সুখের খোঁজে,পর্ব -২৭,২৮

0
331

#সুখের খোঁজে,পর্ব -২৭,২৮
#মৌমিতা হোসেন
২৭

বাইরে মুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।রাত দশটা বেজে গেছে এখনো তৌসিফ না ফেরায় চিন্তা হয় নিতুর।ঐ দিনের পর থেকেই একটু দেরি হলে দুশ্চিন্তা শুরু হয়। বাচ্চাদের খাইয়ে তৌসিফ কে ফোন দেয় নিতু। কিছুক্ষণ রিং হবার পর রিসিভ করে জানায় যে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। নিতু নিশ্চিন্ত হয়ে বাচ্চাদের ঘুম পারিয়ে তৌসিফ এর অপেক্ষায় বসে থাকে। বৃষ্টি থাকায় রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকে তাই তৌসিফ এর ফিরতে আজ এতো দেরি।রাত এগারোটায় কলিং বেল এর আওয়াজ শুনলেই নিতু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তৌসিফ ভিজে টুপটুপা। নিতু দেখেই বলে,”ভিজে একি অবস্থা হয়েছে আপনার? তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেরে ফ্রেশ হন।আজতো নির্ঘাত আপনার ঠান্ডা লাগবে।এতো ভিজলেন কি করে?”

“এক সাথে এতো কথা বললে উত্তর দেবো কীভাবে? আগে ব্যাগগুলো ধরো। বাইরে যেই বৃষ্টি গাড়িতেই ছিলাম।নেমে এটুকু আসতেই ভিজে এই অবস্থা। তুমি খাবার রেডি করো খুব খিদে পেয়েছে। আমি গোসল করে আসছি।”তৌসিফ সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। এদিকে নিতু ব্যাগগুলো রুমে নিয়ে রেখে আগে তৌসিফ এর কাপড় বের করে দেয় তারপর তাড়াতাড়ি খাবার গরম করে।এর মধ্যে তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে আসলে দুজন মিলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। খাওয়ার মাঝেই তৌসিফ বলে,”খাওয়া শেষ হলে তাড়াতাড়ি রুমে আসো। তোমার জন্য গিফ্ট আছে।”

নিতু খানিক অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,”এই বৃষ্টির মাঝে আপনি গিফ্ট কিনেছেন কোথা থেকে।এজন্যই আপনার এতো দেরি আজ?”

“বলতে পারো এজন্যই একটু দেরি। কতোদিন তোমাকে কিছু কিনে দেই না।আর এজন্য তুমিও কতোদিন আমাকে আদর করো না, কাছে আসো না তাই ভাবলাম বৌকে খুশি করতে কিছু গিফ্ট কিনে দেই।”কথাগুলো বলে তৌসিফ মিটমিট হাসতে থাকে।আর নিতু খাওয়া বন্ধ করে লজ্জায় কি বলবে খুঁজতে থাকে।মাথা নিচু করে খাবার নাড়াচাড়া করতে থাকে।

এমন সময়ে তৌসিফ আবার বলে,”এতো দিন হয়ে গেছে তবুও তুমি অল্পতেই এতো লজ্জা পাও কেনো বলোতো?অবশ্য লজ্জা পেলে তোমাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগে তখন আরো বেশি আদর করতে ইচ্ছে করে। ভাবছি নাহিন এর বয়স দু’বছর হয়ে গেছে এখনি যদি আরেকজন বাবু আনা যায় তাহলে…..।”

নিতু আর চুপ থাকতে পারেনা।বলে,”ধ্যাত, আপনাকে নিয়ে আর পারা যায়না। দিন দিন এতো নির্লজ্জ হচ্ছেন কেনো বলুনতো?”

তৌসিফ নিতুর দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”আজ আবার একটু নির্লজ্জ হতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই।আর অনেক দিন তো না ভালোবেসে তোমায় শান্তি দিলাম আজ নাহয় একটু ভালোবেসে শান্তি দেই?”

