#সুখ_সন্ধানী
পর্ব ৬,০৭
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
০৬
আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম,
শর্ত একটা-ই,তা হলো আমরা এখন যে জমিতে আছি তা আমার ছেলের নামে লিখে দিতে হবে এবং দুটো ঘর করে দিতে হবে। যদি রাজি থাকেন তাহলে আমরা এমন অবৈধভাবে মেলামেশা না করে আল্লাহর শরিয়ত মোতাবেক একটা সম্পর্কে যায়। তাহলে অন্তত এইসব পাপ থেকে মুক্তি পাবো এবং পরপারে সুখে থাকবো।
আজিজ চাচা হয়তো আমার মুখে এমন প্রস্তাব আশা করে নি তাই কিছুটা হতবাক দেখাচ্ছিলো উনাকে। উনি আমাকে বললেন,, এই বয়সে বিয়ের কথা বললে ছেলে মেয়েরা কি ভাব্বে আর পাড়াপ্রতিবেশিরা কি ভাব্বেন। তার চেয়ে আমার দেওয়া প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও। আনন্দ কি শুধু আমার একার হবে? তুমি ও এতো দিনের অপূর্ণ যন্ত্রণা থেকে কিছুটা মুক্তি পাবে আর আমিও। কেউ কিছু জানবেও না। টাকা পয়সা যায়গা জমি চাও দিবো কিন্তু এই বয়সে বিয়ে করা সমাজের চোখে খারাপ দেখায়।
উনার বলা কথা গুলো শুনেই বুঝতে পারছি কতটা নির্লজ্জ এবং অমানুষ,, মানুষের ভয়ে গোপনে পাপ করতে রাজি কিন্তু আল্লাহর ভয়ে পাপ থেকে বিরত থাকতে রাজি না। আমি উনাকে বললাম,, আপনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে,, মানুষের হায়াত মওতের কথা বলা যায় না। এমন ব্যভিচার করার পরে আল্লাহর কাছে কি জবাব দিবেন আপনি?? আমার কথা গুলো নিরিবিলিতে বসে একটু ভেবে দেখবেন।
আমি সেখান থেকে বেরিয়ে চলে আসলাম। হিমেল কে রেখে এসেছি, হয়তো এতোক্ষণ কান্না শুরু করেছে। যতদূর সম্ভব তারাতাড়ি বাড়িতে চলে আসি। মা আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করে,, এতোক্ষণ কই ছিলি??
আজিজ চাচার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম।
কেন? কি কথা বললি ওই বেয়াদব মানুষের সাথে?
নিজের প্রতিবন্ধী সন্তান এবং তোমাদের জীবনের এক বিন্দু সুখের জন্য সব করতে রাজি আমি, তাই উনাকে বললাম, যদি যায়গা দিয়ে আমাদের বাড়ি করে দেয় তাহলে আমি উনার কথা মতো চলবো।
সাথে সাথে মা আমাকে ঠাস্ করে থাপ্পড় মারেন এবং বলে!! নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন, দরকার হয় মা ছেলে সবাই মিলে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করবো তাও এইসব পাপের বাড়িতে থাকবো না।
মায়ের এমন কথাতে মনটা ভরে গেলো। এতো কষ্টের মধ্যে থেকেও নিজেদের সামান্য সুখের জন্য আমার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হতে দিতে নারাজ। মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে সব কথা খুলে বলি। এখনো মা আমাকে ওইসব কথা বলতে নিষেধ করে,,এতো বয়োস্ক মানুষের সাথে কোন ভাবেই আমাকে বিয়ে দিবেন না।হয়তো পৃথিবীর কোন মা-ই তার মেয়ের এতো বড় ক্ষতি চান না।
