সুখের_নেশায়,৩৪,৩৫

0
861

#সুখের_নেশায়,৩৪,৩৫
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৩৪

ফজরের আযানের ধ্বনি কানে ভেসে আসতেই সাফারাত নড়েচড়ে উঠে। বুকে গুটিসুটি মেরে ঘুমন্ত চৈত্রিকাকে টেনে সোজা করে পাশে শুইয়ে দিল। তৎপরে সাফারাত গালে হাত বুলিয়ে পাশে শুয়ে নেত্রদ্বয় নিমীলিত করে নেয়। নরম একটা স্বর চৈত্রিকার কর্ণধারে পৌঁছায় নিমেষে।
‘ উঠুন চৈত্র জান। ‘

এক বাক্যে চৈত্রিকা তৎক্ষনাৎ ক্ষীণ নড়ে উঠল। ঘুম ভীষণ পাতলা ওর। বিলম্ব না করে চক্ষুদ্বয় মেলার চেষ্টায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। মাত্র দু ঘন্টা পূর্বে ঘুমে বিভোর হয়েছিল, যার ফলে চোখ মেলা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। তবুও পিটপিট করে সাফারাত এর মুখের দিকে কপাল কুঁচকে চাইল। ও কি ভুল কিছু শুনল?জান?এটাই তো ডাকলো সাফারাত। হুট করেই চৈত্রিকার বুকের অবস্থা বেশ টালমাটাল। ভাঙা গলায় প্রশ্ন করে,
‘ আপনি এই মুহুর্তে আমায় ডেকেছিলেন? ‘
‘ ইয়েস ডেকেছি। উঠুন। ‘
‘ আচ্ছা আপনি কি আমাকে শুধু নাম ধরে ডেকেছিলেন? ‘

চৈত্রিকার এমন অদ্ভুত প্রশ্নে সাফারাতের ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে এলো। কপালে বলিরেখার ভাঁজ ফুটে উঠল। লহু স্বরে বললো,
‘ আপনার নাম ধরে ডেকেছি। কেন? আপনার নাম কি চৈত্র না?’
থতমত খেয়ে যায় চৈত্রিকা। আমতাআমতা করে বলে,
‘ হ্যাঁ। কিন্তু নামের সাথে আর কিছু ডাকেন নি?’
‘ আর কিছু ডাকার কথা ছিল?’-‘-এক ভ্রুঁ উঁচিয়ে প্রশ্ন করল সাফারাত।
‘ উঁহু! ফ্রেশ হতে হবে। নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ‘

চৈত্রিকা সাফারাতের প্রশ্নসূচক চেহারায় দৃষ্টি রেখে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল কথা কাটানোর নিমিত্তে। নয়ত কেমন করে জিজ্ঞেস করবে যে আপনি কি আমায় জান ডেকেছিলেন? আমার মনে হলো জান ডেকেছেন। এই লজ্জাতুর শব্দটা উচ্চারণ করতে পারবে না ও। তাই যে করে হোক সাফারাতের দৃষ্টি হতে পালাতে হবে এখন,এই মুহুর্তে। বিছানা থেকে তাড়াহুড়োয় উঠতে নিলে সাফারাত উঠে বসে। কন্ঠে উদগ্রীব, উত্তেজনা।

‘ যেতে পারবেন?আমি কোলে করে দিয়ে আসি ওয়াশরুমে?’

চৈত্রিকা উঠতে গিয়েও থমকে গেল। শ্রবণগ্রন্থি ঝালাপালা করে উঠে ওর লজ্জায়,সংকোচে। সাফারাতের দিকে তাকানোর সাহস অব্দি নেই ওর। এটা কি প্রশ্ন ছিল নাকি লজ্জায় ফেলার,ডুবানোর মন্ত্র? শাড়ি সামলে জবাব না দিয়ে এক প্রকার দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে চৈত্রিকা। অর্ধ গোসল সেড়ে খেয়াল হলো কাপড় আনে নি। জড়তা সংকোচ নিয়ে দরজা একটুখানি খুলে ডেকে উঠল,

‘ সাফারাত! ‘
‘ কি কালার শাড়ি পড়বেন?’

