#সুখ_সন্ধানী
পর্ব ৪
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
কিন্তু আজ মাথা ঘুরানি তে সন্দেহ টা প্রখর হলো। অতিরিক্ত ভয় সারা শরীর কে নিথর করে দিচ্ছে। এতো অশান্তির মধ্যে চাইনা নতুন কোন অশান্তি যোগ হোক। আর কেউ জানুক না-জানুক আল্লাহ তো জানেন আমি কোন পাপ করিনি। তাই আল্লাহর কাছে জোর দাবি জানিয়ে ফরিয়াদ করলাম, যেন আমার সন্দেহ টা ভুল প্রমাণিত হয়। সন্ধ্যার আগে মা ইট ভাটা থেকে বাড়ি ফিরলে সাথে সাথে রাতুল বলে দেয়, আমি আমার পড়ে যাওয়ার কথাটা। আমার হাতে পায়ে কোথাও আঘাত লাগছিলো নাকি তা দেখার জন্য মা উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ে। আমি শান্ত ভাবে মাকে বললাম, যার সারা শরীরে মিথ্যা কলঙ্কের দাগে ভরপুর তার এতোটুকু আঘাতে কিছু হবে না। কিন্তু আমার চিন্তা অন্য কোথাও। প্রায় দুই তিন মাস থেকে আমার মাসিক বন্ধ আছে। এতো কিছুর মধ্যে এইদিকে খেয়াল ছিলো না আমার।
কথা গুলো শোনা মাত্র মা বারান্দায় বসে পড়ে। কোন কথা নেই কারো মুখে। হয়তো আমার ভয় টা এখন মায়ের মনেও চলে গেছে। তিন চার দিন পরে মা কিছু টাকা জোগাড় করে আমাকে নিয়ে মামার বাড়িতে যায়। যেহেতু সুজন আমার খালুর সাইকেল চুরি করেছিলো তাই মামারা সুজন কে খারাপ ভাবে। তবে আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাও উনারা জানেন,, কেউ হয়তো বিশ্বাস করে আমি খারাপ আর কেউ হয়তো বিশ্বাস করে না। ওখানে যাওয়ার পরে আমাকে একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়,, উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন কত মাস থেকে মাসিক বন্ধ আছে। আমি ওতো দিন তারিখ মনে রাখতাম না তাই আনুমানিক বললাম,, হবে হয়তো দুই তিন মাস।
উনি আমার কথার উপর ভিত্তি করে ঔষধ দিলেন, এটা খেলে ৪/৫ দিনের মধ্যে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবে। বাচ্চা নষ্ট করতে মোটেও ইচ্ছে করছে না কারণ আল্লাহ তার বান্দার রিজিক আগে থেকেই বরাদ্দ করে রেখেছেন। কিন্তু বাবা মায়ের অভাব অনাটনের সংসারে এই পাঁচজনের প্রতিদিনের রিজিক আনতেই হিমসিম খেতে হয় তারউপর নতুন কিছু মানতে কেউ রাজি না। বিশেষ করে ওই নেশাখোর চোরের কোন চিহ্ন আমার মাঝে রাখতে চাই না। ডাক্তারের বলা নিয়ম অনুয়ায়ী ঔষধ খেলাম কিন্তু বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পরিবর্তে আমার জীবন নিয়ে সংশয় দেখা দিলো। পেটের ব্যাথা অস্থির ভাবে চিল্লাচিল্লি করছি, প্রায় দুইদিন ধরে ব্যাথা চেপে নিয়ে আছি। টাকা পয়সা নাই, অল্পতেই বেশি লোক জানাজানি করা উচিত না। কিন্তু বর্তমান অবস্থা চেপে রাখার মতো না।
যে ডাক্তার ঔষধ দিয়েছিল উনাকে ডাকা হলো উনি সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। এদিকে মামা মামির আচরণ দেখে বুঝা যাচ্ছে আমাদের উপর তারা কতটা বিরক্ত। যা টাকা পয়সা ছিলো সব শেষ। সদরে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো অবস্থা নাই। যেভাবেই হোক কষ্ট সহ্য করতে হবে আমাকে। চিল্লিয়ে তো এটা থেকে মুক্তি পাবো না। মা মেয়ে সারারাত জেগে থাকি। শরীরের রক্ত গুলো বের হতে হতে ফ্যাকাসে হয়ে গেছি। মামাও কিছু টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু তিনি আর কোন টাকা দিতে পারবেন না । মামির নাকি কোন আত্মীয়ের বিয়ে। বাড়ির সবাই নাকি বিয়ে খেতে যাবে। তাই তারা আমাদের বাড়িতে আসার কথা মুখে না বললেও আকার ঈঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
