#সুখের খোঁজে,পর্ব-৩,০৪
#মৌমিতা হোসেন
০৩
নিতুর বাবা মারা যাওয়ার পর চাচা চার /পাঁচ মাস টাকা দেয়।এরপর থেকে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে এড়িয়ে যায়। নিতুর কাছে চাচাকে আজকাল খুব স্বার্থপর মনে হয়।ফুপিদের ও বিরক্ত লাগে।ফুপিরা ফোন দিলেই ওর মাকে শুধু নিতুর বিয়ের কথা বলে।আর এটাই নিতুর বিরক্তির কারন।
কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে উঠলে হঠাৎ একদিন বড় ফুপু তার ছোট ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে আসে।ছোট ছেলের নাম আতিক। মাস্টার্স পরীক্ষা দেবে সামনে।বড় ফুপুর দুই ছেলে এক মেয়ে।বড় ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে।মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ছেলে বিদেশে থাকে। দুই মাস পর দেশে আসলেই বিয়ে হবে।এসব কথা জানাতে আর ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের দেখতেই মুলত বড় ফুপু নিতু দের বাসায় আসে। সালেহা বেগম দেখে খুশি হলেও খরচের কথা মাথায় আসলে চিন্তায় পরে যান। সেতু, সাজিদ ফুপি আর ভাইকে দেখে বেশ খুশী হয়।
আতিক বাসায় এসেই নিতুর খবর নেয়।সেতু দৌড়ে গিয়ে বলে,’আপু তাড়াতাড়ি চলো ফুপি এসেছে। তোমাকে ডাকছে।আতিক ভাইও এসেছে সেও তোমাকে খুঁজছে।’
নিতু যেইনা শোনে আতিক ভাইও আসছে তখনই কপাল কুঁচকে বসে পড়ে।কারন নিতুর আতিক ভাইকে মোটেও পছন্দ নয়।দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় একবার এসেছিলো উনি। তখন ভাইয়ার কথা বলার ধরন নিতুর পছন্দ হয়নি।কথায় একটু বাজে ইঙ্গিত দিয়েছিলো আতিক ভাই।আর বিভিন্ন অজুহাতে নিতু কে ছুঁয়ে দিতে চাইতো এসব নিতুর ভালো লাগেনি।ভাইয়ের উদ্দেশ্য যে মোটেও ভালো ছিলোনা সেটা নিতু খুব ভালো ভাবেই বুঝেছিলো।তারপর যেকদিন ছিলো একটু এড়িয়ে চলেছিলো নিতু।আজ আবার এসেছে শুনে বেশ বিরক্ত হয়। তবুও ভাবে এতো দিনে হয়তো তার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।এই ভেবে ফুপির ডাকে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে দৌড়ে যায়।বলে,
‘আসসালামুওয়ালাইকুম ফুপি।’
ফুপি নিতু কে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।বলে,’ওয়ালাইকুমুস সালাম।কেমন আছিস মা?’
‘ভালো। তুমি ভালো আছো?’
‘হুম আছি আলহামদুলিল্লাহ।তোর পড়ালেখা কেমন চলছে!’
