#সুখ_নীড়
#পর্ব_৪
হাসপাতালের বেডে বসেই জয়ীতা সিদ্ধান্ত নিলো সে আর পল্লবের সংসারে ফিরবে না। জানে এটা তার জন্য খুব কঠিন সিদ্ধান্ত। কিন্তু সে মনস্থির করেছে যে আর কিছুতেই ও বাড়িতে নিজেকে এত অপমান করাতে চায় না। পল্লবের থেকে সে কিছুই নিবে না। পল্লব তাকে ছাড়া সুখী থাকতে চাইলে সেখানে জোরাজুরি করে আর কী লাভ! অনেক তো হলো। চেষ্টা তো সে আর কম করল না! সে পরাজয় মেনে নিয়েই পল্লবের সাথে সম্পর্কের ইতি টানতে নিজেকে প্রস্তুত করল। কিন্তু এ কথা কাউকেই জানাল না সে। এমনকি যে পল্লব এতদিন ধরে চাইছিল সে চলে যাক, সেই পল্লবকেও না।
পল্লব হসপিটালের বিল সকালেই ক্লিয়ার করে বলে গিয়েছে বারোটার দিকে এসে জয়ীতাকে নিয়ে যাবে।
সে তাকে রেডি থাকতে বলে গেছে।
পল্লব বেরুবার কিছু পরেই জয়ীতা বেরিয়ে যায় হসপিটালের বেড ছেড়ে৷ শরীরটা প্রচণ্ড রকম খারাপ। এক পা হাঁটলে যেনো দু’পা পিছিয়ে যাচ্ছে। তারপরও তার যেতে হবে। অনেক দূরে যেতে হবে! এ লোকালয় ছেড়ে বহুদূর!
বারবার ফোনটা বেজে যাচ্ছে তার। হাতে নিয়ে দেখল তার মা কল দিয়েছে। কথা বলতে ইচ্ছে হলো না তার। কোনো আপন মানুষকেই আর আপন মনে হয় না কেনো যেনো। সবাই নিজেকে নিয়েই ভাবতে চায় যেনো।
মায়ের কলটা কেটে দিয়ে নাম্বারটা ব্লক করে রাখল। তার কাছে মনে হয় সবাই তাকে প্রয়োজনে শুধু ব্যবহার করছে। প্রয়োজন শেষে ডাস্টবিনের আবর্জনা সে। এই আপন মানুষগুলির থেকে দূরে কোথাও যেতে চায় ।
সকাল থেকে সাজেদা বেগমের মেজাজ তিরিক্ষি। পল্লবের গতিবিধি আজকাল তার কেনো যেনো মোটেই ভালো ঠেকছে না। ছেলেটা কেমন যেনো বদলে গেছে। কোনোকিছুতেই আর আজকাল সিরিয়াস না৷ উলটা তার উপর নানান সময়ে এটা ওটা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
পল্লব হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল। সাজেদা বেগম মাত্র অফিসের জন্য রেডি হয়ে নিচে নেমেছে।
পল্লবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,
– কী খবর! আজকাল তো তোমাকে দেখাই যায় না! কোথায় থাকো? অফিসেও ইরেগুলার! নাকি বউয়ের পাশের বেডটায় একদম গেড়ে বসেছ পাহাড়া দেবার জন্য!
পল্লবের এসব কথা কানেও গেল না। সে উলটা প্রশ্ন করল, আমি কি জানতে পারি দেওয়ান বিল্ডার্সের কাছে কন্ট্রাক্ট কী করে গেল?
– সেটার আমি কি জানি? এই প্রজেক্ট তো তোমার দায়িত্বেই ছিল। আমাকে আবার এর মাঝে কেনো?
– আম্মি, এমন ভাব করো না যেনো তুমি কিছুই জানো না। ইউ নো এভ্রিথিং! কতবার বলেছি এই প্রজেক্ট ওদেরকে দেওয়া যাবে না। ওদের মতো কালপ্রিট স্বভাবের মানুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ আছে কিনা সন্দেহ! ওরা ওখানে যেসব অসামাজিক কাজ করবে তাতে মানুষের উপকার কিছু তো হবেই না বরং অনেকগুলি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর সবকিছু খুলে বলার পরেও তুমি ওদের সাথে ডিল ফাইনাল করে ফেললে? তোমার কাছে সবকিছুর উপরে টাকা আর স্বার্থ, তাই তো!