দৈবাৎ প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল চৈত্রিকা। সাফারাত উল্টো হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। তার ফর্সা দেহ দৃশ্যমান। উদোম পিঠ,তাগড়া বলিষ্ঠ দেহ অবলোকন হতেই চৈত্রিকার গলা শুকিয়ে আসছে। তার চেয়েও অত্যাধিক অবাকের বিষয় সে কি করে বুঝল চৈত্রিকার কাপড়ের জন্য হাক ছেড়েছে? চৈত্রিকা ভাবনায় এতো মগ্ন ছিল ও বুঝতেই পারে নি সামনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। গরম, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস মুখে পড়তেই কেঁপে উঠল ও। সমুখে দৃষ্টি মেলে দেখে সাফারাত কলা পাতা রঙের একটা শাড়ি,ব্লাউজ প্রয়োজনীয় সকল জিনিস ওর দিকে বাড়িয়ে রেখেছে। কখন এলো?আগে থেকেই সব রেডি করে রেখেছিল নাকি?আর শাড়ির ও ব্লাউজের সাথে অন্যসব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো?হোক না স্বামী তবুও সাফারাতের হাতে সবকিছু দেখে চৈত্রিকার লজ্জায় মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। হাত কাঁপছে ঠকঠক করে।

‘ লজ্জায় লাল-নীল হবেন নাকি এগুলো নিবেন?’

লাল-নীল?হ্যাঁ। চৈত্রিকা অনুভব করতে পারছে ওর দু’গালের উত্তাপ। নিশ্চয়ই অনেক লাল হয়ে আছে। দ্রুত গতিতে কাপড়গুলো নিয়ে সাফারাতের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল। এতক্ষণে বোধহয় বন্দি খাঁচায় আটকে থাকা পাখির ন্যায় চৈত্রিকার নিঃশ্বাস ও মুক্তি পেল। প্রায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় ছিল।
.
.
.
চৈত্রিকা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসতেই দেখে সাফারাত বিছানার চাদর পাল্টে ফেলেছে। আগের চাদর টা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে নিলেই ইতস্তত কন্ঠে বলে উঠল চৈত্রিকা,
‘ আমাকে দিন। আমি ধুয়ে দিব। ‘
‘ নো নিড, আমি পারব। নামাজ পড়ুন আপনি। আমি আসছি। ‘
‘ কিন্তু! ‘
সাফারাত গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
‘ আমি ধুয়ে দিব চৈত্র। ইজি হোন আমার সাথে। এতো সংকোচ রাখবেন না। ‘
চৈত্রিকা আর কিছু বলতে পারল না। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাফারাতও ফ্রেশ হয়ে রুমেই নামাজ আদায় করে নেয়। বিছানায় গা এলিয়ে বলে উঠল,
‘ ঘুমাবো চৈত্র। আপনি চাইলে ঘুমিয়ে নিতে পারেন কিছুক্ষণ। ‘
‘ বাহিরে যাবো একটু।’-মিনমিন স্বরে বলে উঠল চৈত্রিকা।

সাফারাত কোনো প্রকার প্রতুত্তর করলো না। চোখ বুঁজে ফেলল। চৈত্রিকা ঠাহর করতে পারে সাফারাতের নীরবতা সম্মতির লক্ষণ।
ভেজা চুল ঝেড়ে শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিল চৈত্রিকা। দরজা হালকা করে ভিজিয়ে সিঁড়ির অভিমুখে এলো। নিচে তাকাতেই দেখতে পায় মিনা সোফায় ঘাড় হেলিয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে হাত পা ছড়িয়ে। মেয়েটা নিজের ব্যাপারে একদম বেখেয়ালি। গলা টা মৃদু ব্যাথা করছে চৈত্রিকার। গরম পানি করে খেলে কিছুটা হলেও রিলিফ পাওয়া যাবে। চৈত্রিকা ধীরস্থির ভঙ্গিতে সিঁড়ি অতিক্রম করে নেমে এলো। মিনা কে ডাকতে লাগল আস্তে-ধীরে, নিচু গলায়। চোখ মেলতেই ক্ষীণ স্বরে বললো,

