সুখের খোঁজে,পর্ব -৭,০৮

0
401

#সুখের খোঁজে,পর্ব -৭,০৮
#মৌমিতা হোসেন
০৭

নিতুর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে। তৌসিফ এর কাছে আসায় ও বেশ ভয় পায়,বিরক্ত হয়।ওর তো ভালো লাগেনি। অনেক কষ্ট হয়েছে।এখনো হচ্ছে।এতো দিন নাটক, সিনেমায় স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্ক দেখেছে।এমন সম্পর্ক তো দেখেনি ও। মা-বাবাকেও দেখতো তারা কতো সুখি। তাহলে ওর বেলায় এমন হলো কেনো।

ধীরপায়ে হেঁটে নিতু আলমারি থেকে চাদর নিয়ে বিছানার চাদর পাল্টে দেয়।এর মধ্যে দরজায় কেউ ধাক্কা দিলে তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচল দিয়ে বড় করে ঘোমটা দেয় যাতে গলার দাগ না দেখা যায়। দরজা খুলতে যাবে এমন সময় তৌসিফ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নিতু কে থামতে বলে।নিজে গিয়ে দরজা খুলে দেখে বিথি, সাদিয়া এসেছে। তৌসিফ বলে,”কিরে এতো সকালে এসে দরজা নক করছিস কেনো?কি দরকার।”

তৌসিফ বাসার সবার সাথেই এমন একটু মেজাজ ভাব নিয়ে থাকে।তাই তপু ছাড়া বোনদের সবাই ওকে একটু ভয়ই পায়। তপু ভালো ছেলে, ঠিকমতো পড়ালেখা শেষ করে এখন চাকরি খুঁজছে, সবাই ভালো বলে তাই তৌসিফ এর সাথে ওর লাগালাগি চলতেই থাকে। তৌসিফ এর লাইফস্টাইল তপুর একেবারে পছন্দ না।এই বিয়ের আগে ও তৌসিফ কে বলেছিলো যে যদি ঠিকমতো সংসার করতে পারে তবেই যেনো বিয়ে করে । নতুবা শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন যেনো নষ্ট না করে। তৌসিফ ও বিয়েটা করতে চায়নি কিন্তু বাবার জন্য শেষমেষ করতে বাধ্য হলো।

যাই হোক বিথি ভাইয়ের কথায় উত্তর দেয়,”ভাইয়া চাচা,মা সবাই ভাবিকে আর তোমাকে ডাকছে নাস্তা খেতে।চলো।”

“হুম আসছি একটু পর। গিয়ে বল সবাইকে খাওয়া শুরু করতে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে, বলছিলাম যে ভাবি কোথায়?”

তৌসিফ তাকায় বোনদের দিকে,”আছে ভেতরে।রেডি হচ্ছে।যা এখন।”বলেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাড়ান্দায় চলে যায় মাথা মুছতে মুছতে।রুমের সাথেই দক্ষিনে একটা বাড়ান্দা আছে। সেখানে খাঁচায় একটা টিয়া।সকালে কাপড় নাড়ার সময় দেখেছিলো নিতু। নিতু চুপচাপ দাঁড়িয়ে তৌসিফ এর কান্ড দেখলো আর কথা শুনলো।

তৌসিফ রুমে এসে নিতু কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,”কী ব্যাপার মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তাড়াতাড়ি রেডি হও।আর একটু ঢেকেঢুকে থেকো।এই ওয়েনমেন্ট লাগিয়ে নাও।”