– তোমাকে কত বার বলব, আমি এসবের কিছুই জানিনা। চড়া গলায় উত্তর দিলেন, সাজেদা বেগম।
– বাহ, ” আমি এসবের কিছুই জানি না “…এগুলো বলে দায় এড়ানো যায় না। একটা ছোট বাচ্চাও বুঝবে কাজটা কে করেছে! তুমি ছাড়া এ কাজ আর কেউ করবে না! সারা জীবন শুধু নিজের স্বার্থটাই দেখে গেলে, আম্মি। কৈফিয়ত চাওয়ার সুরেই কথাগুলো বলে পল্লব।
– হাউ ডেয়ার ইউ!
এত সাহস কোথা থেকে পাও? তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো ভুলে যাও নি আশা করছি? তোমার মা আজ পর্যন্ত কারো কাছে জবাবদিহি করেছে এটা নিশ্চয়ই দেখনি তুমি। আর এখন পর্যন্ত করতে বাধ্যও নই সেটাও তুমি ভালো করেই জানো। তারপরেও যেহেতু তুমি জানতে চাইছ তাই তোমার ভুল ভাঙানোর জন্য বলছি এই কাজটা আমি করিনি এটা ঠিক, তবে কল্লোল করেছে।
– হোয়াট? ভাইয়া? ভাইয়া কোথা থেকে এলো?
– তুমি যেভাবে তোমার বউ নিয়ে হসপিটালে দিন দিন দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছ সেক্ষেত্রে তোমাকে ছাড়া আমার তো অন্য একটা অপশনে যেতেই হবে, তাই না? তোমার আশায় বসে থাকলে আমার বিজনেস চলবে না। তাই দায়িত্বটা আমি কল্লোলকে দিয়ে দিয়েছি।
পল্লব এবার ক্ষেপে বম্ব হলো।
সে বলল, এমন তো কথা ছিল না। মানুষের সমস্যা থাকতেই পারে। প্রজেক্টটা আমি এতদূর হ্যান্ডেল করার পরে আমাকে কিছু না বলে হঠাৎ করে ভাইয়ার কাছে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার আগে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করলে না?
– আসলে তুমি কি চাও বলোতো? তুমি কি এখানে আমার সাথে ঝগড়া করতে এসেছ? তুমি যেমন আমার ছেলে, তেমনি কল্লোলও আমার ছেলে। তাছাড়া ভুলে যেও না সে এই বাড়ির বড় ছেলে। তাই যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে সেই আমার ফার্স্ট চয়েজ। শুধু ফার্স্ট চয়েজই বলব না , বেস্ট চয়েজ।
পল্লব রাগে থর থর করে কাঁপছে। নিজেকে কোনরকম সামলে বলল, এই কথাটা বারবার বলে তুমি আমাকে কী মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছ?
– হোয়াট? কী মনে করে করিয়ে দিব? তবে হ্যা, শুধু এটা মনে রেখো এই বিশাল বিজনেস আমার একার জোরে এতদূর টেনে এনেছি। আমার সিদ্ধান্তে কারো প্রশ্ন তোলার রাইট আমি কাউকে দেইনি। আর কল্লোল তোমার বড় ভাই , তাকে রেস্পেক্ট দিয়ে কথা বলবে। বারবার এসব কথা আমি মনে করিয়ে দিতে চাই না।
– সে যতটা না রেস্পেক্ট আমার কাছে পাওয়ার যোগ্য তার থেকে বেশিই দেই। তবে আমি বোধহয় ভুলই করেছি যে যতটুকু সম্মান পাওয়ার যোগ্য তাকে ঠিক ততটুকু সম্মান দেওয়া আমার উচিত ছিল। কোনো অসম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মানের স্থানে বসিয়ে সেখান থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যে কতটা কষ্টের সেটা আমার থেকে বেশি আর কেউ জানে না। তাই তুমিও তোমার বেস্ট চয়েজকে বলে দিও আমার ম্যাটারে নাক গলাতে না আসতে! তাহলে আমিই ভুলে যাব সে আমার বড় ভাই!
– লিমিট ক্রস করেই যাচ্ছ! একটু তো সংযত হও।
– নো ওয়ারিস, আমি সংযতই আছি।
কিছুটা থেমে পল্লব আবার বলল, তুমি কি তাহলে এভাবেই একের পরে এক বড় বড় প্রজেক্ট তোমার বড় ছেলের হাতে হ্যান্ডওভার করে দিতে যাচ্ছ?