‘ রুমে গিয়ে ঘুমাও। এখানে একটু পর মানুষ আসবে যাবে। খারাপ দেখাবে তো। ‘
মিনা ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ রুম থেকেই আইলাম মাত্র ভাবী। এনে আইয়া কুদ্দুর বইতেই চোখ টা লাইগা গেছে। ‘
‘ সমস্যা নেই। রুমে যাও তুমি। ‘
‘ আপনার কি কিছু লাগব?আমারে কন কি লাগব?’
‘ গরম পানি। আমি নিজেই করতে পারব। তুমি যাও। ‘
‘ না না আমি এখনই কইরা আনতাছি। আপনি এনে বসেন। ‘
‘ লাগবে না। আমি পারব মিনা। তুমি গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও। ‘

কথাটা বলেই চৈত্রিকা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। একটা পাতিলে পানি গরম করতে দিয়ে চোখ বুলালো পুরো রান্না ঘরে। আরেকবার এখানে আসার কারণে বৃহৎ আকারের কিচেন রুমটা দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হলো না চৈত্রিকা। গরম পানি একটা স্টিল এর গ্লাসে ঢেলে লবণ মিশিয়ে নিল। গ্লাসটা ছোট কাপড় দিয়ে ধরে তাপ যেন হাতে না লাগে। গ্লাসটা হাতে নিয়ে ড্রইং রুমে আসতেই মুখোমুখি হয় মৌসুমি বেগমের। চৈত্রিকা তব্দা খেয়ে যায়। পরক্ষণেই সালাম দেওয়া মাত্র মৌসুমি বেগম কড়া কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ লাজ শরমের অভাব নাকি তোর?বস্তির মেয়ে হয়ে অবশ্য সংস্কৃতি, আদব কায়দা জানা তোর ধাঁচের না। আমরা তো শাশুড়ির আদেশ বিহীন লজ্জায় বিয়ের পরদিন রুম থেকেই বের হয় নি। আর তুই সোজা কিচেনে ঢুকে গেলি?এতো বড় বাড়ি, কিচেন রুম দেখে লোভ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই!’

মৌসুমির বেগমের ব্যবহারে হতবিহ্বল চৈত্রিকা। ও জানত উনি স্বভাবে কর্কশ কিন্তু এমন ব্যবহার মোটেও আশা করে নি। অভ্যন্তরে জাগ্রত ব্যাথা,যন্ত্রণা জল হয়ে পরিপূর্ণ করলো চৈত্রিকার চক্ষু কোল। তবুও হাসিমুখে কঠিন এক জবাব দিল সে,

‘ আমার তো শাশুড়ী নেই ফুপু। অন্য কেউ নির্দেশ দিবে না। তাই অপেক্ষা না করে নিজেই চলে এলাম। আফটার অল সংসার টা আমার। বর বললো সংসার টা সামলানোর দায়িত্ব আমার। আমি আবার স্বামী ভক্ত। ‘

মৌসুমি বেগম রাগান্বিত চোখে তাকালেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
‘ বড়দের সাথে এভাবে কথা বলা শিখিয়েছে তোর মা?এই তোর ব্যবহার?’
‘ বস্তির মেয়ে তো তাই। ‘

সাদামাটা জবাব চৈত্রিকার। মৌসুমি বেগম ক্ষিপ্র নেত্রে তাকাতেই চৈত্রিকা পুনরায় বলে উঠল নম্রস্বরে,

‘ আপনার কিছু লাগবে ফুপু?আমায় বলুন। চা খাবেন?আমি বানিয়ে দিই?’
‘ গতকাল বউ হয়ে এসে আজ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিস?এখন কি তোর জন্য আমি আমার ভাইপোর বাড়িতে চলতেও পারব না?’
‘ অবশ্যই পারবেন। আমি তো আপনার হেল্প করতে চাইছিলাম। ‘
‘ তোর হেল্প নিব আমি?মৌসুমি হাওলাদারের এতো সময় খারাপ সময় আসে নি এখনও যে একটা বস্তির মেয়ের হাতের কিছু খেতে হবে আমার। আমার চোখের সামনে থেকে সরে দাড়া। ‘

