সুখ_নীড় #পর্ব_২,০৩

0
637

#সুখ_নীড়
#পর্ব_২,০৩
মারজানা_হোসেন_রোজী
০২

জোর করে পল্লবকে বিয়ে করার পরিণাম জয়ীতা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বিয়ের পর থেকে এ বাড়িতে তার সম্মানের স্থানটুকু একদম তলানিতে। বাড়ির অন্য সবার কথা না হয় বাদই দিলো সে কিন্তু যে পল্লবের জন্য সে এ বাড়িতে এসেছিল সেই পল্লবের দু’চোখেই আজ অবধি একটু স্থান করে নিতে পারেনি জয়ী। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে কবে নিজের প্রাপ্তিটুকু নিয়ে সবার সাথে গর্ব করবে সে! এখন তো মনে হচ্ছে পল্লবকে বিয়ে করা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। সেদিন যদি সবকিছু মেনে নিয়ে পল্লবের থেকে দূরে সরে যেত সেটাই তার জন্য খুব সুখকর হতো হয়তো ৷

ছাদের এককোণে বসে সেই দিনগুলোর কথা আজও তার স্মৃতিতে ভেসে বেড়ায়। সেই যে আলো ঝলমলে এক পার্টিতে পল্লবকে প্রথম দেখা, পল্লবের প্রেমে পড়া, পল্লবকে বিয়ে করা, জোর করে তার ঘরে আসা সবই যেনো আজ তার জীবনের দুঃস্বপ্ন। কেনো সেদিন অমির সাথে পল্লবের পার্টিতে গিয়েছিল।

পল্লবের সাথে তার প্রথম দেখা হয় ওয়াশরুমে । ভুল করে সেদিন জয়ীতা ছেলেদের ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছিল। একটু ফ্রেশ হয়ে পেছন ফিরতেই দেখে পল্লবকে। পল্লবকে দেখে তার হাত-পা বরফের মতো জমে যায়। সে নিজেই যে ভুল করেছে সেটা বুঝতে না পেরে হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলে,

– কী আশ্চর্য! আপনি এখানে কেন?

– ইজন্ট ইট রিডিকিউলাস টু হিয়ার দিস কোয়েশ্চেন ফ্রম ইউ? আর ইউ ক্রেজি? এটা জেন্টস ওয়াশরুম। আপনি বলুন, আপনি এখানে কী করছেন?

ততক্ষণে যেন হুশ ফিরল জয়ীতার। এই বোকামিটা সে আগেও করেছে। হুটহাট করে না দেখেই সেখানে ঢুকে পড়েছিল।

সে ঘাবড়ে যেয়ে বলল, ওহ! তাই নাকি আ’ম ভেরি সরি ভেরি সরি। প্লীজ, ক্ষমা করবেন!

– ইটস ওকে! এরপরে দেখেশুনে ঢুকবেন কিছুটা রাগত স্বরে বলল, পল্লব।

এমনিতেই অমির আচরণে ভীষণ বিরক্ত জয়ী তার উপরে ওয়াশরুমে যে এমন একটা ভুল করার কারণে আরো বেশি রাগ হচ্ছে নিজের উপর। কেন যে অমির সাথে নাচতে নাচতে এখানে চলে এলো?

হঠাৎ খেয়াল হলো অমি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

– এতক্ষণে তোর আসার সময় হলো? আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছিস বলতো!

