#সুখের খোঁজে,পর্ব -২৩,২৪
#মৌমিতা হোসেন
২৩
সকাল থেকেই খারাপ লাগলেও বিষয়টা তৌসিফ কে জানায়নি নিতু।ভেবেছে ঠিক হয়ে যাবে।কারন ডেলিভারি ডেট আরো দশ দিন পরে ছিলো। তৌসিফ অবশ্য প্রতিদিন খাওয়ার আগে নিতু কে নিয়ে একসাথে বসে নাস্তা খেয়ে সব ঔষধ খাইয়ে তারপর দোকানে যায়।যাওয়ার আগে সবাইকে বারবার বলে যায় যেনো নিতুর খেয়াল রাখে।কোন সমস্যা হলেই যেনো ফোন দেয়।আরো অনেক কিছু। সবাই এসব দেখে মিটমিট করে হাসে। তৌসিফ কে সবাই এখন মজা করে “বৌ পাগল “ডাকে।যদিও পেছনেই সবাই ডাকে। সামনে বলার সাহস কারো নেই।তবে তৌসিফ এর কেনো জানি এতে একটুও রাগ হয়না।ও বেশ মজা পায়।মনে মনে ওর এই ডাকটা ভালোই লাগে।আর নিতু এসবে বেশ লজ্জা পায়।
যাই হোক আজকেও তৌসিফ নাস্তা শেষ করেই দোকানে যায়। তবে আজ যাওয়ার আগে কেমন অস্থির লাগছিলো। নিতু কে ছেড়ে যেতে ইচ্ছেই করছিলো না। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসে বলছিলো,”বৌ আজ না যাই।কেনো জানি ভালো লাগছে না।”
নিতুর খারাপ লাগলেও বুঝতে না দিয়ে বলে,”না যান। সবাইতো বাসাতেই আছে। সমস্যা হলেই আপনাকে ফোন দেবো আমি। চিন্তা করবেন না একদম।”
“ঠিক আছে।মনে থাকে যেনো। খারাপ লাগলেই ফোন দেবে।”বলে একটা হাসি দিয়ে নিতু কে জড়িয়ে ধরে কপালে,গালে আদর দিয়ে চলে যায়। এটাও অবশ্য এখন তৌসিফ এর প্রতিদিনের কাজ।
তৌসিফ যাওয়ার পরেই নিতু রুমে এসে শুয়ে পড়ে।আজ আর কি রান্না হবে বা কোন কিছুই রাহেলাকে বলেনা। রাহেলা ভাবে হয়তো খারাপ লাগছে নিতুর তাই আর ডাকতে যায়না।আপন মনে অন্যান্য কাজ করতে থাকে।
এদিকে নিতুর হঠাৎ পেট ব্যাথা শুরু হয়। খারাপ লাগতে থাকে। মায়ের কথা মনে পড়ে। সালেহা গতো সপ্তাহেই এসে দেখে গেছে মেয়েকে। সাথে নিয়ে যেতে চাইলে তৌসিফ বাঁধা দেয়।ও নাকি নিতু কে ছেড়ে থাকতে পারবেনা ।তাই নিতুও তৌসিফ এর কথা ভেবে যায়নি।পেটের ওপর হাত রেখে শুধু এপাশ ওপাশ করতে থাকে।মনে মনে ঠিক করে তৌসিফ কে ফোন দেবে।ফোন নেয়ার জন্য বিছানা থেকে উঠতে নিলেই ব্যাথায় আবার বসে পরে। হঠাৎ প্রচন্ড ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিলে রাহেলা দৌড়ে নিতুর রুমে আসে। নিতুর অবস্থা দেখে আতঙ্কে কি করবে ভেবে পায়না রাহেলা। আকবর আলি তখনই বাজারে গিয়েছে মাত্র। রাহেলা তৌসিফ কে ফোন দেয়। কিন্তু লাইন ব্যস্ত আসলে দৌড়ে চাচিদের ডাকে। সবাই তাড়াতাড়ি এসে নিতুর অবস্থা দেখে বুঝতে পারে ডেলিভারি পেইন উঠেছে। নিতু কে কীভাবে হসপিটালে নিয়ে যাবে এসব নিয়ে যখন সবাই চিন্তিত তখন তপু খবর পেয়ে দৌড়ে আসে।
