সুখ_নীড় #পর্ব_২১,২২

0
420

#সুখ_নীড়
#পর্ব_২১,২২

২১

নিজের মায়ের উপর পল্লবের এত বেশি ক্ষোভ জমেছে যে সে নির্দ্বিধায় তার মায়ের বিরুদ্ধে যেয়ে তার মায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী শাহীন তালুকদারের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তাব পেয়ে কোনো কিছু আগেপিছে চিন্তাভাবনা না করেই রাজী হয়ে যায়। এসব দেখে জয়ীতার খুব ভয় হচ্ছে। সে কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টাও করেছে।

এই ক’টা দিন ধরে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না সে। ক’দিনে পল্লবের সাথে ভালো করে মন খুলে কোনো গল্পও করেছে কি না মনে পড়ে না। পল্লবের মা কতটা ভয়ংকর হতে পারেন এটা জয়ীর নিজের সাথে এতকিছু না ঘটলে কোনোদিনই বিশ্বাস হতো না। এখন শুধু ভয় হচ্ছে কখন না কী ঘটে যায়! নিজের চেয়ে বেশি ভয় পল্লবকে নিয়ে।

পল্লবের মুখের দিকে তাকালেই নিজের উপর ভীষণ রাগ হয় তার। তার জন্যই আজ এই অবস্থা পল্লবের। তার আসলে উচিত ছিল সম্পর্কের শুরুতেই পল্লবের জীবন থেকে সরে যাওয়া। এত যুদ্ধ করে সম্পর্ক টেকাতে গিয়ে ফলাফল যে কী হচ্ছে সে তো এখন দেখতেই পাচ্ছে। এত আরাম আয়েশে যে বড় হয়েছে সে এখন অন্যের হুকুমের গোলামী করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত ।

রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি চলছিল। জয়ী তার ছোটো দুই রুমের বাসা এখন মোটামুটি গুছিয়ে ফেলেছে। মনের অশান্তি বাদ দিলে সুখের কমতি থাকার কথা ছিল না। জয়ী এমন একটা টিপটপ গোছানো সংসারের স্বপ্নই দেখেছে আজীবন। পল্লব অফিস থেকে লোন নিয়ে নিত্যকার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা সবই কিনে ফেলেছে ইতিমধ্যে। শাহীন তালুকদারের সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক যাচ্ছে এখন। মোটামুটি ভালোই বেতন দিচ্ছে সাথে পুরানো মডেলের একটা টয়োটা করোল্লা গাড়ি। এমন ওল্ড মডেলের গাড়ি পল্লব কোনোদিন চালিয়েছে মনে পড়ে না জয়ীর। কিন্তু এখন এটাই যে জুটেছে এটাই তো তাদের মহত্ব! নয়ত বাসে ঝুলে ঝুলে প্রতিদিন অফিস করতে হতো পল্লবকে!

রাতে খেয়েদেয়ে শোয়ার বন্দোবস্ত করছে জয়ী। তখনই পল্লবের ফোনটা বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল শাহীন তালুকদারের ফোন।

– ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে জয়ী বলল, এত রাতে তোমাকে কী মনে করে কল দিয়েছে আবার?

– দেখি কী বলে?

– আচ্ছা। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জয়ী কিচেনের লাইট অফ করতে সেদিকে পা বাড়াল।

মিনিট দুই তিনেক বাদেই সে ফিরে দেখল কথা শেষ হয়েছে মাত্র পল্লবের।

– জয়ী বলল, কী কথা হলো?

– আগামীকাল ভোরের দিকে শাহীন ভাই তার প্রচারণার জন্য টাংগাইলে যাচ্ছে। আমাকেও নিতে চাচ্ছে।

– কী বললে তুমি?

– এ ব্যাপারে অবশ্য আজ অফিসেই কথা বলেছিল আমার সাথে । এখন আবার কনফার্ম হবার জন্য কল দিয়েছিল। আমি কী বলব বুঝতে না পেরে ওনার জোড়াজুড়িতে রাজী হয়েছি।

– এটা কী ঠিক করলে? উনারা তোমাকে ইউজ করছে তুমি বুঝতে পারছ না কেনো? আম্মিকে বিপদে ফেলবার জন্যই তোমাকে নিয়ে যেতে চাইছে। তোমার যাওয়া উচিত হবে না।

– আই ডোন্ট কেয়ার! উনার কথা কখনো মুখেই আনবে না। উনি বিপদে পড়লে আমার কিছু না। উনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই এখন আর! আমি তাকে চিনি না।

– চিনি না বললেই সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় না, পল্লব। উনি যদি জানতে পারে তুমি ওনার বিরুদ্ধে প্রচারণা করেছ কী হবে ভেবে দেখেছ? আমাদের বিপদ আরো বাড়বে।

– এত ভাবাভাবির সময় নেই। আমি যাদের নুন খাচ্ছি, তাদের কথাও ভুলে যেও না।

– দু’দিনের বন্ধুকে নিয়ে এত ভাবনা? আর আম্মির সাথে যে তোমার নাড়ীর সম্পর্ক!

