#সুখের_নেশায়,পর্ব_৫৮ শেষ
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার অভিমান লেগেই থাকে। প্রেমিকারা বড্ড অভিমান প্রিয় হয়। অভিমান করাও যেন একটি বিশেষ গুণ। এই গুণ যার নেই তার পক্ষে কখনও প্রেমিক কিংবা স্বামীর ভালোবাসাময় সিক্ত কন্ঠনালি হতে ‘অভিমানিনী’ সম্বোধন খানা শোনা হবে না। অভিমান করলেই তো তুমি বিবেচিত হবে অভিমানিনী হিসেবে। তেমনই জার্মানির আবহাওয়া ঢেড় অভিমান করে। ইউরোপ মহাদেশের অন্যতম দেশ জার্মানির যেন অভিমানের শেষ নেই। কখনও রৌদ্দুর হয়ে যায় তো কখনও মেঘ। কখনও তুষার হয় তো কখনও বা অগ্নি। একই দিনে ভিন্ন রূপ ধারণ করতে দেখা যায়। আবহাওয়া রূপ বদলের মাধ্যমে যেন অভিমান প্রকাশ করার কান্ডকারখানা দেখে জার্মান বাসীরা ধরেই নেয় তাদের মাতৃভূমি জার্মানি অভিমান প্রিয়।
ছোট্ট সুখ কে কোলে নিয়ে প্রিয়ন্তী বাড়ির সামনের বাগানে হাঁটাহাঁটি করতে ব্যস্ত। বাচ্চা মেয়েটার অশান্তি লেগেই আছে সকাল থেকে। শান্তি পাবেই বা কেমন করে!এতটুকু বয়সে একদিনে তাপমাত্রার এত পরিবর্তনে অবুঝ সুখের-ও ভালো লাগছে না। জুন মাস চলছে। প্রিয়ন্তী বার্লিনের কিছু স্থানীয় মানুষের কাছে শুনেছিল জুন মাসে না-কি জার্মানির একই দিনে চার ঋতুর দেখা মিলে। কথাটা প্রথমত অনেকটাই আশ্চর্যজনক মনে হয়েছিল প্রিয়ন্তীর নিকট। কিন্তু আজ হারে হারে টের পাচ্ছে। যদিও চার ঋতুর দেখা পায় নি তবে দুই ঋতুর পেয়ে গেল। সকাল হতে তাপমাত্রার একবার বৃদ্ধি হচ্ছে আবার কমছে। আজ ভোর বেলা ঘুম ভাঙতেই সর্বপ্রথম চক্ষু যায় তার ঘোলাটে কাঁচের খিড়কির দিকটায়। গতরাতেও কি স্বচ্ছ দেখেছিল কাঁচ টা!অথচ কৃষ্ণ আঁধারের সমাপ্তি ঘটতেই ঘোলা হলো কিভাবে?কৌতূহলবশত ধীরস্থ ভঙ্গিতে ও এগিয়ে আসল জানালার কাছ টাতে। হাতের তালু দিয়ে জানালার কাঁচ টা ঘষতেই চোখে পড়ে বরফ পড়ছে। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসে-‘ তুষারপাত হচ্ছে!’ সিজন টা তুষারপাতের নয়। তবুও তীব্র গরমের মাঝে হুট করে তুষারপাতের আগমনে তব্দা খেয়ে যায় প্রিয়ন্তী। বিস্ময় কাটিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে আসে। নিচে আসতেই জানতে পারে সাফারাত ফিরতে পারে নি। আজ সকালেই তো বাংলাদেশ থেকে ফেরার কথা তার। চৈত্রিকাকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানায়,এয়ারপোর্টে এসে বসে আছে। হঠাৎ করে তুষারপাতের কারণে রাস্তা বল্ক হয়ে গিয়েছে। রাস্তা ক্লিয়ার হলেই চলে আসবে। এটা শুনতেই প্রিয়ন্তীর সকল খুশি উবে যায়। ভাইকে ছাড়া বাড়িটা নির্জীব মনে হয়। মাত্র দু’দিনের জন্যই তো গিয়েছিল মানুষ টা,কিন্তু চৈত্রিকাকে তাতেই মুখ কালো করে বসে থাকতে দেখেছে প্রিয়ন্তী। ব্যাস,ভাবীর মন খারাপ মানে প্রকৃতির চোখ ধাঁধানো রূপও জ’ঘ’ন্য।
