সুখের খোঁজে,পর্ব -২৯,৩০

0
471

#সুখের খোঁজে,পর্ব -২৯,৩০
#মৌমিতা হোসেন
২৯

তপু উত্তরে বলে,”হুম অফিসের কাজে কিছুদিন ঢাকার বাইরে ছিলাম।কাল এসেছি। অনেক দিন তোর সাথে দেখা হয়না তাই চলে এলাম গল্প করতে।”

তৌসিফ চুল ঠিক করে তপুর পাশে খাটে শুয়ে পরে।বলে,”ভালো করেছিস। ভালো লাগছে না খুব ক্লান্ত লাগছে কয়দিন ধরে।খেতে পারছি না।”

“তোর এমন অবস্থা হয়েছে কেনো?তুই কি নিজেকে আয়নায় দেখেছিস ?এই কদিনেই এতো রোগা হয়ে গিয়েছিস কেনো?ডাক্তার দেখাসনা কেনো?”

তৌসিফ সবটা বুঝতে পেরে হেসে বলে,”নিতু এনেছে তোকে? মেয়েটা কেনো যে এতো অস্থির!!”

তপু একটু বিরক্ত হয়ে বলে,”নিতু একা অস্থির হবে কেনো? তোকে দেখে তো আমারই অস্থির লাগছে।কাল আমরা ডাক্তার এর কাছে যাবো। আমি সকালেই এপোয়েনমেন্ট নিয়ে রাখবো।”

তৌসিফ একটু হেসে বলে,”আরে ভাই এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেনো?তেমন কিছু হয়নি।ডাক্তার দেখাতে হবে না।”

নিতু সেই সময় ঘরে ঢোকে।সব শুনে কিছুটা অধিকার নিয়ে জোর গলায় ও বলে,”অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। কালকেই ডাক্তার দেখাবেন।”

ভাই আর বৌ এর জোড়াজুড়িতে তৌসিফ শেষমেষ রাজি হয়। দুই ভাই বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তপু কে নিতু অনেক খেতে বললেও খায়না।কারন তৌসিফ কে দেখে মুখে হাসি নিয়ে কথা বললেও মনে মনে খুব চিন্তায় পরে গিয়েছে তপু।

তৌসিফ আজকেও খেতে বসে একটু খেয়ে আর খেতে পারলো না।নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”খেতে পারছিনা নিতু।বমি পাচ্ছে। আমি বসি তুমি খাও।”

“আজকাল প্রায়ই আপনি এমনটা করছেন। এভাবে না খেলে হবে?দুপুরেও আজকাল ঠিকমতো খাননা।সব খবরই কিন্তু আমার কাছে আসে।”

তৌসিফ একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,”তুমি কি আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছো?যাই হোক সব কিছুই হচ্ছে অতিরিক্ত কাজের প্রেশারে।”

নিতু একটু জোর খাটিয়ে বললো,”আপনি যা বললেন বুঝলাম। তবে কাল ডাক্তার দেখাতে হবে।”

“ঠিক আছে নিতু রানি যাবো ডাক্তার এর কাছে।” এসব বলার মাঝেই হঠাৎ তৌসিফ এর বেশি খারাপ লাগলে দ্রুত বেসিন এর কাছে যায়। বমি হয় সাথে নাক থেকে রক্ত পড়তে থাকে।রক্ত দেখে তৌসিফ ভয় পেয়ে যায়। দুর্বল অবস্থায় তাড়াতাড়ি কল ছাড়ে যাতে নিতু দেখতে না পায়। কিন্তু তার আগেই নিতু এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। নিতু ভয় পেয়ে একরাশ চিন্তা নিয়ে তৌসিফ কে দেখতে থাকে। মস্তিষ্ক খারাপ কিছু ইঙ্গিত দেয় । তাড়াতাড়ি তৌসিফ কে ধরতে গিয়ে দেখে ওর শরীরে জ্বর। নিতু তৌসিফ এর মুখ ধোয়ার পর ওকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। তৌসিফ ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়ে।

