সুখ_সন্ধানী Part 2

0
898

#সুখ_সন্ধানী
Part 2
Writer #Fabiha_Busra_Borno

তখন উনারা কথায় কথায় সুজনের সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। এই প্রথম বাড়ি পর্যন্ত কোন বিয়ের প্রস্তাব এলো। সুজন ছেলে টা অতটাও খারাপ না। কিন্তু আমার বাবা বলেন,, আমরা গরীব মানুষ বলে কি এমন অজানা অচেনা কোন ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিবো? যদি আমার মেয়েকে পছন্দ হয় তাহলে ওই ছেলের বাপ মা কে আসতে বলেন। সকলের কথা বার্তায় রাজি হলে বিয়ে দিবো।

ওই রাতের পরে থেকে আমি আর কখনো সুজনের দিকে লজ্জায় তাকাই নি পর্যন্ত। দুইদিন পরে সুজন নাকি বাড়িতে গেছে ওর বাপ মা কে আনার জন্য। আমাদের বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা শুরু করে দিয়েছে মা পুরাতন বিছানার চাদর,বালিশের কভার সহ সব কিছু কেচেকুচে পরিষ্কার করার যুদ্ধ চালাচ্ছে ।পাশের বাড়ি থেকে কাঠের চেয়ার, দুটো কাচের থালা গ্লাসও নিয়ে আসছে। দুপুরে খেতে এসে সুজনের দলের লোকজন বলে গেছে সুজন ওর বাপ মা কে নিয়ে এসেছে। বিকালে আমাদের বাড়িতে আসবে তাই আমাদের এতো আয়োজন।

প্রতিদিন দুশো টা মজুরিতে কাজ করে সুজন। বাবা মা আর এক বড় ভাই আছে। যায়গা জমি কিছু নাই শুধু দুটো খুপরি ঘর আছে। ছেলে কাজ করে বউয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারবে অনায়াসে। এইসব কথা বলে রাস্তার ম্যানেজার বাবাকে বোঝাচ্ছিলেন। গ্রামের দুই একজন যারা এসেছিলেন তারাও বিয়ে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। সবার সম্মতিতে রাতে বিয়ের আয়োজন করা হয়। যেহেতু আমাদের বাড়িতে সব সময় অভাব অনাটন লেগেই থাকে তাই পাড়া প্রতিবেশীরা যে যার মতো দুই এক কেজি করে চাল এবং ময়-মসলা নিয়ে এসে হাতাহাতি করে রান্না এবং অন্যান্য কাজ করতে শুরু করে।

আজিজ চাচার আগে থেকেই অনুমতি ছিলো আমাদের ইচ্ছে-স্বাধীন ভাবে উনার দিঘির মাছ ধরতে পারবো। তাই দিঘি থেকে বড় বড় মাছ ধরা হয়েছে। বাড়িতে মুরগী ছিলো সেগুলো জবাই দেওয়া হয়েছে। এতো অল্প সময়ের মধ্যে বাড়ির পরিবেশ পাল্টে গেছে। সবাই কত আনন্দ করছে, আমি চুপচাপ ঘরের মধ্যে বসে আছি। রাতে বিয়ে পড়ানো হয় আমাদের। তারপর আমি সুজন আর শশুর শাশুড়ী বাড়িতে চলে যায়। যেহেতু নিজের বাপের বাড়ি বলে কিছু নাই তাই বরের ঘর বাড়ি নিয়ে তেমন মাথা ঘামালাম না। আঁখের পাতা আর পাঠকাঠি মিশানো পাতলা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরের সব কিছু দেখা যায়। ঘরে একটা বাঁশের মাচাং পাতা,, আধা-পুরাতন কাঁথার উপর ময়লা কাভার ছাড়া দুটো বালিশ। একটু নড়াচড়া করলেই মাচাংয়ের কেমন ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ শব্দ হচ্ছে। ঘরের এক কোণায় কয়েকটি হাড়িপাতিল।

শশুর শাশুড়ী পাশের ঘরে কি বলে না বলে সব কিছু আমি শুনতে পাচ্ছি এমনকি তাদের হাটাচলার শব্দ ও স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তারমানে আমাদের কথা ও উনারা শুনতে পাবেন। একটু পরে সুজন ঘরে ঢুকে দরজা তে যে চাটাই দেওয়া হয় সেই বাঁশের লাঠি দিয়ে আটকয়ে দিলো।জীবনের প্রথম কোন পুরুষ মানুষের সাথে ঘুমাতে হবে। এর আগে অনেকেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আমাকে স্পর্শ করলেও এই প্রথম নিজ ইচ্ছাতে বসে আছি বাসোর ঘর নামে এই খুপরি ঘরে।