– ভালো করেই জানো আমি সেটা ছিন্ন করেছি। এ বিষয়ে আর কথা বলো না, প্লিজ। আমি ভেবেচিন্তেই ডিসিশন নিয়েছি। আমি ওনাকে কোনো শাস্তি তো দিতে পারব না তাই এটাই আমার পক্ষ থেকে ওনাকে শাস্তি দেবার একটা বেস্ট ওয়ে। এজন্যই আসলে আমি রাজী হয়েছি।

– ব্যাপারটা যতো হালকা ভাবছ ততটা হালকা নয়। নিজের মায়ের বিপক্ষ দলে যোগ দিয়ে তাকে নির্বাচনী মাঠে দুর্বল করাটা যে কত বড়ো বোকামি! প্লিজ, নিজের রক্তের সাথে শত্রুতা বাড়িও না। এমনিতেই আমরা ওনাদের চরম শত্রু এখন। আমাকে আর তোমাকে পরিবারের মানুষ পর্যন্ত নাকি এখন ভাবে না।

– আমিও ওই পরিবারের কেউ হতে চাই না। আর ওই পরিবারের না বলেই আমি শাহীনের সাথে যাচ্ছি।

– এগুলি একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাচ্ছে, পল্লব। তুমি কি একবারও ভেবেছ শাহিন ভাইয়া কেন আমাদের এভাবে সাহায্য করছেন? তুমি কি মনে করেছ সে দুধে ধোয়া তুলসী পাতা? সে তোমাকে ব্যবহার করছে! একটু তো ভাবো।

– আমাকে কি তুমি বোকা ভাবো জয়ী? কী ভেবেছ আমি কি কিছুই বুঝিনা? হঠাৎ করে শাহীন ভাইয়ের আমার প্রতি এমন করে দরদ উথলে ওঠার কারণটা আমি ভালো করেই বুঝি! কোনো স্বার্থ ছাড়া কেউ এক পাও সামনে আগায় না। উনি ওনার স্বার্থ দেখছেন আমি আমারটা দেখছি। ব্যস হয়ে গেল। এই মুহূর্তে ওনাকে আমার দরকার। বিনিময় উনি তো আমার কাছে কিছু আশা করবেনই ।

– তাহলে তুমি সব জেনে বুঝেই সামনে এগুচ্ছো?

– একদম! আমাকে আম্মির বিরুদ্ধে সে ব্যবহার করতে চাইছে। আমি সেটা সাদরে গ্রহণ করেছি। আমার আম্মি আর শাহীন ভাই দু’জনের কারো মধ্যে কোন তফাৎ নেই। এরা এক ঘাটের মাঝি। স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। তাছাড়া আমি চাই না আম্মি এ নির্বাচনে জিতুক! যদি উইন করে তবে তার অহংকার আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে। তার একটু মাটিতে পা রাখা দরকার।

– সবই বুঝতে পেরেছি কিন্তু তাই বলে নিজের মায়ের সাথে এভাবে শত্রুতা বাড়িয়ে ভালো করছি কি! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। জানিনা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে?

– এত বেশি দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। আমি তোমার পাশে আছি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। আমি তোমার হাত ছাড়ব না। ভয় পেও না। তাতে যত যা-ই ঘটুক। তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করো।

অনেক রাত হয়ে গেলো। জয়ীর ঘুম আসে না কিছুতেই। পল্লব নিশ্চিন্তমনে ঘুমাচ্ছে। জয়ীর অজানা ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে । সে বুঝতে পারছে না কী করে পল্লবের কাছে বোঝাবে নিজের মনের কথা। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়ল সেও।

খুব ভোরে কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙল পল্লব আর জয়ীর। এত ভোরে কে আসতে পারে তাদের বাসায় তাছাড়া তাদের বাসাতে তো কেউ আসেও না। পল্লব ওঠার আগেই জয়ী যেয়ে দরজা খুলল। দেখল হান্নান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। এই লোকটাকে জয়ী আগে থেকেই চেনে। ইনিই পল্লবের জন্মদাতা এটা না জানলেও ইনাকে দেখলেই তার কেনো যেন বুকের মাঝে কী এক অজানা ভয় জেগে ওঠে।

জয়ীর পেছন পেছন পল্লবও এসেছিল। সে নিজেও হান্নানকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায়। জয়ীকে উদ্দেশ্য করে সে বলে ভিতরে যাও আমরা একটু কথা বলব।

জয়ী ভিতরে চলে যায় ঠিকই কিন্তু পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করে।

– এত সকালবেলা আপনি আমার এখানে কেন এসেছেন আর আমি যে এখানে থাকি এটা আপনি জানেনই বা কী করে? বেশ চড়া গলায় পল্লব কথাগুলো জিজ্ঞেস করল হান্নান সাহেবকে।

– দরকার না হলে আমি এত সকালে আসতাম না আর এড্রেসের কথা বলছ সেটা পাওয়া খুব কঠিন কিছু কি?

– শাহীন ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়েছেন?

– নিয়েছি, যেখান থেকে নেয়ার নিয়েছি। সেটা জানার দরকার কী? তোমার সাথে খুব জরুরী কিছু কথা আছে! এজন্য এসেছি!