– এক্সট্রিমলি সরি দোস্ত। ওদের সাথে যেয়ে আমি একদমই তোর কথা ভুলে গিয়েছিলাম। চল, চল পার্টি প্রায় শেষের পথে। খাওয়া-দাওয়া করি। এরপরে তোর সাথে পল্লবের দেখা করিয়ে দিব।

– খাওয়া-দাওয়ার দরকার নেই, কারো সাথে দেখা করারও দরকার নেই। আমি ফিরতে চাই, প্লিজ।

– বোকা নাকি তুই? কত কষ্ট করে এখানে আমরা আজকে এসেছি। আর কিছু না খেয়ে চলে যাব? তাছাড়া পল্লবের সাথে তো তোর দেখাই হয়নি! আজকে পল্লবের মুড ভালো আছে। আমার মনে হয় কাজ হয়ে যাবে।

– আমি বলেছি তো, তোর কোনো পল্লব টল্লব এর কাছে আমি যাব না। দেখাও করব না। তুই আমাকে নিয়ে চল। তুই যদি না যাবি আমি নিজেই চলে যাব। জীবনেও তোর আক্কেল হবে না। ব্যাক্কল ব্যাক্কলই রয়ে যাবি।
একটা মানুষকে এই অপরিচিত পরিবেশে এনে রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিচ্ছিস তোর পার্টিতে। তারপরও তোর হুশ হয় না।

জয়ীতা রাগ করে প্রায়ই রওনা দিচ্ছিল ঠিক তখন পল্লব এসে হাজির তাদের মাঝে।

– হে, অমি! সে তাহলে তোর সাথে এসেছে? ও আই সি! এজন্যই ওকে আমি চিনেছিলাম না। বাই দ্যা ওয়ে, নাইস চয়েস! তা কবে থেকে রে বন্ধু? কিছুই তো জানালি না। ডুবে ডুবে পানি খাচ্ছিস?

– আরে না! ওসব কিছু না। ও হচ্ছে আমার খুব ছোটবেলার ফ্রেন্ড। আমরা ক্লাস ওয়ান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত একসাথে পড়েছি। আমাদের বাসাও পাশাপাশি ছিল। আচ্ছা, পরিচয় করিয়ে দিই। ও হচ্ছে জয়ীতা। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। আমার মত হ-য-ব-র-ল না।

আর জয়ীতা! ও হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড, পল্লব। যার কথা তোকে আমি বলেছিলাম।

– উনার সাথে আগেই আমার পরিচয় হয়েছে। তাও আবার ওয়াশরুমে। হেসে বলল, পল্লব!

– হাউ ফানি! কখন?

– মাত্র কয়েক মিনিট আগে। আচ্ছা সেসব কাহিনী তোর না জানলেও চলবে। তো ফ্রেন্ডকে নিয়ে এসেছিস খুব ভালো হয়েছে। এই সুযোগে ওনার সাথে পরিচিত হওয়া গেল। ডিনার সার্ভ করছে। প্লিজ, বসে যা উনাকে নিয়ে।

অমি কিছু বলার সুযোগই পাচ্ছিল না। পল্লব আবার চলে যাচ্ছিল তখন অমি তাকে পিছু ডাকল।

– পল্লব! তোর সাথে কিছু কথা ছিল ।

– পল্লব এগিয়ে এসে বলল, হ্যা, বল!

– জয়ীতাকে আসলে তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই নিয়ে এসেছিলাম। তুই ব্যস্ত মানুষ। সহজে তো পাওয়া যায় না তাই এখানে আসা। ওর একটা জব ভীষণ প্রয়োজন। গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। খুব ভালো রেজাল্ট ওর। দেখ তো কোথাও একটু ব্যবস্থা করা যায় কিনা। খুব প্রবলেমে আছে বলেই নিয়ে আসা। অনেক আশা নিয়ে তোর কাছে নিয়ে এসেছিলাম।

পল্লব খানিকক্ষণ জয়ীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কর্পোরেট জগৎ সম্মন্ধে প্রাক্টিক্যাল আইডিয়া আছে কিছু আপনার?