কেটে গেছে দুই তিন দিন, এখনো আজিজ চাচার লোকজন বা উনি নিজে আমাদের বাড়িতে বা আমার কাছে আসেন নি। হয়তো উনার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছেন। হয়তো বুঝতে পেরেছেন জীবনের শেষ প্রান্তে এমন পাপ করা ঠিক হবে না। বিকালে হিমেল কে নিয়ে বসে আছি এমন মুহুর্তে আজিজ চাচা বাবাকে বলে উনি আমাকে বিয়ে করতে চান। যেহেতু আমি আগে থেকেই বাড়ির সবাই কে বলেছি এমন প্রস্তাব আমি নিজে দিয়ে এসেছি তাই আপত্তি থাকলেও অমত করেনি কেউ।
আজিজ চাচা এই জমির কাগজপত্র ঠিক করে সামনের বুধবার রেজিস্ট্রি অফিসে যাবেন এবং আমাদেরও যেতে বলেন। যেহেতু আমার আর সুজনের এখনো তালাক হয় নি তাই আমাকে শরিয়ত মোতাবেক এখনই বিয়ে করা সম্ভব না। জমি রেজিস্ট্রার হওয়ার পরের দিন আমাকে দিয়ে তালাক কার্যকর করাতে চান তিনি তারপর আমাদের এই বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরি করতে করতে ৯০ দিন (ইদ্দত) পুর্ন হবে।
যেই কথা সেই কাজ,, গতকাল জমি রেজিস্ট্রি হয়েছে আর আজ আমাকে কাজির কাছে এনেছেন তালাক করাতে। স্বামী স্ত্রী নামক সম্পর্ক টা আমার আর সুজনের আদৌও ছিলো না। কিন্তু তারপরও কেন আমার এতো কষ্ট হচ্ছে তালাক দিতে। কান্না গুলো জমা হয়ে গলার মাঝে আটকে থেকে ব্যাথা দিচ্ছে। কোন রকম চোখের পানি সামলে কাগজে সই করে বেরিয়ে আসি। বাড়ির কাজ সম্পুর্ন করতে ইট বালি আসতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আজিজ চাচা বাজার করে পাঠিয়ে দেন। গ্রামের মানুষ আমাদের দু চোখের কুটে দেখতে পারে না আর।
আমার নামে গ্রামের মানুষের মুখে মুখে হাজারো নিন্দা কথা। এবার নাকি রাঘব বোয়ালে হাত দিয়েছি,, অনেক আগে থেকেই আমাদের সম্পর্ক ছিলো কিন্তু এতোদিন মানুষ বুঝতে পারেনি এমন নানান রকম নিন্দা কথা। যেসব মানুষ আমাকে এতো দিন কু-নজরে দেখেছিলো তারা এখন উঠে পরে লেগেছে শেষ মুহূর্তে একটু মজা নিতে। বুড়োর চেয়ে বেশি সুখ দিতে পারবে এমন কিছু কিছু খারাপ কথা নির্দ্বিধায় বলে ফেলে।
প্রায় একমাস পরে সুজনের কাছে তালাকনামা পৌঁছায়। সুজন এই তালাক মানতে রাজি না তাই সে আজ আমাদের বাড়িতে এসে ধমকাধমকি শুরু করে।আমি এই তালাক মানি না, আমার বউকে আমি এখনি নিয়ে যাবো এই সেই অমুক তমুক ইত্যাদি। হঠাৎ করে আমাদের বাড়িতে এমন সার্কাস চলা দেখে বিনা পয়সার অনেক দর্শক জমেছে। আমি ঘরের মধ্যে হিমেলকে নিয়ে চুপচাপ বসে আছি। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার উপক্রম কিন্তু সুজনের নাটক শেষ হচ্ছে না। কিছুক্ষন পরে আজিজ চাচা বেশ কিছু লোকজন নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসেন এবং সুজনকে শাসিয়ে তাড়িয়ে দিলেন।
