#সুখ_সন্ধানী
পর্ব ৯
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno
সব কিছু গোছানো শেষে আমরা সবাই রওনা দিলাম অজানার পথে। জীবনে কখনো একা একা এতো দূরে যায় নি। আল্লাহর নাম মুখে নিয়ে সুখ সন্ধানী পাঁচটি জীবনের পথ চলা শুরু। গঞ্জের বাস স্ট্যান্ডে এসে ঢাকার বাসে উঠলাম। মামা বাড়ি থেকে মা ঠিকানা লেখা একটা কাগজ এনেছিলো। আমার ব্যাগে রাখলাম কাগজ টা। মা রাতুল ও কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে নিয়ে পাশাপাশি সিটে বসেছে আর আমি মুকুল আর হিমেল কে নিয়ে বসেছি। এর আগে কখনো আমার কেউ বাসে উঠিনি। তাই সবার কেমন বমি বমি ভাব হচ্ছে মা তো অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাসের যাত্রীদের মধ্যে থেকে একজন স্ব-হৃদয়বান ব্যাক্তি আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। উনি মাকে দেখাশোনা সেবাযত্ন করতে শুরু করেন।
পানি দিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে দিলেন। রাতুল কেও আগলে রেখেছেন। কতদিন পরে কেউ একজন এমন ভাবে আমাদের বিপদে পাশে দাঁড়ালেন তা ভুলেই গেছি। অনেক ক্লান্ত শরীর নিয়ে মা হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। একটু পরপরই বাসে যাত্রী উঠানামা করছে। প্রায় রাত ১০ টার দিকে বাসা ঢাকায় এসে থামে। আমাদের সব জিনিসপত্র বাস থেকে নামিয়ে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় বাসে সাহায্য করা ভাইটি আমাদের কে বলেন,, মনে হচ্ছে আজ সারাদিন আপনারা কেউ কিছু খান নি। চাচি তো সারা রাস্তায় বমন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আর কোলের বাচ্চার কি হাল হয়েছে। এই দুটোরও তো দেখি চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। চলো তোমাদের কিছু কিনে দিই।
উনি রাতুল মুকুল এর হাত ধরে নিয়ে যেতে থাকেন আমি বারবার নিষেধ করলাম কিন্তু উনি শুনলেন না। এখনো দুনিয়ায় দুই একজন ভালো মানুষ আছে বলে দুনিয়া টিকে আছে। এমন ভালো মানুষকে আল্লাহ দীর্ঘায়ু দান করুন। এসব কথা ভাবছিলাম তখনই দেখি উনি আমাদের জন্য ও কিছু খাবার কিনে এনেছে। খুব লজ্জা লাগছে এমন অপরিচিত কেউ আমাদের জন্য এতো কিছু করছে দেখে। সত্যি বলতে খুব খিদে পেয়েছে আমারও নিশ্চয়ই মায়েরও এমন খিদে পেয়েছে তাই অনিচ্ছা স্বত্বেও মাকে আগে খাইয়ে দিয়ে আমিও খেলাম। দীর্ঘ সময় ধরে গাড়িতে থাকার জন্য এবং সেই ভোর থেকে না খেয়ে থাকার জন্য পেটে সামান্য খাবার যাওয়ার সাথে সাথে পরম শান্তির ঘুম চোখে চলে এলো। চাইলেও কোন ভাবে ঘুমকে আটকাতে পারলাম না। পরম আবেশে দু চোখ আপনা আপনি বুজে গেছে।
যখন চোখ খুললো তখন তপ্ত দুপুরের কড়া রোদের প্রখরতা টের পেলাম। হালকা আবছা আলো চোখে পড়তেই আবারও বন্ধ করে নিলাম। চারিদিকে অনেক লোকের ভীড় জমেছে মনে হচ্ছে। আবারও আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখি আমি রাস্তার ধারে নোংরা আবর্জনার স্তূপে পড়ে আছি। এটা কোথায়, কিভাবে এখানে আসছি কিছুই জানি না। তারাতাড়ি উঠে বসে আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করি মা ভাই ছেলের কথা। কিন্তু কেউ কোন উত্তর দিলো না। আশেপাশের চারিদিকে ছুটাছুটি আরম্ভ করি,, চিৎকার করে একেকবার একেকজন কে ডাকছি,, কখনো রাতুল মুকুল কখনো হিমেল বা মাকে। নাহ্ কোথাও কেউ নাই। যারা আছে তারা সবাই আমার কান্ডুকলাপ দেখছে শুধু।
একে একে অনেক কিছু হারিয়েছি। কিন্তু এবার এক সাথে সবাইকে হারালাম। আমার বুকের মানিক অবুঝ প্রতিবন্ধী সন্তানের কি অবস্থা তাও জানি না। আল্লাহ তুমি কেন এমন করলে আমাদের সাথে। কেন আমি এই রঙিন বাতির শহরে আসতে চাইলাম। আমার অসুস্থ মা ছোট ছোট দুই ভাই আমাকে ভরসা করে এসেছিলো। জানিনা তারা কোথায় কিভাবে আছে এখন।
রাস্তার ধারে বসে কান্না করতে করতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। এতো কষ্টের মধ্যেও পেটে খিদার অনুভব হচ্ছে। এই খিদা আমার জীবনে কাল হয়েছে। যদি না খেয়ে থাকতাম তবুও সবাই কে নিয়ে এক সাথে থাকতাম। এলোমেলো আর নোংরা জামাকাপড়ে রাস্তার পাশে বসে কান্না করা দেখে কিছু পথচারীরা দুই চার টাকা করে সামনে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম তারা আমাকে ভিক্ষুক ভেবে টাকা দিচ্ছে। আমার কাছে এক পয়সা ও নাই। শুধু মাত্র পেটের তাগিদে মানুষ পারে না এমন কোন কাজ নেই।
সেখানেই পরে রইলাম রাত পর্যন্ত। আর না খেয়ে থাকা সম্ভব না। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। সামনের টাকা গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে একটু দুরের দোকানে গিয়ে একটা পাউরুটি আর পানি নিলাম। খাবার গলার নিচে নামে না,, বারবার হিমেলের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
এতো রাতে একা মেয়ে মানুষ কোথায় যাবো কি করবো বুঝতে পারছি না। একটা বড় দোকানের বারান্দার এক পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। এমন সময় দুজন লোক এসে বলে,, কি রে যাবি??
