সুখ_নীড় #পর্ব_৩০,৩১

0
524

#সুখ_নীড়
#পর্ব_৩০,৩১

৩০

তুহিন আজকাল প্রায়ই অফিসের কাজকর্মে অনিয়মিত থাকছে। এটা নিয়ে তার বড়ো ভাই শাহীন তালুকদার ভীষণ ক্ষেপে আছে। সকালে বাসা থেকে বের হবার আগে এসব নিয়ে একদফা বকাঝকা করেছে।

আসলে তুহিন এখন ভীষণ ব্যস্ত মোহনাকে কী করে ট্রেস করা যায় সেটা নিয়ে। এই মেয়েটাকে ধরতে পারলে অনেক কিছুই সলভ হয়ে যেত! তার সম্ভাব্য সবখানে খুঁজেছে কিন্তু তেমন ইতিবাচক কোনো ফলাফল পায়নি। জয়ীতাকে সে কথা দিয়েছে পল্লবের খুনী পর্যন্ত পৌঁছাতে সে সব ধরণের সাহায্য করবে। এদিকে তার ভাইয়ের কাছে এ ব্যাপারে সত্যিটাও বলতে পারছে না। শাহীনের কড়া নিষেধ এসব নিয়ে কোনো ঘাটাঘাটি না করতে। পুলিশ তাদের ডিউটি করছে। এমনিতেই তারা এই মামলার সাথে সন্দেহভাজনের তালিকায় জড়িয়ে আছে। তার উপর তুহিন যদি আবার এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে থাকে তাহলে কীভাবে না কীভাবে ফেঁসে যায় তার খবর আছে!

কিন্তু নাছোড়বান্দা তুহিন কি আর কথা শোনার পাত্র! যাই হোক, সে আজ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আজ সারাদিন অফিসেই থাকবে। বেশ কিছু কাজ পেন্ডিং আছে সেগুলি দেখা দরকার। গতমাস জুড়ে বেশ কিছু মিটিং আর পার্টিতে সে অনুপস্থিত ছিল এটা নিয়েও কড়া ধমক খেয়েছে ভাইয়ের কাছে। সেগুলি থেকে নানান ডাটা কালেকশান করে কয়েকটা ডকুমেন্টস রেডি করতে হবে।

জয়ীতা দূর হতে তাকিয়ে সাজেদা চৌধুরীকে দেখছে।
সাজেদা চৌধুরী তার নাতীকে কোলে নিয়ে আদর করছেন। জয়ীতার সাথে ব্যবহার খুব একটা ভালো না হলেও আগের থেকে অনেকটাই স্বাভাবিক। সে নিজেও ওই ভিডিও ফুটেজ দেখার পরে জয়ীতার উপর অযথা দোষ দেবার কারণে মনে মনে লজ্জিত হলেও জয়ীতার কাছে নিজের ভুল স্বীকার করেনি। জয়ীতা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। আর ওনার মতো মানুষ জয়ীতার কাছে ভুল স্বীকারও করবে না, সরিও বলবে না। এটাও জয়িতা ভালো করে জানে। উনার মত মানুষের কাছ থেকে এটা আশা করা নিতান্তই অমূলক।

তিন চারদিন ধরে ঘনঘন জয়ীতার বাসাতে আসছে। উদ্দেশ্য একটাই নাতীকে আদর করা। আজ এসেই জয়ীতাকে বলেছে আগামী সপ্তাহে ঢাকায় ওনার বাসাতে নিয়ে যাবে। ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে রাখতে। জয়ীতা যেতে রাজি কিনা সেটা একবারও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেনি। সরাসরি অর্ডার ব্যাগপত্র গুছিয়ে ওনার বাসাতে যেতে হবে! যে বাসাতে থাকার জন্য কত যুদ্ধ করেছে হঠাৎ সেখানে জয়ীতার এত কদরের কারণ যে তার ছেলে। এটা জয়ীতা জানে। এজন্যই খুব ভয় হচ্ছে। এই মানুষটা স্বার্থ ছাড়া এক পাও চলার কথা না। তার ভয় হচ্ছে তার ছেলেকে না তার বুক থেকে কেড়ে নেয়। জয়ীতাকে যে সে কিছুতেই ও বাড়িতে খুব বেশি সময় টিকতে দিবে না এটা নিশ্চিত। খুব ভয় হচ্ছে ছেলেটাকে নিয়ে।
এত এত দুশ্চিন্তার মাঝে এখন পর্যন্ত তার ছেলের নাম পর্যন্ত রাখা হয়নি। কী নাম রাখবে! তার ছেলেকে নিয়ে যার অঢেল স্বপ্ন ছিল সেই মানুষটাই নেই। জয়ীতা শুধু ভাবে একটাই তো জীবন! সেই জীবনে এত না পাওয়া এত অপ্রাপ্তি এত কষ্ট কেন? কেন পল্লব এভাবে চলে গেল? বুক ভেঙে কান্না আসে। কান্নাটাকে খুব আটকাতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না! রাতভর তার চোখের পানিতে বালিশ ভিজে।

