সুখের_নেশায়,১৬,১৭

0
855

#সুখের_নেশায়,১৬,১৭
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___১৬

চৈত্রিকা চমকে উঠে নিজের হাতের দিকে তাকাল। সাফারাতের হাতের বাঁধনে আঁটকে আছে হাত টা। চোখের সামনে চকচক করছে স্বর্ণের আংটি। চৈত্রিকা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সাফারাতের বাহুতে বন্দী শরীর টা ক্ষীণ কাঁপছে তার। সাফারাত কি করে জানল সে এখন অন্য কারো বাগদত্তা? এই আংটি টা দেখেই কি?আর এতো অনায়সে মনের কথা কি করে পড়ে নিল মানুষ টা?কি করে বুঝল চৈত্রিকার কান্নার কারণ?কত সহজে পূরণ করে দিল অসমাপ্ত বাক্য, না বলা কথাটুকু। আঙ্গুলে শোভাময় আংটি টার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাফারাত ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন হলদে রশ্মিতে। চৈত্রিকা সেদিকে চেয়ে ধরা গলায় বললো,
” হুট করে হয়ে গেছে। কাউকে জানানোর সুযোগ হয় নি। ”
” আমি তো তা জানতে চাই নি চৈত্র। আমি শুধু জানতে চাই আপনি কেন অন্যকারো বাগদত্তা হলেন?”
কি চাপা রাগ,ক্রোধ সাফারাতের কন্ঠে! চৈত্রিকার বুক টা কেঁপে উঠল। পেশিগুলো কঠিন হয়ে উঠেছে সাফারাতের। এহেন ক্রোধান্বিত রূপে চৈত্রিকার গলা শুকিয়ে এলো। অন্য কারো বাগদত্তা হয়েছে বলেই কি সাফারাতের এতো রাগ!চৈত্রিকার মাথা ভো ভো করছে। হুট করে খেয়াল করে আংটি টা টেনে আঙ্গুল থেকে খুলে ফেলছে সাফারাত। চৈত্রিকা ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বলে উঠল,
” কি করছেন এসব?”
সাফারাত আন্টি টা হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিল। চৈত্রিকাকে নিজের সাথে চেপে ধরল শক্ত করে।
” এটা ফিরত দিয়ে দিবেন। ”
একটুখানি পিছিয়ে গেল চৈত্রিকা। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে,
” মানে?”
” একদম ইজি। আপনি করছেন না বিয়েটা। ”
চৈত্রিকা বিস্ফোরিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সঙ্গে সঙ্গে। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল অস্ফুট,
” কি বলছেন আপনি?”

মৃদু মৃদু বাতাসে চৈত্রিকার চুল উড়ে এসে কপালে পড়ছে। পুরো স্থান জুড়ে নিরবতা। সাফারাত হাত বাড়িয়ে চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিল। গভীর, স্থির চাহনি তার সামনে উপস্থিত নারীর মুখপানে। হাত বাড়িয়ে আলতো করে কাছে টেনে নিল ক্ষীণ। কপালে উষ্ণ এক পরশ ছুঁয়ে দিতেই থরথর করে কেঁপে উঠল নরম,কোমল দেহখানি। হয়ত আকস্মিক ধাক্কা, ভালোবাসাময় পরশ সামলাতে ব্যর্থ সে। সাফারাত অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে কিন্তু মাদকতা নিয়ে বললো,
” আপনি আমার সুখ চৈত্র। নিজের সুখ কে কি করে অন্যকে দিয়ে দেই? ”

ভালোবাসা,প্রণয়,অনুরাগ। এগুলো প্রকাশ করতে মুখে ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা বলা কি অধিক জরুরি? না একদমই প্রয়োজন নেই। ‘ আপনি আমার সুখ চৈত্র ‘ এই নেশার্ত বাক্য ‘ ভালোবাসি’ বলার চেয়েও অধিক ভালোবাসাময়। যেই ভালোবাসার কাঙ্গাল চৈত্রিকা তা যেন আজ তার আঁজলা তে ধরা দিয়েছে। মুঠো পুড়ে আঁকড়ে নিতে ইচ্ছে করছে চৈত্রিকার। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে গেল এক ফোঁটা নোনতা,তপ্ত জল। বহু প্রতিক্ষার পর সুখ যেন স্বয়ং হেঁটে এসে তার দুয়ারে কড়া নাড়ছে।