– ইয়ে মানে… না। তবে চেষ্টা করলে পারব হয়তো।

– ওকে, অমি! সানডেতে ওনাকে সিভিসহ নিয়ে আসিস অফিসে। কথা হবে সেদিন ডিটেইলস।

পল্লবের সাথে অতটুকুনই কথা হয় সেদিন জয়ীর। এরপরে পল্লবের অফিসে চাকরি হওয়া, প্রেম হওয়া সবই এখন স্মৃতি। যে মানুষটাকে সে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল সেই মানুষটা আর এই মানুষটা এক নয়। এই মানুষটার সাথে সে মন খুলে গল্প করতে পারে না।
ক’দিন ধরেই পল্লবকে একটা কথা বলবে বলবে করেও সে সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। অথচ একসময় অকপটে কতো কিছুই না বলা যেতো! আসলে সে খুব বোকা বলেই হয়তো পল্লবের আসল চেহারা তখন বুঝতে পারেনি।

জয়ী রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে সেই দিনগুলোর কথা ভাবছিল তখন পেছন থেকে এসে রুনু ডাক দিলো। রুনু এ বাড়িতে কাজ করে বহুবছর ধরে। এই একমাত্র মানুষ এ বাড়িতে যার সাথে মন খুলে একটু কথা বলতে পারে জয়ী।

– আফা, আপনে এই হানে! ভাইয়া, আইসা খুঁজতাছে। তাড়াতাড়ি যান নাইলে কুরুক্ষেত্র শুরু হইয়া যাইব।

– পল্লব এসেছে? এইসময় তো আসে না কখনো।

– তাই তো! দ্যাহেন যাইয়া। আইছে হয়তো কোনো কাজে। তাত্তারি যান।

পল্লবের সামনে যেতেই ভয় হয় জয়ীতার। সারাক্ষণ কেমন একটা থমথমে ভাব থাকে চোখমুখে। এই একটা বছরে কোনোদিন একটু মিষ্টি করে তার সাথে কথা বলেছে কি না এটাই মনে করতে পারে না জয়ী।
জিদের বশে আর মান সম্মানের কথা ভেবে এত যুদ্ধ করে পল্লবকে বিয়ে করাটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল এটা সে প্রতি মুহূর্তে টের পাচ্ছে।

রুমে ঢুকতেই পল্লব হুংকার দিয়ে বলে উঠল,

– কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

– ভয়ে ভয়ে জয়ী উত্তর দিলো, ছাদে?

– এই ভর দুপুরে ছাদে কী করতে? নাগর খুঁজতে গিয়েছিলে নাকি?

– এসব কী বলছ, পল্লব? কেউ শুনলে কী বলবে?

– শুনুক! আজকাল রাফির সাথে এত পিরিত কিসের তোমার ? চিৎকার করে বলে উঠল, পল্লব!

– ছিঃ! তোমার মুখে কিছুই আটকায় না। বাইরে আম্মি আছেন, ভাবী আছেন, মেইডরা আছে, প্লিইজ। একটু তো বুঝেশুনে কথা বলো। রাফি এ বাড়ির ড্রাইভার। কাকে নিয়ে কী বলছ তুমি? কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল, জয়ীতা।

– আমার কানে সবই আসে বুঝেছ? আজ দু’দিন ধরে কারো অনুমতি ছাড়াই কী এমন দরকার পড়ল যে রাফিকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে থাকতে হলো? কোথায় গিয়েছিলে জানতে পারি কি? নাকি রাফিকেই ডেকে জিজ্ঞেস করব?

জয়ী আর কিছু বলতে পারল না। কিছু বলতে যাবে তার আগেই কোনোরকমে মুখটা দু’হাতে চেপে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিলো।

হড়হড় করে বমি করতে শুরু করল সে। দরজাটা লক করার সুযোগ হয়নি তার। খানিক সময় পরে কিছুটা বমির ধকল কমলে একটু ফ্রেশ হয়ে পেছনে ফিরতেই দেখে পল্লব দাঁড়িয়ে। পল্লবের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল এতক্ষণে ।

পেছন ফিরতেই পল্লবের রক্তবর্ণ চোখজোড়া দেখে ভয়ে কুঁকড়ে উঠল জয়ী।

– আমার সন্দেহই তাহলে সত্যি। ইউ রাবিশ! আবার বাঁধিয়েছ? কতবার বলেছি সাবধান হতে!

