#সুখের_নেশায়,৪৬,৪৭
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৪৬
বাহিরে আঁধার নেমে এসেছে। সেই অন্ধকার,অমানিশা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করার পূর্বেই টুপটুপ করে জ্বলে উঠল ময়ূখ। তাদের দীপ্ততা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল পুরো ঘরময়। সাফারাত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মেজাজ চরম তপ্ত হয়ে আছে তার। মাথা,ঘাড় ব্যাথায় টনটন করছে। বিকেল হতে এই কক্ষে আসে নি চৈত্রিকা। তাকে দেখার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত হয়ে সাফারাত বেজায় বিরক্ত, রাগান্বিত। সুঠাম, তাগড়া,বলিষ্ঠ পুরুষালি শরীর টায় এখনও আগের ন্যায় ফিরে আসে নি শক্তি। ডাক্তারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা শরীরে যেন জোর না দেয়। মস্তিষ্কের মতোন ক্ষত হাত-পাও। হাঁটতে বেশ বেগ পোহাতে হয়। দাঁড়ানো টা-ই কষ্টকর হয়ে যায়। পায়ের প্লাস্টার টা গতকাল খোলা হয়েছে। সাফারাতের এসব বিষয়ে তোয়াক্কা নেই। তার ফর্সা মুখটা রক্তিম রঙে রাঙানো। ভিতরে ভিতরে ক্রোধ। দরজা পর্যন্ত হেঁটে এসে গলা উঁচিয়ে প্যাসেজওয়ে ধরে টইটই করে চলন্ত মিনাকে ডাকল। স্থির হলো মিনা। উল্টো ঘুরে এক প্রকার দৌড়ে ছুটে এলো। অবাক স্বরে তড়িঘড়ি করে বললো,
‘ কিছু কইবেন স্যার? আপনে উঠছেন ক্যান?কিছু লাগলে আমারে কন। ‘
সাফারাত চোখ রাঙিয়ে তাকালো। রোষপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল,
‘ চৈত্র কোথায়?’
‘ ভাবী?ভাবীরে তো কতক্ষণ আগে ছাঁদে যাইতে দেখলাম। আইচ্ছা আমি এহনই ডাকতে যাইতাছি। ‘
‘ তোমার যেতে হবে না৷ আমি যাবো। নিচে যাও তুমি। ‘
‘ আচ্ছা স্যার। ‘
মিনা কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে চলে গেল নিচে। সাফারাত আস্তেধীরে হেঁটে ছাদের সিঁড়ি অভিমুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। অসুস্থ পা দুটো নিয়ে কিভাবে ভাঙ্গবে এতগুলো সিঁড়ি? ভেবেই গরম মেজাজ টা বেশ চটে গেল। সকল অসুস্থতা ঠেলে দিয়ে উঠে পড়ল সিঁড়ি বেয়ে। সময় লাগল,একটু আকটু কষ্ট হলো কিন্তু রাগ কমলো না। এত খামখেয়ালিপনা পছন্দ না তার। রাতের বেলা ছাদে তা-ও প্রেগন্যান্সি অবস্থায়। চৈত্রিকা কি বুঝতে পারলো না তাকে না দেখে কি হাল হবে তার প্রাণপুরুষের?ছাদের দরজা পার করে ঢুকতেই ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে গেল সাফারাতের। পুরো ছাদের মেঝেময় ছোট ছোট প্রদীপ বাতি জ্বলছে। সকল বাতি ডিঙিয়ে ছাদের অন্যপাশে যেতেই চক্ষে বিঁধল একটা মেয়ের শাড়ির আঁচল মেঝেতে পড়ে আছে। আঁচল টা লাল বর্ণের। টুকটুকে লাল একটা শাড়ি। শাড়ি টা চিনতে সময় লাগল না। এটা তার জীবনের প্রথম নারীর,তার মায়ের।
এক গাছি চুল আঁচলের পাশাপাশি মেঝে স্পর্শ করছে। ঝুঁকে প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত মেয়েটা। চিকন ঠোঁটের কার্নিশে বহমান স্মিত হাসি। সাফারাত থমকে গেল। থমকালো তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া। দৃষ্টি স্থির,অনঢ়।
মেয়েটা কানে গুঁজে রাখা একটা লাল রঙা জারবেরা। কারো উপস্থিতি আঁচ করতে পেরে চট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো সে। এক জোড়া মন্ত্রমুগ্ধ মিশ্রিত নেত্রের চাহনি দেখে ভড়কে গেল। দ্রুত গতিতে দাঁড়িয়ে ছুটে এসে উদ্বেল মাখা,উদভ্রান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘ একা একা এসেছেন?আপনার তো পায়ে ব্যাথা। আমিই নিয়ে আসতাম। একা আসতে গেলেন কেন?কষ্ট হয় নি?’
