#সুখের_নেশায়,২৬,২৭
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___২৬
প্রতি/শোধ? প্রেম অস্ত্র? শব্দগুলো তীক্ষ্ণভাবে কর্ণে বিঁধছে চৈত্রিকার। হালকা লাল,নীল,হলদে দীপ্ততায় সাফারাতের মুখের কাঠিন্য ভাব চৈত্রিকার শ্বাস আঁটকে দিচ্ছে। ভেঙে পড়েছে মেয়েটা আজ সম্পূর্ণভাবে। যাকে আঁকড়ে ধরে সুখ খোঁজার চেষ্টা করে, সেই মানুষটাই কষ্ট দেয় বেশি। দুমড়েমুচড়ে দেয় অন্তর। চৈত্রিকার মনে হচ্ছে আজ তার বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই। কি করে এই প্রতি*শোধের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসবে ও?সাফারাত কি ভালোবাসে নি তাকে?অভিনয় করেছে মাত্র। কিভাবে মুছে দিবে অতীত থেকে সেই তিক্ত স্মৃতিটুকু! সাফারাতের বুকে মাথা এলিয়ে দিল। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করছে না সাফারাত। চৈত্রিকার মনে পড়ছে সেই দিনটা। যেদিন নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডকে অন্যের সাথে প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে দেবার তীব্র প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।
ইকোনমিকস প্রাইভেটের জন্য সকাল সকাল কলেজে এসে হাজির হলো চৈত্রিকা। আজ মনটা ভালো না একদম। গতরাত থেকে ইচ্ছে করছিল বাবার সাথে একটু কথা বলার। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারে নি। তাছাড়া অন্য চিন্তায় ঘুম হারাম ওর। ব্যাগ রেখে বাহিরে এসে দেখে সাফারাত কলেজের একপাশে করা ফুল বাগানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চৈত্রিকা মিষ্টি হেসে বলে উঠল,
‘গার্লফ্রেন্ডের জন্য ফুল চুরি করার ধান্দা? ‘
‘ না। গার্লফ্রেন্ডে এলার্জি আছে আমার। ‘
দুষ্ট হেসে প্রতুত্তর করে সাফারাত। চৈত্রিকা বাঁকা হেসে বললো,
‘ তাহলে আমি কি?’
‘ তুমি তো চৈত্র মাস। যাকে আমি কিস করতে পারব না। যখন তখন জড়িয়ে ধরতে পারব না। আর,,,!’
সাফারাত চৈত্রিকার মুখে দেখে কথাগুলো অসমাপ্ত রেখে দিল। মেয়েটার ফর্সা গাল দুটো টসটসে লাল হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। মাথা চুলকে বললো,
‘ এইবার বুঝলে? ‘
চৈত্রিকা ঠোঁট উল্টে বলে উঠল,
‘ বুঝলাম। তবে আমাদের ক্লাসের সুন্দরী সিনথিয়া তো তোমার জন্য পাগলপ্রায়। ওকে গার্লফ্রেন্ড বানালেই তো পারো। কিস করতে পারবে কিন্তু! ‘
কথাটা বলেই চৈত্রিকা দাঁত কেলায়। সাফারাত ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
‘ মন টানে না। ‘
‘ আমার টানে জানো?’
‘ হোয়াট?’
ভ্রুঁ উঁচিয়ে চাইল সাফারাত। দৃষ্টি প্রশ্নবিদ্ধ। চৈত্রিকার মুখের অবস্থা থমথমে। আমতা আমতা করে বললো,
‘ আরে সিনথিয়ার প্রতি না। সামনের ফুলগুলোর প্রতি। আমার খুব ইচ্ছে আমার জীবনে প্রণয়ের আরম্ভ টা ফুল দিয়ে হবে। ‘
‘ প্রেমে পড়লে নাকি চৈত্র মাস?’
‘ উহু!এমনি এমনি ফিলিংস। ‘
সাফারাতের হাসি পেল। চৈত্রিকা যদি রেগে যায় তাই অন্যদিকে চেয়ে হাসল। ঠিকি চৈত্রিকা দেখল তা। রাগ হলো কিঞ্চিৎ।
টিফিন টাইমে বেঞ্চে মাথা দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে সিনথিয়া।সবাই সেদিকে চেয়ে কানাঘুঁষা করছে। চৈত্রিকা এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত রাখে। সিনথিয়া আর ও একই স্কুলে একসাথে পড়ালেখা করেছে। খুব বেশি ক্লোজ না হলেও ভালো বন্ধুত্ব। চৈত্রিকা মাথায় হাত রেখে মলিন স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘ কাঁদছিস কেন?’