রাতে নিতুর আর খাওয়া হয়না।সব গুছিয়ে রুমে গিয়ে দেখে তৌসিফ ঘুমিয়ে পড়েছে।নিতু ও গিয়ে তৌসিফ এর পাশে শুয়ে পরে। কিন্তু কিছুতেই আজ ঘুমেরা চোখে ধরা দেয়না।ভোরের দিকে কখন যেনো ঘুমিয়ে পরে নিতু।পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে নিতুর।চোখ খুলে দেখে তৌসিফ ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। নিতু আস্তে করে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা রেডি করতে যায়।তার আগে তুলি আর নাহিন কে দেখে যায়। দুই ভাই-বোন এখন আলাদা রুমে ঘুমায়।বড় হয়েছে তাছাড়া এক বিছানায় জায়গাও হয়না। নিতুর অবশ্য এতে মনের মধ্যে খুব খচখচ করে। রাতে দুই তিন বার এসে দেখে যায়।কাল তৌসিফ কে নিয়ে চিন্তায় আর ভালো লাগছিলো না তাই আর ওদের দিকে মনোযোগ ছিলোনা। রুমে গিয়ে দেখে দুই ভাই-বোন ঘুমে বিভোর।ভাবে এরই মধ্যে কতো গুলো বছর কেটে গেলো।এতো সুন্দর একটা পরিবার,এমন রাগে কটকট করা মানুষটা আজ কতো সহনশীল হয়েছে।হুট করেই এখন আর রাগ করেনা।সংসারের প্রতি কতো মনোযোগী হয়েছে। সবাইকে কতো ভালোবাসে।ভাবলে স্বপ্ন মনে হয়।আজ তৌসিফ এর চিন্তায় ভালো লাগছে না।ডাক্তার দেখানোর আগে এই অশান্ত মনটা আর শান্ত হবে না।

এর মধ্যে রেহানা খালা আসলে দু’জন মিলে খাবার রেডি করে।বন্ধের দিন থাকায় সবাই দেরি করে ওঠে। তৌসিফ কে আজ সকাল থেকেই একটু অন্যরকম লাগছে।চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।শরীর যে খারাপ লাগছে বোঝা যাচ্ছে। নিতু কপালে হাত দিয়ে দেখে এখন জ্বর নেই। সবাই একসাথে বসে নাস্তা খায়। তবে তৌসিফ এর খাওয়ার ব্যাপারে কোন আগ্ৰহ ছিলোনা। তৌসিফ একটু খেয়ে ওর রুমে চলে যায়।আসোলে রাতে নাক থেকে রক্ত পড়ার পর থেকে ও খুব চিন্তায় আছে।তাই কিছু ভালো লাগছেনা।

নিতু তৌসিফ এর ব্যাপারটা বুঝতে পারে। বাচ্চাদের খাওয়ানো শেষ করে রুমে গিয়ে দেখে তৌসিফ চুপচাপ শুয়ে আছে।বন্ধের দিন এমন সময়ে ও বাচ্চাদের নিয়ে হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকে।আর আজ….যাই হোক নিতু তৌসিফের পাশে গিয়ে বসে কপালে হাত দিয়ে বলে,”শরীর বেশি খারাপ লাগছে? নাস্তা খেলেন না কেনো?”

“না তেমন কিছু না। ভালো লাগছে না কোন কিছু।আর খেতে ইচ্ছেই করেনা। খেতে নিলেই বমি পায়।”

“আজ ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ খেলেই দেখবেন ভালো হয়ে যাবেন।এতো টেনশন নিয়েন না। বাচ্চারা সবাই আপনার হৈ হুল্লোড় দেখার জন্য অপেক্ষায় আছে পাঠিয়ে দেই?”

তৌসিফ বুঝতে পেরে বলে,”হুম দাও। আমি ঠিক আছি।”

“আর দুপুরে কি খাবেন বলুন।আজ আপনার পছন্দে রান্না হোক।”

তৌসিফ হেসে নিতুর গালে হাত রেখে বলে,”আজ আমার বৌ যা রাঁধবে আমি তাই খাবো।”