ওষ্ঠদ্বয়ে একটা আঙুল ঠেকতেই কন্ঠনালিতে আটকা পড়ল চৈত্রিকার সকল প্রশ্ন। তিরতির করে কেঁপে উঠল ওর দু ঠোঁট। সাফারাত অধর প্রসারিত করলো ক্ষীণ। ঠোঁটে আঙ্গুল টা দিয়ে আরেকটু চাপ দিল। তাতে যেন আরো প্রবলভাবে কাঁপল দু’ঠোঁট। সাফারাত টের পেল তা। চৈত্রিকার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল তৎক্ষনাৎ। গভীর চোখের চাউনিতে লজ্জায় আরক্তিম হয়ে যাচ্ছে সে। সাফারাত চারদিকে চোখ বুলিয়ে কানের কাছে মুখ এগিয়ে আনল। বাড়িয়ে দিল চৈত্রিকার বক্ষস্পন্দন। ফিচেল স্বরে বলে উঠল,
‘ বিকেল হতে ছাদে বাসরঘর সাজাচ্ছিলেন?একবারও ভাবলেন না আপনার স্বামীর মুড আছে কি-না বাসর করার। ‘
চৈত্রিকার বুকে উত্তাল পাতাল ঢেউ গর্জে উঠতে শুরু করলো নিমিষেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। ফাঁকা ঢোক গিলল সে। চক্ষুদ্বয় পিটপিট করে বললো,
‘ শুভ জন্মদিন। ছাব্বিশ পেরিয়ে সাতাশ হলো। একটু বড় হলেন,একটু বুড়ো হলেন। ‘
সাফারাত এক ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো,
‘ সারাদিন উইশ করলেন না। এখন করলেন। জন্মদিন যখন শেষ হওয়ার পথে। ‘
‘ শেষ হয় নি। রাত বারোটা অব্দি সময় থাকে। ‘
‘ আপনি এত বছরেও আমার জন্ম তারিখ টা ভুলেন নি। কিন্তু আপনার জন্মদিন টা যে কবে?’
আকাশে চন্দ্রিমা উপস্থিত হয়েছে নিজের অপার সৌন্দর্য নিয়ে। তাহার রুপে আলোকিত পুরো ছাদ। প্রদীপের আলোয় জ্বলজ্বল ছাদে চৈত্রিকার পুরো মুখশ্রী হলদে দেখাচ্ছে। ঢের অভিমান চেহারায়। সাফারাত ভুলে গেল ওর জন্ম তারিখ? এই ভালোবাসা? কয়েক বছরের দূরত্বে,বিচ্ছেদে ভুলে গেল?বয়স ছাব্বিশ হোক!মনটা প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে সেই কিশোরী জীবনের মতো হয়ে গেল।অভিমানহত হয়ে সাফারাতের কাছ থেকে সরে যেতে নিলে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সাফারাত। শাড়ি গলিয়ে উন্মুক্ত পেটে হাত রেখে নেশাক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ আপনি সুন্দর চৈত্র মাস। ভীষণ সুন্দর। আম্মু আজ আপনাকে তার শাড়িতে দেখলে বিস্মিত হত। বলত,এই মেয়েটা তো অপ্সরী। কে বলবে এই মেয়েটা শুধু আমার ত্রিশ দিনের ছোট?আপনি তো সদ্য ফোঁটা পদ্ম। ‘
সাফারাতের ঘোর লাগা কন্ঠস্বর মোলায়েম সারা গা,দেহপিঞ্জর কাঁপিয়ে তুলল। শ্বাস ভারী হয়ে এলো চৈত্রিকার। চুলগুলো একপাশে রেখে সাফারাত কানের পিঠে উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে দিল। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে নিল নিজের অভ্যন্তরে। প্রশ্ন করল,
‘ জারবেরা কোথায় পেলেন?’