মাথা তুলে তাকালো সিনথিয়া। চোখ মুখ ফুলেফেঁপে একাকার মেয়েটার। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে উত্তর দিল,
‘ কাঁদব না তো কি করব?তোর ওই বন্ধু সাফারাত আমাকে একটা কথা বলার সুযোগ পর্যন্ত দিচ্ছে না। এতো অহংকার ওই ছেলের। আমি কি করব চৈত্র? আমার অনেক কষ্ট হয়। আমি ওরে ছাড়া থাকতে পারমু না। প্লিজ তুই একটা বার কথা বলার ব্যবস্থা করে দে বইন। ‘
চৈত্রিকা কিয়ৎক্ষণ ভাবল। সাফারাতকে অনেক বার বলেছে, বুঝিয়েছে। কিন্তু ওই ছেলে কোনোমতেই কথা বলতে পর্যন্ত রাজি না। চৈত্রিকা ব্যতীত কোনো মেয়ের সাথেই কথা বলে না। সাফারাতের হাসি,মুগ্ধময় স্বর সবই চৈত্রিকা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। চৈত্রিকা শুনেছে গম্ভীর ছেলেগুলো ভালোবাসে বেশি। একদম মাখোমাখো প্রেম হয় ওদের। একবার যদি সিনথিয়ার সাথে সেট করে দিতে পারে তাহলে দুই বন্ধুর ঘটকালি করার সুযোগ হবে একটা সময়। আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে চট করে একটা বুদ্ধি উড়ে এসে চৈত্রিকার মস্তিষ্কে বসল। সিনথিয়ার কানে কানে কিছু একটা বলে উৎফুল্ল হাসে।
কলেজ ছুটি শেষে সাফারাতকে ধরে বেঁধে এক প্রকার জোর করে একটা খালি ক্লাসে নিয়ে এলো চৈত্রিকা। কি একটা বিষয় নাকি বুঝতে পারে নি এটা যেন সাফারাত বুঝিয়ে দেয়। সাফারাত কোনোরকম বিরক্ত প্রকাশ না করে সাথে আসল। এই ক্লাসরুম টা ছোট। জরুরি দরকার ছাড়া এটাতে ক্লাস করানো হয় না। চৈত্রিকা একটা খাতা বের করে ব্যাগ টা রেখে খালি বোতল হাতে নিয়ে বলে উঠল,
‘ তুমি বসো। আমি পানি নিয়ে আসছি। ‘
সাফারাত মাথা নাড়ে। চৈত্রিকা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে আড়ালে গিয়ে ডাকে সিনথিয়াকে। তড়িঘড়ি করে বলে,
‘ জলদি যা। আমি খেয়াল রাখছি কেউ আসে কিনা। আজ রাজি করিয়েই ফেলিস বোন। যদি না পারিস সাফারাত কিন্তু আমায় এই কান্ডের জন্য ছেড়ে দিবে না। ‘
সিনথিয়া খুশিতে জড়িয়ে ধরল চৈত্রিকা কে। তৎপরে ছেড়ে দিয়ে রুমে ঢুকে যায়। সাথে সাথেই বাহির থেকে দরজা আঁটকে দেয় চৈত্রিকা। এছাড়া উপায় নেই। বদ্ধ রুম ছাড়া সাফারাতের সাথে কথা বলার সুযোগ পাবে না সিনথিয়া। সাফারাত দিবে না। টেনশনে হাঁটু কাঁপছে রীতিমতো। চৈত্রিকা ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করছে কলেজ প্রাঙ্গণে। ভিতর হতে কোনো সাড়া পাচ্ছে না। প্রায় তিন মিনিট কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে নিজেদের বাড়ির একটা পিচ্চি ছেলেকে দৌড়ে আসতে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ল চৈত্রিকা। কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
‘ কি হয়েছে? তুই এখানে কেন?’
ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
‘ তোমার আব্বারে হসপিটালে লইয়া গেছে। জলদি চলো। তোমার মা পাঠাইছে আমারে। ‘
ভূতল কেঁপে উঠল চৈত্রিকার। আশেপাশের সবকিছু ভুলে ছুটে চলে আসে বাড়িতে। ভুলে যায় দু’টো মানুষকে বন্দি রেখে গিয়েছে ও।
সাফারাতের শার্ট খামচে ধরল দুর্বল হাতে বিষাক্ত স্মৃতি হতে বেরিয়ে। সাফারাতের মুখভঙ্গি শক্ত, কঠিন। চৈত্রিকা ফুপিয়ে উঠল মুহুর্তেই। সে জানে না সেদিন কি হয়েছিল, তবে ও ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে সাফারাতকে। সাফারাত ওর স্বামী। আবেগের বয়সে নিজের অনুভূতি বুঝতে পারে নি। কিন্তু কি এমন হয়েছিল যার কারণে সাফারাত দূরে চলে গেল বন্ধুত্বের বন্ধন ভেঙে? সত্যিই সাফারাত প্রতি*শোধ নেওয়ার জন্য ফিরে এসেছে?চৈত্রিকার ভিতরটা ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে উঠেছে। সাফারাতের বুক থেকে মাথা তুলে সিনথিয়ার দিকে অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগল নিক্ষেপ করল। গলায় কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। বহু কষ্টে প্রশ্ন করল,
‘ কি হয়েছিল ওইদিন? দয়া করে খুলে বল আমাকে। ‘
‘ সিনথিয়া কেন বলবে?আমি বলব আপনাকে। সবকিছু আমি বলব। আপনি তো চেয়েছিলেন সিনথিয়ার সাথে আমার প্রেম হোক তাই না?’