তৌসিফ এর চোখে আজ অন্য রকম আকুতি, আবদার, অধিকার।এই আকুতি উপেক্ষা করার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই নিতুর নেই। নিতু লাজুক হাসি হেসে কোন রকম খাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে রুমে যায়। তৌসিফ বাচ্চাদের পাশে বসে ওদের কপালে আদর দিচ্ছিলো।এমন সময় নিতু কে দেখে শাড়ি আর ফুলের মালাটা এগিয়ে দিয়ে দুষ্টুমির স্বরে বলে ,”আজ তাহলে তোমার মনেও একই তোলপাড় চলছিলো?”

নিতু ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,”মানে?”

“মানে এজন্য আমার কলিজার টুকরোদের আজ তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছো? তুমিও একাকী আমার সঙ্গ পেতে চাও?যাক ভালোই হলো। আমি পাশের রুমে অপেক্ষায় আছি তুমি শাড়িটা পরে আসো।”

নিতু লজ্জা পেয়ে সামনে থেকে যেতে নিলে তৌসিফ হাত ধরে টেনে নিজের কাছে এনে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”খোঁপায় মালা আর চোখে কাজল পড়তে ভুলো না যেনো লাজুক বৌ।”

তৌসিফ পাশের রুমে অপেক্ষায় থাকে নিতুর। এদিকে নিতুও অনেক দিন পর আজ একটু আয়নায় নিজেকে দেখে।বাচ্চা, সংসার নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয়।আর গতো দুমাস তৌসিফ কে নিয়েই সারাক্ষন ব্যস্ত ছিলো।এর মাঝে নিজের দিকে নজর দেবার সময়ই পায়নি। চেহারায় কেমন ক্লান্তির ছাপ, এলোমেলো চুল। নিজেকে আয়নায় দেখে নিতু খানিকটা বিরক্ত হয়।মনে মনে বলে,”এতো সুন্দর মানুষ টার পাশে সত্যি আজ আমি বেমানান। আজ নিজেকে একটু সাজাতেই হবে।”শাড়িটা বের করে দেখে খুব খুশি হয়।শাড়ি পরে চুল আঁচড়ে খোঁপায় ফুলের মালা পড়ে। চোখে কাজল, হালকা লিপস্টিক এতেই নিজেকে বেশ পরিপাটি মনে হয়। এভাবে তৌসিফ এর সামনে যেতে বেশ লজ্জা বোধ করে।

রাত প্রায় একটা বাজে নিতু পাশের রুমে তৌসিফ এর কাছে যায়। গিয়ে দেখে তৌসিফ কপালে হাত রেখে শুয়ে আছে।মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পরেছে।এটা দেখে নিতুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। অনেক আগেই রেডি হয়ে আসতে নেয় এর মাঝেই নাহিন ঘুম থেকে উঠে গেলে ওকে ঘুম পাড়াতে সময় লাগে।আর তাই দেরি হয়। নিতু তাই আর কোন কথা না বলে তৌসিফ কে কিছুক্ষণ দেখে আস্তে করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে থাকে। বৃষ্টির পানি এসে মুখে পরছে, কিছু সময় পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ঠান্ডা বাতাসে শীত শীত লাগছে।সব মিলিয়ে বেশ ভালো লাগে নিতুর। নিতু ভাবে, সারাদিন মানুষ টা কতো কষ্ট করেছে তাই ঘুমিয়ে যখন পরেছে তখন আজ আর তার ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। তাকে ঘুমাতে দেয়া উচিত।

এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কোমরে কারো হাতের স্পর্শে শিহরিত হয় নিতু।ও বুঝতে পারে যে তৌসিফ জেগেই আছে। তৌসিফ নিতু কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে দিয়ে বলে,”এতোক্ষণে আসার সময় হলো?”