একটা মানুষ ঠিক কতক্ষণ এসব কথা সহ্য করতে পারে চৈত্রিকার জানা নেই। চক্ষে টলমল করা জল অবাধে গড়িয়ে পড়ার তোরজোর চালাচ্ছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চৈত্রিকা সরে দাঁড়াতে যাবে ঠিক তখনই ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় ওকে মৌসুমি। সঙ্গে সঙ্গে ডান হাত টা চেপে ধরে চিল্লিয়ে উঠলো চৈত্রিকা। পানির গ্লাস কিঞ্চিৎ উঁচু হতে মেঝেতে আছড়ে পড়ে ঝংকার শব্দের সৃষ্ট করে। চৈত্রিকার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। জ্বলে যাচ্ছে ওর হাত টা। ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে লাগল ও। সকল কান্ড দেখে মিনা হতভম্ব। দৌড়ে এসে চৈত্রিকার পাশে মেঝেতে বসল ও।

‘ হায় আল্লাহ! এটা কি করলেন ম্যাডাম? ‘

মৌসুমি মিনার ভয়ার্ত স্বর কর্ণপাত করলেন না। বরং তাচ্ছিল্য হাসলেন। গটগট করে উপরে চলে গেলেন তিনি। মিনা দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

‘ অসভ্য মহিলা। ভাবী আপনার হাত বেশি জ্বলতাছে?আমি স্যার রে ডাইকা লইয়াই। ‘

চৈত্রিকা অন্য হাতে মিনার হাত ধরে আটকালো। টলমলে নয়ন জোড়া নিক্ষেপ করে মাথা নেড়ে না করলো। মিনা তড়তড় করে বলে উঠল,

‘ আমি বলমুই ভাবী। এই মহিলার একটা উচিত শিক্ষা দরকার। আপনের এতো সুন্দর হাত টা পুইড়া ফেললো। ‘

মিনার চক্ষু কোল ভিজে উঠেছে। কন্ঠে কাতরতা। চৈত্রিকা ব্যস্ত পায়ে রান্না ঘরে ছুটে এলো। পানির কল ছেড়ে দিয়ে হাত টা দিতেই ছ্যাৎ করে উঠল মন,হাত,অন্তর। বড্ড জ্বলছে। একটা মানুষ এতো নির্দয় কেমন করে হতে পারে?মৌসুমি যে ইচ্ছেকৃত এটা করেছে বুঝতে বাকি নেই চৈত্রিকার। সাফারাত তাহলে গতরাতে সঠিক কথা বলেছিল। এই বাড়িতে বসবাসরত মানুষগুলো বিষাক্ত। চৈত্রিকার চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় নোনতা গরম জল ঝরছে। দু’ চোখের পাতা এক করে বিড়বিড় করে বলে উঠল,

‘ আমার জীবনে সুখের বসবাস চিরকালের জন্য নয়। জীবনে সুখ ছিনিয়ে আনার লড়াই টা খুব কঠিন। কষ্টদায়ক। ‘

#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৩৫

চৈত্রিকা চুপিসারে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। মাথা থেকে শাড়ির আঁচল ফেলে অগ্রসর হলো সে বারান্দার দিকে। এই মুহুর্তে সাফারাতের সামনে থাকা যাবে না। হাত টার অবস্থা বেশ খারাপ। জ্বলন হচ্ছে তীব্র হতে তীব্রতর। ফর্সা মুখবিবর, চোখ, নাক কান্নার দরুন ফুলেফেঁপে,লাল হয়ে একাকার। চুল থেকে এখনও ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরছে। শাড়ির লম্বা আঁচল কিঞ্চিৎ মেঝে স্পর্শ করে চলেছে হাঁটার তালে তালে। জীবনের কঠিন পরিস্থিতি বুঝে উঠার পর অনেক ভেঙেছে চৈত্রিকা ভিতরে ভিতরে। আত্মচিৎকার করে বেড়িয়েছে অন্তর,মন। যার হিসেব সে কোনো কালে রাখে নি। সইতে সইতে কঠোর হয়েছে। সহ্যশক্তি অপার ওর। কিন্তু নিজের অভ্যন্তরে দমিয়ে রাখা নরম মনটা কাঁদে নিরবে,নিঃশব্দে।

বেলকনিতে দাঁড়াতেই সকালের স্নিগ্ধ বাতাস পুরো কায়া ছুঁয়ে দিচ্ছে অনবরত, বিরতিহীন। বাতাস যেন চৈত্রিকার মনের দুঃখ নিজের দখলে কেঁড়ে নেবার আপ্রাণ প্রয়াসে নিমগ্ন। চৈত্রিকা চায় নিজের জীবনের সকল কষ্ট উজার করে দিতে। ভারী নিঃশ্বাস বহন করে বেঁচে থাকা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে দিনকে দিন।

‘ কি ভাবছেন আপনি?’