সকালের সমাপ্তিতে দুপুরের আগমন। এখন আবার গরমের ঠ্যালায় হুঁশ নেই মানুষজনদের। হুট করে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে বেরুলে যেমন মনে হয় পুরো অঙ্গ জ্বলসে যাচ্ছে, তেমনই হাল জার্মানবাসীদের। ‘ সুখ’ কে বেশিক্ষণ এসি রুমে রাখা যায় না,শুধু শুধুই কান্না জুড়ে দেয় মেয়েটা। সাদীদ কে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিল চৈত্রিকা। তন্মধ্যে চিল্লিয়ে উঠে সুখ। তাই ওকে নিয়ে হাঁটতে বাগানে আসে প্রিয়ন্তী। বাড়ির সামনের স্থান টা বড় নয় খুব একটা। একদম মেইন রোডের সাথেই ওদের এই দু’তলা বাড়ি। এখানে এসেছে কয়েক মাস ঘনিয়ে এসেছে। আগের ফ্ল্যাট টা ছেড়ে এই বাড়ি টায় শিফট হয় ওরা। প্রিয়ন্তী পুতুলের মতো দেখতে সুখ কে মুখের সামনে এনে ধরলো। হেসে উঠল সুখ। হাসলে টোল পড়ে বাচ্চা এই মেয়েটার গালে। প্রিয়ন্তী মিষ্টি হেসে ওকে বুকে জড়িয়ে ফেলল। আহ্লাদী স্বরে বললো,
‘ আমার সুন্দরী আম্মা। আপনি না-কি আয়মানের সুখ?’
‘ টুমিও টো সুন্দর প্রিয়ন। ‘
কয়েকমাসে পরিচিত হওয়া কন্ঠস্বরের বিকৃত বাংলা ভাষা শ্রবণ হতেই প্রিয়ন্তীর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। চক্ষুদ্বয়ের আকার ছোট ছোট। চাহনি তীক্ষ্ণ। ফাইয়াদ মাথা চুলকে ওর সামনে এসে দাঁড়াল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে স্মিত হেসে বললো,
‘ টুমিও সুন্দর। অনেক সুন্দর। ‘
‘ আপনি এখানে কি করছেন?’
হাত বাড়িয়ে সুখ কে নিয়ে নিল ফাইয়াদ নিজের কাছে। ফাইয়াদের সঙ্গে বেশ সখ্যতা সুখের। দেখলেই পিটপিট করে চেয়ে থাকে। আদুরে ভঙ্গিতে হাসে। ফাইয়াদ ওকে কোলে নিয়ে বলে উঠল,
‘ মম আমার জন্য একটা মেয়ে দেকেছে বিয়ের জন্য। আমিও ছবি দেকেছি। এখন একটা কফি হাউসে দেকা করতে যাবো। টুমিও যাবে আমার সাথে। টুমাকে নিটে এলাম। ‘
প্রিয়ন্তী হতবাক,নিস্তব্ধ। তার স্থবির দৃষ্টি জোড়া নিবদ্ধ ফাইয়াদের দিক। আকস্মিক অন্তর টা প্রচন্ড ব্যাথা করছে ওর। কাঁপা কন্ঠে তেজের অস্তিত্ব ঢেলে দিল। এ মুহুর্তে সহ্য হচ্ছে না ফাইয়াদকে। বরঞ্চ এত মাস এই বিদেশি ভূত,জার্মানির বাচ্চাকে লাই দেওয়া টাই আকাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ করে বুকে যন্ত্রণার সূত্রপাত ঘটালো এই ছেলে। তেজী,রোষপূর্ণ কন্ঠস্বর প্রিয়ন্তীর,
‘ বিয়ে করবেন আপনি,আমি কেন যাবো?আপনার আর আপনার ওই হবু বউয়ের মধুময় প্রেমলীলা দেখতে?’