তপুর অন্য কাজ থাকায় আজ তপু অফিসে যায়না।সেই কাজের জন্য বের হবে এমন সময় বিথির কাছে নিতুর অবস্থার কথা শুনে দৌড়ে আসে। নিতু কে দেখেই আগে সিএনজিতে করে হসপিটালে নিয়ে আসে। ওদের সাথে তপুর মা, জুঁই ও আসে।আর এদিকে আকবর আলি খবর পেয়ে ওনারা অন্য গাড়িতে করে হাসপাতালে চলে আসে।পথেই ফোন করে তৌসিফ কে খবরটা জানায়।খবর শুনেই তৌসিফ দোকান বন্ধ করে রওনা দেয়। নিতু কে হসপিটালে ইমারজেন্সি তে ভর্তি করানো হয়।
এরই মাঝে তৌসিফ হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে এসে নিতু কে খুঁজতে থাকলে আকবর আলি ছেলের কাছে এসে বলে,”চিন্তা করিস না বাবা। নিতু ওটিতে আছে। আল্লাহর কাছে দোয়া কর । ইনশাআল্লাহ ভালো খবর আসবে।আজ তপু না থাকলে তো বিপদেই পরে যেতাম।ভাগ্যিস ও আজ ছিলো।”
তৌসিফ নিতুর চিন্তায় বাবার কথা শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়না।চুপ করে ওটির সামনে গিয়ে বসে পড়ে।মনে মনে বলতে থাকে,”কেনো আজ আমি তোমাকে ছেড়ে গেলাম নিতু। ওটিতে যাওয়ার আগে আমি তোমাকে দেখতে পেলাম না। কথা ছিলো এই কষ্টের পুরো সময়টা আমি তোমার পাশে থাকবো। কিন্তু পারলাম না। আমার ব্যর্থতা যে আমি তোমাকে দেখে তোমার যে কষ্ট হচ্ছিলো সেটা বুঝতে পারিনি।তুমি … তুমি নিশ্চই আমাকে খুজছিলে।”ঘামে ভেজা শার্ট, এলোমেলো চুল সব মিলিয়ে পাগল লাগছিলো তৌসিফ কে ।মনে মনে আল্লাহকে বারবার স্মরন করতে থাকে তৌসিফ।
অন্য সবাই ও খুব উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। তপু এসে তৌসিফ এর কাঁধে হাত রেখে চিন্তা না করার জন্য ইশারা দেয়। তৌসিফ কিছু বলেনা।প্রায় ঘন্টাখানেক পর নার্স একটা ধবধবে সাদা ছোট্ট একটা পরীকে নিয়ে এসে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ মেয়ে হয়েছে। প্রথমে কে কোলে নেবেন?কার কাছে দেবো?”
সবাই দৌড়ে যায়। সাথে তৌসিফ ও।চাচি নাতিকে কোলে নেয়। সবাই ছোট বাবুকে দেখে যখন মহাখুশি তৌসিফ তখন নার্স এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমার নিতু কেমন আছে?ও ঠিক আছে তো? আমি কি ওর কাছে একটু যেতে পারবো?”
