সুখ_নীড় #পর্ব_৯,১০

0
538

#সুখ_নীড়
#পর্ব_৯,১০

০৯

“বিয়ের পরে বছরখানেক ভালোই ছিলাম। বিপত্তি শুরু হয় এর পরের বছর থেকেই। ধীরে ধীরে কিছু না কিছু নিয়েই সাজেদার সাথে আমার মত বিরোধ হতে শুরু করল। শুরুর দিকে সাজেদা কিছুটা সংযত হয়ে চলাফেরা করলেও আবার সে আগের মতো হতে শুরু করে। আমি বাধা দিলে বলত, আমি নাকি ব্যাকডেটেড, আটকালচারড। বাড়ি ভর্তি নানান ধরণের লোকজন থাকত চাইলেও ওর সাথে আমি ওর মতো করে চিৎকার চেচামেচি করতে পারতাম না। ওর মান সম্মান না থাকলেও আমি আমার মান ইজ্জত নিয়ে খুব ভয় পেতাম।

ও তোকে তো বলাই হয়নি আমি তখন তোর শাশুড়ির বাড়িতেই থাকতাম। আমার শ্বশুরই থাকার জন্য খুব চাপাচাপি করেছিলেন। উনি একা থাকতেন। আমারও খুব খারাপ লাগত। পরে আমার শ্বশুর আর সাজেদার অনুরোধে আমি ও বাড়িতে চলে এসেছিলাম।

সাজেদার সাথে আমার সম্পর্কের টানাটানি চলছেই তখনও। আমার শ্বশুরও চেষ্টা করত মেয়েকে বোঝানোর। কিন্তু সে কারো কথা শুনলে তো! পরে আমার বড় আপা বুদ্ধি দিলো বাচ্চা নেবার। আমিও ভাবলাম হয়ত বাচ্চা হলে সাজেদার ম্যাচিউরিটি আসবে। এই বেপরোয়াভাব নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমার শ্বশুর খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন সে বছর। সেও মেয়ের কাছে আবদার করেন একটা নাতি নাতনীর জন্য।

সাজেদা না চাইলেও আল্লাহর রহমতে সে বছর কল্লোলের জন্ম হলো। আমি যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। কিছুদিন বেশ ভালোই চলছিল আমাদের ছোট্ট সংসার। কল্লোলের জন্মের পরের বছর আমার শ্বশুর মারা গেলেন। যেনো সে কল্লোলের অপেক্ষায়ই ছিলেন।

শ্বশুর মারা যাবার কিছুদিন পর হতেই মনে হলো সাজেদা যেন একদম অন্য মানুষ। একদম স্বাধীন। সারাদিন সে তার মতো থাকত। আমি আর কল্লোল তার জীবনে একটু ঠাই খোঁজার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতাম। ওর বড় বোন মাজেদা আপা তখন প্রায়ই আমাদের বাসায় আসত। কল্লোলকে সেই বেশিরভাগ সময় দেখভাল করত। উনার বড় ছেলেটার পরে আর কোনো বাচ্চাকাচ্চা তখন ছিল না। ছোট ছেলেটা জন্মেছে উনার শেষ বয়সে। কল্লোলকে খুব ভালোবাসত সে। ও সাজেদাকে অনেক বোঝাত। মাঝেমাঝে শাসনও করত।এতে ফলাফল হলো আরো ভয়ানক। সে তার বড় বোনকে জড়িয়ে আমাকে নিয়ে খুব বাজে ধরণের মন্তব্য করল। লজ্জায় আপা এ বাড়িতে আসা ছেড়ে দিলেন। আপার সাথে তৈরি হলো এক বিশাল ফারাক। ও বাড়ির কারো সাথে এ বাড়ির মানুষের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আর সেই রেশ এখনো চলছে। বড় আপা আর ভাইজান নেই কিন্তু সেই যে আন্তরিকতার ঘাটতি সেটা আর কোনোদিন পূরণ তো হয়নি বরং যতটুকু জানি সেটাতে আরো যেনো দিনদিন মরিচা ধরে ভঙুর হয়েছে।