সাফারাতের কঠিন গলায় শেষের বাক্য টা শুনে চৈত্রিকার বক্ষস্থল কেঁপে উঠল। তবে কি সেদিন না বুঝে করা ভুলের জন্য ওদের মাঝে কিছু হয়েছে?করুন দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সাফারাতের পানে। কিন্তু সাফারাত বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করল না। হাত টা ধরে টান দিয়ে পা বাড়াতেই চৈত্রিকার পড়ে যাওয়ার উপক্রম। এক পা ও নড়ার শক্তি টুকু নেই মেয়েটার। সাফারাত বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে পাঁজা কোলা করে চেয়ারে এনে বসালো। সিনথিয়া এগিয়ে এলো পিছু পিছু। সাফারাত সিনথিয়াকে চেয়ারে বসতে বলে নিজে একটা চেয়ার টেনে চৈত্রিকার মুখোমুখি বসল। চৈত্রিকার দিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলতে শুরু করে,
‘ সেদিন আপনার কাছ থেকে এমনটা আমি মোটেও আশা করি নি। আপনার জন্য আমার মা নিজের পরিবার, কলেজের শিক্ষকদের সামনে ছোট হয়েছে। বদ্ধ সেই রুমে সিনথিয়া যখন এগিয়ে এসে আমার হাত টা ধরেছিল আমার ওই মুহূর্তে আপনাকে খু/ন করার ইচ্ছে জেগেছিল চৈত্র। সিনথিয়ার অশ্রু আমার হৃদয় নাড়াতে পারে নি কিন্তু আপনার আমার সাথে করা কান্ডটা,ধোঁকা দেওয়াটা আমাদের বন্ধুত্বে আঘাত হেনেছিল। ‘
কথাগুলো বলে একটু থামল সাফারাত। কপালের শিরাগুলো দৃশ্যমান। সিনথিয়া মাথা নিচু করে রেখেছে।
‘ অনেক বার দরজায় করাঘাত করেও কারো সাড়া শব্দ পাই নি। কলেজে তো মেবাইল এলাউ ছিল না। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা হওয়ার পথে। সিনথিয়া সাহস করে আমার কাছাকাছি আসতে পারে নি আর। দূরে বসে ছিল। তখনই দেখলাম মেয়েটার চোখ নিভু নিভু হয়ে আসছে। আমি জানতাম না ওর বদ্ধ রুমে শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। মেয়েটার অবস্থা বেগতিক দেখে এগিয়ে যায় আমি৷ কাছে যেতেই ও আমার বুকে ঢলে পড়ে। সেই মুহুর্তে একজন দপ্তরি দরজা মেলে দেয়। আমাদের এই অবস্থায় দেখে আঁটকে রাখে। আমি যা বুঝার বুঝে গেলাম। উনি আমাদের ব্যাপার টা খারাপ ভাবে নিয়েছেন। অনেক বুঝিয়েও লাভ হয় নি উনাকে। একটা বদ্ধ রুমে দু’টো ছেলেমেয়ে একে অপরের কাছাকাছি নিশ্চয়ই ভালোভাবে নিবে না কেউ? প্রিন্সিপাল স্যার সহ বাকি অনেক টিচার আসলেন। আমার বাবা-মা, সিনথিয়ার বাবা-মাকে খবর দেওয়া হয়। কলেজের মান সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে তাই চুপিচুপিই খবর পাঠালেন। তবুও এলাকায় পাঁচ কান হয়ে গেল৷ কিছু সর্দার সাজা লোকেরও আগমন ঘটল। আমার মা’কে বলা হলো তিনি ছেলে মানুষ করতে পারেন নি। চরিত্রহীন ছেলে পুষেছেন। মেয়েদের ফুসলিয়ে রুমে এনে জোর করার চেষ্টা করে। এমনকি ধ/র্ষ/ণ শব্দটাও বাদ যায় নি। আমার সব থেকে প্রিয় মানুষ আমার মা তখন চোখে অশ্রু নিয়ে শুধু একবার আমার দিকে তাকিয়েছিল। ছোট্ট করে ধরা গলায় বলেছিলেন — ‘ আমার ছেলে এমন না। ‘
কিছু লোক তাচ্ছিল্য হেসেছিল প্রতুত্তরে। সিনথিয়া ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুখ খুলে বলেছিল একবার সবাই যা ভাবছে তেমন কিছুই না। ও আমাকে পছন্দ করে নিজ থেকে আমার সাথে জোর করে কথা বলতে এসেছে এটাও জানায়। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে নি। বাহির থেকে লক করা ছিল এটা দপ্তরি বললেও সবাই বিশ্বাস করে নি। মুখে মুখে এটাই ছিল দু’জন একা রুমে কি করছিলাম ছুটির পর?নিশ্চয়ই প্রেম অথবা অসভ্যতামি,নোংরামি ?