সুখ_নীড় #পর্ব_২৮,২৯

0
467

#সুখ_নীড়
#পর্ব_২৮,২৯

২৮

তুহিন সব বিল পরিশোধ করে জয়ীতার বাচ্চাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করিয়ে সাথে করে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে এসেছে। সাথে জয়ীর মাও আছেন। জয়ীতা হাসপাতলে অসুস্থ একথা এখনো তুহিন তার মাকে জানায়নি। জয়ীতা কখন না কখন সুস্থ হয় সেই অপেক্ষা না করে তুহিন নিজে থেকেই বাচ্চাটাকে রিলিজ করিয়ে নিয়ে এসেছে।

সে হাসপাতালে পৌঁছাতেই কর্তৃপক্ষ জানালো যে, জয়ীতার বাচ্চার অবস্থা এখন আগের থেকে অনেকটাই ভালো। ফুসফুসও ভালোই কাজ করছে। অনেকটাই স্বাভাবিক। বড় কোনো ঝুঁকি নেই আর। তাই তারা চাইলে এখনই বাচ্চাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া হাসপাতালে নবজাতকের জন্য বেডের বেশ স্বল্পতা। বাসায় নিয়ে যথাযথভাবে দেখভাল করলেই খুব তাড়াতাড়ি সে আরো স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

দুই তিনদিন আগে জয়ীতা হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে অনুনয়-বিনয় করেছে যাতে তার বাচ্চা কিছুটা স্বাভাবিক হলে রিলিজ দেওয়া হয়। প্রতিদিনের এত এত খরচ জয়ীতার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। তাই সে তার বাচ্চাকে বাসায় নিয়ে যেতে চায়। এমনিতেই এ পর্যন্ত তুহিনের কাছ থেকে প্রচুর নেওয়া হয়েছে আর কত নেওয়া যায়। সে মুখ ফুটে কিছু না বললেও তুহিন নিজে থেকে সবকিছু করছে। জয়ীতার ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। এভাবে আর কত ঋণী থাকা যায়!

পল্লবের নিখোঁজ হওয়ার রাতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা শুনে সাজেদা চৌধুরীর চোখ ছানাবড়া। ওই রহস্যময় মেয়েটা কে হতে পারে, কিভাবে তার কাছে পল্লবের ফোন গেল এটা কিছুতেই সে মেলাতে পারছে না। সাজেদা চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন এবার সে প্রমাণ পেয়েছেন তাই এবার আর বসে থাকবেন না। জয়ীতাকে সাথে নিয়ে সোজা থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জয়ীতাকে বললেন, সেদিন রাতে যা কিছু ঘটেছিল সবকিছু নিখুঁতভাবে থানায় যেন সে বর্ণনা দেয়। কোনো একটা সূক্ষ্ম ঘটনাও যেন বাদ না পড়ে। যে কোনো মূল্যে সে তার ছেলেকে যে বা যারা খুন করেছে তাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে চায়।

এত সময় ছেলের খুনিকে খুঁজে বের করার উত্তেজনায় সাজেদা চৌধুরী ভুলেই গিয়েছিলেন যে জয়ীতার বাচ্চা হয়েছে । কিন্তু সেই বাচ্চা এখন কোথায় সেটা জিজ্ঞেস করার কথা এতক্ষণ মনে আসেনি। গাড়িতে বসে জয়ীতাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজে কিছুটা শান্ত হতেই পল্লব এবং তার বাচ্চার কথা মাথায় আসল।

জয়ীতা গাড়িতেও ডুকরে কেঁদেই যাচ্ছে সাজেদা চৌধুরী তাকে সান্তনা দিতে দিতে বললেন, যে যাবার সে তো চলে গিয়েছে। তাকে তো আমরা আর ফিরে পাবো না। শুধু শুধু কান্না করে তুমি তোমার বাচ্চাটার ক্ষতি করছ। আমার কাছে সবকিছুর আগে এই মুহূর্তে পল্লবের বাচ্চা । আমার আদরের নাতীকে তুমি কোথায় রেখেছ, মা। ওকে একনজর আমাকে দেখতে দাও।।