নিতুর মনে মনে দুশ্চিন্তা থাকলেও কিছু বুঝতে দেয়না।বলে,”আচ্ছা ঠিক আছে। নিতু বাচ্চাদের ডেকে তৌসিফ এর কাছে বসিয়ে রেখে রান্নায় চলে যায়। বিকেলে তপু এসে তৌসিফ আর নিতু কে নিয়ে এলাকায় এক হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তার দেখায়।ডাক্তার সব শুনে বেশ কিছু টেস্ট দেয়।আর রিপোর্ট নিয়ে আবার দেখা করতে বলে।ডাক্তার তৌসিফ আর নিতু কে বাইরে পাঠিয়ে তপু কে বললো যে ,সে খারাপ কিছু সন্দেহ করছে। তবে মন থেকে চাইবে যেনো তার সন্দেহ ভুল হয়।তপু ডাক্তার এর কথা শুনে খুব চিন্তায় পরে যায়।

সব টেস্ট করিয়ে বাসায় ফিরতে ওদের রাত হয়। নিতু কয়েকবার তপু কে জিজ্ঞেস করে যে ডাক্তার কি বলেছে। কিন্তু নিতু দুশ্চিন্তা করবে তাই আর বলেনি। এদিকে তৌসিফ ও খুব চিন্তায় পরে যায়। শরীরটাও খুব ক্লান্ত লাগে তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরে। দুজনের মাঝে রাতে আর তেমন কোন কথা হয়না।

রিপোর্ট দেয়ার কথা দুই দিন পর।এই দুই দিন তৌসিফ সকাল হলেই দোকানে চলে গেছে। তবে শরীর খারাপ লাগায় দোকান থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। তৌসিফের বারবার মনে হচ্ছিলো খারাপ কিছু হয়েছে।কারন ওর শরীর প্রচন্ড খারাপ লাগছে গতো কদিন ধরে। কিছু সমস্যা গতো এক সপ্তাহ ধরে হচ্ছে যেমন,নাক থেকে রক্ত পড়া, পেটে ব্যাথা, প্রচন্ড ক্লান্তি।এসব দেখে প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও ঐ দিন ডাক্তার এর কথার ধরনে তৌসিফ খুব ভয় পায়।নিতু অতিরিক্ত টেনশন করে তাই ওকে এই সমস্যা গুলো বুঝতে দিতে চায়নি। মনে মনে আল্লাহকে ডাকে যেনো রিপোর্টে তেমন খারাপ কিছু না আসে।

এদিকে নিতুর এই দুই দিন দুই রাত কাটে নির্ঘুম। ভেতরে অস্থিরতা বাড়তেই থাকে। নামাজ পড়ে শুধু দোয়া করে যেনো সব ভালো হয়। তৌসিফ যেনো সুস্থ হয়ে যায়। সংসার এর কোন কিছুই নিতুর ভালো লাগে না।ফোন করে সালেহা বেগমকে বাসায় আসতে বলে।কারন বাচ্চাদের দেখাশোনা,স্কুল কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছিলো না। রাহেলা খালাও নিতুর অবস্থা দেখে দু’হাত তুলে তৌসিফ এর জন্য দোয়া করে।

সবাই টেনশন করবে তাই তপু তৌসিফ এর বিষয়টা বাসায়ও কাউকে জানায়নি। তবে তপু কে দেখে সবাই বুঝতে পেরেছিলো যে কিছু একটা নিয়ে ও খুব চিন্তায় আছে।

সালেহা বেগম পরদিন সকালেই নিতু দের বাসায় চলে আসে। নিতুকে খারাপ চিন্তা না করে নামাজ পড়ে তৌসিফ এর জন্য দোয়া করতে বলে। কিন্তু তৌসিফ কে দেখে সালেহা বেগম নিজেও চিন্তায় পরে যায়।

আজ বিকেলে রিপোর্ট দেয়ার কথা। তপু সকালে তৌসিফের বাসায় এসে বলে যে,ও একাই অফিস থেকে ফেরার পথে রিপোর্ট নিয়ে আসবে। ওদের যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু নিতু বলে,”না ভাইয়া আমিও যাবো। একবারে ডাক্তার এর কাছে গিয়ে রিপোর্ট দেখিয়ে আসবো।”

“তোমার যাওয়ার দরকার নেই তো। বাচ্চাদের একা বাসায় রেখে হাসপাতালে শুধু শুধু কেনো কষ্ট করবে?”