শরীরের এই অবস্থায় ভ্যানে করে আমাদের বাড়িতে আসার জন্য, ঝাকুনিতে আরো বেশি রক্তক্ষরণ হতে থাকে। বাবা আজিজ চাচার কাছে গিয়ে কিছু টাকা ধার নিয়ে আসেন তারপর অন্য একটা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ঔষধপত্র নিয়ে আসেন। সেগুলো খেয়ে সামান্য সুস্থ হলাম। প্রায় এক মাস এভাবে কাটার পরে এখন মোটামুটি সুস্থ কিন্তু বাচ্চাটা মনে হয় নষ্ট হয় নি। সময়ের বেড়াজালে জীবন চক্র কিছু টা স্বাভাবিক এখন। বর্তমানে আমি পাড়ার অনেকের কাঁথা সেলাই করে দিই,, রাতুল মুকুল কে সাথে নিয়ে অন্যের জমিতে আগাছা পরিষ্কার বা অন্যান্য কাজ করি। পরিপূর্ণ পুষ্টির অভাবে পেটের বাচ্চাটা ঠিক মতো বড় হচ্ছে না।
এইসবের মাঝে সুজনের বাড়িতে অনেক বার খবর দেওয়া হয়েছে যে আমার পেটে বাচ্চা এসেছে। কিন্তু ওদের দাবি বাচ্চাটা সুজনের না, যার বাচ্চা তাদের যেন খবর দেওয়া হয়। পাড়া প্রতিবেশী সবাই বলে, আসমানীর পেটে জারজ বাচ্চা,, এই বাচ্চার বাবা কে তা আসমানী নিজেও না। কতজনের কাছে গেছে কে জানে। হয়তো এইজন্যই কারো নির্দিষ্ট নাম বলতে পারে না।
আমার মুখের উপর অনেকে বলে,, তোর এতো শুভাকাঙ্ক্ষী থাকতে এখন কেউ পাশে আসে না কেন? প্রতিদিন কতজনের কাছে যেতি ইত্যাদি। আমি শুধু বলতাম উপরে আল্লাহ আছেন, উনি সব কিছু জানেন এবং দেখেন। আমার মুখে আল্লাহর কথা শুনলেও সবাই হাসাহাসি করে। সমাজের নানা মানুষের দেওয়া মানষিক অত্যাচারে জর্জরিত আমি এবং আমার পরিবার। জানি পেটের বাচ্চার জন্মের পরে তাকেও মেনে নিতে হবে সে জারজ,, তার মা খারাপ মেয়ে।
কনকনে ঠান্ডায় রাতে ঘুমাতে প্রচুর কষ্ট হয়। না আছে শীতের পোশাক না আছে ভালো বিছানা কাঁথা। এই শীতের এক কুয়াশা ঢাকা রাতে শুরু হয় আমার প্রসব ব্যাথা। মা অস্থির হয়ে পাড়ার অভিজ্ঞ কিছু মহিলাদের ডাকতে যান কিন্তু তারা সবাই জারজ সন্তান কে দুনিয়ায় আনার মতো জঘন্য পাপ কাজ করবেন না বলে ফিরিয়ে দেন। একজন নাকি বলেছে, মা এবং সন্তান দুজনকেই মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে। রাতুল মুকুল কে আমার কাছে রেখে মা আর বাবা গেছে পাশের গ্রামের একজন কে ডাকতে। ব্যাথার চোটে বারবার মনে হচ্ছে আমি মনে হয় আর কখনো মা বাবার মুখ দেখতে পাবো না। প্রায় ভোরের দিকে মা বাবা ওই মহিলাকে সাথে নিয়ে আসলেন। উনি আমার অবস্থা দেখে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন কিন্তু মা বারবার অসহায়চিত্রে অনুরোধ করে বলেন, দেখুন না কোন ভাবে বাড়িতে হয় নাকি।
