#সুখের_নেশায়,৫২,৫৩
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৫২
শক্তপোক্ত হাতের তিন তিনটে থা’প্প’ড় লাল টসটসে কপোলে মাখিয়ে ফাইয়াদের বক্ষে পড়ে আছে জাইফা। অতর্কিতে এমন এক কান্ডে মুখে হাত চৈত্রিকার। অন্যদিকে বুকে একটা মেয়ে পড়ে আছে এতে ফাইয়াদ হতভম্ব,বাকরুদ্ধ। দু’ হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণের ন্যায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে সে। কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা। সাফারাত, চৈত্রিকা দু’জনে বাহিরে আসছিল না অনেকক্ষণ সময় অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পরও। তাই ফাইয়াদ ডাকতে আসে,ঠিক সেই মুহুর্তে তুলোর মতো উড়ে এসে ওর বুকে হামলে পড়ে লাল চুলের,সাদা চামড়ার এক মেয়ে।
চৈত্রিকা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাফারাতের কপালের শিরা উপশিরা ভেসে উঠেছে। ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ। মেয়েটা তখন ওকে ঠেলে সাফারাতের সমুখে আসতেই ‘ জাইফা ‘ নামে চাপা গর্জন করে উঠে সাফারাত। সঙ্গে সঙ্গে চৈত্রিকার সমস্ত দেহ কেঁপে উঠে,ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মেয়েটার দিকে চাইতেই পলকেই সপাটে চড় বসিয়ে দেয় সাফারাত। চৈত্রিকা জাইফা কে ধরতে যাবে তার পূর্বেই মেয়েটা ফাইয়াদের বুকে ঠাঁই পায়। ফাইয়াদের চলাচল আয়ান ও সাফারাতের সঙ্গে হওয়ার সুবাদে ছোট খাটো গেট টুগেদারে তাকেও শামিল করা হয়।
ফাইয়াদ গিয়ে কি হাওয়া হয়ে গেল?সিনথিয়া উঠতে নিলে প্রিয়ন্তী চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ আমি যাচ্ছি ভাবী। আপনি এখানে থাকুন। ‘
এটা বলে প্রিয়ন্তী দরজার কাছে আসতেই ওর চক্ষু চড়কগাছ। অন্তস্থল কেমন যেন নড়ে উঠল। মনে এক সেকেন্ডের ঝড় বয়ে গেল। দীর্ঘ হলো না। তবে ঝড়ের বেশ বেগ ছিল,হৃদপিণ্ড কেমন নাড়িয়ে দিয়ে গেল। ফাইয়াদের বুকে জাইফা!কিন্তু কেন?ফাইয়াদ জাইফাকে কেন বুকে নিল?নানা প্রশ্নে অভ্যন্তর হাস ফাঁস করতে আরম্ভ হয় প্রিয়ন্তীর। আকস্মিক লোহার মতোন ভারী হয়ে যাওয়া পা দু’টো টেনে টেনে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। দেখল,জাইফা অতীব স্বাচ্ছন্দ্যে নাক টেনে টেনে বন্যা বইয়ে দিচ্ছে ফাইয়াদের বুকে। অপরদিকে ফাইয়াদ নির্বিকার। মাথা উচিয়ে দেখতে চাইল প্রিয়ন্তী ফাইয়াদের মুখে বিরক্তি আছে কি-না। না নেই, আছে কেবল অবিশ্বাস্য ভাব। প্রিয়ন্তী ঝটপট নজর সরিয়ে আনল। জাইফার এতো নিশ্চিন্তে অশ্রুপাত, ফাইয়াদের কোনো প্রকার অভিব্যক্তি না করায় প্রিয়ন্তীর মন বলছে এরা পূর্ব পরিচিত ও দু’জন হয়ত প্রেমিক -প্রেমিকা। কিন্তু সাফারাত ও চৈত্রিকার সামনে এভাবে আলিঙ্গন? প্রিয়ন্তী লজ্জা অনুভব করল। হতে পারে এদের দেশে এসব চলে,কিন্তু ওরা তো ভিন্ন দেশের। একটুও চোখ সরমভরম নেই! যে দেশে প্রকাশ্যে ওষ্ঠাধরের মিলন হয়,তাতে আলিঙ্গন তো খুবই তুচ্ছ এক বিষয়। প্রিয়ন্তীর মনে ফাইয়াদের জন্য যে ভালো লাগার জায়গা টা তৈরি হয়েছিল তা নিমেষে খন্ড দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। গলা ধরে আসছে,কন্ঠনালিতে শব্দমালা আঁটকে যাচ্ছে, তবুও ঢোক গিলে সাফারাতকে ডাকল,
‘ ভাই?বাহিরে সবাই ডাকছে। ‘
মেয়েটার কথার সুর ঝংকার তুলে ফাইয়াদের কর্ণকুহর হলো। কোকিলের মতো বেজে উঠল যেন। মুহুর্তেই জাইফাকে বুক থেকে এক প্রকার ছিটকে ফেলে দিল। জাইফা এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পায়। থা’প্প’র খেয়ে সমস্ত দেহ অসাড়তা লাভ করেছিল। থরথর করে কাঁপছিল মেয়েটা। সাফারাত বিরক্তিসূচক কন্ঠে বলে উঠল,