– কেন? এটা তোমার কেন মনে হচ্ছে? একটা প্রজেক্টের দায়িত্ব কল্লোল সামলেছে তার মানে এই নয় যে তোমার সব দায়িত্ব আমি তাকে দিয়ে দিচ্ছি। যার যার জায়গা সে সে স্বাধীন এবং স্বাভাবিকভাবে সামলাতে চেষ্টা করো। অযথা ঝামেলা আমার একদম পছন্দ না। তুমি ইদানীং সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করছ। এই বাড়াবাড়ির কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাৎ করে কোথাকার কোন এক পথের মেয়ে বিয়ে করে ঘরে তুললে অমনি এভাবে বদলে গেলে। মাঝেমধ্যে আমি তোমাকে চিনতে পারি না। আমি শুধু ভাবি, এই কি সেই পল্লব? আমার পল্লবকে নিয়ে আমি গর্ব করতাম! কিন্তু কোথায় সে?
আমার মনে হয় এই পল্লবের সাথে আমার কোনো চেনা জানা নেই।
– চেনা জানা না থাকাটাই মনে হয় তোমার জন্য ভালো। তোমার সবকিছুতেই তো এখন আমি পথের কাঁটা। বিড়বিড় করে বলল, পল্লব।
– এসব কী, পল্লব? মায়ের সাথে এ কেমন করে কথা বলছ? এগিয়ে এসে বলল, চৈতী।
চৈতীকে দেখে পল্লবের মেজাজে যেনো আগুনে ঘি পড়ল। সে বিস্ফোরিত নয়নে চৈতীর দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে মা ছেলের কথা হচ্ছে। কোনো তৃতীয় কারো দখলদারীত্ব আমি পছন্দ করছি না।
– চৈতী ফুঁসে উঠে বলল, তোমার মাথা ঠিক আছে তো? আমি এ বাড়িতে কোনো তৃতীয় পক্ষ নয়। আই থিংক তুমি ভুলে গেছ আমি এ বাড়ির একটা অংশ।
– ওহ, ভাগাভাগিও তবে শেষ! বাই দ্যা ওয়ে, কতটুক কী পেলে জানিও।। আফটার অল, আমার ভাগের ব্যাপারেও ক্লিয়ার হওয়া যাবে।
– দেখলেন, আম্মি! পল্লব কেমন বেয়াদবের মতো ব্যবহার করছে!.. সেদিন বললাম আপনি তো বিশ্বাসই করলেন না। ওর যখন যা মুখে আসে তখনই তাই বলে যায়। আজকে তো নিজের কানেই শুনলেন।
– আহ, চৈতী! তুমি এবার এখানে কেন এসেছ? দেখছ না আমরা মা-ছেলে কথা বলছি। আমাদের কথার মাঝে কথা বলা তোমার একদমই ঠিক হয়নি। নিজের রুমে যাও।
আদেশের সুরে বললেন, সাজেদা বেগম।
পল্লব বাসায় আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। রাগে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেল।
হসপিটালের পার্কিং-এ গাড়িটা পার্ক করে মাত্র সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তখনই পল্লবের সামনে এসে দাঁড়াল হান্নান সাহেব।
লোকটাকে দেখেই তার শিড়দাড়া বেয়ে যেন একটা স্রোত বইতে লাগল। পল্লব কিছু বলার আগেই হ্যাচকা টানে হান্নান তাকে নিজের গাড়িতে তুলে নিলো। গাড়ির দরজা আগেই খোলা ছিল।
হান্নান নামক এই লোকটাকে দেখলে ছোটবেলা থেকেই খুব রহস্যময় মনে হতো পল্লবের কাছে। পল্লবকে খুব আদর করত ছোটবেলা। পল্লব অবশ্য কেনো যেন তার এই অতি মাখামাখি পছন্দ করত না। সব কিছুতেই লোকটার বাড়াবাড়ি পর্যায়ের অধিকার খাটানোর অভ্যাস।
লোকটার আচার আচরণ যেমনই হোক এক দেখাতে মনে হবে তার পুরো শরীর থেকে যেন আভিজাত্য ছিটকে পড়ছে। পল্লবের জ্ঞান হবার পর থেকে লোকটাকে যেমন দেখেছে এখনো তেমনি আছে।
মনে হয় না এখন অবধি একটা চুলেও পাক ধরেছে। ক্লিন শেপ, ব্যাক ব্রাশ করা হেয়ার স্টাইল আর সাদা স্যুট এ সবসময়ই ফিটফাট। ওনাকে আজ অবধি সাদার বাইরে অন্য কোনো রঙের ড্রেসেও দেখা যায়নি।
পল্লবকে জোর করে গাড়িতে বসিয়ে সে বেশ জোরেই গাড়ি টান দিলো।
– পল্লব বিরক্ত হয়ে বলল, আপনি এভাবে আমাকে নিয়ে এসেছেন কেনো? এটা কোন ধরণের বিহেভিয়ার?
