#সুখের খোঁজে,পর্ব -২৫,২৬
#মৌমিতা হোসেন
২৫
নিতু কে কেবিনে দেয়ার পর সবাই বাসায় চলে যায়। সালেহা বেগম,বিথি আর তৌসিফ থেকে যায়। সবাই মিলে তুলিকে নেয়ার অনেক চেষ্টা করলেও নিতে পারেনি।কান্না করে অস্থির।তুলির কান্না দেখে শেষমেষ নিতুই নিষেধ করে ।তুলির আজ ওর মায়ের কাছে অনেক আবদার।কোন কিছুই অন্যের কাছে করতে চায়না। খুব বায়না ধরে। হাসপাতালে এই তিন দিন তুলি খুব বিরক্ত করেছে নিতু কে। নিতু অবশ্য খুব ঠান্ডা মাথায় তুলিকে মানিয়েছে।আদর দিয়ে, বুঝিয়ে,শাষন করে। তৌসিফ সবটাই অবাক হয়ে শুধু দেখেছে।
সালেহা, বিথি, সাদিয়া সবাই পালা করে হাসপাতালে থেকেছে। সবার ওপর দিয়ে বেশ ধকল গেছে।অবশ্য এই ধকল আরো কিছুদিন যাবে।কারন ডাক্তার বলেছে, বাসায় গিয়েও নিতু কিছুদিন কোন কাজ করতে পারবে না।বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হবে।
তিন দিন পর নিতু বাসায় যায়। এবার খুব কষ্ট হচ্ছে নিতুর। হাঁটতে, বসতে সব কাজেই অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে। নিতুর অবস্থা দেখে তৌসিফ বেশ টেনশন এ পড়ে যায়। দোকানে দুটো ছেলে আছে ওদের ওপরে দায়িত্ব দিয়ে তৌসিফ সারাক্ষন নিতুর খেয়াল রাখতে শুরু করে । পনেরো দিন পর সালেহা বেগম চলে যান। সাজিদ,সেতুর পড়ালেখায় বেশ ক্ষতি হচ্ছিলো তাই যেতে হয়। নিতুর অবশ্য এখন হাঁটতে, বসতে সমস্যা হয়না। তবে ভারি কিছু করা যে নিষেধ। বিথি, সাদিয়া যখন সময় পায় তখন আসে। বাবুকে নেয় খেয়াল রাখে। রাহেলা খালা সংসার এর কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
আর তৌসিফ প্রায় দেড় মাস দোকানে ঠিকমতো যায়না। একবার গিয়ে কিছু ক্ষন থেকে হিসেব বুঝে টাকাপয়সা নিয়ে আবার চলে আসে ।পুরোপুরি নিতু কে সময় দেয়। তুলির খেয়াল রাখে। নিতু তৌসিফ এর সব কর্মকাণ্ড দেখে আর অবাক হয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা অনেক আগে থেকেই বন্ধ তৌসিফ এর। বাচ্চাদের ক্ষতি হবে তাই সিগারেট খাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে।যেই মানুষটা কোন কিছুর কোন দায়িত্ব নিতে চাইতো না।সে এখন দুই সন্তানের বাবা। নিতু,বাচ্চা সবার কতো খেয়াল রাখে। নিতুর নিজেকে খুব সুখী একজন মনে হয়।
তৌসিফ ছেলের নাম রাখে নাহিন। ছেলে-মেয়ে, নিতু কে নিয়ে তৌসিফ এর সুখের সময় কাটতে থাকে। দোকানে গিয়ে কতোবার যে নিতু কে ফোন দেয় তার কোন হিসেব নেই। একবার নিতুকে দেখার বাহানায় আবার একবার ছেলে-মেয়ের সাথে কথা বলার বাহানা করে। প্রতিদিন দোকান থেকে আসার সময় বাচ্চাদের জন্য আবদার মতো বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আসে।আর নিতুর জন্য আনে বেলি ফুলের মালা।