আমার মন একটাবারও সায় দেয় নি আপনার নামটা নেওয়ার। শত হোক মায়ের পরে আমার মনে জায়গা নেওয়া দ্বিতীয় নারী ছিলেন আপনি। সিনথিয়ার বাবা গলা উঁচিয়ে বলেছিলেন উনার মেয়েকে নিয়ে কি করবেন উনি। কিভাবে মুখ দেখাবে সমাজে? একটা সঠিক বিচার যেন হয়। বিচার?হ্যাঁ দোষ না করেও বিচার হয়েছিল সেদিন আমার। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় আমার ও সিনথিয়ার বিয়ের। একটা ছেলের সাথে ধরা খাওয়া মেয়েকে ঘরে তুলবে না কেউ এটা ধারণা ছিল সিনথিয়ার পরিবারের। বিয়ে টাই যেন সঠিক সমাধান মনে হয়েছে উনাদের।
বিয়ে?আট বছর আগে সেদিন কি সিনথিয়া,সাফারাত এর বিয়ে হয়েছিল?তবে কি সিনথিয়া সাফারাতের প্রথম স্ত্রী? প্রতি/শোধ নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় স্ত্রী বানালো ওকে? চৈত্রিকার মনে হচ্ছে তার শ্বাস রোধ করে ফেলছে কেউ। চোখ নিভে আসছে। একেবারে বন্ধ হবার আগে সাফারাতের মুখ টা ভেসে উঠল চক্ষে। দেখল সাফারাত হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ওর দিকে। তা আঁকড়ে ধরার পূর্বেই চেয়ার থেকে মেঝেতে ঢলে পড়ল নরম দেহ টা তৎক্ষনাৎ।
#চলবে,,!
#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___২৭
হলদে আলোর ছটায় চৈত্রিকার সদ্য পিটপিট করে খোলা চক্ষুদ্বয় নিমীলিত হয়ে আসছে বারংবার। চোখ দুটো জ্বালা করছে ভীষণ। কিছু সময় চেষ্টার ফলে আঁখিদ্বয় পুরোপুরি মেলতে সক্ষম হয়। প্রথমেই চোখে পড়ল বাঁশের সিলিং। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে হালকা আলোতে তার দিকেই নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলে রেখেছে সিনথিয়া। চেহারায় অস্থিরতা, বিচলিতা। তাকে চোখ মেলতে দেখে যেন মুহুর্তেই সকল চিন্তা কেটে গিয়ে ঠোঁট প্রসারিত হলো। উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ ঠিক আছিস চৈত্র? ‘
চৈত্রিকা নিরব,নিশ্চুপ। চোখ মেলে সিনথিয়ার মুখটা দেখে জ্ঞান হারানোর পূর্বের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। না চাইতেও সিনথিয়াকে অসহ্য লাগছে। একদমই সহ্য করতে পারছে না। কোন নারীই বা পারে নিজের স্বামীর জীবনে অন্য কোনো নারীর উপস্থিতি মেনে নিতে?হতে পারে চৈত্রিকা দ্বিতীয় তবুও সাফারাতকে কিছুতেই হারাতে পারবে না। হাজার প্রতি/শোধে ক্ষতবিক্ষত করুক চৈত্রিকার হৃদপিণ্ড তবুও চৈত্রিকা সাফারাতকে ভালোবাসা বন্ধ করবে না। এক চুলও নড়বে না সাফারাতকে ছাড়া। কিন্তু সাফারাত কোথায়?চৈত্রিকা সারাঘরে চোখ বুলিয়ে দেখতে পায় কাঠের আসবাবপত্র। ছোট একটা রুম। চৈত্রিকা বুঝতে পারে এটা চিলেকোঠার ঘর। হয়ত দূর থেকে কোনো মানুষ আসলে রাতে থাকার জন্য এই ঘরগুলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এই ঘরের আনাচে-কানাচেতে কোথাও সাফারাত নেই।
বুকে পাথর সমান ওজন অনুভব করছে চৈত্রিকা। নিজের অবুঝের মতো করা ভুলগুলো এতো ভারি পড়বে কখনও ভাবে নি সে। ভিতর টা আত্মচিৎকারে ফেটে যাচ্ছে। কি করে বুঝাবে ও সাফারাতকে?সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে প্রশ্ন করল,
‘ সাফারাত? ‘
‘ বাহিরে। ‘
চৈত্রিকা অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বললো- ‘ আমি উনার সাথে কথা বলতে চাই। ‘
‘ ঠিক আছে। ‘