ফাইয়াদকে ক্রোধানলে দগ্ধ করে দ্রুত বেগে প্রস্থানের জন্য উদ্যত হয় প্রিয়ন্তী। নেত্র কার্নিশ বেয়ে এক বিন্দু জলও গড়িয়েছে, তবে তা উপস্থিত মানুষ টার অলক্ষ্যে, আড়ালে। ওকে যেতে দেখে ব্যগ্র, উত্তেজিত গলায় ডেকে উঠল ফাইয়াদ,
‘ প্রিয়ন!’
‘ একদম প্রিয়ন ডাকবেন না। ‘
প্রিয়ন্তীর থমকে যাওয়া পা দু’টোর দিকে এক পলক চেয়ে ফাইয়াদ নত মস্তকেই কয়েক পা এগিয়ে আসল। দু’জন কার মধ্যবর্তী পার্থক্য খুবই ক্ষীণ এবং কিঞ্চিৎ। ফাইয়াদ মুখ এগিয়ে আনল প্রিয়ন্তীর কানের অতীব নিকটস্থে। হৃদয়ের গতি নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে পড়ল ওর। আমতা আমতা করে ফাইয়াদকে কিছু বলবে তার পূর্বেই সে বলে উঠল,
‘ আমাকে বারণ করো না প্রিয়ন। এই ডাকে আমি ভালোবাসা খুঁজে পায়। এটা ভালোবাসার ডাক। ‘
অনুভূতিরা পাখনা মেলে উড়ার তোরজোর চালাচ্ছে। হৃদপিণ্ড লাব ডাব শব্দ সৃষ্ট করছে। শিহরণ বয়ে যাচ্ছে প্রিয়ন্তীর শিরা উপশিরায়,রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। ফাইয়াদের ঘাড়ে সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছুঁয়ে দিল ও। আনমনে প্রশ্ন করলো,
‘ ভালোবাসার ডাক?’
‘ ইয়েস প্রিয়ন। সারাজীবন ডাকটে চাই টুমায় এই নামে,ভালোবেসে। ‘
প্রিয়ন্তী অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসল,
‘ বিয়ে করবেন না তাহলে ওই মেয়েকে?’
ফাইয়াদ বাঁকা হাসল। বললো,
‘ ওটা মিথ্যে ছিল। টুমার চোকের বাষা দেকতে চেয়েছিলাম। টুমি প্রেমে পড়েছো প্রিয়ন। দিবে টো সারাজীবন টুমাকে ভালোবেসে ডাকার অনুমটি?’
লাজুক হাসল প্রিয়ন্তী। পরমুহূর্তেই মুখভঙ্গি বদলে ঠাট্টা করে বললো,
‘ অনুমটি গ্র্যান্টেড। ‘
যার সান্নিধ্যে নতুন করে হাসতে শিখেছে, মিলেছে সুখ নিঃসন্দেহে তার সন্নিকটে থাকা যায় আজীবন সুখের নেশায়।
______________
চৈত্রিকা সকাল থেকে রান্না বান্নার কাজে নিমজ্জিত। খুশিতে ওর দুই অধরে হাসি খেলে যাচ্ছে খানিকক্ষণ পর পর। পোলাও টা চুলা থেকে নামিয়ে নতুন কাজের মেয়ে অলিভিয়াকে বললো টেবিলে সাজিয়ে দিতে। অত্যাধিক সুন্দরী রমণী অলিভিয়া ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে বাধ্য মেয়ের মতোন প্রতি উত্তর করলো,
‘ ওকে ম্যাম। ‘
চৈত্রিকা দ্রুত পদে পা ফেলে নিচে অবস্থিত বড় কক্ষে প্রবেশ করে। বিছানার দিকে নজর যেতেই দেখে গালে হাত রেখে ঘুমোচ্ছে সাদীদ। ঠোঁট দু’টো ফোলা ফোলা, গোলাপি। মায়ার জ্বালে জড়িয়ে গেল চৈত্রিকা নিমেষে, তৎক্ষনাৎ। সাদীদের গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে বলে উঠল,
‘ বাবার কার্বনকপি। ‘
