হলো।এটাও তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”
নিতু কিছু বুঝতে না পারায় জিজ্ঞেস করে,”মানে কি? আপনি লাল শাড়ি পাল্টে কেনো এটা পড়তে বলেছেন? আপনি কি চান না যে আমাকে সুন্দর লাগুক?”
“হুম অবশ্যই চাই সুন্দর লাগুক ।আর সেটা শুধু আমি একা দেখবো।লাল শাড়িতে তোমাকে অনেক বেশী মোহনীয় লাগছিলো।তাই পাল্টাতে বলেছিলাম।কারন আমি চাইনা আমার বৌকে আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখে সুন্দর বলুক। কিন্তু দেখো কোনই লাভ হলোনা।কারন নীল রঙেও তোমায় অসাধারণ লাগছে।”
“তাহলে কি এখন আবার অন্য শাড়ি পড়বো?”
“না থাক এটা পড়েই চলো।”
নিতু হেসে দেয়। ভাবে প্রেমে পড়লে বুঝি মানুষ এমন বোকা বোকা কথাও বলে? হিংসুটে হয়ে যায়? হঠাৎ তৌসিফ এসে নিতু কে জড়িয়ে ধরে বলে,”ভালোবাসি ।”নিতু আর কোন কথা খুঁজে পায়না। দুজন মিলে সারাদিন বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, খাওয়া দাওয়া করে।রাতে বাসায় ফেরার সময় অনেক দিন পর সিঁড়িতে হঠাৎ তপুর সাথে দেখা হয়। তপু দুজনকে একসাথে এভাবে হাসি খুশি দেখে বেশ খুশী হয়। নিতু তপু কে দেখে সালাম জানায়।ঐ ঘটনার পর নিতুর আর তপুর সাথে দেখা হয়নি। অনেকটা ইচ্ছা করেও দেখা করেনি।কারন ও বুঝতে পেরেছে যে কোন কারনে হয়তো দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ চলছে।এই দ্বন্দ মেটানোর আগ পর্যন্ত তপু ভাইয়ের সাথে কথা বলা যাবেনা।তাই গতো কদিন তপু কে এড়িয়ে গেছে নিতু। কিন্তু আজ সামনে চলে আসায় সালাম দিতে হয়েছে।
তপু সালামের উত্তর দেয়।বলে,”কেমন আছো নিতু? তোমাকে আজকাল দেখাই যায়না।”
নিতু তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাইয়া। মায়ের বাসায় গিয়েছিলাম।আর বাসায় আসার পর থেকে সময় হয়নি তাই হয়তো…।”
“আচ্ছা সমস্যা নেই। ভালো আছো এটাই বড় কথা।”
তৌসিফ নিতুর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলে,”তুমি ঘরে যাও। আমি আসছি একটু পরে।”
নিতু বুঝতে পারে তৌসিফ এর নির্দেশ।তাই বলে,”ঠিক আছে।”
তপুর দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইয়া যাই তাহলে।সময় করে বাসায় আসবেন।”নিতু বাসায় চলে যায়।
তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে তপু বলে,”কীরে এভাবে নিতু কে যেতে বললি কেনো?কোন সমস্যা?আর সারাদিন কোথায় ছিলি?”
“বলেছি আমার ইচ্ছা। তোকে বলতে হবে?আর বৌকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম।এতেও কি কোন সমস্যা আছে?”
“নারে কোন সমস্যা নেই।তোর বৌকে নিয়ে তুই যেখানে ইচ্ছা যেতে পারিস। অনেক দিন পর দেখা হলো। সম্পর্কে আমরা ভাই হই।তাই এটুকু তো জিজ্ঞেস করতেই পারি নাকি বলিস?”