নার্স বলেন,”না স্যার। ওনার এখন সেন্স নেই। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একটু দুর্বল হয়ে গেছে।রক্ত দিতে হয়েছে। ঘন্টা দুয়েক পর দেখতে পারবেন। তবে আলহামদুলিল্লাহ যে নরমাল ডেলিভারী হয়েছে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”এমন সময় চাচি সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চাকে এনে তৌসিফ এর সামনে ধরে বলে,”তোর মেয়েকে কোলে নিবি না বাবা?দেখ কি সুন্দর ফুটফুটে চাঁদের মতো মেয়ে হয়েছে তোর। মাশাআল্লাহ।”
তৌসিফ এর যেনো এতোক্ষণে মেয়ের কথা খেয়াল হলো। তাকিয়ে একদৃষ্টিতে দেখতে লাগলো । সত্যি একেবারে পরী।চাচির দিকে হাত বাড়াতেই তৌসিফ এর কোলে দিয়ে দিলো। তৌসিফ কোলে নিলো ঠিক তবে কীভাবে সামলাবে বুঝতে পারছিলো না।এতো তুলতুলে নরম!বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে।মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বলে, “মাশাআল্লাহ।”আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে।মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব সুখ আজ ওর ঝুলিতে এসে জমেছে।চোখ থেকে না চাইতেও পানি গড়িয়ে পরে।বলে ,”আজ থেকে আমি তোকে তুলি নামে ডাকবো। তুলোর মতো নরম তুই তাই তুই হলি আমার তুলি।”
তৌসিফ এর কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে দেয়। তপু এসে মেয়ের কানে আযান দেয়।চাচা হয়েছে তাই তপুর আনন্দ কোনো অংশে কম নয়।এরই মাঝে ঠোট ফুলিয়ে কান্না শুরু করলে তৌসিফ অস্থির হয়ে যায়।বলে,”চাচি তাড়াতাড়ি নার্স কে ডাকেন।বাবু কাঁদছে । দেখেন না কোন সমস্যা হলো কিনা।”
তৌসিফ এর অস্থিরতা দেখে আর কথা শুনে আবার সবাই হেসে দেয়।চাচি এসে তাড়াতাড়ি কোলে নেয়।আর বলে,”এতো অস্থির হতে হবে না বাবা।ওর ক্ষুধা পেয়েছে তাই হয়তো কাঁদছে। ওকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যেতে হবে। একটু খাওয়াতে হবে।”
তৌসিফ কপাল কুঁচকে বলে,”কিন্তু নিতু তো ঘুমাচ্ছে।ওর কাছে এখন না নিলে হয়না চাচি? মানে ওর কষ্ট হবে তো।”
“না বাবা কষ্ট হবে না।তুই এখানে বসে থাক।এতো চিন্তা করতে হবে না তোকে।পাগল একটা।”বলে হাসি দিয়ে বাবুকে নিয়ে চাচি নিতুর কেবিনে ঢোকে।
ডাক্তার বলেছে,নিতুর জ্ঞান ফিরলে আজকেই রাতে বাসায় নিয়ে যেতে পারবে।তাই সবাই বাসায় চলে যায়। তবে হসপিটালে তৌসিফ এর সাথে তপু আর নিতুর মা থেকে যায়।খবর পেয়েই তিনি সাজিদ, সেতুকে নিয়ে রওনা দেন।আর সরাসরি হাসপাতালে চলে আসেন। নাতিকে দেখে যেনো আনন্দের সীমা থাকে না সালেহার।আজ নিতুর বাবার কথা খুব মনে পড়ছে সালেহা বেগম এর। মানুষটা বেঁচে থাকলে কতো খুশি না হতো আজ।