“না ভাইয়া। আমার ভালো লাগছে না। আমি যাবো।আর বাসায় আম্মু আছে। সমস্যা হবে না।”

তপু বুঝতে পারে নিতু কে বলে লাভ নেই তাই বলে,”ঠিক আছে। আমি অফিস থেকে চলে আসবো। তুমি চলে যেও রিকশা নিয়ে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

তৌসিফ আজ কোন কথা বলেনা।চুপ থাকে। তবে মনে মনে ঠিক করে নিতুর সাথে ও যাবে। শরীর বেশি খারাপ লাগায় আজ আর তৌসিফ দোকানে যায়নি। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটিয়েছে। তবে সারাদিন তৌসিফ আর নিতুর মাঝে ছিলো নিরবতা।যে যার মতো কাজ করতে থাকে। বিকেলে নিতু রেডি হতে নিলে তৌসিফ ক্লান্ত শরীরেই নিতুকে পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে। নিতু চোখ বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। গভীর ভাবে উপলব্ধি করে ওর প্রানপ্রিয় মানুষটিকে।

কিছুক্ষণ নিরব থাকার পরে তৌসিফ বলে,”নিতু আমার খুব ভয় লাগছে। অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে তোমাদের হারিয়ে ফেলবো আমি।কোন এক ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছি মনে।কেমন লাগছে ঠিক বোঝাতে পারবো না নিতু।”

তৌসিফের অবস্থা দেখে নিতু নিজেকে শক্ত করে। মনকে শান্ত করে।তৌসিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”এতো টেনশন করবেন না।দেখবেন রিপোর্টে সব ভালো আসবে।কোন ঝড় আসবে না। আমি আসতে দেবো না।আপনি একটু রেস্ট নিন। আমি রিপোর্ট নিয়ে আসি।”

তৌসিফ নিতুর গালে হাত রেখে মন ভরে কিছুক্ষণ নিতু কে দেখে । কপালে চুমু খেয়ে বলে,”তোমার কথা যেনো সত্যি হয়। আমাদের সুখের সংসারে যেনো কোন ঝড় না আসে।”

নিতু তৌসিফ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তৌসিফ বলে,”আমিও যাবো। দুজন মিলে আজ রিকশা ভ্রমন করতে করতে যাবো। তুমি আজ সেই লাল শাড়িটা পড়ে সাজবে আমার জন্য।”

নিতু হেসে দেয়।বলে,”ঠিক আছে।এই অসুস্থ অবস্থায় ও আপনার মনের রং শেষ হয়না তাইনা? আপনি রেডি হন।”

তৌসিফের কথা অমান্য করার সাধ্য নিতুর নেই।নিতু লাল শাড়িটা পরে রেডি হয় আর তৌসিফও একটা পাঞ্জাবি পরে। দুজন মিলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রিকশায় ওঠে। পথে তৌসিফ নিতুর প্রিয় বেলি ফুলের মালা কিনে নিজ হাতে খোঁপায় পড়িয়ে দেয়।মনের ভেতরে অজানা আশঙ্কা থাকলেও কেউ কাউকে বুঝতে দেয়না।দুজনের হাসপাতালে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়। গিয়ে দেখে তপু ওদের আগেই চলে এসেছে। তপু ওদের এভাবে দেখে খুশি হয়। বলে,”ভালোই প্রেম হুম!! আমি তোদের জন্য এসে অপেক্ষায় বসে আছি। আর তোরা সেজেগুজে ঘুরে বেড়িচ্ছিস?”

তৌসিফ বলে,”হুম অনেক দিন পর দুজন মিলে রিকশা ভ্রমন করলাম।”তৌসিফ এর শরীর বেশ খারাপ লাগছিলো। কথা বলতে বলতে তাই ও পাশে চেয়ারে বসে পরে। নিতু আবার টেনশন শুরু করে।

তপু গিয়ে রিপোর্ট এনে ডাক্তার এর অপেক্ষায় বসে থাকে। অবশেষে তপু গিয়ে রিপোর্ট ডাক্তারকে দেখালে ডাক্তার বলেন, “আমার সন্দেহই ঠিক ।যতোটুকু বোঝা যাচ্ছে লিভার সিরোসিস হয়েছে।তবে কোন অবস্থায় আছে সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। এটা বোঝার জন্য আরো কিছু টেস্ট করাতে হবে।এখনি ভয় পাবেন না। মানসিক ভাবে শক্ত হতে হবে। আমি আপাতত কিছু ঔষধ দিচ্ছি।রোগিকে ঠিকমতো ঔষধগুলো খাওয়াবেন।আর যতো দ্রুত পারেন টেস্টগুলো করিয়ে রিপোর্ট এনে দেখা করবেন।”