এর মাঝে হঠাৎ আমার ট্রান্সফার অর্ডার হলো রংপুরে। আমার তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেনো। একদিকে সাজেদার সাথে আমার সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে তার উপর কল্লোলকে ছেড়ে যেতে মন চাচ্ছিল না। এতদিন শ্বশুরের জোরে বদলি হবার ঝামেলায় পড়তেই হয়নি। কিন্তু তখন তো আর কিছুই করার নেই।
সাজেদাকেও বললাম সাথে যাবার জন্য। কিন্তু সে কিছুতেই যেতে রাজী হয় না। বাধ্য হয়ে একাই চলে গেলাম। মাসান্তে ঢাকাতে যেতাম ওদের কাছে। কিন্তু দূরে থেকেও সাজেদার মনে আমার জন্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারলাম না আমি। অপারগ হয়ে ধীরে ধীরে ঢাকাতে যাওয়া কমিয়ে দেই। টেলিফোনে কথা হতো প্রতিদিনই। যতটুকু কথা হতো ওই কল্লোলকে নিয়েই। ইচ্ছে করেই আর ঢাকাতে ফেরার কোনো চেষ্টা করতাম না। রোজ রোজ অশান্তির চেয়ে একা বিরহে পুড়ে ছাই হওয়াতেও বেশি সুখ ছিল। আমার বড় আপা মাঝে অষ্ট্রেলিয়া থেকে এসে সাজেদার বাসাতে ছিল সপ্তাহখানেক। আমি তখন রংপুরে। আপাকে নিষেধ করার পরেও প্রথমে ও বাড়িতে ওঠে। সে কল্লোলের সাথে সময় কাটাবার জন্যই ওখানে যায় মূলত। আমাকে খুব বকাবকি করে আমি কেনো ঢাকায় যাই না। কল্লোলের বয়স তখন তিন হবে। আসলে তখন সাজেদার সাথে আমার সম্পর্ক এত খারাপ যে আমি ঢাকাতে যেতাম না একদমই। আপা এতকিছু না জানলেও সে আঁচ করতে পেরেছিল অনেক কিছুই। আমাকে খুব বোঝাল এভাবে চলতে থাকলে আমাদের সংসার টিকবে না। আমাকে যে করে হোক ঢাকাতে ফিরতে হবে। আমার ছেলেটার জন্য ফিরতে হবে।

এর মাঝে আপা রংপুর এলেন আমার বাসায়। আমি তখন কিছুটা নমনীয় হই ঢাকায় ফেরার ব্যাপারে। আমি আবার তদবির শুরু করি ঢাকায় ট্রান্সফারের জন্য। আপা টানা একমাস ছিলেন সেবার আমার সাথে।
হঠাৎ আপা একদিন জানালেন সাজেদা নাকি আবারো প্রেগন্যান্ট। সাজেদা কিছু বলেনি তবে সে আঁচ করেছে। সাজেদার মেডিক্যাল ফাইলগুলো নাকি কীভাবে আপার সামনে এসে যায়। তখন সে নিজেই দেখেছে। সাজেদার তিনমাসের প্রেগন্যান্সির কাগজপত্র সে দেখেছে নিজের চোখে। সাজেদাকে জিজ্ঞেস করলে নাকি সে অস্বীকার করেছে সবকিছু। আপা আর জোরাজুরি করেনি সেসব নিয়ে। সে খুশিমনে আমাকে জানাল সবকিছু।”

কথাগুলো বলে জয়ীতার শ্বশুর কিছুটা দম নিলো। চোখের পানি গড়িয়ে তার কুচকে যাওয়া হাতের উপর টপটপ করে পড়ছে।

জয়ীতার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এসব শুনতে। সে ভাবত এই পৃথিবীতে সেই বুঝি একমাত্র মানুষ যে ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত অবহেলাই পেয়েছে। কিন্তু এখন দেখল তার থেকেও বেশি কষ্টে আছে এই মানুষটি। হয়ত অনেক কথাই সে বলতে পারছে না। তবুও অনেক কিছু সে বুঝে নিচ্ছে।

– আপনি খুশি হননি পল্লবের আসার কথা শুনে?

– হুম, আমি ভীষণ খুশি হলাম। সেই খুশিতেই ঢাকাতে ফেরার সর্বাত্মক চেষ্টা করলাম। শ্বশুরের ক্ষমতা তখনও ম্লান হয়ে যায়নি। আমি সফল হলাম। চলে গেলাম আবার ঢাকাতে। ততদিনে পল্লবের জন্মের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমাকে পেয়ে সাজেদা কিছু ভরসা পেল। ভেতরে ভেতরে কিছুটা হয়ত ভয় পাচ্ছিল। দুইটা বাচ্চা সামলানো কম কষ্ট তো নয়।

পল্লবের জন্ম হলো। তখন আমাদের সংসারটা চলছিল স্রোতের টানে ভেসে চলা নৌকার মতো। কারণ যে আমি একসময় সাজেদার জন্য খুব টান অনুভব করতাম সেই আমার মাঝেও একটা ফারাক হতে শুরু করল। সাজেদাও সেটা টের পেল। সে তো এমনিতেই আমার থেকে দূরে সরে গিয়েছে। আমার এক তরফা টানে সম্পর্কটা এতদিন জোড়াতালি দিয়ে চললেও এবার যখন আমার দিক থেকেও সূতা ছিঁড়ে গেল তখন স্রোতের সাথে নৌকার পাল যেন হেলেদুলে চলছিল। তাই খুব ভয় হলো মনে হচ্ছিল যখন কখন পাল ছিড়েখুঁড়ে নৌকাই না তন্নতন্ন হয়ে যায়। তখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাব সবাই। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের আলাদা থাকাটাই সবচেয়ে বড় সমাধান। যদিও একই ঘরে আমি আলাদাভাবেই থাকতাম। পরে ইচ্ছে করেই আবার ট্রান্সফার অর্ডার নিলাম। চষে বেড়াতে লাগলাম বাংলাদেশের এ মাথা থেকে ও মাথা। মাঝেমাঝে ঢাকাতে যেতাম বাচ্চাদের দেখতে! এই তো এভাবেই একসময় এতটা দূরে সরে গেলাম কখন নিজেও টের পেলাম না। বাচ্চাদের সাথে ফোনে কথা হতো। কিন্তু ওদের মায়ের সাথে হতো না। প্রথম প্রথম ঈদগুলিতে ঢাকাতে যেতাম। কিন্তু আমাকে দেখে খুব বিরক্ত মনে হতো ওদের মাকে। বাধ্য হয়ে পরে সেটাও বন্ধ করে দেই।