‘ তোরা যা,আমি চৈত্রকে নিয়ে আসছি। আর সাথে এই উন্মাদ মেয়েটাকে নিয়ে যাবি। আমার চোখের সামনে যেন না পড়ে। বিবাহিত পুরুষের গায়ে লেপ্টে পড়ে। আমি এক বাচ্চার বাপ হতে যাচ্ছি এবার পিছু ছাড় বোন। ‘
শেষের কথাগুলো শুনে চক্ষুদ্বয় পিটপিট করে তাকালো জাইফা। এক তো থা’প্প”ড়ে ভীষণ আহত সে, তার উপর সাফারাতের রাগমিশ্রিত বাংলা শব্দাংশ,বাক্য। সে বাংলা পারে কিন্তু ঠিকঠাক নয়। সাফারাত এক বাচ্চার বাপ হতে যাচ্ছে শুনেই হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল জাইফা। সেদিকে চেয়ে চৈত্রিকা সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছাড়ল। সাফারাত এভাবে জাইফাকে আ*ঘাত করবে ঘূনাক্ষরেও কল্পনা করে নি ও। এত ক্রোধ,জেদ এই লোকটার! আর মেয়েটাও বাচ্চামো স্বভাবের। জাইফা নামটা সাফারাতের মুখে শুনেই চৈত্রিকার চট করে মনে পড়ে যায় বাংলাদেশে থাকাকালীন আলো বলেছিলেন জাইফা নামের একটা মেয়ের সাথে উনি সাফারাতের বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছিলেন কিন্তু সাফারাত রাজি হয় নি। চৈত্রিকা মনে মনে বলল, ‘ এই মেয়েই তাহলে জাইফা যে সারাক্ষণ সাফারাতের কাছ ঘেষঁতে চাইত!’
ভাবী-ভাইকে একান্তে ছেড়ে প্রিয়ন্তী বেরিয়ে আসে। এখানে কি হয়েছে কিছুই ওর বোধগম্য হচ্ছে না। কিন্তু মনটা অতিশয় বেই’মানি শুরু করেছে ওর সঙ্গে। বারংবার চক্ষে ভাসছে ফাইয়াদের বুকে জাইফার অবস্থানের দৃশ্য খানা। জাইফা আয়ানদের পাশের বাসার। প্রতিবেশী। মিসেস তিয়ানার একমাত্র কন্যা। বাগানের দিক টায় যেতে নিলে বিচলিত একটা স্বর ডেকে উঠল ওকে–‘ প্রিয়ন। ‘
পা জোড়া থেমে গেল। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল ফাইয়াদকে। ফাইয়াদ তড়িৎ বেগে উপস্থিত হলো ওর সম্মুখে। জিজ্ঞেস করলো,
‘ ওই মেয়েটা কে টুমি চিনো?আমার বুকে পড়েছিল। ‘
প্রিয়ন্তীর ভ্রুঁ যুগল কপাল ছুঁয়ে দিল তৎক্ষনাৎ। রুক্ষ কন্ঠে,গলায় তেজ ঢেলে বলে উঠল,
‘ আপনার গার্লফ্রেন্ডকে আপনি চিনেন না?জার্মানির বাচ্চা ন্যাকামি তো ভালোই পারেন। মিথ্যুক একটা। আরেকবার প্রিয়ন ডাকলে শরীরের ছাল তুলে ফেলব। ছোট হতে পারি,বেক্কল না। ‘
কথাগুলো বলে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে প্রিয়ন্তী হনহনিয়ে ত্যাগ করল স্থান। ফাইয়াদ আহাম্মকের মতো চাইল। চক্ষু কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবার উপক্রম। প্রিয়ন্তী এত দ্রুত বাংলা বলেছে ছেলেটার মাথায় কিছুই ধরে নি। বিড়বিড় করতে থাকে,
‘ ইশ!প্রিয়ন কি বলে গেল?মোবাইলে রেকর্ড করে রাকলে তো পরে আসতে আসতে সুনে বুঝতে পারতাম। ‘
.
.
সাফারাত মাথার কয়েক গাছি চুল টেনে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। রাগ জিনিসটা নিজের উপর চওড়া হতে দেয় না সহজে। যথেষ্ট চেষ্টা করে সংবরণের। জাইফার কুরুচিপূর্ণ আচরণের ক্ষেত্রে পারল না। মেয়েটা আগে থেকেই উড়নচণ্ডী দশার। বছরে কয়েকবার বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানো তার স্বভাব। সাথে অভিনব, নতুন বিএফ তো আছেই। এ ধরনের মেয়ে একদমই পছন্দ না তার। দেখলেই মস্তিষ্কে রক্ত চাপে। খু*ন করার নেশা জাগ্রত হয়। চৈত্রিকাকে পা থেকে মাথা অব্দি দেখে নিয়ে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলো,
‘ ঠিক আছেন আপনি চৈত্র?’