জয়ীতা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। হঠাৎ সে সতর্ক হলো। এই মানুষটার আসলেই কি পরিবর্তন হয়েছে নাকি তার সাথে অভিনয় করছে সে বুঝতে পারছে না। এভাবে মা বলে ডাকছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে নাকি তার কাছ থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নেয়ার পায়তারা করছে জয়ীতার মাথায় আসছে না কোনোটাই । তার বাচ্চাকে নিয়ে সত্যি বলবে নাকি মিথ্যে বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু এই মুহুর্তে সাজেদা চৌধুরীর কাছে মিথ্যে বলাটাও যেন একটা বড় অন্যায় হয়ে যাবে তার নিজের সাথেই। একদিকে তার ছেলের আকাশসম বিল সামলাতে হিমসিম খেতে হবে তাকে অন্যদিকে পল্লবের খুনিকে খুঁজে বের করতে হলে এনার সাহায্য ছাড়া তার একার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না।

কিন্তু তার ভয় হচ্ছে সত্যটা জানার পরে তার কাছ থেকে তার বাচ্চাকে কেড়ে নেওয়া হবে নাতো! কিন্তু যাবে তো যাবেই বা কোথায়? সাজেদা চৌধুরী যখন একবার জানতে পেরেছেন যে পল্লবের বাচ্চা আছে। সে তাকে কিছু না জানালেও এই পৃথিবীর বুকে তার বাচ্চা যেখানেই থাক সে কিছুতেই জয়িতাকে ছেড়ে কথা বলবে না! তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করবে!

সাজেদা চৌধুরী আবারো জয়ীতাকে তার বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করলে জয়ীতা এবার আমতা আমতা করে বলে তার বাচ্চা তার বাসাতেই আছে। তার বাচ্চাটা যে প্রি-ম্যাচিউর বেবি এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে এসব কথা আর বলতে গেল না কিছুই।

জয়ীতার কাছে সেদিন রাতের সব বর্ণনা শুনে পুলিশ অফিসার এবার কেইস নিতে বাধ্য হলেন। জয়ীতা এবং সাজেদা চৌধুরী দু’জনেই আশাবাদী।

সাজেদা চৌধুরী নিজেই জয়ীতাকে নিয়ে জয়ীতার বাসার উদ্দ্যেশ্যে রওয়ানা হলেন। জয়ীতা কয়েকবার চেষ্টা করেছে কোনোভাবে ওনার পিছু ছাড়ানো যায় কিনা কিন্তু কোন লাভ হয়নি। পল্লবের কবর দেখতে চাইলে সাজেদা চৌধুরী বলেন, পরে দেখাবেন।

একবুক হাহাকার আর শূন্যতা নিয়ে একদিন পরে বাসায় ফিরেছে জয়ীতা। বাসাতে ফিরে অবাক। তুহিন তার সমস্ত চিন্তাকে নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। তার বাচ্চাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করিয়েছে। এতগুলো টাকা কী করে সে বিল দিবে এটা নিয়ে চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছিল অথচ সবকিছুর সমাধান তুহিনই করেছে, অথচ সে কিছুই টের পেল না।

জয়ীতা তার মায়ের কাছে এ ব্যাপারে সব কথা শুনল কীভাবে তুহিন তাদেরকে সাহায্য করেছে। তার মায়ের কাছে পল্লবের কথা বলতে যেয়ে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে । সাজেদা চৌধুরীও নাতীকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন।

সেদিন রাতের আসা মেয়েটার নাম বলেছিল মেঘনা। তবে জয়ীর সন্দেহ হচ্ছে ওটা ওর আসল নাম কিনা! সে একবার ম শব্দটা বলে পরে বলেছে মেঘনা। তার মানে এটা তার আসল নাম না। আসল নাম বলতে গিয়ে সে আবার থেমে যেয়ে অন্য একটা নাম বলেছে। মেয়েটার কাছে পল্লবের ফোন কী করে এলো এটাই মাথায় ঘোরাচ্ছে জয়ীতা। হঠাৎ তার আরেকটা কথা মনে আসায় সে দ্রুত তার শাশুড়িকে ফোন করল।

সাজেদা চৌধুরী ফোন ধরতেই জয়ীতা বলল,

– আমি একটা বিষয় তো ক্লিয়ার যে ওই মেয়েটার নাম মোটেই মেঘনা নয় তবে ম অক্ষর দিয়েই কোনো নাম হবে। আরেকটা বিষয় আমার কাছে খটকা লেগেছে সেটা হলো ও নিশ্চয়ই নিজে গাড়ি চালিয়ে আমার বাসা পর্যন্ত আসেনি। ওর সাথে হয়ত ওর ড্রাইভার ছিল অথবা অন্য কেউ।