সাজেদা চৌধুরীর কথায় জয়ীতা কোন উত্তর না করায় সে আবারো বলল, শুনতে পেয়েছ আমি কি বলেছি? খুব তাড়াতাড়ি করে ফেলবে। নেক্সট উইকে তুমি ঢাকাতে যাচ্ছ। আমার বাসায় থাকবে। এই পরিবেশে আমার নাতীকে রাখা যাবে না। এমনিতেই ও আন্ডার ওয়েট। তার উপর যত্নআত্তি ঠিকমত হচ্ছে না। তুমি বাচ্চাদের যত্নই ঠিকমত বোঝো না। আমার যা মনে হয় ওর জন্য একটা প্রপার ট্রিটমেন্ট দরকার। প্রপার এনভায়রনমেন্ট দরকার। আমি আমার নাতীকে শহরের বেস্ট ডাক্তার দিয়ে ট্রিটমেন্ট করাব ওর জন্য যা যা দরকার সব করব। ওর জন্য একটা ভালো পরিবেশ দরকার।

অতএব এখানে একমুহূর্ত না। তেমাকে সাত দিন সময় দিলাম সবকিছু গুছিয়ে ফেলো। অবশ্য এখান থেকে কোনকিছুই নিতে হবে না। শুধুমাত্র তুমি তোমার কাপড় চোপড় নেবে আর যা কিছু আছে সেগুলো কী করবে না করবে সেটা তোমার ব্যাপার।

জয়ীতা সাহস সঞ্চার করে বলল, আমি এখান থেকে যেতে চাই না। আমি এই সংসারের আনাচে-কানাচে যেখানে যাই দেখছেন সবখানে আমার পল্লবের হাতের ছোঁয়া পাই। আমি এসব কিছুই হারাতে চাই না আর আমি বাসা থেকেও যেতে চাই না আমি এখানেই থাকব। আমি এখানে পল্লবের গায়ের ঘ্রাণ পাই যা অন্যখানে পাব না।

– এসবের মানে কী? তুমি বললেই হলো? ও বাসাতে যেয়েও পল্লবের ভাবনায় ডুবে থাকবে সমস্যা কোথায়? ওখানেও তো তুমি ছিলে একসময়।

– হ্যাঁ ছিলাম। কিন্তু যে সময়টা ওখানে ছিলাম ওই সময় তো ছিল সম্পূর্ণ তিক্ততায় ভরা । ওই বাসাতেই কোন সুখস্মৃতি আমি হাতরে হাতরব মরে গেলেও পাব না। আমি এই বাসাতেই থাকতে চাই কারণ এখানে আমি যতটুকু সময় ছিলাম পল্লবকে নিয়েছিলাম।
আমাদের দু’জনের জীবনের সবচেয়ে মিষ্টি সময়টুকু এখানেই কাটিয়েছি।
আমি চাই আমার বাচ্চাটা এখানে ওর বাবার ছায়া, কায়া, ঘ্রাণ খুঁজে পাক।

সাজেদা চৌধুরী এবার কিছুটা ক্ষেপে গেলেন! তবে নিজেকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, তুমি কি পাগল হয়েছ? এটা কি তোমার বাপের বাড়ি যে তুমি এখানে পড়ে থাকবে? এটা একটা বাসা হলো! কাল বাড়িওয়ালা তোমাকে তাড়িয়ে দিলে থাকবে কই আর কোথায়ই বা হাতড়ে বেড়াবে তোমার সুখের স্মৃতি। আর বাসার খরচই বা চালাবে কি করে? আলাদিনের চেরাগ নিশ্চয়ই নেই তোমার কাছে?

– আমি যেভাবে হোক ম্যানেজ করব।

আমাকে একদম ক্ষেপিও না। আমি তোমাকে তুমি যাবে কি যাবে না সেটা একবারও জিজ্ঞেস করিনি তোমাকে বলেছি সবকিছু প্যাক করো। আর কোনো কথা নেই। এই নোংরা পরিবেশে আর এতোটুকু ঘরে আমার নাতী বড়ো হবে এটা তুমি ভাবলে কি করে? তুমি কি করবে কি না করবে এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তুমি যদি ভালোভালো আমার সাথে যেতে চাও যাবে। না গেলে আমি আমার নাতিকে নিজেই নিয়ে যাব!