‘ জ্বি। ‘
‘ চলুন তাহলে। ‘
কেউ চেয়ারে,কেউ ঘাসের উপর আবার কেউ কেউ দোলনায় বসে আছে। বাগানের একপাশে পাতানো বেঞ্চে খালুর পাশাপাশি একটা অপরিচিত বয়স্ক লোক কে দেখতে পেল চৈত্রিকা। আলো বেগমের পাশাপাশিও একটা অপরিচিত মহিলা বসে খুশগল্প করছেন। আলো চৈত্রিকাকে সাফারাতের পাশে দেখতে পেয়ে এক গাল হাসি হাসলেন। বিদেশি মহিলা টার দিকে চেয়ে ইংরেজি ভাষায় বলে উঠলেন,
‘ লুক তিয়ানা শি ইজ চৈত্র। সাফারাতের ওয়াইফ। তোমাকে ওর কথা-ই বলেছিলাম। ‘
মিসেস তিয়ানা হাসোজ্জল মুখে তাকালেন। চোখ দুটো বেশ টানা টানা। পুরো চেহারা জুড়ে যেন আলোর ছটা। অতীব সুন্দর নারী। চৈত্রিকার অনেক পছন্দ হলো ওনার মনোমুগ্ধকর হাসি টুকু। অতঃপর শুনতে পেল ওনার সাবলীল কন্ঠস্বর,
‘ হাউ আর ইউ কিউট গার্ল?ইউ আর সো প্রিটি। ‘
চৈত্রিকা লজ্জা পেল অল্পসল্প। রূপে সে পিছিয়ে নয়। বেশ ফর্সা ও সুন্দর। বরং এতকাল মানসিক অশান্তি, পরিবারের টানাপোড়েন, বাবার দেওয়া কষ্ট সব মিলিয়ে ফুলের ন্যায় মূর্ছে গিয়েছিল। প্রেগন্যান্ট হবার পর রূপ,সৌন্দর্য দ্বিগুণ হলো। সাফারাতের মতো জীবনসঙ্গী পেলে বোধহয় কোনো মানসিক অশান্তি জীবনে ভর করতে পারে না। প্রতি মুহুর্ত,প্রতিক্ষণ সুখের হয়। তবে যেই মানুষ টা মুঠো ভরে আঁজলা তে সুখ ঢেলে দিচ্ছে সে কি সুখী?মানসিক কষ্ট তার হৃদয় রক্তাক্ত করছে না তো?চৈত্রিকা নম্রতার সহিত জবাব দিল,
‘ ফাইন মিসেস তিয়ানা। হাউ আর ইউ? ‘
‘ ফাইন,প্রিটি গার্ল।’
আলো বেগম সবাইকে কফি দিয়ে, আরেক কাপ কফি হাসিমুখে সাফারাতের দিকে বাড়িয়ে দিল। সাফারাত কফি কাপের দিকে এক পলক চেয়ে ওনাকে পাশ কাটিয়ে ফাইয়াদ ও আয়ানের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। তিয়ানা,সিনথিয়া,চৈত্রিকা বিস্মায়াবিষ্ট হয়ে পড়ে সাফারাতের আলো বেগমকে করা উপেক্ষা অবলোকন করে। চৈত্রিকা তীররেখা নজরে সাফারাতের দিকে তাকাল। সকল যোগ,বিয়োগের সমাধান তো হলো কিন্তু কোথাও আলোর দোষ খুঁজে পেল না ও। হুট করে একটা মানুষের এত ঘৃ’ণার কারণ কি? আলো বেগম কি সাফারাতের মা’য়ের মৃ/ত্যুর কারণ? দ্বিতীয় খু*নি?নয়ত সাফারাত কেন ঘৃ’ণার দৃষ্টিতে তাকায়!হুট করেই চৈত্রিকার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। ভুল ভাবছে সে। মা’য়ের মত স্নেহ,স্বার্থবিহীন উজার করে ভালোবাসা,সাফারাতকে শক্ত করে গড়ে তোলা সেই নারী বেই*মান কি করে হতে পারে!এ ভাবনা টাই যেন তুচ্ছ, নিরর্থক।
________________
বার্লিন শহরজুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত। প্রভাতে এত বর্ষণ ভীষণ মন সতেজ করা অনুভূতির জন্ম দেয়। পরিবেশ রোমাঞ্চকর করে তুলে। বিশাল কাঁচের প্রাচীর টা বেয়ে পানির ধারা নেমে যাচ্ছে নিম্নদিকে। বিছানায় শুইয়ে শুইয়ে এমন এক সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য ক’জনের হয়!চৈত্রিকা দেয়ালে টার দিকে মুখ করে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। চক্ষু মুদে আবারও দৃষ্টি মেলে দিল স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল টায়। বার্লিনের বৃষ্টির কি অপরুপ দৃশ্য!
ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে সৌন্দর্য দেখায় বাঁধা পড়ল চৈত্রিকার। অনুভূতিরা ভয়ংকর, মারা/ত্মক,বেসামাল হয়ে উঠল। সাফারাত হাতের তোয়ালে টা রেখে ওর অনাবৃত দেহে একটা শুভ্র রঙের পাতলা শার্ট জড়িয়ে নিল। অধিক সুন্দর হওয়ার দরুন শার্ট টা বেশ মানিয়েছে তাকে। চৈত্রিকা নিষ্পলক, নির্নিমেষ চেয়ে রইল অনেকক্ষণ,বেশ দীর্ঘ সময়। আমতা আমতা করে প্রশ্ন করে,
‘ এত সকাল সকাল শাওয়ার নিলেন যে?কোথাও যাচ্ছেন?’
‘ সকাল সকাল শাওয়ার নিয়েছি বলেই এই প্রশ্ন নাকি সন্দেহ? মধুর রাত পাড় করা ছাড়াও প্রভাতে শাওয়ার নেওয়া যায় চৈত্র মাস। রিলেক্স থাকেন। ‘ সুখ ‘ আসুক তারপর নাহয় আপনি ও আমি দু’জন একসাথে শাওয়ার নিব,একদম সক্কালে। ‘
সাফারাতের দুষ্টমির স্বর শুনে চৈত্রিকার দু’গাল টুকটুকে লাল বর্ণ ধারণ করল। উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজতে নিলে কানে আসে সাফারাতের কঠিন কন্ঠের কড়া নিষেধাজ্ঞা,
‘ ভুলেও উপুড় হবেন না চৈত্র। সুখ ব্যাথা পাবে এবং আপনিও। ‘
উপুড় হলে তো পেটে চাপা পড়বে তা মাথায় ছিল না চৈত্রিকার। পা দু’টো সোজা করে শুইয়ে রইল। রুমের এক কোণায় বড় বড় টলি ব্যাগগুলো দেখে বলল,
‘ আমরা সত্যিই চলে যাবো?খালামণি কষ্ট পাবেন। আয়ান,সিনথিয়া কাউকেই বলা হলো না। না গেলে হয় না সাফারাত?’
চৈত্রিকার শেষের কথাটা করুন শোনাল। সাফারাত আয়নার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে একবার তাকালো। পরক্ষণেই শার্টের হাতা গুটিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে এল ওর দিকে। বিছানায় শুইয়ে চমকিত নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখছে চৈত্রিকা। ধীরস্থির ভঙ্গিতে সাফারাত ওর কাছাকাছি এলো। খুবই সন্নিকটে। ওর তৈলাক্ত মুখশ্রীর পানে ঝুঁকে চেয়ে থাকল অনিমেষ নেত্রে। চৈত্রিকা নির্বাক। চোখ বুঁজতেই সাফারাত উষ্ম ঠোঁট চেপে ধরল ওর ললাটে। মুহুর্তেই কোমল দেহখানির রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে গেল। বিছানায় দু ‘ হাত ভর দিয়ে সাফারাত ছুঁয়ে দিল চৈত্রিকার কম্পনরত অধর। সাথে সাথে সরে এলো না। বরঞ্চ মিনিট খানেক ব্যয় করে দীর্ঘ এক চুম্বনে লিপ্ত হয়। চৈত্রিকার শ্বাস ক্রমাগত ভারী হয়ে আসে। সাফারাত তুখোড় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে ওর শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার অবস্থা। বুকের উঠানামা, ঢেউ খেলানো। গালে এক হাত রেখে স্থির করলো ওকে। ডাকল,
‘ চৈত্র মাস!’
চৈত্রিকার মুহুর্তেই সাড়া–‘ হু!’
সাফারাত আদুরে গলায় বলে উঠল,
‘ আমি একটা সুন্দর, সুস্থ, সুখের জীবন চাই চৈত্র। সকল বেই’মান দের থেকে দূরে গিয়ে আপনাকে,সুখ কে নিয়ে,প্রিয়ন্তীকে নিয়ে সুখের সংসার চাই। প্লিজ আমাকে বাঁধা দিবেন না। কারো প্রতি এতটাও বিশ্বাস রাখবেন না যার আসল রূপ প্রকাশিত হলে আপনি মানসিক ভাবে ধ্বংস হয়ে যাবেন। ‘
সাফারাত সরে গেল। পুনর্বার তাড়া দিয়ে বলে,
‘ উঠুন। আমরা একটু পরেই বেরিয়ে যাব। আয়ানকে গত রাতে বলেছি আমি আলাদা থাকব। ও একটু কষ্ট পেয়েছে কিন্তু আমাকে বুঝে খুব। ‘
________
প্রিয়ন্তী, চৈত্রিকা রেডি হয়ে নিচে আসল। ক্যাথরিন ব্যাগগুলো বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে। সাফারাত খালুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। আয়ানও বেরিয়ে পড়ল ওর সাথে। সিনথিয়াকে জড়িয়ে ধরল চৈত্রিকা। আয়মানের কথা জিজ্ঞেস করতেই ও জানায় যদি আয়মান জানে ওরা অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে এখানে থাকবে না তাহলে তুলকালাম বাঁধিয়ে দিবে ছেলেটা। কখনই যেতে দিবে না। এটা শুনে চৈত্রিকার খারাপ লাগল। ছেলেটার সারাক্ষণ সুখ সুখ বলে মামী মণির যত্ন নেওয়াটা ভীষণ মিস করবে ও। সবাইকে ড্রইং রুমে দেখলেও আলো কে কোথাও দেখল না। সিনথিয়া ওর চোখের দৃষ্টি দেখে বললো,
‘ আম্মু তোদের বিদায় দিতে পারবেন না তাই রুমের দরজা লক করে বসে আছেন। সাফারাত এখানে আসার পর আম্মুর সাথে ঠিকঠাক কথা বলছেন না। এমনকি এ বাড়ি ছেড়ে ভিন্ন জায়গায় থাকার সিদ্ধান্ত নিল। তুই কি জানিস ওর এমন করার কারণ?’