নিতুর কেনো জানি তৌসিফ এর কথা ভালো লাগছে না।তাই কিছু না বলে চুপচাপ রেডি হলো।গয়না গুলো পড়লো।চুড়ি পরলো যাতে হাতের কাটা জায়গা দেখা না যায়।মাথায় বড় করে ঘোমটা দিতে নিলে তৌসিফ আবার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে নেয়। নিতু খানিক ভয় পেয়ে সরে গিয়ে দ্রুত দরজা খুলে বের হয়ে বাইরে গিয়ে দাড়ায়। এতে তৌসিফ এর বেশ রাগ হয়। নিতু কে বেশ পছন্দ হয়েছে ওর।একদম নরম তুলতুলে। দেখলে নেশা ধরে যাচ্ছে। তবে এই পছন্দ ঠিক তেমন পছন্দ নয়। দৈহিক টান বলা যায় একে।তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে পাঞ্জাবি পড়ে বের হয়। নিতুর সাথে রাগে কোন কথা বলেনা। তৌসিফ এর পেছনে পেছনে নিতু ধীরপায়ে হেঁটে ডাইনিং এ যেতেই দেখে চাচা,চাচি,বাবাসহ সবাই বসে কথা বলছে। নিতু সবাইকে সালাম জানায়।।বিথি, সাদিয়া দ্রুত এসে নিতু কে নিয়ে চেয়ারে বসায়। তৌসিফ ওর মতো করে চেয়ার টেনে বসে খাওয়া শুরু করে।অন্য সময়ে সবাই যার যার বাসাতেই খাওয়া দাওয়া করে। তৌসিফ এর বিয়ের জন্য আজ সবার এক সাথে খাওয়া দাওয়া।যাই হোক টেবিলে তপুও বসেছিলো। তপু কানের কাছে এসে তৌসিফ কে বলে,” আজতো বৌ এর জন্য অপেক্ষা কর।আর কি করেছিস ওর সাথে? মেয়েটা তো হাঁটতে ও পারছেনা।”

তৌসিফ রেগে তাকায় তপুর দিকে। কিন্তু সবাই সামনে থাকায় কিছু না বলে চুপ থাকে। তপু নিজেই পরিচিত হয় নিতুর সাথে।বয়স অনেক কম দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নিতুর জন্য মায়া হয় তপুর।নাস্তা শেষ হলে আকবর আলি তৌসিফ কে বলেন বিকেলে রেডি হয়ে নিতু কে নিয়ে যেনো ওদের বাসায় যায়। ওখানে একদিন থেকে তারপর যেনো চলে আসে।

এই কথা শুনে নিতু বেশ খুশি হয়।কারন ও আজ আর তৌসিফ এর সাথে থাকতে চাচ্ছিলোনা। মাকে খুব মিস করছে নিতু।কিন্তু তৌসিফ বাধ সাধে।বলে,”বাবা আজ আমার বন্ধুরা আসবে নিতু কে দেখতে।আর আমারও একটু কাজ আছে। তাই আজ যেতে পারবো না।কাল নিয়ে যাবো।”
এই কথা শুনে নিতুর মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কিছু বলতে পারেনা।

তৌসিফ নাস্তা শেষ করে রুমে যাওয়ার আগে নিতু কে রুমে যেতে বলে। এদিকে বিথি, সাদিয়া সহ সবাই সামনে থাকায় ইচ্ছা করে নিতু রুমে যায়না। ওদের সাথে বসে কথা বলতে থাকে। রুমে গিয়ে তৌসিফ অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে বের হয়ে দেখে তখনও নিতু ওর বোনদের সাথে গল্প করছে। দেখেই তৌসিফ এর মেজাজ বিগড়ে যায়। রেগে নিতু কে ডাকতেই ও কেঁপে ওঠে।বিথিরাও ভয় পেয়ে বলে,”আচ্ছা ভাবী তুমি রুমে যাও ভাইয়া ডাকছে। বিকেলে গল্প করবো।”

নিতু ভয় পায়। তৌসিফ এর চোখের দিকে তাকিয়েই মাথা নিচু করে ফেলে। তৌসিফ ওর হাত ধরে রুমে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।গলার স্বর উঁচু করে বলে,”কখন তোমাকে ডেকে এসেছি। এতোক্ষণ আসোনি কেনো?”