জয়ীতা কিছু বলতে যাবে অমনি তার মা ইশারায় নিষেধ করল।

সাজেদা চৌধুরী বেরিয়ে যাওয়ার সময় জয়ীতার মাকে বলল, মেয়েকে বোঝান। নিজের ভালো চাইলে আমার কথার যেন কোনো হেরফের না হয়।

সাজেদা চৌধুরী বেরিয়ে যাবার পরে জয়ীতার মা তার পাশে যেয়ে বসল। সে জয়ীতার চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজেই কেঁদে ফেলল।

– মা রে! আমরা গরীব। গরীবের কথার কোনো মূল্য নেই এই পৃথিবীতে। তুই ওনার সাথে পারবি না মা। আগে তো পল্লব ছিল এখন তুই একা। ওনার সাথে যুদ্ধ করে পারবি না। শুধুই কষ্ট পাবি। তুই তোর ছেলেকে নিয়ে ওনার বাসাতে যা। উনাকে তো জানিসই। ওনার কথার ব্যত্যয় হলে কী করতে পারে জানিসই তো!

আমরা ওনার সাথে পারব না, মা। তাছাড়া বাবুর তো আসলেই ভালো ডাক্তার দরকার! তুই একা কীভাবে কী করবি? একটু ভাব মা।

– তোমার কী মনে হয় উনি আমাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিবে? কখনোই না। কী করব বুঝতে পারছি না। বাবুকে নিয়ে পালিয়ে যাব। তুমিও বাড়ি ফিরে যাও।।

– তুই কি পাগল? তোর শাশুড়ির হাত যে লম্বা। তুই যে জঙ্গলেই যাস না কেন সেই জঙ্গল থেকে টেনে নিয়ে আসবে।
শুধুই অশান্তি বাড়বে। তাছাড়া বাবুর জন্য আসলেই ওই বাসা অনেক কম্ফোর্টেবেল। তুই ওনার সাথে চলে যা। আগে দেখ না কী করে! ভালো না হলে পরে দেখা যাবে! আমরাতো আছি।

জয়ীতা বুঝতে পারছে না কী করবে? তার মা তো সত্যি কথাই বলেছে তার পক্ষে এই মহিলার সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব না! একেতো এখন সে সম্পূর্ণ একা। তার উপর সাথে এত ছোট বাচ্চা!
আর কত সহ্য করতে হবে তাকে? উপরওয়ালা এত নিষ্ঠুর কি করে হতে পারে তার সাথে?

তুহিন রুমে বসেই তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কে বললো গত মাসের সব মিটিংয়ের ফাইলপত্র আর সফট কপি তার কাছে জমা দিতে।

তুহিন একটার পর একটা ফাইলপত্র, মেইল ঘেটে ঘেটে নানা ধরনের ডাটা কালেকশন করছে। হাতের কাজ শেষ করে এরপর তুহিন বিভিন্নসময় হওয়া মিটিংগুলোর ভিডিও ওপেন করল। এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রেজেন্টেশন দিয়েছে অনেকেই। তুহিন সেগুলোকে সামারাইজ করবার জন্যই ভিডিও দেখছে।
ভিডিও দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা জায়গায় তার চোখ আটকে গেল। এ সে কাকে দেখছে?

এদিকে সাজেদা চৌধুরীর বাসায় ফিরে সার্ভেন্টদেরকে বলল, পল্লবের রুম রেডি করতে। মনে মনে ভেবেছিল সপ্তাহখানেক পরে তার নাতীকে নিয়ে আসবে কিন্তু আজকে জয়ীতার ব্যবহারে সে ভীষণ রেগে গিয়েছে। জয়ীতাকে এক সপ্তাহ সময় দেওয়ার মতো মানসিকতা এখন আর তার নেই। আগামীকাল বা পরশু দুই-একদিনের মধ্যেই জয়ীতাকে আর তার নাতীকে এখানে নিয়ে আসবে।

সে নিজে যেয়ে তদারকি করছে রুমের কোথায় কী সাজানো হবে, কোথায় কী রাখা হবে। তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে আরো কী কী ফার্নিচার এখানে সংযোজন করতে হবে সে বিষয়ে অর্ডার দিলো।

এতক্ষণ ধরে দূরে দাঁড়িয়ে চৈতী শাশুড়ির কর্মকাণ্ড দেখছিল। গুটি গুটি পায়ে কাছে এসে দাঁড়ায়।

– কী ব্যাপার! কিছু তো বলবে? তোমাকে দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি কিছু জানতে চাচ্ছ!

– না, মানে আমি বলছিলাম কি পল্লবের রুমটা এভাবে সাজাচ্ছেন ওখানে কে থাকবে? এত তোড়জোড় করে রুম সাজাচ্ছেন এজন্য বলছিলাম আরকি!

– স্ট্রেঞ্জ! তুমি এখনো বুঝতে পারোনি? আমি এ বাড়িতে এ বাড়ির ভবিষ্যৎ ওয়ারিশকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি, পল্লবের ছেলেকে নিয়ে আসছি । কী বলো!