‘জ্বী ভালো।’
কথার মাঝেই নিতু খেয়াল করে আতিক তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিছুটা বিরক্ত হয়ে সালাম দেয়।
আতিক একটু বাঁকা হেসে উত্তর দিয়ে বলে,’কেমন আছো নিতু?এই কদিনে বেশ বড় হয়ে গিয়েছো দেখছি।’
অন্যরা কেউ না বুঝলেও নিতু বুঝতে পারে আতিক ভাই আসলে কি বলতে চেয়েছে।তাই আর কথা না বাড়িয়ে ফুপিকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়।
সত্যি আতিকের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি।আতিক আড়চোখে নিতুর ওপর একবার চোখ বোলায়। মনে মনে আওড়ায়,’এবার আমি আমার ইচ্ছে পূরণ না করে বাড়ি ফিরবো না নিতু রানি।’
সারাক্ষন গল্প , খাওয়া সব নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকে। ফোনে ফুপি নিতুর বিয়ের কথা বললেও এখানে এসে আর এই ব্যাপারে কিছু বলেনা তাই নিতু মনে মনে বেশ খুশি হয়।ফুপি আর সালেহা বেগম বারবার নিতুর বাবার কথা মনে করে আর কান্না করে।সন্ধ্যায় সবাই পড়তে বসে। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলে সেতু লাইট আনতে যায়।ওর সাথে সাথে সাজিদ ও যায়। সেতু যেতো লাইট আনতে কিন্তু ঐ রুমে আতিক ভাই সহ সবাই গল্প করছিলো তাই আর যায়নি।নিতু আসলে এবার আর কোন খারাপ পরিস্থিতিতে পরতে চাচ্ছিলোনা।এর মাঝে কোথা থেকে যেনো হুট করে আতিক নিতু দের রুমে এসে নিতুর পাশে বসে পরে। শরীরের সাথে ঘেসে বসতেই নিতুর অস্থিরতা বেড়ে যায়।বেশ বিরক্ত হয়েই ফিসফিস করে বলে,’এসব কি আতিক ভাই সরে বসুন।এসব আমার পছন্দ না।’
আতিক অন্ধকারে সুযোগ পেয়ে পেছনে হাত নিয়ে কোমর চেপে ধরে।আর বলে ,’কেনোরে নিতু আমি একটু ছুঁতে চাইলেই তোর সমস্যা হয়? স্কুলে যাওয়া আসার পথে নাকি তোর জন্য এক প্রেমিক অপেক্ষা করে। ওকে বুঝি খুব ভালো লাগে?তো সে কেমন দেখতে? আমার চেয়েও ভালো?’
আতিক এর স্পর্শে আর কথা শুনে নিতু রাগে,ঘৃনায় এক ধাক্কায় আতিক ভাইকে সরিয়ে দেয়। কিছু বলবে তার আগেই সেতু লাইট নিয়ে এসে ভাইকে দেখে বসতে বলে। কিন্তু সেতুকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে আতিক।আর তখনি নিতুর দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে চলে যায় পাশের রুমে।
নিতুর খুব খারাপ লাগে।আতিক ভাইকে খুব নোংরা মনে হয়। কিন্তু এসব কথা কাকে বলবে তাই চুপ থাকে। পরবর্তী দুই দিন বিভিন্ন ভাবে সুযোগ পেলেই আতিক নিতুর সাথে বাজে ব্যবহার করে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছুঁয়ে দেয়।এসব কাউকে বলাও যায়না তাই নিতু কি করবে বুঝতে পারছিলো না।
আতিক কে পেয়ে সালেহা ও পরদিন বলে যে,’যে কদিন তুই আছিস ওদের স্কুল, কলেজে তুই একটু নিয়ে যাস। আমি এদিকটা সামলাই।’
আতিক যেনো মনে মনে এটাই চাচ্ছিলো। খুব খুশি মনে রাজী হয়ে যায়। কিন্তু নিতু এসব শুনে খুব বিরক্ত হয়।আর মনে মনে ঠিক করে যে, যেই কদিন আতিক ভাই থাকবে সেই কদিন একটু সতর্ক হয়ে চলতে হবে।আর সেভাবেই চলে নিতু। কলেজে যাওয়া আসার পথে যাতে কোন অসভ্যতা না করতে পারে সেজন্য সেতুর আগে ছুটি হলেও ওকে বসিয়ে রেখেছে।নিতুর ছুটি হলে তারপর বের হয়েছে।ওরা দুজন একই স্কুল কলেজে পড়তো।আলাদা বিল্ডিং হলেও গেইট একটাই তাই একসাথেই বের হয় এই দুই দিন। আতিক কোনভাবেই নিতু কে এই দুই দিন একা পায়নি তাই কিছু বলতেও পারেনি।
আসলে আতিক যখন শেষের বার নিতু দের বাড়ি বেড়াতে আসে তখনই ওর নিতু কে পছন্দ হয়। এটাকে আসলে ঠিক পছন্দ বলা যায়না নিতুর বাড়ন্ত শরীরের ওপর নজর পরে আতিকের। স্বার্থ হাসিলের জন্য নিতু কে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু নিতু আতিক কে সব সময় বড় ভাইয়ের মতোই সম্মান করে এসেছে।আর আত্মীয়ের মধ্যে এসব নিতুর পছন্দ না।তাই নিতু না করে দেয়।তখন একদিন সুযোগ বুঝে নিতু কে বাজে ইঙ্গিত দিলে কিশোরী নিতু বেশ ঘাবড়ে যায়।আর এক পর্যায়ে আতিক কে চড় দিয়ে অপমান করে।সেই থেকেই নিতুর ওপর আতিকের অনেক ক্ষোভ।আর তাই এবার সেই অপমান এর প্রতিশোধ যেভাবেই হোক নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে আতিক।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মাঝরাতে সাজিদ উঠে পানি খেতে চায়। সাজিদ ওর মায়ের সাথে ঘুমালেও ফুপি থাকায় আজ আপুদের সাথেই ঘুমিয়েছে। নিতু ঘুমঘুম চোখে উঠে দেখে রুমে পানি আনতে ভুলে গেছে।মাঝের রুমে টেবিলের পাশে একটা ছোট খাট সেখানেই আতিক ভাইকে ঘুমাতে দেয়া হয়েছে।তাই পানি আনতে যেতে খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো।কিন্তু উপায় না পেয়ে পানি আনতে গেলেই আতিক উঠে এসে নিতুর হাত ধরে।নিতু ভয় পেয়ে যায়।
নিতু বলে,’আতিক ভাই কি করছেন?হাত ছাড়ুন।’
আতিক আরো জোরে হাত চেপে ধরে বলে,’কেনো না ছাড়লে কি করবি? খুব পালিয়ে বেড়াচ্ছিস এবার।ভয় পাস বুঝি?’