রিট্যায়ারমেন্টের পর বাগেরহাটে স্থায়ীভাবে চলে আসি। এই বাড়িটা করি। কিছু বাগান করি৷ মাছের ঘের করি, খামার করি ।মাঝেমাঝে সৎ ভাইবোন আসে বেড়াতে। ওদের ছেলেমেয়েরা হৈচৈ করে কিছুদিন কাটিয়ে যায়।
এই তো এই নিয়ে বেশ আছি। বলতে বলতে চশমাটা সরিয়ে চোখের পানি মুছেন খালেক সাহেব।

জয়ীতা তার শ্বশুরের কথাগুলি শুনতে শুনতে আনমণে নিজের চোখে হাত দিয়ে দেখে দু’চোখ বেয়ে তারও নোনাপানি উপচে পড়ছে।

সেদিন চলে এলো বাসাতে। আর থাকা হলো না তাদের। রাতে খাবার পর আজ খালেক সাহেবের বড় বোন কল দিলে খালেক সাহেবের কথা বলা শেষ হলে তার সাথে জয়ীতাও আজ কথা বলল। বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। জয়ীতা একদিন কথা বলেই তার মায়ায় জড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে কত আগে থেকেই সে তাকে চেনে।

পরেরদিন নাস্তার টেবিলে খালেক সাহেব জয়ীতার বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, চিন্তা করিস না, মা। দেখি কি করা যায়। আমি আগামীকাল ঢাকা যাচ্ছি। হারামজাদাটাকে ঘাড় ধরে নিয়ে আসব তোর কাছে।

– জয়িতা চমকে উঠল। সে বলল, না, বাবা। আমি সেটা চাই না। আমি চাই না আপনি আমার জন্য কারো কাছে ছোট হন। তাছাড়া ওখানে যেয়ে কী লাভ, বলেন! নিজেকে আর কত অপমান করাব? অনেক তো চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন লাভ হবে না। শুধু শুধু আমার জন্য ওখানে যেয়ে আমাকে আর ছোট করবেন না। সাথে আপনি নিজেও ছোট হবার দরকার নেই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। অনেক ভেবে চিন্তেই আমি ওখান থেকে বেরিয়েছি আমি সেখানে আর ফিরতে চাই না। কিছুতেই না।

– পাগল হয়েছিস? তোরা ছোটরা ভুল করবি এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সে ভুল ঠিক করার দায়িত্ব আমাদের বড়দের। আমি যেয়ে দেখি কি করা যায়। এভাবে কি জীবন চলে?

– আপনি কিছুই করতে পারবেন না। জোর করে ধরে বেঁধে একটা সম্পর্ক জোড়া লাগানো যায় না। শুধু শুধু ব্যর্থ চেষ্টা করার কী দরকার? আমি সবকিছু ভুলতে চাচ্ছি। আমি দু’একদিন বাদেই এখান থেকে চলে যাব আর একটা চাকরি বাকরি কিছু খোঁজ করে নেব। লেখাপড়া শেষ করেছি কোথাও-না-কোথাও ঠিকই চাকরি জুটে যাবে। আপনি একদম টেনশন করবেন না আমাকে নিয়ে।

– বেশি বড় হয়ে গেছিস, না? বাবা বলে ডাকিস অথচ বাবার কথার কোন মূল্য নেই তোর কাছে। তোকে কি আমি এখান থেকে চলে যেতে বলেছি? তুই এখানে যুগের পর যুগ থাক! আমার কোনো অসুবিধা নেই। তুই এখানে এসেছিস আমার বাড়িতে যেন প্রাণ ফিরে এসেছে। আমার সারা জীবনের স্বপ্ন আমার ছেলেরা, ছেলে বউয়েরা আমার বাড়িতে থাকবে, আমার বাড়ি খিলখিল করে হাসবে। এ বাড়ি কার জন্য? তোদের জন্যই তো। পল্লবের সাথে তোর সম্পর্ক থাক বা না থাক আমার সাথে তোর বাবা মেয়ের সম্পর্ক এটা কখনো ছিঁড়বার নয়!