হাত কচলাতে কচলাতে উত্তর দেয়,”সবাই গল্প করছিলো তাই..”

কথা শেষ হবার আগেই তৌসিফ এসে ওর গাল চেপে ধরে বলে,”এরপর থেকে আমি ডাকলে যেনো সাথে সাথে সামনে হাজির থাকো।এর ব্যাতিক্রম হলে খবর আছে।”

নিতু কেঁদে দেয়। কাঁপা কন্ঠে বলে,”আ..র কখনো এমন হবে না। আমি ব্যাথা পাচ্ছি। দয়া করে ছাড়ুন আমাকে।”

নিতুর কান্না দেখে তৌসিফ ওকে ছেড়ে দিয়ে আকষ্মিক ঘর ছেড়ে বাইরে চলে যায়। নিতু কিছুই বুঝতে পারেনা। তবে এই পনেরো দিনের ভালোলাগাটা আস্তে আস্তে যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। তৌসিফ দুপুরে বাসায় খেতে আসে না। নিতুর অবশ্য তৌসিফ না থাকায় ভালো লাগছে। দুপুরে খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ চাচি,বিথি, জুঁই সবার সাথে গল্প করে রুমে এসে কখন যে নিতু ঘুমিয়ে পরে টেরই পায়নি।সমস্ত শরীর ব্যাথায় নিতুর কিছু ভালো লাগছিলো না।সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যায় তখনো তৌসিফ ঘরে না ফিরলে আকবর আলির চোখে লাগে। তিনি তৌসিফ কে ফোন দেয়।কাজ,ব্যস্ততা ইত্যাদি জানিয়ে লাইন কেটে দেয় তৌসিফ।আকবর আলি বুঝতে পারে ইচ্ছা করেই আজ নিতু কে ঐ বাসায় নিয়ে যায়নি তৌসিফ। হয়তো বন্ধুদের সাথে বসে কোথাও আড্ডা দিচ্ছে।।মন খারাপ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করে এবার যেনো ছেলেটা ঘরমুখো হয়,অসৎসঙ্গ ত্যাগ করে।

এদিকে নিতু সন্ধ্যার পর মাকে ফোন দিয়ে অনেকক্ষন কথা বলে। সাজিদ,সেতু ও কথা বলে।ওরা বারবার নিতুরা কখন বাসায় যাবে সেটা জানতে চায়। নিতু বলে যে পরদিন যাবে। তৌসিফ কেনো আজ ওকে বাসায় নিয়ে গেলো না সেটা ও আর ভাবতে পারলো না। নিতুর কাছে সব কিছু খুব অদ্ভুত লাগে। ছোট্ট এই জীবনে কখনো প্রেম ভালোবাসার পাল্লায় পড়েনি।বাবা-মা এর ভালোবাসা দেখে ভাবতো সব স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনে হয় এমনি সুন্দর মিষ্টি সম্পর্ক থাকে। তৌসিফ কে দেখার পর থেকে গতো পনেরো দিন নিতুও ওকে নিয়ে সময়ে অসময়ে সুন্দর স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু কাল রাতের পর থেকে ওর আর ভালো লাগছেনা।সব কিছুই বিরক্ত লাগছে। মনে মনে ঠিক করে বাসায় গিয়ে মাকে বলবে বিষয়টা। ভাবতে ভাবতে কখন যে অনেক রাত হয়েছে নিতু সেটা টেরই পায়নি।

রাত দশটা বাজলে ও তৌসিফ বাড়ি না ফিরলে আকবর আলির নিতুর জন্য খারাপ লাগে। তিনি নিতুর কাছে এসে বলেন,”একটা জরুরী কাজ পরে যাওয়ায় তৌসিফ এর আসতে দেরী হবে মা।তুই নাহয় খেয়ে শুয়ে পর।তোর শ্বাশুড়ি থাকলে এসব দায়িত্ব সেই পালন করতো।আর আমার ছেলেটাও হয়তো এমন হতো না কিন্তু কি করবো বল সবই ভাগ্য।আস্তে আস্তে সংসার এর দায়িত্ব তোকেই বুঝে নিতে হবে মা। আমি তাহলে এখন যাই শুয়ে পরি।”