নিতু কাঁপা কন্ঠে উত্তর দেয়,’ভভ…ভয় পাবো কেনো? আপনি আমার হাত ছাড়ুন। সাজিদ পানি খাবে তাই পানি নিতে এসেছি।’
হাত ছাড়াতে নিলে আতিক আরো শক্ত করে ধরে পাশেই দেয়ালের সাথে চেপে ধরে।পানির গ্লাসটা কাত হয়ে পরে যায়।
‘প্লিজ ভাইয়া আমার সাথে এমনটা করবেন না। আমি আপনার বোন হই। আমাকে যেতে দিন ।আম্মু চলে আসলে খুব খারাপ হবে।’নিতু কথাগুলো বলে কাঁদতে থাকে।
কিন্তু আতিক আজ বেসামাল।ওর উদ্দেশ্য শুধু নিতুর শরীর। আতিক নিতুর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করতে থাকে। নিতু আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে সেখান থেকে চলে আসার জন্য।এক পর্যায়ে আতিক রেগে বলে,’এতো ছটফট করিস না। আমাকে আমার কাজ করতে দে। নাহলে মা,চাচি কেউ চলে আসলে তোকেই সবাই খারাপ বলবে। আমাকে না।কারন এতো রাতে তুই এখানে এসেছিস আমি কিন্তু যাইনি।’
আতিক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে নিতু কে জড়িয়ে ধরে কামিজের চেন খুলতে থাকে।
নিতু বুঝতে পারছেনা এখন ও কি করবে।চোখ থেকে পানি ঝরতে থাকে।আরো খারাপ কিছু হবে তার আগেই নিতু আতিক কে এক ধাক্কায় সরিয়ে যেতে নিলে আতিক আবার নিতু কে ধরে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে। নিতুর ওপরে উঠে চেপে ধরলে আর কোন উপায় না পেয়ে নিতু চিৎকার দেয় আর তখনই নিতুর ফুপি আর মা দৌড়ে ঐ রুমে এসে লাইট জ্বালায়। আতিক সাথে সাথে সরে যায় আর নিতু দৌড়ে এসে ওর মাকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। নিতুর মা আর ফুপি অবাক হয়ে আতিকের দিকে তাকিয়ে থাকে।ফুপি বলে,’এসব কি দেখছি আমি?আতিক তুই কি করছিলি নিতুর সাথে?’
‘বিশ্বাস করো আমি কিছু করিনি মা।নিতুই এসেছে আমার কাছে। এসে বলছে ও নাকি আমাকে ভালোবাসে।আরো বাজে প্রস্তাব দিয়েছে।ও পানি নেয়ার নাম করে এখানে এসে আমাকে ডেকে আরো অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলছিলো।’
এসব শুনে নিতুর মা বলল,’কি বলছিস এসব আতিক? নিতু এমনটা কখনো বলতে পারেনা। আমি চিনি আমার মেয়েকে।তুই এমন কথা……’
ফুপি হাত উঁচু করে ইশারায় সালেহাকে চুপ করিয়ে দেয়।বলে,’আর কতো নিজের মেয়ের কুকীর্তি ঢেকে রাখবে সালেহা? তোমাকে বারবার বলেছি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও।কথা শুনছো না।এ কেমন বেহায়া মেয়ে বানিয়েছো।ফুফাতো ভাইয়ের দিকে কেউ এমন নজরে তাকায়?লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।এসব করে বুঝি আমার ছেলেকে ফাঁসানোর প্ল্যান ছিলো তোমাদের?’