নাহিন হওয়ার পর আকিকার দিনে খুশিতে তৌসিফ নিতু কে বলেছিলো,”আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রাপ্তি হলে তুমি।তোমার মাঝে আমি পৃথিবীর সকল সুখ খুঁজে পেয়েছি।এই সুখ নামক তোমাকে আমি কখনো হারাতে চাইনা।তুলির পরে নাহিন কে পেলাম। সত্যি আমি যে কতোটা সুখি সেটা তোমাকে ঠিক ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। আমার এলোমেলো জীবনটাকে তুমি গুছিয়ে নিয়েছো।আজ আমার জীবনটাকে এতো রং দিয়ে রঙিন করার জন্য তোমার কি লাগবে বলো।কি উপহার দিলে তোমার মন ভরবে। তুমি খুশি হবে। আমারও মনে হবে যে আমি তোমায় কিছু দিয়েছি।”
নিতু তৌসিফ এর কথা শুনে বলে,” আপনি আমাকে এতোটা ভালোবাসা দিয়েছেন যে এর ভারই আমি সহ্য করতে পারছিনা।তাহলে এই এতো ভালোবাসার পর আমার আর কি চাওয়ার থাকতে পারে বলুন। আরো কিছু চাওয়ার সাহস আমি দেখাই কি করে?”
“এসব বললে হবেনা। কিছু একটা তো চাইতেও হবে। উপহার হিসেবে আমি তোমাকে দিতেই পারি।তাই তাড়াতাড়ি বলো তোমার কী চাই!”
নিতু একটু ভাবে তারপর তৌসিফ এর হাত দুটো ধরে বলে,”এই যে আপনার হাত দুটো ধরেছি। এই দুটো হাত কখনো ছেড়ে যাবেন না। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার সাথে বাঁচতে চাই,সুখে দুঃখে সব সময় আপনাকে আমার পাশে চাই, আমরা পড়ালেখা শেষ করতে পারিনি কিন্তু আমি চাই আমাদের সন্তানেরা পড়ালেখা শেষ করুক, মানুষের মতো মানুষ হোক ।আর এক্ষেত্রে যেনো আপনি আমাকে সাহায্য করেন।”
“আর কিছু চাইনা? ভেবে বলো নিতু রানি।পরে কিন্তু চাইলেও পাবেনা।”বলে তৌসিফ মিটমিট হাসতে থাকে।
নিতু বুঝতে পারে তৌসিফ এর মনোভাব।তাই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।বলে,”লাগবে আর একটা জিনিস।”
“হুম বলো বলো কি লাগবে।”
“এতো দিনের মতো আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিদিন দোকান থেকে আসার সময় আমার জন্য বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবেন। এটা আমার খুব পছন্দের।
তৌসিফ নিতুর কথা শুনে হেসে দেয়। নিতু কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”বৌ তুমি আজীবন এমন বোকা,নরম তুলতুলেই থেকো।এই নরম ,বোকা বৌকে আমি অনেক ভালোবাসি। অনেক। প্রতিদিন যদি বেলি ফুলের মালা না পাই তাহলে?তখন অন্য ফুল দিয়ে মালা গেঁথে আনলে হবে তো?”
“হুম হবে। বেলি ফুল আমার খুব পছন্দের। কিন্তু যদি না পান তখন আর কি করার।তখন অন্য ফুলের মালা আনবেন। আপনার আনা সব কিছুই আমার পছন্দ। খুব পছন্দ।”
নিতুর দিকে তাকিয়ে ওর কথা গুলো শুনতে থাকে তৌসিফ। কপালে চুমু খেয়ে বলে,”কাল থেকে রোজ আসার সময় আমি তোমার জন্য বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবো।আর না পেলে অন্য ফুলের হলো তো?”