চৈত্রিকা লোভী হয়ে উঠল। পারল না ফিরিয়ে দিতে। সাফারাতের বুকে লাফিয়ে পড়ল, আছড়ে পড়ল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোন। গলা জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইল কিয়ৎক্ষণ,কয়েক মুহুর্ত। শূণ্যে অনুভব করল নিজের দেহটাকে। কোমড় আঁকড়ে ধরে সাফারাত চৈত্রিকার শরীরটাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিল চৈত্রিকার গাল,কপাল,চিবুক। এ যেন বহু দিনের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে সাফারাত। লজ্জায় মিইয়ে গেল চৈত্রিকা শক্ত বুকের মাঝে। সাফারাতের গায়ের মন মাতাল করে তোলা গন্ধ তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছে হুড়মুড়িয়ে। নেশা লেগে আসছে। অতীব প্রখর নেশা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাফারাতের বুকে আঁকড়ে ধরল হাত। তখনই কোমরে রাখা বলিষ্ঠ হাত শক্ত হয়ে এলো। চৈত্রিকার মনে হচ্ছে কোনো এক গভীর স্বপ্নে ডুবে আছে সে। বঞ্চিত হতে চাই না সে এই বুকের উম থেকে। মনে মনে প্রার্থনা করে স্বপ্ন যেন ভেঙে না যায়। তার প্রার্থনা বোধ হয় কবুল হলো না। ব্যাগে অবস্থান করা মোবাইল টা বেজে উঠল। অসহ্য শব্দ ছড়িয়ে দেয় শব্দহীন পরিবেশে। কল্পনা থেকে যেন জাগতিক বাস্তবতায় ফিরে আসে চৈত্রিকা। সাফারাতের বুকের উষ্ণতা, পরম সুখ ত্যাগ করে ঝটপট ছিটকে সরে যায়। মোবাইল বের করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে ভেসে এলো ফাহমিদার কর্কশ,রাগমিশ্রিত কন্ঠস্বর।

” কোথায় তুই? এখনও আসছিস না কেন?তাহাফ এসেছে। তোর জন্য অপেক্ষা করছে। তোর কি আসতে দেরি হবে?তাহাফ বলছে ও গিয়ে আনবে তোকে। ”
” না। কোনো দরকার নেই। আসছি আমি। ”
চৈত্রিকার কন্ঠ কঠিন হলো। ফোন রেখে সাফারাতের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত সুরে বললো,
” আমার যেতে হবে সাফারাত। ”

মৌন মুখে গাড়ির দরজা মেলে দিয়ে চৈত্রিকাকে বসতে ইশারা করে সাফারাত। চৈত্রিকা বসলো না। নিস্তব্ধ,নিরব এই রাস্তায় সাফারাতের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি যুক্ত ফর্সা গালে ওষ্ঠের প্রলেপ এঁকে দিল সাহস জুগিয়ে। নিম্নস্বরে বললো,

” আজ সন্ধ্যে বেলায় আপনার অধরযুগলের স্পর্শ আমার গালে পড়েছিল। তখন উপলব্ধি করতে না পারলেও এখন স্পর্শটুকু পরিচিত হয়ে গেল। ”

আজ গাড়িতে গালের সেই উষ্ণ আর্দ্র ছোঁয়াটা ছিল সাফারাতের যা এখন বুঝতে পারে চৈত্রিকা। লজ্জায় তার মুখ আরক্ত হয়ে গেল কথাটা বলে। ঠোঁট দুটো হালকা প্রসারিত হলো সাফারাতের। বললো,