এইরকম অবস্থায় ওই মহিলা টা নতুন ব্লেড দিয়ে আমার জরায়ুর এক পাশে কেটে দিলেন। জানিনা মৃত্যুর যন্ত্রণা কতটা কঠিন কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে এর চেয়ে মৃত্যুর যন্ত্রণা অনেক কম হবে। এক হতদরিদ্র পরিবারের আর্তনাদ শোনার মতো কেউ নাই দুনিয়ায়। অনেকক্ষন চেষ্টার পরে একটা ছেলের জন্ম দিলাম আমি। ওই মহিলা জোরে করে বলেন, আসমানীর পোলা হইচে। এতো কষ্টের মাঝেও সবার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো। কিন্তু বাচ্চাটা কান্না করছে না। ওই মহিলাটি মাকে আগুন জ্বালাতে বলেন,, তারপর ওই ছোট বাচ্চাকে আগুনে ধোঁয়ার মধ্যে উপর করে কিছুক্ষণ ধরে রাখে আবারও সরিয়ে নিয়ে যায় এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পরে বাচ্চাটা একটু কান্না করে।
যে মুহুর্তে নিজের জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম ঠিক সেই মুহুর্তে এতো কিছু ফিরে পাওয়া স্বপ্ন ছাড়া অন্য কিছুই না। এই শীতের সময় বাচ্চা হওয়ার জন্য আরেকটা বিপদে পড়লাম। যে পরিমাণ জামাকাপড় লাগবে তা দেওয়ার মতো সামর্থ্য নাই। আমরা ভাইবোনরা অন্যের ব্যবহার করা পুরাতন জামাকাপড় পড়ে বড় হয়েছি তাই বাড়িতে পুরাতন তেমন কিছুই নাই। শীতের সময় হয়েছে বলে ছেলের নাম রেখেছি হিমেল। বেশ কিছু মাস যাওয়ার পরে খেয়াল করলাম, অন্য বাচ্চাদের মতো হিমেল স্বাভাবিক নয়। পা গুলো কেমন বাঁকা হয়ে থাকে,, তেল দিয়ে মালিশ করার পরে ও সোজা হয় না। ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় আরকি।
এমন প্রতিবন্ধী ছেলেকে সাথে নিয়ে আবারও নেমে পড়ি জীবন যুদ্ধে। আমাদের বাড়ির পাশে দীঘির পাড়ের সাথে আজিজ চাচা নতুন পান ক্ষেতের চাষ করেছেন। বাড়ির পাশে হওয়ার জন্য প্রতিদিন আমি ওই ক্ষেতে কামলা দিতাম। আজিজ চাচার বাড়ির কাজের ছেলেটা আমার সাথে কাজ করে। কাজ করার সময় কোন কারন শরীরের কাপড় একটু সরে গেলেই ওই ছেলের চোখ পড়তো সেই দিকে। ওর সাথে কাজ করে খুব ভয় করে আমার। একদিন রাতে প্রচুন্ড গরমে ভাঙা জানালা খোলা রেখেছিলাম। গভীর রাতে খেয়াল করলাম কেউ জানালা দিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। আমি বাইরে মা কে ডাক দিয়ে বাড়ির পিছনে যেতে বলি। আব্বা মা সাথে সাথে ওখানে গিয়ে দেখে আমাদের পাড়ার একটা ভাই পালাতে গিয়ে খেঁজুরের কাঁটার ভেতর পড়ে আছে। আব্বা সাথে সাথে উনার পরিবারের লোকজন কে ডেকে আনেন। যদিও তারা বিশ্বাস করে এই ঘটনাতে আমাদের কোন দোষ নেই তবুও আমাকে দোষ দিয়ে বলেন,, এমন বে** মেয়ে গ্রামে থাকলে বেটা-ছেলেদের তো চরিত্র খারাপ হবেই।
আবারও মান-সম্মান হারানোর ভয়ে কথা গুলো দুই পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলাম। জানি এইসবের বিচার করার কেউ নাই তাই আর বাড়াবাড়ি করলাম না। আশেপাশের সকল প্রতিবন্ধীদের সরকারি ভাতা দেওয়া হয়। তাই আমাকে সাথে নিয়ে আব্বা পাশের গ্রামের মেম্বারের কাছে গেলেন। উনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে পরের দিন খুব সকাল সকাল আমাকে যেতে বললেন। বাড়ি ফিরে উনার বলা সব কাগজপত্র ঠিক করে রাখলাম। সরকার থেকে কিছু টাকা পেলে ছেলেটার চিকিৎসা করা যাবে, জামাকাপড় দেওয়া যাবে এইসব চিন্তা করতে করতে খুশিতে ঘুমই হলো না।