নিতু হেসে দেয় বলে,” হুম হলো।”
সময় যেতে থাকে।নাহিনের বয়স এখন দুই বছর। তুলিকে স্কুলে দিয়েছে গতো বছরই।এখন নার্সারিতে পড়ে।নাহিন অনেক দুষ্টু হয়েছে। সারাক্ষন ওদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নিতু কে।স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, রান্না, নাহিন কে সামলানো।সব মিলিয়ে নিতু ক্লান্ত হয়ে যায়। তবে সন্ধ্যা হতেই তৌসিফের অপেক্ষায় থাকে। সারাদিন বাসায় থাকে না মানুষ টা। অনেক পরিশ্রম করে। একবারে রাতে বাসায় ফেরে । তবে যতোই ঝামেলায় থাকুক ফুলের মালা আনতে ভোলে না নিতুর ভালোবাসার মানুষ টা।কেনো যে ওকে এতো ভালোবাসে সেটাও বোঝেনা।আজ রাত প্রায় দশটা বেজে গেলো এখনো তৌসিফ আসেনি। নিতুর ফোনটাও ধরছে না।এক পর্যায়ে ফোন বন্ধ আসছে।লাইন ঢুকছেনা।তাই খুব চিন্তা হতে থাকে নিতুর। বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে তৌসিফের। অবশেষে রাত এগারোটায় কলিং বেল বাজতেই নিতু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে তৌসিফ এসেছে।ডান হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ। সাথে তপুও আছে। নিতু দেখেই অস্থির হয়ে যায়। কেঁদে দেয় তৌসিফ কে ধরে।
নিতু কাঁদতে কাঁদতে বলে,”কি হয়েছে আপনার?কি হয়েছে বলুন? আমি সেই সন্ধ্যা থেকে ফোন করেই যাচ্ছি। আপনার ফোন কোথায়?আর ….আর এসব কীভাবে?”
তপু নিতুর অবস্থা দেখে বলে,”নিতু শান্ত হও। আগে ভেতরে ঢুকে বসতে দাও তৌসিফ কে।তারপর বলছি আমি।”
তৌসিফ কে দেখে নিতুর আর খেয়াল ছিলো না যে পাশেই তপু ভাই দাঁড়িয়ে আছে। নিতু তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় দিয়ে বলে,”দুঃখিত ভাইয়া।আসোলে ওনার অবস্থা দেখে আপনি যে দাঁড়িয়ে আছেন খেয়াল করিনি।”
“বুঝতে পেরেছি।এখন আগে তৌসিফ কে বসতে দাও।এরপর কিছু খাইয়ে ঔষধগুলো খাওয়াও।”এই কথা বলে তপু নিতুর হাতে একটা ঔষধের প্যাকেট দেয়।
নিতু প্যাকেট রেখে তাড়াতাড়ি তৌসিফ কে ধরে ড্রইং রুমে বসায়।এরপর বলে,”ভাইয়া বসেন আর প্লিজ আমাকে বলেন এসব কীভাবে হয়েছে?”
তপু আড়চোখে তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”কিরে আমি সব বলবো নাকি তোরটা তুই বলবি?”
তৌসিফ শান্ত চোখে তপুর দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি নিজেই বলবো।তুই বাসায় গিয়ে রেস্ট নে। আমার জন্য আজ অনেক কষ্ট করেছিস। অনেক ধন্যবাদ ভাই।”
“বাবারে বাবা ভাই ডাকছিস আবার ধন্যবাদ দিচ্ছিস? দেবো পিঠে বারি।তুই রেস্ট নে।আর কিছু লাগলেই ফোন দিস।”
“হুম অবশ্যই ফোন দেবো। এভাবেই আমার পাশে থাকিস।আর আমার অনুপস্থিতিতে আমার পরিবারটার ও খেয়াল রাখিস।”
একটু রেগে গিয়ে তপু বলে,”হয়েছে এবার থাম।”
আস্তে করে তৌসিফ এর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”এবার আগে তোর এই বাচ্চা বৌকে সামলা।আর কিছু ক্ষন গেলে কান্না করতে করতে নিতুই অসুস্থ হয়ে যাবে। দুজনকে একসাথে সামলাতে পারবো না আমি।”
নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”ছোট বোনু কান্না বন্ধ করে ওকে ঔষধ খাওয়াও।আর যে কোন সমস্যা হলে ফোন দিতে ভুলে যেওনা যেনো। ভাইটা সব সময় তোমার পাশে আছি মনে রেখো।”
তপু চলে গেলে দরজা লাগিয়ে নিতু তৌসিফ এর সামনে এসে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে।আর বলে,”এখন কি বলবেন দয়া করে ?আপনার এমন অবস্থা কীভাবে হয়েছে?”