শাশুড়ির এমন ধরনের কথায় চৈতি কিছুটা হোঁচট খেলো এভাবে কথা শুনবে সে আশা করেনি কখনো।

মনে মনে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলো চৈতী । তার মানে পল্লবের ছেলে আসছে সাথেও জয়ীতাও আসছে। মেয়েটার দম আছে ভেবে মনে মনে এক চোট প্রশংসাও করল জয়ীতার।

তার শ্বাশুড়ীর সাথে যুদ্ধ করে জয়ী দল জিতেছে এটা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু তার শ্বাশুড়ীর যেভাবে ওয়ারিশ নিয়ে আসছি, অমুক করছি, তমুক করছি এসব শুনে মেজাজটা চরম বিগড়ে যায়।

চৈতী সেখানে আর কোনো কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। কল্লোলের কাছে সবকিছু খুলে বলল।

রাতে খাবার টেবিলে কল্লোল জয়ীতার ব্যাপারে তার মায়ের কাছে প্রশ্ন তুলল।

– আমি শুনলাম তুমি নাকি ওই জয়ীতাকে আবার এ বাড়িতে ঢোকাতে চাচ্ছ?

সাজেদা চৌধুরী ভাত মাখতে মাখতে প্লেট থেকে মাথা না তুলেই বললেন, সমস্যা কি তোমাদের?

– আম্মি, তুমি ওকে কী করে হজম করতে পারবে? ভুলে গেছ সব?

– কিছুই ভুলিনি। ওকে হজম করছে কে?

– মানে?

– আমি শুধুমাত্র বাচ্চাটার জন্য এটা করছি। সে আমাদের বংশের রক্ত। আমার নাতী তো যে সে স্থানে থাকতে পারে না

– তার মানে ওই বাচ্চাটার জন্য করছ?

– হুম। এটাই তো বললাম।

– তাহলে ওই জয়ীতা?

– বাচ্চাটা তুমি আর চৈতী এডাপ্ট করবে! তোমাদের পরিচয়ে সে বড়ো হবে!

আচ্ছা এসব চিন্ত পরে করি। আগে তো নিয়ে আসি। আল্লাহ আল্লাহ করো। পরে দেখা যাবে কী দিয়ে কী করি। একটা ছেলে তো জন্ম দিতে পারোনি। এবার পল্লবের বাচ্চাটাকে বাবার আদর আর মায়ের আদর দিয়ে তোমরাই মানুষ করবে। ওই জয়ীতা তো জাস্ট দুই দিনের মেহমান।

কল্লোল এবং চৈতীর মুখে যেন হাসি ফুটে ওঠে। এটা তো তারা ভাবেনি! তার মা আসলেই জিনিয়াস। এই সময়ের মাঝে কত কী ভেবে ফেলেছে। বাহ!

চলবে…..

#সুখ_নীড়
#পর্ব_৩১

জয়ীতা অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার ছেলেকে নিয়ে সাজেদা চৌধুরীর সাথে তার বাসাতে আসে। এ বাড়িতে পা রাখতেই বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। এ বাড়ির সাথে তার কত শত স্মৃতি পল্লবকে ঘিরে। থাকুক তাতে তিক্ততা! তবুও তো এখানেই তো তার সাথে পল্লবের একটা দীর্ঘ সময় ধরে থাকা হয়েছে।
এ বাড়ি থেকে পল্লবের হাত ধরে বেরিয়ে যাবার সেই দিনের কথা আজও তাজা! সেদিনও কি সে ভেবেছিল এ বাড়িতে সে আবারও ফিরবে কিন্তু সেই সময় তার সাথে থাকবে না পল্লব।

পল্লবের রেখে যাওয়া একমাত্র স্মৃতি, তাদের ছেলেকে নিয়ে এভাবে একা এ বাড়িতে ফেরা হবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে। তার যে শাশুড়ি এ বাড়ি থেকেই একদিন তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল। আজ আবার সেই শাশুড়িই তাকে আদর করে ঘরে তুলছে। যদিও এর মাঝে কোনো ছল আছে কিনা এটা এখনো জানে না! জয়ীতার মা জয়ীকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। সে কিছু করতেও পারছেন না। কীভাবে মেয়েকে আর নাতীকে রক্ষা করবেন সেই বুদ্ধিও পাচ্ছেন না। জয়ীতার শাশুড়িকে তার একফোঁটাও বিশ্বাস নেই।
কিন্তু উনার সাথে পারার মতো ক্ষমতাও তার নেই।

জয়ীতা আর তার ছেলের গ্রাণ্ড ওয়েলকাম করল চৈতী। এতটা একদমই আশা করেনি জয়ীতা।
আসার পর থেকে তার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করছে সবাই। তাকে তার রুমে নিয়ে আসা হলো। এই রুমেই সে থেকেছে পল্লবের সঙ্গে। সবই আগের মতো আছে শুধু মানুষটা আর নেই।

কষ্টে গলাটা বুজে আসে তার। তার সাথে সবার ব্যবহার আর সবার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখে শুধু তার মনে হচ্ছে এই আচরণটুকু যদি পল্লব থাকতে তার সাথে করা হতো! পল্লব কতই না খুশী হতো! ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।