নিতু কিছুই বলেনা। চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। হালকা জ্বর অনুভব করায় কিছু না খেয়েই শুয়ে পরে।আজও গভীর রাতে হঠাৎ কারো স্পর্শে ঘুম ভাঙে নিতুর। উঠতে গেলেই তৌসিফ এর কন্ঠস্বর শুনে কি করবে ভেবে পায়না। নিতুর তখন ভালোই জ্বর শরীরে,প্তচন্ড মাথা ব্যাথা সাথে শরীর ব্যাথা। তৌসিফ যখন নিজের কাজে ব্যস্ত তখন কষ্টে এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিতু বাধা দেয় তৌসিফ কে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,”প্লিজ আমাকে এখন ছাড়ুন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। অনেক ব্যাথা হয়।”

বেসামাল তৌসিফ নিতুর কোন কথাই শোনে না। শুধু বলে,”সারাদিন ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর নয়।তাই চুপ থাকো।”উন্মাদের মতো তৌসিফ নিতু কে ভোগ করে।কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে আজও এক পর্যায়ে নিতু জ্ঞান হারায়।কখন যে ভোর হয় টেরই পায়না নিতু। তৌসিফ এর ডাকে নিতুর জ্ঞান ফেরে।চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নিতু কে ডাকছে। নিতু দ্রুত উঠতে গিয়েও পারেনা উঠতে। তৌসিফ মনে হলো একটু স্বস্তি ফিরে পায়। নিতু কে বলে,”তোমার অবস্থা দেখেতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।এই টুকুতেই এই অবস্থা?বাকি জীবন তোমাকে নিয়ে কীভাবে কি হুম? উঠে ফ্রেশ হয়ে ওষুধ খাও।তারপর রেডি হও।আজ তোমার বাসায় যাওয়ার কথা।”

নিতু এতোক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে সব শুনেছে। কিন্তু কোন উত্তর দেয়নি।ভয়, ঘৃনা,লজ্জা সব ঘিরে ধরেছিলো ওকে। বিছানা থেকে কোনরকম নেমে ওয়াশরুমে যাবে তখনি তৌসিফ আবার ডাকে। একটু আমতা করে বলে,”স্বামী-স্ত্রীর এসব কথা আবার বাইরে অন্য কাউকে বলো না যেনো।”

নিতু হালকা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে যায়। খুব কষ্ট হচ্ছিলো নিতুর।রেডি হয়ে দুজন একসাথে নাস্তা করে । নিতু ওষুধ খায়। সবাই নিতু কে দেখে জিজ্ঞেস করে নিতুর কি হয়েছে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে ও অসুস্থ।তৌসিফ বলে যে জ্বর হয়েছে।এসব বলে কাটিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি নিতুর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

নিতুর মায়ের বাড়িতে আজ উৎসব। বিভিন্ন রান্নার আয়োজন চলছে। জামাই আসবে বলে কথা। সাজিদ, সেতু মহাখুশি। দুপুরে ওরা বাসায় পৌঁছালে সালেহা এসে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে। নিতু মাকে ধরে কেঁদে দেয়। সালেহা নিতু কে দেখে আঁতকে ওঠে। মেয়েকে দেখে মায়ের মন কেনো জানি বলছে মেয়ে ভালো নেই।শরীরের উত্তাপ টের পায় সালেহা।মেয়ের করুন মুখের দিকে তাকাতেই তৌসিফ এসে সালাম জানায়।আর বলে,”মা আসলে বিয়ের অতিরিক্ত ধকলের জন্য নিতুর পড়শু থেকেই জ্বর। আপনি চিন্তা করবেন তাই জানানো হয়নি। ওষুধ খাচ্ছে কমে যাবে ইনশাল্লাহ।”