নিতু কাঁপা কন্ঠে বলে,”নিহান উঠে গিয়েছিলো। ওকে ঘুম পাড়াতে দেরি হয়ে গেলো।আর আপনি ঘুমাননি এখনো?আমি ভেবেছি আপনি ঘুমিয়ে পরেছেন।”

তৌসিফ নিতুর সামনে এসে বলে,”না ঘুমাইনি। ঘুমিয়ে পরলে এতো সুন্দরী বৌকে দেখতাম কীভাবে বলো?মাশাআল্লাহ! আমার বৌকে পুরো পরীর মতো লাগছে।”

নিতু খুব লজ্জা পায়। তৌসিফ নিতুর কপালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,”অনেক ধন্যবাদ নিতু। আমার জীবনে এসে জীবনটাকে এতো রং দিয়ে রঙিন করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। অনেক ভালোবাসি তোমাকে।”

নিতু ও বলে,”আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”

বাহিরে সারারাত ধরে তুমুল বৃষ্টি হয়েছে।আজ যেনো বৃষ্টি বন্ধ হবার নামই নিচ্ছেনা।তেমনি তৌসিফ নিতু কে সারারাত ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে।এই ভালোবাসার যেনো কোন শেষ নেই। দু’জনই পুরো রাত জুরে একে অপরকে ভালোবাসা দেয়া নেয়ায় মেতে থাকে। ভোরবেলা নাহিনের কান্নার শব্দে নিতু তাড়াতাড়ি উঠে যেতে নিলে দেখে তৌসিফ নিতু কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।হাত সরাতে নিলেই তৌসিফ বিরক্ত হলে নিতু আস্তে করে বলে,”নাহিন উঠে গিয়েছে।হাত সরান যেতে দিন।”

তৌসিফ একটু বিরক্ত হয়ে বলে,”বাবাটা আজকাল শান্তিতে তোমায় আদরটাও করতে দেয়না। অনেক হিংসুটে হয়েছে।”

তৌসিফ এর কথা শুনে নিতু হেসে দেয়। তাড়াতাড়ি তৌসিফ এর হাত সরিয়ে উঠে কাপড় ঠিক করে নাহিন এর কাছে চলে যেতে নিলে তৌসিফ ডেকে বলে,”ঘুম পারিয়ে আবার আমার কাছে আসো নিতু। তোমাকে আমার আরো লাগবে। তোমাকে জড়িয়ে ধরে আরো কিছু সময় ঘুমাতে চাই ।”

নিতু লাজুক হেসে চলে যায়।এভাবেই বেশ হাসি আনন্দেই দুজনের সংসার জীবন কাটতে থাকে। সুখের খোঁজ যেনো পেয়েই গিয়েছে দু’জন। নিতু শুধু দোয়া করতো এই সুখের অনুভুতি যেনো কখনো না হারিয়ে যায়।

কেটে যায় আরো পাঁচটি বছর।এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়। তপুর আরো একটা ছেলে হয়।প্রথম বাচ্চাকে এই বছর স্কুলে দিয়েছে।বৌ বাচ্চা নিয়ে বেশ ভালোই আছে তপু।

সাদিয়া,বিথি, জুঁই তিনজনই ওদের সংসার জীবনে বেশ ভালো আছে। বিথির জমজ ছেলে।বয়স তিন বছর।আর জুঁই এর এক ছেলে এক মেয়ে।সাদিয়ার এখনো বাচ্চা হয়নি।ডাক্তার দেখাচ্ছে। একটু সমস্যা আছে তাই কনসীভ হচ্ছেনা।

সেতুর এক ছেলে বয়স তিন বছর।আর সাজিদ মাস্টার্স দেবে এবার।চাকরিও খুঁজছে।চাকরি পেলে সালেহাকে আর সেলাই করতে দেবে না। পুরোপুরি রেস্ট এ চলে যাবে।সবাই যার যার মতো বেশ ভালোই দিন কাটাচ্ছে।