” বাহ্!খুব ইনটেলিজেন্ট তো আপনি। ”

সাফারাত কি পরিহাস করল চৈত্রিকা কে নিয়ে?কথায় তো এমনই ঠেকল। চৈত্রিকা লজ্জা অনুভব করল। রক্তিম আভায় সিক্ত মুখখানা লুকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। সাফারাতও বিনা শব্দে গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করে।
_________________

গাড়ি থেমে গেছে চৈত্রিকাদের বাসা থেকে কিছু দূরে। চৈত্রিকাই জোর করে এখানে থামিয়েছে, পাছে যদি কেউ দেখে ফেলে সেই ভয়ে। দারোয়ান দেখলেই তো পুরো বিল্ডিংয়ে রটিয়ে ফেলবে। তখন কি করে বাবা-মা’র সামনে মুখ দেখাবে চৈত্রিকা?তাছাড়া বাবা?বাবা তো এখনও ক্ষমা করে নি তাকে। ভালোবেসে মাথায় হাত রাখে নি এখনো। আজ চৈত্রিকা ভালোবাসার মানুষ পেল। বাবার ভালোবাসাও কি পেয়ে যাবে এমন করে হুট করে, অপ্রত্যাশিত ভাবে!সকল ভাবনা দূরে ঠেলে গাড়ির দরজা মেলতে গিয়ে দেখল লক করা। সাফারাত লক করেছে কি?ঘাড় ঘুরিয়ে ছোট্ট করে উচ্চারণ করল–” খুলে দেন। ”

সাফারাত চোখ বুঁজে সিটে মাথা এলিয়ে রেখেছে। মুখে বিরক্তি ভাব। চোয়াল শক্ত। আকস্মিক এমন করার কারণ ধরতে পারছে না চৈত্রিকা। অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করে–” খুলবেন না?”

চোখ মেলে চাইল সাফারাত। মায়াবী গড়নের মেয়েটাকে একদম ছাড়তে ইচ্ছে করছে না তার। মেয়েটার সামান্য ঠোঁটের ছোঁয়ায় তার ভিতরটায় তোলপাড় হচ্ছে সেই কখন থেকে। বুকের যন্ত্রণা লুকিয়ে চৈত্রিকা কে কাছে টেনে গাঢ় একটা চুমু খেল কপালে। বেশ তৃপ্তি নিয়ে। আবেগে চোখ বুঁজল চৈত্রিকা।
গাড়ির দরজা মেলে দিতেই নেমে পড়ল মন্থরগতিতে। কয়েক মুহুর্ত আগেই তো হলো দু’জনের প্রণয়ের সূচনা,আরম্ভ। অথচ সামান্য দূরত্ব যেন দু’জনকে পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দিচ্ছে। এর থেকে অপ্রকাশিত সম্পর্ক, বন্ধুত্বই যেন ঢেড় ভালো ছিল। চৈত্রিকা একবার পিছনে তাকিয়ে দেখল সাফারাত চেয়ে আছে নির্নিমেষ দৃষ্টি ফেলে। সময় কতকিছু বদলে দেয়। আজ থেকে বন্ধুত্বর সম্পর্ক পেরিয়ে নতুন এক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেল দু’জন। কিন্তু নামছাড়া সেই সম্পর্ক।
.
.
সিঁড়ি অতিক্রম করে উপরে উঠে দরজা অবধি আসতেই চৈত্রিকার হাত টা চেপে ধরল কেউ। কিছু বুঝে উঠার আগেই টেনে হিঁচড়ে ছাদে নিয়ে এলো। ঘৃণায় রি রি করে উঠল চৈত্রিকার সমগ্র দেহ,অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। চাপা আত্মস্বরে চিৎকার করে উঠল,

” আপনার সাহস হলো কি করে আমাকে এভাবে টেনে হিঁচড়ে আনার?”