গোসল সেড়ে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ল চৈত্রিকা। দর্পণ অভিমুখে দাঁড়াতেই মনে পড়ে যায় সেই দিনটার কথা যেদিন সাফারাত বলেছিল আপনি লাল টুকটুকে হয়ে থাকবেন চৈত্র। আজ আবারও লাল রাঙা বউ হতে ইচ্ছে করছে। দু’দিনের দূরত্বে মনের যত শত যন্ত্রণার শুরু হয়েছে সকল কিছুর প্রশমন হিসেবে সেই মানুষ টাকে ঝাপটে ধরতে মন স্পৃহা জাগছে। পূর্বে দু’জন অব্যক্ত অনুভূতি নিয়ে দু’জনের কাছ থেকে দূরে ছিল বছরের পর বছর। অথচ আজ দুই দিনের দূরত্বে দম বন্ধকর পরিস্থিতি। ভালোবাসার রং পাল্টায়। এই নয় যে,ফিকে হয়ে যায়। বরং গভীর হতে গভীর হয় যদি অনুরাগ,অনুভূতি সত্য হয়। সাফারাত ফোন দিয়েছিল বাড়ির রাস্তায় আছে ওরা। চৈত্রিকা সাদীদের পাশে অলিভিয়াকে রেখে ড্রইং রুমে এলো। প্রিয়ন্তীর উদ্দেশ্যে বললো,
‘ ফাইয়াদ ভাইয়া চলে গিয়েছে? আর কখন আসবেন? ‘
প্রিয়ন্তী সুখ কে কোলে নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কন্ঠস্বর নরম,মায়াভরা,
‘ একেবারে সন্ধ্যায় জয়েন করবেন আয়ান ভাইদের বাসায়। ভাইয়া আসছে?’
‘ হু। সুখ কি ঘুমিয়ে পড়েছে? ‘
‘ হুম।’
কথোপকথনের মধ্যেই বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠল। প্রিয়ন্তী এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকল আয়মান। চোখে মুখে গম্ভীর ভাব। পিছু পিছু এলো সিনথিয়া। চৈত্রিকা এই ভরদুপুরে অকস্মাৎ ওদের দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়ল। বিহ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কি হয়েছে? এমন হঠাৎ করে? ‘
‘ ওকেই জিজ্ঞেস কর। ‘
সিনথিয়া বড়সড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে আয়মান কে দেখিয়ে দিল। চৈত্রিকার কোমর জড়িয়ে ধরল আয়মান। শান্ত কন্ঠে আবদারের স্বরে বলে উঠল,
‘ আমি আজ সারাদিন এখানে থাকতে পারি মামি মণি?আমি আমার জন্মদিন টা সুখের সাথে কাটাতে চাই। সবসময় তো ও দূরে থাকে আমার থেকে। আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড শি ইজ এ্যা লিটল গার্ল। বাট আই কান্ট বি হ্যাপি উইথআউট হার। প্লিজ গিভ মি পারমিশন। ‘
কি মিষ্টি,নিঃসংকোচ আবদার!চৈত্রিকা সোফায় বসে সুখ কে আয়মানের সামনে ধরলো। আয়মান গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সুখের দিকে। চৈত্রিকা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘ সুখ চাইলে ও সারাজীবনের জন্য তোমার আয়মান। ওকে এক পলক দেখার জন্য মামি মণির কাছে আবদার করতে হবে না। যখন মন চায় চলে আসবে। ‘
দরজার দিকে নজর যেতেই সিনথিয়া চৈত্রিকাকে ডেকে বললো,
‘ দ্যাখ,চৈত্র কে এসেছে!’