তুলি এখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী।আর নাহিন প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। তৌসিফ আর নিতুর ঘরে এখন আরো একজন নতুন সদস্য আছে।তুলি আর নাহিন এর জন্য ছোট এক ভাই নিয়ে এসেছে তৌসিফ আর নিতু।বয়স তিন বছর। দেখতে একেবারে তৌসিফ এর মতো।ছোট ছেলের নাম রেখেছে নিরব। এদিকে তৌসিফ এর ব্যবসা বেশ ভালো চলছে। নিতুর নামে একটা জায়গা কিনেছে । ভাবছে আরেকটা দোকান কিনবে। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে তৌসিফ।বাসায় যেকোন অনুষ্ঠানে সবাই একসাথে হয়,বেশ হাসি আনন্দে দিন কাটতে থাকে সবার।

নিতু আর তৌসিফ এর ভালোবাসা দিনদিন যেনো বেড়েই চলছে।একজন অন্যজনকে ছাড়া এখন কোন কিছু কল্পনাই করতে পারেনা।কিন্তু নিতুর কপালে হয়তো আল্লাহ সুখ বেশি দিন স্থায়ী রাখেনি ।বেশ কিছু দিন ধরে তৌসিফ এর শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা।এমন সুঠাম দেহের মানুষটা আগের চেয়ে অনেক রোগা হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করতে পারছে না। খাবারে অরুচি তৈরি হচ্ছে। বেশিক্ষণ কাজ করলেই কাহিল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসবের কিছুই নিতুকে জানায়নি তৌসিফ।কারন ও অল্পতেই অনেক টেনশন করে।আর দেখা যাবে ডাক্তার এর কাছে যেতে বলবে যেটা তৌসিফ এর জন্য সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ। ছোটবেলা থেকেই কেনো জানি হাসপাতাল,ডাক্তার ,ঔষধ এসবে অনীহা। তাই খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তৌসিফ নিজের জন্য ডাক্তার এর কাছে যায়না। তাছাড়া তৌসিফ ভেবেছে অতিরিক্ত কাজের প্রেশারে হয়তো এমনটা হচ্ছে।তাই বিষয়টা ততোটা গুরুত্ব দেয়না।

নিতুর নজরে অবশ্য বিষয়টা এড়ায়নি।তাই আজ সকালে নাস্তার টেবিলে নিতু বলে,”আপনার শরীর কি খারাপ? ক’দিন ধরে দেখছি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছেন না,কেমন দুর্বল লাগছে দেখতে।”

যেই ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হলো। তৌসিফ মনে প্রানে চাচ্ছিলো যে নিতু যেনো বিষয়টা খেয়াল না করে। তৌসিফ নাস্তা খেতে খেতে বললো,”তেমন কিছু না বৌ। অতিরিক্ত কাজের ঝামেলায় হয়তো এমন লাগছে। নতুন দোকানের কাজ শেষ হলেই দেখবে ঠিক হয়ে গিয়েছি।তখন টানা কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে নেবো।”

“এসব বাহানা করে লাভ নেই।আজ বিকেলে একটু ডাক্তার দেখান। আপনাকে দেখতে কেমন রোগী মনে হচ্ছে।”

“আচ্ছা দেখা যাবে।”বলে তৌসিফ চেয়ার ছেড়ে উঠে নিতুর কাছে গিয়ে ওর কপালে আদর দেয়।আর দোকানের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। নিতু কে আর কোন কিছু বলার কোন সুযোগ দেয়না। নিতু জানতো যে তৌসিফ কে ডাক্তার দেখাতে বললে ও এমনটাই করবে।তাই নিতু একটু হতাশ হয়ে বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য রেডি হতে চলে যায়।

চলবে……..

#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -২৮)
#মৌমিতা হোসেন

নিতু সারাদিন বাচ্চা, সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও তৌসিফ কে নিয়েও মনে মনে চিন্তা হতে থাকে ।আজ সকালে যাওয়ার পর থেকে তৌসিফ একবারও ফোন দেয়না।তাই নিতুর খুব চিন্তা হয়। দুপুরে নিতু ফোন দিলে দোকানের এক কর্মচারী ফোন রিসিভ করে বলে যে,তৌসিফ আজ ব্যস্ত।পরে ফ্রি হয়ে ফোন দেবে। এতে নিতুর বেশ মন খারাপ হয়। নিতু বুঝতে পারে ডাক্তার এর কাছে যাওয়ার কথা বলেছে বলেই তৌসিফ এমন করছে।তাই কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দেয়।