” আর তোর?তোর সাহস হয় কি করে আমার বাগদত্তা হয়ে অন্য একটা ছেলের গাড়ি করে আসার?তার সাথে মেলামেশা করার? রাস্তায় না গেলে তো দেখতেই পেতাম না তোর রূপ। ”

চমকিত নয়নে তাকাল চৈত্রিকা তাহাফের মুখের দিকে। হুট করে তাহাফের কথাগুলো তার মস্তিষ্ক তরঙ্গ হতেই জ্বলতে শুরু করল ভেতর। কারো বাগদত্তা হওয়ার আগে সে একজন মানুষ। তার নিজস্ব মতামত,স্বাধীনতা আছে। কন্ঠস্বর যথেষ্ট ঠান্ডা রেখে বললো,

” আপনি আমাকে এভাবে বলতে পারেন না তাহাফ ভাই। ছাড়ুন আমাকে। বাসায় যাবো। ”

তাহাফের মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল। প্রচন্ড জোরে চেপে ধরল চৈত্রিকাকে দেয়ালের সাথে। ব্যাথায় চৈত্রিকার মুখের ভাব করুন হলো। তাহাফ থেকে যত ছুটতে চেষ্টা করছে ততই যেন চেপে ধরছে সে। চৈত্রিকা কাঁদতে গিয়েও কাঁদল না। মুহুর্তেই চোখ মুখে অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে উঠল। তাহাফ কে সরিয়ে সপাটে এক চড় বসিয়ে দিল গালে। তাহাফের চক্ষু হতে আগুনের ফুলকি ঝরছে। তার পুরুষালী অহংকারে যেন আ*ঘাত হেনেছে সহজ সরল মোমের মতো মেয়েটা। চৈত্রিকার হাত টা পিছনে নিয়ে মুচড়ে ধরল। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে সে। তাহাফ দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠল,

” তোকে অনেক ছাড় দিয়েছি। প্রথম যেদিন তুই আমাকে প্রত্যাখান করেছিস সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম তোকে আমার করেই ছাড়ব আমি। তোর ফর্সা, নরম দেহে শুধু আমার স্পর্শ থাকবে। তোর মন বুঝার অহেতুক সময় আমার নাই। তোর সৌন্দর্যর প্রতিই আমি আকৃষ্ট। এটাই আমার ভালোবাসা। ”

মানুষ এতো নিকৃষ্ট হয়!চৈত্রিকার দমবন্ধ হয়ে আসছে তাহাফের নোংরা বাক্যে। তাহাফ মুখ এগিয়ে এনে গলায় ছোঁয়াতেই মনে হলো কেউ তার শরীরে কলংক লেপে দিয়েছে। না পেরে ভয়ংকর এক কাজ করে বসল চৈত্রিকা। হাঁটু দিয়ে আ*ঘাত করল পুরুষাঙ্গ বরাবর। সাথে সাথেই ছেড়ে দিয়ে সরে যায় তাহাফ। চৈত্রিকা এক দলা থুতু ফেলল ছাদের মেঝেতে। আঙ্গুল উঁচিয়ে রাগান্বিত, কম্পয়ান গলায় বললো,

” তোর মতো জানোয়ার খুন করতেও হাত কাঁপবে না আমার। ”

চৈত্রিকা উদভ্রান্তের মতো ছুটে এসে ঘরে ঢুকে সরাসরি রুমে চলে এল। দরজা বন্ধ করে ঠেস দিয়ে রইল। ঠিক কতক্ষণ তার হিসেব নেই। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই বিব্রত হয়ে পড়ে। মিম ভ্রুঁ কুঁচকে, কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। চৈত্রিকা চক্ষু মেলতেই হন্য হয়ে এগিয়ে আসল। কন্ঠে প্রবল উৎকন্ঠা,

” কি হয়েছে আপু?”
” কই কিছু হয়নি তো। ”
” তাহলে এভাবে এলে কেন?এতো ঘাবড়ে আছো কেন?”