– জয়ী আস্তে করে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল, আমার কী দোষ বলো! আমি কি ইচ্ছে করে… আল্লাহ দিলে আমি….

– চুপ… একদম চুপ! আজ সন্ধ্যায়ই হসপিটালে যাবে এটাকে খসাতে! আর একটা কথাও না।

জয়ী ডুকরে কেঁদে উঠে।

– একদম চুপ। ভাব দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না! পেটে পেটে শয়তানিতে ভরপুর। আমি কি আর এসব বুঝি না। মল্লিক বাড়িতে শেকড় গাড়ার ধান্ধা শুরু করেছ, নাহ! ইম্পসিবল!

– জয়ীতা দু’হাতে পেট চেপে ধরে করুণ স্বরে বলে উঠল, আবার সেই মৃত্য যন্ত্রণা ? প্লিইজ!

– একটা কথাও শুনতে চাই না। আমি সন্ধ্যা আন্টির সাথে কথা বলে রাখছি। উনি ক্লিনিকে থাকবেন আজ। আজকের মধ্যেই যেনো এই জঞ্জাল সাফ করে আসা হয়।

আর কোনো কথা বলার সুযোগ জয়ীতা পেলো না। হনহন করে বেরিয়ে গেল পল্লব।

পল্লব বের হতেই দেখল ড্রয়িংরুমে তার আম্মি সাজেদা বেগম আর পাশেই তার বড় ভাবী চৈতী বসা।

– কী সমস্যা আবার? বললেন, সাজেদা বেগম।

– চোর ধরা পড়ার মতো করে পল্লব বলল, কই কিছু নাতো!

পল্লবের কথা শুনে চৈতী মৃদু হেসে সামনে থাকা বাটি থেকে এক টুকরো আপেল মুখে দিতে দিতে বলল, বুঝলেন আম্মি, আমাদের পল্লবের কপাল ভালো। এমন উর্বর ভূমি কি সাধনায় মিলে? আমি যেখানে এই সাত বছরে একটা বাচ্চার মা হয়ে আর দ্বিতীয়বার চেষ্টা করেও পারছি না আর সেখানে আমাদের ছোট বউ বছরে দু’বার? দু’বার বলছি কেনো? তিনবার হবার কথা তো! একটা তো পেটে করেই নিয়ে এসেছিল!

পল্লব বুঝতে পারল এ বাড়িতে কোনো কথাই মাটিতে পড়ার জো নেই। দেয়ালেরও কান আছে এ কথা এ বাড়িতে একদমই সত্যি।

– আমি কোনো ঝামেলা চাই না। যা করার তুমি নিজেই করবে। এবং দ্রুত করবে। আমাকে হাজার ঝামেলা পোহাতে হয় সারাক্ষণ। এসব ফালতু ঝামেলাও যেনো আমাকে ডিল করতে না হয়!

এরপর চৈতীকে উদ্দেশ্য করে বলল, বৌমা, কল্লোলকে বলবে রাতের মিটিংটা ওকেই ডিল করতে আমি আর যাচ্ছি না। আমার অন্য একটা কাজ আছে।

– ঠিক আছে, আম্মি। বাধ্য পুত্রবধূর মতো জবাব দিলো চৈতী।

সাজেদা বেগম উঠে যাবার পরেও সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে পল্লব। চৈতী তার দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, আচ্ছা, আমিও উঠি। তোমার ভাইয়াকে খবরটা বলে আসি। জানোই তো আজকের মিটিংটা কতো ইমপর্ট্যান্ট। আম্মি তো আবার এমন সব কাজে তোমার ভাইয়াকে ছাড়া আর কাউকে ভরসাই করতে পারে না।

একদিকে জয়ীতার উপরে জমা হওয়া প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণা আরেকদিকে চৈতীর এমন খোঁচা মারা কথা হজম করতেই কষ্ট হচ্ছে পল্লবের।

চোখ মুছতে মুছতে এর মধ্যে নিচে নামল জয়ী। নেমে দেখে পল্লব তখনো যায়নি। সে অনেক আশা নিয়ে পল্লবের জন্য অপেক্ষা করছিল। অথচ কী হতে কী হয়ে গেল। জীবনের হিসেব মেলাতে পারছে না একদমই।

জয়ীতাকে দেখে রাগটা যেনো আরো টগবগিয়ে উঠল পল্লবের। জয়ীর দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, সবখানে রাষ্ট্র করা সারা।!
ইডিয়ট!