– সাজেদা একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, তোমার এটা কেন মনে হচ্ছে? তুমিতো থানায় স্টেটমেন্ট দিলে ও নিজে গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে চলে গিয়েছে। ওর সাথে আর কেউই ছিল না।

– মনে হচ্ছে কারণ ওকে বিদায় জানাতে যখন আমি রাস্তা পর্যন্ত গিয়েছিলাম তখন খেয়াল করেছি ও যখন ড্রাইভিং সিটে বসে তখন সিটটাকে ও একটু এডজাষ্ট করে নিয়েছিল ওর নিজের জন্য। আমার প্রশ্ন হচ্ছে ও যদি ওই রাতে নিজেই ড্রাইভ করে আসত তাহলে সিটটা ওর আন্দাজেই এডজাস্ট করা থাকত। আমার মনে হচ্ছে এখান পর্যন্ত ও নিজে ড্রাইভ করে আসেনি ওর সাথে অন্য আরেকজন ড্রাইভার ছিল। হয়তো সেও ওর সহযোগী!

– হতে পারে। তোমার কথায় যুক্তি আছে কিন্তু অতো রাতে তুমি বললে যে ঐদিন ঝড়-বাদল ছিল তাছাড়া সামনে গাছ উপড়ে পড়েছিল তাহলে ওই লোকটা গেল কোথায়? আর গেলই বা কী করে?

– আমার মনে হচ্ছে লোকটা হয়তো এখানকার আশেপাশের কেউ অথবা ওনাদের সাথে আরও একটা গাড়ি ছিল সেটাতে ওরা ব্যাক করেছে।

– তোমারে কথাটা কেমন যেন মিলছে না। ওদের সাথে যদি আরেকটা গাড়ি থাকত এবং ওরা যদি ব্যাক করত তাহলে এই মেয়েটাও নিশ্চয়ই ওদের পিছু পিছু চলে যেত। সে একা ছিল বিধায় ঝড়বাদলের রাতে যেতে সাহস পায়নি তোমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে এবং ও যদি জানত এটা পল্লবের বাসা তাহলে সে কখনোই আসত না। সে হয়তো ভুল করেই তোমার এখানে এসেছে।

– আমিও সেটা ভাবছি কারন ও যদি জানত এটা পল্লবের বাসা তাহলে নিশ্চয়ই পল্লবের ফোনটা ওভাবে সাথে করে নিয়ে আসত না। আমার কাছে আরেকটা ব্যাপার খটকা লাগছে। আমার মনে হচ্ছে ওরা হয়ত পল্লবের পিছু করছিল। পল্লব সেই সময় বাসাতে ফিরছিল। না হলে ওই ঝড় বাদলের রাতে এখানে কেন আসবে?
পল্লবকে ওরা…. আর কিছু বলতে পারে না জয়ীতা। কিছুতেই চোখের পানি আর আটকে রাখতে পারে না সে। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছে সেদিনের ঘটনা।

যদিও নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছে সে পল্লবের জন্য কাঁদবে না। কান্না মানুষকে দুর্বল করে দেয় এই মুহূর্তে তাকে দুর্বল হওয়া চলবে না। যে করে হোক পল্লবের খুনিকে খুঁজে বের করতেই হবে।

জয়ীতার সাথে কথা শেষ করে সাজেদা চৌধুরী দ্রুত থানার উদ্দেশ্যে রওনা হন।

থানায় পৌঁছাতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। পল্লবের নিখোঁজ হওয়ার পরে আরও তিন দিন ধরে তার ব্যাংক ট্রানজেকশন হয়েছে। সাজেদা চৌধুরীর তো মাথায় হাত এটা কি করে সম্ভব একজন মৃত ব্যক্তির একাউন্ট কী করে ট্রানজেকশন হয়?