প্রায় ৩ ঘন্টা পরে পর নিতুর জ্ঞান ফেরে। প্রথমেই নিতু তৌসিফ কে খোঁজে। তৌসিফ নিতুর পাশেই বসে ছিলো। নিতু কে চোখ খুলতে দেখতেই ওর হাতে, কপালে চুমু খায়। মাথায় পরম আবেশে হাত বুলিয়ে দেয় আর মৃদু স্বরে বলে,”ধন্যবাদ প্রিয়। অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
তৌসিফ কে বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখে নিতুর আর বুঝতে বাকি থাকে না। তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে তাই নিতু একটা হাসি দেয় আর বলে,”ভালোবাসি।”মা রুমে থাকায় দুজনের আর তেমন কোন কথাই হয়না।
নিতু কে নিয়ে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। পুরো বাড়িতে আনন্দের আমেজ।আকবর আলি তো বাড়ি ফিরেই মিষ্টি কিনে সবার বাসায় দেয়া শুরু করেছে। আনন্দের যেনো শেষ নেই। রাহেলা আজ আর বাসায় যায়না।তার বৌমনির বাবু হয়েছে তাকে এই অবস্থায় রেখে যায় কীভাবে? সবার আনন্দ দেখে নিতু কেঁদে দেয়।
রাতে আজ সালেহা ঘুমায় মেয়ের সাথে।প্রথমে অবশ্য এটা শুনে তৌসিফ একটু অমত করে । কিন্তু যখন দেখে রাতে বাচ্চা সামলাতে হবে আর বাচ্চার ব্যাপারে তৌসিফ নিতু কারোরি কোন জ্ঞান নেই।তখন নিতুর অনুরোধে তৌসিফ অন্য রুমে গিয়ে ঘুমাতে রাজি হয়।
প্রথম সাতদিন বাসায় মেহমান, নিতুর অসুস্থতা সব মিলিয়ে তৌসিফ নিতুর কাছে গিয়ে একটু একাকী সময় কাটাতে পারেনি বা কোন গল্প করতে পারেনি।এই এক সপ্তাহ দুজনের কাছে মনে হচ্ছিলো বছরেরও বেশি সময়। সারাদিন বাসায় মেহমান। তৌসিফ দুর থেকে শুধু নিতু কে দেখেছে আর চোখে চোখে দুজন কথা বলেছে।যখন সুযোগ পেয়েছে ছোট বাবুকে একটু কোলে তুলে নিয়েছে,আদর দিয়েছে।এই কদিনেই মনে হচ্ছিলো দুজনের মাঝে অনেক কথা জমেছে । কখন জমানো কথাগুলো বলবে দুজন দুজনকে সেই অপেক্ষায় থাকে দুজন।
বাচ্চার আকিকা দিয়ে নাম রাখে তাসফিয়া তুলি।আকিকা দেয়ার পর নিতুর মা,ভাই-বোন সবাই চলে যায়। সেতু, সাজিদ এর পরীক্ষা থাকায় সালেহা ইচ্ছা থাকলেও নিতুর কাছে বেশিদিন থাকতে পারেনা। তৌসিফ অপেক্ষায় থাকে কখন নিতু কে একা পাবে।দুজন একটু একাকী কথা বলবে। কিন্তু রাতে বাচ্চাকে সামলাতেই দুজন বেশ হিমশিম খায়। একটু পরপর খাওয়ানো, কাঁথা পরিবর্তন করা,ঘুম পরানো সব মিলিয়ে দুজনের নতুন এক অভিজ্ঞতা। অবশেষে ভোরে মেয়েকে ঘুম পারিয়ে নিতু তৌসিফ এর পাশে শুয়ে পড়লে তৌসিফ নিতু কে জড়িয়ে ধরে।বলে,”অনেক ধন্যবাদ আমাকে এতো সুন্দর একটা পরী উপহার দেয়ার জন্য।ঐ দিন তো তোমাকে দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।যেই সময়টা তোমার পাশে থাকা উচিত ছিলো সেই সময়টাই আমি থাকতে পারিনি। এজন্য দুঃখিত।”
“আপনাকেও ধন্যবাদ। আমার জীবনটা আজ পরিপূর্ণ হয়েছে। আল্লাহর কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। মাঝে মাঝে ভয় হয় জানেন?মনে হয় এই আনন্দ,এই সুখ আমার জীবনে স্থায়ী হবে তো?”