– নিশ্চুপ!
পল্লবের বিরক্তি আরো বেড়ে গেল। এই লোকটার অত্যাচার তার জীবনে দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। আর সেও নির্বোধের মতো সহ্য করে যাচ্ছে। তার জীবনের সব অন্তহীন সমস্যার মূল এই লোকটা।
– কথা বলছেন না কেনো? গাড়ি থামান, এখনি। আমি নামব। ধমকের সাথেই বলল, পল্লব।
পল্লবের গলার স্বরের থেকেও দশগুণ জোরে ধমক দিয়ে সে বলল, একদম চুপ! মায়ের মতো শুধু অর্ডার করাই শিখেছ। নির্বোধ! একটা কথাও বলবে না। এটা তোমার মায়ের রাজ্য না।
পল্লব কিছু বলতে যাবে তখনই ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিতেই দিকে দেখল স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে “বাবা কলিং….”
হান্নান সাহেবও একবার স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে পল্লবের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাব বোঝার চেষ্টা করল। পরে আবার ড্রাইভিং এ খেয়াল দিলো।
পরপর দু’বার ফোন বাজার পরেও সে রিসিভ না করায় হান্নান সাহেব পাশ থেকে বললেন, হয় কলটা রিসিভ করো নয়তো কেটে দাও। ঘ্যানঘ্যান শব্দে বোরিং লাগছে।
– সব বিষয়ে আপনার উঁচু নাকটা না গলালেই বোধ হয় ভালো হয়। ইটস মাই ফোন। সো আই উইল ডিসাইড হোয়াট টু ডু অর নট!
– নিজে নিজে ডিসিশন যদি নিতেই পারতে তবে এমন বেহাল দশা হতো না। সবকিছু একদম লেজে গোবরে করে ফেলছ দিনদিন । শুরুটা করেছ ওই জয়ীতাকে লাইফে জায়গা দিয়ে। এখন একের পর এক জট লাগিয়েই যাচ্ছ। নিজে ঠিক করতে পারছ না বলেই আমাকে নাক গলাতে হয়।
– আমি তো আপনাকে বলিনি। আমার জীবন আমি বুঝব! আর আমার প্রবলেমগুলি কিন্তু আপনিই বাড়িয়েছেন।
আমার লাইফে আপনার কোনো অস্তিত্ব আমি দেখতে চাই না, প্লিজ।
আমাকে মাফ করুন।
– হা হা হা! আমার অস্তিত্ব দেখতে চাও না! স্ট্রেঞ্জ! জন্মের অস্তিত্ব কী করে ঘুচাবে? পাগলামি করো না একদম! আমি তোমার ওয়েল উইশার। কোনো এনিমি নই।
– আমি আপনাকে স্বীকার করি না।
– তুমি স্বীকার করো আর না করো সত্যি তো আর বদলে যাচ্ছে না। একবার দুইবার নয়, বারবার কনফার্ম হয়েছ। এমনকি যাকে জন্মদাতা বলে মানো তার স্যাম্পলের সাথেও নিজের স্যাম্পল টেস্ট করিয়েছ। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। শত চেষ্টায়ও নিজের সাথে আমার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটুকু তুমি ভুলে থাকতে পারবে না বা অস্বীকার করতে পারবে না। সত্যকে যত তাড়াতাড়ি মেনে নিবে ততই নিজেকে নিজে গুছিয়ে উঠতে পারবে।
পল্লবের চোখ ফেটে যেন আগুনের লাভা বের হবে এমন অবস্থা!
– কিছুটা দ্বিধা নিয়ে পল্লব খানিকক্ষণ পরে বলল, আপনি একটা সত্যি কথা বলবেন!
– অবশ্যই। তোমার সাথে মিথ্যে কেন বলব?.