– জরুরি কথা যে বলবেন সেটা আমি আপনাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি। জি, বলুন।

– দেখো, আমি প্রথম থেকেই বলছি তোমার শাহীনের সাথে মেশাটা মোটেই ঠিক হয়নি। ও একটা সুবিধাবাদী। আমার থেকে ভালো ওকে কেউ চেনে না। তোমাকে তোমার মায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যই সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তোমাকে তার নির্বাচনী এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য। তোমাকে কিছুই করতে হবে না শুধু তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও তোমার মায়ের জন্য যে কতটা ক্ষতিকর সেটা তুমি টের পাচ্ছ না। মায়ের সাথে আর কত দূরত্ব বাড়াবে? নিজের পায়ে আর কুড়াল মেরো না।

-সবই টের পাচ্ছি এবং সবই বুঝি। আপনি খুব বোকা মনে করছেন কেনো আমাকে? আর আমি যতদূর জানি শাহীন তালুকদারের সাথে তো আপনার খুব ভালো বিজনেস রিলেশান। তাইলে বন্ধুর ভালোমন্দ ভাবা বাদ দিয়ে আমার আম্মির ভালো নিয়ে এত মাথাব্যথা কেনো? উনার কাছে যতদিন সুবিধা নেয়ার নিয়েছেন। এখন তো তাকে ছেড়েছুড়ে চলে এসেছেন। তাইলে আবার!

– মাথা ঘামাতে বাধ্য হচ্ছি কারণ সে তোমার আম্মি। আর তার ভালো মানে তোমার ভালো। এজন্যই বলছি। আর একটা কথা! আমি তোমাকে আগেই বলেছি তোমার আম্মিকে আমি কখনোই ছেড়ে আসতে চাইনি। সেই তার আভিজাত্য আর অহংকারের কারণে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। নতুন কাউকে পেলে পুরানোকে ভুলে যাওয়া তোমার আম্মির আজন্ম অভ্যাস।

– নিজের মায়ের এমন কুকীর্তির কথা নতুন করে আবারও শুনে পল্লবের ঘৃণায় শরীর শিউরে ওঠে। সে প্রসঙ্গ বদলাতে বলে, বুঝেছি। শাহীন তালুকদারকে আপনি যে সুবিধাবাদী বললেন আপনিও তো তার থেকে কোনো অংশে কম নয়। একসময় আম্মির সাথে খুব লয়াল ছিলেন এখন সাইড চেঞ্জ করেছেন। মানে যেখানে যখন সুবিধা পান আর কী! সেটা যাই হোক, আমি আমার ভালোমন্দ বুঝি। আমাকে কী করতে হবে সেটাও জানি। আপনাকে কষ্ট করে এভাবে আসতে হবে না। ওহ আরেকটা কথা!

– হ্যা, বলো। আরেকটা কথা! আমি শুধু এই নির্বাচনী প্রচারণার কথাই বলছি না আমি চাচ্ছি তুমি শাহীনের বলয় থেকে একদমই বের হয়ে যাও। ও মানুষ হিসেবে খুব বেশি ভালো না। তুমি বিপদে পড়বে।

– পল্লব খানিকটা সময় কিছু ভেবে ধীরেসুস্থে বলল, পৃথিবীতে সবাই সুবিধাবাদী। তাই আমিও নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করছি। ভাবছি আমিও এর বাইরে থাকব কেন? আমার থেকে তো জীবনে বহু সুবিধা নিয়েছেন এবার আমার দিকে একটু তাকান! মায়ের সংসার ছেড়ে এসেছি, জানেনই তো তার সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছি আমি। এখন আপনার কি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না আমাকে সাহায্য করা?

– নিজের জেদের কারণে তুমি আজকে এই পর্যায়ে পৌঁছেছ। বারবার নিষেধ করেছি। এখনো বলছি খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি। ওই মেয়ের হাত ছেড়ে মায়ের ছেলে মায়ের কাছে ফিরে যাও।

হান্নান সাহেব পল্লবের ক্রোধান্বিত চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, সে যাই হোক আমার কথা শুনবে তো না, কতবারই তো বললাম। বলো কী করতে পারি তোমার জন্য? আমার থেকে সাহায্য নিবে ভাবতেই পারিনি। কতবার বললাম আমার ফ্যাক্টরিতে ঢুকতে তা না করে শাহীনের ফ্যাক্টরিতে ঢুকলে।

– আমি আপনার ছেলে। সেই হিসেবে ওখানে ওই পোস্টে কেনো চাকরি করে নিজেকে অপমান করাব? ওটা আপনার ছেলের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। ওখানে জয়েন করে নিজেকে ছোট করতে চাইনি।

– হান্নান সাহেব চুপচাপ শুনছিলেন।

– আমি আম্মির কাছে যতদিন ছিলাম মালিকের মতোই ছিলাম। তাই বুঝতেই পারছেন।

– এখন কী চাচ্ছ তুমি? কিছুটা ভীতিকর কণ্ঠে বললেন হান্নান সাহেব।

– ভয় নেই। বেশি কিছু দিতে হবে না। আমাকে জাস্ট বেড়িবাঁধ এ আপনার পেট্রোল পাম্প আছে ওটা দিয়ে দিন। ওটা তো আপনার আন্ডারেই আছে। তাই সমস্যা হবে না নিশ্চয়ই। ওটা পেলে আমি শাহীনকে ছেড়ে দিব কথা দিলাম।

– হান্নান সাহেব একটু নড়েচড়ে বসলেন।

– কথা বলছেন না যে! ভয় পেয়ে গেছেন মনে হচ্ছে! দুই নাম্বারি করে কম তো কামাননি। মেয়েকে বিদেশে পাঠিয়েছেন পড়াশোনা করতে। ছেলেকে গার্মেন্টস বিজনেসে সেট করে দিয়েছেন। আমারও তো কিছু প্রাপ্য আছে, তাই না!

– না মানে!