“আল্লাহ যেনো আমাদের জীবনে এই সুখ লম্বা সময় রাখে সেই দোয়া করছি। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। তোমাকে আমার পাশে চাই।আল্লাহর কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই আমার।”
চলবে……
#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -২৪)
#মৌমিতা হোসেন
সময় স্রোতের মতো বয়ে যেতে থাকে। তুলির বয়স এখন চার বছর।স্বভাব একেবারে নিতুর মতো হয়েছে। ঠান্ডা মেজাজের,গুলুমুলু ,আর দেখতে একেবারে মায়ের মতো।বাবা বলতে অজ্ঞান।বাবার কলিজার টুকরা হলো তুলি। রাতে দোকান থেকে আসার পর থেকে বাবার সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। বাড়ির প্রথম এবং একমাত্র মেয়ে হওয়ায় সবার আদরে আদরে বেশি আহ্লাদি হয়ে গেছে তুলি।তাই একটুতেই কেঁদে দেয়।
এই চার বছরে অনেক শুভ কাজ হয়েছে। তপু ভাই আর তৌসিফ এর মধ্যকার সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটেছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ভালোবাসা এখন দেখার মতো।সব বিপদে, আনন্দে একজন অন্যজনের পাশে থাকে সর্বক্ষন। দুই বছর আগে তপু ভাই বিয়ে করেছে। অফিসের এক কলিগ এর সাথে বিয়ে হয়।নাম জাকিয়া।বেশ ভালো মেয়েটা।এক ছেলে হয়েছে বয়স আট মাস।
জুঁইয়ের বিয়ে হয়েছে তিন বছর চলছে।বেশ ভালোই আছে। প্রথমে তো বিয়ে করতেই চায়নি। পড়ালেখা না শেষ করে নাকি বিয়েই করবে না। কিন্তু ভালো পাত্র পেয়েছে বলে সবার জোড়াজুড়িতে রাজি হয়ে যায়। শ্বশুর বাড়ি মিরপুরে। সবাই বেশ অমায়িক। জুঁই কে বেশ ভালোবাসে।ওর এক ছেলে নাম জাহিন।বেশ দুষ্টু।যখনি আসে টুকটুক করে হেঁটে বেড়ায়।আধো আধো বুলিতে কথা বলে।
সাদিয়া ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছে। দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস এখনো শুরু হয়নি।ওর জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। ভালো ছেলে পেলেই হয়তো বিয়ে দিয়ে দেবে।
আজকে তুলি সকাল বেলাতেই কান্না করতে করতে এসে তৌসিফ কে বলছে,” বাবা দেখো জাহিন কাল আমার খেলনা ভেঙে ফেলেছে।”
হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো এমন সময়ে তুলির ঘুম ভাঙতেই কালকের বিচার আজ দিচ্ছে কেঁদে কেঁদে। তৌসিফ তুলিকে কোলে বসিয়ে আদর দিয়ে বলে,”ও তো ছোট ভাই তোমার।তাই না বুঝেই ভেঙে ফেলেছে মা । তাই কেঁদো না মা আমার। আমি আরেকটা এনে দেবো তোমাকে হলো তো?”