এদিকে তৌসিফ সত্যি আজ খুব ইচ্ছে থাকলেও নিতুর ফোন রিসিভ করেনি। প্রতিদিন কয়েকবার ফোন করে নিতুর সাথে কথা বলবে এটাই যেনো নিয়ম হয়ে গেছে।আজ তাই একটু অস্থির লাগছিলো। তবে ঐ যে ডাক্তার এর কাছে যেতে হবে তাই এড়িয়ে গেছে।

বিকেলে নিতু আবার তৌসিফ কে ফোন দেয় কিন্তু ঐ সময়ে ও সত্যি ব্যস্ত থাকায় নিতুর সাথে কথা বলতে পারেনি।কাজ শেষ করে রওনা দেয়ার আগে তৌসিফ নিজেই ফোন দেয় নিতু কে। নিতু তখন ছোট বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত। তৌসিফ এর ফোন দেখেই রিসিভ করে বলে,”আসসালামুয়ালাইকুম। এতোক্ষনে আপনার সময় হলো ফোন করার?”

“রাগ করোনা নিতু।আজ খুব ব্যস্ত ছিলাম। সত্যি বলছি।”

“বুঝতে পেরেছি।আর বলতে হবে না। আপনি কেনো সারাদিনে ফোনে কথা বলেননি সেটা আমার জানা আছে।”

“আচ্ছা এই বিষয়ে আমরা বাসায় এসে কথা বলি। আমি এখন রওনা দেবো।”

“আচ্ছা সাবধানে আসবেন।”বলে নিতু ফোন রেখে তৌসিফ এর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকে।

তৌসিফ এর বাড়ি ফিরতে রাত নয়টা বেজে যায়। তৌসিফ কে দেখতে খুব দুর্বল লাগছিলো। তৌসিফ কে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসতে বলে নিতু রান্নাঘরে চলে যায়। খাবার গরম করে। তৌসিফ খেতে বসে খাবার নেড়েচেড়ে বলে,”খেতে ভালো লাগছে না নিতু।”

“কেনো রান্না ভালো হয়নি?”

তৌসিফ এর শরীর একটু বেশি খারাপ লাগছিলো। তাই নিজ থেকেই বলে,”জানিনা তবে কিছুদিন ধরে কিছুই মজা লাগছে না। খেতে নিলেই বমি পাচ্ছে। তুমি অযথা টেনশন করো তাই তোমাকে ইচ্ছা করে বলিনি।ভাত খাবো না। তুমি বরং খেয়ে আমাকে এক গ্লাস লেবুর শরবত দাও দেখি ভালো লাগে কিনা।”তৌসিফ হাত ধুয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পরে।

নিতুর গলা থেকেও আর খাবার নামে না।সব গুছিয়ে রেখে তৌসিফ এর জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে যায়।রুমে গিয়ে দেখে তৌসিফ ঘুমিয়ে পরেছে। নিতু রুমে না যাওয়া পর্যন্ত তৌসিফ সাধারণত ঘুমায় না।আজ তাই তৌসিফ এর চেহারায় এতো ক্লান্তি দেখে বেশ খারাপ লাগছে । কিছুটা টেনশন হচ্ছে। মনে মনে ঠিক করে কাল যেভাবে হোক ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাবে।সরবতের গ্লাস টেবিলে রেখে তৌসিফ এর পাশে শুয়ে নিতুও ঘুমিয়ে পরে।

খুব ভোরে পাখির ডাকে নিতুর ঘুম ভাঙে।আজ আকাশ কিছুটা পরিস্কার। বারান্দা বৃষ্টির পানিতে ভেজা। নিতু নামাজ পরে বারান্দায় একা বসে সকালটা উপভোগ করতে থাকে। তৌসিফ এর সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্ত গুলো মনে করে আর একা একা হাসতে থাকে।রাহেলা খালা আসলে নাস্তা রেডি করে বাচ্চাদের রেডি করিয়ে স্কুলে দিয়ে আসে।স্কুলে নেয়ার দায়িত্বটা ছোট বাবু আসার পর থেকে তৌসিফ নিজেই পালন করে। কিন্তু আজ তৌসিফ অসুস্থ থাকায় নিতু আর ওকে ডাকেনি।নিতুই নিয়ে যায়। বাসায় এসে দেখে তৌসিফ ঘুম থেকে উঠে গেছে। নিতু পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে ,”শরীরের কী অবস্থা?”