জয়িতার চোখজোড়া ভিজে উঠল।

খালেক সাহেব আবার বললেন, একদম কোনো কথা নয়। চুপচাপ এখানে থাকবি। আমার অনুমতি ছাড়া এখান থেকে এক পা বাইরে যাওয়ার সাহস কখনো দেখাবি না। আমি আগামীকাল ঢাকা যাচ্ছি। ভয় নেই পল্লবকে আমি তোর কথা কিছুই বলব না। আমি আমার মতো করে দেখে আসব যে আসলেই ওই বাড়িতে যাওয়ার মত কোনো পরিবেশ আছে কিনা। আমি বাবা হয়ে আমার মেয়েকে এমন কোনো পরিবেশে ফেলে দিব না যেখানে যেয়ে তাকে জ্বলে-পুড়ে মরতে হবে। এতটুকু ভরসা আমার উপর রাখতে পারিস। তাছাড়া আমার একটু এমনিতেই যাওয়া দরকার ঢাকাতে। কিছু কাজ আছে। আর পল্লবের সাথেও কথা বলা দরকার। ওর ভেতরে আসলে চলছে কী সেটা আমাকে জানতে হবে।

পরেরদিন খালেক সাহেব ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই জয়ীতার ফোনে কল আসে। ফোন রিসিভ করে দেখে খালেক সাহেবের বড় বোন সেতারা বেগম ফোন দিয়েছেন।

জয়ীর সাথে অনেক কথাবার্তা হলো তার। সে আগেই তার ভাইয়ের কাছে জেনেছে জয়ীতার সাথে পল্লবের সম্পর্কের কথা। জয়ীতাকে তারও খুব ভালো লাগল। জয়ীতার কাছে ওই বাসা সম্পর্কে, তার শাশুড়ি সাজেদার সম্পর্কে, কল্লোল, চৈতী সবার সম্পর্কে নানান কথা সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে।

কথা বলতে বলতে একসময় হঠাৎ করে সে বলে একটা কথা বলব, মা। আমার মনে হচ্ছে কথাটি এখন তোমাকে জানানো প্রয়োজন। কখন না জানি চলে যাই। শরীরের যে অবস্থা! কিন্তু এই সত্যটা জানানো ভীষণ প্রয়োজন। তাই বলছি। কথাটা আসলে তোমাকে বলা ঠিক হবে কিনা জানি না আর তুমি এটা কীভাবে নেবে তাও জানি না। কিন্তু আমার বিশ্বাস তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে। তোমার সাথে কথা বলে মনে হলো তোমার কাছে কথাটা বলা যায়। আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি।

জয়িতা খানিকটা অবাক হলো কি এমন কথা বলবে যার জন্য সে এভাবে বলছে।

সে বলল, অবশ্যই ফুপি মা। আপনি আমাকে নিশ্চিন্তে বলতে পারেন।

সেতারা বেগম খানিকক্ষণ উসখুস করে বলেই ফেললেন, পল্লবের সাথে আমার ভাই খালেকের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। জানি ব্যাপারটা তোমার কাছে হয়ত অবিশ্বাস্য লাগছে। কিন্তু এটাই সত্যি কথা। এ কথা পৃথিবীর তিনটি প্রাণী ছাড়া আর কেউই জানে না। আমি, খালেক, সাজেদা। হয়তো পল্লবও জানে না। কেনো যেনো মনে হলো তোমাকে জানানো প্রয়োজন। তুমি তার অর্ধাঙ্গিনী।

জয়ীতা এবার যেন একদম থ’ হয়ে গেল। সে আস্তে করে বলল, মানে….. বুঝলাম না।

তোমাকে সবকিছু খুলে বলছি। পল্লব যখন ওর মায়ের পেটে আসে তখন টানা ছয়মাস খালেক ঢাকাতে যায়নি। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম আমি যখন জেনেছিলাম সাজেদা তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। ওর মেডিক্যাল রিপোর্ট আমি দেখে ফেলেছিলাম। কী যেন সমস্যা ছিল ওর প্রেগন্যান্সিতে। তাই বাচ্চাটাকে এবোর্ট করতে পারেনি। আমি আগেই জানতাম যে খালেক ঢাকায় যায় না। এ জন্যই ভাইয়ের সংসারের অশান্তি দূর করতে অষ্ট্রেলিয়া থেকে ছুটে যাই। গিয়ে নিজেই শকড হয়ে যাই। গিয়ে দেখি তোমার শাশুড়ির নানান জনের সাথে নানান সম্পর্ক। এ জন্যই খালেকের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না। খালেক এসব দেখেই ওর থেকে দূরে সরে গিয়েছিল।

আমি পল্লবের জন্মের সত্য বের করতে মরিয়া হয়ে উঠি। ভাইকে তো আর জিজ্ঞেস করা যায় না। ভেবেছি এমনও হতে পারে দু’একদিনের ছুটিতে হয়তো সে ঢাকাতে যেতে পারে। অফিসে খোঁজখবর নিয়েও তেমন কিছু বুঝলাম না।
একটা ব্যাপার আমার কাছে সন্দেহ লেগেছিল আমি যখন ঢাকা থেকে এসে সাজেদার প্রেগন্যান্সির কাগজপত্র দেখেছি এসব নিউজ ওকে বলেছিলাম ওর মুখে কোনো খুশির ছিটেফোঁটাও দেখিনি। যা দেখেছি তা হলো রাজ্যের দুশ্চিন্তা আর উদ্বিগ্নতা।