চৈত্রিকা তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারল না। রয়ে সয়ে বললো,
‘ আনিয়েছি বাজার থেকে। আপনি বিয়ের পর থেকে আমায় দিচ্ছেন না। ‘
সাফারাত সুপ্ত হেসে বলে উঠল,
‘ চালাক হয়ে গেলেন চৈত্র। অবশ্য আপনি চালাক। তবে বোকা শুধু আমার কাছেই। ‘
কথাটা বলেই সাফারাত পাঁজা কোলা করে চৈত্রিকাকে নিয়ে দোলনায় বসে পড়ল। ফর্সা ঘাড়ে থুতুনি ঠেকিয়ে বলে উঠল,
‘ জারবেরার মাধ্যমে ভালোবাসা টা মিস করছেন?’
চৈত্রিকা নিমিষেই উত্তর দিল,
‘ খুব। ‘
‘ এত প্রিয় হয়ে গেল ফুলগুলো? ‘
‘ উঁহু। শুধু মাত্র ভালোবাসার মাধ্যম টা। ‘
সাফারাত ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিতেই চৈত্রিকা তার পেটে চাপ প্রয়োগ করা হাত দুটো খামচে ধরে। শ্রবণ হয় গাঢ় স্বরের একটা অদ্ভুত,ভয়ংকর একটা প্রশ্ন।
‘ আপনার প্রথম ভালো লাগা কে চৈত্র? ‘
প্রথম ভালো লাগা?জীবনের প্রথম ভালো লাগা ক’জন মনে রাখে?বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভালো লাগা,পছন্দের পরিবর্তন ঘটে,বদল হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চৈত্রিকার এটা হলেও একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সেটা হয় নি। সাবলীল কন্ঠে প্রতুত্তর করে,
‘ আমার প্রথম ভালো লাগা, প্রথম ভালোবাসা আপনি সাফারাত। ভালোবাসি আমি আপনাকে। খুব ভালোবাসি। কিশোরী জীবনের সেই প্রথম দেখায় আপনাকে দেখে আমার হৃদস্পন্দন থমকে যায়। শুধু দেরি হয়ে যায় ভালোবাসা টা বুঝতে, অনুভব করতে। ‘
অকপটে স্বীকার করে চৈত্রিকা নিজেই হতভম্ব। আজ সে লজ্জা পেল না। সাফারাতের লহু স্বর শুনতে পায়। হৃদয় নিংড়ানো স্বর।
‘ কয়েক মাস আগে যখন জার্মানি থেকে ফিরে আপনার খুঁজে সিলেট গিয়ে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ঢাকাতে চলে আসি তারপর একদিন জ্যামে আটকা পড়ি। গাড়িতে বসে বাহিরে তাকিয়ে ছিলাম। তখনই চোখে পড়ে একটা সুতি থ্রি পিস পরিহিতা মেয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে ফুটপাত ধরে হেঁটে আসছে। চৈত্র মাসের গরমে অবস্থা নাজেহাল মেয়েটার। কপাল থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। ছোট্ট একটা ফুল বিক্রেতা শিশু এক বালতি জারবেরা নিয়ে মেয়েটার পথ আঁটকে দাঁড়ায়। মেয়েটা হাসিমুখে একটা জারবেরা হাতে তুলে নেয়। সাথে সাথে একটা ছবি তুলে রাখি আমি মেয়েটার। কারণ আট বছর আগের যেই কিশোরী চৈত্র কে খুঁজতে আমি সিলেট গিয়েছিলাম সে আমার চোখের সামনে,যাকে চিনতে আমার এক মুহুর্তও লাগল না। পার্থক্য সময়ের সাথে মেয়েটার চেহারার পরিবর্তন হয়েছে একটুখানি। আগের চেয়েও দ্বিগুণ মায়াবিনী,সুন্দর হয়ে উঠেছে। কিছু সেকেন্ড পর সুন্দর সেই চৈত্র নামের মেয়েটা ছোট শিশু টার বালতি তে ফুল টা রেখে গালে হাত বুলিয়ে চলে যায়। সেদিন হতে জারবেরা আমার পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিল। হয়ে উঠল আমার প্রেম নিবেদনের মাধ্যম। ‘