এবার আবার সাজেদা চৌধুরীর সন্দেহের তীর জয়ীর দিকে। যেহেতু লেনদেনগুলো কার্ডে হয়েছে তার মানে জয়ীতা নিশ্চয়ই পল্লবের কার্ডের পাসওয়ার্ড জানে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। স্বামীর ব্যাংক পাসওয়ার্ড স্ত্রী জানতেই পারে। এ ছাড়া আর কে পল্লবের পাসওয়ার্ড জানবে বা ব্যাংক থেকে টাকা তুলবে। ব্যাংক স্টেটমেন্টটা হাতে নিয়ে সে বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভালো করে বোঝার চেষ্টা করছে। রাগে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। এই জয়ীতাই তাহলে তার ছেলে পল্লবকে খুন করেছে আর এখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য নাটকের পর নাটক করে যাচ্ছে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য সেদিন রাতের ওই সব মনগড়া কাহিনী সাজিয়ে তাকে বোকা বানাচ্ছে।

এমন মুহূর্তে হান্নান সাহেব এসে সাজেদা চৌধুরীর পাশে বসল।

হান্নান সাহেবকে দেখে সাজেদা চৌধুরীর মেজাজ আরো বিগড়ে গেল।

– তুমি? তুমি এখানে কি করতে এসেছ? আর তুমি জানলেই বা কী করে যে আমি থানায় এসেছি?

– শান্ত হও সাজেদা! থানায় এসেছি আমি অন্য একটা কাজে। যাওয়ার পথে তোমাকে দেখে এখানে থামলাম ।

– তোমার তো এখানে থামার কথা না। তোমার কাজ শেষ তুমি চলে যাও, প্লিজ। তোমার কারণে আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি তুমি ভুলে যেও না।

– আমার কারণে মানে? কী বলতে চাচ্ছ তুমি? পল্লব কি আমার কেউ ছিল না? আমি কি তাকে ভালোবাসতাম না? আমি এই ক’টা দিন কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না।।যেদিকে তাকাই শুধু পল্লবকে দেখি। আমার কষ্টটা না বুঝে উলটা ব্লেম করছ! এই স্বভাবটা আর গেল না তোমার!

– তুমি যদি আমার ছেলের কান না ভরতে তাহলে সে আমাকে ছেড়ে এই জঙ্গলে বাসাও নিত না আর এভাবে খুনও হতো না।

– বাহ, নিজের অপরাধ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছ! পল্লবের স্বাভাবিক জীবনকে অস্বাভাবিক করেছ তুমি আর তোমার অহংকার! তোমার থেকে পালিয়ে বেড়াতেই সে বিরুলিয়াতে বাসা নিয়েছে। কী করেছিলে ওর সাথে আর ওর বউয়ের সাথে সেটা কি মানুষ ভুলে গেছে ভেবেছ?

– আরো কিছু বলতে যাবে তখন সাজেদা চৌধুরী চোখ কটমট করে তাকালেন।

চলবে….

#সুখ_নীড়
#পর্ব_২৯

কয়েক মুহূর্তের জন্য আপন ভাবলেও সাজেদা চৌধুরী তার রূপ দেখিয়ে দিলেন আবারও। কিছুসময় আগেই জয়ীতাকে যা না বলা যায় সেসব কথা বলে ইচ্ছেমতো গালাগাল করেছেন। জয়ীতাই নাকি তার ছেলেকে খুন করেছে। জয়ীতাকে থ্রেট করেছে সে তার নাতীকে জয়ীতার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে এই খুনের প্রতিশোধ নিবে । আর জয়ীতাকে স্বামী হত্যার দায়ে জেলে পঁচে মরতে হবে।

জয়ীতার সমস্যা যেন কাটছেই না। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা হাজির। একদিকে পল্লবকে হারিয়ে সে বিপর্যস্ত অন্যদিকে তার নিজের ঘাড়েই পল্লবের খুনের বোঝা চাপানোর হুমকি ধামকি। তার সাথে যোগ হয়েছে তার নবজাতক বাচ্চাটিকে হারানোর নতুন ভয়।