সালেহা আর কথা বাড়ায়না। দুজনকে নিতুর রুমে নিয়ে গিয়ে রেস্ট নিতে বলে রুম থেকে বের হয়। কিন্তু বুকের ভেতর কেমন জানি করতে থাকে সালেহার।মায়ের মন হয়তো এমনি। সন্তানের কিছু হলে না বলতেও টের পেয়ে যায়।

চলবে….

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৮)
#মৌমিতা হোসেন

সেতু, সাজিদ বোন দুলাভাই কে পেয়ে ওদের রুমে থেকে আর বেরই হচ্ছেনা। দুলাভাই এর সাথে নানান গল্প জুড়ে দেয়। নিতু খালা আর মায়ের সাথে রান্না ঘরে শ্বশুর বাড়ির গল্প করতে থাকে।সবার কথা খুব ভালো বললেও তৌসিফ এর ব্যাপারে যে ও কোন কথাই বলছেনা সেটা সালেহা ভালো ভাবেই খেয়াল করলো।এর মাঝে নিতুর হাতের কাটা দাগ,ক্লান্ত চোখ কোন কিছুই সালেহার চোখে এড়ায়নি। সালেহা মনে মনে ভয় পায় ভাবে মেয়েকে কি তবে ভুল জায়গায় বিয়ে দিলো? তৌসিফ এর কথা জিজ্ঞেস করলে বারবার এড়িয়ে যায় নিতু। নিতু ভেবেছিলো মাকে তৌসিফ এর কথা বলবে। কিন্তু মায়ের সাথে কতোটুকু শেয়ার করা যায়?এসব ব্যাপার কি মায়ের সাথে আলাপ করা যায়? এই নিয়ে দ্বন্দ্বে পরে কিছু বলতে পারেনা। সালেহা বুঝতে পারছিলো নিতুর সমস্যা।তাই বোনকে আড়ালে ডেকে সময় সুযোগ মতো নিতুর সাথে আলাপ করতে বলে।

সন্ধ্যায় প্রতিবেশীরা আসে নিতু আর জামাই এর সাথে দেখা করতে। এভাবেই দুপুর, সন্ধ্যা পার হয়। এতো নিয়ম,এতো মানুষ সব দেখে তৌসিফ এবার বিরক্ত হতে থাকে।তৌসিফ নিতু কে কয়েকবার ডাকলে সেতুকে নিয়ে এসে যখন যেটা লাগবে সেটা দিয়ে আবার দ্রুত ওর সামনে থেকে চলে যায়। এতে তৌসিফ আরো বেশি বিরক্ত হয়।রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানায় বসে তৌসিফ নিতুর অপেক্ষা করতে থাকে।এমন সময় সাজিদ রুমে এসে তৌসিফ এর পাশে শুয়ে পরে। তৌসিফ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে,”সাজিদ তুমি এখানে কেনো? নিতু কোথায়?”

ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে সাজিদ উত্তর দেয় ,”ভাইয়া আমি আপনার কাছে ঘুমাবো।মায়ের শরীর খারাপ হওয়ায় আপু মায়ের সাথে থাকবে।”