তখন থেকেই সন্দেহ থাকলেও আমি একদম শিওর হই পল্লবের জন্মের বছর পাঁচেক পরে। ওর ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। মনের কথা বলার কেউ ছিল না তো! তাই কষ্টের কথা কাগজ কলমে লিখে হালকা হতো। একটা পুরানী ডায়েরির পাতায় ওর হাতে লেখা তখনকার নানান সময়ে ঘটে যাওয়া কাহিনীগুলি পড়তে পড়তে পল্লবের জন্মের ইতিহাস নিয়ে কিছু পেলাম। যা ভেবেছিলাম তাইই ।
পল্লব যে ওর ছেলে না এটা জেনে-বুঝেই সে পল্লবকে ওর নাম দিয়েছে। ও সাজেদাকে বদনামের হাত থেকে বাঁচাতে, একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে সমাজের চোখে নিচু না দেখাতেই পল্লবকে নিজের নাম দিয়েছে।

আমার ভাইয়ের মন অনেক বড়। কিন্তু ওই হারামজাদি কোনোদিন বুঝল না। কতবার আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করব ভেবেছি কিন্তু আমি সাহস পাইনি। ও বরং এখন পল্লবকেই ওর নিজের ছেলে কল্লোলের চাইতে বেশি ভালোবাসে।
সাজেদার পাপের শাস্তি পাচ্ছে আমার ভাই। সে তো দিব্যি ভালোও আছে। আমি যতদিন শুধু বেঁচে আছি শুধু এই আশায় আছি ওই চরিত্রহীনা মহিলার বিনাশ কবে দেখব। আমি ওকে ছটপট করতে দেখতে চাই। সেইভাবে ছটপট করতে দেখতে চাই যেভাবে করছে আমার ভাইটা।

জয়ীতা যেন স্ট্যাচু হয়ে গেছে। কী বলবে কিছু বুঝতে পারছে না।

চলবে….

#সুখ_নীড়
#পর্ব_১০

পল্লবের সাথে খালেক সাহেবের কোনো বায়োলজিকাল সম্পর্ক নেই এটা জানার পর থেকে জয়ীতার মাথায় কোনো কিছুই কাজ করছে না। এই ঠাণ্ডার মাঝেও সে দরদর করে ঘামছে। কারো সাথে এ কথা শেয়ার করারও উপায় নেই। আর সেতারা বেগমের বলা কথাগুলোর মাঝে এক বর্ণও মিথ্যা আছে বলে তার মনে হচ্ছে না। তাছাড়া তার শ্বশুরের বলা কাহিনীর সাথেও মিলিয়ে তার কাছে মনে হচ্ছে আসলেই কোথাও গড়বড় আছে। সে বারবার বলেছে তার সাথে তার স্ত্রীর দীর্ঘদিন কোনো সম্পর্ক ছিল না। যা ছিল লোক দেখানো। সরাসরি কিছু না বললেও তার শ্বশুরের বলা কথাগুলো আর কথা বলার বিভিন্ন সময়ে তার ব্যক্ত অনুভূতি সব যেনো ওই একটা ব্যাপারের দিকেই নির্দেশ করছে। কত চাপা কষ্ট বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন উনি। পৃথিবীতে উনার বলার জায়গা পর্যন্ত নেই। হায়রে জীবন! আর কত মহানুভবতা ওনার মাঝে। জেনেশুনেও পল্লবকে কখনো বুঝতে দেননি যে সে তার বাবা নয়। বরং নিজের ঔরসজাত সন্তানের থেকে তাকেই বেশি ভালোবাসে সে।

জয়ীতা পল্লবের সাথে তার সংসার জীবনের সেই শুরুর দিনগুলো থেকে অনেক কিছুই শুধু মিলিয়ে যাচ্ছে৷ হঠাৎ করে পল্লবের পরিবর্তনের কারণ ভাবছে সে।
তার স্পষ্ট মনে আছে এখনো। একটা ঘটনা আজ বারবার মনে পড়ছে তার।
সেদিন পল্লবের ফোনটা বেজেই যাচ্ছিল। পল্লব তখন ওয়াশরুমে। জয়ীতা এগিয়ে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখল, স্ক্রীনে ভাসছে, খালেক মল্লিক ইজ কলিং….

নাম দেখে সে প্রথমে ভেবেছিল তার শ্বশুর কল দিয়েছে। তাই রিসিভ করতে চেয়েছিল কিন্তু পরক্ষনেই আবার জয়ীতার মাথায় আসে তার শশুরের নাম্বার তো পল্লবের ফোনে ‘বাবা’ লিখে সেভ করা। তাছাড়া কোনো সন্তানই বাবা মায়ের নাম্বার ফোনে নাম লিখে সেভ করে না। খানিকটা অবাক হলো সে। পরে ভাবে অন্য কেউ।
একই নামে কত মানুষই তো থাকে।

পল্লব বের হবার পরে সে বলেছিল তার ফোনে কল এসেছে। পল্লব ফোনটা হাতে নিয়ে কল লিস্ট চেক করে ফোনটা আবার ফেলে রাখে বিছানাতে। তার কল ব্যাক করার আগ্রহ দেখল না জয়ীতা। সে ভাবল, অন্য কেউ হবে হয়তোবা।