চলবে……..

#সুখ_নীড়
#পর্ব_৩

মায়ের অতীত কলঙ্কিত অধ্যায় সন্তানের সামনে চলে আসলে কোনো সন্তানের পক্ষেই মানসিকভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব না। তাও আবার যখন নিজের জন্ম পরিচয় নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে তখন পৃথিবীর কোনো ভালোকেই ভালো মনে হয় না। পল্লবের অবস্থা এখন এমনই। কোনোকিছুতেই এখন তার মন বসে না। মাঝেমধ্যে মন চায় দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যায়। এই একটা বছর ধরে কী পরিমাণ যে মানসিক অস্থিরতার মাঝে প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে এটা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না। যতই চেষ্টা করে সবকিছুতে স্বাভাবিক রিয়্যাক্ট করবে ততই যেন অস্বাভাবিক হয়ে যায় সে। এই কষ্ট সে কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না। কার কাছে বলে নিজেকে আরো ছোটো করবে! নিজের মায়ের দিকে তাকাতেও তার ঘৃণা হয় কিন্তু কী করবে মা তো! মাকে ছাড়া তার পরিচয়ই বা কী? মন চায় মায়ের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিন্তু সাহসে কুলোয় না একদমই। এই এক বছরে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছে তার মায়ের থেকে সে। একসময় সে তার মায়ের চোখে হারাত অথচ তার মায়ের কোনো কথাই আর শুনতে মন চায় না। তাও শুনতে হয়! জোর করেই শুনতে হয়!

এতবছর ধরে যে বাবাকে সে নিজের বাবা মনে করে এসেছে সেই বাবার সাথে তার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই এটা সে কী করে মেনে নিবে নিজেই বোঝে না। তার জন্মের ইতিহাসটাই সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় তার জীবনে। এর মাঝে নতুন করে প্যারা যোগ হয়েছে জয়ীতা।

পল্লব বুঝে জয়ীতার কোনো দোষ নেই। তবুও কেনো যেনো জয়ীতাকে আর আগের মতো ভালো লাগে না তার। মেয়েটাকে এতবার নিষেধ করল তার জীবনের সাথে না জড়াতে কিন্তু শুনলে তো! এখন ভোগো!
জেনে বুঝেই নিজের জীবনটাকে এই নরকের মাঝে টেনে নিয়ে এসেছে। এখন নিজের জীবন নিজেই সামলাও।

রাগে বিড়বিড় করতে করতে হসপিটালের বেডে শোয়া জয়ীতার পাশে এসে দাঁড়াল সে।

পল্লবের দিকে তাকাতে ঘৃণা হয় জয়ীর। ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। চোখের কোল ঘেষে পানি গড়িয়ে পড়ছে তো পড়ছেই। সে শুধু ভাবে, একটাবারের জন্যও কী মানুষটার মনে একফোঁটা মায়া হয় না?

ডাক্তার সন্ধ্যা রানী ভেতরে ঢুকলেন। নার্সকে ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললেন। পল্লবকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, কতবার বলেছি এই পাপ আমাকে দিয়ে আর করাস না। তোরা এ যুগের ছেলেমেয়ে। এত অসচেতন হলে কী করে হবে?