‘চুপ করেন আপা এসব কি কথা বলছেন আপনি?চিন্তা করে বলুন কি বলছেন। আপনি কি নিতু কে চেনেন না? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?যা মুখে আসছে তাই বলছেন।এমন সব কথা আর বলবেন না প্লিজ।’
‘সালেহা তোমার কথায় তো মনে হচ্ছে তুমিও এই প্ল্যান এর অংশিদার। সত্যি আমারই বোকামি হয়েছে।তোমাদের এখানে আসাটাই আমার উচিত হয়নি। আমার ভাইটাকে শেষ করেছো।এখন আবার আমার ছেলের দিকে তোমাদের নজর পড়েছে।ছিঃ….’
আতিক প্রথমে একটু ভয় পেলেও মায়ের সাপোর্ট পেয়ে মনে মনে বেশ খুশি হয়।আর মায়ের সামনে আরো করুণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হচ্ছিলো সত্যি সব দোষ নিতুর।আর আতিক পুরোপুরি নির্দোষ।
চলবে….
#সুখের খোঁজে……(পর্ব -৪)
#মৌমিতা হোসেন
কাঁদতে কাঁদতে নিতু বলতে থাকে,’বিশ্বাস করো মা সাজিদ পানি খেতে চেয়েছিলো তাই আমি পানি নিতে আসি।আর তারপর ভাইয়া আমার সাথে অসভ্যতা শুরু করে। আমি কিছু করিনি। বিশ্বাস করো। ভাইয়া আমার নামে মিথ্যা বলছে।’
কথা শেষ করার আগেই ফুপি এসে নিতু কে এক চড় মেরে বলে,’এতো বড় সাহস তোর তুই আমার ছেলে সম্পর্কে এতো নোংরা কথা বলছিস। শুধু আমার মৃত ভাইয়ের মেয়ে বলে আজ তোকে মাফ করলাম। নাহলে এর উপযুক্ত শাস্তি আমি তোকে দিয়েই ছাড়তাম।বেশরম মেয়ে কোথাকার।কি আছে তোর মাঝে যে আমার এই সোনার টুকরো ছেলে তোর সাথে এমনটা করবে?যত্তোসব।’
রাগে চোখ রাঙিয়ে সালেহার দিকে তাকিয়ে ফুপি বলতে থাকে,’আরো কয়মাস আগেই বলেছিলাম ভাই বেঁচে নেই তাই এই বয়সি মেয়েকে ঘরে রেখো না বেশি দিন। বিয়ে দিয়ে দাও। আমার কথা শুনলেনা তো।এখনো সময় আছে মেয়েকে যতো জলদি পারো বিয়ে দিয়ে দাও।দেখো বেশি দেরি করতে গিয়ে আবার পস্তাতে না হয়। তোমার মেয়ের মতিগতি আমার সুবিধার ঠেকছে না বলে দিলাম। নাহলে এমন ঘটনা বাইরের কারো সাথে করলে সমাজে আর মুখ দেখাতে পারবে না। তাই সময় থাকতে মেয়ের একটা ব্যবস্থা করো।’
এতো সব কথা বলে ফুপি তার ছেলের হাত ধরে রুমে নিয়ে যায়। রুমে গিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,”চিন্তা করিস না বাবা এখান থেকে আমরা কাল সকালেই চলে যাব। এখানে আসাটাই আমাদের উচিত হয়নি।তোর বাবা যেনো এসবের কোন কিছু না জানতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখিস।”আতিক এর বাবা বেশ রাগী মানুষ তাই ওরা সবাই ওনাকে বেশ ভয় পায়।
আতিক এতোক্ষণ টেনশনে থাকলেও এখন তার ওপর মায়ের বিশ্বাস দেখে একটু সাহস পায়।আর খুশিও হয়। সত্যি কথা বের হয়ে না আসে সেই ভয়ে ও মায়ের সাথে তাল মেলায়।আর বলে,”হ্যা মা আমরা কালকেই চলে যাবো।এমন জায়গায় থাকা উচিত না।কে জানে নিতুর মনে কি আছে। আবার কোন ঝামেলায় ফেলে দেবে আল্লাহ জানে।”এসব বলতে থাকে আর করুন চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।আর এর সাথে নিতুর নামে বানিয়ে আরো কিছু বাজে কথা বলে।
এসব শুনে নিতুর ফুপি ওর সম্পর্কে খুব খারাপ ধারনা পোষন করে আর প্রচন্ড রাগ হয়।
এদিকে সালেহা এতো কটু কথা শুনে কি বলবে বুঝতে পারছিলো না।আজ স্বামী বেঁচে থাকলে এমন জঘন্য কথা ওনার কলিজার টুকরাকে নিয়ে কারো বলার সাহস হতো না। শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কাঁদতে থাকে।