তুহিন দ্রুত অফিসের ফাইলপত্র সব কোনোরকমে গুছিয়ে রেখে কাউকে কিছু না বলেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে সাথে সাথে ফোন দিলো জয়ীতাকে। জয়ীতাকে তেমন কিছু না জানিয়ে শুধু বলল, দ্রুত থানায় আসো। আমি অপেক্ষা করছি।

এর মধ্যে জয়ীতার সাথে তুহিনের কথাবার্তা তুমিতে গড়িয়েছে। বয়সে তুহিন কিছুটা ছোটো হলেও তারা দুইজন এখন অনেকটা বন্ধুর মতোই। এই একজন মানুষকেই জয়ীতা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে।

জয়ীতা এ খবর যেয়ে তার শাশুড়িকে জানাল। সাজেদা চৌধুরী এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে দ্রুত জয়ীতাকে নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।

থানায় পৌঁছাতেই তুহিনের কাছে তারা যেটা শুনল তাতে তাদের চোখ ছানাবড়া। মোহনার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। খোঁজ পাওয়া গিয়েছে বলতে মোহনা কোথায় আছে সেটা এই মুহূর্তে না জানা গেলেও মোহনা কার আশ্রয়ে আছে এটা বুঝতে পেরেছে তুহিন।

মিটিং এর ভিডিওতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মোহনা হান্নান সাহেবের বড়ো ছেলে মাসুদের গেস্ট। তার সাথে বেশ হৃদ্যতা রয়েছে মোহনার। শাহীন সাহেবদের কোম্পানির সাথে হান্নান সাহেবের বিজনেস বেশ পুরানো।
তাদের অফিসে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বা পার্টি থাকলে হান্নান সাহেব বা তার বড়ো ছেলে দাওয়াত পায়।

সেদিনের একটা ডিনার পার্টিতে মাসুদের সাথে মোহনাও ছিল। ভিডিও ফুটেজ দেখার পরপরই তুহিনের সব খোঁজখবর নেয়া শেষ। মাসুদের বউ বাচ্চা থাকতেও মোহনার সাথে ইলিগ্যাল রিলেশান তার! মোহনা তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য মাসুদের পোষ মানা ময়না হয়েছে। মোহনার সাথে ওই রাতে এই মাসুদই হয়ত ছিল। মোহনাকে পুলিশ কাস্টডিতে আনতে পারলেই সব ক্লিয়ার হওয়া যাবে।

কিন্তু তুহিনের মাথায় আসছে না মাসুদ কেন পল্লবকে মারতে যাবে। তার সাথে কী সম্পর্ক?

তুহিনের কাছে এসব কথা শুনে জয়ীতা ভীষণ ভেঙ্গে পড়ে। তার কাছে এখন অনেক কিছুই পরিষ্কার। পল্লবকে কতবার সে নিষেধ করেছে হান্নান সাহেবের সাথে কোনো ঝামেলায় না জড়াতে। ওই পেট্রোল পাম্পই তাহলে কাল হয়ে দাঁড়াল তাদের জীবনে।

তুহিন স্টেটমেন্ট দেবার জন্য পুলিশ স্টেশনের ভেতরে ঢুকল।

এ সময় জয়ীতা তার শাশুড়ি সাজেদা চৌধুরীর কাছে সবকথা বলে। সাজেদা চৌধুরীর তো মাথায় হাত! হান্নান সাহেবকে সে ঘুনাক্ষরেও সন্দেহ করেনি। একজন বাবা কী করে তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে! বুকটা কেঁপে উঠল তার।

সারারাত ঘুম হলো না তার। সকালের দিকে কোনোমতে একটু ঘুম হলো। ঘুমে অচেতন তখন দরজা নক করার শব্দে তড়িঘড়ি করে উঠে সে দরজা খুলল।
খুলে দেখ তার শাশুড়ি সাজেদা চৌধুরী এসেছেন।

– এক্ষুণি রেডি হও। পুলিশ স্টেশন থেকে কল এসেছিল। দ্রুত যেতে হবে। মোহনাকে গতকাল রাতেই এরেস্ট করা হয়েছে। তোমাকে নিয়ে যেতে হবে। ঐ রাতের ব্যাপারে তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

জয়ীতা এত ভালো একটা খবর এত দ্রুত পাবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। তার ছেলেকে কার কাছে রেখে যাবে এটা নিয়ে চিন্তা করলে তার শাশুড়ি তাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলে। চৈতী দেখে রাখবে বলে আশ্বস্ত করে।

থানায় পৌঁছে মোহনাকে দেখতেই চিনতে পারল জয়ীতা। এই তো সেই মেয়ে যে ঝড় বাদলের রাতে তার বাসাতে আশ্রয় নিয়েছিল। আর এর কাছেই পল্লবের ফোন পাওয়া গিয়েছিল।
জয়ীতা রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে পুলিশের সামনেই মোহনার চুলের মুঠি ধরে চিৎকার করে ওঠে । এত জোরে ধরেছে যে মোহনা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে।