সিনথিয়া দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যেতেই দরজা দিয়ে সাফারাতের প্রবেশ ঘটে। হালকা আলোয় সাফারাতের চোখের দৃষ্টি, মুখ টা দেখে চোখের কোল ভিজে উঠল চৈত্রিকার। এলোমেলো শাড়ি নিয়ে এক প্রকার লাফিয়ে বিছানা ছাড়ল। ঝড়ের বেগে হামলে পড়ল সাফারাতের বুকে। আকস্মিকতায় সাফারাত এক পা পিছিয়ে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে চৈত্রিকার পিঠে হাত রাখল আলতো করে। স্পর্শ পেয়ে চৈত্রিকা ফুপিয়ে উঠল। সারা অঙ্গ,দেহ কাঁপছে কান্নার দাপটে। অনলের দহনে শরীরের প্রতিটা স্নায়ুকোষ, অন্তর,হৃদয় পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে। ভাঙা গলায়,অস্পষ্ট কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আপনি যত অত্যাচার করবেন,কষ্ট দিবেন,শাস্তি দিবেন সব মাথা পেতে নির্দ্বিধায় সহ্য করে নিব। কিন্তু আপনাকে ছাড়া এক মুহুর্তও থাকতে পারব না। কষ্ট আপনি দিবেন, আমি তা সুখ হিসেবে গ্রহণ করব। আপনার সান্নিধ্য ছাড়া আমার আর বেঁচে থাকা সম্ভব না। দয়া করে আমায় দূর করে দিবেন না। আমি,,আমি সিনথিয়াকেও মেনে নিব৷ শুধু আপনার থেকে দূর করবেন না আমাকে। ‘
চৈত্রিকা সাফারাতের টিশার্ট মুঠোয় পুরে আকুতি মিনতি করতে থাকে। বাবার পর এই একটা মানুষকে জীবনে সব থেকে বেশি ভালোবাসে। বাবার আদর তো কখনও পাওয়া হয় নি কিন্তু হাতের নাগালে থাকা এই সুখ যে পায়ে ঠেলে দেওয়া সম্ভব না ওর দ্বারা। লড়াই করতে করতে আজ বড্ড ক্লান্ত দেহ,মন,মস্তিষ্ক। সাফারাতের মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হলো না। আবারও কাতর স্বরে বলে উঠল চৈত্রিকা,
‘ আমি জানি আমি যা করেছি ক্ষমার যোগ্য না। আমি তো মরে গেলেও আপনার মা’র সম্মান ফিরিয়ে আনতে পারব না। আর না পারব উনার কাছে ক্ষমা চাইতে। অতীতের বিষাক্ত সেই স্মৃতি, ঘটনা টুকুও মুছে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আমি আগে বুঝতে পারি নি আপনাকে ভালোবাসি আমি সাফারাত। একদমই বুঝতে পারি নি। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল তাই চলে যেতে হয়েছে আমার। কয়েকদিন কলেজে আসতে পারে নি। আসার পর আপনার,সিনথিয়ার অনেক খোঁজ করেছি। কেউ কিছু বলতে পারে নি। শুধু জেনেছি আপনি কলেজ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। সেদিন প্রথম উপলব্ধি করি আমি আপনাকে ভয়ংকর রকমের ভালোবেসে ফেলেছি। আপনাকে মনে মনে,বাস্তবে অনেক খুঁজে বেড়িয়েছি। অনেক। আমার এতগুলো বছর কেটেছে আপনার ও বাবার ভালোবাসা পাওয়ার আশায়। ‘
একনাগাড়ে পাগলের মতোন প্রলাপ করে যাচ্ছে চৈত্রিকা। সাফারাত কোমর জড়িয়ে শূণ্যে তুলে নিল। চৈত্রিকা থমকে গেল। স্তব্ধতায় ছেয়ে গেল মুখমন্ডল। চক্ষু হতে স্রেফ অবাধে জল গড়াচ্ছে। মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে যেন ভুলে গিয়েছে। শূন্য অবস্থায় বিছানায় এনে বসালো সাফারাত। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর ও আদেশের সুরে বললো,
‘ কান্না থামান। ‘
চৈত্রিকা হাতের উল্টো পিঠে তড়িঘড়ি করে চোখ হতে গড়িয়ে ভিজিয়ে দেওয়া গাল দুটো মুছতে আরম্ভ করে। কিন্তু এতে নাকের পানি,চোখের পানি মিলেমিশে একাকার। সাফারাত হাত বাড়িয়ে টিস্যু দিয়ে যত্ন করে পুরো মুখ মুছে দেয়। চৈত্রিকা কাঁপা কাঁপা হাতে সম্পূর্ণ পানি খেয়ে নিজেকে কিছুটা সামলে নিল। সাফারাতের মুখভঙ্গির পরিবর্তন হলো এবার। দু’হাতে মাথার চুলগুলো টেনে নিজের রাগ সংবরণ করে।
‘ অল্পতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন? শুনেই?আপনি কি আমার অবস্থা টা অনুভব করতে পেরেছেন চৈত্র? আমার বক্ষে তড়তড় করে প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা যন্ত্রণা আঁচ করতে পারছেন?’