তপু ডাক্তার এর কথা শুনে কি বলবে কি করবে বুঝতে পারছিলো না।দাঁড়িয়ে বলে,”ঠিক আছে। আমি তাহলে টেস্ট করিয়ে একবারে রিপোর্ট নিয়ে আসবো।”

“শুধু রিপোর্ট না রোগিকে নিয়ে আসবেন।”

“ঠিক আছে “বলে তপু উঠে দাড়ায়। কিন্তু তপুর পা চলছিলো না। এদিকে বাইরে নিতু আর তৌসিফ তপুর অপেক্ষায় বসে আছে। মনে প্রানে দোয়া করছে যেনো কোন খারাপ খবর না আসে।

চলবে……..

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৩০)
#মৌমিতা হোসেন

তপুর আসতে দেরী দেখে তৌসিফ বলে,”কি ব্যাপার নিতু তপু এখনো আসছে না কেনো?আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না।চলো আমরাও ভেতরে যাই।”

নিতু বাধা দেয়। নিতু ইচ্ছে করেই ভেতরে যায়নি।কারন নিতু গেলে তৌসিফ ও যাবে।আর রিপোর্টে যদি খারাপ কিছু আসে তখন তৌসিফ ভেঙে পড়বে। তাই তপু যখন একাই যেতে চায় তখন আর নিতু নিষেধ করেনি।

তৌসিফ যেতে চাইলে নিতু বলে,”আর একটু বসেন। এতো অস্থির হচ্ছেন কেনো? তপু ভাই এখনি চলে আসবে।”

“বসে থাকতে ভালো লাগছে না নিতু।একদম ভালো লাগছে না।”কথাটা বলেই তৌসিফ তপুকে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইল বের করে।

এর মধ্যেই নিতু বলে,”ঐ যে দেখেন তপু ভাই চলে এসেছে। শুধু শুধু অস্থির হন আপনি ।” দু’জন তপুর দিকে তাকিয়ে থাকে। তপুর চেহারা দেখে নিতুর কেমন জানি মনের মধ্যে খারাপ কিছুর ইঙ্গিত দেয়। তবে খুব করে দোয়া করে যেনো তপু ভাই এসে বলে যে, রিপোর্ট ভালো এসেছে।

তপু একরাশ চিন্তা নিয়ে ওদের সামনে এসে দাড়াতেই তৌসিফ বলে,”কীরে আজ তো মনে হচ্ছে তুই রোগী হয়ে গিয়েছিস।এমন লাগছে কেনো তোকে ?কি হয়েছে? রিপোর্ট দেখে ডাক্তার কি বললো?”

তৌসিফের কথায় তপুর ধ্যান ভাঙে। সামনে ওদের দেখে থতোমতো খেয়ে কি বলবে কীভাবে বলবে ভাবতে থাকে।এরই মধ্যে নিতু বলে,”ভাইয়া কি হয়েছে?কোন সমস্যা? আপনাকে এমন লাগছে কেনো?ডাক্তার কি বললো?”

তপু নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”তেমন কিছু না। ভেতরে একজন রোগীর কথা শুনে খারাপ লাগছিলো।”

তপুর কথা শুনে তৌসিফ আর নিতু দু’জনই একসাথে বলে ,”ও আচ্ছা।”

তৌসিফের কষ্ট হচ্ছে তবুও ম্লান হেসে বসে পরে। নিতু সাথে সাথে বলে,”কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”

“হুম একটু খারাপ লাগছে। তপু তো রিপোর্ট এনেছে।সব কাজ শেষ এখন চলো বাসায় যাই। হাসপাতালে আর ভালো লাগছেনা আমার।”

তপু বলে,”না কাজ শেষ হয়নি।তোর আরো ২/৩ টা টেস্ট করাতে হবে।আর টেস্টগুলো আজকেই করাতে হবে।”

নিতু একটু চিন্তিত হয়ে বলে,”আবার টেস্ট কেনো ভাইয়া? রিপোর্ট দেখে ডাক্তার কি বললো?”