“এইতো ভালো। তুমি আজ আমাকে ডাকোনি কেনো? আমি নিয়ে যেতাম ওদের।আর শরীরের কথা জিজ্ঞেস করছো কেনো বলোতো?”

নিতু কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলে,”আপনার শরীর ভালো না তাই আপনাকে ডাকিনি।আজ আপনি ডাক্তার এর কাছে যাবেন। আমি আজ আপনার কোন কথাই শুনবো না।”

তৌসিফ নিতুর হাত ধরে টেনে পাশে বসায়, গালে দুহাত রেখে বলে,”এতো টেনশন করো কেনো বলোতো?তেমন খারাপ লাগলেতো আমি নিজেই ডাক্তার এর কাছে যেতাম।টেনশন করে আমার গুলুমুলু বউটার মুখটা অন্ধকার করে রাখলে আমার ভালো লাগে বলো?”

নিতু তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে ওমনি তৌসিফ নিতুর ঠোঁটে চুমু খায়। নিতু অপ্রস্তুত হয়ে পরে।সরে যেতে নিলে তৌসিফ নিতু কে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বলে,”বাবুটা ঘুমাচ্ছে। তোমাকে একটু আদর করি? একটু ভালোবাসি?”

নিতু লজ্জা পেয়ে তৌসিফ এর পাশে থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে বলে,”খালা বাসায়।আর ছোট বাবু এখনি উঠে যাবে জনাব। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। অসময়ে নয়।”

তৌসিফ নিতুর দিকে আগাতে থাকে আর বলে,”খবরদার বৌ দরজার বাইরে যাবে না। যেখানে দাঁড়িয়ে আছো সেখানেই থাকো।আর ভালোবাসা মাঝে মাঝে অসময়ে হলে ক্ষতি কি?”

নিতু লাজুক কন্ঠে বলে,”কোন ক্ষতি নেই। তবে এখন অনেক কাজ আর বাবু উঠেই যাবে। আমি যাই আমার কাজ আছে।”

তৌসিফ নিতুর কথা শেষ হবার আগেই ওর হাত ধরে কাছে টেনে বলে,”তোমার এই ছোটাছুটির অভ্যাস আর গেলো না। বুড়ো হলেও কি এমন করবে?এখন নাহয় শক্তি আছে তাই তোমায় ধরতে পারি। বুড়ো হলে তো শরীরে শক্তি থাকবে না।তখন তোমায় আটকাবো কীভাবে?”কথা শেষ করে কাছে যেতে নিলেই নীরব কেদে ওঠে।আর ঐদিকে রাহেলা খালাও নিতু কে ডাক দেয়। এই অবস্থা দেখে তৌসিফ, নিতু দুজনই উচ্চস্বরে হেসে দেয়।দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে।

নিরব এর কান্নার গতি বাড়তে থাকলে নিতু তাড়াতাড়ি ওকে কোলে নিয়ে ঠান্ডা করে।ঐ দিকে রাহেলা খালা ডাকতে থাকে। তৌসিফ এর কাছে নিরবকে রেখে নিতু রান্না ঘরে যায়। তৌসিফ আজ আর সকালে দোকানে যায়না। নিতু যেতে দেয়না আর ওর নিজেরও যেতে ইচ্ছে করেনা। খুব দুর্বল লাগছে আজ। কিন্তু নিতু কে ব্যাপারটা বুঝতে দেয়না।

দুপুরের পরে দোকানে যেতে নিলে নিতু বলে,”আজ যাওয়ার দরকার নেই।আজ বিকেলে ডাক্তার এর কাছে যাবেন।”