তৌসিফ এর মেজাজ যেনো মুহুর্তেই খারাপ হলো।ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো যে এটা নিতুর চালাকি। শ্বশুর বাড়ি তার ওপর বাড়ি ভর্তি মেহমান তাই তৌসিফ কিছু বলেনা। চুপচাপ বাড়ান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকার আকাশে জ্বলজ্বল করছে তারা। হালকা বাতাস বেশ ভালো লাগতে থাকে ওর।ভাবতে থাকে সারাদিনের কথা। শ্বাশুড়ি মাকে ওর ভালোই পছন্দ হয়।মা নেই তাই হয়তো মায়ের আদর পেতে ভালো লাগে। খুব যত্ন করে খাওয়ায় ওকে,গল্প করে, খাওয়ার সময় পাশে বসে থাকে।তাই অনেক দিন পর মনে হলো ও একটু তৃপ্তি সহকারে খেতে পেরেছে। বাসায় মা না থাকায় বেশিরভাগ সময় একা একাই খায় ও।আগে বাবা দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।চাচিরা আদর করলেও সবাই যে যার সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। তৌসিফ এর জন্য যেনো কারো সময় ছিলোনা।তাই এইচএসসি পরীক্ষার পর আস্তে আস্তে বন্ধুদের পাল্লায় পরে একটু বেপরোয়া হয়ে যায়। পড়ালেখার সমাপ্তি ঘটায়।সব দিক দিয়ে তপু ভালো তাই সবাই তপুর প্রশংসা করে এতে তপুর প্রতি ওর হিংসা জন্মায়।জিদ করে বন্ধুদের নিয়েই সময় কাটাতে থাকে তৌসিফ।

হঠাৎ নিতুর ডাকে পেছনে ফিরে তাকায় তৌসিফ। বিরক্ত হয়ে বলে,”কি চাই? এখানে এসেছো কেনো? তুমি যে ইচ্ছা করেই সাজিদ কে পাঠিয়েছো সেটা আমি ভালোই বুঝতে পেরেছি।”

নিতু শাড়ির আঁচল আঙুলে পেচাতে থাকে। তৌসিফ এর রাগ দেখে খানিকটা ভয় পায়।সাহস করেই বলে,”আসলে মায়ের শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে যায় তাই আমি আর খালা মায়ের কাছে থাকতে চাই। পানি রেখে যাচ্ছি। কিছু লাগলে ডাকবেন। আমি এসে দিয়ে যাবো।”

কথা শেষ হতেই তৌসিফ নিতুর কাছে এসে বলে,”আমার তো তোমাকে দরকার। বিয়ে করেছি কি বৌ মায়ের কাছ থাকবে বলে?”
এই কথা বলে নিতু কে জড়িয়ে ধরতে নিলে নিতু আবারো তৌসিফ কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় আর এক দৌড়ে চলে যায় রুম থেকে। তৌসিফ খুব বিরক্ত হয়।ও ভাবে মেয়েটার সমস্যা কি?যখনই কাছে যায় তখনই এমন করে।বেশ রাগ হয় ওর।

নিতু মুলত জোর করে মায়ের কাছে থাকে। সালেহা প্রথমে রাজি না হলেও পরে নিতুর কান্না দেখে রাজি হয়।ভাবে একটা রাতই তো।থাকুক না হয়।

এদিকে নিতুর খালা সন্ধ্যার পরপরই নিতুর সাথে কথা বলতে বলতে ওর মন খারাপের কারন আর তৌসিফ এর ব্যাপারে সব কিছু জানতে চায়। নিতু যতোটুকু বলা যায় তার সবটাই বলে।খালা নিতু কে বোঝায় সংসার জীবন সম্পর্কে।আর বোনকেও ব্যাপারটা জানায়। যেহেতু শ্বশুর বাড়ির সবাই ভালো। নিতু কে এই দুই দিনেই বেশ ভালোবাসা দিয়েছে,আর মা ছাড়া বড় হওয়া তৌসিফ এর কথাও তার জানা তাই সালেহা ভাবে আস্তে আস্তে সব হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।আর তাই সালেহা ঠিক করে এ ব্যাপারে কথা বলবে মেয়ের সাথে। রাতে মায়ের কাছে ঘুমানোর জন্য আবদার শুনে তাই সালেহা প্রথমে অমত করলেও পরে আর কিছু বলেনা।