সুজন আমার পাশে বসতেই কেমন বিশ্রী গন্ধ লাগছে। কোন রকম কথা ছাড়াই সরাসরি স্বামীর অধিকার আদায়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে। ভিষণ লজ্জা করছে আমার,, পাশের ঘরে শশুর শাশুড়ী আছে তারা হয়তো এই মুহূর্তে কি হচ্ছে সেই শব্দ গুলো শুনতে পাচ্ছে। কি আজব বিষয়, যে ছেলে এতো দিন আমার সাথে তেমন কথাই বলে নি সেই ছেলে আজ কেমন হিংস্র হয়ে গেছে। প্রচুর কষ্টের মধ্যেও টু শব্দ করলাম না আমি। রাতের মধ্যে কয়েকবার সুজন ওর এমন হিংস্র রুপ দেখিয়েছে আমাকে। বিয়ের পরে হয়তো সব পুরুষ মানুষ এমন আচরণ করে ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে গেলাম সব। বাড়িতে কোন কল বা পুকুর নাই, আর সুজন মরার মতো ঘুমিয়ে আছে রোদ বের হয়েছে তাও ঘুম ভাঙার কথা নাই। নাপাক শরীরে থাকতে বেশ উশখুশ লাগছে কিন্তু করার কিছুই নাই।

সকালে শাশুড়ীকে বললাম কি রান্না করবো। তিনি বলেন,, আমি করবো, তোমার কিছু করা লাগবে না সুজন কে ডেকে তুলো। আমি ঘরে গিয়ে অনেক ডাকাডাকির পরে উনি উঠলেন চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। উনি ঘুম থেকে উঠার পড়ে আমাকে নিয়ে, বাড়ি থেকে অনেক দূরে একটা পুকুরে গেলেন। ওখানেই নাকি আমাদের বাড়ির সবাই গোসল করে আর পাশের বাড়ি থেকে পানি এনে রান্নাবান্না ও খাওয়া দাওয়া করে। প্রথম দিন বলে আমাকে পানি আনতে দেওয়া হয় নি। কিন্তু পরের দিন শাশুড়ী সাথে করে নিয়ে গিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন এবং পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওই বাড়িতে দুইদিন ছিলাম কিন্তু সুজনের বড় ভাইয়ের সাথে দেখা হয় নি।

যেহেতু আমাদের এখানে রাস্তার কাজ এখনো শেষ হয় নি তাই আমি আর সুজন এখানে চলে আসি আর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবো। এই দুইদিনে আমি বুঝতে পারছি সুজন প্রতি রাতে নেশা করে। যদিও এখনো সুজনকে আমি এ বিষয়ে কিছু বলিনি তবে বলবো বলে মনে মনে ভাবছি। এখানে আসার পরে সুজনের সাথে থাকার কোন সুযোগ হয় নি। যেখানে আমাদের থাকার যায়গা নাই সেখানে আমাকে আর সুজন কে একটা ঘরে রাখা টা বিলাসিতা ছাড়া অন্য কিছুই না।

রাস্তার লোকজন খেতে এসে যে যার মতো ফাজলামোর স্বরে আমাকে যা ইচ্ছে বলে।
আজ সুজনের সামনে একটা ছেলে বললো,, ভাইয়ের বউ মানে আমাদের অর্ধেক বউ, ভাই না পারলে আমাদের বলো, আমরা বাকি কাজ করে দিবো।

এমন কথা শুনে আমার রাগ হচ্ছে অথচ সুজন ওদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। যেন কিছুই বলে নি তারা।আরেক দিন তো দুইজন মানুষের সামনে সুজন আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমা দিলো। কোন রকম সুজন কে ঠেলে আমি চলে আসছি। হয়তো বিয়ে পরে বউকে চোখের সামনে দেখেও দূরে থাকার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না তাই এমন কিছু করেছে ভেবে নিজের রাগ কে চেপে রাখলাম।

রাস্তার কাজ আর কিছু দিন হলে শেষ হবে কিন্তু সুজন আমাকে নিয়ে ওর বাড়িতে চলে এসেছে। এখানে আসার পরে আরেক ঝামেলা শুরু,, সুজনের বড় ভাইয়ের আগের তিন বউ চলে গেছে। উনার চরিত্রের দোষ আছে। উনার তাকানো দেখে বুঝতে পারি, আমাকে উনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন। প্রায় এক মাস হলো আমাদের বিয়ের কিন্তু এখনো সুজন আমাকে কোন জামাকাপড় দেয় নি। বাপের বাড়ির আধাপুরাতন জামা কাপড় ব্যবহার করি। শশুর ভ্যান গাড়ি চালিয়ে মাঝে মাঝে মাছ তরকারি কিনে। সুজনের যা ইনকাম হয় সব নেশার পিছনে শেষ করে। প্রতিদিন নেশা করে এসে আমার উপরে অত্যাচার চালায়। অনেক বার নেশা ছাড়ার জন্য বুঝিয়েছি কিন্তু তাতে কোন কাজ হয় নি।

যে বাড়িতে পানি নিতে যায় ওই বাড়ির ছেলে কলেজে পড়ে। আমাকে ভাবি ভাবি করে ডাকে। একদিন পানি নিতে গেছি আর অমনি বাড়ির গেট বন্ধ করে দিয়ে আমাকে বলে,আজ বাড়িতে কেউ নাই, ভাবি তোমাকে হেব্বি হট লাগে,, মাঝে মাঝে আমাকে তুমি খুশি করবে তাহলে আমিও তোমাকে খুশি করবো। এইসব বলে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি কলপাড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই তারপর দৌড়ে বাইরে চলে আসি।রাতে মাতাল অবস্থায় সুজন বাড়ি ফিরলে তাকে এইসব কথা বলি। মাতাল অবস্থায় কথা গুলো অর্থ বুঝলো নাকি জানি না তবে কোন কথা বলে নি এই বিষয়ে।