আর নিতু হয়ে যায় নিশ্চুপ,নির্বাক। জীবনে এমন অপবাদ শুনতে হবে,এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে সেটা কখনো কল্পনাও করেনি নিতু। হঠাৎ দেখে সাজিদ, সেতু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।মা,আপার অবস্থা দেখে ওরাও কাঁদছে। নিতু লজ্জায়,অপমানে আস্তে আস্তে হেঁটে ওর ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।চুপ করে বসে কাঁদতে থাকে।
কাঁদতে কাঁদতে কখন যে সকাল হয়ে গেছে সেটা নিতু টেরই পায়নি। সকালে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙে নিতুর। নিচে বসেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছিলো। ঘুম ভাঙতেই টের পেলো প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। ছোটবেলা থেকেই একটু কাদলেই নিতুর মাথা ব্যাথা করে।আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। তাড়াতাড়ি উঠে জামা ঠিক করে দরজা খুলতেই দেখে সামনে মা দাঁড়িয়ে আছে।
আসলে রাতে নিতু রুমে চলে সালেহা বেগম ইচ্ছা করেই মেয়েকে আর ডাকে না।মেয়ে একা একা কাঁদলে মন হালকা হবে ভেবে ছেড়ে দেয়। কিন্তু সকাল হলেও দরজা না খুললে চিন্তায় পরে যায় আর এজন্যই ডাকতে আসে। মেয়ের বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে সালেহা বেগম এর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।এক রাত কেঁদে কেঁদে চেহারার কি অবস্থা করেছে। অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার জন্য চোখ, মুখ পুরো গোলাপী হয়ে আছে। সালেহা বেগম নিতু কে স্বাভাবিক করার জন্য রাতের প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে,’কীরে মা আর কতো ঘুমাবি? কলেজে যাবি না?’
‘না মা আজ শরীর ভালো লাগছে না।যেতে ইচ্ছে করছে না।আজ বাসায় থাকি?’
‘ঠিক আছে থাক।হাত -মুখ ধুয়ে আয় আমি নাস্তা দিচ্ছি।’
এর মধ্যে ফুপি আর আতিক আসে খাওয়ার রুমে।হাতে ব্যাগ দেখে সালেহা বলে ,’কী ব্যাপার আপা হাতে ব্যাগ কেনো?এতো সকালে কোথায় যাচ্ছেন?’
ফুপি রেগে উত্তর দেয়,’ভাবলে কি করে রাতের ঘটনার পরেও আমি আর আমার ছেলে তোমার বাসায় আরো থাকবো? আমাদের কি মান সম্মান বলতে কিছু নেই? আমরা এখনি চলে যাচ্ছি। ভাইয়ের বাসায় এটাই হয়তো আমার শেষ আসা। একটা কথা শোনো যা শুনলাম মেয়ের অবস্থা কিন্তু বেশি সুবিধাজনক নয়।তাই মেয়ের ভালো চাইলে পড়াশোনা শেখানোর ঢং না দেখিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দাও। অন্ততঃ আমার ভাইয়ের সম্মান টা রক্ষা হোক।’
নিতু খেতে বসলেও ফুপির কথা শুনে খাবার আর গলা থেকে নামলো না।আস্তে উঠে নিজের রুমে চলে যায়।সালেহা ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে।ঠিক করে এবার একটু কঠিন হতে হবে তাকে। অন্তত মেয়ের জন্য হলেও।
নিতু চলে গেলে আতিক আর আপাকে উদ্দেশ্য করে সালেহা বলে, আমি ভালো করেই জানি আমার মেয়ে কোন খারাপ কাজ করেনি।তাই দয়া করে আমার মেয়েকে নিয়ে আর কোন খারাপ কথা বলবেন না আপা।যেতে চাচ্ছেন চলে যান। আমাদের ভালো মন্দ আমরাই বুঝে নেবো।’