“কি এমন হয়েছে যে ডাক্তার এর কাছে যেতে হবে? আমি ভালো আছি নিতু। এতো দুশ্চিন্তা করোনা তো। তবে তুমি যখন বলছো তখন সময় করে একদিন যাবো।”

নিতু খুব মন খারাপ করে বলে,”সেই একদিন টা আজ হলে ক্ষতি কি? আপনার চেহারা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে।প্লিজ একবার চলুন।”

তৌসিফ নিতু কে জড়িয়ে ধরে বলে,”যাবো বললাম তো বৌ।আজ অনেক কাজ দোকানে। সকালে যাইনি।এখনো দেরি করে যাচ্ছি। বিকেলে আর বের হতে পারবো না নিতু রানি।”

নিতু জানে যে এখন যতোই বলুক তৌসিফ যাবেনা।তাই আর কিছু বলেনা। কিছুটা অভিমান করে চুপ থাকে। তৌসিফ নিতুর কপালে আদর দিয়ে বলে,”একটু হাসি দাও না।এতো সুন্দর চেহারা যদি এমন প্যাচার মতো করে রাখো তাহলে ভালো লাগে বলো?”

নিতু মলিন চেহারা নিয়ে তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”হাসি আসছেনা আমার। খুব চিন্তা হচ্ছে আপনাকে নিয়ে।অথচ আপনি কথাই শুনতে চাচ্ছেন না।এমন করলে হয়?”

“হয়।এমন মলিন চেহারা নিয়ে থেকো নাতো।ডাক্তার দেখাতে গেলে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যাবো।এতো এতো টেস্ট,অযথা এতো এতো ঔষধ উফফ ভাবতেই বিরক্ত লাগছে আমার।আর শরীর তেমন বেশি খারাপ লাগলে তো যাবোই।”

নিতু তৌসিফ এর বুকে মাথা রেখে বলে,”মনে রাখবেন।এরপর যখন আমি অসুস্থ হবো তখন আমিও আপনার কথা শুনবো না।ডাক্তার এর কাছে যাবো না। কিছুতেই না।”

তৌসিফ নিঃশব্দে হাসে আর বলে,”ঠিক আছে সময় হলে দেখা যাবে।এখন একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আমায় বিদায় দাও।”

নিতু একটা হাসি দিয়ে বলে,”এবার হলো?”

“হুম হলো।”তৌসিফও হাসি দিয়ে বিদায় নিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নিতু আবার ওর কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে।

বেশ কয়েকটি দিন এভাবেই কেটে যায়।নিতু ও কয়েকবার ডাক্তার এর কাছে যাওয়ার কথা বলে । কিন্তু তৌসিফ যেতে না চাওয়াতে আর বলেনা। তৌসিফ এর ওজন আরো কমতে থাকে, চেহারা দেখলেই মনে হয় ও অসুস্থ, খাবারে দিন দিন অরুচি আসতে থাকে। তবুও ডাক্তার ভীতি সহ বিভিন্ন কারনে তৌসিফ আর ডাক্তার এর কাছে যায়না।

নিতু কে কাল হঠাৎ চাচিরা সবাই বলে , তৌসিফ এভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে কেনো? ওকে যেনো ডাক্তার কাছে নিয়ে যায়।তখন ত্রনিতুর হঠাৎ তপুর কথা মাথায় আসে।তাই কাজের ফাঁকে তপুর সাথে দেখা করতে যায়। তপু হঠাৎ ওর বাসায় নিতুর আগমনে বেশ অবাক হয়।বলে,”কি ব্যাপার নিতু? তুমি আমার বাসায়?কোন সমস্যা হয়েছে কি?”

নিতু সালাম জানিয়ে বলে ,”ভাইয়া একটা দরকার ছিলো। একটু সাহায্য করতে পারবেন?”