ওইদিনের পরে সুজন আর কখনো ফিরে আসেনি। কিন্তু আজিজ চাচা মাঝে মাঝে আসেন, চুলে এবং দাড়িতে কলপ দিয়ে আসেন। হয়তো অল্পবয়সী মেয়েকে বিয়ে করার আনন্দে উনারও শখ,বয়সকে লুকানোর। মাঝে মাঝে হিমেল কে জিনিসপত্র দেওয়ার অজুহাতে আমার সাথে কথা বলেন আমি কথার ফাঁকে চাচা বললে উনি রেগে যেতেন আর চাচা ডাকতে নিষেধ করতেন।
আজ আজিজের স্বপ্ন পুরোনের দিন,, চুপিচুপি আজ আমাদের বিয়ে সমাপ্ত হলো,, কুঁড়ে ঘরের আসমানী এখন রাজরানী। লোক মুখে শোনা যায়, বয়স্করা নাকি বউকে বেশি আদর করে। হয়তো আমিও এমন সোনায়সোহাগা বউ হবো। এতো দিন পরে হয়তো একটু ভালো পোশাক ভালো খাবার ভালো ঘরবাড়ি পাবো। সারাজীবন দুঃখের মধ্যে থেকে থেকে ভুলেই গেছি সুখ কি, দেখতে কেমন। তা-ই-তো সুখ সন্ধানী জীবন আমার নতুন স্বপ্নের আলপনা আঁকতে শুরু করেছে।
হ্যাঁ অবশেষে বিয়ে হয়ে গেছে এই বুড়ো মানুষের সাথে। উনাকে দেখে আমার গা ঘিনঘিন করছে। এই মানুষ কে কিভাবে নিজের শরীর দেখাবো। স্বামী স্ত্রী মিলনে কি শুধু শরীরের মিলন হয় নাকি মনেরও মিলন হয়। যদি মনের মিলন হয়েই থাকে তাহলে সেই মিলন আমার এই জীবনে আর আসবে না।
#বর্তমান
বাড়ির ভিতর থেকে গেট আটকানো। অনেক বড় দালান বাড়ি। অনেক ডাকাডাকির পরে প্রায় আমার সমবয়সী একটা মেয়ে গেইট খুলে দিলো। মনে হয় এটা ছেলের বউ। মেয়েটা গেইট খুলেই চলে গেছে আর উনার ছেলে কি কি সব কথা বলে গালাগালি করা শুরু করেছে। বাপ ছেলের ঝগড়া দেখে বুঝতে পারলাম সুখ কেমন তা কখনো দেখতেই পাবো না। ঘরে এসে দেখি ঘরে কোন জিনিসপত্র নেই। একটা পুরনো চৌকি তাতে দুটো বালিশ আর একটা আধাপুরনো কাঁথা। এমন বড় বাড়িতে ঘরের জিনিসপত্র দেখে অবাক হলাম। এই ঘর আর সুজনের ঘর প্রায় একই ছিলো শুধু এটা পাকা বাড়ি। আজিজ হয়তো বুঝতে পারছে আমি কি ভাবছি তাই সে বলেন, আরিফ (আজিজের ছেলে) ওর মাকে খুব ভালোবাসে তাই ওর মায়ের ব্যাবহার করা জিনিসপত্র নিয়ে গেছে।
আবারও বুঝলাম কি সহ্য করতে হবে আমাকে। ছেলে মেয়েরা নানান রকম ভাবে বাঁধা সৃষ্টি করেছে বিয়ে আটকাতে কিন্তু কোন ভাবে সফল হয় নি।তারা ভাবছে আমার পাল্লায় পড়ে ওদের বাবা খারাপ হয়ে গেছে তাই সব দোষ আমাকে দিচ্ছে। আজিজের চাহনি, খুসখুস করে নড়াচড়া দেখে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। এমন সময় একটা পিল এনে খেতে বলে আমাকে। আমি তো অবাকের শীর্ষস্থানে পৌঁছে গেলাম। উনার কি একটুও লজ্জা করছে না, মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে এইসব করার কথা ভেবে। ছেলে মানুষ হয়তো এমনই হয়। যায়হোক আমি উনাকে বললাম এইসব খেতে হবে না। কিন্তু উনি কোন রিক্স নিতে চান না। উনার ছেলে মেয়েরা নাকি শর্ত দিয়েছেন বাচ্চা আর ওদের মায়ের কোন জিনিস আমার নেওয়া যাবে না।
বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তখন জোর খাটিয়ে দূরে থাকা সম্ভব না। সম্পুর্ণ একতরফা ভাবেই আজিজ তার চাহিদা পুরোন করে নিলো। আজিজ ঘুমিয়েছে কিন্তু ঘুম নাই আমার চোখে। পুরো জীবনের হিসাব কষতে বসেছি। একদিন দুইদিন নয় বাকিটা জীবন কি আমি এইভাবে থাকতে পারবো।