সেতু ঘুমিয়ে পড়লে সালেহা মেয়েকে নিয়ে বাড়ান্দায় বসে।নিতু মায়ের কোলে মাথা রাখতেই সালেহা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।সালেহা বলে,”আজ তোকে কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শুনবি।”

“হ্যা মা শুনবো।বলো।”

সালেহা বলতে থাকে”বিয়ের পর মেয়েরা সকল আপনজনদের ছেড়ে এক নতুন পরিবারে, নতুন পরিবেশে যায়। সেখানে কোন কিছুই প্রথম প্রথম মেয়েদের ভালো লাগে না।খাপ খাওয়াতে, নতুন মানুষদের আপন করতে যথেষ্ট সময় লাগে।কারো মানসিকতাই হয়তো তোর সাথে মিলবে না।যদি কারোর সাথে মিলে যায় তবে বুঝতে হবে তোর ভাগ্য ভালো। সমস্যা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদেরকেই মানিয়ে নিতে হয়।তোর কাছ থেকে শুনে মনে হলো তোর শ্বশুর বাড়ির সবাই বেশ ভালো। শুধু তৌসিফ এর ব্যাপারেই তুই চুপ আছিস। নতুন পরিবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলো ও। তৌসিফ এর পছন্দ,অপছন্দ, ভালোলাগা,মন্দলাগা সব কিছুই তোর আপন করে নিতে হবে। ছেলেটা মায়ের আদর পায়নি।তাই যথেষ্ট পরিমাণে ভালোবাসা দিয়ে ওকে ঘরমুখো করতে হবে।”

একটু থেমে আবার বলে,”তোর বাবা বেঁচে নেই। আমি চাইলেই যেকোন কিছু করতে পারিনা। আমি বুঝতে পারছি তৌসিফ এর কোন ব্যাপারে তোর হয়তো সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এখানে আমার কিছুই করার নেইরে মা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেমন খুব সহজ তেমনি খুব কঠিন। খুব হিসেব কষে চলতে হয়। একটু ধৈর্য ধর দেখবি আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। খুব শীঘ্রই সুখের খোঁজ পাবি । অপেক্ষা কর মা।তোর তরফ থেকে কখনো জামাই কে কোন অভিযোগ করার সুযোগ দিসনা।এমন কিছু কখনো করিসনা যাতে আমার অসম্মান হতে পারে।”

এতোক্ষণ মায়ের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো নিতু।সব বুঝলেও ওর প্রতি তৌসিফ এর আচরন ওর বোঝার বাইরে ছিলো।এই দুই দিনে তৌসিফ এর ব্যবহার ওর একটুও ভালো লাগেনি। তবুও মায়ের কথা শুনে আর কিছু বলতে পারলো না। নিতু বুঝে নিলো যে বিয়ের পর মেয়েরা পর হয়ে যায়। তখন চাইলেই আর মায়ের কাছে ফিরে আসা যায়না।নিতুর চোখ থেকে পানি ঝরছ।তাই অস্ফুট স্বরে বললো,”চিন্তা করোনা মা। আমি চেষ্টা করবো সবার মন রক্ষা করে চলতে। কখনো কাউকে কোন অভিযোগ করতে দেবো না।”

সালেহা ও মেয়েকে জরিয়ে ধরে কাঁদছে।

পরদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার পরেই তৌসিফ বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিতু কে বলে রেডি হতে। নিতু ভেবেছিলো রাতে যাবে। কিন্তু তখনই রেডি হতে বললে করুন চোখে একবার তৌসিফ এর দিকে তাকায় আর একবার মায়ের দিকে তাকায়। সালেহা বলে,”দুপুরে খেয়ে গেলে ভালো হতো না?”