– আ’ম এক্সট্রিমলি সরি, আন্টি। কথা দিচ্ছি নেক্সট টাইম এমন ভুল আর হবে না।

– কিছুটা ধমকের সুরে ডাক্তার সন্ধ্যা বললেন, “নেক্সট টাইম এমন ভুল আর হবে না” এর মানে কী? নেক্সট টাইম আসলে আমি কেনো কেউই তোর জন্য কিছু করতে পারবে না। মার্ডার কেসের আসামি হব নাকি? এবার তো ওর এত খারাপ অবস্থা হয়েছিল, মেয়েটাকে বাঁচাতে যে পেরেছি এটাই ভাগ্য!
ওর অবস্থা দেখেছিস! পুরা চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। উপরওয়ালার কাছে থেকে অনেক হায়াত নিয়ে এসেছে, যে কারণে কিছু হয়নি। কৈ মাছের প্রাণ বলা যায় মেয়েটার। অতটুকুন জানের উপর আর কত সয়?তোর মা আমার বাল্যকালের বান্ধবী! তাই তাকে আমি না করতে পারিনি।
কিন্তু এরপরে আমার পক্ষে আর কিছুই সম্ভব না। আমি বুঝতে পারি না তোদের সমস্যা কোথায়? বড় বউ একটা বাচ্চার জন্য হাহাকার করছে আর ছোট বউ বাচ্চা কনসিভ করেছে আর সেই বাচ্চা তোরা নিচ্ছিস না। আমি বুঝি না লাইফ এনজয় করার কি আছে? বাচ্চা এসেছে তাকে পৃথিবীতে আসতে দে।

পল্লব মাথা নিচু করে চুপচাপ সবকিছু হজম করছে। তার সব রাগ এখন জয়ীতার উপর।

ওকে কিছুদিন বেড রেস্টে থাকতে হবে। বেড রেস্ট মানে বেড রেস্ট! কমপ্লিটলি বেড রেস্ট। ওর দিকে খুব খেয়াল রাখবি আর আমি যেসব খাবার দাবার, মেডিসিন সাজেস্ট করছি সেভাবে ঠিকঠাক রুটিনমাফিক দিবি। কোনো ভুল ত্রুটি না হয় যেনো।

জয়ীতার বিপি চেক করে ডাক্তার রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

ডাক্তার সন্ধ্যা বের হয়ে যাবার পরে পল্লব ধমকের সুরে জয়িতাকে বলল, সন্ধ্যা আন্টি কি বলল বুঝেছ নিশ্চয়ই? দু’দিন যদি বাঁচতে চাও তাহলে সাবধানে চলবে। মাসান্তে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য আমার সাথে তোমার সংসার করার প্রয়োজন নেই। যদি বুঝে শুনে চলতে পারো তাহলে আমার সাথে থাকো, নইলে না। এখনো সময় আছে যা লাগবে নিয়ে আমার কাছ থেকে বিদায় হতে পারো। আমি একবারের জন্যও তোমাকে প্রশ্ন করব না যে কেন যাচ্ছো কী নিয়ে যাচ্ছো! তোমার লাইফ যাতে ফুললি সিকিউরড থাকে আমি সেই ব্যবস্থা করে দেব। এই সমস্ত সস্তা সেন্টিমেন্ট, ভালোবাসা, সংসার, স্বামী, স্ত্রী ডায়লগ বাজি বাদ দিয়ে নিজের জীবনটাকে নিয়ে ভাবতে শেখো। আমার সাথে থাকলে এই এক বছরের যেভাবে থেকেছো এর থেকে বরং আরো খারাপ হবে ভালো কিছুই পাবে না।

পল্লবের কথাগুলি শুনে জয়ীতার বুকের ভেতর দুমড়ে-মুচড়ে যেন কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে যায়। মানুষ এত পরিবর্তিত কী করে হয়? এই মানুষকে তো সে ভালবাসেনি। মানুষ চিনতে তার এত ভুল হবে একথা সে যেন আজও বিশ্বাস করতে পারে না।

কি কথা বলছো না যে! তোমার মাকে আর ভাইকে খবর দাও তোমাকে এসে নিয়ে যাক। তোমার যখন যা প্রয়োজন হবে তাই পাবে। ওখানে থাকলে তুমি ভালো থাকবে। তুমি যেমন ভালো থাকবে আমিও ভালো থাকব!