যেহেতু মেম্বার কাগজপত্র নিয়ে কাল সকাল দশটার আগে ইউনিয়ন পরিষদে জমা দিবেন তাই আমি হিমেল কে কোলে নিয়ে কাগজপত্র সাথে নিয়ে একাই রওনা দিলাম। মেম্বারের বাড়িতে আসার পরে আমাকে একটা ঘরে বসতে বলে উনি বাইরে চলে যায়। বেশ কিছুক্ষন বসে আছি তবুও উনি আসছেন না এদিকে হিমেলের বোধহয় খুব খিদে পেয়েছে তাই কান্না করছে। যেহেতু ঘরে কেউ নাই তাই আমি হিমেল কে খাওয়াতে শুরু করি। কিছুক্ষন পরে মেম্বার সাহেব ঘরে আসেন। উনাকে দেখে আমি হন্তদন্ত হয়ে নিজের কাপড় ঠিক করতে থাকি। উনি কাগজপত্র নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ইনিয়েবিনিয়ে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে।
নিজের পায়ে হেঁটে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি আমি। আমি চারিদিকে তাকিয়ে বাইরে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছি।বাড়িতে এতোক্ষণে কোন মানুষের কথার আওয়াজ পাইনি আমি, মনে হয় কেউ নাই বাড়িতে। মেম্বার টেবিলের উপর কাগজ রেখে সরাসরি দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি বারবার শাসনের স্বরে উনাকে বললাম,, খবরদার সামনে আসবেন না,, আপনাকে খুন করে ফেলবো আমি। কিন্তু উনি মনে হয় আমার কথা গুলো শুনতে পাচ্ছেন না। উনি আমার শাড়ির এক অংশ টেনে ধরে, আর অন্য হাতে আমাকে থামানোর চেষ্টা করে। আমি ছোটাছুটি করার চেষ্টা করেই চলেছি কিন্তু কোলে বাচ্চা থাকা জন্য সম্ভব হচ্ছে না। উনার সাথে এমন জোড়াজুড়ির সময় হিমেল আমার কোল থেকে নিচে পড়ে যায় এমনিও আগে থেকেই কান্না করছিলো, এখন পড়ে যাওয়ার জন্য আরো বেশি কান্না করতে শুরু করে।
যেহেতু বাড়িতে কেউ নাই তারউপর সব দরজা জানালা বন্ধ তাই জীবনের প্রথম কোন পুরুষের কাছে পরাজিত হতে হলো। এই প্রথম কোন মা তার প্রতিবন্ধী অবুঝ সন্তানের সামনে ধর্ষিত হলো। উনি আমার মুখে গামছাটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন আর হাত দুটো উনার কব্জায়। উনি উনার ইচ্ছে অনুযায়ী নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন,, পাশে বাচ্চার কান্নার আওয়াজও তার কু-কর্মকে সামান্য বাঁধা দিচ্ছে না।
পশুর মতো অত্যাচার চালিয়ে ক্লান্ত শরীরে উঠে নিজের পোশাক পড়তে পড়তে আমাকে শাসিয়ে বলেন,, যদি কাউকে কিছু বলিস তাহলে সব দোষ তোর উপরেই চাপিয়ে দিবো। এলাকার মানুষ ভালো করে জানে তোর চরিত্র কেমন তাই সাবধান থাকবি। আর মজাটা ভালো পেয়েছি,, চেষ্টা করবো তোর ছেলের কাজটা করার জন্য। উনার কাছে থেকে ছাড়া পাওয়ার সাথে সাথে হিমেল কে কোলে তুলে নিই। সেই থেকে কান্না করতে করতে হাপিয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে নিজেকে সামলিয়ে বেড়িয়ে চলে আসি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এই কথা সত্যিই কাউকে বলবো না,এমনকি মাকে ও না। কারণ বলে যদি কোন প্রতিকার করা না যায় তাহলে শুধু শুধু মায়ের কষ্ট বাড়ানো হবে।
কোন রকম এলোমেলো পায়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে কেউ নাই, যে যার কাজে গেছে। এতো কান্নার কারণে রাস্তায় হিমেল ঘুমিয়ে গেছে। হিমেল কে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে আমি,,,,
চলবে,,