হিমেল হয়তো অনেক কান্না করছে। আল্লাহ গরীবদের জীবন কে এতো দূর্বিষহ করেন কেন। কোন রকম জেগে জেগে রাত পার করলাম। খুব ভোরে পবিত্র হয়ে আজিজ নামাজ পড়তে মসজিদে যায় এবং আমাকেও পড়তে বলেন।
সকাল হতে না হতেই আজিজের মেয়ে দরজায় তালা দিয়ে দেয়। ওইটা ওর মায়ের ঘর তাই ওই ঘরে আমার মতো মেয়েকে ঢুকতে দিবে না। মেয়েটার মুখের ভাষা এতো খারাপ, যা মুখে আসে তাই বলে দিচ্ছে। এমন সময় আজিজ বাড়িতে আসে আর মেয়েকে থাপ্পড় মারে সাথে সাথে মেয়েটার হাতের কাছে থাকা কাচের জগ আমার দিকে ছুড়ে মারে আর আমার কপালে লেগে অনেক খানি যায়গা কেটে গড়গড়িয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে।
স্পষ্ট বুঝতে পারছি ছেলে মেয়ের অমতে আমাকে বিয়ে করেছে আর আমি শুধু শুধু নিজের সন্তান এবং বাবা মায়ের কথা ভেবে আবারও আগুনে ঝাপ দিলাম। আমি হাত দিয়ে কপাল শক্ত করে চেপে ধরে আছি আর অন্য দিকে আজিজের ছেলে মেয়েরা আমাকে তালাক দেওয়ার জন্য ঝগড়া করে চলেছে।
চলবে,,
আগামী পর্বে গল্পের নতুন মোড় আসবে,,
#সুখ_সন্ধানী
পর্ব ৭
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
আমি রক্তাক্ত কপাল চেপে ধরে দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে বসে পড়ি। আমার দিকে নজর দেওয়ার কেউ নাই। যদিও আজিজ ছেলে মেয়ের সাথে প্রচুর ঝগড়া করছে কিন্তু আমার কাছে এইসব অসহ্যকর মনে হচ্ছে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে আজিজ রেগে গিয়ে বলে,, আসমানীর সাথে কেউ কখনো খারাপ আচরণ করলে আমার অবশিষ্ট যায়গা জমি যা আছে সব ওর নামে লিখে দিবো। আজিজের এমন কথা শুনে আমি হতবাক!! এমনিতেই ছেলে মেয়েরা আমাকে লোভী মনে করে তারউপর এমন কথা শুনে তাদের বিশ্বাস আরো পাকাপোক্ত হলো।
আমার মাথার রক্ত গুলো পরিষ্কার করে দেওয়ার পরে আমাকে রান্না ঘরে নিয়ে আসা হয়। রান্না ঘরের আসবাবপত্র গুলোর নাম জানা তো দূরের কথা আমি জীবনেও দেখিনি। উনি আমাকে যা ইচ্ছে রান্না করতে বলে বাইরে চলে যান এবং উনার ছেলের বউকে ডেকে আমাকে সাহায্য করতে বলেন। কাল থেকে তো কিছুই খায় নি তাই খিদেও পেয়েছে প্রচুর তাই আমি রান্নার কাজে মনোযোগ দিলাম।
উনার সম্পত্তির উপর কোন লোভ নেই আমার। আমি যখনই বাইরে কোথাও কাজে বা অন্য কারনে যেতাম তখনই কারো না কারো লালসার দৃষ্টিতে পড়তাম। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম উনার বাড়িতে স্ত্রী রুপে কাজের মেয়ে হয়ে থাকতে। দশ জনের দৃষ্টিতে না পরে অন্তত একজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছি। গরীবের ঘরের মেয়েদের কারো ঘরের বউ হওয়ার সৌভাগ্য হবে না।