কারণ তার বাবা কল দিলে পল্লব মন খুলে তার সাথে গল্প করে। এটা জয়ী ভালো করেই জানে। এই মানুষটিই তাদের বিয়ের সময় পল্লবকে একমাত্র সাপোর্ট দিয়েছিল। পল্লবের সাথে তার বন্ডিংটা সেদিনই বুঝেছিল জয়ী। দূরে থেকেও ছেলের মনজুড়ে ছিল তার স্থান। বিয়ের দিন জয়ীতাদের গ্রামে সেই কতটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন। পল্লবের এক ডাকে তিনি না এসে থাকতে পারেন নি।

এরপরে ওইদিন আবার সন্ধ্যাবেলা জয়ীর সাথে কথা বলার সময় খালেক সাহেব জয়ীকে জিজ্ঞেস করেন পল্লব কোথায়? কল দিয়েছে কয়েক বার অথচ রিসিভ করেনি। এরপর সন্দেহ দূর হলো জয়ীতার। দুপুরের ওই ফোন কল তাহলে তার বাবারই ছিল। কিন্তু নাম লিখে সেভ করার ব্যাপারটা তার মাথায় আসেনি। জিজ্ঞেস করবে সেই সাহসও ছিল না। তখন কিছুদিন ধরেই এ কথা সে কথা নিয়ে মনোমালিন্য চলছিল দু’জনের। ভেবেছিল হয়তো কোনো কারণে বাবার নাম্বার নাম লিখে সেভ করেছে নয়তো এমনিতেই। পরে এ নিয়ে আর মাথা ঘামাতে যায়নি সে। নিজের সংসার নিয়েই তখন টানাটানি চলছে।

জয়ীর হঠাৎ চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে উঠল। তবে কি পল্লব সবকিছু জেনে গিয়েছে? জয়ীতার অস্বস্তি আরো বাড়তে লাগল। শুরুর দিকে বাবা ছেলের মাঝে এসে যেমন সম্পর্ক দেখেছিল কিছুদিন বাদে সেটা তার কাছে মনে হয়েছে অনেকাংশেই বদলে গেছে । হঠাৎ করে পল্লব কেমন যেন বদলে গেল।
জয়ীর সাথে যখন তার শশুরের কথা হতো প্রায়ই সে পল্লবের ব্যাপারে নালিশ জানাত। খালেক সাহেব প্রায়ই অভিমান করে বলতো আমার ছেলেটা কি বউকে পেয়ে তার বাবার কথা ভুলেই গেছে? একবারও কি তার মন চায় না বাবাকে দেখতে আসতে বা ফোন করে কথা বলতে? জয়ীতা তখন হাস্যচ্ছলে কথাগুলো উড়িয়ে দিত। এবং এটা সেটা বলে তাকে বুঝাতে চাইত। যেমন পল্লবের ব্যবসায়িক নানান ব্যস্ততা চলছে, এই কাজ সেই কাজ এসব বলে তার বাবাকে ব্যর্থ বুঝ দিত।

জয়ীতার কাছে এখন সবকিছু ধীরেধীরে পানির মতো পরিষ্কার হচ্ছে। হঠাৎ করে পল্লবের এমন বদলে যাওয়া, তার সাথে মিসবিহেভ করা, পল্লবের মা সাজেদা চৌধুরীর সাথে সবকিছু নিয়েই বিভেদ শুরু হওয়া, তার বাবার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি সবকিছুর পেছনেই কারণ হয়ত একটাই ।

তার অনুমান যদি সত্যি হয়ে থাকে এটাই কি তবে সেই কারণ। পল্লব তাকে বারবার বলেছিল, “আমার জীবনের সাথে জড়িও না। নিজের মতো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। আমার সাথে জড়ালে পদে পদে শুধু অপমানিত হবে। আমার জীবনের সাথে জড়ালে একটা অসম্মানজনক জীবনই পাবে। ”

জয়ী তখন ভেবেছিল হয়ত তার মা জয়ীকে মেনে নিবে না এটা বুঝিয়েছে। এখন বুঝতে পারছে আসলে কাহিনী হয়তো অন্য কিছু। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগল, পল্লব জানল কোথা থেকে? এ কথা তার শ্বশুর, শাশুড়ি আর সেতারা বেগম ছাড়া আর কেউ তো জানার কথা না। আর এ কথা এদের মধ্যে কেউ জানানোরও কথা না। তাহলে কী করে জানল পল্লব? জয়ী মাথা খাটাতে থাকে। পল্লব যদি সত্যিই কিছু জেনে থাকে তবে কে তাকে জানাতে পারে?