চৈত্রিকা নিজেকে ধাতস্থ করে বললো–” ক্লান্ত লাগছে। আমি একটু রেস্ট নিব মিমু। তুই যা এখন। ”
তৎক্ষনাৎ ফুলদানিতে নজর যেতেই জিজ্ঞেস করল,

” নতুন জারবেরা কে এনেছে?”
” তাহাফ ভাই এনেছে আপু। ”
এটুকু বলে থেমে মিম আবার বললো,
” আপু আমার মনে হয় তাহাফ ভাইয়া-ই সে ব্যক্তি যে বিগত কয়েকদিন ধরে তোমায় ফুল দিয়ে যাচ্ছে। ”

কথাগুলো বলে মিম চলে গেল। চৈত্রিকা ফুলগুলো হাতে তুলে তীব্র ঘৃণা নিয়ে ছুড়ে মারল জানালা দিয়ে। কোনো অসভ্য ব্যক্তির দেওয়া জিনিস থাকতে পারবে না এখানে। মিমের কথাগুলোও ফেলে দেবার নই। তাহাফ ছুটিতে এসেছে প্রায় অনেকদিন হয়ে গেছে। ঠিক তার আসার পর থেকেই আড়ালে কেউ সারাক্ষণ চৈত্রিকার উপর নজর রেখে যাচ্ছে। ফুল দিচ্ছে, বাবার চিকিৎসার টাকা দিচ্ছে,কেয়ার করছে। কিন্তু তা যে কোনোভাবে মিলে না তাহাফের ব্যক্তিত্বের সাথে। হয়ত সমীকরণ মিলেও যায়। চৈত্রিকা শুকনো জারবেরা গুলো ছুঁয়ে বিড়বিড় করে,

” এই ব্যক্তি কখনও হতে পারে না, যার কাছে ভালোবাসা কেবলই শারীরিক চাহিদা। ”

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___১৭

সাফারাত বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই পৃথকের বাবা -মা এসে সামনে দাঁড়াল। নিমেষে চোখে মুখে বিরক্তি উপচে পড়ল তার। শার্টের উপরের বোতাম টা খুলে সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ফেলল। ধরন এমন যেন নিঃশ্বাস টা আঁটকে ছিল গলায়। চাচা-চাচীর দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত নম্র স্বরে প্রশ্ন করলো,

” কিছু বলবেন আপনারা?”

পৃথকের বাবা নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালো একবার। মুখ ফিরিয়ে গমগমে স্বরে বললেন,

” কেস টা ফিরিয়ে নাও সাফারাত। নিজের চাচাতো ভাইয়ের সাথে এমন শ/ত্রুতা মানায় না তোমার। ”

” আর আমার উপর আপনাদের অত্যাচার, আপনার ছেলের আমাকে মে/রে ফেলার চেষ্টা সবকিছুই মানানসই ছিল? ”

সাফারাতের প্রশ্নের পৃষ্ঠে জবাব দেওয়ার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলেন না পৃথকের বাবা-মা। উপায় না পেয়ে পৃথকের মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সাফারাতের হাত ধরে বলতে লাগলেন,

” একটু দয়া করো। ছেলেটাকে ছাড়িয়ে আনো। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি ওর কারণে কখনও কোনো ক্ষতি হবে না তোমার। তুমি দয়া না করলে আমার ছেলেটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। ”

দয়া!আহা এ যেন বিদ্রুপের হাসির যোগ্য সাফারাতের নিকট। হাসিটুকু চেপে রাখল। চিরাচরিত গম্ভীর স্বরে বললো,

” জেনেশুনে নিজের বুকে ছুরির মা/রার মানুষ আমি নই। ”

ব্যাস এতটুকুই একটা বাক্য। আর এক সেকেন্ডও ব্যয় না করে দ্রুত বেগে উপরে চলে গেল। পৃথকের মা মেকি কান্নার ফোঁটা মুছে কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল,

” দেখলে এই ছেলের এটিটিউড?তোমাকে আগেই বলেছিলাম সময় থাকতে শেষ করে দাও একে। কিন্তু তুমি আমার কথাটাই আমলে নিলে না। ”