সারাদিন আমার সাথে কেউ কোন কথা বলে নি। উনি বিকালে আমার জন্য কিছু নতুন জামাকাপড় সহ বিছানার জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসেন। উপযুক্ত ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ের সামনে উনার এইসব আদিখ্যেতা আমাকে সত্যিই লজ্জায় ফেলছে। রাতে উনার সাথে বেশ কিছুক্ষন কথা হলো আমার। উনি বলেন,, আমার চেয়ে অনেক বয়সী মানুষের বউ বাচ্চা না। প্রতিটি মানুষের শারীরিক চাহিদা থাকে। আমি তাদের থেকে ব্যাতিক্রম নই। কিন্তু এই বয়সে নতুন করে সংসার করার কথা বললে লোকে খারাপ ভাবে, ছেলে মেয়েরাও খারাপ মনে করে। কিন্তু তারা বুঝেনা দিন শেষে কথা বলার জন্য বৃদ্ধকালেও একজন জীবন সঙ্গী সবার প্রয়োজন আছে। বর্তমান সামাজিক এবং মানুষিক দৃষ্টিভঙ্গি গুলো এমন হয়েছে যে, ছেলে মেয়ে বড় হওয়ার পরে কারো স্বামী/স্ত্রী মারা গেলে ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও কেউ তাদের চাহিদা গুলো পুরোণ করতে পারে না। কিন্তু শেষ বয়সে এই একাকীত্বটা কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা শুধু ভুক্তভোগীরাই বুঝে।
উনার বলা প্রতিটি কথার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। সত্যিই তো, স্বামী অসুস্থ হলে একজন স্ত্রী যে সেবা দিতে পারবে সেই সেবা কি মেয়ে বা ছেলের বউ দিতে পারবে। আমরা শুধু উপরের বিষয় গুলো নিয়ে একটা মানুষ সম্পর্কে বিভিন্ন মন্তব্য করি কিন্তু তার গভীরতা কখনো বুঝার চেষ্টা করিনা।
আমার রান্না করা কোন খাবার শুধু মাত্র আজিজ ছাড়া এই পরিবারের অন্য কেউ খায় না। তাই একরকম আলাদা সংসারের মতো চালচলন। আগে আমি রান্না করে চলে আসি তারপর ওরা করে। এভাবেই চলছে কয়েকদিন। আজ দুপুরের আগে উনি কয়েক সেট জামাকাপড় হিমেল জন্য কিনে আনেন। আমাকে দিয়ে বলেন, আমি যেন বিকালে হিমেলকে দেখতে যায়। এই বাড়িতে রান্না করার পরে আর তেমন কোন কাজ করতে হয় না আমাকে। সারাদিন চুপিচুপি হিমেল আর মা বাবার জন্য কান্না করি। লজ্জায় কিছু বলতেও পারি না। ইচ্ছে ছিলো হয়তো কখনো হিমেল কে এখানে নিয়ে আসার কথা বলবো কিন্তু এই পরিবারের অবস্থা দেখে সেই ইচ্ছে কে করব দিয়েছি।
বিকালে নতুন নতুন পোশাক পড়ে বাবার বাড়িতে আসার জন্য রেডি হলাম। এমন সময় তুলি (আজিজের মেয়ে) এসে হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে দেখতে লাগে ওদের বাড়ি থেকে কি কি নিয়ে যাচ্ছি। তারপর হিমেলের জামাকাপড় দেখে বলে,, জারজ বাচ্চার দ্বায়িত্ব আমার বাবার ঘাড়ে দেওয়ার জন্য দেহ বিক্রির ব্যাবসা ছেড়ে রাজ প্রাসাদের দিকে নজর দিয়েছিস। আমার বাবাকে আলাভোলা মানুষ পেয়ে নিজের ইচ্ছে মতো নাচাতে তোর লজ্জা করে না। তোর ওই নোংরা শরীরে কতশত মানুষের স্পর্শ আছে তা জানি না কিন্তু এই শরীর বাপের বয়সী মানুষের কাছে দেখতে তোর সামান্যও লজ্জা করে না??