চৈত্রিকা চমকিত নয়নে তাকালো সাফারাতের মুখের দিক। সাফারাত তখন মাদকতাময় দৃষ্টি মেলে চিকন অধরের দিকে চেয়ে বললো,
‘ আপনি আমাকে জন্মদিনের গিফট দিবেন না চৈত্র? আমি কিন্তু অগ্রীম গিফট দিয়েছি আপনাকে। যেটা এই মুহুর্তে আপনার পেটে অবস্থান করছে। আর আট মাস পরেই এক ফালি সুখ নিয়ে হাজির হবে। বন্ধুত্বের কোনো সুবিধা পেলাম না। সব নিজেই জোর করে আদায় করতে হয়। অস্থির আমাকেই হতে হয়। ‘
চৈত্রিকা লজ্জা পেল। দখিনা শীতল হাওয়ায় নিভে গেল সবকটা বাতি,শুধু ছাদের মাঝে থাকা একটা প্রদীপ বাদে। তা-ও বাতিটার আগুন নিভু নিভু। চাঁদ মুখ লুকিয়েছে। জোৎস্না বিলীন করছে না আর। সাফারাতের চোখে হাত চেপে ধরল চৈত্রিকা। সাফারাত বাঁধা দিল না। কোমর জরিয়ে কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠল,
‘ রেডি ম্যাম। ‘
চৈত্রিকা নিজের ওষ্ঠযুগল এগিয়ে আনল সমুখের মানুষটার ঠোঁটের কাছাকাছি, অতি নিকটস্থে। বুক টা দুরুদুরু করছে। অস্বাভাবিক শরীরের কার্যকলাপ। শিরায় উপশিরায়,রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট দুটো তে নিজের ওষ্ঠাধর আলতো ছোঁয়াতেই সারা দেহ,কায়া বজ্রপাতের ন্যায় কেঁপে উঠল। চোখ বুঁজে মিশিয়ে দিল দু’ অধর। সাফারাত তা সাদরে আঁকড়ে ধরল। পরম সুখের নেশায় মত্ত, মাতাল হলো যেন দু’জনে,দু’টো হৃদপিণ্ড।
____________
চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা চৈত্রিকা বেলকনির রেলিংয়ে এক হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির বড়সড় রাজকীয় গেট দিয়ে প্রবেশ করছে লাশবাহী গাড়িটা। অদ্ভুত ব্যাপার হলো বাড়িতে একজন সদস্যের লাশ আসছে অথচ কান্নার রোল পড়ে নি। কারো ক্রন্দন চিৎকার আসছে না চৈত্রিকার কর্ণধারে। চৈত্রিকা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। বিদায়ের সব আয়োজন হয়ে গেছে। কাফনের কাপড়ও রেডি। মৌসুমির চোখ দুটো ফোলা। চৈত্রিকা কে দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদল সে। আবেগে নাকি ভুলে বস্তির মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরল?চৈত্রিকার হাসি পাচ্ছে। ভীষণ। মৃ’ত্যু মানুষ টার শা*স্তির অবসান ঘটিয়ে দিল। শা*স্তি টা আরেকটু দীর্ঘ হতে পারল না?