কথাটা বলেই চৈত্রিকার হাত টা টেনে নিজের বুকে রাখে সাফারাত। তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,
‘ বছরের পর বছর ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করছি আমি। আমার যন্ত্রণার কারণ কি জানেন?আপনাকে ভালোবেসে ফেলা। ‘
চৈত্রিকা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো। প্রতি/শোধ শব্দটা মুহুর্তেই চাপা পড়ে গেল সাফারাতের শেষোক্ত বাক্য কর্ণপাত হতেই। সাফারাতের ভালোবাসা সত্য। চৈত্রিকার মন কিছুক্ষণ আগে ভেঙে গেলেও সে বিশ্বাস হারায় নি সাফারাতের ভালোবাসার উপর থেকে। ওর তখন মনে হয়েছে, এখনও মনে হচ্ছে সাফারাত যদি ওর খু’ন ও করে ফেলে শেষ নিঃশ্বাস ফেলা অব্দি বিশ্বাস হবে না চৈত্রিকার। এটা কি অন্ধ বিশ্বাস! হ্যাঁ। সুখের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে মাঝে মাঝে অন্ধবিশ্বাসে ডুবে যায় আমরা। লাভ, ক্ষতি কোনো কিছুর পরোয়া করি না। চৈত্রিকা মুখ ফোটে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই সাফারাত মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠল,
‘ ইয়েস চৈত্র মাস। আই ফল ইন লাভ উইথ ইউ এন্ড ব্যাডলি নিডেড ইউ অলসো। আই কান্ট লিভ উইথআউট ইউ। বিকজ ইউ আর মাই হ্যাপিনেস। আমার সুখ আপনি। আপনাকে ঘৃণা করে দেশ ছেড়েছি। মনের গহীনে চিরতরে চাপা দিয়েছি বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কিন্তু কলেজ জীবনের শুরু থেকেই আপনার প্রতি ঝুঁকে ছিল মন। দুর্বল ছিল। যেটা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাই নি। যখন বুঝতে পারলাম তখন আমি আপনার থেকে অনেক দূরে। আমার মন জুড়ে আপনার প্রতি প্রতি/শোধের অনল দাউদাউ করে জ্বলছিল সেই মুহুর্তে। চাপা পড়ে যায় প্রেমের অনুভূতি মায়ের চোখের জলের সামনে। শত হোক আপনি দোষী ছিলেন চৈত্র। আমার প্রতিবার না করা সত্ত্বেও সিনথিয়া কে আমার কাছাকাছি আনার চেষ্টা করেছেন। জানেন নিজের আবেগ, অনুভূতি প্রথম প্রথম দমিয়ে রাখতে বেশ কষ্ট হত আমার।
আম্মুকে কয়েকবার বলেই ফেলেছি আমার চৈত্র কে চায়। মায়ের মন তো হাসিমুখে বলেছে জার্মানি থেকে ফিরেই আমি আপনাকে চোখের সামনে দেখব। দিন কয়েক কেটে যাওয়ার পর সেদিনের সেই তিক্ত, জঘন্য ঘটনা টা সারাক্ষণ আমার মাথায় চেপে বসে থাকত। দম বন্ধ হয়ে আসত আমার। প্রতি বার আপনাকে মে/রে ফেলার স্পৃহা জাগত। পারিবারিক এবং বিভিন্ন কারণে আমার মাঝে একবার দেশে ফেরা হলেও আবার কয়েকদিন বাদে ফিরে যেতে হয় জার্মানি। নিজেকে ততদিনে, বছরে আমি সম্পূর্ণ রূপে পরিবর্তন করে ফেলি। আশ্চর্য হয় প্রথমে নিজের আমূল পরিবর্তন দেখে। এতগুলো বছর পর ফিরে সিলেটে যায় আপনার খুঁজে। গিয়ে জানতে পারি ঢাকাতে থাকেন আপনারা। খুঁজে বের করা আমার জন্য কঠিন কিছু ছিল না। আপনার ফ্যামিলির অবস্থা সম্পর্কে জানতেও আমার সময় লাগে নি। তার মধ্যে জানতে পারি আপনার এখনও বিয়ে হয় নি। তখনই মাথায় আসে সেদিনের হিসেব-নিকেশ টা নাহয় অন্য উপায়ে করা হোক। আপনার জন্য মনে বহু বছর আগে জন্ম নেওয়া প্রেম পুনরায় জেগে উঠে। তা চেপে রেখে মিথ্যে ভালোবাসা দেখিয়ে প্রেম নামক বন্ধনে জড়িয়ে আপনাকে নিঃশেষ করে দেবার বহু কল্পনা করি। কিন্তু দিনশেষে আমি হেরে গেছি চৈত্র। যাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি তাকে আঘা*ত করার মতো শক্তি, সাহস আমি পাচ্ছিলাম না। পারছিলাম না আপনাকে দিনের পর দিন কষ্টে দেখতে। ভালোবাসার শক্তি এতই অধিক ছিল যে প্র/তি/শো/ধ, আঘা/ত এসব নিরর্থক, অর্থহীন হয়ে পড়ে।
সাফারাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চৈত্রিকার মায়াভরা মুখশ্রীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে,
‘ আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি আপনাকে ভালোবাসলে কেন আবার এসব বললাম?আমি আপনাকে কষ্ট, আঘা/ত দিতে চেয়েছি এগুলো লুকিয়ে গেলেও পারতাম তাই না?’