তুলি কান্না থামিয়ে হাসি দিয়ে বলে,”ওকে আমার জন্য কিটক্যাটও আনবে বাবা। জাহিন এর জন্য আনবে না।ও দুষ্টু।”
আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে দাও মামনি।দাদা ভাইয়ের কাছে যেতে হবে।দাদা ভাইয়ের অসুখ করেছে তো। সাথে সাথে তুলি আবার গাল ফুলিয়ে বলে ,”আমাকে নিয়ে যাও বাবা। আমি দাদাভাই কে দেখবো।”
“ঠিক আছে নিয়ে যাবো।”বলেই বুকের ভেতর কেমন যেনো করে ওঠে তৌসিফ এর।আজ এক সপ্তাহ ধরে আকবর আলি আইসিইউ তে আছে। বার্ধক্য জনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলো অনেক আগে থেকেই।এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ স্ট্রোক করে।সেই থেকেই হাসপাতালে ভর্তি।ডাক্তার সব আশা ছেড়ে দিয়েছে। ওনাকে দেখার জন্যই জুঁই কাল এসেছে এই বাসায়।
এমন সময় নিতু তাড়াহুড়ো করে এসে তৌসিফ কে বলে,”আসুন নাস্তা দিয়েছি।খেয়ে তাড়াতাড়ি যান হাসপাতালে।আর কি খবর হয় আমাকে জানাবেন। আমার ভালো লাগছে না কিছুই।”
“তোমাকে না কতোবার বলছি নিতু যে এ সময়ে এভাবে দৌড়ঝাপ করো না। একটু আস্তে কি কাজ করা যায়না?”
“ছয় মাস চলছে।এখন আবার কি সমস্যা হবে? আমি যেতে চাচ্ছি আপনার সাথে।প্লিজ আমাকে নিয়ে যান। আমি বাবাকে দেখতে চাই। সাতটা দিন ধরে বাবা হাসপাতালে। সবাই যাচ্ছে। আপনিও যাচ্ছেন। আমার কি দেখতে ইচ্ছে করেনা?”
“অবশ্যই করে। কিন্তু এই অবস্থায় তোমাকে এতো দুরে হাসপাতালে আমি নিয়ে যাবো না। অসুস্থ হয়ে যাবে।আর এই সময়টা বিপদজ্জনক।ডাক্তার এবার তোমাকে সাবধানে থাকতে বলেছে।তাই হেয়ালি করোনা নিতু রানি।”কথার মাঝে হঠাৎ হাসপাতাল থেকে ফোন আসে। তৌসিফ রিসিভ করে কথা বলতে বলতে ধপ করে বিছানায় বসে পরে। নিতু কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। নিতু ভয় পেয়ে যায়।উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করে ,”কি হয়েছে ? আপনি কাঁদছেন কেনো?কে …কে ফোন করেছে?”
“হাসপাতাল থেকে ফোন করেছে।বাবা.. আমার বাবা আর নেই নিতু।”বলে কাঁদতে থাকে তৌসিফ।নিতু ও কেঁদে দেয়।কি করবে ভেবে পায়না।এরই মধ্যে তপুও খবর পেয়ে দৌড়ে ওপরে আসে। তৌসিফ কে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। সবাই মিলে হাসপাতালে যায়। নিতুর শরীর খারাপ থাকায় ওকে আর সাথে করে নিয়ে যায়না।
একসাথে অনেক সমস্যা থাকায় আবারো স্ট্রোক করে। এবার আর ডাক্তার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেনি।হাসপাতালের ফর্মালিটিজ শেষ করে আকবর আলির লাশ নিয়ে ফিরতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। এলাকার স্থানীয় আর ভালো মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন আকবর আলি।তাই অনেক লোক তার জানাজায় শরীক হয়।এশার নামাযের পর জানাযা হয়।