মাথা নাড়িয়ে না বললো চৈত্রিকা। সিনথিয়া ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে চৈত্রিকাকে আলো বেগমের রুমের সামনে নিয়ে গেল। অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা মেললেন না তিনি। বাধ্য হয়ে ওনাকে বিদায় না জানিয়েই বেরিয়ে আসতে হলো। গাড়িতে উঠে যখন সাফারাতের পাশে বসল অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই দেখতে পেল আলো বেগম মুখে ওড়না চেপে ধরে কাঁদছেন খোলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। চৈত্রিকার বুক টা থরথর করে কাঁপল। ধীরে ধীরে চলন্ত গাড়ি থেকে জানালা দিয়ে আবারও তাকালো বারান্দার দিকে। সাফারাতের উদ্দেশ্যে তড়তড় করে ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠল,
‘ খালা মণি কাঁদছেন সাফারাত। গাড়ি থামান। একটা বার কথা বলে আসুন ওনার সাথে। ‘
চৈত্রিকার সেই স্বর আমলে নিল না সাফারাত। উল্টো চোয়াল শক্ত করে গাড়ির গতি বাড়িয়ে ছুটে চলল বার্লিন নগরীর অপর এক প্রান্তে।
# চলবে,,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৫৩
বৃষ্টিতে কাঁদায় মাখামাখি রাস্তা টা আজ বড্ড মিস করছে চৈত্রিকা। এ শহরের রাস্তাগুলো পাকা,বৃষ্টিতে কেবল ভিজে কিন্তু কাঁদা হয় না। পিচ ঢালা রাস্তা ধরে প্রায় অনেক কিলোমিটার অতিক্রম করল ওদের গাড়ি টা। পিছনে ফেলে এলো বার্লিনের কিঞ্চিৎ সৌন্দর্য,সেই নগরীর ফরসা মানুষগুলোকে। গাড়িটা থামিয়ে সাফারাত আগে নামল। ভিজে গেল সাদা শার্ট টা। চুল বেয়ে কপাল ছুঁয়ে পানি পড়ছে অনবরত। দৌড়ে গিয়ে পাশের একটা শপ থেকে দু’টো ছাতা হাতে নিয়ে ফিরল। চৈত্রিকা নেত্রদ্বয় পিটপিট করে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টে। একটা ছাতা গাড়ির উপর রেখে অন্য একটা মেলে ওর পাশের দরজা মেলল সাফারাত এক হাতে। শান্ত কন্ঠে বললো,
‘ নামুন চৈত্র। ‘
মোহাবিষ্ট হয়ে চৈত্রিকা নেমে দাঁড়াল। মৃদু যা অভিমান জমেছিল ক্ষীণ সময়ের জন্য তা সাফারাতের নরম,মায়াভরা কন্ঠে সম্পূর্ণ উবে গেল। কন্ঠ টা কেমন নেশা নেশা। অদ্ভুত এক নেশা!একজন মানুষের কন্ঠস্বর,আচরণ, চরিত্রের এত পরিবর্তন ঘটে!কখনও গম্ভীর, কঠোর,রষকসহীন। আবার কখনো নরম,যত্নশীল, মোহনীয়। এ যেন মুদ্রার এপিঠ -ওপিঠ।
চৈত্রিকাকে ছাতার নিচে নিয়ে কাছে টেনে নিল সাফারাত। এতটা কাছে নেই দু’জন , মাঝখানে দূরত্ব রয়েছে। শুধু হাত টা টেনে হাতের মুঠোয় বাঁধল,যেন চৈত্রিকার গা তার সিক্ত স্পর্শে ভিজে না যায়। হঠাৎ বৃষ্টির শিকার হয়ে ভিন্ন এক দেশে জ্বর বাঁধতে পারে অনায়সে। সেই রিস্ক নিতে নারাজ সাফারাত। আলতো করে ছুঁয়ে রাস্তা পার করে চৈত্রিকাকে অপর প্রান্তে নিয়ে এল। ওদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড় করিয়ে ছাতা টা চৈত্রিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পুনরায় মাথায় বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে ফিরে এলো গাড়ির কাছে। অন্য ছাতা টা মেলে প্রিয়ন্তীকে একইভাবে অপর পাশে নিয়ে গেল। চৈত্রিকার হাতে ফ্ল্যাটের চাবি টা ধরিয়ে দিয়ে লহু স্বরে বললো,
‘ আপনারা দু’জন উপরে চলে যান। গিয়ে অবশ্যই ড্রেস পরিবর্তন করে নিবেন৷ ভিজে গেছেন। ‘
চৈত্রিকা অবাক হলো। নিজের এবং প্রিয়ন্তীর দিকে তাকালো। বৃষ্টির ছিটা পানিতে নিচের অংশ ভিজেছে শুধু। এতেই কি চিন্তা সাফারাতের! অথচ নিজে কাকভেজা হয়ে আছে তাতে মাথা ব্যাথা নেই। চৈত্রিকা মিনমিনিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ আপনি যাবেন না?’