হুট করে তার মাথায় এলো এ কথা আরেকজনও তো জানে। আর সে হলো পল্লবের আসল জন্মদাতা। সেই হয়ত পল্লবকে জানিয়েছে। আবার মাথায় এলো সে পল্লবকে এত বছর পরে জানাবেই বা কেন? তার পরক্ষণেই মনে হলো হয়তো সে পল্লবের থেকে সে সুবিধা নিতে চাইছে। কারণ সে যেই হোক কোনো ভালো মানুষ নিশ্চয়ই না। সে আগাগোড়া একজন সেলফিস মানুষ। না হলে একজন বিবাহিতা নারীর সাথে তার সম্পর্ক তৈরি হতো না। সে সারাজীবনই সুবিধাবাদী । একসময় সুবিধা নিয়েছে পল্লবের মায়ের থেকে আর এখন পল্লবের থেকে নিতেই পল্লবকে নিজের পরিচয় দিয়েছে। এরা নোংরা মানসিকতার মানুষ। এদের নোংরা মানসিকতা কোনোদিনই বদলাবে না।

কিন্তু কে হতে পারে সেই লোকটা। তার শশুর এর কাছে শুনেছে একসময় তাদের বাড়িতে লোকজন ভরপুর থাকত। থাকারই কথা পল্লবের নানা ছিলেন একজন মন্ত্রী। নানান ধরনের মানুষের আনাগোনা ছিল তার চারপাশে। এদের মাঝে হয়তো কেউ। যে করেই হোক এই কালসাপকে তার খুঁজে বের করতে হবে। না হলে পল্লবের জীবনটা তছনছ হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা সে কীভাবে করবে? পল্লব তো তাকে সহ্যই করতে পারে না।
জয়ীর অনুমান শক্তি খুবই প্রখর। সে ভাবল যে করে হোক পল্লবের পাশে তাকে থাকতেই হবে। এই রহস্যের জটও তাকে খুলতে হবে।

খালেক সাহেব ঢাকাতে একটা হোটেলে উঠেছেন। ঢাকায় এলে হোটেলেই থাকেন। অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন থাকা স্বত্তেও তিনি কারো বাসায় ওঠেন না। নানান ধরণের কথার বাণে জর্জরিত হতে হয়। তাই এসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকবার জন্যই তিনি হোটেলে থাকেন।

কল্লোলের সাথে দেখা করে এসেছেন ওর অফিসে যেয়ে। আর পল্লবকে বেশ কয়েকবার কল দেবার পর ফোন রিসিভ করল। পল্লবকে জানাল সে ঢাকায় এসেছে একটা কাজে। কালই চলে যাবে। যাবার আগে তার সাথে একবার দেখা করে যেতে চায়। পল্লব খানিকক্ষণ থেমে জবাবে জানাল সন্ধ্যায় সে আসবে। খালেক সাহেব আসলে এসেছেনই পল্লবের সাথে কথা বলতে।

খালেক সাহেব পল্লবের জন্য একটা রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছেন ঘণ্টা দুয়েক ধরে। বারবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। খালেক সাহেব তো একবার ধরে নিলেন যে হয়তো আজ আর দেখা হবে না পল্লবের সাথে। তিনি ভেবেছিলেন আজ তার সাথে কথা বলতে পারলে কাল সকালেই বাগেরহাটের উদ্দেশে রওনা হবেন। জয়ীকে একা একা রেখে এসেছে। এমনিতে মেয়েটার মানসিক অবস্থা ভালো না। একা একা কীভাবে থাকবে তা নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে।

অধৈর্য হয়ে উঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক সে সময় হুড়মুড় করে সেখানে ঢুকল পল্লব। পল্লবকে দেখে খালেক সাহেবের যেন হালে পানি ফিরল। তিনি উঠেই পল্লবকে শক্ত করে দু’হাতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। অনেকদিন পর তার সাথে দেখা। পল্লব এতদিন পরে একটা ভরসার জায়গা পেল যেনো। সেও শক্ত করে খালেক সাহেবকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

খালেক সাহেব খেয়াল করলেন পল্লব যেনো তার বুকের মধ্যে গেঁথে আছে। তার চশমার আড়াল থেকে সব কিছুই ঝাপসা দেখছেন। মনে মনে ভাবছেন কে বলবে এই ছেলেটা তার না। সম্পর্ক কি শুধু জন্ম দিলেই হয়? রক্তের সম্পর্ক ছাড়া কি সম্পর্ক হয় না? কই কল্লোল তো এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লো না তার বুকে। কল্লোলকে তো সে জন্ম দিয়েছে। ভালোবাসা শুধু রক্তের সম্পর্কেই হয় না।

পল্লবের সাথে অনেক কথা হলো। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে জয়ীকে নিয়ে নানান কথা জিজ্ঞেস করলেন তিনি। কিন্তু পল্লব ইচ্ছে করে কথাগুলোকে এড়িয়ে গেল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন জয়ীর সাথে ঝগড়া হয়েছে কিনা। পল্লব জানে তার বাবা জয়ীকে খুব পছন্দ করে তাই সে জয়ীর ব্যাপারে সেসব কথা এড়িয়ে যেয়ে বলল, জয়ী এখন ওর মায়ের কাছে আছে।
এটা বলেছে না হলে তার বাবা যদি আবার জয়ীর সাথে দেখা করতে চায় তাহলে আরেক বিপদ হবে। খালেক সাহেব মনে মনে হাসলেন ছেলের মুখে এমন সাজানো গোছানো মিথ্যে কথার বহর শুনে।