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সমুখে চক্ষু মেলে ধরলো সকলে। তরান্বিত হয়ে সোফা ছাড়ল চৈত্রিকা। সাফারাতের পাশে মা’কে এত মাস পর দেখতে পেয়ে ওর চোখ ভিজে উঠল। ঝড়ের বেগে গিয়ে শক্তপোক্ত বাঁধনে বেঁধে নিল ফাহমিদা বেগমকে। তিনিও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেলেন। বললেন,
‘ কেমন আছিস মা?’
চৈত্রিকা নির্বাক। কথা বলতে ভুলে গিয়েছে যেন। ফাহমিদা হেসে বললেন,
‘ চমকে গিয়েছিস তাই না?আমার সামনের মাসে আসার কথা ছিল কিন্তু আজকে কিভাবে?’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ও। সত্যিই ফাহমিদার সামনের মাসে আসার কথা। কয়েকদিন আগেও সাফারাত বলছিল ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে, মা’কে এখন আনা সম্ভব না। সাফারাত তো বাংলাদেশ অফিসের কিছু কাজে গিয়েছিল। তাছাড়া সিয়া মা’য়ের কবর জিয়ারত করতে। কিন্তু এমন সারপ্রাইজ পাবে কল্পনায়ও ভাবে নি চৈত্রিকা। সারপ্রাইজ! তার মানে সাফারাত ওকে সারপ্রাইজ দিয়েছে? আঁড়চোখে তাকালো ও সাফারাতের দিকে। সাফারাত ওর দৃষ্টি দেখে হনহনিয়ে চলে গেল সামনে। মেয়ের কপালে চুমু এঁকে রুমে চলে গেল। এই মানুষ টা এমন কেন?চৈত্রিকা বুঝে পায় না। ওর একেকটা মুহুর্ত আনন্দময় করে তোলার জন্য যা দরকার তা সাধ্যমতো চেষ্টা করে সাফারাত।
‘ সাফারাত নিয়ে এলো আমাকে। আমার টিকেট কাটা হয়েছিল,আমি তোকে জানাবো বললে সাফারাত বলে তোকে চমকে দিতে। আসলেই ওর কথাটা না শুনলে তোর এই সুন্দর,চমকপ্রদ চেহারা খানা দেখার সৌভাগ্য হতো না আমার। ‘
চৈত্রিকা মৃদু হাসল। কন্ঠস্বর ঈষৎ মিহি,
‘ মিমু কেমন আছে?’
‘ আর বলিস না। ও তো আসতে চাইছিল। এমনিতেই জার্নিতে অনভ্যস্ত মেয়েটা। গর্ভবতী অবস্থায় এত ধকল নিতে পারবে না তাই দিহানের কড়া নিষেধে আসতে পারল না। আমি আসার সময় কাঁদছিল। একবার বেবি হয়ে গেলে দিহান নিয়ে আসবে ওকে। ‘
ফাহমিদাকে রুম দেখিয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে এসে চায়ের কাপ টা বিছানার পাশে অবস্থিত সেন্টার টেবিলের উপর রাখে চৈত্রিকা। অপেক্ষা প্রিয় মানুষটার। সাদীদ কে নিয়ে গেছে সিনথিয়া বাহিরে। সুখ,সাদীদ দু’জনেই সিনথিয়াও আয়মানের কাছে। ওয়াশরুমের দরজা খুলে সাফারাত বেরিয়ে এলো। উদোম, উন্মুক্ত সুঠাম দেহে জল ধারা নেমে যাচ্ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে সাফারাত চিরচেনা গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
‘ সাদীদ কোথায়?’