তৌসিফ বাম হাতটা নিতুর মাথায় রাখে।নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”চোখটা মোছ। একটুতেই এতো কাঁদো কেনো তুমি? তুমি কাঁদলে আমার বুকের ভেতরটা কেমন অস্থিরতায় ছেয়ে যায়। সেটা কি তুমি বুঝতে পারো না?”
নিতু আরো জোরে কান্না শুরু করে আর বলতে থাকে,” ঠিক আছে আর কাঁদবো না।এখন বলুন এই অবস্থা কীভাবে হয়েছে?”
নিতুর অবস্থা দেখে এই কষ্টের মাঝেও তৌসিফ হেসে দেয় আর বলে,”পাশের দোকানটা আমি কিনে নেবো।আজ ওটার জন্য এডভান্স তিন লক্ষ টাকা দেয়ার কথা ছিলো। ভেবেছিলাম এবার তোমার জন্মদিনে তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো।তাই তোমাকে আগে বলিনি। কিন্তু দেখো সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।”
“মানে?”
নিতু কে পাশে বসতে ইশারা দেয়। নিতু উঠে এসে পাশে বসে বলে,”বলুন এখন।”
“টাকা নিয়ে বারোটার দিকে আমি ঐ ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হই।কেউ মনে হয় আগে থেকেই আমাকে অনুসরন করছিলো।যাওয়ার পথে কোথা থেকে একটা বাইক সামনে এসে দাঁড়ায়।ব্যাগ নিতে চাইলে আমি বাধা দেই আর তখনই ওরা ছুড়ি দিয়ে আমার হাতে আঘাত করে।মাথায় পিস্তল দিয়ে বারি দিয়ে টাকার ব্যাগটা ছিনিয়ে নেয়।আর লোকজন জরো হবার আগেই ওরা টাকা নিয়ে বাইকে পালিয়ে যায়।”তৌসিফ কথা বলতে বলতে হাঁপাতে থাকে।সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে পরে।
নিতু সাথে সাথে অস্থির হয়ে বলে,”থাকে আর বলতে হবে না এখন। রুমে চলুন কিছু খেয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমাবেন।”
তৌসিফ নিতুর হাত ধরে আস্তে আস্তে রুমে যায়। মাথাটা কেমন ঘোরাচ্ছে।শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছে। রুমে গিয়ে ড্রেস পরিবর্তন করে,ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে।এসবেই নিতু সাহায্য করে তৌসিফ কে।এরপর খাবার এনে খাইয়ে দেয়।ঔষধ দেয়। তৌসিফ শুয়ে পরলে নিতু পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।এক পর্যায়ে তৌসিফ ঘুমিয়ে পড়লেও মাঝরাতে ব্যাথায় জ্বর চলে আসে। নিতু খুব চিন্তায় পরে যায় তৌসিফ কে দেখে। আবার মাথায় পানি ঢালে,জ্বরের ঔষধ খাওয়ায়। তৌসিফ এর ঘুমাতে রাত সাড়ে চারটা বেজে যায়। তৌসিফ কে দেখে নিতুর খুব কষ্ট হয়।নিতুর চোখে সারারাত ঘুমেরা ধরা দেয়না।চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে তার খুব প্রিয় মানুষ টার দিকে।
চলবে……
#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -২৬)
#মৌমিতা হোসেন
ভোরে ফজরের নামাজের পর নিতু চোখের পাতা এক করে। ঘুম ভাঙে সকাল আটটার দিকে।আজ রাহেলা খালা দেরি করে আসে।কদিন ধরেই ওনার শরীর একটু খারাপ।তাই আজ দেরি করে এসেছে। রাহেলা এসে নিতুর চোখ মুখ দেখেই বলে,”কি হইছে বৌ মনি?আফনের চোখ মুখ এরম ফোলা ক্যান?কানছেন ক্যান?কি হইছে?”