আতিক কে উদ্দেশ্য করে বলে,’আমি আর তোর মামা তোদের কখনো পর ভাবিনি। নিজের ছেলের মতোই তোদের ভালোবেসেছি।সেই তুই নিতুর সাথে এমন নোংরা কাজ কীভাবে করলি? নিতু কে নিয়ে এতো খারাপ কথা না বললেও পারতি আতিক।মামাতো হলেও তো তুই ওর ভাই। কীভাবে পারলি এতো নোংরা কথা ওকে নিয়ে বলতে? এতো নোংরা কাজ ওর সাথে করতে?এতো ছোট বয়সে ওর কোমল নরম মনে খুব বড় একটা দাগ দিয়ে দিলি।যাক মনে রাখিস যে অন্যায় করে সে জীবনের কোন একদিন ঐ অন্যায়ের জন্য অবশ্যই শাস্তি ভোগ করবে।’
নিতুর ফুপি সালেহার কথা শুনে রেগে আর কিছু না বলে আতিক কে নিয়ে তখনই চলে যায়।ওদের চলে যাওয়া দেখে সাজিদ, সেতু খুব খুশি হয়। সারাদিন ওরা নিতুর মন ভালো করার জন্য বিভিন্ন ধরনের গল্প বলে। কিন্তু নিতুর মন ভালো হয়না।সব কিছুর জন্য ওর খুব খারাপ লাগতে থাকে।
রাতে নিতু একা বসে চাঁদ দেখতে থাকে।আর বাবাকে মিস করতে থাকে।এর মধ্যে সালেহা নিতু কে খেতে ডাকতে আসলে নিতু বলে,’মা কেনো বাবা এতো তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেলো? আমি বাবাকে খুব মিস করছি। খুব ভালোবাসি বাবাকে।’
নিতু মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।সালেহা মেয়ের এই কথার কোন উত্তর দিতে পারেন না।নিরবে সেও চোখের পানি ফেলে। তিনটি সন্তানকে কীভাবে মানুষ করবে তার মাথায় এখন শুধু এই চিন্তা।কান্না লুকিয়ে মেয়েকে নিয়ে খেতে যায় সালেহা।
বেশ কিছুদিন কেটে যায়। নিতু, সাজিদ, সেতু সবাই পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আর সালেহা তার সেলাই সহ সংসার এর বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে।এই ব্যস্ততায় ঐ রাতের ঘটনা সবাই প্রায় ভুলেই যায়। তবে সালেহা বুঝতে পারে বাস্তবতা বড়ই নির্মম আর কঠিন। নিতুর ফুপি বাসায় গিয়ে ছোট বোন আর ভাইকে সব বলে।তারাও ফোন করে সালেহাকে অনেক কটু কথা শোনায়।আর বারবার মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কথা বলে। নিতুর চাচা এই সুযোগে টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়। চলতে কষ্ট হলেও সালেহা ঠিক করে এদের কাছ থেকে আর কোন রকম সাহায্য সে নেবে না।
এরই মাঝে নিতুর এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। নিতু যদিও ভালো ছাত্রী না তবুও বাবার ইচ্ছার পুরনের জন্য দিন রাত পড়াশোনা করে। মোটামুটি ভালো ভাবেই পরীক্ষা শেষ করে নিতু। পরীক্ষা শেষ হবার কিছু দিনের মাঝেই ডাক্তার চাচা নিতুর জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে।ছেলের নাম তৌসিফ।
বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে তৌসিফ।বয়স চব্বিশ।মা মরিয়ম আক্তার মারা গেছে সেই ছোট্ট বেলায়।বাবা আকবর আলির অতিরিক্ত আদরে বড় হয়েছে।এইচএসসি পরীক্ষার পর তৌসিফ আর পড়াশোনা করেনি। এলাকায় বন্ধুদের পাল্লায় পরে পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পরে। কিছুটা বখাটে হয়ে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে বসে আড্ডাবাজি করা,সিগারেট খাওয়া, সুন্দরী মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়ানো আর বাবার টাকা বসে বসে খরচ করাই যেনো তার একমাত্র কাজ ছিলো। তবে তৌসিফ এর মনটা ভালো। একমাত্র ছেলে হওয়ায় আর মা না থাকার কারনে বাবা,চাচার অতিরিক্ত ভালোবাসায় যখন দেখলো ছেলে পুরোপুরি বিপথে যাচ্ছে তখন তৌসিফ এর বাবা জোর করে নিজেদের ব্যবসায়িক কাজে ছেলেকে বসিয়ে দেয়।