জয়ীতার আচরণেই পুলিশ ইন্সপেক্টর বুঝতে পারল এই মোহনাই মূল কালপ্রিট।

জয়ীতা যতবার চিৎকার করে পল্লবকে কেন মেরেছে এটা জিজ্ঞেস করছে মোহনা ততবারই অস্বীকার করছে। সে কিছুই জানে না বলে নিজেকে নির্দোষ দাবি করছে। পরে একে একে সেদিন রাতের ঘটনাঃ কী করে সেদিন সে চলে যাবার পরে পল্লবের ফোন পাওয়া গেল, ব্যাংকের বুথে মোহনার ভিডিও ফুটেজ এসব দেখানো হলো।
কিন্তু মোহনা এতটাই নাছোড়বান্দা যে এসব দেখার পরেও মুখ খুলতে চাচ্ছিল না।

সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল মোহনার পেট থেকে সত্যি কথা বের করতে। এর জন্য বেশ কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে একজন নারী কনস্টেবলকে। বেশ মতো ডোজ পড়ার পরেই সে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছে।

মোহনার স্টেটমেন্ট থেকে জানা যায়, বেশ কিছুদিন ধরেই পেট্রলপাম্প নিয়ে হান্নান সাহেবের সাথে এবং তার বড় ছেলে মাসুদের সাথে বাকবিতন্ডা হচ্ছিল। হান্নান সাহেব না পারছিল তার ছেলের কাছে পল্লবের ব্যাপারে সব কথা বলতে আবার না পারছিল পল্লবকে পেট্রলপাম্প দেয়ার ব্যাপারে না করতে।

শেষমেষ অনেক উপায় করে মাসুদ তার বাবার পেট থেকে পল্লবের ব্যাপারে সব কথা উদ্ধার করে। হান্নান সাহেব নিরুপায় হয়ে তার সাথে পল্লবের সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। এরপর থেকেই পল্লবকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মাসুদের ছক কষা শুরু হয়। সে ভয় পাচ্ছিল পল্লব লিগ্যালি তার বাবার সম্পদের জন্য যদি আদালতের শরণাপন্ন হয় তাহলে পেট্রলপাম্প তাদের হারাতে হবে । হান্নান সাহেব এর কিছুই জানতেন না। তবে মাসুদ যা কিছু করত মোহনা সবকিছুই জানত। বেশ কিছুদিন ধরেই প্লান করছিল কি করে পল্লবকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়।

সেদিন রাত ছিল তাদের জন্য একটা উত্তম সময় । পল্লব তাদের পেট্রোল পাম্প থেকেই গাড়িতে তেল ভরে বিরুলিয়ার দিকে যাচ্ছিল। সেই সময় পেট্রলপাম্পের অফিসে মাসুদ এবং মোহনাও ছিল।

প্লান অনুযায়ী পল্লবের গাড়ির পিছু নেয় তারা। বেশ কিছুক্ষণ পিছু নেওয়ার পরে এমন জায়গা খুঁজছিল যেখানে যেয়ে তারা পল্লবের গাড়িকে এমনভাবে ধাক্কা দিতে পারে যাতে ধাক্কা খেয়েই গাড়ির বারোটা বেজে যায় আর সাথে পল্লব। এমনভাবে ঘটনা সাজাতে চেয়েছিল যাতে এটা সবার কাছে দুর্ঘটনা বলে মনে হয়। তাছাড়া সেদিন চারপাশে ঝড়-বৃষ্টি এত পরিমান হচ্ছিল যে রাস্তায় অন্য কোনো মানুষজন ছিল না।

পল্লব খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল। সহজে তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না তারা। বেশ কিছুক্ষণ অনুসরণ করার পরে তাদের সুযোগ আসে। পল্লব চালাচ্ছিল বেশ আগের মডেলের একটি করোল্লা গাড়ি। গাড়িটা অনেকটাই হালকা এবং কন্ডিশনও খুব বেশি ভালো না। সেই তুলনায় মাসুদের হ্যারিয়ার জিপটা অনেক মজবুত।

একটা বাঁকের মতো জায়গায় যেয়ে সে পল্লবের গাড়িটা বাগে পেল। গাড়িতে তার গাড়ী দিয়ে খুব জোরে ধাক্কা দিলো। পরপর কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার পরে গাড়িটা সামনে একটা গাছের সাথে বেশ জোরে যেয়ে আছড়ে পড়ল। পল্লবের গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। দূরে বসে এটা এনজয় করছিলো হান্নানের ছেলে মাসুদ এবং মোহনা।

বেশ খানিকক্ষণ কেটে যাবার পরেও যখন পল্লবের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তখন মাসুদ নিশ্চিত হওয়ার জন্য পল্লবের গাড়ির কাছে মোহনা কে পাঠালো। সে নিজে গেল না যদি পল্লব বেঁচে থাকে তাহলে তাকে দেখে হয়তো চিনতে পারবে সেই ভয়ে।