নিতু রাহেলা খালার অস্থিরতা দেখে বলে,”আরে চুপ করো খালা। আমার কিছু হয়নি।”
“তাইলে? আমার তুলি,নাহিন ভালো আছে?ওগোর কিছু অয়নাইতো?”
নিতু রাহেলার অস্থিরতা দেখে তাকে সবটা খুলে বলে।রাহেলাও শুনে মন খারাপ করে। অনেক বছর ধরে কাজ করায় বাসার সবার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে রাহেলার। নিজের পরিবারের মতোই ভালোবাসে সবাইকে। রাহেলা বলে,”আফনের আম্মারে খবর দেন। কয়দিন আইয়া থাইকা যাউক।আফনে একলা বাবুগো, তৌসিফ বাবারে সামলাইতে পারবেন না।”
“ভালো কথা বলেছো খালা। একটু পরে ফোন দিয়েই বলবো।মা আসলে ভালো হবে। তোমাকে ধন্যবাদ খালা। সত্যি তুমি অনেক ভালো।”
“হইছে আর কওন লাগবোনা।যে নিজে ভালা হের কাছে সবাইরেই ভালা মনে হয়।এহন যান আফনে বাবজানের সেবা করেন। আমি এদিক সামলাই আইজকা।”
“ঠিক আছে খালা। আমি একটু স্যুপ বানিয়ে নিয়ে যাই। বাকিটা তুমিই করো আজ।”
“আইচ্ছা ঠিক আছে।”
নিতু স্যুপ বানিয়ে তৌসিফ এর জন্য নিয়ে যায়। সারারাত ছটফট করে এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।বাচ্চারাও ঘুমাচ্ছে।এই সুযোগে নিতু মায়ের কাছ ফোন করে সব কিছু খুলে বলে। সালেহা বেগম বলে যে তিনি দুপুরেই চলে আসবে।ফোন রাখতেই পাখির নিতু কে ডাকা শুরু হয়ে যয়। নিতু পাখির সাথে কিছু সময় কথা বলে পাখিকে খাবার দেয়, বারান্দায় ছোট বাগানের যত্ন নেয়।পুরো বসাটায় এই বারান্দাটা নিতুর খুব পছন্দের।মন খারাপ হলে বা চিন্তায় পড়লে নিতু এখানে এসে পাখির সাথে কথা বলে, নিজের বাগানের গাছ,ফুল দেখে এতে ওর মন অনেকটাই হালকা হয়।
বেশ কিছু সময় পর তৌসিফ এর ডাক শুনে ঘরে ঢুকে দেখে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। নিতু তাড়াতাড়ি তৌসিফ এর কাছে গিয়ে ওকে উঠিয়ে হাত মুখ মুছে স্যুপ খাইয়ে দেয়। তৌসিফ পুরোটা সময় নিতু কে দেখতে থাকে অপলক।এক সময় বলে,”এভাবে আদর করে খাওয়ালে তো আমি অসুস্থ হলেই ভালো।রোজ রোজ তুমি এতো যত্ন নেবে, সারাক্ষন আমার পাশে থাকবে আর আমায় এভাবেই ভালোবাসবে।”
নিতু খানিক রাগ দেখিয়ে বলে,”এমন কথা আর কোনদিন বলবেন না। সুস্থতা আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত।আর আমি কি আপনি অসুস্থ না হলে আপনার খেয়াল রাখি না? আপনার যত্ন নেইনা?”