তুলির কথার জবাব দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তার যায়গাতে আমি হলেও হয়তো এমন কথা বলতাম। গরীবের লজ্জা থাকতে নেই তাই আমি আবারও ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হতেই উনি বাড়িতে আসেন। তারপর আমার হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলে যাওয়ার সময় যেন কিছু কিনে নিয়ে যায়। এক সাথে এতো টাকা দিয়ে জিনিস আমি জীবনেও কিনি নাই। আমি নিতে না চাইলেও উনি জোর করে আমাকে টাকা দেন।
আজ কয়েকদিন পরে আমার নাড়ি কাটা ধনকে দেখলাম। আদরে আদরে বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। আমার চেয়ে আমার সন্তানের জীবন আরো কষ্টকর। আমি নিজ হাতে ওর জীবন এমন করেছি। যদি গর্ভে থাকা অবস্থায় নষ্ট করার বৃথা চেষ্টা না করতাম তাহলে হয়তো সুস্থ সবল ভাবে জন্ম নিতো। এই কথা গুলো আমাকে গুমরে গুমরে কষ্ট দেয়।
বাড়ির রুপ পালটে গেছে। নতুন ঘরে হিমেলকে সাথে নিয়ে মা বাবা ঘুমায়।অন্য বাচ্চারা ৭/৮ মাস হতে না হতেই বিভিন্ন রকম বুলি ফোটে কিন্তু আমার হিমেল এখনো কিছুই বলতে পারে না। জানি হয়তো ছেলেটার মুখে মা ডাক কখনো শুনতে পাবো না। এ বাড়িতে রাত থেকে পরের দিন দুপুরের আগে বাড়িতে চলে আসি। বিকালে খুব বেশি মনে হচ্ছিলো হিমেলর কথা গুলো। ঘরে বসে একা একা বেশ কিছুক্ষণ কান্না করলাম। আজিজের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে দেখে তারাতাড়ি নিজের চোখের পানি মুছে চোখ মুখে পানির ছিটা দিলাম।
উনি উনার মেয়ের জন্য কিছু পোশাক কিনে এনেছেন,, আমাকে বিয়ে করার পরে এখন পর্যন্ত মেয়েটা উনাকে ডাকে নি বা কোন রকম কথা বলে নি। তুলির ঘরের সামনে গিয়ে তুলিকে বারবার ডাকছে, তুলি কোন রকম জবাব না দিয়ে বাইরে এসে বলে,, কি হয়েছে কেন ডাকছেন?