মাথা দুলাল চৈত্রিকা নিরব ভঙ্গিতে। সাফারাত ঠোঁট কামড়ে চোখ বুঁজে চৈত্রিকার হাতে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিল গভীরভাবে। দমকার হাওয়ার ন্যায় কিছু একটা চৈত্রিকার বক্ষস্থল ঠান্ডায় কাঁপিয়ে তুলল। শোনা গেল সাফারাতের দৃঢ় কন্ঠস্বর।
‘ আমাদের একদিন না একদিন সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। কয়েকদিন আগেও আমি আপনার কাছে আসতাম প্রতি/শোধ নেওয়ার ভাবনা নিয়ে,নিজের ভালোবাসা একপাশে চেপে রেখে। আপনার বাবার মৃত্যুর দিন আমার মনে উদয় হয় আমি কাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করছি যে কি-না নিঃশেষ হলে আমার নিঃশেষ হওয়া নিশ্চিত। আপনার বাবার মৃত্যুর দিন প্রকাশ করেছিলেন আমার প্রতি আট বছর দূরে থাকা,বন্ধুত্ব ভেঙে কিছু না বলে চলে যাওয়ার অভিমান। আমি আজ যদি সবটা ক্লিয়ার করে না বলতাম সব তো ধোঁয়াশা ও প্রশ্ন হয়ে থেকে যেত। আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে যাওয়ার পর একটা সময় হয়ত আপনি জানতে পারতেন আমি আপনাকে হার্ট করার পরিকল্পনা করেছি তাতে আপনি ভেঙে কাঁচের ন্যায় তচনচ হয়ে পড়তেন। আমি আপনাকে হারাতে চাই না চৈত্র। তাই আমাদের এক হওয়ার আগে সবটা খোলাসা করতে চেয়েছি আমি। আপনি চাইলে আমাকে শাস্তি দিতে পারেন। সহ্য করে নিব। কারণ,আপনাকে ভালোবাসার পাল্লা টা ভীষণ ভারি চৈত্র। ‘
চৈত্রিকা প্রচন্ড অবাক হলো। বিমূঢ়তায় বাক হারা হয়ে পড়ে। যেই মানুষটাকে ও কষ্ট দিয়েছে নিজের করা বোকামির জন্য সেই মানুষটা উল্টো শাস্তি দিতে বলছে। ঠোঁট দুটো নাড়ানোর চেষ্টা করল। ভাঙা গলায় দুরুদুরু বুক নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ সেদিন সিনথিয়ার সাথে আপনার বিয়ে হয়েছিল?’