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪৭
বাতাবিলেবু গাছের ফাঁক দিয়ে কচি রাঙা রৌদ্র আসছে। বাগানের একপাশে শেষ আয়োজন চলছে সুফিয়া বেগমের। সকালে দ্বিতীয় বার হার্ট অ্যাটাক করলে উনাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ফিনাইলের উদ্ভট গন্ধে মাখা চার দেয়ালের মাঝে তিনি নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চিরতরে হারিয়ে যান ক্ষিতি হতে। মেদিনীর মোহ-মায়া তো তখনই ত্যাগ করেছেন যখন দিনের পর দিন,মাসের পর মাস পঁচে পঁচে মরণ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন বিছানায় কাতরে। সেই সময়টা তে বিশ্রী গন্ধে কেউ উনার রুমে পা রাখত না। এমনকি মিনা পর্যন্ত না। রাখত শুধু একটা মানুষ। চৈত্রিকা অবাক হতো সাফারাতকে দেখে কতই না নির্দ্বিধায় লোকটা সুফিয়া বেগমের ঘরে যেত। চৈত্রিকাও যেত তবে শেষ দিকে যাওয়া হতো না আর। গেলেই গরগর করে বমি করে দিত। সুফিয়া বেগমের লাশ আনার পর চৈত্রিকা একটা বার’ও সাফারাতকে দেখতে পায় নি। এমনকি বাড়িতেই আসে নি। হসপিটালে থাকতে ফোন করে শুধু এতটুকুই জানায়,সুফিয়া এহমাদ আর নেই। চৈত্রিকার উনার মৃ*ত্যুর কথা শুনে চমকে নি বরং সেই মুহুর্তে স্তব্ধতায়, বিমূঢ়তায় বাক হারা হয়ে পড়ে পুরুষালি গম্ভীর স্বরে সুফিয়া এহমাদ নামটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই। যাকে কখনও দাদি বাদে অন্য নামে ডাকতে শুনে নি,দাদির সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখে নি সেই মানুষটাই উনার নাম উচ্চারণ করেছিল। কিছু একটা ছিল সাফারাতের কন্ঠে। বিয়োগের ছাপ,কষ্ট ছিল না। একদম সাবলীল, স্বাভাবিক, ঠান্ডা ছিল কন্ঠটা।
চৈত্রিকা ফোন হাতে নিল। সাফারাত কোথায় জানতে হবে ওর। আজ বড্ড রহস্যময় লাগছে সাফারাতকে। চৈত্রিকার মনে হচ্ছে সে কিছু একটা মিস করছে। কিছু একটা তার আড়ালে রয়ে গেছে। সাফারাত! সাফারাতকে আরেকটু বুঝার বাকি রইল কি?দ্রুত ডায়াল করলো সাফারাতের নাম্বারে। অপর পাশের মানুষ টা সঙ্গে সঙ্গে কল টা রিসিভ করলো। গম্ভীর স্বরে বললো,
‘ চিন্তা করবেন না চৈত্র। চিন্তা করলে আমাদের সন্তানের ক্ষতি হবে। আমি আসছি। ‘
‘চৈত্রিকার কন্ঠে বিস্ময়,প্রবল উত্তেজনা–‘ কোথায় আপনি?’
সাফারাত আশে পাশে তাকালো। তৎপরে চাইল মা’য়ের কবরটার দিক। উত্তপ্ত, সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস উন্মুক্ত অন্তরিক্ষের তলে বিসর্জন দিয়ে বলে উঠল,
‘ আম্মুকে জানাতে এলাম বহু বছর পর তার অপরাধীর পতন ঘটেছে। আসছি। ‘
কল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। চৈত্রিকা বড়সড় ঝটকা খেল। ফোন হাতে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। তার সজাগ মস্তিষ্ক নানাবিধ কল্পনায় ব্যস্ত। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো,
‘ সাফারাত? সাফারাত জানে?নাকি আমার বুঝার ভুল?এ কেমন রহস্য?’