আমি দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছি শুধু। উনি জামাকাপড়ের ব্যাগ গুলো তুলিকে দিতেই তুলি ওইগুলো ফেলিয়ে দিয়ে জোরে জোরে বলতে থাকে,, আমার জন্য এইসবের কি দরকার ছিল। ওই বে** আর ওর জারজ বাচ্চার জন্য বেশি বেশি কিনে দেন। বুড়াতি বয়সে রঙ লেগেছে আপনার শরীরে, চোখের সামনে আপনাদের এমন রঙ ঢং দেখার জন্য এই বাড়িতে আছি আমরা। নায়ক নায়িকারা প্রতিদিন সিনেমা করে বাড়িতে আর আমরা সেই সিনেমা দেখার দর্শক মাত্র।
তুলি দরজাটা আটকে আবারও ঘরে চলে গেছে। উনি ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। পাশের ঘরের বাইরে উনার ছেলের বউ ও ছিলেন। উনি হয়তো প্রচুর লজ্জা পেয়েছেন এই মুহুর্তে। কোন রকম সে বাইরে চলে যায়। রাত অনেক হয়েছে অথচ উনি এখনো ফিরেন নি। প্রচুর উৎকণ্ঠা অবস্থায় অপেক্ষা করছি। অবশেষে উনি ফিরলেন। আমি খাওয়ার দিতে চাইলে উনি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন বলে চুপচাপ সুয়ে পড়েন। আল্লাহর প্রদত্ত সম্পর্কে জড়ানোর পরে এমনই আলাদা মায়ার বাধনে আবদ্ধ হয়ে যায় পরস্পরে।ঠিক তেমনই মায়া সৃষ্টি হয়েছে আমাদের মাঝে। তবে এই মুহূর্তে উনাকে শান্তনা দেওয়ার মতো কোন ভাষা জানা নেই আমার। তাই আমি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ সুয়ে পড়লাম।
গত দুই দিন থেকে আরিফের আচরণ কেমন যেন লাগছে। গোসলের পরে ভেজা জামা কাপড় শুকাতে দিলে সেগুলোর দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে। আমি বুঝতে পারি আমাকে সে ভালো নজরে দেখে না। আজ গোসল করার সময় হঠাৎ করে গোসলখানার উপরের ছিদ্রের দিকে নজর পড়ে। সাথে সাথে দুটো চোখ ছিদ্র থেকে দূরে সরে যায়। ভয়ে হাত পা জমে গেলো। জানি এটা আরিফ কিন্তু এই কথা কাউকে বলা যাবে না । কারণ এমনই আমাকে নিয়ে সব সময় ঝামেলা বেঁধেই আছে নতুন করে লঙ্কাকাণ্ড বাধাতে ভয় পাচ্ছি। কোন রকম গোসল শেষ করে বাইরে এলাম। আশেপাশে আরিফ কে কোথাও দেখলাম না। বারবার ওই মুহূর্তটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
আমি আমার মতো করে চলাফেরা করতে থাকি। নিজেকে সব সময় আরিফের থেকে দূরে দূরে রাখতাম।আজ সকালে আজিজ মাছের ট্রাকের সাথে ঢাকায় যায়, মাঝখানে একদিন পরে ফিরার কথা। বিকালে দেখলাম আরিফের বউকে কোথায় যেন যেতে।হয়তো বাবার বাড়িতে যাচ্ছে। কেমন একটা ভয় আমাকে জেপেধরে। রাতে আমি দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে সুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পরেই অনুভব করি কেউ আমার স্পর্শকাতার যায়গাতে হাত দিয়েছে। তৎক্ষনাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার মুখ চেপে ধরে জোরজবরদস্তি শুরু করে। নিজেকে রক্ষা করতে আমি হিংস্র বাঘীনির মতো রেগে যায়। সুযোগ বুঝে আরিফের শরীরের সব চেয়ে দুর্বল যায়গা তে স্ব জোরে লাথি মারি।সাথে সাথে আরিফ ককিয়ে উঠে বিছানা ছেড়ে নিচে পরে যায়। আমি হাতের কাছে একটা ফুলদানি পাই আর সেটা দিয়ে আরিফের উদ্দেশ্যে আঘাত করি। যেহেতু ঘর অন্ধকার তাই বুঝতে পারিনি কোথায় লেগেছে। সে আবারও আমার কাছে আসার চেষ্টা করে তখন হঠাৎ করে মনে হলো বিছানার নিয়ে আজিজের একটা বড় রামদা আছে। এই মুহূর্তে আমি হাতাহাতি জ্ঞানশুন্য, ভালো মন্ধ বোঝার অবস্থায় নেই।
দা হাতে নিয়ে সরাসরি,,,,,,,
চলবে,,,