তৌসিফও তপুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তপু ওদের চোখের দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করে। মনে মনে বলে,কি বলবে ওদের?এমন খবর কি করে দেবে ভাইকে, নিতু কে।আর এখনো তো নিশ্চিত না।তাই ঠিক করে এখনি খবরটা কাউকে বলবে না।এসব ভাবনার মাঝেই নিতু আবার বলে,”কি ব্যাপার তপু ভাই? বলেছেন না কেনো?ডাক্তার কি বলেছে?”

তপু বলে,”তেমন কিছু না। কিছু ঔষধ দিয়েছে।আর আজকেই টেস্ট গুলো করিয়ে রিপোর্ট দেখাতে বলেছে। তাই আর কি।”

নিতু বলে,”আলহামদুলিল্লাহ। একটু চিন্তামুক্ত হলাম। মনে প্রানে দোয়া করছি যেনো এই টেস্টের রিপোর্ট ও ভালো আসে।”তৌসিফ এর হাত ধরে ওর দিকে তাকিয়ে ওকে ভরসা দেয়।

তপু বলে যে,”চলো এখন আগে টেস্টগুলো করি। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

টেস্ট করাতে গিয়ে দেখে এগুলো আজ রাতে করানো যাবে না। সকালে করাতে হবে। তাই তপু প্রথমে তৌসিফ আর নিতু কে চলে যেতে বলে। কিন্তু তপু তৌসিফের শরীর খারাপ থাকায় ওদের আর একা ছাড়েনা। একটা সিএনজি করে সবাই একসাথে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসে।

তৌসিফ বাসায় এসে কিছু না খেয়েই শুয়ে পরে।তৌসিফের এই অবস্থা দেখে নিতু খুব মন খারাপ করে। মনে প্রানে দোয়া করে তৌসিফের সুস্থতার জন্য। বাচ্চাদের খাইয়ে ঘুম পাড়াতে গেলে আজ তুলি বলে,”আম্মু বাবার কি হয়েছে?বাবা কদিন ধরে আগের মতো আমার সাথে খেলে না,গল্প করেনা। আমার একটুও ভালো লাগেনা।”

নিতু মেয়েকে আদর করে কাছে এনে বলে,”তোমার বাবার শরীর একটু খারাপ মা। তাই এখন একটু কম খেলছে তোমাদের সাথে। দোয়া করো বাবা সুস্থ হলেই আবার আগের মতো খেলবে তোমাদের সাথে।”

তুলি তবুও মন খারাপ করে মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। সবাই ঘুমালে নিতু রুমে এসে তৌসিফ কে দেখতে থাকে।কেমন যেনো কষ্ট হয় বুকের ভেতর।চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরে‌।ঘুম ধরা দেয়না চোখে। রাতে তৌসিফ এর আবার জ্বর আসে।নিতু জোর করে উঠিয়ে ঔষধ খাওয়ায়।জলপট্টি দেয়।জ্বর একটু কমলে অস্থিরতা কমাতে ওযু করে নামাযে বসে। দুহাত তুলে তৌসিফ এর সুস্থতা কামনা করে। জায়নামাজের পাটিতে বসে থেকেই কখন যে ভোর হয়ে যায় টের পায়না নিতু। ইবাদাত শেষ করে নাস্তা বানাতে চলে যায়। আজকেও তৌসিফ এর সাথে হাসপাতালে যাবে তাই ঠিক করে তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করবে।

খুব ভোরেই তৌসিফের ঘুম ভাঙে। শরীরটা একটু ভালো লাগছে। রাতে হঠাৎ করে খুব খারাপ লাগছিলো। কিছু একটা যে হয়েছে সেটা তপু না বললেও তৌসিফ বুঝতে পেরেছে। নিতু কে পাশে না পেয়ে জোরে ডাকে। নিতু তৌসিফের ডাক শুনে দৌড়ে যায় ওর কাছে। ভাবে যে হয়তো তৌসিফের খারাপ লাগছে। রুমে তাড়াতাড়ি যেতে নিয়ে দরজায় ধাক্কা খেয়ে হাতে প্রচন্ড ব্যাথা পায়। তৌসিফ সেটা দেখে আসতে নিলে ওর মাথায় চক্কর দেয়। সাথে সাথে বসে পরে। নিতু ব্যাথা নিয়েই এসে বলে,”আপনার শরীর ঠিক আছে তো?কোন সমস্যা হয়নি তো?”