কোনো উপায়ান্তর না দেখে সে তুহিনকে ফোন করল। তুহিন ছাড়া এই মুহূর্তে আর কাউকে সে ভরসাও পায় না। তুহিন সবকিছু জেনে জয়ীতাকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করল। জয়ীতা বুঝতে পারছে তার শ্বাশুড়িকে সাথে নিয়ে সামনে আগাতে গেলে এক পা এগুলে দুই পা পিছু ফিরে আসতে হবে। তাই পল্লবের খুনী পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে তাকে নিজেকেই যা করার করতে হবে।
এজন্য এখন তাকে যদি কেউ সাহায্য করতে পারে সেটা হচ্ছে একমাত্র তুহিন। এই একটিমাত্র মানুষই এখন তার নিখাঁদ শুভাকাঙ্ক্ষী। তুহিনের কাছে সব কথা খুলে বলতেই তুহিন প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করলেও পরে তাকে অভয় দেয় । এ ব্যাপারে সে জয়ীতার সব ধরনের সাহায্য করবে কথা দেয়।

পরেরদিন সকালবেলায় জয়ীতা থানায় অপেক্ষা করছে তুহিনের। সে থানায় এসেছে পল্লবের ব্যাংক স্টেটমেন্ট নেওয়ার জন্য। থানায় এসে ওসি সাহেবের কাছে জানল যেসব এটিএম বুথ থেকে পল্লবের ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা তোলা হয়েছে সেসব বুথের সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে ইতিমধ্যে । এটা জানার পরে জয়ীতার টেনশন কিছুটা কমলো। অন্তত এ যাত্রায় তার শাশুড়ির রোষানল থেকে কিছুটা হলেও তো রক্ষা পাওয়া যাবে।

ওসি জামান সাহেব জানালেন, কিছুক্ষণ পরে সাজেদা চৌধুরীও আসছেন এখানে। তার সাথে কথা হয়েছে।

জয়ীতা উনি আসা পর্যন্ত অপেক্ষায় বসতে চাইছে না।উনার সামনে পড়ার কোন ইচ্ছেই জয়ীতার নেই। সে তুহিনকে দিয়ে অনুরোধ করালো যাতে ভিডিও ফুটেজটা তাদেরকে দেখানো হয়।

ট্রানজেকশনের টাইমের সাথে মিলিয়ে সিসিটিভি ফুটেজের দিকে তারা গভীরভাবে খেয়াল করছে। পল্লবের একাউন্ট থেকে টাকা উঠানোর কাছাকাছি সময়ে যারাই টাকা তুলেছে সবগুলো ছবি খুব ভালো করে জুম করে দেখানো হচ্ছে জয়ীতাকে।

হঠাৎ জয়ীতার চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে উঠল। তুহিনও ব্যাপারটা খেয়াল করে বলল, কাউকে চিনতে পেরেছেন?

জয়ীতা বলল, হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। এই তো সেই মেয়ে যে ঐ রাতে আমার বাসায় এসেছিল। যার কাছ থেকে আমি পল্লবের ফোনটা পেয়েছিলাম। কী যেন নাম বলেছিল…. মেঘনা! যদিও এটা ওর আসল নাম না আমার বিশ্বাস। এই ডাইনীটাই তাহলে সব জায়গা! ও মাই গড।

জয়ীতার কথা শুনে ভারপ্রাপ্ত অফিসার জামান এবং তুহিন দুজনেরই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। তুহিন এগিয়ে এসে ছবিটা দেখতেই সে নিজেও বড় একটা ধাক্কা খায়।

পুলিশ অফিসার আরো পাকাপোক্তভাবে নিশ্চিত হবার জন্য প্রত্যেকটা ট্রানজেকশনের টাইম অনুযায়ী সবগুলো সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলেন। এই ক’দিনে বেশ কয়েকবার টাকা তোলা হয়েছে পল্লবের একাউন্ট থেকে।
অবাক করা বিষয় হলো প্রত্যেকটা সিসিটিভি ফুটেজে এই একটা মাত্র মেয়েকেই দেখানো হচ্ছে। জয়ীতা ভাবছে এই মেয়ের যদি অন্য কোনে সহযোগী থাকে তাহলে তারা কই? নাকি সবকিছু এই মেয়েটা একাই করেছে? তাহলে কি তার সব ধারণা মিথ্যে?

তুহিনের চোখ-মুখের পরিবর্তন দেখে জয়ীতা বুঝতে পারল যে কিছু একটা চলছে তুহিনের ভেতর!

সে তুহিনকে জিজ্ঞেস করল, তুমিও একে চেনো?

তুহিন কিছুটা ইতস্তত করে বলল, হুম, চিনি।

দায়িত্বরত অফিসার জামান এবার সতর্ক হলেন। জয়ীতা কিছু জানতে চাইবার আগেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, উনার সম্পর্কে কী জানেন সবকিছু ডিটেইলস এ বলুন।

– না, মানে আসলে আসলে …..