‘ চুমু খান নি ওর কপালে?’– সোজাসাপ্টা প্রশ্ন চৈত্রিকার। তবে কন্ঠ খাদে।
‘ খেয়েছি। নিত্যকার অভ্যেসের পরিবর্তন কখনও হবে না। কিন্তু একজনকে চুমু খাওয়া বাকি আছে। ‘– দু অধর চেপে দুষ্টমির স্বরে বলে উঠল সাফারাত।
চৈত্রিকা মাথা নত করে ফেলল। চিবুকে হাত রেখে ওর মুখ টা উপরে তুলে ললাটে ওষ্ঠের প্রগাঢ়, গভীর স্পর্শ দেয় সাফারাত। ধীরে ধীরে সরে গিয়ে চায়ের কাপ তুলে এক চুমুক বসায়। তখনও চৈত্রিকার সারা মুখশ্রী লালচে আবিরে মাখোমাখো। চায়ের কাপ টা শব্দ সৃষ্ট করে টেবিলে রেখে গায়ে কালো একটা টি-শার্ট জড়ালো সাফারাত। চৈত্রিকার হাত টেনে দাঁড় করিয়ে বুকে টেনে আনল। কোমরে গুঁজে রাখা আঁচল টা টেনে ছড়িয়ে দিল। শক্ত করে বলিষ্ঠ এক হাত চেপে ধরল কোমরের অনাবৃত অংশে। চৈত্রিকার হৃদযন্ত্র ক্রিয়া তীব্র হতে তীব্রতর হলো। ঢেউ খেলতে আরম্ভ করলো সমস্ত বক্ষ জুড়ে। সাফারাত গলায় ঠোঁট ছুঁয়ে স্থির হয়ে রইল। কিয়ৎক্ষণ বাদে তাকে বাঁধা প্রদান করা নরম,কোমল হাত টার আঙ্গুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে দেহটা মিশিয়ে নিল নিজের মাঝে,বুকের অভ্যন্তরে। ধীরে ধীরে ওষ্ঠদ্বয় কান পর্যন্ত পৌঁছাল। কানের পাতায় স্পর্শ এঁকে সাফারাত লহু স্বরে প্রশ্ন করে,
‘ কিছু বলতে চান?’
‘ হু। ‘– কন্ঠ জড়িয়ে আসছে চৈত্রিকার।
‘ কি?’
চৈত্রিকা উঁচু হলো ফ্লোরে আঙ্গুল ভর দিয়ে। কিঞ্চিৎ, বেশি নয়। সাফারাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে লজ্জাতুর কন্ঠে বললো,
‘ ধন্যবাদ সাফারাত। ‘
.
.
.
কিছু কথা চেপে যাওয়ায় শ্রেয়। যার কাছে বলব করেও বলা হচ্ছে না হয়ত সেই মানুষ টা জানে কথা খানি। সে কেবল সবটুকু জেনেও চুপ আছে। প্রকাশ করতে চাইছে না। কি দরকার যেসব জীবনে অশান্তি ডেকে আনে তা নিয়ে আর বলার!তাই চৈত্রিকাও সিদ্ধান্ত নিল সাফারাতকে একদমই জিজ্ঞেস করবে না ফারুক এহমাদের ফাঁ/সি হয়েছে তা সে জানে কিনা! যেহেতু বাংলাদেশ গিয়ে এসেছে অবশ্যই শুনেছে। গতরাতে মৌসুমি ফুপির সাথে কথা হয়েছিল চৈত্রিকার। ওনার কাছেই জানতে পারেন ফারুক সাহেবের ফাঁ/সি হয়েছে স্ত্রীকে খু*ন করার দায়ে। প্রচলিত এবং চিরন্তন সত্য এক বাক্য –‘ যেমন কর্ম তেমন ফল। ‘ একটা সময় ফারুক এহমাদ পরকীয়া করে সিয়াকে ধোঁকা দেয়, আজ তিনি পরকীয়ার জন্যই স্ত্রীর খু*ন করেন। না না নিজে জড়ান নি,ওনার স্ত্রী ওনার পথে নামার সম্ভাবনা দেখে অন্য পুরুষের সঙ্গে জড়িয়েছেন। যার জীবন টা দুর্বিষহ করে নর’পশু গুলো এতকাল শান্তিতে ছিল সেই সাফারাত আজ সুখে,স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। আর ওনারা ভুগছেন কর্মের ফল। পা’প কর্মের ফল।