“হুম নাও তো। কিন্তু এই যে এখন একটু বেশি নিচ্ছো।এই বেশি ভালোবাসা পাওয়ার লোভে বললাম।”
“না আর কখনো এভাবে বলবেন না। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”কথা শেষ করতেই তুলি ঘুমঘুম চোখে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে আমিও বাবাকে অনেক ভালোবাসি।
হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরায় তৌসিফ এর হাতে ব্যাথা পায়।উফফ শব্দ করতেই নিতু তুলির দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙায়।তুলি কিছু বুঝতে না পেরে বলে,”বাবার কি হয়েছে? কীভাবে ব্যাথা পেয়েছে বাবা?”
“সেটা বাবাকে ব্যাথা দেয়ার পর খেয়াল করলে হবে?বাবা অনেক ব্যাথা পেয়েছে তাই একটু সাবধানে ধরবে বাবাকে।আর আজ স্কুলে যেতে হবে না। বাসায় বাবার পাশে থাকো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে মামনি। আমি আর বাবাকে ব্যাথা দেবো না।আর আজ সারাক্ষণ আমি বাবার পাশেই বসে থাকবো।”
তৌসিফ এতোক্ষণ ধরে মা মেয়ের কথা শুনে নিতুকে চোখ টিপ দেয় আর বলে,”এবার তোমরা থামবে? আমার মা কি আমাকে ইচ্ছে করে ব্যাথা দিয়েছে যে ওকে এতো বকছো?”তুলি বাবার কথা শুনে খুশি হয়ে যায় আর দ্রুত বাবার পাশে বসেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
তুলি বলার মতো আর কিছু খুঁজে পায়না।বাবা আর মেয়ের আহ্লাদ দেখতে থাকে।ঔষধ নিয়ে এসে তৌসিফ কে খাইয়ে একটু রেস্ট নিতে বলে।এর মধ্যেই নাহিনও ঘুম থেকে উঠে যায়। নিতু বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে।মাঝে মাঝে এসে তৌসিফ এর কিছু লাগবে কিনা দেখে যায়। তৌফিক আজ পুরোপুরি রেস্ট এ।তাই শুয়ে বসে নিতুর ব্যস্ততা দেখতে থাকে। ঘামে ভেজা শাড়ির ব্লাউজ, কপালে এলোমেলো চুল, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ এসব কিছুই তৌসিফ কে আকর্ষণ করে। কিন্তু হায় এমন দিনেই বেচারা বাসায় যেদিন কিনা মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। তৌসিফ আনমনে এসব ভাবতে থাকে আর মিটমিট হাসতে থাকে।এর মধ্যে নিতু এসে বলে,”কি হয়েছে আপনার?টাকা ছিনতাই হওয়ার কষ্টে মাথায় সমস্যা হয়েছে নাকি?এই অবস্থায় এভাবে হাসছেন কেনো?”
তৌসিফ এর ধ্যান ভাঙে।বলে,”না বৌ কিছু হয়নি। তোমাকে দেখছি। দেখতে ভালো লাগছে।আর তাই হাসছি।”নিতুর হাত ধরে বললো ,”এতো কাজ করতে হবে না। আমার কাছে এসে বসো। আমার তোমাকে প্রয়োজন।”
এরই মধ্যে তৌসিফ এর চাচিরা, তপু, তপুর বৌ সবাই হুরমুর করে তৌসিফ এর ঘরে প্রবেশ করে।নিতু তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে দেয়।এই একটা অভ্যাস সবাই বলেও দুর করাতে পারেনি। কাউকে দেখলেই নিতু মাথায় কাপড় দেয়।আর তৌসিফ কে আপনি করা বলে।
সবাই তৌসিফ কে দেখতে এসেছে।চাচিরাও অস্থির হয়ে বলে,”এখন থেকে এসব টাকা পয়সার ঝামেলা যেদিন থাকবে সেদিন তপু কে আগে থেকেই বলে রাখবি।একা একা যাবিনা কোথাও।কতো বড় বিপদ থেকে আল্লাহ বাঁচিয়েছে?”