পল্লবের সাথে কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি যতটুকু বুঝলেন পল্লব খুব বেশি ভালো নেই। ভেতরে ভেতরে একটা হাহাকার যেন বয়েই যাচ্ছে। ছেলেমেয়ে যত বড়ই হোক তার মনের কথা বুঝবে না এতটা অক্ষম বাবা মা নন। সরাসরি কিছুর জিজ্ঞেস করতেও পারছেন না তিনি।

বেশ সময় পরে উঠতে যাবে তখন হঠাৎ পল্লবের হাত দুটি চেপে ধরে তিনি বললেন, বাবা আমার শরীরের অবস্থা খুব বেশি ভালো না। নানান সমস্যায় জড়িয়ে আছি। বয়স হয়েছে বুঝিসই তো। হয়তো যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। ছোট্ট জীবনে অনেক কিছুই চাওয়ার ছিল কিন্তু মানুষের চাওয়ার সাথে পাওয়ার পূর্ণতা হবে এটা তো কোন বিধানে লেখা নেই। আমার নাম হয়তো সেইসব হতভাগ্যদের খাতায় লিখেছেন যাদের চাওয়া পাওয়ার কোন মূল্য কারো কাছে নেই।
কথাগুলি বলতে বলতে খালেক সাহেবের সত্যিই চোখ বেয়ে গ্রীবাদেশ সিক্ত হলো।
খালেক সাহেবের চোখে পানি দেখে পল্লবের চোখজোড়াও ভিজে উঠল। সে মনে মনে ভাবল, সত্যিই তো! তার বাবা তো সেই সব হতভাগাদের দলেই। কী পেয়েছেন তিনি জীবনে? এত ভাল মানুষ হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীর কাছে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। একজন পুরুষের কাছে এর থেকে কষ্টের আর কী হতে পারে? সারাটা জীবন স্ত্রী-সন্তানকে ছেড়ে একটা নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন। তার নিজের থেকেও বেশি দুর্ভাগা মনে হচ্ছে তার বাবাকে। নিজের কষ্ট যেন নিমিষেই ভুলে গেল সে।

পল্লব তাকে কিছু বলতে যাবে তখনই খালেক সাহেব বললেন, আমি কি তোমার জীবন থেকে মাত্র সাতটা দিন আমার পাশে পেতে পারি? আমি আগামীকাল ঢাকা থেকে চলে যাচ্ছি। হতে পারে এটাই আমার শেষ আসা। আমি কি আগামী সাতটা দিন বাগেরহাটের মাটিতে তোমার সাথে থাকতে পারি? তোমাদের বাসায় আমি যতটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঠিক ততই আরাধ্য তোমরা আমার বাড়ীতে। পথ চেয়ে থাকি যদি কেউ আসো। কিন্তু আমার সেই চাহনি নিস্ফলই রয়ে যায়৷ বাবা, আমার চাওয়াটুকু কি খুব বেশি হয়ে গেল? আমি কল্লোলের কাছে এমন আবদার করবার সাহস পাইনি। কারণ সে কেমন তুমি তো জানোই। তাই তোমার কাছেই শেষ ভরসা হিসেবে এই আবদারটুকু!

বলতে বলতে খুব ইমোশনাল হয়ে গেলেন খালেক সাহেব।

পল্লব তো এমনিতেই ক’দিন ধরে খুব মানসিক যন্ত্রণার মাঝে দিন কাটাচ্ছে তাই তার কাছে তার বাবার করা আবদারটুকু মোটেও অন্যায় মনে হয়নি। সে নিজেও এই ইঁটকাঠের শহর ছেড়ে দূরে কোথাও পালাতে চায়৷ এই মানুষটিকে সে যতই এভয়েড করার চাক না কেনো সে পারবে না। রক্তের বাঁধন না থাকলেও এই মানুষটিই তার একমাত্র আপন।

পরদিন বাগেরহাটের বাসে চড়েছে বাপ ছেলে। সাঁ সাঁ করে গাড়ি ছুটছে তার গন্তব্যে। ইচ্ছে করেই নিজের গাড়ি আনেনি পল্লব। সে কিছুদিন তার মায়ের প্রাচুর্যের বাইরে একটা সাধারণ জীবন যাপন করতে চায়। একটা ব্যাকপ্যাকে মাত্র দুই তিনসেট পোশাক নিয়ে এসেছে। কাউকেই কিছু জানায়নি। তার মা জানলে তো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠত। ছোটবেলা থেকে সে প্রায়ই তার বাবার কাছে যাবার আবদার করত তার আম্মির কাছে। কিন্তু সে কিছুতেই যেতে দিতে রাজী হতো না। মাঝেমাঝে এমন করে চুরি করে চলে আসত বাবার কাছে। আজও বহুকাল পরে সেই একইভাবে চলে এসেছে। এই মানুষটি যে তাকে পিতৃ পরিচয়ে আপন করে নিয়েছে তাকে সে কী করে এভাবে খালি হাতে ফেরাবে!

তার আম্মি তাকে না পেলে দুনিয়া তোলপাড় করে খুঁজতে শুরু করবে তাই একটা মেসেজ পাঠাল,

” আমি ক’দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। অযথা খোঁজাখুঁজি করো না। আমার সময় হলে চলে আসব”!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here