আচানক পাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠধ্বনি কর্ণপাত হতেই চৈত্রিকার দেহের সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরে যায়। স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ হয় নি। তবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া অত্যন্ত অস্বাভাবিক। পুড়ে যাওয়া হাত টা ঝটপট শাড়ির নিচে লুকিয়ে ফেলল কায়দা করে। নয়ত সাফারাতের দৃষ্টি পড়ে যাবে এতে। তারপর কি হবে বা কি ঘটবে তার জানা নেই। কিন্তু তার জন্য সম্পর্কে ফাটল ধরবে নিশ্চয়ই?সম্পর্কে দূরত্ব কতটা কষ্ট বয়ে আনে জীবনে তা চৈত্রিকা ভালো করে জানে। তাই চায় না সাফারাতের সাথে তার ফুপুর সম্পর্ক নষ্ট হোক। নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিল,

‘ কই কিছু না। আপনি ঘুমোন নি?’
‘ শাড়ির নিচে হাত লুকালেন কেন?আপনার চোখ মুখ এভাবে ফোলার কারণ?আপনি কান্না করেছেন?’

সাফারাতের রোষপূর্ণ কন্ঠে চৈত্রিকার বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল। নত মস্তকে হাতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পায় হাত মুঠো করে রেখেছে সাফারাত। চোখ জোড়া লাল,রক্তিম। হঠাৎ এমন কেন করছে?এত রাগ কেন দেখাচ্ছে?

‘ হাত কেন লুকাতে যাবো?কি হয়েছে আপনার?’

হাত টা টেনে শাড়ির নিচ থেকে বের করে আনল সাফারাত। পুড়ে যাওয়া স্থানে একটুখানি লাগতেই চৈত্রিকা নিজেকে ধাতস্থ রাখতে পারল না। জ্বলনে মৃদু চিল্লিয়ে উঠলো ও চোখ মুখ কুঁচকে। হাত টা সামনে এনে হতভম্ব হয়ে যায় সাফারাত। ফর্সা চামড়ায় লালের আস্তরণ। পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। সাফারাত দ্রুত কোলে তুলে নিল ওকে। হুট করে এমন করায় বিমূঢ়তায় বাকহারা চৈত্রিকা। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই সাফারাত বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে ওকে কোলে করে নিচে নিয়ে এলো। ড্রইং রুমে উপস্থিত মৌসুমি,মিনা,সুফিয়া সবাইকে এড়িয়ে বাড়ির বাহিরে এনে গাড়িতে বসিয়ে দিল চৈত্রিকাকে। প্রিয়ন্তী পিছন পিছন দৌড়ে এলো। জোর গলায় ডেকে উঠল,

‘ কি হয়েছে ভাইয়া?ভাবী কে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?’
‘ হসপিটালে। ‘
সাফারাতের নির্লিপ্ত জবাব শুনে চক্ষু বৃহদাকার ধারণ করলো চৈত্রিকা ও প্রিয়ন্তী উভয়েরই। প্রিয়ন্তী হ্যাবলাকান্তের ন্যায় চৈত্রিকার দিকে এক পলক তাকিয়ে সাফারাতের দিকে চেয়ে মৌনতা ভাঙল। অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,

‘ কেন? ‘
‘ তোর ভাবী আমার হৃদপিণ্ড জ্বালিয়ে দিয়েছে তাই। ‘

সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে গাড়িতে বসে পড়ল সাফারাত। ড্রাইভিং করতে করতে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ রেডি থাকুন জবাবদিহিতা করতে। ‘
‘ কিসের জন্য? আর এই একটুখানি পুড়ার জন্য আমার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাড়িতে চলুন। সবাই কি ভাবছে?এভাবে সবার সামনে দিয়ে কোলে করে নিয়ে আসলেন?ছিঃ!’