‘ না। কিছু জরুরি জিনিস কিনতে হবে রান্নার জন্য। হুট করে এলাম। বেশি কিছু নেই বাসায়। আপনারা গিয়ে ফ্রেশ হন। পাশেই গ্রোসারি সুপারশপ। আসা যাওয়ায় পঁয়ত্রিশ মিনিট ব্যয় হবে। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
চৈত্রিকা নিজের মাথার উপরের ছাতা টা সাফারাতের মাথার উপর ধরে টুপ করে প্রিয়ন্তীর ছাতার নিচে ঢুকে পড়ল। বেশ আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
‘ আর ভিজবেন না। অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ‘
‘ প্রিয়ু চোখ বন্ধ কর তো। ‘
সাফারাতের কথায় প্রিয়ন্তী চমকে উঠল। দুই নেত্র খিঁচে বন্ধ করে ফেলল বিনা প্রশ্নে। সাফারাত সঙ্গে সঙ্গে চৈত্রিকার এক হাত ধরে উল্টো পিঠে চুমু খেল। দীর্ঘমেয়াদি নয়,সাময়িক সেকেন্ডের ছিল সেই অধরযুগলের আর্দ্র ছোঁয়া। তারপর চলে গেল সাফারাত। এখনও দুরুদুরু কাঁপছে বুক। চৈত্রিকা সেই কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে প্রিয়ন্তীর সাথে ফ্ল্যাটে আসলো। দু’জনে প্রথমে কাপড় পাল্টে ড্রইং রুমে এলো। চৈত্রিকা পুরো কক্ষের দিকে একবার চক্ষু বুলালো। যেহেতু গতকাল এসে দেখে গিয়েছে সবগুলো কক্ষই গোছালো তাই আর গুছাতে হলো না। এতে অবশ্য বেশ বোর ফিল করছে ও। একটু আকটু কাজ করতে পারলে একাকিত্বের অনুভূতি টা বোধহয় কম হতো। সিদ্ধান্ত নিল রান্না করবে দুপুরের জন্য। সকালেও ওরা নাস্তা করে বের হয় নি। তবে পথিমধ্যে একটা রেস্টুরেন্টে কফি,কেক খেয়েছে। এখানকার রেষ্টুরেন্টের খাবারগুলো বিশেষ ভালো লাগে নি চৈত্রিকার। সবকিছু কেমন যেন পানসে। চকলেট কেক টা-ই একটু মুখে রুচেছে। প্লাজুর সাথে লম্বা একটা কামিজ পড়েছে চৈত্রিকা। স্কার্ফ টা গলায় পেঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে আসল৷ সাফারাত বলেছে টুকটাক খাবারের জিনিস আছে। ফ্রিজ খুলে সব ফাস্ট ফুড পেল। আর একটা ঝুড়িতে পাস্তা,নুডলস, স্যুপ,চিপসের প্যাকেট। ঠান্ডার দিনে স্পাইসি স্যুপ ভালো লাগবে ভেবে বানানোর সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। এর মধ্যে বেজে উঠল কলিংবেল। রান্নাঘর থেকে প্রিয়ন্তীকে বললো খুলে দেখতে কে এসেছে।
কথামতো প্রিয়ন্তী দরজা মেলল, ভাবল সাফারাত এসেছে কিন্তু সামনে যাকে দেখল তাতেই চোখ ছানাবড়া। বিড়বিড় করলো দাঁতে দাঁত কিটে- ‘ সাদা চামড়ার জার্মানির বাচ্চার আগমন,জ’ঘ’ন্য রকম স্বাগতম। ‘
ফাইয়াদ চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে স্বভাবসুলভ স্মিত হেসে বললো,
‘ হেই প্রিয়ন। ঢুকতে দিবে না?’