– এত বছর পরে আপনি এই সত্যটাকে এভাবে আমার সামনে কেনো নিয়ে এসেছেন? আপনারও তো পরিবার আছে! আপনার ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। আমি যদি এখন আপনার আর আমার পরিচয় ওদের কাছে ফাঁস করে দেই কী হবে বলতে পারেন?
– হা হা হা! মায়ের মতো হতে পারোনি একদম। আর আমার মতো তো নয়ই। সবই সোজা করে ভাবো! ভেবে অবাক হই আমার ঔরসের সন্তান ওই বোকাসোকা খালেক সাহেবের মতো কী করে হলে?
– কারণ, সে আমার বাবা। আপনি তাকে একবারের জন্যও বোকাসোকা বলবেন না। রাগে গজগজ করতে করতে বলল, পল্লব।
– বাবা, তবে ভারপ্রাপ্ত বাবা!
পল্লব আরো কিছু বলতে যাবে কিন্তু রাগে গলা থেকে শব্দই বেরুচ্ছে না।
আর কোনো কথা হলো না কারো সাথে। থমথমে একটা অবস্থা বিরাজ করছে। মাঝেমাঝে বিকট শব্দে আসা গাড়ির হর্ণ যেন পল্লবের কানে সীসা ঢেলে দিচ্ছে। কী যে অবস্থা! এই লোকটাকে না পারে ছাড়তে আবার না পারে কাছে টানতে! সে মুখে যতই অস্বীকার করুক সত্য তো আর বদলে যাচ্ছে না। এই লোকই তার জন্মদাতা বাবা। তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা আর ঘৃণ্য সত্য।
রাস্তায় তেমন যানজট না থাকায় গাড়ি ততক্ষণে ধামরাই পৌঁছে গেছে। একটা নির্জন জায়গায় গাড়ি থামাল হান্নান সাহেব।
– পল্লব এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, এখানে কেনো এনেছেন?
– সে না হয় ধীরেসুস্থেই জেনো। চলো, মুক্ত বাতাসে বাপ ছেলে একটু অক্সিজেন নেই। বলেই পল্লবের হাত ধরে টেনে সামনের দিকে নিতে চাইল, সে।
পল্লব একটা ছিটকে দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।
হঠাৎ কী মনে করে পল্লব গড়গড় করে বলল,
– আম্মিকে এতই ভালোবাসতেন তবে বিয়ে করেন নি কেনো?
– কারণ আমরা সেটা কেউই চাইনি। ভারী গলায় বললেন, হান্নান সাহেব।
– বাহ! আমি কি ধরে নিবো আপনার জন্যই আম্মির সাথে বাবার এই ডিস্ট্যান্স?
– হা হা! নারে বাবা! আমি কোথাকার কোন চুনোপুঁটি যে তোর সো কলড বাবা আর ওই মহারাণী ভিক্টোরিয়ার মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়াব? কীভাবে কী হয়েছে না হয়েছে সেসব না ঘেটে জীবনটাকে কী করে সহজ করা যায় সেটা ভাবা উচিত আমাদের।
– আমাকে ভাবতে হবে, সবকিছুর মূলে জানতে হবে। আফটার অল আমার জীবনের প্রশ্ন! আমি সাফার করছি। আপনি যদি না বলতে চান তাহলে আপনার নিষেধ স্বত্তেও আমি আম্মির সামনে দাঁড়াব সত্য জানতে। আমাকে জানতেই হবে।
– ভুলেও এই ভুল করো না। তাহলে নিজের জীবনের সাথেই বেঈমানী করে ফেলবে। শুধু এটুকু জেনে রাখো আমি তোমার ভালো চাই। এবং যেকোনো মূল্যেই ভালো চাই।
– ভালোই যদি চান তবে অতীতকে এভাবে আড়ালে রাখছেন কেনো?
– কিছুকিছু অতীত না জানাই ভালো। সহ্য করতে পারবে না। তাই যতটুকু জানো ততটুকুকেই আগে গ্রহনযোগ্য করে নাও। পরে না হয় সময় হলে আরো জানাবো।
পল্লবের কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কী এক নারকীয় যন্ত্রণা এসে তার পুরো জীবনটাকে ওলট-পালট করে দিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে জয়ীতার কথা মাথায়ই নেই তার। বারোটার মধ্যে জয়ীতাকে নিয়ে আসবার কথা তার । অথচ এখন দুপুর একটা।
চলবে….