বাড়ির প্রবেশদ্বার হতে কারো গলার আওয়াজ কর্ণে আসছে। উচ্চ চিৎকার, চেচামেচির তীক্ষ্ণ শব্দ। মৌসুমি দৌড়ে গেলেন সেদিকে। ধীর পায়ে চৈত্রিকাও গেল। তব্দা খেল না সে। এটাই যেন স্বাভাবিক। মা’য়ের মৃ*ত্যুতে ছেলের আগমন স্বাভাবিক নয় কি?মাথার সমস্ত চুল সাদা মাঝে এক দু’টো কালো চুল পাহাড়ের ন্যায় উঁচু হয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সবাইকে। হয়ত বুঝাতে চাইছে নির্দয়হীন,নিকৃষ্ট মানুষ টা এখনও পুরোপুরি বুড়ো হয় নি। দারোয়ানের উপর তীব্র রাগ ঝাড়ছেন আধবয়স্ক লোকটা। কেন উনাকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। দারোয়ান বার বার একই বুলি আওড়াচ্ছেন–‘ স্যারের আদেশ অমান্য করতে পারবো না আমরা। আপনি ঢুকতে পারবেন না। ‘
বাক্য দু’টো যেন দারোয়ান চাচার মুখস্থ। কি সুন্দর করে আওড়াচ্ছেন, কোনো হকচকানো কিংবা আমতাআমতা ভাব নেই। খুবই তুখোড় প্রত্যেক টা শব্দমালা। মৌসুমি কে দেখে ফারুক এহমাদ হাঁক ছাড়লেন। এগিয়েও গেলেন মৌসুমি। জেদ দেখিয়ে বললেন,
‘ গেট খুলো। ঢুকতে দাও ভাইকে। ‘
দারোয়ান আনতস্বরে জানালেন সাফারাতের অর্ডার ছাড়া পারবেন না। চৈত্রিকা ধিমে গতিতে হেঁটে এসে আরেকটু গলা বাড়িয়ে দেখতেই চোখে পড়ল একটা দশ অথবা এগারো বছরের ছেলে বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে একটা সুন্দর চৈত্রিকার মা’র বয়সী মহিলার সাথে। মহিলার চুলগুলো ঈষৎ লালচে কালার। ফারুক এহমাদের সাথে এসেছেন তারা বুঝতে বাকি নেই চৈত্রিকার। ছোট্ট ছেলেটা মাম্মা বলে ডেকে উঠল মহিলা টাকে। নিমিষেই চৈত্রিকার বিস্ময় আকাশ ছুঁয়ে ফেললো। ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ফারুকের দিক। যেই লোক সাফারাতের মা’কে বয়স করে বাচ্চা নেওয়ার কারণে দিন-রাত অবজ্ঞা করেছে,মার*ধর করেছে সেই লোকের একটা দশ বছরের বাচ্চা আছে। আর সিয়ার মৃ*ত্যুর নয় বছরও হয় নি তাহলে এই বাচ্চা টা?মানে ফারুকের দ্বিতীয় বিয়ের পূর্বেই এই বাচ্চা টা হয়েছে। ছি!একটা মানুষ এত জঘ’ন্য হতে পারে? চৈত্রিকা যেন নিজের শাশুড়ির কষ্টটা অনুভব করতে পারছে। দিনকে দিন কতটা ধোঁকা পেয়েছিলেন সেই নারী। হয়ত জানতেন স্বামী পরকীয়ায় জড়িয়ে অবৈধ বাচ্চার বাপও হতে যাচ্ছেন যা তিনি কাউকে জানান নি। হয়ত লজ্জায়। কিংবা অতীব কষ্টে।
মৌসুমির কর্কশ কন্ঠে চৈত্রিকা সম্বিৎ ফিরে পায়। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন–‘এই মেয়ে তুমি বললে নিশ্চয়ই ঢুকতে দিবে। বাড়ি তো এখন তোমার। সব লুটে নিয়েছ ছেলেটাকে মায়া জাদু করে। এখন দারোয়ানকে বলো ভাই-ভাবী কে ঢুকতে দিতে। ‘
গিরগিটি! হ্যাঁ মৌসুমির জন্য এই শব্দ টা শব্দভান্ডার থেকে খুঁজে বের করলো চৈত্রিকা। ক্ষণে ক্ষণে বর্ণ পাল্টায় এই মহিলা। চৈত্রিকা মুখ লুকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসল। ফারুক এহমাদ, উনার ওয়াইফ এবং ম’রা বাড়িতে আসা কয়েকজন মানুষের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওর দিকে। মুহুর্তেই নিজের নরম,কোমল মন লুকিয়ে শক্ত রূপ ধারণ করলো চৈত্রিকা। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে কঠোর কন্ঠে বলে উঠল,