শেষের কথাগুলো বলার সময় পল্লবের গলাটা যেন কেঁপে উঠল, ব্যাপারটা এড়াল না জয়ীতার কাছে।

– জয়িতা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, ভালো থাকার জন্যই তোমার সাথী হয়েছিলাম। তোমাকে ছেড়ে যাবার জন্য তো এত যুদ্ধ করে তোমার হাতটা ধরিনি। তুমি তো আমাকে গোপনে বিয়ে করে গোপনেই ডিভোর্স দিয়ে দিতে চেয়েছিলে!
একটা সত্য কথা বলবে পল্লব!
হঠাৎ করে কী এমন হলো যে তুমি একদম বদলে গেলে? তোমার কাছে আমি কিছু চাই না। তুমি শুধু আমার সেই আগের পল্লব হয়ে যাও! তুমি একবার মিষ্টি করে ভালোবেসে বলো আমাকে তোমার জীবন থেকে চলে যেতে আমি সব অধিকার ছেড়ে তোমার থেকে অনেক দূরে চলে যাব। কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা ধরে এলো জয়ীতার। আর কোনো কথা বলতে পারল না সে।

জয়ীতা অনেক কষ্ট করে পল্লবের দিকে পাশ ফিরল। ফিরে দেখে তার পেছনে কেউই নেই। পুরো কেবিনে সে একা।
কষ্টে বুকটা আরো ভারী হয়ে এলো। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিটুকু অবহেলায় গড়িয়ে পড়ে মাথার বালিশটাকে ভিজিয়ে ফেলল।

পরপর দুইবার ফোন বাজার পরে ফোনটা তুলল পল্লব। হসপিটালের করিডোরে এইসময় তেমন মানুষজন নেই। পল্লব ফোনটা রিসিভ করবে কিনা ভাবছে।

স্ক্রিনে ভাসছে….. খালেক মল্লিক ইজ কলিং……

কিছু সময় অনেককিছু ভেবে সে ফোনটা রিসিভ করল।

ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই মোটা ভরাট কণ্ঠ।

– কিরে বাপ! ফোন ধরছিস না কেনো? এত অচ্ছুৎ হয়ে গেলাম তোদের কাছে!

পল্লব কী বলবে বুঝতে পারছে না। কি বলে তাকে সম্বোধন করবে সেটাও তার মুখে আসছে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলল, না, না, বাবা। এসব কি বলছ! একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই রিসিভ করতে দেরি হলো।

– তাই বলে মাসের-পর-মাস তুই ব্যাস্ত থাকিস? লাস্ট আমার সাথে কবে কথা বলেছিস তোর মনে আছে?

– না মানে….!

– বুঝেছি মায়ের দীক্ষায় দীক্ষিত হচ্ছো তোমরা দু ভাই আজকাল। কল্লোল না হয় সারাজীবনে একটু স্বার্থপর টাইপের কিন্তু তুই তো এমন ছিলি না। আর কেউ আমাকে মনে না করলেও সপ্তাহান্তে তুই একবার আমাকে কল দিতি। বুড়ো বাপটা মরে গেছি না বেঁচে আছি এতোটুকু খবর তো নিতে পারিস। এই একটা বছর ধরে তুই যেন কেমন বদলে গেলি রে, বাবা।