সাফারাত এক হাতে নিজের ভেজা চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘ ছিঃ! এর কি আছে চৈত্র? কোলে নিয়েছি। সবার সামনে কিস তো করি নি। এটা আমি বদ্ধ রুমেই করবো। অস্থির হলে নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারব না। তাই বদ্ধ রুমই সেফ। ‘

সাফারাতের কথা শুনে কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে চৈত্রিকার। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ছোটাছুটি করছে বেহায়া অনুভূতিরা। মনে থাকলে ও আর কখনও এমন কিছু বলতে যাবে না সাফারাতকে। লাল বর্ণে ছেয়ে থাকা মুখ আরো রক্তিম হয়ে উঠেছে। নিয়ন্ত্রণহীন বক্ষস্পন্দন। না জানি ঠিক কখন স্বাভাবিক হয়!

গাড়ি থামে হসপিটালের সামনে। সাফারাত গাড়ির দরজা মেলে দিতেই চৈত্রিকা দ্রুত পায়ে নেমে পড়ে। বলা তো যায় না যদি আবারো কোলে নিয়ে বসে?সাফারাতের পিছু পিছু হসপিটালে ঢুকে পড়লো। সকাল হলেও হাসপাতালের করিডোর জুড়ে মানুষের গিজগিজ। রিসিপশনে কথা বলে একজন মহিলা ডাক্তার এর সিরিয়াল কাটে সাফারাত। কিন্তু ওনাকে দেখাতে দেখাতে লেট হয়ে যাবে। মেয়েটা বলেছিল একজন পুরুষ ডাক্তার এখন ফ্রি আছে গেলেই দেখাতে পারবে তৎক্ষনাৎ তবুও সাফারাত নারাজ। কোনো পুরুষ ডাক্তার দেখাবে না ও। যেই মহিলা ডাক্তার এভেইলেবল আছেন এই মুহুর্তে ওনার কাছেই যেন এখন দেখানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। মেয়েটা বাধ্য হয়ে শেষমেশ ওদের সিরিয়াল ইমারজেন্সি বলে সামনে দেয়। একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে চৈত্রিকা কেবল দেখেই গেল। সবসময়কার মতো করে আজও এক ভিন্ন সাফারাত দেখতে পাচ্ছে সে। অদ্ভুত তার ব্যবহার। অত্যাধিক পসেসিভ যেন। সামান্য একটু হাত জ্বলেছে এতেই তার কত অস্থিরতা,কত ব্যাকুলতা!

ডাক্তার চৈত্রিকার হাত টা পর্যবেক্ষণ করে বললেন,’ তেমন একটা খারাপ অবস্থা হয় নি। কিভাবে পুড়লেন? ‘
চৈত্রিকা মিনমিনে স্বরে জবাব দিল,’ গরম পানি পড়ে গিয়েছিল ভুলবশত। ‘
‘ আচ্ছা কেয়ারফুল থাকবেন। আর কয়েকদিন এই হাত টা ভেজাবেন না। আমি মেডিসিন দিয়ে দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে। ‘
‘ জ্বি। ধন্যবাদ। ‘

সাফারাত এতো সময় অব্দি পাশে বসে ছিল। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে গাড়িতে এসে বসল। চৈত্রিকাও বসল পাশের সিটে।
‘ গরম পানি করতে গিয়ে ভুলবশত আপনার হাতে পড়েছে এটা আমার বিশ্বাস হয় নি চৈত্র। সত্য আপনি বলবেন নাকি আমি আমার নিয়মে বের করবো?একসঙ্গে কাটানোর প্রথম সকালেই আপনি আমার সাথে মিথ্যে বলছেন?’