তুহিনের এমন গরিমসি দেখে অফিসার জামান বললেন, দেখুন! কোনো রকম কিছু লুকানোর চেষ্টা করবেন না। একবারও এমন কথা ভাববেন না। তাহলে আপনি অনেক বড় ঝামেলায় পড়বেন। আপনি বুঝতে পারছেন এটা মার্ডার কেইস। উনার সম্পর্কে যা কিছু জানেন সবকিছু বলেন। কথা দিচ্ছি কোনো বিপদ হবে না আপনার।

– ওর নাম মোহনা! আমি আর ও একসাথে এমবিএ করেছি।

জয়ীতা তো এবার আরো অবাক। তার চিন্তাই ঠিক। এই মেয়ে আসল নাম লুকিয়ে অন্য নাম ব্যবহার করেছে।

– তুহিন আর কিছু বলছে না দেখে অফিসার জামান বললেন, এটুকুই নাকি আরো কিছু জানেন? মানে ওনার সাথে আপনার রিলেশন কেমন ছিল? উনি এখন কোথায় থাকে?

– আমার আর মোহনার রিলেশন ভালোই ছিল আমরা ক্লোজ বন্ধু ছিলাম। কোথায় থাকে সেটা আমি জানি না।

– শুধুই ক্লোজ বন্ধু ছিলেন নাকি এর থেকেও বেশি কিছু? প্লিজ কো-অপারেট করুন। কোনোকিছু লুকাবেন না। আপনি লুকালেও আমরা তদন্ত করে সব কিছু বের করে ফেলব কিন্তু আপনি নিজে থেকে যদি আমাকে সবকিছু বলে দেন সেক্ষেত্রে দেখা যাবে আমাদের একটু বেগ কম পেতে হবে, কাজটা আমাদের জন্য সমাধান করা সহজ হবে, দ্রুত হবে। সাথে আপনারও বিড়ম্বনা হবে না।

– বেশ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তুহিন আস্তে করে বলল, মোহনার সাথে আমার রিলেশনটা বন্ধুত্বের থেকেও বেশ কিছু ছিল। আমরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করতাম।

– করতাম তার মানে এখন তার সাথে আপনার কোনো রিলেশন নাই সেটা বোঝাতে চাইছেন তো?

– জি। ওর সাথে আমার খুব ভালো রিলেশন ছিল এটা সত্যি । কিন্তু বেশ কিছু কারণে ওর সাথে আমার ব্রেক আপ হয়ে যায় আজ থেকে আরও দেড় বছর আগে।

জয়ীতা হাঁ করে সবকিছু গিলছে। তার মাথায় ঢুকছে এই মেয়ে যদি তুহিনের গার্লফ্রেন্ড হয়ে থাকে সেখানে পল্লবকে কেন খুন করতে যাবে। পল্লবের সাথে এই মেয়েটির কীসের শত্রুতা?

– তো তুহিন সাহেব, যেহেতু মোহনার সাথে আপনার একটা ভালো রিলেশন ছিলো তাই আপনি ভাল করেই চিনেন। এজন্য ওর নাড়ি নক্ষত্র সম্মন্ধে সবকিছু বললে আমার জন্য খুব ভালো হতো। আর তদন্তেও খুব সুবিধা হতো।

– ও খুব হাই অ্যাম্বিশাস একটা মেয়ে। সাথে ভীষণ লোভীও। মোটামুটি মধ্যবিত্ত ঘরের একটা মেয়ে। বাবা বেঁচে নেই, মা আছেন। আরো দুই ভাই আছে ওর। পরিবারের সাথে ওর সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। স্বাধীনচেতা টাইপের মানুষ। কাকরাইলে ওদের ভাড়া বাসার ঠিকানাটা আমি জানি যদি সেই আগের বাসাতেই থাকে তাহলে আমি আপনাকে ওর বাসা চিনিয়ে দিতে পারব কিন্তু যদি বাসা শিফট করে সেক্ষেত্রে আমার আর কিছু করার থাকবে না।

– ও আই সি! কিছুক্ষণ অফিসার থেমে থেকে আবার বললেন, দেখুন! এটা যদিও আপনার পার্সোনাল ম্যাটার। তাও আমাদের ইনভেস্টিগেশন এর খাতিরে আপনাকে একটু জিজ্ঞেস না করে পারছি না। ওনার সম্পর্কে আপনি যে বিশেষণগুলো ইউজ করেছেন একটাও তো উনার প্রতি ইমপ্রেস হওয়ার মতো মনে হলো না। ওনার কোনো ভালো গুণ আপনার চোখে পড়েনি নাকি ওনার সাথে রিলেশন নেই দেখে এখন সবকিছুই আপনি ওনার খারাপ ভাবে দেখছেন?.