সালেহা বেগম সাজিদ, সেতুকে নিয়ে দুপুরেই চলে আসে। নিতু শ্বশুর এর মাঝে নিজের বাবাকে খুঁজে পেয়েছিলো। অনেক ভালোবাসা পেয়েছে।তাই ওনার মৃত্যু মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সবাই কেঁদেই যাচ্ছে।আর তুলি তো দাদাভাই দাদাভাই করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো কিছু সময় আগে।
তৌসিফ এর মায়ের কবরের পাশেই আকবর আলির দাফন সম্পন্ন হয়।মেনে নিতে কষ্ট হলেও মেনে নিতে হয়। তাই তৌসিফ ও বাবার মৃত্যু মেনে নিয়েছে।ঐ যে সময় সব ঠিক করে দেয়। তেমনটাই হয়েছে।নিজে শক্ত হয়ে নরম মনের নিতু রানিকে সামলে নিয়েছে। সালেহা বেগম কিছু দিন থেকে চলে গেছে।সময় যেতে থাকে। নিতু তৌসিফ দুজন দুজনকে খুব সুন্দর ভাবে সামলে নিয়েছে। বাবাকে হারানোর শোক অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে।
নিতুর ডেলিভারি ডেটও চলে এসেছে। দুইদিন ধরে নিতুর শরীর খারাপ। প্রেসার বেড়ে গেছে।তাই এবার আর রিস্ক না নিয়ে আগেই ডাক্তার এর সাথে পরামর্শ করে নিতু কে হাসপাতালে ভর্তি করায় তৌসিফ।সব পর্যবেক্ষণ করে ডাক্তার বলে,”এবার মনে হয় সিজার করতে হবে তৌসিফ সাহেব। তা না হলে একটু রিস্ক হয়ে যাবে।প্রেসার গতো এক সপ্তাহ ধরে অনেক বেশি,আর বাচ্চার নড়াচড়াও কম। তাই তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিন।”
“আপনি যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করুন। নিতুর ব্যাপারে আমি কোন রিস্ক নিতে চাইনা। জটিলতা মনে করলে সিজার করে ফেলুন।”খুব চিন্তাযুক্ত অবস্থায় কথাগুলো বলে তৌসিফ।
ডাক্তার বলে,” ঠিক আছে। সব যদি ঠিক থাকে তাহলে কাল সকালে অপারেশন করে ফেলবো ইনশাআল্লাহ। আপনি প্রস্তুতি নিয়ে নিন।”
“ঠিক আছে।”তৌসিফ নিতুর কেবিনে গিয়ে সব জানালে নিতু বলে,”নরমাল ডেলিভারি হলে ভালো হতো না?”
“না ভালো হতো না।কোন রিস্ক চাইনা।”বলেই নিতু কে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়।বলে,”অনেক ভালোবাসি তোমাকে নিতু।বাবা আমাকে ফেলে চলে গেলো। তোমাকে আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লাগবে।একদম আমার মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত লাগবে।”
নিতু কেঁদে দেয়।বলে,”আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আপনি যেটা যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে।”
এরই মাঝে তুলি ঘুম থেকে উঠে বাবা -মায়ের আদর দেখে গাল ফোলায়।বলে,”আমাকে কেউ ভালোবাসে না। সবাই পঁচা।”
তৌসিফ, নিতু দুজনই তখন তুলিকে দেখে ওর কথা শুনে হেসে দেয়। পরদিন নতুন বাবু কিনে আনবে শুনে রাগ ভেঙে যায়। খিলখিল করে হাসতে থাকে দুজনের ছোট পরীটা।
পরদিন সকালে সিজার করবে।তাই চাচিরা,তপু, জুঁই সবাই এসে হাজির হয়। সবার কাছ থেকে দোয়া নেয় নিতু।চাচিরা সাহস দেয়।আর সালেহা বেগম মেয়েকে মুখে মুখে সাহস দিলেও ভেতরে খুব টেনশন করতে থাকে। তৌসিফও খুব চিন্তায় থাকে। নিতু কে ওটিতে নেয়া হয়।
বেশ কিছু সময় পর নার্স বাইরে এসে তৌসিফ কে খুঁজলে তৌসিফ দৌড়ে সামনে যায়। নার্স বলে,”আলহামদুলিল্লাহ এবার ছেলে হয়েছে। মিষ্টি না খাইয়ে যাবেননা কিন্তু।”