“আমি চাই না আমার আর নিতুর মাঝে তুই কখনো কোন কথা বলিস।আর ভাই হই বলছিস? আমাদের মাঝে কি ভাই ভাই সম্পর্ক আছে? কিছু থাকলে তা হলো হিংসা, রেষারেষি। ছোটবেলার মতো ভালোবাসাটা এখন আর নেই।”কথা গুলো বলে তৌসিফ ওপরে উঠে যায়। তপু কে আর কিছু বলার সুযোগ দেয়না। তপু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। জানেনা তৌসিফ এর ভূল ধারণা কবে দুর হবে। তপু এখনো সেই ছোট তৌসিফ কে খুব মিস করে ,সেই ভাইকে ফিরে পেতে চায় কিন্তু তা আর বলার সুযোগ হয়না।
নিতু ওপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শ্বশুর কে ফোন করে ভালোমন্দ খবর নেয়। শ্বশুর জানায় যে পরদিন সকালে চলে আসবে। তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে আসলে ক্লান্ত থাকায় দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমের রাজ্যে চলে যায়।
তৌসিফ নিতুর সময়টা খুব ভালোই কাটছে। সারাদিন সংসারের কাজের মাঝে যখনই সময় পায় তৌসিফ এর সাথে একটু কথা হয়। জুঁই,বিথিরা মাঝে মাঝে আসে ওদের সাথে গল্প করে, শ্বশুর এর সেবা করে,আর সব কিছুর মধ্যে বেশি ভালো লাগে তৌসিফ এর কেয়ারিং।যতো দিন যাচ্ছে তৌসিফ যেনো ততোটাই নিতুর প্রেমে পাগল হচ্ছে।যখন তখন বাসায় এসেই নিতু কে কাছে টেনে নেয়,ওর জন্য টুকটাক উপহার নিয়ে আসা সব মিলিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছে নিতু।
তবে শতো চেষ্টা করেও তৌসিফ কে দোকানে পাঠাতে পারেনা নিতু।ওসবের জন্য নাকি সারাজীবন পরে আছে। এখন সময় নাকি বৌকে ভালোবাসার। নিতু কি বলবে খুঁজে পায়না ।তাই চুপ থাকে।আকবর আলিও এখন তৌসিফ কে দোকানে যাওয়ার কথা খুব একটা বলেনা।কারন সে বুঝতে পেরেছে যেহেতু বৌমার জন্য এই ভবঘুরে ছেলেটা অবশেষে ঘরমুখো হয়েছে সেহেতু পরিবারের দায়িত্ব একদিন না একদিন ঠিকই নেবে।তাই ছেলেকে ছেলের মতোই ছেড়ে দিয়েছে।
কেটে যায় বেশ কিছুদিন।যতো দিন যাচ্ছে দুজনের ভালোবাসাটাও ততো গভীর হচ্ছে। কয়েকদিন ধরেই নিতুর শরীরটা ভালো না। খুব ক্লান্ত লাগে, অল্পতেই হাঁপিয়ে যায়,খেতেও পারছেনা ঠিকমতো। একবার ভাবে মা কে ফোন করে বলবে কিন্তু টেনশন করবে তাই আর কিছু বলেনা।আর তৌসিফ তো আরো বেশি চিন্তা করবে তাই ওকেও কিছু বলেনা।আজ সকাল থেকেই শরীরটা বেশি খারাপ লাগছে।তাই রাহেলা নিতু কে কাজ করতে দেয়না। রান্না ঘর থেকে বের করে চেয়ারে বসিয়ে একাই নাস্তা রেডি করে টেবিলে দেয়।এর মধ্যে তৌসিফ আর আকবর আলি টেবিলে এসে নিতু কে এভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। তৌসিফ বলে,”কি ব্যাপার নিতু এভাবে বসে আছো যে?কোন সমস্যা?”
নিতু উত্তর দেবে তার আগেই দৌড়ে আবার বেসিনে যায়,বমি হয়। তৌসিফ আর আকবর আলি নিতুর অবস্থা দেখে খুব অস্থির হয়ে যায়।আকবর আলি তৌসিফ কে বলে,”আজকেই বৌ মা’কে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যা। কদিন থেকেই দেখছি ওকে অন্যরকম লাগছে।এসব কি আমি খেয়াল করবো?”
নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”বৌমা তোমাকে বলছি। খবরদার আজ ঘরের কোন কাজ করতে যাবেনা।রেস্ট নাও।আজ আমরা রাহেলার রান্নাই খাবো।”
তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”আজ কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। বাসায় থাক। বৌমার দিকে খেয়াল রাখিস।”এসব বলে তিনি চিন্তাযুক্ত চেহারায় দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
শ্বশুর এর এতো ভালোবাসা দেখে নিতু খুব খুশি হয়। বাবার কথা খুব মনে পরে। বাবার জায়গাটা শ্বশুর আব্বা পুরোপুরি নিয়ে নিয়েছে।এমন শ্বশুরকে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হতে থাকে।এরই মাঝে তৌসিফ বলে,”কি ব্যাপার নিতু তোমার শরীর এতোটা খারাপ বলোনি কেনো?এখনো খারাপ লাগছে? একটু কিছু খাও তারপর নাহয় রেস্ট নাও।”
নিতু সবার ভালোবাসা পেয়ে আবেগে কেঁদে দেয়। নিতুর কান্না দেখে তৌসিফ অস্থির হয়ে যায়। নিতু কান্না বন্ধ করে বলে,”আসোলে গতো কিছুদিন ধরেই শরীর খুব খারাপ লাগছে।সব কিছুতেই অস্থির লাগে,খেতে নিলে বমি পায়।খেতেও পারছিনা।”এসব শুনে তৌসিফ একটু চিন্তায় পরে যায়।
তখন রাহেলা বলে,”মনে হইতাছে খুশির খবর আইবো।বৌ মনি মনে হয় মা হইবো।”এসব শুনে তৌসিফ আর নিতু দুজনই খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রাহেলার দিকে।
চলবে……