তৌসিফ নিতুর হাত ধরে বলে,”না কোন সমস্যা নেই। একটু মাথায় চক্কর দিলো।তেমন কিছু না। খেতে পারছিনা তাই হয়তো এই দুর্বলতার জন্য মাথা ঘুরাচ্ছে।যাক তুমি কোথায় ব্যাথা পেয়েছো দেখাও তাড়াতাড়ি। আবার কেটে গেলো নাকি?”

তৌসিফের অস্থিরতা দেখে নিতু বলে,”একটু শান্ত হয়ে বসুন।তেমন কিছু হয়নি।এতো অস্থির হবেন না।”

“এরপর থেকে এতো তাড়াহুড়ো করে কাজ করবে না।সব সময় আমি থাকবো না তোমার খেয়াল রাখার জন্য। নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে।”কথাটা বলেই তৌসিফ এর কেমন জানি লাগলো আজ।

নিতু তৌসিফ এর কথা শুনে একটু রেগে বললো,”এটা কেমন কথা বললেন? আপনি থাকবেন না মানে?কোথায় যাবেন? আমার খেয়াল সব সময় আপনাকেই রাখতে হবে। সবার খেয়াল আমি রাখবো সমস্যা নেই।কখনো এক্ষেত্রে আপনাকে অভিযোগ করার সুযোগ দেবো না। কিন্তু আমার যত্ন, খেয়াল রাখতে হবে শুধু আপনাকেই। মনে থাকে যেনো।”

“সেতো রাখবোই। কিন্তু যখন আমি থাকবো না তখন?তখনের জন্য নিজের খেয়াল রাখা শেখো আমার নিতু রানি।”

নিতু তৌসিফ কে জড়িয়ে ধরে বলে,”এমন দিন কখনো না আসুক। আমি অনেক বছর আপনার সাথে থাকতে চাই।একদম বুড়ি হওয়া পর্যন্ত।বুড়ি হয়েও আপনাকে পাশে চাই।”

তৌসিফ হেসে দিয়ে বলে,”বুঝতে পেরেছি।আর বলতে হবে না। আমার নিতুর আজ আদর লাগবে।তাই নিজ থেকেই আমার এতো কাছে এসেছো আজ তাইনা?”

কথা শেষ করে নিতুর আরো কাছে আসতে নিলেই নিতু তৌসিফ কে সরিয়ে দিয়ে বলে,”ধ্যাত, আপনাকে কিছু বলাও মুশকিল।বলি এক বোঝেন আরেক। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে রেডি হন। তপু ভাই এসেছিলো। তাড়াতাড়ি যেতে হবে টেস্ট করাতে।আল্লাহর নাম নিয়ে এই রিপোর্ট ভালো আসলে আর যেতে হবেনা হাসপাতালে। ওখানে গেলেই আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।ভয় লাগে, অজানা এক আশঙ্কা ঘিরে ধরে আমাকে।”

“ঠিক বলেছো। আমারও ভালো লাগেনা।আচ্ছা তুমি নাস্তা রেডি করো আমি রেডি হয়ে আসছি।”তৌসিফ ওয়াসরুমে চলে যায়।আর নিতু ও নাস্তা রেডি করতে যায়।আজ আর বাচ্চাদের স্কুলে পাঠায়না। তৌসিফ আর নিতু রেডি হয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তপু অফিসে গিয়ে ছুটি নিয়ে হাসপাতালে আসে।নিতু দের যাওয়ার আগেই তপু হাসপাতালে পৌঁছে ওদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তৌসিফদের রাস্তায় যানজট থাকায় পৌঁছাতে একটু সময় লাগে।

হাসপাতালের গন্ধ বরাবরই তৌসিফ এর অপ্রিয়। খুব প্রয়োজন ছাড়া এখানে পা রাখার মানুষ তৌসিফ না।বাবা আর নিতুর বেলায় কীভাবে যেনো শক্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলো। তবুও অনেক অবুঝের মতো আচরন করেছিলো তখন। কবে বাসায় নিয়ে আসবে এই পায়তারাই করেছিলো সব সময়। এবার শরীর এতো বেশি খারাপ না লাগলে হয়তো অসতেও চাইতো না।জোর খাটাতো। কিন্তু নাক থেকে রক্ত পড়ার পর থেকে খুব চিন্তায় আছে আর এজন্যই এসেছে।যাই হোক টেস্ট এর ওখানে সিরিয়াল,এতো অসুস্থ মানুষ সব দেখে কেমন যেনো অস্থির লাগতে থাকে ওর। আবার জ্বর আসে। অবশেষে তৌসিফ এর নাম ধরে ডাকলে তপু ধরে নিয়ে যায়।জ্বর আসায় খুব দুর্বল লাগছে তৌসিফের।