– আমতা আমতা করার তো কিছুই দেখছি না। আমি আপনার সম্পদে একজন লিগ্যাল ওয়ারিশ। তাছাড়া বাবা হিসেবে ছেলের বিপদে পাশে থাকা আপনার কর্তব্য।

হান্নান সাহেব একটু গড়িমসি করে বললেন, এসব কথা আসছে কেনো? এসব ছাড়ো। তুমি মায়ের কাছে ফিরে যাও।

– বারবার একই গান কেনো শোনাচ্ছেন? মায়ের কাছে ফিরে যাও, মায়ের কাছে ফিরে যাও। আপনার কোনো দায়িত্ব নেই! নাকি জন্ম দিয়েই আপনার দায়িত্ব খালাস!
এবার চিৎকার করে বলে উঠল পল্লব। ভেতরে যে জয়ী আছে সেটাও মনে নেই যেনো। জয়ী যে তার ব্যাপারে সবই জানে এটা এখনো অজানা পল্লবের।

– পল্লব, আস্তে বলো। তোমার ওয়াইফ শুনবে।

– শুনুক। তারও জানা উচিৎ আমার আসল পরিচয়। আচ্ছা, সেসব বাদ দিন। আপনাকে যেটা বললাম সেটা করছেন কিনা জানাবেন। তবে আশা করছি আমাকে নিরাশ করবেন না। কারণ আমি চাই না এই বয়সে আপনার স্ত্রী সন্তানদের কাছে এটা ফাঁস হোক যে আপনার স্ত্রী সন্তান থাকার পরেও যৌবনে আমার মায়ের সাথে ইলিগ্যাল রিলেশানের মাধ্যমে আমাকে জন্ম দিয়েছেন!
আর আমি এই মুহূর্তে কী করতে পারি আর কী পারি না সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। কারণ দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ আমি!

পল্লব কিছুসময় চুপ থেকে আবার বলল, আর এটা আপনার ফ্যামিলির কাছে প্রকাশ পেলে এই বয়সে ছেলেমেয়ে আর ওয়াইফের কাছে আপনার অবস্থানটা কী হবে বুঝতেই পারছেন!
আর আমি আপনার সাথে মোটেই ফান করছি না এটাও বুঝতে পারছেন।

– মাথা ঠাণ্ডা করো তুমি। কীসব বলছ?.

– মাথা ঠাণ্ডাই আছে। আমি ভেবেচিন্তেই বলছি। আমারও শাহীনের গোলামী করার শখ নেই। আপনি আমার ডিমান্ড ফিলআপ করবেন আশা করছি। না হলে কী হবে বুঝতেই পারছেন৷

চলবে…….

#সুখ_নীড়
#পর্ব_২২

– ভালো করেই জানিস আমি কী করতে পারি। আমার ছেলেটাকে তুই আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিস। কী ভেবেছিস, আমার ছেলেকে আমার থেকে আলাদা করে সুখ নীড় বাঁধবি! সেটা কোনোদিনই সম্ভব না। তোকে আমি আজ গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে মারব। যন্ত্রণা কাকে বলে তখন টের পাবি। কবর দেবার জন্য কেউ তোর লাশও খোঁজে পাবে না, নষ্টা মেয়ে। তুই আমার ছেলের কানে এতটাই বিষ ঢেলেছিস যে সে আমার বিরুদ্ধে যেয়ে শাহীনের মতো একটা বেজন্মার সাপোর্ট দেয়। কী ভেবেছিস, একবার পালিয়েছিস, আবার পালাবি? এবার আর সেই সুযোগ তোকে দিব না। তোকে এখানেই মেরে ফেলে রেখে যাব। তোর এই সুখের নীড়েই তোর কবর রচনা হবে!

জয়ীতার চুলের গোছা শক্ত করে চেপে ধরে কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে বলছে জয়ীর শাশুড়ি সাজেদা চৌধুরী।

জয়ীর চোখদু’টো ভয়ে টকটকে লাল হয়ে গেছে। এই মহিলাকে সে চিনে। ইনি যেটা বলে সেটা করতে মুহূর্তও ভাবে না। একবার তার হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছে আবার হয়ত সম্ভব হবে না। সে বারবার সাবধান করেছিল পল্লবকে যাতে শাহীনের নির্বাচনী প্রচারণায় না যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! পল্লবতো আসলে তার মায়েরই ছেলে। মা ছেলের কারো জিদ কারো থেকে কম নয়। জয়ী মনে মনে ধরেই নিয়েছে এবার আর তার নিস্তার নেই এই জল্লাদের হাত থেকে।
সাজেদা চৌধুরীর সাথে আরো দুইটা লোক আছে। দেখতে জল্লাদকেও হার মানাবে! এদেরকে জয়ী আগে কখনো দেখেনি তাদের বাড়িতে। হয়তো তার শাশুড়ির সব ধরণের কুকর্মের সাথী।

– আম্মি৷ বিশ্বাস করেন আমি পল্লবকে আপনার বিরুদ্ধে কিছুই বলিনি। আমি ওকে অনেকবার নিষেধ করেছি। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে বলল, জয়ী।

– আবারো মিথ্যে বলছিস! মরার ভয় নেই তোর! তুই না জানালে আমার ছেলে সেদিন আমার পাস্ট নিয়ে ওসব বলল কেনো? আমাকে বোকা ভেবেছিস? তোর কারণে আমার ছেলেটা আমাকে পর করে দিয়েছে। এই কষ্ট বুঝিস? সন্তান মায়ের থেকে দূরে গেলে কত কষ্ট হয় এটা তুই কী করে বুঝবি! তোর মতো একটা বাজারের মেয়ের কাছে এসবের মূল্য কী!