মোহনা গাড়ির কাছে যেয়ে দেখল, পল্লব গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল এর উপরে উপুর হয়ে আছে। মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পুরো মুখ ঢেকে গেছে।
হঠাৎ করে মোহনাকে লোভে পেয়ে বসলো। সে তড়িঘড়ি করে পল্লবের পকেটে হাত দিয়ে তার আইফোন এবং মানি ব্যাগটা নিয়ে নিল। এটা অবশ্য মাসুদের অজানা ছিল।

নিচু হয়ে পল্লবের পকেটে হাত দেওয়ার সময় মোহনার মনে হচ্ছিল পল্লব তখনও বেঁচে আছে। সে একথা এসে মাসুদকে জানালে মাসুদ কিছুটা ঘাবড়ে যায়। তার ভয় হয় পল্লব যদি বেঁচে যায় তাহলে তার সব কষ্টই বৃথা।

শেষে আরেকটা উপায় বের করে। সে পল্লবের গাড়ি নিয়ে তুরাগ নদীতে ফেলে দেওয়ার প্ল্যান করে। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। পল্লবের মৃত্যুও যেভাবে নিশ্চিত করা হবে অন্যদিকে সব প্রমাণও মুছে ফেলা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে মোহনাকে বলল, তার গাড়িটাকে ড্রাইভ করে রাস্তার উল্টোদিকে নিয়ে চলে যেতে যাতে কেউ যদি পল্লবের গাড়ি দেখেও ফেলে তাতেও সমস্যা নেই যদি তার গাড়িটাকে সেফ রাখা যায়।

মাসুদ পল্লবসহ পল্লবের গাড়ি নিয়ে তুরাগ নদীতে ফেলে দেয়। আর এদিকে মোহনা তড়িঘড়ি করে খানিকদূর যেতেই দেখে সামনে বিশাল এক গাছ পড়ে আছে অর্থাৎ সেখান থেকে সামনে যাবার কোনো উপায় নেই। পেছনেও ফেরার সাহস করছিল না যাতে পল্লবের গাড়ির পেছনে কোনো গাড়ি পিছু করছিল এমন প্রমাণ না মিলে।

পরে বাধ্য হয়ে সে জয়ীতার বাসাতে আশ্রয় নেয় কিন্তু তখন সে জানত না এই বাড়িটাই পল্লবের বাড়ি যাকে কিছুক্ষণ আগেই তারা মতো মেরে ফেলেছে।।
পল্লবের ফোনটা লক করা থাকায় সে ফোনটাকে বন্ধ করতে পারছিল না।

জয়ীতা যখন তার বাসাতে মোহনা থাকা অবস্থায় পল্লবের নাম্বারে ফোন দিয়েছিল স্ক্রিনে তখন পল্লব এবং জয়ীতার একটা ছবি ভেসে ওঠে। এটা দেখে ভীষণ ঘাবড়ে যায় মোহনা। সে তড়িঘড়ি করে ফোনের রিংটোন যাতে জয়ীতার কান পর্যন্ত না পৌঁছাতে পারে তাই সোফার কুশনের নিচে চাপা দিয়ে রাখে। এবং বুঝতে পারে এটা পল্লবেরই বাসা।

এরপরে খুব তাড়াতাড়ি করে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে মোহনা। যাবার সময় ভয়ের চোটে পল্লবের ফোনটা আর নেওয়া হয় না। মনে মনে খুব আফসোস করে ফোনটার জন্য। কিন্তু পরে সেটা কাটিয়ে ওঠে পল্লবের মানিব্যাগে তার ব্যাংকের কার্ড পেয়ে।
পল্লব মাত্র কিছুদিন আগে এই একাউন্টটা খুলেছিল। তার ব্যাংক থেকে পাওয়া পাসওয়ার্ড নতুনভাবে রিসেট দেওয়া হয়নি তখনো। পাসওয়ার্ডটা মনে থাকে না বলে সে যে কাগজে পাসওয়ার্ডটা লিখা ছিল সেটা ভাজ দিয়ে কার্ডের পেছনে কার্ডের কাভারের সাথে রেখে দিয়েছিল ।

মোহনা তো পাসওয়ার্ড পেয়ে তো মহাখুশি। সে মাসুদকে আর এসব কিছু জানায় না। ইচ্ছেমতো সুযোগ বুঝে পল্লবের একাউন্টের টাকাগুলি তুলে ফেলে। লাখ তিনেকের মতো টাকা ছিল পল্লবের ওই একাউন্টে।

মোহনার কাছে এসব শুনে জয়ীতার দম আটকে আসে। তার মন চায় ওর গলা চেপে দম বন্ধ করে মেরে ফেলে। চিৎকার করে মোহনাকে গালাগাল করতে থাকে। পল্লবের উপর চালানো এসব অত্যাচারের কথা শুনে সাজেদা চৌধুরীর মাথায় হাত।।।

সাজেদা চৌধুরীর ছেলে টাকার অভাবে হান্নান সাহেবের কাছে পেট্রোল পাম্পের দাবী করেছিল। সে যদি সেদিন তার আদরের ছেলেকে তার জীবন থেকে বের করে না দিত তবে এসব কিছুই হতো না। তার ছেলেই নেই তবে এত অঢেল সম্পদ দিয়ে কী হবে!