আমি বললাম,,, কই যাবো?
যেখানে যাওয়ার জন্য বসে আছিস। আমরা দুজন আছি। কত নিবি বল?
এখন বুঝতে পারছি উনারা কি বলতে চাইছেন। আমি শুধু বললাম, ভাই আমি খারাপ মেয়ে না। আমার ছোট দুই ভাই মা আমার ছেলেকে আজ হারিয়ে ফেলেছি। এমন কষ্টের সময় দয়া করে আবারও নতুন কষ্ট দিবেন না। আল্লাহর দোহাই লাগে আপনাদের,,,,,,,,
উনারা কেমন ভাবে যেন একে অন্যের দিকে তাকাতাকি করে চলে গেলো। রাত গভীর থেকে গভীরোতর হলো। তেমন কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। আমি সামান্য কাৎ হয়ে দেয়ালে হেলান সুয়ে পড়লাম। চোখ দুটো একটু লেগে আসতেই অতর্কিত ভাবে কয়েকজন লোক আমাকে ঘিরে ধরে আর সাথে সাথে মুখ চেপে ধরে। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি ছোটার জন্য কিন্তু একা একটা মেয়ে মানুষের পক্ষে এতো গুলো পুরুষ মানুষের সাথে পেরে ওঠা অসম্ভব। নিমিষের মধ্যে উনারা আমাকে একটা নির্জন কোথাও নিয়ে গেলেন।
হয়তো আজই আমার জীবনের শেষ,, আর কখনো এই পৃথীবির সুর্য্য উঠা দেখা হবে না। এতো কিছু হারানোর পরেও নিজের জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠি। কাকুতি মিনতি করে সবার হাতে পায়ে ধরছি আমাকে ছাড়ার জন্য। কিন্তু সবাই ক্ষুধার্ত বাঘ। আমার কাকুতি তাদের কান পর্যন্ত যাচ্ছে না। ছিড়েখুঁড়ে খাচ্ছে সব হায়েনার দলেরা। কষ্টে যন্ত্রণায় শরীরের প্রতিটি অঙ্গ পতঙ্গ জর্জরিত। একেকজন কে মনে হচ্ছে স্বয়ং আজরাইল আমার জান কবজ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
একের পরে এক মানুষ রুপি জানোয়ারদের পৈশাচিক চাহিদা পুরণ করার পরে আমার ছিন্নভিন্ন দেহ ফেলে রেখে চলে গেছে। উঠে বসার শক্তি টুকু নেই আমার মাঝে। তৃষ্ণায় ক্লান্তিতে চোখ মুখ বুক ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করলে আর কখনো খুলতে পারবো না।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে পাশেই কোথাও মানুষের কথার শব্দ কানে আসে। আবছা অন্ধকারে নিজেকে নগ্ন অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। পাশেই এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো জামা কাপড় গুলো কুড়িয়ে নিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলাম। ব্যাথায় হাটা চলা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কোন রকম পাকিয়ে পাকিয়ে পাশেই রাস্তার উপর উঠলাম। ইচ্ছে আজও যদি কেউ কিছু ভিক্ষা দেয় তাহলে অন্তত ওই টাকা দিয়ে পেট পুরে কিছু খাবো।
কিন্তু এই রাস্তায় মানুষের চলাচল খুবই কম। অনেক কষ্টে সামনের দিকে এগোতে থাকলাম। বড় রাস্তার পাশে বসে আছি। ঘন্টা খানিক পরে সামান্য কয়েকটা টাকা নিয়ে একটা দোকান থেকে খাবার কিনে খেলাম। ক্ষুধার যন্ত্রণার মতো করুন যন্ত্রণা আর নেই।
কোন কাজ তো অন্তত করতে হবে আমাকে। কিন্তু তার আগে নিজেকে সুস্থ করতে হবে। সুস্থ শরীর ছাড়া কেউ কোন কাজ করতে দিবে না। তাই আপাতত রাতের খাবারের জোগাড় করতে আবারও ভিক্ষা করতে শুরু করি। সারাদিন ধরে ভিক্ষা করে বেশ কিছু টাকা হয়েছে। রাতে যে দোকানে খেতে গেলাম সেখানকার একজন কে বললাম,, ভাই আপনার দোকানে রান্নার কাজের জন্য আমাকে নিবেন? আমি গ্রামে অনেক রান্না করতাম। আমার রান্না টা খুব খারাপ না। আমি সারাদিন আপনার দোকানে কাজ করবো বিনিময়ে আমাকে খেতে দিবেন শুধু!!