– জয়ী এত ব্যাথার মাঝেও একটা তিরস্কারের হাসি দিয়ে বলল, ওহ! তাহলে টের পাচ্ছেন তবে! আমার থেকে যখন আমার সন্তানদেরকে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তখন কি একবারের জন্যও ভেবেছিলেন আমার কেমন লেগেছিল? সন্তান হারানোর সেই কষ্ট আমি আজও ভুলিনি। উপরওয়ালার আদালতে অভিযোগ করেছি। তিনি সবই দেখছেন। একটা কথা মনে রাখবেন, তিনি ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।

জয়ীর কথা শেষ হতে না হতেই সাজেদা চৌধুরী তার চুলের গোছা আরো জোরে শক্ত করে চেপে ধরে উপুর্যুপরি একটার পর একটা থাপ্পড় মারতে থাকে। জয়ীতার মনে হচ্ছিল মাথার খুলি থেকে তার চুলগুলি খুলে উনার হাতে খসে পড়বে। ব্যাথার তাড়নায় চোখমুখে অন্ধকার দেখছে সে। কিছুক্ষণের জন্য ধরেই নিয়েছে এই জল্লাদের হাতেই আজ তার মৃত্যু হবে।

পল্লব আজ ফেরার কথা। সকালে রওয়ানা দেবার আগে তাকে কল দিয়েছিল। জয়ী এখন শুধু আল্লাহর নাম জপছে মনে মনে। এছাড়া আর উপায়ই বা কী! এই বন্ধ ফ্লাটের দরজার এপাশে কী ঘটছে ওপাশের কেউ বা কী করে জানবে! তাকে সাহায্য করার জন্য কেউই আসবে না।

আজই তার জীবনের শেষ দিন এমনটা ভেবেই নিয়েছিল জয়ী। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। জয়ী যেন হালে পানি পায়। নিশ্চয়ই পল্লব চলে এসেছে। এ যাত্রায় তবে বেঁচে যাবে সে! মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানায় সে।

কলিংবেলের শব্দ শুনেই সাজেদা চৌধুরী সতর্ক হলেন। পাশে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকা লোকদু’টিকে ইশারায় বললেন, কে এসেছে দেখতে! সে জয়ীর মুখ চেপে ধরে টেনে নিয়ে ভিতরের রুমে চলে যায়।

দরজা খুলতেই পল্লব হতভম্ব । এই মানুষ দু’জন তার মায়ের সব ধরণের কুকর্মের সাথী। এরা এখানে কী করে এলো ভেবে সে দিশেহারা। মুহূর্তেই যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল। লোক দু’টি তাকে কিছু বলার আগেই সে তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এদিক ওদিক তাকিয়ে জয়ীকে দেখতে না পেয়ে ভেতরের রুমে যায়। যেয়ে দেখে তার ভাবনা একচুলও অবান্তর নয়। তার আম্মি শক্ত করে চুলের মুঠি চেপে আছে জয়ীতার। আর জয়ীতা ব্যাথার তাড়নায় চোখমুখ কুচকে আছে। ওর দিকে তাকানো যাচ্ছে না।

পল্লবের চোখ দুটি যেন বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসবে তখনই। সে দিগ্বিদিক হারিয়ে চিৎকার করে উঠে।

– আম্মি? এখনই জয়ীকে ছেড়ে দাও। না হলে খুব ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে এখানে। তোমার শকুনের চোখ এখানেও পৌঁছে গেছে? এই মুহূর্তে তুমি জয়ীকে ছেড়ে এখান থেকে এক্ষুনি
বের হও। না হলে আমি বাধ্য হব খারাপ কিছু করতে! আমাকে বাধ্য করো না!

সাজেদা চৌধুরী পল্লবকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যান। সে জয়ীকে ছেড়ে দিয়ে রাগে গড়গড় করতে করতে পল্লবের দিকে এগিয়ে এসে পল্লব কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার গালে ঠাস করে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।
জয়ীতার এটা দেখে হাত পা কাঁপা বেড়ে দ্বিগুণ হলো। নিজের কষ্ট সে সহ্য করলেও পল্লবকে কষ্ট পেতে দেখে তার কষ্ট যেন আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল।

– হারামির বাচ্চা! বউয়ের কেনা গোলাম হয়েছিস! আমি তোকে এইজন্য এত বড় করেছি? ভেবেছিস আমি তোদের খোঁজখবর কিছু জানিনা। যেখানেই যাবি ছায়ার মতো লেগে থাকব। তোর কলিজায় এত সাহস তুই আমার আজন্ম শত্রু শাহীনের সাথে হাত মিলিয়ে আমাকে বরবাদ করতে চাচ্ছিস!
তোর পিরিতের বউয়ের কষ্ট দেখে মায়া লাগছে খুব? তোর সামনে আজ তোর বউকে কেটে টুকরো টুকরো করব। দেখি কী করিস?