তৌসিফ বাবুকে কোলে নিয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ। আমার এক বাবা চলে গেছে আর এক বাবা কে আল্লাহ তায়ালা দিয়েছে।”বলে তাকিয়ে দেখতে থাকে।চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু পরে দুই ফোঁটা। আজ বাবার কথা মনে পরে যায় ।এবার আর এই ছোট্ট বাবুকে কোলে নিতে ভয়, সংকোচ হয়না। উপস্থিত সবাইও বেশ খুশি হয়।তপু এসে কানে আযান দেয়। নিতু সুস্থ আছে জেনে সবাই চিন্তামুক্ত হয়।
সবাই নতুন বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত এমন সময় তুলি এসে কান্না শুরু করে দেয়।বলে,”আমার ভাইয়াকে কেউ আমাকে দেয়না। সবাই পঁচা।”
সবার হঠাৎ খেয়াল হয় তুলির কথা। তাড়াতাড়ি তুলিকে বসিয়ে ওর কোলে নতুন বাবুকে ধরে। ওমনি তুলি ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে ছোট বাবুকে আলতো ছুঁয়ে দেয়।আর খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে । তুলিকে দেখে অন্যরাও সবাই হেসে দেয়।
নিতু কে কেবিনে দেবে সন্ধ্যায়। ততোক্ষণ পর্যন্ত তৌসিফ এর অস্থিরতা ছিলো দেখার মতো। দুবার বিভিন্ন অজুহাতে নিতু কে গিয়ে দেখে আসে। পরেরবার নার্সরা আর ঢুকতে দেয়না।বলে একটু পরেই কেবিনে দেবে তাই আর যেনো এখানে না আসে। নিতু কে নিয়ে বারবার বিভিন্ন প্রশ্ন করায় নার্সরাও কিছুটা বিরক্ত হয়। আবার হাসাহাসিও করে। তৌসিফ বিষয়টা বুঝতে পারলেও কিছু করার নেই।কারন কেবিনে দেয়ার আগ পর্যন্ত ওর টেনশন কমবে না।
অবশেষে সন্ধ্যায় নিতু কে কেবিনে দিলে তৌসিফ এর মনে শান্তি আসে। দু’চোখ ভরে অনেক সময় ধরে নিতু কে দেখে। নিতুর ক্লান্ত,বিদ্ধস্ত,ব্যাথায় কাতর চেহারা দেখে তৌসিফ বুকের মাঝে ব্যাথা অনুভব করে। নিতুর চোখগুলো ফুলে আছে।ব্যাথায় অনেক কেঁদেছে বোঝা যাচ্ছে।একজন মা কতো শতো কষ্ট করে একটা সন্তান জন্ম দেয়। এতোটা কষ্ট মা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কেউ কখনো সহ্য করতে পারবেনা।আর তাই তো মায়ের সাথে কারো তুলনা নেই।এজন্যই তো আল্লাহ মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত এর কথা বলেছেন।
এসব ভাবনার মাঝেই নিতু তৌসিফ এর দিকে হাত বাড়ালে তৌসিফ এর ধ্যান ভাঙে। নিতুর হাত ধরে বলে,”কিছু লাগবে নিতু রানী? খুব কষ্ট হচ্ছে?”
“হুম অনেক ব্যাথা হচ্ছে।নড়তে পারছিনা।”
তৌসিফ নিতুর কষ্ট দেখে কি বলবে বুঝতে পারেনা। প্রথমবার নরমালে হওয়াতে এসব সম্পর্কে তৌসিফ এর তেমন ধারণা ছিলোনা। কিন্তু এবার….. অপারেশন শব্দটা শুনলেই ওর কেমন জানি ভয় ভয় লাগতে থাকে।তিন দিন নাকি হাসপাতালে থাকতে হবে।আর তার ওপর নিতুর এই ব্যাথায় ভরপুর মুখ দেখে তৌসিফ এর আর কিছুই ভালো লাগে না। তবুও শান্তনা দেয়।বলে,”চিন্তা করোনা।ঔষধ দিচ্ছেতো। দেখবে ব্যাথা কমে গেছে। চুপচাপ শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
তৌসিফ পাশে বসে নিতুর মাথায় হাত বোলাতে থাকে।
চলবে……