– দেখুন, আমি ওর সাথে যখন রিলেশনে জড়াই তখন ওকে ঠিক চিনতে পারিনি। মানুষের মানুষ চিনতে ভুল হয়। এটাই স্বাভাবিক। ও খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল, পড়াশোনায় পাংচুয়াল। আমরা অনেক সময় ধরে গ্রুপ স্টাডি করতাম সেভাবে ওর সাথে আমার একটা রিলেশন তৈরি হয়। বেশিদিন অবশ্য আমাদের সম্পর্ক টেকেনি। মাস ছ’য়েকের মাথায় আমাদের ব্রেকআপ হয়ে যায়।

– যদি কিছু মনে না করেন কারণটা জানতে পারি?

– কারনটা তো আগেই বললাম! ওর স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে আমি যখন ভালোভাবে জানতে পারি তখন ধীরে ধীরে ওর থেকে আমি দূরে সরে এসেছি। ও আসলে শুধুমাত্র আমাকেই নয় ফিনান্সিয়াল অ্যাবিলিটি ভালো এমন দেখে আরো দু’ চার জন ছেলের সাথে রিলেশন করেছে আমি যতদূর জানি। এটা আমি জানার পর থেকে ধীরে ধীরে ওর থেকে দূরে সরে এসেছি। তাছাড়া ওই মাস ছ’য়ের মধ্যে ওর সাথে আমার দুই একবার আরো নানান অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে! ওর স্বভাব চরিত্র তখন আমি মোটামুটি বুঝতে পেরেছি তাই ওর থেকে আমি সরে এসেছি। ও প্রচণ্ড লোভী একটা মেয়ে। টাকা পয়সা ছাড়া কিছুই বোঝে না । স্টুডেন্ট হিসেবে যতটা না ভালো মানুষ হিসেবে ঠিক ততটা খারাপ এবং বাজে।

– আপনি কি নিজে থেকে সরে এসেছেন নাকি ও আপনার থেকে সরে গিয়েছে?

– দুটোই বলতে পারেন আমি ওকে অ্যাভয়েড করতে শুরু করেছি এবং ও যখন বুঝতে পেরেছে ও আমার কাছে যা আশা করছে সেটা কখনো পাবে না তখন ও নিজেও আমাকে অ্যাভয়েড করতে শুরু করেছে এভাবে আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়।

– আই সি! আচ্ছা এবার বলুন পল্লব সাহেবের সাথে উনার কীভাবে পরিচয় থাকতে পারে? পল্লব সাহেবের বাসাতেই বা কেন গেল বা উনার ফোনটাই বা তার কাছে কী করে এলো ? তাছাড়া উনি দেখছি পল্লব সাহেবের ব্যাংক পাসওয়ার্ড পর্যন্ত জানে। পল্লব সাহেবের এটিএম কার্ডটা ওনার কাছে! ব্যাপারটা কী বলুন দেখি! যেহেতু পল্লব সাহেব আপনাদের সাথে কাজ করতেন সেহেতু আপনার হয়তো কিছু জানা থাকতে পারে!

– সরি, এ ব্যাপারে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারছি না কারণ আমার চোখে এমন কিছুই পড়েনি। পল্লব ভাইয়ের সাথে ওনার কোনো পরিচয়ই আছে কিনা সেটা পর্যন্ত আমি জানি না।

– আচ্ছা, ম্যাডাম জয়ীতা! আপনার কাছে একটু আসি। আপনার কি কখনো মনে হয়েছে পল্লবের সাথে এই মেয়ের কোনো যোগাযোগ থাকতে পারে?