-পল্লব রাগে গজগজ করতে করতে ঘুরে দাঁড়িয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলল, ভুলে যেও না আমি তোমার পেটেই জন্মেছি। বুকের পাটায় আমারও কম জোর নেই।
তোমার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে আমি চলে এসেছি। আমি যার সাথে খুশি তার সাথে মিশব! ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রবলেম? আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করার তুমি কে? হু আর ইউ? হু? এখানে আমি তোমাকে আর এক মুহূর্ত দেখতে চাই না। জয়ীর গায়ে হাত দেয়া থাক দূরের কথা তুমি ওকে ছুঁয়েই দেখো আরেকবার! ভুলে যাব তুমি আমার মা।

পল্লবের এমন আগুন ঝরা রুপ জয়ী এর আগে কখনো দেখেনি। যেন আহত বাঘের মতো গর্জে উঠেছে পল্লব।

-ছেলের এমন আচরণে অপমানে নীল হয়ে সাজেদা চৌধুরী বললেন, তবে আমি আগে তোকেই খুন করব। তোর বউকে মেরে কোনো লাভ নাই। আমি তোর মতো কুলাঙ্গার আর বেজন্মাকে পেটে ধরে যে পাপ করেছি সেই পাপ আগে মোচন করে নেই। তোকে জন্মের সময়ই গলা চেপে মেরে ফেলা উচিৎ ছিল। বাঁচিয়ে জীবনে একটা চরম ভুল করে ফেলেছি যার খেসারত দিচ্ছি আমি পদে পদে। একটা ছোটলোকের বাচ্চাকে জীবনের সাথে জড়িয়ে আমার ফ্যামিলিটাকে ধ্বংস করে ফেলেছিস। আমার লাইফটাকে নরকে পরিণত করেছিস।

– তখন মেরে ফেললেই ভালো করতে। এ জীবনের বোঝা কিছু কমত! আমার মত বেজন্মাকে জন্ম দিয়ে তুমি যে অন্যায় করেছ তার ক্ষমা তুমি আমার কাছে কোনোদিনই পাবে না।
আর কথায় কথায় অন্যকে দোষ দেবার আগে নিজের চেহারাটা আয়নায় একটু দেখো। নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো তুমি কে! তাহলে তোমার পরিচয় পেয়ে যাবে। এই এলিগ্যান্ট আর ক্লাসি লুকের মাঝে তোমার যে নোংরা ডাস্টবিনের মতো একটা কদর্য রূপ লুকিয়ে আছে সেটাকে ভালো করে দেখলেই খুঁজে পাবে। তোমার কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি এই জীবন থেকে মুক্তি দাও আমাকে। আমার পেছনে ছায়ার মতো লেগে না থেকে নিজেকে শোধরাও। সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছি। কথা দিলাম কোনোদিনই যাব না। না খেয়ে মরে গেলেও আমি বা আমার স্ত্রী তোমার দ্বারস্থ হব না। আমাকে মুক্তি দাও, প্লিইইজ। খুব ভদ্রভাবে বলছি। আশা করছি আমাকে আর অভদ্র হতে বাধ্য করবে না। না হলে আমিও কতটা অভদ্র হতে পারি সেটা এই মুহূর্তেই টের পাবে। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে।

পল্লব তার মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মায়ের হাত ধরে টেনেহেচড়ে ঘর থেকে বের করে দিলো। সাজেদা চৌধুরী এমন অপমানে নিজেই নিজের চুল টেনে ছিড়েখুঁড়ে ফেলবেন এমন অবস্থা! পল্লব দরজা লাগাবার আগ মুহূর্তে সে বলল, আজকের প্রতিটি কথার জবাব তুমি পাবে, খুব শীঘ্রই পাবে।

জয়ীতা আর পল্লব দু’জনেই পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে বেশ সময় ধরে। কারো মুখে রা নেই। হঠাৎ এসব কী হয়ে গেল? পল্লব রাগে একটা কথাও বলছে না। জয়ীতা অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে। কীভাবে তাদের জীবনটা স্বাভাবিক হবে সে বুঝতে পারছে না। পল্লবটাকেও যে একটু বোঝাবে সেই উপায় নেই। এত ঘাড়ত্যাড়া মানুষ সে জীবনে কমই দেখেছে। কতবার নিষেধ করেছে শাহীনের সাথে যেতে অথচ দোষ এখন সব ওর! খুব ভয় হচ্ছে পল্লবকে নিয়ে। পল্লবের সাথে সত্যিই যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে ওর মা? ওনাকে একবিন্দু বিশ্বাসও নেই জয়ীর। স্বার্থে আঘাত লাগলে এসব মানুষ নিজের রক্তের সম্পর্কও ভুলে যায়। এত এত যশ খ্যাতি, প্রতিপত্তির পেছনে দৌড়ঝাঁপ করে কী হবে যদি মনেই শান্তি না থাকে! সব ভেবেচিন্তে শেষমেশ সবকিছুর জন্য নিজেকেই দোষারোপ করে জয়ী।

বেশ সময় ধরে পল্লব ঝিম মেরে বসে থেকে উঠে বলল, আমি না আসা পর্যন্ত দরজায় বেল বাজাতে বাজাতে কেউ মরে গেলেও দরজা খুলবে না। আমি আসছি।

– জয়ীতা ভয় পেয়ে যেয়ে স্বাভাবিক থাকার ভঙ্গিতে বলল, কই যাচ্ছ এখন আবার? মাথা ঠাণ্ডা করে বসো। আমি জুস নিয়ে আসি।

– জুস খাওয়ার সময় না এটা। যা বলেছি সেটা করো! ধমকের গলায় বলে পল্লব।

পল্লব মিনিট পেরুতেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

জয়ীতা ভেবে পাচ্ছে না এই মুহূর্তে সে আবার কই গেল? সে তার মায়ের সাথে কোনো ঝামেলা করতে যায়নি তো আবার? কী হচ্ছে এসব?