তৌসিফ এমনিতেই নিতুর ওপর রেগে ছিলো।তাই আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,”মা আমার কিছু কাজ আছে। আবার আসবো নাহয়।আজ যেতে হবে।”

সালেহা আর কিছু বলার সাহস পায়না।মেয়ের পছন্দের কিছু খাবার বানিয়েছিলো সেগুলো রেডি করতে চলে যায়। সেতু, সাজিদ বেশ মন খারাপ করে।নিতুও চুপচাপ রেডি হতে চলে যায়।এর মাঝে নিতু আর তৌসিফ কেউ কারো সাথে আর কোন কথা বলেনি।যাওয়ার সময় নিতু খুব কাদে।ওর একটুও যেতে ইচ্ছে করছিলো না। তৌসিফ শ্বাশুড়ি কে আশ্বাস দেয় যে আবার নিয়ে আসবে নিতু কে।

বাসায় ঢুকতেই আকবর আলি একটু অবাক হয়।কারন ওদের রাতে আসার কথা ছিলো। তৌসিফ কে জিজ্ঞেস করতেই ও বলে”কিছু কাজ আছে আর ভালো লাগছিলো না তাই চলে এসেছে।”

নিতু মন খারাপ করে রুমে গিয়ে বসে থাকে।এর মধ্যেই তৌসিফ রুমে এসে দরজা লাগিয়ে নিতুর কাছে আসলে ওর খুব অশ্বস্তি হয়।পানি আনার নাম করে বাইরে যেতে নিলে তৌসিফ আটকায়।হাত ধরে বলে,”তোমার সমস্যা কি?সব সময় পালিয়ে বেড়াও কেনো?ঐ বাসায় যাওয়ার পর থেকে একবার ও কাছে আসো নি। কারন টা কি?”

নিতু হাত ছাড়াতে নেয় কিন্তু পারেনা।ও ভয় পায়। কাঁপা কন্ঠে বলে,”আমি হাতে ব্যাথা পাচ্ছি।হাত ছাড়ুন।”

তৌসিফ নিতু কে জরিয়ে ধরে। কপালে চুমু খায়। মনে মনে বলে,”কিছু একটা আছে এর মাঝে। নাহলে এই দুই দিনেই নিতুর প্রতি কেমন আসক্তি অনুভব করবে কেনো। মেয়েটাকে দেখলেই ওকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।কেমন জানি এক অস্থিরতা ঘিরে ধরে।”

নিতু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু ব্যার্থ হয়।এই দুই দিন নিতু কে কাছে না পাওয়ার জিদ যেনো পুরন করে তৌসিফ।ঘাড়ে মুখ গুজে দেয়।নিতুর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে। আজকেও নিতুর খুব কষ্ট হয়।তাই প্রথমে বাধা দিলেও পরে মায়ের কথা মনে করে চুপ হয়ে যায়। ভালো না লাগলেও,মন থেকে না চাইলেও তৌসিফ এর কথার ওপর কথা বলা যাবে না।কারন তৌসিফ ওর স্বামী।আর এটা তার অধিকার।মায়ের কথা মেনে চলতে হবে তাকে।তাই মনকে শক্ত করে নিতু।

আর তৌসিফ যেনো এভাবে নিতুকে কাছে টেনেই ওর ভেতরের অস্থিরতা কমালো। তৌসিফ নিজের প্রয়োজন পুরন করে ফ্রেশ হয়ে নিতু কেও ফ্রেশ হতে বলে চলে যায় বাইরে। নিতু মনকে শক্ত করে। ফ্রেশ হয়ে সুন্দর লাল টকটকে একটা শাড়ি পরে।এর মধ্যে জুঁই, সাদিয়া ,বিথি চলে আসে ওর সাথে দেখা করতে। সবাই মিলে বেশ গল্প করে। জুঁই, সাদিয়া র পড়া আছে তাই ওরা একটু পরে চলে যায়।বিথির নিতু কে খুব পছন্দ হয় তাই ও থাকে। গল্পের এক পর্যায়ে নিতু বলে,”বোন আমাকে এ বাসাটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবে?”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here