এরপর থেকে মাঝে মাঝে সুজন একে ওকে সাথে নিয়ে বাড়িতে আসে আর আমাকে ওদের সাথে ঘরে বসতে বলে চলে যায়। আমি ও সাথে সাথে শাশুড়ীর ঘরে চলে যেতাম। লোক গুলো ভাবি এটা কই ভাবি ওটা কই বলে আমাকে ডাকতো কিন্তু আমি যেতাম না। কারণ তাদের চাহনি আমার খুব পরিচিত।

মাঝে মাঝে মনে হয় এখান থেকে চলে যায় কিন্তু বাপের অভাবের সংসারে বোঝা হবো ভেবে চুপ থাকি। নিয়তির লেখা মেনে নিতে আরম্ভ করেছি। আজ সকাল হতে না হতেই শাশুড়ী হৈচৈ শুরু করেছেন। তারাহুরো করে বাইরে এসে দেখি মুরগির খোয়ারের দরজার সামনে বসে সুজন কে গালি দিচ্ছে। সুজন নাকি মুরগী বিক্রি করে নেশা করেছে। এর আগেও নাকি হাড়িপাতিল থেকে শুরু করে অনেক কিছু চুরি করে বিক্রি করতো। এতো কিছু শোনার পরে নড়াচড়া করার মতো শক্তি পেলাম না। বাবার বাড়িতে অভাব ছিলো কিন্তু অশান্তি ছিলো না। এ কোন পরিবেশে পড়লাম আমি।

সুজন ঘুম থেকে উঠেই, মুরগী বিক্রি করেনি বলে চিৎকার করে। কিন্তু শশুর শাশুড়ী মানতে নারাজ। এমন ঝগড়া দেখে লোকজন জমে গেলো। তখন একজন লোক বলে সে নাকি দেখেছে সুজন কে মুরগী বিক্রি করতে। সারাদিন ধরে ঝগড়া চললো তারপর আমাদের ভিন্ন করে দেওয়া হলো। একজন নেশাখোর চোরের বউ পরিচয়ে বাঁচতে হবে বাকিটা জীবন।

আমি আশেপাশের বাড়িতে কাজ করে কোনরকম দিন পার করতে থাকি। সুজন একদিন বাজার করলে এক মাস বাজার করে না। বাজার করার কথা বললেই গায়ে হাত তোলে। নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য ঘরের ছোট খাটো জিনিসপত্র চুরি করে বিক্রি করতো। যেহেতু চুরির অভ্যাস আছে তাই আমি কখনো সুজন কে বাপের বাড়িতে নিয়ে আসতাম না। সুজনের এলাকার বাজারে একটা হোটেলে আমার খালু কাজ করতেন।দুইদিন থেকে সুজন বাড়িতে আসেনি। হঠাৎ আজ সকালে খালু আমাদের বাড়িতে এসে বলেন,, সুজন নাকি খালুর দোকানে গিয়ে বলেছে,
‘”আমি আর আসমানী ওর বাপের বাড়ি যাবো কিন্তু ভ্যান পাচ্ছি না যদি আপনার সাইকেল দিতেন তাহলে আসমানীকে রেখে যাওয়ার সময় আপনাকে সাইকেল ফেরত দিয়ে যেতাম””।

খালু সরল মনে সুজনকে সাইকেল দিয়েছেন কিন্তু সুজনের মন ততটাও সরল না তাই সে দুইদিন থেকে গায়েব। খালু গ্রামের প্রামাণিকের কাছে বিচার দেন। বিচারে সুজন কে অনেক মারার পরে স্বীকার করে সাইকেল বিক্রি করে অনেক টাকা ধারদেনা ছিলো সেগুলো শোধ করেছে আর বাকি টাকা দিয়ে নেশা করেছে। খালু নিজেও গরীব মানুষ, বাড়ি থেকে এতো দূরে কাজ করতে আসতে তার অনেক টাকা ভাড়া লাগে তাই সাইকেল নিয়েছিলেন।

আমার খালুর দেওয়া বিচারে সুজনকে মেরেছিলো বলে শাশুড়ী আর আমাকে দেখতে পারে না। কথায় কথায় ঝগড়া করে,, ভালো মন্দ কথা লাগিয়ে সুজন কে দিয়ে মাইর খাইয়ে নেই। আজ দুইদিন ধরে শাশুড়ী তার ভাইয়ের বাড়ি গেছে, সাথে শশুর কেউ নিয়ে গেছেন। এই সুযোগে গভীর রাতে সুজন একজন লোক কে সাথে নিয়ে বাড়িতে ফিরে। তারপর উনাকে ঘরে রেখে টয়লেটে যাওয়ার অজুহাতে বাইরে চলে যায় আর অমনি ওই লোক ঘরের চাটাই আটকে,,,,,

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here