‘ যেই লোক নিজের প্রথম স্ত্রীর,নিজের অংশ, সন্তানের আগুনে পুড়ে যাওয়ার খবর শুনে ম’রার খবর শোনার অপেক্ষা করে,তার মতো নিকৃষ্ট মানবের অপবিত্র পদধূলি পড়তে দিব না আমি এই বাড়ির ভিটে তে। এটা আমার সিয়া মা’র গড়া রাজ্য। কলঙ্ক মুক্ত প্রত্যেকটা দেয়াল। ‘
চৈত্রিকার মুখের আদল বদলে গেছে। ফর্সা বদন রক্তিম হয়ে উঠেছে। মৌসুমি,ফারুক নিস্তব্ধ। সবার দু’ঠোঁট আলগা হয়েছে বেশ। তন্মধ্যে গেটের কাছে একটা গাড়ি আসতেই দারোয়ান দৌড়ে গেট খুলে দেয়। সোজা গ্যারেজে না গিয়ে গাড়িটা চৈত্রিকার কাছ ঘেঁষে থেমে যায়। দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সাফারাত। আঁড়চোখে এক নজর তাকায় গেটের দিক। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। কপালের শিরাগুলো দপ দপ করে উঠে। রাগ নিবারণের নিমিত্তে অভ্যাসবশত শক্তপোক্ত পেশিবহুল হাত খানা মুঠো হয়। মুষ্টিবদ্ধ হয় পাঁচ আঙ্গুল। ধূসর রঙা দু’চোখ তীব্র দাহে জ্বালা করে উঠল। ঘাড় বাঁকিয়ে কাঠ কাঠ গলায় দারোয়ানের উদ্দেশ্যে বললো সাফারাত,
‘ গেট লাগান। ‘
দারোয়ান গেট লাগিয়ে দিল ফারুকের মুখের উপর। ফারুক ডাকলেন সাফারাতের নাম ধরে কিন্তু তা সাফারাতের শ্রবণগ্রন্থিতে পৌঁছালো কি-না সন্দেহাতীত। কেননা চৈত্রিকার হাত আঁকড়ে ধরে বড় বড় পা ফেলে অতিক্রম করে ফেলেছে অনেকখানি রাস্তা। চৈত্রিকা নিরবে,নিশ্চুপে বাধ্য মেয়ের মতোন স্বামীর পাশে হেঁটে চলেছে। কানাঘুঁষা, ফিসফিস শুরু হয়ে যায় চারদিকে। লোকমুখে ঢেড় নিন্দার বাহার চলছে। চৈত্রিকা মেয়েটাই হয়ত স্বামীকে উস্কে দিয়েছে, নয়ত আপন বাপকে কেন বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না৷ এত খারাপ ছেলে যে কি-না বাপকে মা’য়ের লাশ দেখতে দিচ্ছে না আরো কতো কি!
চৈত্রিকা শুনলো, বিনিময়ে হাসলো। সমাজের মানুষ সত্যের গভীরতা জানে?জানে সাফারাতের উপর হওয়া অত্যা’চার- জুলু*মের কথা?একজন গর্ভবতী নারীর নৃ*শংস ভাবে আগুনে পুড়ে মর’বার ঘটনা মনে সজীব রেখেছে?নাকি এটা জানে সেই নারীর মৃৃ*ত্যু কোনো দুর্ঘটনা ছিল না বরঞ্চ কারো উদ্দেশ্য হাসিলের শিকার হয়ে খু*ন হয়েছে?
____________
সুফিয়া বেগমের দাফন কার্য সম্পন্ন হয়েছে বিকেলের দিকে আসরের নামাযের পর পরই। সাফারাত সর্বশেষে এক মুঠো ভিজে মাটি কবরের উপর দিয়ে সরে এলো। বেরিয়ে এলো কবরস্থান ছেড়ে। তার পা জোড়া আর থামল না,একটা বারও পিছু ঘুরে তাকালো না মাটিতে সমাহিত সুফিয়া বেগমের কবরটার দিকে। সদ্য দেওয়া মাটি ভিজে গিয়েছে তুমুল বর্ষনে। সাফারাতের সাদা পাঞ্জাবি বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে সুঠাম দেহে লেগে আছে। দিহান গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ভিজছে। জুবুথুবু অবস্থা তার। হিমেল হাওয়া বইছে। গা কাটা কাটা দিয়ে উঠছে। সাফারাতকে একান্ত সময় কাটাতে দিয়ে অপেক্ষা করছিল সে। সাফারাত এসে তার পাশে দাঁড়াতেই বলে উঠল,
‘ এখন চৈত্রিকাকে সবটা জানাবি তো?’
‘ জানানোর সময় হয়ে গিয়েছে। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে সবটা জানার অধিকার আছে উনার। ‘
দিহান থতমত খেয়ে গেল। চোখ দুটো বৃহৎ আকৃতির করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপনি?তুই চৈত্রকে এখনও আপনি বলে সম্বোধন করিস তাও নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডকে?’