চৈত্রিকা প্রশ্ন টা করতে চায় নি। কিন্তু না করেও থাকতে পারছিল না। সিনথিয়ার তো কোনো দোষ নেই। যদি ও সাফারাতের প্রথম স্ত্রী হয়ে থাকে ওর পায়ে ধরে হলেও সাফারাতের জীবনে একটুখানি জায়গার জন্য অনুরোধ করবে।
‘ উঠুন। ‘
চৈত্রিকা বিনা বাক্যে উঠে দাঁড়ায়। দ্বিরুক্তি করে না। সাফারাত এগিয়ে এসে শাড়িটা ঠিক করে দেয়।
‘ মনে হচ্ছে আপনার স্বামী বিয়ে করে ফেলেছে। সতীনের অত্যাচারে
অবস্থা বিধস্ত। একটু ঠিকঠাক হন। আমরা বাহিরে যাবো। ‘
এমনই তো। চৈত্রিকা মনে মনে এটা আওড়ালেও মুখে অস্ফুটস্বরে বললো,
‘ কিন্তু! ‘
‘ নো মোর ওয়ার্ডস। আমি ফিরিয়ে প্রশ্ন করা পছন্দ করি না চৈত্র। ‘
কিছুটা ঠিক হতেই সাফারাত হাত ধরে বাহিরে নিয়ে এলো। সামনের দিকে তাকাতেই চক্ষুূ দু’টো চড়কগাছ চৈত্রিকার। সিনথিয়া একটা ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। ছেলেটাকে বিদেশি মনে হচ্ছে চৈত্রিকার। বিদেশি দের মতো গায়ের রং অত্যাধিক ফর্সা, চুলগুলো ব্রাউন কালার। চৈত্রিকা আঁড়চোখে সাফারাতের দিকে তাকালো। সাফারাতের চোখে রাগের আভাস মাত্র নেই। ফর্সা মুখটা একটুও লাল বর্ণ ধারণ করে নি। মুখের ভাব নিরলস ও স্বাভাবিক। সিনথিয়া ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে সরে এলো। লজ্জায় নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইল। বিদেশি সেই ছেলেটা এগিয়ে এসে সাফারাতকে জড়িয়ে ধরে। চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলে উঠল,
‘ হাই ভাবী। আমি আয়ান। সাফারাতের কাজিন ও সিনথিয়ার হাসবেন্ড। ‘
চৈত্রিকা সাফারাতের হাত টা খামচে ধরল শক্ত করে। সিনথিয়া সাফারাতের বউ না?আয়ানের বলা কথাটা বার বার কানে বাজছে তার। সাফারাত একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল ওকে। লজ্জায় গুটিয়ে গেল সে। সিনথিয়া ততক্ষণে হাসিমুখে আয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘ কি ভেবেছিলি আমি সাফারাতের বউ?’
চৈত্রিকা মাথা উপর নিচ করে। সিনথিয়া আয়ানের হাত টা আঁকড়ে ধরে বলে,
‘ উহু!আমি তো আয়ান জামানের বউ। সেদিন সাফারাত আমাকে বিয়ে করতে কোনো ক্রমে রাজি হয় নি। তাছাড়া সাফারাতের মা’র পুরো বিশ্বাস ছিল ঘটনা টা সবার দেখার ভুল। তিনি বুদ্ধি করে বলেন এতো কম বয়সে বিয়েটা ঠিক হবে না। আন্টি আমার পরিবারকে কথা দেয় বিয়ের সময় হওয়া অব্দি আমার দায়িত্ব নিবেন। সময় হলে আমার সাথে সাফারাতের বিয়ে হবে। আমার পরিবার রাজি হলেও এলাকার কয়েকজন মানুষ রাজি হন নি। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ তো টাকার লোভী। বাধ্য হয়ে আন্টি মোটা অংকের টাকা দিয়ে দমাতে হয় তাদের। তাছাড়া কলেজের টিচার রা কলেজের সম্মান রক্ষার্থে কথাটা ছড়াতে দেয় নি। রাতের আঁধারে আমাদের কয়েকজনের মধ্যেই সেই ভয়ংকর ঘটনা টা চাপা পড়ে যায়। একটা কাকপক্ষীও টের পায় না। আয়ানের সাথে আমার দেখা জার্মানিতে। আন্টি আমাকে সাফারাতের সাথে পড়তে পাঠায় জার্মানি। ওইখানেই উনার চাচাতো বোনের ছেলে মানে সাফারাতের খালাতো ভাই আয়ানের সাথে পরিচয় হয় আমার। আয়ানের সাথে পরিচয় হওয়ার পর আমি বুঝতে পারি সাফারাতের প্রতি যা ছিল তা কেবল মোহ। ফ্যামিলির বিপক্ষে গিয়ে আমি আয়ানের কাছে বিয়ে বসি। এতো বছরে তোর সাথে অনেকবার দেখা করতে চেয়েছি চৈত্র কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার জন্য বাংলাদেশ আসতে পারি নি। আমি এটাও জানতাম না সাফারাত সেদিনের ঘটনাকে পুষে রেখেছে মনে দিনের পর দিন। এত বছর পর যখন বাংলাদেশ এসে সাফারাতের কাছ থেকে জানলাম তোর খোঁজ পেয়েছে আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। প্রথমেই দেখা করতে চাই কিন্তু সাফারাত দেয় নি। প্রায় একমাস হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে আসার। সাফারাত আমার কাছে সবটা খুলে বলে। এটাও বলে তোকে আঘা/ত করতে যেয়ে আরো তীব্র ভালোবেসে ফেলেছে। ও পারে নি তোকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিতে। তুই ভাগ্যবতী চৈত্র। সবাই অভিনয় করে চরম ভাবে ঠকাতে পারে,কিন্তু অভিনয় করতে গিয়ে ভালোবেসে পরাজিত হয়ে আসে খুব কম অভিনেতা। ‘
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)