টেস্ট করাতে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। তৌসিফের শরীর অনেক খারাপ লাগছে।তাই তপু তাড়াতাড়ি সিএনজি ঠিক করে বাসায় নিয়ে আসে।ভেবেছিলো টেস্ট করানোর পর অফিসে চলে যাবে। কিন্তু তৌসিফের অবস্থা দেখে আর ওদের একা ছাড়ার সাহস হয়নি। বাসায় ফিরতে চারটা বেজে যায়।বাসায় আসার সাথে সাথে বাচ্চারা সবাই ঘিরে ধরে ওদের। কিন্তু তৌসিফের অবস্থা দেখে নিতু সবাই কে রুম থেকে বের করে দেয়। তৌসিফের খুব খারাপ লাগলেও কিছু করার থাকে না।মন চাইলেও শরীর সায় দিচ্ছেনা।তাই চুপচাপ শুয়ে পরে।

তপু তৌসিফের অবস্থা দেখে চিন্তায় পরে যায়। মনে প্রানে দোয়া করে যে, ডাক্তার যা বলেছে সেসব যেনো ভুল হয়।আজকের টেস্ট এর রিপোর্ট যেনো ভালো আসে ।তপুর চিন্তিত চেহারা দেখে নিতু বলে,”ভাইয়া আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?কাল থেকেই দেখছি কিছু একটা নিয়ে আপনি খুব চিন্তিত। আপনার ভাইয়ের রিপোর্ট ঠিক আছে তো? মিথ্যে বলবেন না ভাইয়া।”

তপু নিতুর কথা শুনে কি বলবে ভেবে পায়না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”না নিতু তেমন কিছু না। আজকের টেস্ট এর রিপোর্ট এলে বোঝা যাবে। দোয়া করো যেনো ভালো খবর আসে।আর ওকে আপাতত দোকানে যেতে দিওনা। ফোনে কথা বলে দোকান সামলাতে বলো।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। রিপোর্ট কবে দেবে?”

“এইতো এক সপ্তাহ পরে। একটু সময় লাগবে। তৌসিফের শরীর খারাপ লাগলেই আমাকে ফোন দেবে।যাই হোক আমাকে জানাবে।”কথাগুলো বলে তপু চলে যায়।

নিতুর খুব ক্লান্ত লাগে।কোন রকম খেয়ে নামাজ পড়ে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটায়, ওদের খাইয়ে দেয়। সালেহা বেগম, রাহেলা ওদের দুজনকে দেখে মন খারাপ করে। খুব চিন্তায় পরে যায়।

তৌসিফ পরের দিন দোকানে যেতে চায়। কিন্তু নিতুর নিষেধ এর জন্য আর যায়না। রিপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত বাইরে যাওয়া চলবেনা এটা খুব কড়া করে নিতু বলে দিয়েছে।তাই বাসায় বসে ফোনেই যতোটুকু পারে তদারকি করে।যখন একটু ভালো লাগে তখন বাচ্চাদের সাথে খেলে,গল্প করে। নিতুর সাথে ভোরের আকাশ দেখে,পাখির সাথে কথা বলে,রাতে জ্যোৎস্না বিলাশ করে। কেনো জানি তৌসিফের ভেতরে সব সময় কেমন এক অস্থিরতা বিরাজ করছে । তবে যতোটা পারছে সেই অস্থিরতা,ভয় নিতুর সামনে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছে। শরীর খারাপ লাগলেও সহসা বুঝতে দিতে চাচ্ছেনা। তৌসিফের মনে হচ্ছে রিপোর্ট ভালো আসবে না। রিপোর্ট পাওয়ার আগের এই সময়টা ওর কাছে দুর্বিষহ মনে হচ্ছে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here