“ঠিক আছে চাচি এসব ঝামেলার দিন এখন থেকে আমি তপু কে খবর দেবো হলো তো?”
সবাই বেশ কিছু সময় থাকে।তুলি, নাহিন দাদির সাথে,ফুপির সাথে খেলায় মেতে ওঠে। কিছু সময় থেকে তারপর সবাই চলে যায়।তপু যাওয়ার সময় বলে,”কিছু লাগলে ফোন দিস কিন্তু।আর এক দিক দিয়ে ভালো হয়েছে।তোর অসুস্থতার জন্য তোর বৌ একটু কয়দিনের জন্য শান্তিতে থাকতে পারবে।”বলে চোখ টিপ দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যেতে থাকে।
তখন তৌসিফও হাসে আর বলে,”সুস্থ হয়ে নেই ভাই তারপর তোকে এই প্রশ্নের উত্তর দেবো। অপেক্ষা কর।”
নিতু দুজনের হাসিতেই কেমন এক রহস্য খুঁজে পায়।বলে,”কি ব্যাপার বলোতো।কি নিয়ে তোমরা দুই ভাই এমন বাচ্চাদের মতো করছো?”
তৌসিফ বাম হাত দিয়ে নিতু কে ধরে ওর পাশে বসিয়ে দেয়।বলে ,”তোমাকে নিয়ে। কয়েকদিন তোমাকে ঠিকমতো ভালোবাসতে পারবো না সেটা নিয়ে বেচারা আফসোস করছে।তোমারও কি আফসোস হচ্ছে বৌ?”
এতো ঝামেলার মাঝে তৌসিফ এর এমন কথা শুনে নিতু লজ্জায় লাল নীল হতে থাকে। তৌসিফ এর দিক থেকে চোখ সরিয়ে বলে,”আপনারা এতো নির্লজ্জ কেনো?যা মুখে আসে তাই কি বলতে হয়? একটু রেখে ঢেকে বলা যায়না?”
তৌসিফ নিতুর গালে হাত রেখে বলে,”না বলা যায়না। এখনি তো বলার সময়।তাই বলি।আর তুমিও দুই বাচ্চার মা হয়ে এখনো কেনো এতো লজ্জা?”হঠাৎ ব্যাথা বেড়ে যাওয়ায় তৌসিফ কপাল কুঁচকে শব্দ করলে নিতু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে ওঠে।সেই সকালে ওঠার পর থেকেই বকবক করে যাচ্ছে। শরীরে হাত দিয়ে দেখে আবার জ্বর আসছে। তৌসিফ কিছু বলতে যাবে ওমনি নিতু মুখে হাত দিয়ে চুপ করতে বলে।ঔষধ খাইয়ে ঘুমাতে বলে। বাচ্চাদের নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে অন্য রুমে চলে যায়।যাতে তৌসিফ ঠিকমতো ঘুমাতে পারে।
বিকেল চারটার দিকে সালেহা বেগম আসে। সাজিদ এই বছর এইচএসসি দিয়েছে।এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পড়ছে আর সেতুর অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে ।ওদের পড়াশোনার জন্য সালেহা চাইলেও এসে নিতুর কাছে বেশিদিন থাকতে পারেনা।সেতুর কাবিন হয়েছে এক কলেজের লেকচারার এর সাথে। পরীক্ষা শেষ হলে অনুষ্ঠান করে তুলে নেবে। তুলি খালামনিকে দেখেই আহ্লাদে আরো গলে পরলো।আর নাহিন সেই যে মামার সাথে ঘুরতে বের হয়েছে আর আসার নাম নেই। নিতুর জন্য অবশ্য ভালোই হয়েছে।ও নিশ্চিন্তে তৌসিফ এর দেখাশোনা করছে।