চোখদু’টি টকটকে লাল করে তাকিয়ে আছে অদূরে বসে থাকা জয়ীতার দিকে।
” এই সবকিছুর জন্য এই ডাইনীটাই দায়ী। ” দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলতে থাকে ।
“তুই আমার বুক খালি করেছিস , এবার আমি তোর কোল খালি করব”। বলে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে।

দুইদিনের মধ্যে মাসুদ এবং তার বাবা হান্নান সাহেবকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কল্লোল প্রথমে কোনো কিছু স্বীকার করতে না চাইলেও পরে যখন দেখল বাঁচার কোনো উপায় নেই পরে সব অন্যায় স্বীকার করল। তাছাড়া মোহনা এখানে সবচেয়ে বড়ো স্বাক্ষী।
হান্নান সাহেবকে সপ্তাহ দুয়েক জেলে রেখে পরে ছেড়ে দেওয়া হলো।

যতই দিন যায় জয়ীতার কষ্টগুলি যেন নতুনভাবে তাকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে। এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না পল্লবকে। পল্লবের মৃত্যুর সময় কতটা কষ্ট পেয়েছে ভাবতেই শিউরে ওঠে। নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়।
ঠিকঠাক ছেলেটার দেখভাল করা হয় না। কেমন বেখেয়ালি হয়ে পড়ে থাকে। সারাক্ষণ শুধু পল্লবের ভাবনায় ডুবে থাকতে থাকতে তার ছেলেটা যে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।৷ তার শাশুড়ি তাদের ছেলের নাম রেখেছে আযান।

আযানকে সারাদিন ওর বড়ো চাচী চৈতীই দেখাশোনা করে। আযানের দোলনা থেকে শুরু করে নিত্যকার সব জিনিসপত্র বেশিরভাগই চৈতীর ঘরে। জয়ীতা রাতে ঘুমানোর সময়টুকু শুধু কাছে পায় ছেলেকে।
জয়ীতাকে ব্রেস্ট ফিডিং করানোরও সুযোগ দেওয়া হয় না ঠিকঠাক। বাইরের দুধই বেশী খাওয়ায় আযানকে।
জয়ীতা প্রথমে ভাবে এটা হয়ত ভালোবাসা থেকেই চৈতী করছে। একেতো তার মানসিক অবস্থা ভালো না। তার উপর আযান এ বংশের একমাত্র ছেলে। এ জন্য হয়ত দাদী, চাচা, চাচী সবাই এত আদর করে। সেও এটাকে স্বাভাবিক মনে করত! তাছাড়া সে নিজেও খুব অযত্ন করছিল বাচ্চাটার। উনারা এত দেখভাল করছে ভেবে কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকত।

এভাবে মাসখানেক কেটে গেল।
জয়ীতাকে হঠাৎ একদিন সেই যে বোবা খালা যে তাকে তার শাশুড়ি সাজেদার হাত থেকে বাঁচাতে ছেড়ে দিয়েছিল উনি এসে ইশারায় বোঝাতে চেষ্টা করে যে তার ছেলেকে তার থেকে কেড়ে নেবার প্লান হচ্ছে এ বাড়িতে। জয়ীতা প্রথমে বিশ্বাস করতে না পারলেও হঠাৎ খেয়াল করল সত্যিই তো এ বাড়ির মানুষেরা সবাই আবার তাকে এভয়েড করতে শুরু করেছে। খাবার সময় সবাই একসাথে বসার নিয়ম । অথচ ইদানীং তার ডাক পড়ে না। সে কিছুটা স্বাভাবিক আগের থেকে। চৈতী যেহেতু বাচ্চাটার দেখভাল করে তাই সে সংসারের টুকিটাকি কাজকর্ম দেখত। সার্ভেন্টদের কী করতে হবে না হবে এসব বুঝিয়ে সুঝিয়ে দিত।
কিন্তু সবাই মিলে যখন খেতে বসত তখন তাকে আর এখন কেউ ডাকে না। তার সাথে তেমন কথাবার্তাও বলে না। আবার আজ ক’দিন ধরে তার বাচ্চাটাকেও তার কাছে দেয়া হয় না। রাতের বেলাতে আগে কাছে পেলেও এখন সেটাও পাঠায় না। এতদিন কোনোকিছু জোর করে বলেনি সে ভেবেছে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে সবকিছু দেখে আর ওই খালার কথা শুনে তার বুকের মাঝে কেঁপে ওঠে। কী হতে চলেছে ভেবে শঙ্কিত হয়ে যায় জয়ীতা।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here