উনি সাথে সাথে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন আর বলেন,, চোরচামারে দেশ ভরে গেছে। চুরি করার জন্য নতুন ফন্দি বের করেছে। মনে হচ্ছে আমি বুঝিনি তোর মতলব কি??আজ কাজ দিবো আর কাল দোকান ফাঁকা করে পালাবি। সোজা পুলিশের কাছে দেওয়া উচিত এইসব চোরদের।
হয়তো ঢাকা শহরে ভালো মানুষের চেয়ে খারাপ মানুষের সংখ্যা বেশি তাই এমন ব্যবহার করলেন আমার সাথে। আমাকে চোর ভেবে এভাবে তারিয়ে দিলেন। এই দুই দিনে আমি নিজেই তো দেখলাম ঢাকা শহরের মানুষের আসল পরিচয়। কোন রকম সেখান থেকে একটু দূরে সরে আসি। কিন্তু গত রাতের কথা মনে হতেই ভয়ে পিলেই চমকে যাচ্ছে। আজ কোথায় কিভাবে রাত কাটাবো। কার কাছে সাহায্য চাইবো। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে সামনে এগোচ্ছি।এমন সময় দেখি একজন মানুষ টুপি পড়ে কোথাও যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে সামনে কোথাও মসজিদ আছে।
হ্যাঁ হয়তো মসজিদের আশেপাশে একটু নিরাপদ স্থান পাবো, এই আশায় আমিও উনার পিছনে পিছনে হাঁটা শুরু করি। একটু দূরে গিয়ে মোড় পার করে একটা বড় ঝলমলে মসজিদ দেখলাম। এতো বড় আর সুন্দর মসজিদ আগে কখনো দেখিনি। দলে দলে মানুষ এসে অজু করে নামাজের জন্য ভিতরে যাচ্ছে। মসজিদের এক কোনে কেমন যেন ঘেড়ানো একটা যায়গা দেখতে পেলাম। আজ রাতের জন্য এর চেয়ে নিরাপদ স্থান আর নেই। ভিতর থেকে নামাজের শব্দ শোনা যাচ্ছে,, তেলাওয়াত শোনা যাচ্ছে। উনাদের মোনাজাতের সাথে সাথে আমি ও আমার জীবনের অভিযোগ গুলো আল্লাহর দরবারে তুলে ধরি,,
নামাজ শেষে সবাই চলে গেছেন,, নির্জন স্তব্ধ নিরাপদ যায়গাতে আজ একটু ঘুমাতে হবে। আগামী কাল কি হবে সেই চিন্তা মাথা থেকে বের করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। সারারাত কিভাবে পার হলো বুঝতেও পারি নি। মাইকে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রতিদিন এখানে ঘুমাবো। আল্লাহর ঘরের সাথে ঘুমাতে খুব ভালো লাগছে আজ।
বেশ কয়েকদিন ধরে এই নোংরা অপবিত্র জামাকাপড় আর দেহ নিয়ে ঘুরছি। একটা পড়ার মতো জামাকাপড়ের খুব দরকার। উদ্দেশ্যে সেই ভিক্ষা। আবারও শুরু করলাম,,,, দুপুরের আগে রাস্তার পাশে পুরাতন কাপড় বিক্রেতার থেকে একটা সালোয়ার কামিজ নিলাম। যেভাবেই হোক নিজেকে পবিত্র করতে হবে তাই কোথাও পুকুর বা টিউবওয়েল আছে নাকি জিজ্ঞেস করতে থাকি সবাই কে। অবশেষে একটা নর্দমার মতো কোন পুকুরের পানিতে নিজেকে পবিত্র করার বৃথা চেষ্টা করলাম।
দুইদিন থেকে রাতে মসজিদের ওই কোণাতেই ঘুমায় আর খুব ভোরে চলে যায়। আজও সন্ধ্যার পরে সেই নির্দিষ্ট স্থানে আসার সময় বেশ মোটা এবং ফর্সা মাঝবয়েসী মহিলার সাথে দেখা হয়। উনি আমাকে বললেন,,,,,,,,,,
চলবে,,,,,