” মে/রে ফেলেটাই বাকি ছিল। ওর ওই দূরসম্পর্কের খালা না নিয়ে গেলে আজ ও এমন হতো না। ”

” ওই মহিলা না জানি কি করল যে এই ছেলে এমন আগুন হয়ে ফিরে এলো। ”

পৃথকের বাবা চিন্তিত হয়ে সোফায় বসে পড়লেন। ছেলেকে কিভাবে মুক্ত করবেন জেলে থেকে ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছেন না৷ সাফারাত কোনো রাস্তাই রাখল না। সাফারাতের সাথে কথা বলা তো দূর হিম শীতল দৃষ্টি দেখলেই অন্তর আত্মা শুকিয়ে যায় উনার।
.
.
ভোরের স্নিগ্ধ আলো ফুটেছে সবে। চৈত্রিকা জানালা মেলে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে নিল ভিতরে। অর্ধরাত্রি নিদ্রাহীন কাটিয়ে প্রভাতের এই নির্মল বাতাস টুকু যেন খুব দরকার ছিল। চৈত্রিকার মস্তিষ্কে বিভিন্ন ভাবনার বিচরণ থেমে নেই। তাহাফের ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়েছে তাকে। এছাড়া সাফারাতের সাথে নতুন করে পথ চলা,সাফারাতের অতীত সব চৈত্রিকার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কি হয়েছিল সাফারাতের অতীতে?না চৈত্রিকা আর ভাবতে পারছে না। এবার সরাসরি সাফারাত কেই জিজ্ঞেস করবে। চৈত্রিকার এখনো মনে পড়ে সিলেটের সেই স্মৃতিগুলো।

কলেজে নতুনদের নবীনবরণ আজ। চৈত্রিকা তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে কলেজে এলো। তারও যে আজ নবীনবরণ। কলেজে ঢুকে পরিচিত বান্ধবীদের না পেয়ে যখন খুঁজতে ব্যস্ত তখনই একটা ছেলের কন্ঠ পেয়ে থমকে গেল পা দুটো আপনাআপনি। পিছনে তাকিয়ে দেখে সতেরো কি আঠারো বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। নিমিষেই সকল তাড়াহুড়া, ব্যস্ততা ভুলে যায় চৈত্রিকা। তার কিশোরী মন এক মুহুর্তের জন্য হলেও অজানা কারণে কেঁপে উঠে। নরম গলায় বলে,

” আমাকে ডাকছো?”
ছেলেটা একটুখানি এগিয়ে এলো। হালকা হেসে বললো,
” হুম তোমাকেই ডাকছি। প্রিন্সিপাল স্যারের অফিস টা কোথায় বলতে পারবে?”
চৈত্রিকার ভ্রুঁ কুঁচকে গেল। মনে মনে বললো- ‘ অদ্ভুত! ‘

” তুমি আর আসো নি কলেজে? ”
” না ভর্তি হবার পর আজকেই এলাম। ”
” ওহ। এতদিন এতগুলো ক্লাস হলো অথচ আজ এলে?”
” আমি এতদিন সিলেটে ছিলাম না। আমি ঢাকাতে থাকি। ”
” ঢাকাতে থাকলে এখানে কেন এলে?”

চৈত্রিকার চক্ষুদ্বয় ছোট্ট ছোট্ট হয়ে এল। ছেলেটা সেদিকে তাকিয়ে বললো,
” এতদিন নানার বাসায় ছিলাম। সিলেট আমার দাদুর বাড়ি। ইন্টার টা এখানে থেকেই কমপ্লিট করব। বাই দ্যা ওয়ে, আমি সাফারাত। সাফারাত এহমাদ। হোয়াটস ইয়োর নেইম? ”

কিশোর বয়সের চৈত্রিকা প্রথমবারের মতো কোনো ছেলের সান্নিধ্যে এসে কেমন ফ্রিজ হয়ে গেল। মনে তার হাজারো লাল,নীল নানা রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। যতবার তাকিয়েছে সাফারাতের দিক বুকটা ধুক ধুক করছে প্রচন্ড। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে প্রতুত্তর করল,
” আমি চৈত্রিকা। ”
” ওহ্। চৈত্র মাস। ”

চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পরক্ষণেই লজ্জিত ভঙ্গিতে আওড়ালো,

” চৈত্র মাস? ”
” ইয়েস। চৈত্রিকা থেকে চৈত্র। চৈত্র মানেই চৈত্র মাস। ”

‘ চৈত্র মাস ‘ আহা!শব্দটা কতকাল ডাকে না সাফারাত। চৈত্রিকা স্মৃতির পাতায় ডুবে রইল না আর। কতশত মুহুর্ত তাদের। স্মৃতিতে একেকটা মুহুর্ত জাগিয়ে তুলতেও সারাদিন ফুরিয়ে যাবে তবুও শেষ হবে না মিষ্টি সেই সময়গুলো। সেদিনের পর থেকেই দু’জনের একটুআধটু কথোপকথনে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। অতঃপর গভীর বন্ধুত্ব। ওদের এই বন্ধুত্ব নিয়ে কত হিংসে করত ক্লাসের সকলে। তখন চৈত্রিকার বেশ আনন্দ হতো। তৃপ্তি পেত এটা ভেবে ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটার, সুন্দর মনের মানুষটার বেস্ট ফ্রেন্ড সে।

দরজায় করাঘাতের শব্দে চৈত্রিকার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। প্রচন্ড জোরে ধাক্কাচ্ছে কেউ। স্তব্ধ হয়ে গেল চৈত্রিকা। কিছু বুঝে উঠার আগেই ফাহমিদার উত্তেজিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো দরজার অপর পাশ হতে। চৈত্রিকা দৌড়ে গিয়ে দরজা মেলে দিতেই ফাহমিদা মেয়ের উপর ঢলে পড়লেন। মা’কে ধরে ভয়ার্ত চোখে তাকালো। ফাহমিদা বহু কষ্টে উচ্চারণ করলেন,

” তোর বাবা,,তোর বাবা কেমন যেন করছে চৈত্র। কেমন যেন করছে। ”

আর বলতে পারলেন না তিনি। ভেঙে পড়লেন কান্নায়। চৈত্রিকার মন টা কু ডাকছে। মা’কে পাশের চেয়ারে বসিয়ে পাগলের মতো ছুটে এল বাবার কক্ষে। বিছানায় ছটফট করছেন আহমেদ। শ্বাস ফেলছেন খুব জোরে জোরে। মিম বাবার হাত ধরে কেঁদে যাচ্ছে অনবরত। মাথা টা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে চৈত্রিকার। কি করবে,কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কয়েক পা পিছিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি অতিক্রম করে নিচে নেমে এলো। শ্বাস ফেলতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। গেইটের দিকে যেতে যেতে পায়ের তলায় কিছু একটা বিঁধতেই ব্যাথায় কুঁকড়িয়ে উঠল। উন্মুক্ত, খালি পায়ের তলায় ইটের কণা বিঁধেছে। ব্যাথায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। তাতে তোয়াক্কা করল না চৈত্রিকা। তার যে এখন বাবার জন্য ভাবতে হবে,বাবাকে বাচাতে হবে। দারোয়ান দেখল চৈত্রিকার রক্তমিশ্রিত পায়ের ছাপ। আঁতকে উঠলেন তিনি। এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,

” কি হইছে মা?এই সাতসকালে তোমার এই অবস্থা কা?পা থাইক্কা তো রক্ত ঝরতাছে। ”

” চাচা একটা গাড়ি ডেকে আনেন। বাবাকে হসপিটালে নিতে হবে। ”