হাজার অশান্তির ভীড়ে আরেক নতুন চিন্তা যোগ হয়েছে জয়ীর মাথায়। হান্নান সাহেবকে পল্লব গতকাল সকালে আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে ৪৮ ঘণ্টার। এই সময়ের মধ্যে তাকে জানাতে হবে পেট্রোলপাম্প পল্লব পাচ্ছে কি পাচ্ছে না। হান্নান সাহেব যে ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি মোটেও, সেটাও বুঝতে পেরেছে জয়ী.! চারদিকে এত শত্রু বাড়িয়ে পল্লব কী করে বাঁচবে এটা ভেবে মাথা ঘুরছে জয়ীতার। চারপাশে যেন সবকিছু ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে। সম্পর্কের শুরু থেকেই পল্লবের এই একগুঁয়েমি তার একদমই পছন্দ ছিল না। কিন্তু কিছুই করার নেই তার। এতটা নাছোরবান্দা গোছের মানুষ আগে দেখেনি সে। পল্লব যা চায় তা করে ছাড়ে। পল্লবের এই স্বভাবের কারণেই সে পল্লবকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল।

দিনগুলি চোখের সামনে যেন এখনও জ্বলজ্বল করছে৷ জয়ীতার। মনে পড়ছে এই স্বভাবের কারণেই কীভাবে পল্লব ধীরে ধীরে তার অফিসের বস থেকে প্রেমিকে পরিণত হয়। শত চেষ্টা করেও পল্লবকে পিছু ছাড়াতে পারেনি। জয়ী তখনই টের পেয়েছিল এই অসম ভালোবাসার পরিণতি খুব একটা ভালো হবে না। ব্যাপারটা নিয়ে শুরুর দিকে যখন অফিসপাড়ার চারপাশে নানান ধরনের গুঞ্জন চাউর হতে থাকে তখন জয়ীতা নিজেকে সরাতে চেষ্টা করে । সে পল্লবকে কিছু না জানিয়েই এখান থেকে চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চাকরী খোঁজা শুরু করে । জয়ীতা তার এক বান্ধবীর সাহায্যে একটা চাকরি জোগাড়ও করে ফেলেছিল। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হলো। পল্লব আরো উল্টো আঠার মত সারাক্ষণ তাকে অনুসরণ করতে লাগল । জয়ীতা পল্লবকে অ্যাভয়েড করছে এটা পল্লব কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। এক সময় সে জোর করে জয়ীতাকে তার বিছানায় যেতে বাধ্য করে।
সবকিছু হারিয়ে জয়ী তখন নিঃস্ব। সে ধরেই নিয়েছে পল্লব আর দশটা বড়লোকের ছেলের থেকে আলাদা নয়। সে তাকে ভোগ করতে চেয়েছে এবং সেটাই করেছে। এসব প্রেম ভালবাসা সব কিছুই মিথ্যে অভিনয় ছিল । তার মতো একটা সাধারণ মেয়েকে ভালোবেসে পল্লব হয়তো নিজের স্ট্যাটাস নষ্ট করবে না।

জয়ীতা যখন সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিল , এই পৃথিবী থেকে তিক্ত স্বাদ ছাড়া আর কোন কিছুই অনুভব করার সামর্থ্য সে হারিয়ে ফেলেছিল, পল্লবের দিক থেকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল ঠিক তখনই সে সেই পল্লবকেই আশার আলোর মতো তার পাশে পায়। জয়ী বুঝতে পারে তার ভাবনার মধ্যে আসলেই ভুল ছিল পল্লব আর দশটা ছেলের মত নয়। পল্লব হাঁটু গেড়ে তার কাছে ক্ষমা চায়। আসলে জয়ীতা যাতে তাকে ছেড়ে যেতে না পারে এজন্যই পল্লব তাকে এভাবে বাধ্য করে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় এটুকু ভাবার মতো চেতনা তখন ছিল না পল্লবের। তাই সে জয়ীতাকে তার জীবনে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। জয়ীতা তখনই আঁচ করতে পেরেছিল এই সম্পর্কের পরিণতি কখনোই ভালো হবে না। কী করবে কী না করবে ভেবে না পেয়ে রিক্তবক্ষে গ্রামে ফিরে যায়। সেখানে যেয়েও রক্ষে নেই। পল্লবও তার গ্রামে যায়। পল্লব জয়ীতাকে বিয়ে করার জন্য জয়ীর পরিবারকে রাজী করায় । একরকম জোরজবরদস্তি করে জয়ীকেও রাজি করায় সে। নিজের মা কোনোদিনই তাদের সম্পর্ক মেনে নিবে না তাই তার বাবা খালেক সাহেবের সাহায্য নেয়। পল্লবের একগুয়েমি আর ভালোবাসার কাছে হেরে যায় জয়ীতা। বিয়ে করতে বাধ্য হয় তাকে।

এরপর শুরু হয় তাদের সংসার। জয়ীতা পল্লবের অফিসে চাকরি করত তখনও। পল্লবের খুব কাছের দু-একজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া তাদের বিয়ের খবর কেউ জানত না। বছরখানেক খুব ভালোভাবে কেটেছিল তাদের। পল্লব প্রায়ই নানান অজুহাতে বাসার বাইরে থাকার নাম করে জয়ীর কাছে থাকত। জয়ীতা বারবার পল্লবকে অনুরোধ করে তাদের সম্পর্কের কথা তার পরিবারকে জানাতে কিন্তু পল্লব সময়ের অপেক্ষায় ছিল। সেই মোক্ষম সময় আসার আগেই হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই পল্লব তার জীবন থেকে আবার দূরে সরে যেতে থাকে। বদলে যেতে থাকে।