– আমি বদলাইনি, বাবা! আমি নানান কাজে ব্যস্ত থাকি। তুমি কি আমাকে জরুরী কিছু বলবে না হলে আমি ফোনটা রাখতে চাচ্ছি। পরে কথা বলব তোমার সাথে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পল্লবের বাবা বলল, নারে বাবা কি আর বলব! তোরা কেমন আছিস সবাই সেটা জানার জন্য ফোন দিয়েছিলাম, তা ছাড়া শুনলাম জয়ী মা নাকি খুব অসুস্থ! মেয়েটাকে সেই যে একবার দেখলাম আর জীবনে দেখা হলো না। মাঝে মাঝে কথা হয় ওর সাথে। কতবার বললাম আমার কাছে একটু নিয়ে আয়। তোরা আসলি না! বৌমার খেয়াল রাখিস, খুব লক্ষ্মী মেয়ে! তোরা আমার নিজের ছেলে হওয়ার পরেও আমার খোঁজ খবর নিস না। এই মেয়েটাই একমাত্র আমার খোঁজ খবর নেয়!
জয়ী মা সুস্থ হলে একবার আয় না ওকে নিয়ে আমার কাছে। তোর মায়ের মত বিশাল রাজত্বের মালিক না হলেও এই মফস্বল এলাকাতে তোর বাবারও কিন্তু কম নেই। কবে না কবে মরে যাই আয় সবকিছু একটু দেখে যা। আমার মরার পরে এগুলো তো তোরাই পাবি নাকি। বেঁচে থাকতে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে রেখে যাই। জয়ী মায়ের নাম্বারে কল দিয়ে বন্ধ পেলাম। একটু দিবি ওকে?

– বাবা, আমি এখন দূরে আছি। পরে কথা বলো।
আচ্ছা, বাবা। সময় পেলে আসব আমরা। রাখি তাইলে।

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো পল্লব।

ঝাপসা চোখে খালেক মল্লিক লেখা নামটাকে আবার এডিট করে টাইপ করল, বাবা!

কিছুদিন আগে ‘বাবা’ শব্দটাকে মুছে খালেক মল্লিক লিখেছিল।
সে চেয়েছিল বাবা নামটাকে তার জীবন থেকে মুছে দিতে। কিন্তু এই লোকটার সাথে কথা বলার পর নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, পল্লব ।

এই মানুষটাই তার বাবা। এই মানুষটাকেই সে বাবা বলে জানে, বাবা বলে জানতে চায় সারাজীবন।

গলাটা বুজে আসে তার!

খালেক সাহেব সারাজীবন ব্যবসায় করেছেন ঢাকাতে। পল্লবের জন্মের কিছু আগে থেকেই সাজেদার সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়। ভেবেছিল পল্লবের জন্মের পর সম্পর্কটা স্বাভাবিক হবে কিন্তু তেমন কোনো লক্ষণ তো দূরের কথা আরো বিপর্যস্ত হয় তার সাংসারিক জীবন। শেষে বাধ্য হয়ে আলাদা থাকতে শুরু করে। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরে চলে আসেন বাপ দাদার ভিটেয়। বাগেরহাটের অদূরেই বিশাল বাড়ি তার। বেশ জমাজমি আর সহায় সম্পত্তি পৈত্রিক সূত্রেই পেয়েছে। আর নিজেও অনেক কিছু করেছে। এই বুড়ো বয়সটা একাকী পার করছে। এত এত সম্পত্তির মাঝেও কোথাও সুখ নেই তার। সব থাকতেও নিঃস্বের মতো দিনযাপন করে । বাড়িতে কয়েকজন চাকর বাকর আছে। এদের নিয়েই দিন কাটে তার।
ছেলেদের দেখতে মন চাইলেও কখনো যাওয়া হয় না ঢাকাতে। সাজেদা তার সাথে ছেলেদের দেখা হোক এটা পছন্দ করে না। সাজেদার সাথে তার ডিভোর্স না হলেও সম্পর্কটা তার থেকেও খারাপ পর্যায়ের।

তাছাড়া ছেলেরাও মায়ের ছায়াতেই থাকতে চায়। থাকাটাই স্বাভাবিক। মায়ের বিশাল বিত্ত, বৈভব, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা। এসবের বলয় ছেড়ে তারাও হয়ত বেরুতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। একবুক দীর্ঘশ্বাসকে পুঁজি করেই মৃত্যুর প্রতীক্ষায় প্রতি রাতে ঘুমাতে যায় খালেক মল্লিক।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here