চৈত্রিকা গাড়িতে বসে আনমনে এসব ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে ওদের গাড়িটা আয়মানদের বাড়ির সামনে থেমে গেল। ছিঁড়ে ফেলল তার ভাবনার সুতো। সাফারাত গায়ের জ্যাকেট টা খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সুখ কে কোলে তুলে নেয়। সাদীদকে নেয় ফাইয়াদ। কতকাল পরে এ বাড়িতে আবারও আগমন ওদের। আসার ইচ্ছে ছিল না। আসলেই মনে পড়ে যায় সেই দুমুখো ছলনাময়ী নারীর কথা। যার জন্য সাফারাতের জীবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে কষ্টে, যন্ত্রণায়। কি বিভৎস করে দিয়েছিল ওর জীবন টা! তবুও আসতে হলো। খালু ও আয়মানের অনুরোধ ওরা ফেলতে পারে নি। এই বাড়ির আশেপাশে এখনও কি পঁচাও বিষের ঝাঁঝালো গন্ধ নাসারন্ধ্রে আসে সমীরণ মাধ্যমে? ছলনাময়ী সেই নারী নেই। তাহার অবস্থান ও শেষ ঠিকানা এখন জার্মানির বড়সড় এক কবরস্থানে। প্রায় মাস তিনেক আগে মা’রা যান আলো বেগম। বাড়িতে কেউ ছিল না। সিনথিয়া ও আয়ান আয়মানকে নিয়ে একমাসের জন্য বাংলাদেশ গিয়েছিল। সিনথিয়ার বাবার হঠাৎ মৃ*ত্যুতে মেয়েটা প্রচন্ড ভেঙে পড়ে। তাই ওকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি সিলেটে যায় আয়ান। আলো বেগম যান নি। অবহেলা,অযত্নে তিনি রুমের এক কোণায় পড়ে থাকতেন। সিনথিয়া,আয়ান ততটাও কঠোর হতে পারে নি ওনার প্রতি। কিন্তু বাবার আকস্মিক মৃ’ত্যুতে ওনাকে ফেলেই পাড়ি জমাতে হয় মাতৃভূমিতে। খালুও যান সঙ্গে। সকল সত্য জানার পর স্ত্রীর সঙ্গে ঘৃ-ণার দেয়াল তুলে দেন তিনি। কাজের মেয়ে ক্যাথরিন কে আলো বেগমের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেখে যাওয়া হয়। আপনজন ও কাজের মেয়ের যত্ন?তাতে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। আলো বেগম ডিপ্রেশনে আছেন তা জেনে ক্যাথরিন সুযোগ বুঝে দিব্যি তিন দিন ছুটি কাটিয়ে আসে। কোনো এক সকালে সিনথিয়াকে কল করে জানায় বিষের গন্ধে পুরো বাড়িতে শ্বাস ফেলা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। সুই-সাইড করেছেন আলো বেগম। তিন দিন পূর্বেই মৃ*ত্যু হয়েছে ওনার। দেহের টিস্যু ও অঙ্গ বিকল হয়ে পচনও ধরে গিয়েছে ইতমধ্যে। সেদিন চৈত্রিকা শুনেই ছুটে আসে,সাফারাত আসে নি। শুধু এটুকু বলেছিল– কিছু মানুষকে কখনও ক্ষমা করা যায় না চৈত্র, তার মৃ*ত দেহকেও না। ঠিক কতটুকু কষ্ট পেলে,কঠোর হলে এমন কাঠিন্য বাক্য উচ্চারণ করা যায় চৈত্রিকা সেদিন উপলব্ধি করতে চেয়েছিল। কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হলো। মস্তিষ্কে আসল– প্রকৃতি কখনও কাউকে ছাড় দেয় না। অনুতাপের আগুনের তেজ অতীব তীব্র ও প্রখর।
_____________
আয়মানের বার্থডে পার্টি শেষে এখানেই থেকে যেতো হলো ওদের। রজনীর গভীরতা অত্যাধিক। চৈত্রিকা সিনথিয়ার কাছ থেকে একটা নরমাল শাড়ি এনে ফ্রেশ হয়ে নিল। রুমে ঘোর অন্ধকার। এক চিলতে রোশনাই আপ্রাণ প্রয়াসে মগ্ন রুমে উঁকি দেওয়ার নিমিত্তে। বাগানের খুঁটিতে জ্বলন্ত বৈদ্যুতিক বাতি হতে এর উৎপত্তি। চৈত্রিকা মুগ্ধ হলো, এক দৃষ্টে চেয়ে রইল আলো আঁধারির খেলার পানে। পিছন হতে দু’টো হাত ওকে শক্ত করে বেঁধে ফেলে। ডাকল হাতের মালিক প্রগাঢ়ভাবে। অত্যন্ত মাদকতাময় সেই স্বরের ডাক,