– জি না। এমনটা আমার কখনোই মনে হয়নি। পল্লবের সাথে যদি ওর পরিচয় থাকত তাহলে আমি নিশ্চয়ই একে চিনতাম। পল্লব আমাকে বলত।

– আচ্ছা আচ্ছা। কিছু মাইন্ড করবেন না, প্লিজ।আপনার পার্সোনাল লাইফ সম্পর্কে কয়েকটা কোশ্চেন জিজ্ঞেস করব। আশা করছি আপনি তদন্তের স্বার্থে কোনোকিছু লুকাবেন না।

– অবশ্যই আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন।

– আপনাদের ম্যারেড লাইফ কেমন ছিল? হ্যাপি ছিল নাকি…. মানে কোনো সন্দেহ, অবিশ্বাস…মানে বুঝতেই তো পারছেন আমি কী বুঝাতে চাচ্ছি!

– জি, আমি বুঝতে পারছি। প্লিজ, পল্লব এই পৃথিবীতে নেই। ওকে নিয়ে কোনো উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করা হোক এটা আমি চাই না।

– দেখুন, আমি বুঝতে পারছি আপনার খারাপ লাগছে আমার কথা শুনতে। কিন্তু আপনাকে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। পরিস্থিতিটা এখন এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। পল্লব সাহেবের ব্যাংক কার্ড অন্য একটা মেয়ের কাছে পাওয়া গিয়েছে এবং এই মেয়ে সম্পর্কে যে কথা শুনলাম তাতে কোনো কিছুই অমূলক ভাবা যাচ্ছে না। আমি পল্লব সাহেব সম্পর্কে যতদূর ইনভেস্টিগেট করে জেনেছি, শুনেছি ওনার নাকি দুইটা বাসা ছিল। একটাতে আপনাকে নিয়ে থাকত আরেকটা বাসা ঢাকাতে যেখানে উনি একা থাকতেন। আপনার মনে কখনো সন্দেহ হয়নি ওই বাসাতে উনি একা কেন থাকতেন, কাকে নিয়ে থাকতেন?

-না, কখনো সন্দেহ হয়নি। কারণ পল্লব সেরকম নয় আর আমাদের দুটো বাসা থাকার কারণটা আপনাকে আমি গতকালই বলেছি। আমাদের পারিবারিক কিছু সমস্যা আছে যে কারণে পল্লব এভাবে থাকত। আমাকে কেন বিরুলিয়া থাকতে হয়েছে সেটাও আপনাকে বলেছি। আমার শাশুড়ির সামনেই আপনাকে বলেছি। আবার কেন এটা জিজ্ঞেস করছেন?

– দেখুন আমাদেরকে সবদিক ভেবেই তদন্ত করতে হয়। ঠিক আছে। আপনার কথাই মেনে নিলাম। তবে আপনিই বলুন এই মেয়ে পল্লব সাহেবের ব্যাংক কার্ড কীভাবে পেল আর পাসওয়ার্ডই বা কীভাবে জানল?

– যেভাবে ওর মোবাইল পেয়েছে। আর পাসওয়ার্ডের ব্যাপার হচ্ছে পল্লবের পার্সে ব্যাংক কার্ডের পেছনেও একটা কাগজে এই কার্ডের পাসওয়ার্ড লেখা ছিল। ওই একাউন্টটা ও নতুন করেছিল। পাসওয়ার্ড মনে না থাকত না বিধায় ও লিখে রেখেছিল। এটা আমি নিজে দেখেছি। এই মেয়ে কোনোভাবে হয়ত ওর থেকে ব্যাংক কার্ড জব্দ করেছিল। দ্যাটস সিম্পল! অথচ এ নিয়ে আপনি আমার পল্লবের চরিত্র নিয়ে আজেবাজে বলছেন!

তুহিনের দিকে তাকিয়ে জয়ীতা বলল, চলুন! এনারা এনাদের মতো তদন্ত চালিয়ে যাক। আমরা আমাদের মতো একটু চেষ্টা করি।

জামান সাহেব তুহিনের কাছে আরো কিছু বিবৃতি নিয়ে তখনকার মতো ছেড়ে দিলো।
তুহিন আর জয়ীতা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এখান থেকে দ্রুত বের না হলে ওই মেয়ে আবার না কোথায় লাপাত্তা হয়ে যাবে! যত দ্রুত সম্ভব ওকে ধরতে হবে। না হলে মূল কালপ্রিট ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাবে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here