ধীরেধীরে এমন অবস্থা হয় জয়ীর সাথে তেমন কথাবার্তাও বলত না। থ’ মেরে বসে থাকত। আসা যাওয়া কমিয়ে দেয় জয়ীর বাসাতে। জয়ীতাকে চাকরি থেকে রিজাইন দিতে বাধ্য করে। কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে যায়। অফিসে একদিন আসলে তিনদিন খবর থাকত না। কোথায় থাকত সেটা জয়ীতা জানতে চাইলেও বলত না। মাঝে মাঝে জয়ীতাকে চড় থাপ্পড় দিতেও কার্পন্য হতো না তার। মাঝেমধ্যে নেশাও করত। এ যেন পল্লবের এক অচেনা রূপ! জয়ীতা একদমই চেনে না এই পল্লবকে।

এরমাঝে তাদের বিয়ের কথা কানে যায় সাজেদা চৌধুরীর। সে নানান ভাবে থ্রেট করে জয়ীকে যাতে সে পল্লবের জীবন থেকে সরে যায়।

এই দোলাচলের মাঝেই হঠাৎ করে মাস দু’য়েক লাপাত্তা হয়ে যায় পল্লব। কোনো খবর ছিল না তার। হন্যে হয়ে পল্লবকে খুঁজেছে জয়ীতা কিন্তু না, কোথাও তার নাম নিশানা নেই।

আসলে হান্নান সাহেব নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য পল্লবকে সত্যটা জানিয়ে দিয়েছিল। পল্লব মানতেই পারছিল না যে সে আসলে একটা জারজ সন্তান। মানসিক অশান্তিতে পুড়ে পুড়ে নিজেকে কয়লায় পরিণত করে ফেলে। না পারত কাউকে কিছু বলতে, না পারত সইতে। মানসিক যন্ত্রণায় সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। পালিয়ে বাঁচার জন্য মালয়েশিয়া তার এক বন্ধুর কাছে চলে যায়। কিন্তু সেখানে যেয়েও এক ফোঁটা শান্তি মেলেনি। কোথায় যাবে সে ভেবে পায় না। এ যে তার আজন্ম কষ্টের এক উপাখ্যান।

নিজে থেকেই আবার জয়ীর কাছে ফিরে আসে। ভাবে শুধুশুধু এই মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ! তাকে মুক্তি দিয়ে নিজেই জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায় সে। পল্লবকে ফিরে পেয়ে জয়ীর সব অভিযোগ গায়েব। সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। আবারও হাজারো রঙিন স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে জয়ীতা কিন্তু মুহুর্তেই সেই স্বপ্ন খান খান হয়ে যায় যখন পল্লব তাকে জানায় সে তাকে ডিভোর্স দিতে চায়।

জয়ীতা নানানভাবে বোঝায় পল্লবকে। জানতে চায় কী তার অপরাধ! কিন্তু কোনো উত্তর নেই পল্লবের কাছে তার শুধু একটাই কথা সে মুক্ত হতে চায় সব সম্পর্কের বাঁধন থেকে।

যে মানুষটাকে জয়ী পাগলের মত ভালবাসে, যাকে খুঁজতে খুঁজতে সে নিজেকে একবিন্দু ক্লান্ত মনে করেনি এতদিনে সে হঠাৎ করে এসেই এখন বলছে সে তাকে চায় না। এটা কী করে সম্ভব? কিছুতেই মেনে নিতে পারে না জয়িতা। এর মাঝে সে টের পায় সে মা হতে যাচ্ছে। পল্লবকে এই খুশির খবর জানানোর মতো ধৈর্যটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে । যেখানে একফোঁটা ভালোবাসাই অবশিষ্ট নেই সেখানে এই সন্তানের কোনো মূল্যই আছে কিনা এই মানুষের কাছে সে সন্দিগ্ধ। পরে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পল্লবকে জানাতে বাধ্য হয়। কিন্তু কোনো লাভ নেই। পল্লব বলে বাচ্চা নষ্ট করতে। জয়ী কিছুতেই রাজী হয় না।

সাজেদা চৌধুরীও জয়ীকে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে। পল্লব একদম গুটিয়ে ফেলে সবকিছু থেকে।

জয়ীতা বুঝতে পারে পল্লব বা তার আম্মি কখনোই তার অনুনয়, বিনয়, নম্রতাকে কোনো মূল্য দিবে না। সে নিজের এবং সন্তানের অধিকার আদায়ে নিজেই সোচ্চার হয়।

সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই চোখদু’টি ঝাপসা হয়ে যায় তার। এত যুদ্ধ করে আজ এখানে পৌঁছাতে পেরেছে। এখান থেকে আবার কোনদিকে যেতে হবে কে জানে! একটা সুখের নীড় বুঝি আর বাঁধা হলো না।

একদিকে তার শাশুড়ি অন্যদিকে হান্নান সাহেব। তার উপর এখন শাহীন নামের এই আপদ!
ইনিও যে পল্লবের ভালো কিছু চায় না এটা সে ঠিকই টের পাচ্ছে। যার শুরুটা আজই হলো। এর শেষ কোথায় সে জানে না!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here