‘ চৈত্র! ‘
চৈত্রিকার ভিতরে ঝড়,বাহিরে কম্পন। শরীরের প্রত্যেক টা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কাঁপছে। হুট করে সাফারাতের স্পর্শে তরঙ্গ খেলে যায় সমগ্র কায়ায়। গতি হারা হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি শব্দ বোধহয় সাফারাতের কর্ণ গহ্বরে অনায়সে পৌঁছে যাচ্ছে।
‘ চৈত্র! ‘
আবারও ডাক। সেই সাথে জবাব,
‘ জ্বি! ‘
‘ সুখী তো আপনি আমার সাথে? ‘
চৈত্রিকা বাকরুদ্ধ। পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে অস্থির। ওকে কখনও এ ধরনের প্রশ্ন করে নি সাফারাত। হাত ছাড়িয়ে সাফারাতের দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে। অল্পস্বল্প আলো এসে ঠিকরে পড়ছে উজ্জ্বল মুখ টায়। চক্ষু জোড়ার দৃষ্টি মোহনীয়,নেশালো। সাফারাতের ঠোঁটের কোণে হাসি। এক ভ্রুঁ উঁচিয়ে নির্নিমেষ চেয়ে আছে জবাবের প্রতীক্ষায়। মাঝে মাঝে অনেক অপ্রকাশিত কথা আমরা চাই প্রকাশিত হোক। সবসময় অব্যক্ত কথা বুঝার চেয়ে শোনার মাঝে বোধহয় তৃপ্তি। চৈত্রিকা মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে সাফারাতের অধর সম্মুখে অধর যুগল এগিয়ে আনল। কোমরে হাত পেঁচিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে দেয় সাফারাত।
‘ বলবেন না?’
চৈত্রিকা মুখ খুলল,ঠোঁট দু’টো আলগা হলো সামান্য। সঙ্গে সঙ্গেই অনুভূত হলো রুক্ষ, শুষ্ক ওষ্ঠাধরের ছোঁয়া। অতঃপর দুই অধরের সন্ধি। সাফারাত পুনর্বার ফিচেল স্বরে বলে উঠল,
‘ এবার বলুন। ‘
‘ জীবনে সুখ বলতে কি?তা আমি বুঝ হওয়ার পর কখনও বুঝি নি। বাবার অবহেলা, আপনজনদের অপয়া ডাক,মেয়ে হয়ে জন্মে এই সমাজে নানা খারাপ মানুষের জ’ঘন্য কটুক্তি সবকিছুতে আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেত। ভাবতাম একটু কি সুখ আমি পাবো না?আমার ফাটলকৃত জীবনটায় আপনি আসলেন। সুখের সাথে আমাকে সাক্ষাৎ করালেন। হয়ে উঠলেন আমার সুখ। সুখ বলতেই আপনাকেই বুঝি সাফারাত। শুধুই আপনি। আমার কাছে ব্যাখা করার জন্য শব্দের অভাব। কিন্তু আপনি আছেন। তবুও কি শব্দমালার প্রয়োজন রয়েছে? আপনার সাথে সুখী হবো না এমনও কি হয়?’
#সমাপ্ত
( আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই? গল্পটাকে সবাই অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন। আমার পক্ষ থেকে আপনাদের সবার জন্য অবিরাম ভালোবাসা। ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। ধন্যবাদ গল্পটাকে এতো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য। অবশেষে সমাপ্তি।)