সাফারাত মুখ উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকতে পারল কেবল। কারণ বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা তেছড়াভাবে চোখের কোলে এসে পড়তে আরম্ভ করে। সাফারাত আবারও অম্বর পানে মুখ উঁচিয়ে ধরে। তবে এবার নেত্রদ্বয় বুঝে রাখে। অধর কার্নিশ ক্ষীণ বাঁকিয়ে বলে,
‘ আপনি সম্বোধন টা বেশ প্রিয়। এই সম্বোধনে সুখ পাই। আপনি বলে সম্বোধন করা সেই নারীতে রয়েছে সুখ। আমার চৈত্র মাসের মাঝে অসীম সুখ খুঁজে পাই আমি। ‘
দিহান হাসলো। বললো,
‘ তোর সুখের সমাপ্তি না হোক। ‘
______________
চৈত্রিকা থম মেরে বসে আছে সোফায়। ফাহমিদা মেয়েকে বার বার বুঝাচ্ছেন। হুট করে কি হলো চৈত্রিকার তিনি বুঝতে পারছেন না। মৌসুমি, চাচী নিজ নিজ রুমে। মিমের শাশুড়ির শরীরটা খারাপ বলে সে চলে গিয়েছে সুফিয়া বেগমের লাশ নিয়ে যাওয়ার পর পর। ফারুককে এই বাড়িতে প্রবেশ করতে না দিলেও জানাযার সময় ছেলে হিসেবে উনাকে চুপি চুপি দেখানো হয় শেষ বার মা’য়ের মুখটা। সব-ই চলছে সময়ের নিয়মে। কিন্তু চৈত্রিকার হঠাৎ এহেন মৌনতা ফাহমিদার ভয় করছে। এক দৃষ্টে চেয়ে আছে মেয়েটা মেঝের দিক। ফাহমিদা সাফারাতকে ফোন করে জানায়। সদর দরজা পাড় করে ছুটে আসে সাফারাত। চৈত্রিকার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ভিজা শরীরে। অধৈর্য স্বরে বলে উঠল,
‘ কি হয়েছে চৈত্র? চুপ করে আছেন কেন আপনি?’
চৈত্রিকা দৃষ্টি তুলে সাফারাতের দিকে নিক্ষেপ করলো। জাগতিক সকল বাস্তবতা, দিক বিদিক ভুলে হামলে পড়ল সাফারাতের বুকে। অকস্মাৎ কান্ডে সাফারাত পড়ে যেতে নিয়ে এক হাত মেঝেতে সাপোর্ট হিসেবে রাখে। সামলে নেয় নিজেকে। অন্য হাতে শক্ত করে চৈত্রিকার পিঠ আঁকড়ে ধরে আবদ্ধ করে নিজের মাঝে মোলায়েম দেহ খানি। ফাহমিদা চলে গেলেন। মেয়ের যে এখন প্রয়োজন তার প্রিয় মানুষ টার। চৈত্রিকার ফুঁপানোর শব্দ শোনা গেল না। নতুন করে সাফারাতের পাঞ্জাবি অশ্রুজলে ভিজল না। স্রেফ চুপটি মেরে বুকে পড়ে রইল মেয়েটা। সাফারাত গাঢ় স্বরে ডাকল,
‘ চৈত্র! ‘
এক ডাকেই মাথা তুলে আঁখিদুটি নিবদ্ধ করলো সাফারাতের মুখের দিকে চৈত্রিকা। স্থির দৃষ্টি। হাতের ইনজেকশন সিরিঞ্জ টা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ আপনি জানতেন দাদি মা’র খু/নি?’
সাফারাত চমকালো না। দুর্বোধ্য হাসল। নিরলস ভঙ্গিতে জবাব দিল,
‘ জানতাম। শুধু সুফিয়া বেগম নয় আরো একজন আছে মা’য়ের খু*নী যার নামটা আপনার কল্পনার বাহিরে। ‘
চৈত্রিকার হৃদস্পন্দন থমকে গেল ক্ষীণ সময়ের জন্য। তার জানার খাতায় শুধু অপরাধী দাদি তাহলে আরেকজন? কে সে?একটা মানুষকে মা*রার পিছনে এতজনের হাত?
#চলবে,,,!