আকবর আলির নিজের একটা দোকান আছে মালিবাগে মৌচাক মার্কেটে। কসমেটিকস এর দোকান। তবে দোকানে বসানোর পরেও কাজের প্রতি ওর অমনোযোগীতা দেখে আকবর আলি ভাবে বিয়ে দিয়ে দিলে হয়তো ছেলে সংসারী হবে,বখাটে গুলোর সঙ্গ ছাড়বে।আর তাই মেয়ে খোঁজা শুরু করে।
তৌসিফ দেখতে শ্যামলা,লম্বা,এক কথায় সুদর্শন যুবক। মগবাজারে নিজেদের তিনতলা বাড়ি। দুই চাচাসহ একসাথে থাকে এখানে। তৌসিফরা থাকে দোতলায় ।
আসিফ ডাক্তার এর পেশেন্ট হলো আকবর আলি।প্রায়ই আসতেন চেম্বারে।সেই সুবাদে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুজনের মাঝে।ছেলের বিয়ের কথা বললে আসিফ ডাক্তার এর নিতুর কথা মনে পড়ে।আর তাই সে নিতুর সাথে তৌসিফ এর বিয়ের কথা বলে।আকবর আলি খুব অমায়িক তাই তিনি ভাবেন ছেলেও নিশ্চই বাবার মতো হবে।আর এজন্যই খুব বেশি না ঘেটে বিয়ের কথা বলে ফেলে।
সালেহা বেগম প্রথমে এখনি নিতু কে বিয়ে দিতে না চাইলেও পরে সবকিছু ভেবে রাজি হয়ে যায়। তবে আগে নিতুর সাথে কথা বলে তারপর ডাক্তার কে সিদ্ধান্ত জানাবে বলে একটু সময় চায়।সালেহা নিতু কে ডেকে তৌসিফ এর ব্যাপারে সবকিছু বলে। নিতু বিয়েতে প্রথমে রাজি হয়না।কারন আতিক ভাই এর করা অসভ্যতামি নিতু এখনো পুরোপুরি ভুলতে পারেনি।আর ঐ রাতের ঘটনার পর থেকে পুরুষ দের প্রতি ওর একটা নেতিবাচক ধারনাও তৈরি হয়।তাই নিতু বলে,’মা আমাকে পর করে দেয়ার জন্য এতো তাড়াহুড়ো করছো কেনো? আরো কিছুদিন তোমার সাথে আমাকে থাকতে দাও। এতো তাড়াতাড়ি আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাইনা।’
মা নিতু কে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বলে,’সব মেয়েকেই একদিন বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়।তোর বাবা নেই। তোদের ডাক্তার চাচা যেহেতু প্রস্তাবটা এনেছে তাই আমার মন হয় ভালোই হবে।আশা করি তুই বুঝতে পারবি।’
নিতু কি বলবে ভেবে পায়না।কারন সে পড়ালেখা করে চায়। তবুও সব কিছু ভেবে মায়ের দিকে তাকিয়ে অবশেষে বিয়েতে রাজি হয় নিতু। সেতু, সাজিদ এতে বেশ খুশি হয়। পরদিন সকালেই সালেহা বেগম ডাক্তারকে ফোন দিয়ে ছেলের পরিবার কে নিয়ে বাসায় আসতে বলে।কারন বিয়ের আগের অনেক কথাবার্তা থাকে। যেহেতু নিতুর বাবা নেই তাই সব বিষয়েই নিতুর মা আগে কথা বলতে চায়। তাছাড়া ছেলে -মেয়েও কেউ কাউকে দেখেনি।তাই দেখার কাজটাও হবে।আর ছেলের নিতু কে পছন্দ হলে তবেই তো পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বড়রা।
এদিকে তৌসিফ ও ওর এই বাউন্ডলিপনা ছেড়ে এখনি বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিলো না।ওর তো এলাকায় সব সুন্দরী মেয়েকেই পছন্দ হয়।কোন একজনে বাধা পড়তে তৌসিফ এর মন একেবারেই সায় দেয়না।কিন্তু বাবার জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েই মেয়ে দেখতে আসতে রাজি হয়।
চলবে……