প্রিয়ন্তী মাথা উঁচিয়ে কিছুটা চেপে দাঁড়াল। চৈত্রিকা কিচেন রুম থেকে বেরিয়ে এসে ফাইয়াদকে দেখে অধর কার্নিশ প্রসারিত করে বললো,
‘ ভাইয়া বসুন। বৃষ্টি কমলেই আসতে পারতেন। এত তাড়া ছিল না। ‘
ফাইয়াদ সোফায় বসল। আঁড়চোখে একবার চাইল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়ন্তীর দিক। কেমন মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসল ফাইয়াদ। বললো,
‘ পিচ্চি মেয়েকে স্কুলে দিটে হলে আগে সিটিজেনশিপ লাগবে। এখনই কাগজ জমা দিয়ে রাকতে হবে। টুমার টা নিয়ে ভয় নেই। এই ধরো দু’মাসের মঢ্যে পেয়ে যাবে টুমি। ‘
প্রিয়ন্তী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। ‘ত’ ট উচ্চারণ করে, বাংলা ভাষার খু*ন করছে আবার ওকে পিচ্চি বলা হচ্ছে! ইচ্ছে করে মজা করছে ফাইয়াদ ওকে নিয়ে তা দিব্যি বুঝতে পারছে ও। নাক ফুলিয়ে দরজা লাগিয়ে রুমের দিকে যেতে নিলে চৈত্রিকা ডেকে উঠল,
‘ প্রিয়ু ভাইয়ার জন্য একটা তোয়ালে নিয়ে আসো। আর তোমার পাসপোর্ট,প্রয়োজনীয় কাগজ গুলো দাও ভাইয়াকে। সাফারাত গতকাল বলেছিল,খুব শীগ্রই তোমার পড়ালেখার ব্যপার টা নিশ্চিত করতে হবে। ‘
‘ আচ্ছা ভাবী। ‘
‘ ভাইয়া কফি চলবে?’
ফাইয়াদ চৈত্রিকার প্রশ্নে মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ হুম। ‘
চৈত্রিকা চলে যেতেই প্রিয়ন্তী হাতে তোয়ালেও কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলো। হাতের কাগজগুলো সামনের টি টেবিলে রেখে তোয়ালে টা এক প্রকার ছুঁড়ে মারল। ফাইয়াদ সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল। কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি হয়েছে প্রিয়ন?’
‘ আপনি আমাকে পিচ্চি বললেন কেন?’
‘ টুমি কি পিচ্চি না?হাউ ওল্ড আর ইউ?’
‘ আজ রাত পেরুলেই ষোলো হবে। ‘
ফাইয়াদ সুপ্ত হেসে, কন্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘ বিয়ের জন্য রেডি?ছেলে দেকব?ঠিকঠাক কিস করতে পারো টো প্রিয়ন?’
এমন ঠাট্টার স্বর কর্ণপাত হতেই প্রিয়ন্তীর সারা অঙ্গে স্ফুলিঙ্গ হতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল যেন। রাগান্বিত স্বরে ঈষৎ চিল্লিয়ে উঠল,
‘ আপনি আমাকে আপনার মতো অসভ্য মনে করেন?’
মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ আঁখিদ্বয় বড়সড় করলো ফাইয়াদ। বিস্ফোরিত কন্ঠস্বর তার,
‘ আমি কি করলাম? ‘
‘ কি করেন নি?গত রাতেই তো জাইফাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘
‘ কি বলছো?ওই মেয়ে টো উড়ে এসে আমার বুকে পড়েছিল।’
‘ একদম ভালো সাজার চেষ্টা করবেন না। আপনারা তো রাস্তা ঘাটে, মানুষের সামনে লিপ কিস করতেও দ্বিধাবোধ করেন না। নির্লজ্জ! ‘
ফাইয়াদ সবটা বুঝল একটা শব্দ বাদে। প্রশ্ন করলো,
‘ দিটাবোত কি প্রিয়ন?এন্ড জাইফা!শি ইজ নট মাই গার্লফ্রেন্ড। হোয়াই শুড আই কিস হার?কিস লাইফে একবারই করেসিলাম ‘ অ্যালেক্স ‘ কে। ‘
প্রিয়ন্তীর বুক ধরফর করে উঠল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আওড়ালো,
‘ হু ইজ অ্যালেক্স? ‘
‘ মাই এক্স গার্লফ্রেন্ড। লাইফের পথম প্রেম। ‘
‘ এক্স হলো কেন?’
ফাইয়াদ নির্বিকার অভিব্যক্তি ধারণ করে প্রতুত্তর করলো,
‘ ও আমায় লিভিং এর জন্য অফার করেছিল। আমি ভাবটে সময় নিই,ভেবে ডিসিশন নিলাম আমি পারব না। দ্যাটস হোয়াই শি লেফট মি ফর লাইফ। ‘
প্রিয়ন্তীকে স্তব্ধতা, অবাকতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিতে ব্যর্থ হলো।কারণ এদেশে এসব কমন বিষয়। ফাইয়াদের প্রতি প্রথমদিন থেকেই একটা পজিটিভ ভাব আসে। ক্ষণিকের জন্যও মনে হয় নি এটা এক ভিন্ন দেশের ছেলে। যথেষ্ট ভদ্রতা বজায় রাখে ছেলেটা। এছাড়া কম বয়সে যেই ধাক্কা টা পেয়েছে প্রিয়ন্তী জীবনে এখন ছেলেদের সান্নিধ্যে ভয় হয়, ভীষণ ভয়। একমাত্র ভাই ছাড়া কাউকেই বিশ্বাস হয় না। তবুও ফাইয়াদের কাছে অকপটে মনের ভাষা ব্যক্ত করছে পারছে সে। মুখে হাসি ফুটছে। নিত্যনতুন অনুভূতির সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে। কথার বিপরীতে কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল ও। ফাইয়াদ উত্তেজিত সুরে বলে উঠল,
‘ কোথায় যাচ্ছো?’