প্রায় পনেরো দিন পরে সালেহা বেগম চলে যায়। তৌসিফ এখন আগের চেয়ে বেশ সুস্থ।এই কদিন সবাই মিলে বেশ আনন্দে কাটে।ভাই অসুস্থ শুনে জুঁই, সাদিয়া এসে ঘুরে যায়। ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে বেশ কষ্ট পায়।রাগী হলেও তপু আর তৌসিফ দুই ভাইকেই বোনেরা খুব পছন্দ করে,খুব ভালোবাসে।সাদিয়ার বিয়ে হয়েছে ছয় মাস আগে।ছেলে সরকারি চাকুরিজীবী।বেশ ভালো আছে।
এখন বাকি আছে বিথি ।বিথির বিয়েও ঠিক হয়ে আছে।ছেলে ব্যবসা করে।নিউ মার্কেটে দুটো দোকান আছে।ঢাকায় নিজেদের বাড়ি আছে আর কি লাগবে।ওর সামনে দ্বিতীয় বর্ষে ফাইনাল পরীক্ষা।শেষ হলেই বাড়িতে শুরু হবে বিয়ের আমেজ। সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।
নিতু দিনরাত সেবা করে তৌসিফ কে সুস্থ করে তোলে।হাতের ক্ষত শুকাতে বেশ সময় লাগে। তৌসিফ নিতুর ভালোবাসায়,যত্নে সুস্থ হয়। নিতুর প্রতি ওর ভালোবাসা,শ্রদ্ধা আরো বহুগুনে বেড়ে যায়। জীবনে নিতু কে ছাড়া যেনো তৌসিফ এখন অসহায়।প্রায় দুই মাস পরে আবার দোকানে যাওয়া শুরু করে।পাশের দোকানটা তৌসিফ কিনে নেয়। তবে সব বড় বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় সাথে করে তপু কে নিয়ে যায়। এবার তৌসিফ খুব মনোযোগ সহকারে ব্যবসা শুরু করে।
আজ বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক দিন পর আজ নিতু কে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে হয় তৌসিফ এর। ভালোবাসার মানুষটি গতো দুই মাস ধরে ওর কতোই না সেবা করলো।এক হাতে বাচ্চাদের স্কুল, সংসার সব সামলিয়েছে কোন প্রকার বিরক্তি ছাড়া। নিতুর উদারতা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তৌসিফ কে খুব মুগ্ধ করে।এতো ভালো কেউ হতে পারে? নানান ভাবনায় মত্ত থাকে ও।মনে মনে ঠিক করে নিতুর জন্য কোন উপহার কিনে নিয়ে যাবে। হঠাৎ খেয়াল হয় অনেক দিন নিতু কে কিছু কিনে দেয়না, বিয়ের পর কোথাও বেড়াতেও নিয়ে যায়না। সবাই বিয়ের পর কতো জায়গায় বেড়ায়। তৌসিফ এসবের কিছুই করেনা। তৌসিফ ঠিক করে এবছর শীত এলে নিতু কে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবে। সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাবে। নিতু শুনলে নিশ্চই খুব খুশি হবে।
আর আজ কি দেয়া যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা আইডিয়া আসে মাথায়। তৌসিফ আজ তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে শাড়ির দোকানে গিয়ে নিতুর জন্য একটা গোলাপী রঙের সুতি শাড়ি কেনে, ফুলের মালা কেনে।আজ একটু নিতু রানিকে সাজাতে মন চাচ্ছে।আর মন চাচ্ছে খুব ভালোবাসতে। বাচ্চাদের জন্যও টুকটাক কেনাকাটা করে তাড়াতাড়ি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তৌসিফ।
চলবে……