চৈত্রিকা ভড়কে গেলো। আমতাআমতা করে বললো- ‘ আপনি ভুল বুঝছেন। আমি সত্যি..’
এতটুকু বলে থেমে গেল চৈত্রিকা। সাফারাতের দৃষ্টি লুকিয়ে মিথ্যে বলার মতো সাহস করে উঠতে পারল না আর। মুখস্থের মতো করে আনতস্বরে জানালো-‘ আমি গরম পানি নিয়ে ড্রইং রুমে আসছিলাম ফুপুর ধাক্কায় গ্লাস থেকে সম্পূর্ণ পানি হাতে পড়েছে। আপনি ফুপু কে কিছু বলবেন না দয়া করে। ‘
সাফারাত মুখ ফিরিয়ে নিল। স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে সে। পুরো রাস্তায় ফিরে অব্দি তাকালো না চৈত্রিকার দিক। চোখে মুখে অন্ধকার ছেয়ে গেল চৈত্রিকার। বুঝতে পারে ও প্রথমে লুকিয়ে রাখার ফলস্বরূপ সাফারাত এর রাগের আভাস। বাড়ির দীর্ঘ বড় গেট অতিক্রম করে গাড়ি ভিতরে ঢুকল। ডিরেক্ট পার্কিং এর জায়গায় নিয়ে এলো গাড়িটা সাফারাত। নেমে গটগট করে ভিতরে ঢুকে পড়ল। চৈত্রিকা চেয়েও তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারে নি তাগড়া লম্বাচওড়া সাফারাতের সঙ্গে।
সাফারাত ড্রইং রুমে এসে মিনার উদ্দেশ্যে বললো- ‘ নাস্তা রেডি করো মিনা। আর অন্য একজন সার্ভেন্ট কে ফুপুর রুমে পাঠাও প্যাকিংয়ে হেল্প করতে। ‘
আশ্চর্যান্বিত হয় চৈত্রিকাসহ ড্রইং রুমে উপস্থিত সকলে। মৌসুমি সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কন্ঠে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলেন,
‘ কেন?’
‘ কারণ আপনি চলে যাচ্ছেন?’- কাঠ কাঠ গলায় প্রতুত্তর করে সাফারাত।
‘ চলে যাচ্ছি মানে?’
‘ আপনি আপনার বাড়িতে যাচ্ছেন। ‘
সুফিয়া বেগম কন্ঠে তেজ আনার চেষ্টা করে বলে উঠলেন- ‘ কি হচ্ছে এসব সাফারাত?কি চাইছো তুমি?’
‘ চাওয়া টা একদম স্বাভাবিক দাদি। নাস্তা করে যেন চলে যায় ফুপু।’
রাগে থরথর করে কেঁপে উঠলেন মৌসুমি। চৈত্রিকার দিকে তীক্ষ্ণ চাউনি নিক্ষেপ করলেন। বললেন,
‘ এখন কি তোমার বউয়ের জন্য এই বাড়িতে থাকা নিষেধ? এই মেয়ের জন্য আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করবে?’
সাফারাত দূরে জড়ো হয়ে অবস্থান করা চৈত্রিকার দিকে এক নজর চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে আনলো। রাগ সংবরণের চেষ্টায় দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

‘ আপনি যদি ইচ্ছে করে আমার বউকে আঘা’ত করতে পারেন। তাহলে আমিও আমার বউয়ের সেফটির জন্য আপনাদের মতো বিপদকে দূরে সরিয়ে রাখতে জানি। আর আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা বলছেন?কিসের সম্পর্ক?দাদি ও প্রিয়ন্তী বাদে কারো সাথে আমার সম্পর্ক নেই। একটা সময় এই সম্পর্কের টানে এসেছিলাম আপনাদের কাছে আম্মুর মৃত্য’র পর। জার্মানি থেকে ফিরে এই বাড়ুিতে ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হয় নি আমাকে। দারোয়ান দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কিছুই ভুলি নি আমি। ভাগ্য ভালো এখনও আপনাদের মতো কালসাপ কে আমি আমার সান্নিধ্যে আসতে দেয়। নাস্তা করেই বেড়িয়ে যাবেন। আপনাকে আর আপনার মেয়েকে এই বাড়ির ত্রিসীমানায় যেন না দেখি। কোনো অধিকার নেই আপনাদের এ বাড়িতে। ‘

সাফারাত চলে যেতে নিলে মৌসুমি তেঁতে উঠলেন। চৈত্রিকার সামনে নিজের অপমান সইতে না পেরে কর্কশ গলায় বলে উঠলেন,
‘ সব অস্বীকার করলেও যার রক্ত শরীরে বহন করছিস তাকে অস্বীকার করে দেখা। একবার মুখে বলে দেখা তুই জাফর ভাইয়ের ছেলে না। না-কি তোর মা আমার ভাইকে ঠকিয়েছে?’