দারোয়ান কি শুনতে পেয়েছে চৈত্রিকার কথাটা?মেয়েটার মুখ দিয়ে শব্দ বেরিয়ে যেন বেরোচ্ছে না। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আছে কন্ঠনালিতে। চোখ দুটো ঘোলা হয়ে আসছে বারংবার। হৃদপিণ্ড টা অসম্ভব,অসহনীয় ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। চৈত্রিকার শ্বাস কি বন্ধ হয়ে যাবে এখন?হাত মুঠো করে ফের বললো,

” বাবাকে হসপিটালে নিতে হবে চাচা। ”

দারোয়ান এবার বুঝতে পারল। চৈত্রিকা কে আশ্বাস দিয়ে বললো,

” তুমি কাইন্দো না। গাড়ি আনতাছি আমি। আনতাছি। ”

উপরে এসে বাঁধল আরেক বিপত্তি। বাবাকে কিভাবে নিচে নিয়ে যাবে সেটা ভেবে চৈত্রিকার মুখ শুকিয়ে গেল। মিম অশ্রুসিক্ত,ভেজা কন্ঠে ফুঁপিয়ে বলে উঠল,

” বাবা তো হাটতে পারে না। নিচে নিব কিভাবে আপু? ”

দারোয়ান একা পারবে না। চৈত্রিকা পাশের বাসার এক লোক কে ডেকে আনল। আজ খুব করে অনুভব করল মেহুল বেঁচে থাকলে হয়ত একা হাতে বাবাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারত। একটুখানি সাহায্যের জন্য মানুষের দুয়ারে আকুতিমিনতি করতে হত না তার। বাবার এই অবস্থার জন্য চৈত্রিকা নিজেকে দায়ী করল। একটুখানি অসতর্কতার, জেদের কারণে প্রাণপ্রিয় ছোট ভাইকে হারাল। বাবার তীব্র অভিমানে বঞ্চিত হলো ভালোবাসা থেকে।
____________

গাড়ি দ্রুত বেগে এগিয়ে চলেছে অফিসের উদ্দেশ্যে। নিজের হাতের দিকে এক পলক চেয়ে চোখ সরিয়ে ফেলল সাফারাত। ঘড়িতে নয়টা বেজে পনেরো মিনিট। এসির ঠান্ডায় বিরক্তি লাগছে। ড্রাইভার কে বললো এসি অফ করে দিতে। গাড়ির জানালাগুলো মেলে দিতেই প্রকৃতির হাওয়ায় মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল একদম। অক্ষিপটে ভেসে উঠল চৈত্রিকার মায়াবী মুখ টা। ঝটপট আঁখিদ্বয় মেলে মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়। চৈত্রিকার নাম্বারে ডায়াল করে মোবাইল টা কানে ধরে রাখল স্থির। কিন্তু রিসিভ হলো না। ভ্রুঁ যুগল কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হলো। ললাটে স্পর্শ করল তা। পুনরায় কল দিয়ে যখন একই হাল পেল, উদভ্রান্তের ন্যায় লাগাতার কল দিতে থাকে সাফারাত। কল রিসিভ হলো দীর্ঘ,লম্বা একটা সময় পর। অপর পাশের ব্যক্তিকে কিছু বলতে না দিয়ে ধমকে উঠল সাফারাত ক্রোধমিশ্রিত স্বর দ্বারা।

” এতগুলো কল দিচ্ছি ধরছেন কেন আপনি চৈত্র। আপনি কি চাইছেন আমার নিঃশ্বাস আঁটকে যাক? ”

অপর পাশে পিনপতন নিরবতা। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে কেবল। খুবই ক্ষীণ। সাফারাতের রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেল এতে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” স্পিক আপ ড্যামেট। ”

” আমার কোনো পরিচিত আত্মীয় স্বজন নেই এই শহরে। আমার বাবার লা/শ টা দাফনে একটু সহায়তা করবেন সাফারাত? ”

হতভম্ব, স্থবির হয়ে পড়ল সাফারাত। অত্যন্ত শান্ত ছিল চৈত্রিকার গলার স্বর। কলটা কেটে গেছে কিছুক্ষণ পূর্বে। কি বললো এটা চৈত্রিকা!

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here