“হুম বলো। নিশ্চই করবো।”

“ভাইয়া উনি বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ। কিছু খেতে পারেনা। খুব দুর্বল। আমি কোনভাবেই তাকে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যেতে পারছিনা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তার ডাক্তার দেখানো উচিত। আপনি যদি ওনাকে একটু বলতেন। এ ব্যাপারে আমার কোন কথাই শুনতে চাচ্ছেনা।”

তপু বেশ চিন্তায় পরে যায়। তৌসিফ সারাক্ষন থাকে দোকানে।আর তপু থাকে অফিসে।অফিসের ব্যস্ততা,বৌ বাচ্চা সব সামলে বেশ কিছুদিন ধরে তৌসিফ এর সাথে দেখা হয়না ওর।এর মধ্যে তপুর বৌ এসে বলে,”হ্যা ভাবি সেদিন তৌসিফ ভাইকে দেখে আমিও বলতে চেয়েছিলাম যে, ভাইয়া অসুস্থ কিনা।কেমন রোগা হয়ে গেছে।ডাক্তার দেখাতে বলেন।”

নিতু হতাশার স্বরে বলে,”এজন্যইতো তপু ভাইয়ের কাছে এসেছি।ভাইয়ার কথা যদি শোনে।ডাক্তার এর ব্যাপারে উনি বরাবরই উদাসীন।আর অনেক ভীতু।”

দুজনের কথা শুনে তপু একটু বিরক্ত হয়ে বলে,”তৌসিফ এর শরীর ভালো না।আর এই কথাটা তোমরা আমাকে এতো দেরীতে বলছো? আশ্চর্য ব্যাপার।আচ্ছা সমস্যা নেই। আমি দেখছি ব্যাপারটা। নিতু তুমি তৌসিফ রাতে বাসায় এলে আমাকে একটা ফোন দিও ।আর কালতো বন্ধ আছে।দেখি ওকে নিয়ে কাল ডাক্তার এর কাছে যেতে পারি কিনা।”

“আচ্ছা ঠিক আছে ভাইয়া। আমি তাহলে এখন আসি।বাসায় বাবুরা একা।”

“ঠিক আছে যাও।আর জানিও।”তপু নিতু কে বিদায় জানিয়ে বেশ চিন্তায় পরে যায়।

নিতু তপু কে বলতে পেরে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বাসায় যায় আর তৌসিফের অপেক্ষা করতে থাকে। তৌসিফের আজ ফিরতে রাত নয়টা বেজে যায়।আজ ওকে আরো বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছিলো। তৌসিফ কে দেখে নিতুর খুব খারাপ লাগে। তাড়াতাড়ি এক গ্লাস সরবত এনে দিয়ে তপু ভাইকে ফোন দিয়ে জানায়।

তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে এলে দেখে যে ওর রুমে তপু বসে আছে। তপু কে দেখে তৌসিফ খুব অবাক হয়।বলে,”কি ব্যাপার তপু তুই এই সময়ে?”

তপু নাহিন আর নিরব এর সাথে খেলছিলো। তৌসিফ এর শব্দ পেয়ে ওর দিকে তাকাতেই বেশ চমকে যায়।একই বিল্ডিং এ থাকলেও গতো প্রায় দুই তিন সপ্তাহ ওদের দেখা হয়না।কারন মাঝে তপু অফিসের কাজেও বেশ কিছুদিন ঢাকার বাইরে ছিলো।আজ রোগা,ক্লান্ত তৌসিফ কে দেখে তাই তপু বেশ অবাক হয়।ওর মনের মধ্যে খারাপ কিছু ঘটার আভাস পায়।এতো সুঠাম দেহের অধিকারী ভাইয়ের মাত্র এই কদিনে শরীরের এই অবস্থা যে কেনো কারো চোখে লাগার মতো ছিলো। এসব ভাবনার মধ্যে তৌসিফ তপুর সামনে এসে কাঁধে হাত রেখে বলে ,”কিরে কোন ধ্যানে হারিয়ে গেলি?কি হয়েছে? অনেক দিন পর দেখা হলো তোর সাথে।কোথায় নাকি গিয়েছিলি?”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here