চক্ষুদ্বয় জ্বলে উঠল সাফারাত এর। হাত মুঠো করে পাশে সৌন্দর্য বিলীন করা ফুলদানি টা সজোরে আঘা’ত করে ফ্লোরে ফেলে দিল। ধ্বক করে উঠল চৈত্রিকার বুক। অকস্মাৎ থরথর করে কাঁপতে লাগল পা দুটো। ফ্লোরের দিকে নজর যেতেই দেখে কাঁচের ফুলদানি টা ভেঙে খন্ড দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে আছে। চৈত্রিকা ভাবতেই পারে নি জল এতদূর গড়াবে। এহেন পরিস্থিতির জন্য নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে ওর। সব দোষের মূলে ও নিজেই। সাফারাত চোয়াল শক্ত করে বললো,
‘ আপনার ভাই চরিত্রহীন ব্যক্তি, আমার মা নই। গেট লস্ট। নয়ত আপনাদের অবস্থা খুব বাজে করবো আমি। নিঃশেষ করে দিব আপনাদের। আমার মায়ের টাকায় মুখে যেই খাবার তুলছেন তা আর জুটবে না। মাইন্ড ইট। ‘

এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে সাফারাত চলে গেল রুমে। চৈত্রিকা সেদিকে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। মৌসুমি তেড়ে এসে কটমট করে বলে উঠলেন- ‘ বাহ!তুই তো অনেক ভালো খেলোয়াড়। দেহ,সৌন্দর্য দিয়ে ভুলিয়ে ফেললি সাফারাতকে। তুই কিভাবে শান্তিতে থাকিস দেখে নিব আমি৷ এই মিনা আমার সাথে আয়। ব্যাগ গুলো গুছিয়ে দিবি। ‘

সুফিয়া বেগম থম মেরে বসে রইলেন। ছোট ছোট শ্বাস ফেলছেন তিনি। বৃদ্ধ বয়সে সম্পর্কের এতো দূরত্ব ওনার আর ভালো লাগছে না। প্রিয়ন্তীর মা সুফিয়া বেগম কে উদ্দেশ্য করে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বললো- ‘ জাত-পাত না দেখে বিয়ে করে এমন মেয়ে ঘরে তুললে সম্পর্ক তো ছিন্ন ভিন্ন হবেই মা। সবে তো শুরু। এই মেয়ের জন্য আপনার নাতি আমাদের না আবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। ‘

তাচ্ছিল্যের সহিত কথাগুলো শুনিয়ে তিনিও ড্রইং রুম ছাড়লেন। চৈত্রিকা মলিন মুখে সুফিয়ার বেগমের দিকে এগিয়ে যেতে নিলে তিনি হাত দেখিয়ে নিষেধ করলেন। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন- ‘ সাফারাতের কাছে যাও। ‘

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে পা ভেঙে আসছে চৈত্রিকার। কি থেকে কি হয়ে গেল এসব?ও তো এমন কিছুই চায় নি। বিয়ের পর সুন্দর একটা সংসার চেয়েছে সব মেয়েদের মতোই। শশুর -শাশুড়ী না থাকুক যারা আছে তাদের নিয়েই সুখের নেশায় ছুটতে চেয়েছে। কিন্তু সবকিছু যেন ভাবনার উল্টো। সবটা অন্যরকম। জীবনের নতুন মোড়ে নতুন করে যেন নব্য এক গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেল ও। সাফারাতের বাবা কেন দূরে থাকে?কেন এ বাড়ির সবার সাথে সাফারাতের সম্পর্ক খারাপ? এছাড়া কষ্ট দেখেছে চৈত্রিকা সাফারাতের রাগান্বিত দু চক্ষে। কি এমন হয়েছিল অতীতের মাঝের সেই সময়গুলো তে?

রুমের সামনে আসতেই চৈত্রিকা বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ হয়ে পড়ল। টালমাটাল এর ন্যায় পিছিয়ে গেল দু’ পা। একি হাল করেছে সাফারাত!

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here