প্রিয়ন্তী হাস ফাঁস করতে লাগল। কিছু বলতে পারছে না। ফাইয়াদ ওর চোখের দিকে তাকালো। গলা ঝেড়ে বললো,
‘ প্রিয়ন!আমি কিন্তু খারাপ নই, আবেগি বয়সের ভুল মাত্র। ভালোবাসা টো এখন অনুভব করতে শিকেছি।’
প্রিয়ন্তীর হৃদস্পন্দন থমকে গেল। ফাইয়াদের বাক্য টাকে স্বীকার করে বলে উঠল,
‘ জানি। আপনি খারাপ নন। ‘
নিজের কাজে নিজেই হতভম্ব প্রিয়ন্তী। কি হলো ওর?কেন এত পজিটিভ অনুভূতি হচ্ছে এই বিদেশি সাদা চামড়ার ছেলে টার জন্য? আবারও আবেগ বশীভূত করা আরম্ভ করলো না-কি! চৈত্রিকা হাতের ট্রে টা টেবিলের উপর রাখল। স্যুপ,পাস্তা, কফি এসব রেডি করতে দেরি হয়ে গেল ওর। স্থির হয়ে থাকা প্রিয়ন্তীর দিক চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
নড়েচড়ে উঠল প্রিয়ন্তী। ফাইয়াদ ওর দিকে নির্নিমেষ,পলকহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে। ঠোঁটের কোণে হাসি। পেট টা গুড়গুড় করে উঠল প্রিয়ন্তীর। ঢোক গিলে বললো,
‘ আমি রুমে যাচ্ছি ভাবী। ‘
বলতে দেরি করলেও সুড়সুড় করে প্রস্থান করতে বিলম্বিত করলো না মেয়েটা।
_____________
হঠাৎ চৈত্রিকার পেট ব্যাথা শুরু হয়েছে ভোরের দিকে। বিছানায় কাকড়ার মতোন বালিশ আঁকড়ে ধরে পড়েছিল সে। সেই সময় থেকেই সাফারাতের চোখে ঘুম নেই, ভিতরটা ছটফট করছে। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। অনলাইনে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে কিছু স্টেপ নিয়েছে। ঘড়িতে এখন সাড়ে ছয়টা। নয় টার দিকে বেরোবে ওরা ডক্টর দেখানোর উদ্দেশ্যে। চৈত্রিকা গাঢ় নিদ্রায় ডুবে আছে। টুল পেতে বসে ওর ঘুমন্ত, তৈলাক্ত বদনের দিক চেয়ে আছে সাফারাত এক দৃষ্টে। দৃষ্টি টা করুণ। মন টা অস্থিরতায় বিষিয়ে যাচ্ছে মুহুর্তে মুহুর্তে। হঠাৎ কর্ণে ভেসে আসে কলিংবেলের শব্দ। সাফারাত ঘড়ির দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। চৈত্রিকার গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে দরজার কাছে আসল। খুলতেই ওর দুই হাঁটু জড়িয়ে ধরল পিচ্চি পিচ্চি দুটো হাত। আয়মান কে কোলে তুলে নিল সাফারাত। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা কে দেখে ঘৃণায়, রাগে মুখ ফিরিয়ে নিল। আলো বেগম অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘ ঢুকতে দিবি না খালামণি কে?কেন আমাকে ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলি?তোকে ছাড়া আমার কষ্ট হয় সাফারাত। কথা বল আমার সাথে। ‘
আয়মানকে কোল থেকে নামিয়ে দিল সাফারাত। আঙ্গুল দিয়ে নিজেদের রুম টা দেখিয়ে বললো,
‘ তোমার মামি মনি ও সুখ ঐ রুমে ঘুমাচ্ছে। ‘
আয়মান দৌড়ে চলে গেল। আলো বেগম এক গাল হেসে বললেন,
‘ কাল থেকে ছেলেটা মনমরা হয়েছিল। তুফান করেছে বাড়িতে। নিজের সব প্রিয় জিনিস ভেঙে ফেলেছে। বার বার বলছিল সুখ না থাকলে ওর কিছুই লাগবে না। শুধু সুখ চায় ওর। তাই নিয়ে এলাম।’
এটুকু বলে তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বললেন,
‘ তোর সাথে আমার কথা আছে সাফারাত। কেন এমন করছিস তুই?’
সাফারাত রোষপূর্ণ কন্ঠে গর্জে উঠল,
‘ আমার মা’য়ের খু*নের পরিকল্পনাকারীর সাথে আমার কোনো কথা নেই। মুখোশের আড়ালে নিকৃষ্ট এক নারী আপনি যে কিনা পুরো দুনিয়ার সামনে মমতাময়ী, নরম স্বভাবের সেজে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে আপনি একজন ছলনাময়ী। গেট আউট ফ্রম হেয়ার। ‘
আলো বেগম ধপ করে দরজায় বসে পড়লেন। টুপটুপ করে চক্ষু কোল থেকে জল গড়াতে শুরু করলো।
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)